[রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ক’জন শহীদ]
মরণের দামে জীবনকে যারা কিনলেন- শহীদদের নামে নামকরণ করা হয়েছে ক’টি ছাত্রাবাসের
-দৈনিক পূর্বদেশ, ১১ জুন, ১৯৭২।
“ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী অন্যান্য জায়গার মত রাজশাহী জেলার অসংখ্য মানুষকে খুন করেছে। খুন করেছে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ অঙ্গনের কাজী নুরন্নবী, আবুল আমজাদ, আলমগীর, কাজল কুমার ভাদ্র, সাইফুল, কাইয়ুম, মান্নান, মোস্তফা, মনসুর, সিরাজ ও শামসুলকে।
কাজী নুরুন্নবী।
অত্যন্ত চেনা একটি মুখ। একজন সংগ্রামী ছাত্রনেতা। ছাত্রদের অধিকার আদায়ের অগ্রনায়ক। ভয় কি জিনিস তিনি জানতেন না। ১ম বর্ষ থেকে ৫ম বর্ষ পর্যন্ত তিনি অধিকার আদায়ের বিপ্লবী যোদ্ধা।
কাজী নুরুন্নবীর বাড়ী রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমার কাজীপাড়ায়। জল্লাদ ইয়াহিয়ার পাকবাহিনী অধিকৃত আমলে তিনি (কাজী) সম্পূর্ণভাবে অসহযোগিতা করেন। এমনি সময়ে ৫ম বর্ষের পরীক্ষা শুরু হলো। তিনি পরীক্ষা দানে বিরত রইলেন। শোনা যায় সেই মুহূর্তে তিনি গোপনে রাজশাহীতে কিছু অনুসন্ধান চালান। অনুসন্ধানকালে পাকবাহিনীর একজন দালাল রাস্তায় তাঁকে দেখা মাত্র ক্যান্টনমেন্টে গার্ড দিয়ে নিয়ে যায়। তারপর তাঁর আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানী পতাকা পোড়ানোর অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়। সম্প্রতি শহীদের মহীয়সী মা, মেডিক্যাল কলেজে প্রধান ছাত্রাবাসের ‘শহীদ কাজী নুরুন্নবী ছাত্রাবাস’ নামকরণ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।
অধিকার আদায়ের আরেক সংগ্রামী নায়ক ছিলেন ৫ম বর্ষের (নতুন) শহীদ আবুল আমজাদ। অত্যন্ত মিষ্টিভাষী, মিশুক ছিলেন। ডাক নাম ‘পেয়ারা’ নামে বন্ধুদের নিকট তিনি প্রিয় ছিলেন। তিনি ভাল গিটার বাজাতেন। পেয়ারার বাবা কুষ্টিয়ার মেহেরপুর কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যাপক ছিলেন। এরপর তিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ ছিলেন। ইয়াহিয়ার আমলে দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে তিনি, পেয়ারা ও পেয়ারার ছোট ভাইকে নিয়ে আশঙ্কায় কাল যাপন করছিলেন। কিন্তু একদিন নরপশুরা এসে বাসা থেকে পেয়ারা ও তাঁর বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। আর ফিরে এলো না।
নাটকীয় ভাবে বেঁচে গেলো তাঁর ছোট ভাই। আর তাই পেয়ারার দেশের বাড়ীতে মা, ভাই-বোনদের সব ভার এসে পড়লো ঐ ছোট ভাইটির ঘাড়ে। শহীদের নামে ‘শহীদ আবুল আমজাদ ছাত্রাবাস’ নামকরণ করা হয়েছে।
সুন্দর, সুশ্রী, এক কথায় স্মার্ট বলতে যা বোঝায় সবগুলি গুন ছিল কাজল কুমার ভদ্রের। রাজশী মেডিক্যাল কলেজের সবচেয়ে চেনা মুখ। কাজল- কাজলদা একগাল হেসে কথা বলতেন। তিনি তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। দেশের গোলযোগকালে প্রথমভাগেই জল্লাদদের শিকার হলেন। কাজলের বোনের উপর অনেক অত্যাচার চলে। পরে তাদের কোন সংবাদ আমরা পাইনি।
রাজনীতির পোকা ছিলেন যিনি, তিনি হলেন আলমগীর। অসুস্থ শরীর নিয়েই তিনি রাজনীতি করতেন। তিনি ছিলেন ১ম বর্ষের ছাত্র। তাঁর বাপ মা থাকতেন বরিশালে। দুর্যোগকালে তিনি রাজশাহীতে ছিলেন। পাকবাহিনী তাঁকে পাকড়াও করলো। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়া হল। পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা হল। তিনি পরীক্ষা দিলেন, পাস করলেন। তারপর ক্যান্টনমেন্টে ডেকে আনা হল। গুলি করে মারা হল। উদ্ভট উপায়ে পাকবাহিনী ঘৃণ্য ইচ্ছা চরিতার্থ করলো। মহাবিদ্যালয়য়ের ছাত্ররা একজন রাজনৈতিক নেতাকে হারালো।
শহীদের নামে আল হেলাল ছাত্রাবাসের ‘’শহীদ আলমগীর ছাত্রাবাস’’ নামকরণ করা হয়েছে।
হানাদার আমলে গোপনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন যে দু’জন কর্মরত কর্মচারী, তাঁরা হলেন কাইয়ুম ও সাইদুল। কাইয়ুম ছাত্রাবাসের কেরানী আর সাইদুল টাইপিষ্ট। জীবনের প্রতি ঝুকি নিয়ে কাইয়ুম, সাইদুল অনেক দুঃসাহসী কাজ করেছিলেন। কিন্তু তাদের এই কাজের একটি দুর্বল অংশ বুঝতে পারে স্থানীয় অবাঙ্গালী ছাত্রদল। তারপর আর বিলম্ব হয়নি। একদিন দু’জনেই একসঙ্গে শেষ হয়ে গেলেন। তাই ছাত্রদের মাঝে কাইয়ুম, সাইদুল স্মৃতি হয়ে থাকলেন চিরকাল।
নগরবাড়ীর পথ দিয়ে আগত হিংস্র পাকবাহিনীর হাত থেকে পরিত্রান পাবার জন্য বর্ডার- এর দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল বাবুর্চি মান্নান ও বয় মন্টু, সিরাজ, শামশুল এবং মনসুরেরা। বিধির ইচ্ছায় পদ্মার পাড়ে বড়কুঠির সামনেই বাঘের সম্মুখে পড়ে সেইসব হতভাগার দল। তারপর এক লাইনে মেশিনগানের গুলিতে লুটিয়ে পড়ল এতগুলো প্রাণ।“