শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
যুবশিবির প্রদত্ত বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি ভাষন | বাংলাদেশ সরকার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় | জুলাই ১৯৭১ |
প্রিয় তরুণ ভাইগণ, আজ তোমাদের দেখে আমি গর্বিত এবং আনন্দিত। আমি জানি তোমাদের অভিভাবকদের অনেকে তাদের শেষ সহায় আলিঙ্গন করে তোমাদের উচ্চতর শিক্ষা প্রদানের জন্য চেষ্টা করছিল,যাতে তোমরা তোমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভবিষ্যতে তাদের তাদের অবলম্বন হতে পারো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের দরুন নিজের মাতৃভূমির সম্মান রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের উপর এসেছে।মাতৃভুমির গরিমা সমুন্নত রাখতে স্কুল এবং কলেজ ত্যাগ করে অস্ত্র হাতে নিতে তোমরা বাধ্য হয়েছ। আমাদের প্রিয় মা বোনদের উপর আরোপিত ইয়াহিয়ার পাঞ্জাব সেনাদের অনির্বচনীয় লজ্জা এবং অত্যাচার হতে রক্ষার্থে আমাদের দায়িত্ব নেওয়া উচিত।
এ মর্মে, ,আমি আমার তরুণ ছাত্র বন্ধু যারা বর্তমানে পরীক্ষার মতো তুলনামুলক সামান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অংশগ্রহণপ্রত্যাহারের আহবান জানাচ্ছি। আমার শিক্ষার্থী বন্ধুরা জানতো যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবস্থা নিতে যথেষ্ট সম্মত হয়েছেন। আমি এটা জেনে গর্বিত যে,আমাদের কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আবেদন নিয়ে আমার কাছে অবতীর্ণ হয়নি, অপরদিকে তাদের সকলে অভিন্ন অনুরোধ নিয়ে এসেছিল যাতে আমাদের দেশের এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে যত দ্রুত সম্ভব তাদের আধুনিক সামরিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করা হোক। আমাদের নিরপরাধ ভাই এবং বোনেরা যে অবর্ণনীয় পাশবিকতার শিকার হয়েছেন, যার ফলস্বরূপ দশ লক্ষেরও বেশি মানুষের নাশ,অগণিত মা-বোনদের সম্ভ্রম ইত্যাদি, পাশবিকতার প্রতিরোধ হিসেবে তোমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞসংকল্পের দ্বারা এমনভাবে প্রতিরোধ করছ,যা পাঞ্জাবী সেনা দ্বারা কখনও প্রতিহত করা সম্ভব হবে না। আমরা জানি যে কতটা কষ্ট এবং অসুবিধার মধ্য দিয়ে তোমরা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছ। তোমরাও জানো আমাদের সম্পদ কতটা সীমিত; কিন্তু যাই হোক না কেন, যতটুকু অর্থ আমরা সংগ্রহ করতে পারি,তার সম্পূর্ণটাই তোমাদের জন্য ব্যয় হবে। এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত। কারণ আমরা জানি যে তোমরাই দেশকে মুক্ত করবে এবং লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত উদ্বাস্তুদের সম্মানের সাথে তাদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে,এই উপায়ে সীমান্ত জুড়ে আশ্রয়প্রার্থী অগণিত মানুষের জন্য আমরা সর্বোচ্চটাই করতে থাকবো,এবং বর্ধিত আতিথেয়তায় প্রচন্ডভাবে ভারাক্রান্ত দেশটিকেও সাহায্য করবো। আমরা ভারতের জনগণের উপর কৃতজ্ঞ, ভারত সরকার আমাদের যেভাবে সাহায্য করেছে তা নজিরবিহীন।তাদের সরকারের সক্রিয় সহানুভূতি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে।
তবুও আমাদের মনে রাখতে হবে, ৬ বা ৭ মিলিয়ন শরণার্থীর ভার বহন একটি দেশের জন্য কতটা কঠিন। অনেকের কাছে এমনও মনে হতে পারে যে, হয়তো এ যুদ্ধের জন্যে অনেকাংশে আমরাও দায়ী। কিন্তু আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, এরজন্য আমরা বিন্দুমাত্র দায়ী নই। ইয়াহিয়া খানের বিশ্বাসঘাতকতাই আমাদের ওপর এ যুদ্ধ নিয়ে এসেছে। আমাদের ৬-দফা দাবির ভিত্তিতে, ২৪শে মার্চের এক সভায় আমরা এক প্রকার সমঝোতায় পৌঁছুই; ইয়াহিয়া তাতে সইও করেছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে তিনি তা প্রচার করবেন এরূপ সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছিলো। ২৫শে মার্চ, হঠাৎ করেই স্পেশাল বিমানে তিনি করাচি চলে যান আর এই দিকে রাতের আঁধারে আমাদের সাধারণ ছাত্র, পুলিশ, ই.পি.আর, বস্তিবাসিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খানসেনারা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নিকৃষ্টতম বিশ্বাসঘাতকতার আর কোন উদাহরণ নেই।ইয়াহিয়া একজন বিশ্বাসঘাতক। বাঙালী যেন আর কখনো মাথা উঁচু করে দাড়াতে না পারে,সেটা নিশ্চিত করাই ছিলো এ অমানবিক বর্বরোচিত আক্রমণের উদ্দেশ্য। ভায়েরা,! এই নরখাদকদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা সর্বদা মনে রাখবেন। ১৬-৩০ বছর বয়সী কোন যুবককে তারা বাঁচতে দেবে না, এবং এ বয়সী মেয়েরাও তাদের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এমনকি এখনো তারা সহস্র নগ্ন যবতীদের সীমান্তে প্রেরণ করছে। আমাদের এ ভয়াবহ পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হবে।স্বাধীন বাঙালী জাতি হিসেবে গর্বভরে আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা কখনো উপহার হিসেবে আসে না, তা অর্জন করে নিতে হয়। আমরা যদি মনে করি, অন্য কেউ আমাদের স্বাধীনতা এনে দেবে, তবে তা হবে প্রচন্ড বোকামী। স্বাধীনতার এ যুদ্ধ আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। অনেকেই হয়তো সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে, তবে এ যুদ্ধ আমার তোমারই লড়তে হবে।
আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের জয়লাভ সম্পর্কে কারো যদি বিন্দুমাত্র কোন দ্বিধা থাকে, তবে আমি তাকে বলছি একথা মাথায় রাখতে, এ যুদ্ধে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালী তোমার সাথে আছে। বিশাল পৃথিবীতে বাঙালীর অস্তিত্ব রক্ষার এই লড়াই এর প্রতিটি সৈনিক, প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার নাম ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে লেখা থাকবে। আমাদের চোখের সামনে তা রক্ত দিয়ে লিখে দিয়েছে ছোট্ট ভিয়েতনাম। সে আজ আর তুচ্ছ নয়, অসীম ক্ষমতার দাপটে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে সংকটময় সময় তারই আঘাতে। ভিয়েতনামের জয় সুনিশ্চিত; আমাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম ঘটবে না। আপনারা নিশ্চয়ই আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে জানেন। প্রবল বাধা- বিপত্তির মাঝেও তারা তাদের প্রবাসি সরকারের অধীনে এক শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলে এবং সাম্রাজ্যবাদ থেকে নিজ মাতৃভূমিকে মুক্ত করে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৯৪৭ এ আমরা যে ভুল করেছিলাম, তা শুধরবার জন্য এ যুদ্ধ লড়তেই হবে। আমাদের প্রথম ও প্রধান পরিচয় আমরা বাঙালী। ধর্ম আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। ধর্ম দিয়ে কখনোই কোন জাতিকে মাপা যায় না। দেশ পরিচালনায়ও ধর্মের অবদান খুব সামান্যই। কোন দেশের পরিচয় গড়ে ওঠে তার ভৌগলিক অবস্থান, তার ভাষা, সংস্কৃতি ৬৭ আর পারিপার্শ্বিক রাষ্ট্রসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। এরপরেই আসে ধর্ম, ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে। আমরা সকল ধর্মের সমান অধিকারে বিশ্বাসী। ঠিক যেমনি একজন মুসলিমের মসজিদে যাবার অধিকার আছে, তেমনি একজন হিন্দুর মন্দিরে যাবার, খ্রিষ্টানের চার্চে যাবার অধিকার আছে। একইভাবে, প্রত্যেকেরই তার নিজ নিজ ধর্ম- কর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। জাত্যবর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক একই অধিকার ভোগ করবে।
আমরা পাকিস্তানকে দু’ভাগে ভাগ করতে চাইনি, কিন্তু পাঞ্জাবী শাসকেরা আমাদেরকে তাদের কলোনিতে পরিণত করতে চাইলো, আমাদের স্বাতন্ত্র্য মুছে দিতে চাইলো এবং এসবই বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। আপনারা শপথ নিয়েছেন এর সমাপ্তি ঘটাবার। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা অতি শীঘ্রই পাকিস্তানী বাহিনীকে আমাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করতে পারবো এবং দেশকে স্বাধীন করবো। আমাদের এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেখানে কোন নির্যাতন থাকবে না, থাকবে না ধনী-গরিবের ভেদাভেদ, বড়- ছোটর বৈষম্য, বরং থাকবে কেবল এক জাতি, মানুষ। আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি হবে সমাজতন্ত্র। সবশেষে, সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের অবগত করতে চাই যে, দেশের ভবিষ্যত সেনাবাহিনীর আপনারাই হবেন ভিত্তি। যারা এ যুদ্ধে অসাধারণ নৈপূণ্য প্রদর্শন করবে, নিজেদের সর্বোত্তম যোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে পারবে , তারাই ভবিষ্যত সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেবে। নেতৃত্ব যেনতেনভাবে পাওয়া যায় না। এটিও অর্জন করে নিতে হয়। সুতরাং, যারা নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করতে পারবে, নেতৃত্ব তারাই পাবে। যদি আমরা কেবল দর্শক হয়ে পড়ি, যদি আমরা নেতারা আপনাদের কষ্টে কষ্ট না লাই, আপনাদের ব্যথায় ব্যাথিত না হই, যদি আমরা আরাম আর নেতৃত্বের স্বপ্নে বিভোর হই, তবে অবশ্যই আপনারা আমাদের সরিয়ে দেবেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম ভুক্তি নেবে, তাদের পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব সরকার নেবে। শহীদ এবং মুক্তিযুদ্ধে স্থায়ীভাবে পঙ্গু ব্যাক্তিবর্গের পরিবারের নিরাপত্তা আর সামগ্রিক দায়দায়িত্বও সরকার গ্রহণ করবে। আমরা আরোও সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, যুদ্ধে অসামান্য সাহসিকতা প্রদর্শনের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশেষ সম্মাননার ব্যবস্থা করা হবে। ইতোমধ্যে আমাদের কর্মসূচিসমূহ সুশৃঙখল ও নিয়মিত হয়ে উঠেছে। তথাপি, প্রশিক্ষণকালীন সময়ে স্বেচ্ছায় আপনারা যে কষ্ট ও ত্যাগ স্বিকার করেছেন, তা লাঘব করবার চেষ্টায় আমরা আমাদের যৎসামান্য রেশনকে যতটুকু সম্ভব পূর্ণাঙ্গ ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন করার চেষ্টা করবো। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আপনারাই আমাদের প্রধান বাহিনী এবং সর্বশেষ শক্তি।
জয় বাংলা
আ.হ.ম.কামরুজ্জামান