যুদ্ধের মুখোমুখি
আমরা সিদ্ধান্ত নেই, রণকৌশলের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এবং যেসব সীমান্ত ফাঁড়িতে শত্রুর পাহারা একটু কম, সেগুলো দখলের মাধ্যমেই আমাদের অভিযান শুরু হবে। প্রতিটি অভিযান শুরুর পূর্বেই ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী আমাদের সহয়তা করবে। সীমান্তবর্তী এলাকা এবং সীমান্ত ফাঁড়ি দখল পরিকল্পনার পেছনে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল, সেগুলো হচ্ছেঃ
(ক) এইসব সীমান্ত ফাঁড়ি বা সীমান্ত এলাকা দখলের যুদ্ধে আমাদের বাহিনীর দক্ষতাও দুর্বলতা আমরা নিরূপণ করতে পারবে।
(খ) সকলকে বলে দেওয়া হবে এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা বদ্ধপরিকর। এবং আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।এতে করে শত্রুরা গেরিলা বিরোধী তৎপরতা কমিয়ে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থায় আরো বেশী শক্তি নিয়োগ করবে। শত্রুদের এভাবে সীমান্ত এলাকায় ব্যস্ত রাখতে পারলে দেশের অভ্যন্তরভাগে শত্রুর সংখ্যা কমে যাবে, ফলে গেরিলাদের কাজ আরও সহজ হবে।
(গ) এধরণের সংঘর্ষের মাধ্যমেই শত্রুর প্রস্তুতি এবং তার প্রতিরোধ ক্ষমতার মাত্রাও আমরা পরিমাপ করতে পারবো।
সীমান্তরেখা বরাবর আমাদের তৎপরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে পাকিস্তানীরা ঠিকই অভ্যন্তর ভাগের শক্তি কমিয়ে সীমান্তে এনে সৈন্য জড় করতে থাকে। এতে বিভিন্ন স্থানের পরিস্থিতি গেরিলাদের অনুকূল হয়ে উঠে।অবশ্য,এই সঙ্গে কিছু অসুবিধাও দেখা দেয়। সীমান্ত এলাকায় শত্রুর শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলাদের সেই পথ দিয়ে দেশের ভেতরে পাঠানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। ভেতরে প্রবেশের প্রায় সকল পথই শত্রুসৈন্যরা বন্ধ করে দেয়।
২২শে সেপ্টেম্বর চম্পকনগর সীমান্ত ফাঁড়ি এবং প্রধান সড়কের উপর গুরুত্বপূর্ণ বল্লভপুর এলাকা দখল করার জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালাই। আক্রমণের আগে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী লক্ষ্যস্থলের উপর গোলাবর্ষণের মাধ্যমে শত্রুর সুদৃঢ় অবস্থানগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করে।
কিন্ত দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার যুদ্ধের পর আমরা পশ্চাদপসরনে বাধ্য হই। কামানের গোলায় শত্রুর তেমন ক্ষতি হয়নি। পাকিস্তানী বাংকারগুলো ছিল খুব মজবুত। প্রতিটি প্রতিরক্ষা বাংকারেই শত্রুরা ভূগর্ভে কয়েকদিন থাকার মতো রসদপত্র মজুত রেখেছিলো। ঘাঁটিগুলোর মধ্যে ট্রেঞ্চপথে যোগাযোগ ছিল। তাছাড়া আমরা যা অনুমান করছিলাম তার চাইতেও বেশী ছিল তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সম্ভার।
চম্পকনগর সীমান্ত ফাঁড়ি আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো ক্যাপ্টেন মাহফুজকে। ফাঁড়ির ডান পাশ দিয়ে নিজেদের আড়াল করে আমি ওদের অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেই। কিন্ত লক্ষ্যস্থলের চারপাশে কয়েকশ গজ এলাকা গা ঢাকা দেওয়ার মতো তেমন কোন ফসলের ক্ষেত, উঁচু ভূমি অথবা বন-জঙ্গল ছিলোনা। পার্শ্ববর্তী একটি পাহাড় থেকে আমি যুদ্ধ পরিচালনা করছিলাম। ফাঁড়িটি থেকে এর দূরত্ব ছিল আটশ গজের মতো। সেখান আমি থেকে লক্ষস্থলের অনেক কিছুই দেখতে পারছিলাম। অয়ারলেসে মাহফুজ আমার সাথে যোগাযোগ রাখছিল। আমাদের বাহিনী কভার দেওয়ার জন্য কামানসহ ভারতীয় গোলন্দাজবাহিনীর একজন পর্যবেক্ষকও আমার সাথে ছিলেন। আগেই উল্লেখ করেছি, আমাদের সৈন্যদের অগ্রসর হওয়ার আগে কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়।কামানের গোলাবর্ষণ শেষ হলে আমাদের বাহিনী চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। এসময় শত্রুরাও প্রচণ্ড বেগে গুলিবর্ষণ শুরু করে।ফাঁড়ির ডান এবং বাম পার্শ্ব থেকেই একটি করে মেশিনগান আমাদের কোম্পানীকে যথেষ্ট বিপাকে ফেলে দেয়।দুর্ভাগ্যক্রমে মাহফুজের একমাত্র অয়ারলেস সেটটিও বিকল হয়ে পড়ে। একটির বেশী দেবার মত মজুত কোন সেট আমাদের ছিলোনা। অয়ারলেস সেট নষ্ট হতেই মাহফুজ তার প্লাটুনের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে এবং আমারওমাহফুজের মধ্যকার সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।কিছুক্ষণ পরেই শুভপুর সেতুর দিক থেকে পাকিস্তানীদের কামানের গোলা আমাদের উপর এসে পড়তে থাকে।এদিকে কবেরহাট এলাকা থেকে আরও শত্রুসৈন্য দ্রুত চম্পকনগরে এসে পৌঁছায়।
কামানের গোলা, বিশেষ করে এয়ারবাস্ট শেল বিস্ফোরণের ফলে আমাদের কোম্পানীর পক্ষে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছিলনা। পাকিস্তানী মেশিনগানগুলোর অবস্থান জানার জন্য আমি মাহফুজের সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করি।অবস্থান জানতে পারলে ভারতীয় কামান থেকে মেশিনগানের উপর গোলাবর্ষণ করা যেতো।আমাদের অবস্থান থেকে আমি কিংবা গোলন্দাজ পর্যবেক্ষক কেউই মেশিনগানগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম না। যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ায় আমাদের সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
এই পরিস্থিতিতে কোম্পানীকে আরও এগিয়ে যেতে আত্মহত্যারই শামিল ছিল।
বল্লভপুর এলাকাতেও আমাদের কোম্পানী কমান্ডারকে শুরুতেই থমকে পড়তে হয়। তার দুটি প্লাটুন লক্ষ্যস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, কিন্ত প্লাটুন কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য তার হাতে কোন অয়ারলেস সেট ছিলোনা। প্লাটুন দুটির সন্ধান লাভের জন্য তখন সে বার্তাবাহক পাঠায়। তাদের খুজে পাওয়া গিয়েছিলো বটে, কিন্ত তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দিনের আলো ফুটতেই পাকিস্তানীরা আমাদের দেখে ফেলে এবং তাদের কামানগুলো সক্রিয় হয়ে উঠে।
এই দুটি আক্রমনেই একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা অভাবে সফল হতে পারিনি।কোম্পানী কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য আমার কাছে অয়ারলেস সেট ছিল অপ্রতুল আর প্লাটুন কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য কোম্পানী কমান্ডারদের কোন অয়ারলেস সেট ছিলোনা।নিজের প্লাটুনগুলোর সাথে সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকলে কোন কোম্পানী কমান্ডারের পক্ষে রাত্রে এধরণের আক্রমণ চালানো বেশ অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে।
সাময়িকভাবে আমরা ব্যর্থ হলেও এ দুটো প্রচেষ্টার ফলে আমরা বুঝতে পারি আমাদের সেনারা যুদ্ধের জন্য উল্লেখযোগ্য দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে। যথাযথভাবে পরিকল্পনা নেয়া হলে এবং যোগাযোগের সরঞ্জামও ভারী অস্ত্র শস্ত্রের সাহায্য পাওয়া গেলো, আমাদের বিশ্বাস ,নিশ্চয়ই আমরা জয়ী হতে পারবো।
যুদ্ধের তখন ছয় মাস চলছে। এসময়ে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো ঘটনা ঘটে। এগুলো পরোক্ষভাবে আমাদের স্বাধীনটা যুদ্ধের ওপর প্রভাব নতুন বিস্তার করে।ঘটনাগুলির একটি হচ্ছে ভারতও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি সাক্ষর। চুক্তি অনুযায়ী দুদেশ কোন সংকটও বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে আসবে বলে অঙ্গীকার করে। চুক্তি সাক্ষরের পর আমাদের সাহায্য করার ব্যাপারে ভারত আরও বলিষ্ঠ ভুমিকা গ্রহণ করে। ভারতের সরকার এবং জনগণ বুঝতে পারে বাংলাদেশ প্রশ্নে তারা যে পদক্ষেপ সে ব্যাপারে এখন তারা একা নয়। অচিরেই এই প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রভাবে ভারতে এবং বাংলাদেশে বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। ভারত এতদিন পর্যন্ত খুব সন্তর্পণে এবং সাবধানে এগিয়ে চলছিলো। চুক্তির পর আমাদেরকে সর্বাত্মক সাহায্যের ব্যাপারে তার সমস্ত দ্বিধাদ্বন্ধ কেটে যায়।
এদিকে দুপক্ষের যুদ্ধের পরিকল্পনা আরও ব্যাপকতর হয়ে উঠে। গেরিলাদের মধ্যে যেন নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়। প্রতিদিনই সড়কও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ চলতে থাকে। প্রকাশ্য দিনের বেলাতেও হামলাও অ্যামবুশ শুরু হয়ে যায়। ভারতীয়ও পাকিস্তানীদের উভয় পক্ষের কামানের গর্জনে সীমান্ত এলাকা হয়ে উঠে চরম উত্তেজনাময়।
এদিকে ২৮শে সেপ্টেম্বর ভারতের ন্যাগাল্যান্ডে বাংলাদেশী পাইলটরা ট্রেনিং শুরু করে। গোড়াপত্তন হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর। প্রায়ই একই সময় পাকিস্তানী নৌবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা ৪৫ জন নৌসেনা নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীরও গোড়াপত্তন হয়। সেপ্টেম্বরে আমরা দুটি নৌযানও সংগ্রহ করি। এম-ভি পলাশ এবং এম-পি পদ্মা নামের জাহাজ দুটি ছিল কলকাতা পোর্ট কমিশনারের। প্রায়৩৮ লাখ টাকা খরচ করে এগুলো যুদ্ধের উপযোগী করে তোলা হয়। প্রতিটি নৌযানে দুটি করে ৪০ মিলিমিটার কামান( এল-৬০) বসানো হয়।
অক্টোবরের মধ্যে দুটি জাহাজই অভিযান শুরু করার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠে। ‘’অপারেশন হট প্যান্টস’’ সাংকেতিক নামে শুরু হয় অভিযান, যার লক্ষ্য ছিল খুলনাও মংলা এলাকায় শত্রুপক্ষের নৌযানের উপর আঘাত হানা এবং পসুর নদীর মোহনায় মাইন স্থাপন করা।