বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ১৫তম খণ্ডের ২৬৩ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ৩৬ নং দলিল থেকে বলছি…
অধ্যাপক রেহমান সোবহান
সত্তরের ডিসেম্বরে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধে আমার সংশ্লিষ্টতা শুরু হয়। যদিও দেশের অন্যান্য অর্থনীতিবিদদের মতো আমিও এক দশক পূর্বে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। দুই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা বরাবরই উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। সত্তরের দশকে বিভিন্ন উন্মুক্ত ফোরাম এবং প্রফেশনাল ও জনপ্রিয় প্রকাশনায় আমি আমার দৃষ্টিতে আঞ্চলিক বৈষম্য এবং পাকিস্তানকে দু’টি ভিন্ন অর্থনীতির আলোকে দেখার কথা লিখতে থাকি। এই দর্শনগুলো জনগণের মাঝে প্রবলভাবে আলোচিত হয় এবং এভাবেই আমরা পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর চোখে শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠি।
বাঙালি অর্থনীতিবিদদের এইসব আলোচনা পাকিস্তানের নীতি নির্ধারকদের কাছে বিভিন্ন সভা ও সেমিনারের মাধ্যমে খুব দ্রুত পৌঁছে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬০ সালে রাওয়ালপিণ্ডিতে অনুষ্ঠিত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে প্রফেসর নুরুল ইসলামের সাথে আমি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের প্যানেলে উপস্থিত ছিলাম। সে বছরেই দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে সভায় অধ্যাপক আখলাকুর রহমান, মোশারফ হোসেন এবং আমি সংযুক্ত ছিলাম।
১৯৬১ সালের প্রথম অর্থ সম্মেলন (যেখানে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম একজন সদস্য ছিলেন এবং আমি পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যদের উপদেষ্টা ছিলাম), ১৯৬৫ সালের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (যেখানে মোশারফ হোসেন এবং আমি উভয়েই সদস্য ছিলাম), ১৯৭০ সালের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (যেখানে অধ্যাপক মাজহারুল হক, নুরুল ইসলাম, আখলাকুর রহমান, আনিসুর রহমান এবং আমি সহ সকলেই সদস্য ছিলাম) প্রভৃতি সম্মেলনে পূর্ব-পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের সাথে পাকিস্তানের পরিকল্পনাবিদ ও নীতি নির্ধারকদের দর্শনে প্রবল পার্থক্য ও মতবিরোধ দেখা যায়।
১৯৬৯-৭০ সাল পর্যন্ত আমি সাপ্তাহিক ফোরামের নির্বাহী সম্পাদক ছিলাম। সেখানে আমি জনতার দরবারে বাংলাদেশের প্রতি বৈষম্য নিয়ে বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে প্রধান সামরিক আইন উপদেষ্টা জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব এম, এম আহমেদের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি।
সেই সব গবেষণা এবং বাংলাদেশের অধিকার নিয়ে জনতার কাতারে বাঙালি অর্থনিতিবিদদের প্রত্যক্ষ অবস্থান বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে রাজনৈতিক সংগ্রামের পালে প্রবল হাওয়া লাগায়। আমাদের অনেকে তখন প্রায়শঃই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনায় বসতেন।
আওয়ামি লীগের ৬ দফা আন্দোলন আমাদের লেখালেখি দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। যদিও আমার জানা মতে কোন অর্থনীতিবিদ সেই দফাগুলো লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলেন না।
১৯৬৯ সালে রাওয়ালপিণ্ডির গোলটেবিল বৈঠকের পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান স্মারকলিপি প্রস্তুতে পরামর্শ দেবার জন্য অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক আনিসুর রহমান এবং অধ্যাপক ওয়াহিদুল হককে ডেকেছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরিতেও সেই বছরের গ্রীষ্মে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, ডঃ এ, আর খান, ডঃ স্বদেশ বোস, ডঃ হাসান ইমাম এবং আমি ডঃ কামাল হোসেনের সাথে করাচিতে দেখা করেছিলাম।
অবশ্য ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের আমাদের অবদান অনিয়মিত ছিল। যাই হোক, সত্তরের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের সেই ব্যাপক নির্বাচনী বিজয়ের পর নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের একটি গ্রহণযোগ্য সংবিধান তৈরি করার উদ্যোগ নিলেন। উল্লেখ্য, এই ৬ দফার ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিল। উনি এরকম একটি সংবিধানকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য আলোচনায় বসতে চাইলেন যেন ৬ দফা কেবল নির্বাচনী ওয়াদার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং এটি যেন জাতীয় পরিষদের সমঝোতার টেবিলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে আসে এবং দেশের জন্য একটি কর্মময় সংবিধান সৃষ্টির পথে অবদান রাখে।
নির্বাচনের পরের মাস থেকে সংবিধান নিয়ে আলোচনার জন্য বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে একের পর এক মিটিং বসতে লাগলো। সেখানে আওয়ামী লীগের হাই কম্যান্ড তাজউদ্দিন আহমেদ, নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এবং খোন্দকার মোশতাকসহ ডঃ কামাল হোসেন, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক সারওয়ার মুর্শেদ, অধ্যাপক আনিসুর রহমান এবং আমি উপস্থিত থাকতাম। বুড়িগঙ্গার পাড়ে একটি বাড়িতে সারা দিনব্যাপী আলোচনা চলতো। একাডেমিশিয়ানদের পাশাপাশি ডঃ কামাল হোসেন সবচেয়ে কার্যকরি ভূমিকা পালন করতেন। তাজউদ্দিন আহমেদের গভীর রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি ছিল। তিনি খুব সহজেই কঠিন কঠিন টেকনিকাল ইস্যুগুলোকে মৌলিক বিষয়াদিতে ভেঙে ফেলতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং সহজাত ধারালো চিন্তাধারার মাধ্যমে সেখানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন। সেই গ্রুপের কাজ শেষ হবার পর আওয়ামীর হাতে একখানা নতুন সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত ছিল এবং সমঝোতার টেবিলে যে কোন ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সংলাপের জন্য তখন আওয়ামী লীগ পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত ছিল।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলো কি সংবিধান সংশোধন বা ৬ দফা নিয়ে কিছু ভাবছিলেন? তা জানার জন্য বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দিন আহমেদের অনুরোধে আমি একাত্তরের জানুয়ারিতে ইনফর্মালভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে গেলাম।
লাহোরে আমি পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতৃস্থানীয় চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিত মুবাশ্বের হাসান ও মিয়া মাহমুদ আলি কাসুরি সাথে দেখা করলাম। শুনলাম, উনারা কেউই সংবিধান সংশোধন নিয়ে তেমন কিছু ভাবেন নাই! তাঁরা ৬ দফাকে শুধু নির্বাচনে জয়লাভের ফাঁকা বুলি ভাবছিলেন! স্বাধীনতার পর জেনেছিলাম যে আমাদের সেই আলোচনার মাঝের কিছু তথ্য কাসুরি সাহেব পাকিস্তানের মিলিটারি গোয়েন্দাদের জানিয়েছিলেন এবং সেই মোতাবেক যুদ্ধকালীন গ্রেপ্তারকৃত ডঃ কামাল হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল।
তারপর আমি লাহোর থেকে করাচি গেলাম। দেখা করলাম ব্যারিস্টার রাফি রেজার সাথে। উনি ভুট্টোর সংবিধান সংক্রান্ত উপদেষ্টা ছিলেন। জানতে পারলাম যে সামনের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে সংবিধান সংক্রান্ত পাকিস্তান পিপলস পার্টির অবস্থান নিয়ে কর্মপরিকল্পনা করতে তিনি ভুট্টো কর্তৃক নিয়োজিত হয়েছেন। বাস্তবে উনি খুব কম কাজই করেছিলেন কারণ ভুট্টো নিজেই সংবিধান সংশোধন নিয়ে আগ্রহী ছিলেন না। ভুট্টর আরেকজন মুখ্য লেফটেন্যান্ট আবদুল হাফিজ পীরজাদা এই বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ঢাকায় ফিরে আমি বঙ্গবন্ধুকে রিপোর্ট করলাম যে পিপিপি সংবিধান সংশোধন নিয়ে তেমন সিরিয়াস নয়।
এই বিষয়টা পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হওয়া গেল একাত্তরের জানুয়ারির শেষে, যখন পিপিপি-র লোকজনসহ ভুট্টো ঢাকায় আসলেন। তাজউদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম যে উনারা ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের চেয়ে ক্ষমতা ভাগাভাগির বিষয়ে আলোচনা করতে অধিকতর আগ্রহী ছিলেন। সেই সফর চলাকালীন আমি রাফি রাজা, মুবাশ্বের হাসান এবং পিপিপি-র শক্তিশালী নেতা মেহরাজ মোহাম্মদ খানের সাথে কিছু আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু সেই আলোচনাগুলো সুনির্দিষ্ট ছিল না, বরং ছিল আধা-দার্শনিক গোছের। অন্যরা পিপিপি-আওয়ামীর এই সংলাপ সম্পর্কে আমার চেয়ে আরো ভালো বর্ণনা দিতে পারবেন। যদিও উনাদের অনেকেই আজ সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। যতদূর বুঝলাম, ১ লা মার্চের আগ পর্যন্ত ইয়াহিয়া কিংবা পিপিপি ৬ দফা নিয়ে সিরিয়াস আলোচনার কথা ভাবেন নাই। যতদূর জানি, আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের মাঝে কখনোই ৬ দফা বাস্তবায়নের আসল সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা হয় নাই। যখন বিস্তারিত আলোচনা শুরু হয়েছিল, তখন একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতের ৫ মিনিট আগে সাংবিধানিক ইস্যুগুলো ৬ দফা থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছিল এবং জেনারেলরা আগেই রক্তপাত ও অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে সকল সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন।
মার্চের ১ তারিখের আগ পর্যন্ত শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতিতে আমার লেখালেখির মাধ্যমে আমি উপরের বিষয়গুলো সম্পর্কে ফোরামে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। পাকিস্তান সমস্যার সর্বশেষ সমাধান যে ৬ দফাকে রাজনৈতিকভাবে অনুধাবন করা, সেটাই আমার লেখার মূল বক্তব্য ছিল। এটা ছাড়া একটা পথ অবশিষ্ট আছে। তা হলো গণসংগ্রাম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা। অল্প কিছু বাঙালি শুধু সে সময় পাকিস্তান সৃষ্টির দর্শনের সাথে মনস্তাত্ত্বিকভাবে সংযুক্ত ছিলেন। তবে প্রশ্ন ছিল একটাঃ আলাদা হয়ে যাওয়া কি সাংবিধানিকভাবে হবে? নাকি যুদ্ধের মাধ্যমে?
১ লা মার্চে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাংবিধানিক সভা স্থগিত করার ঘোষণা আমার মাথায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তার জন্ম দেয়। ঐ দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে ডাকা অসহযোগ আন্দোলন বাংলাদেশের সীমানায় পাকিস্তান সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করে। সেই রাজনৈতিক কর্তৃক আর কোন দিন ফিরে আসে নি। ২৬ শে মার্চ, ১৯৭১-এর পর পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনার সকল চেষ্টাকে বাংলাদেশের লোকজন বিদেশী সশস্ত্র বাহিনীর দখলদারিত্ব হিসেবে দেখেছে।
অসহযোগ আন্দোলনের ডাক অভূতপূর্ব সফলতার পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন প্রয়োজনীয় নাগরিক এবং অর্থনৈতিক সেবা প্রদানে সংকট সৃষ্টি করেছিল। যখন প্রশাসনিক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের আহবানে সাড়া দিয়েছিল, তখন আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশে মিলিটারী ক্যান্টনমেন্ট ব্যতিত পাকিস্তান সরকারের সকল নিয়ন্ত্রণ অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। দেশের সমাজ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়া রোধে এই শূন্যতা কাটিয়ে ওঠা অপরিহার্য ছিল। ফলে ইয়াহিয়া খান ৬ই মার্চ ১৯৭১ তারিখে সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত যাবার আদেশ দিলে বঙ্গবন্ধু দেশের সমগ্র রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর এই দিন থেকে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো স্বায়ত্ত্বশাসন অর্জন করে।
অদ্ভুতভাবে লক্ষণীয় যে, এই সময়ে বাংলাদেশের কিছু কিছু অর্থনীতিবিদ অবিভক্ত পাকিস্তানের অর্থনীতি সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখার লক্ষ্যে সমস্যাসমুহের দিকে মনোনিবেশ করছিলেন। যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থপ্রেরণে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, পাকিস্তানের টাকশাল হতে ছাপানো মুদ্রার সরবরাহের সীমা নির্ধারণ, রপ্তানী নীতিমালা এবং রপ্তানীমূল্য পরিশোধের উপায়, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য এবং কাঁচামাল আমদানী ইত্যাকার সমস্যাগুলোই তাদের কাছে প্রধান হয়ে উঠেছিল।
৩২ নম্বর ধানমন্ডিস্থ প্রফেসর নুরুল ইসলামের বাসাটি শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের একরকম অর্থনীতি বিষয়ক সচিবালয় হয়ে উঠেছিল। সার্কিট হাউস সারিতে ডাঃ কামাল হোসেনের বাসভবন ছিল তৃতীয় প্রশাসনিক কেন্দ্র। আমাদের কেউ কেউ প্রতিদিন সুনির্দিষ্ট সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য প্রফেসর ইসলামের বাসায় মিলিত হতাম। সেখানে বাঙালি বেসামরিক এবং ব্যাংক কর্মকর্তারাও অংশ নিতেন। আমাদের সিদ্ধান্তগুলো সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন আহমেদ কিংবা কামাল হোসেন কর্তৃক ৩২ নম্বর হতে বা কামাল হোসেনের বাসা হতেই আদেশ বা নির্দেশনা আকারে ব্যাংক, সরকারি কর্মকর্তা এবং পত্রিকায় প্রচারনার জন্য পাঠানো হতো।
স্থানীয় অর্থনীতি পর্যালোচনা ছাড়াও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর প্রতিনিধিদের নিকট সারসংক্ষেপ তুলে ধরা ছিল আমাদের অন্যতম কাজ। প্রতিদিনই বড় বড় আন্তর্জাতিক পত্রিকার প্রতিনিধি আমাদের আলোচনার সময়ে আসতেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নিউ ইয়র্ক টাইমস এর টিলম্যান এবং পেগি ডারবিন, সিডনি শনবার্গ -যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্প্রচার করতে গিয়ে পাকিস্তানী আর্মি কতৃক ঢাকা হতে বহিষ্কৃত হন, যা তাঁকে পুলিৎজার পুরষ্কার প্রাপ্তির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল, দ্য গারডিয়ান এর পিটার প্রেস্টন (বর্তমান সম্পাদক) এবং গার্ডিয়ান পত্রিকার মারটিন এডেনি, টাইমস এর পিটার হাজেলহার্স্ট, ওয়াশিংটন পোস্ট এর স্যালিং হারিসন, ওয়াশিংটন স্টার-এর হেনরি ব্র্যাডশার প্রমুখ। অভিজ্ঞ এসব সাংবাদিকদের সকলেই তাদের পত্রিকার পাঠকদের ঢাকার নাটকীয়তার আদ্যোপান্ত জানানোর জন্য নিয়মিত রিপোর্ট করছিলেন।
পিটার হাজেলহার্স্টই আমাকে জানান যে, তিনি সম্প্রতি লারকানায় ভুট্টোর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন যে বাংলাদেশে চলমান উত্তেজনা কিছু শহুরে রাজনীতিবিদদের চায়ের আসরে ঝড় ব্যতিত আর কিছু নয়। বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালালে এই উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হবে এবং আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। এই সামরিক অভিযান আন্দোলনকারীদের ওপর হত্যা-সন্ত্রাস চালিয়েছিল এবং বহু নেতাদের জেলে পুড়েছিল। এই গোপনীয় তথ্যটি আমাদের কাছে ভবিষ্যদ্বাণীর মতো ছিল যা আমরা পরবর্তীতে ১৯৭১ এর ২৫ শে মার্চ সামরিক অপারেশন দেখতে পাই। ভুট্টো নিশ্চয়ই তার ভ্রান্ত ধারণা ইয়াহিয়া খান কে-ও জানিয়েছিলেন।
এ সময় প্রফেসর নুরুল ইসলামের দুজন ভগ্নিপতি, পাকিস্তান আর্মির কর্নেল ইয়াসিন এবং টি এন্ড টি তে কর্মরত জনাব এস হুদা নিয়মিত তার বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন। কর্নেল ইয়াসিন ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন। ফলে তার কাছে ঢাকায় পাকিস্তান আর্মিকে খাদ্য সরবরাহকারীদের তালিকা ছিল। পার্টির স্বেচ্ছাসেবকেরা এই তালিকা মোতাবেক সকল সরবরাহকারীদের সাথে দেখা করেন এবং বেশ কয়েকজনকে ক্যান্টনমেন্টে সরবরাহ বন্ধ করাতে সক্ষম হন। এ কাজের ফলাফলও ভয়াবহ হয়েছিল। ২৫ শে মার্চের ঘটনার পর, কর্নেল ইয়াসিন এবং জনাব হুদা দু’জনকেই আর্মিরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। হুদাকে তাঁরা ঢাকা হাজতে অত্যাচার চালিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পাশাপাশি স্বীকারোক্তি আদায় করতে চেয়েছিল যে, তিনি আমার এবং প্রফেসর ইসলামের সাথে মিলিত হয়ে আওয়ামীলীগ এর পক্ষ থেকে ভারতের সাথে টেলিযোগাযোগ স্থাপনের ষড়যন্ত্র করছিলেন। এই বানোয়াট অভিযোগ পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহিতার চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুকে ‘৭১ এর সময়টাতে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল।
কর্নেল ইয়াসিনকে আরও করুণ পরিনতি ভোগ করতে হয়েছিল। তাকেও হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাকে লাহোরে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তাকে অত্যাচার করে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানে বাধ্য করার চেষ্টা চালানো হয়। এঁদের দু’জনেরই এই পরিণতি ভোগের মূল কারণ ছিল মার্চের সেই দিনগুলোতে অধ্যাপক ইসলাম এবং আমার সাথে মাত্র কয়েকবার দেখা হওয়া।
ইয়াহিয়া এবং মুজিবের মধ্যে যখন আলোচনা শুরু হয়েছিল, আওয়ামীলীগ টিমের ব্যাক-আপ দেয়ার জন্য নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ এবং কামাল হোসেনের পাশাপাশি আমাদের কয়েকজনকেও থাকতে হয়েছিল। ইয়াহিয়া খানের টিমে ছিলেন মেজর জেনারেল পীরজাদা, বিচারপতি কর্নেলিয়াস এবং এম এম আহমেদ। আলোচনার লক্ষ্য ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের রূপরেখা নির্ধারণ করা। আমরা প্রতি সেশন শেষে ইয়াহিয়া খানের টিম প্রদত্ত প্রস্তাবনা গুলো নিয়ে বসতাম এবং আমাদের প্রত্যুত্তর বা বিকল্প প্রস্তাব ঠিক করতাম। সেশনগুলো অনেক দীর্ঘ হতো। কিছু সেশনে বঙ্গবন্ধু নিজেই থাকতেন। ডঃ কামাল হোসেনের মতিঝিল চেম্বারে অনুষ্ঠিত সেশনটি ছিল চরম পরিণতিমূলক, যেটাতে সারারাত ধরে আওয়ামীলীগের হাই কমান্ড এবং উপদেষ্টামন্ডলী পরের দিন আলোচনায় চূড়ান্ত অবস্থান ঠিক করতে কাজ করেছিলেন। আমাদের প্রস্তাবনার ওপর এম এম আহমেদের হাতে লিখিত সংশোধনী নিয়ে আমরা বসেছিলাম, সেটাই ছিল শেষ। ইয়াহিয়া খানের টিম সর্বশেষ যে অবস্থান নিয়েছিলেন তাতে মনে হয়েছে অন্তত অর্থনৈতিক বিষয়াদিসমূহে একরকম ঐক্যমত্যে পৌঁছানো সম্ভব। আমাদের প্রত্যাশা ছিল জেনারেল পীরজাদা ২৪ শে মার্চ আলোচনার সর্বশেষ সেশন আহ্বান করবেন এবং সেখান থেকে একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রেসে আসবে। এই আহবানটির জন্য আমরা ২ দিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম। ২৫ তারিখে আমরা জানতে পারলাম যে এম এম আহমেদ গতরাতে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন। মনে হচ্ছিলো যে তিনিও মিটিঙের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কিন্তু পীরজাদা অকস্মাৎ তাঁকে এবং বিচারপতি কর্নেলিয়াসকে এই বলে ঢাকা ছাড়তে বলেন যে তাদের কাজ শেষ। সমঝোতার বিস্তারিত আলোচনা এখানে করছি না। আগ্রহী পাঠকেরা ‘বাংলাদেশের জন্য সমঝোতা’ শীর্ষক আমার আর্টিকেলে আমার দৃষ্টিতে আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ পাবেন। এটা আমি স্মৃতি সজীব থাকতেই বছরের শেষের দিকে রেকর্ডস্বরূপ সাউথ এশিয়ান রিভিউতে লিখেছিলাম। ডঃ কামাল হোসেনও পৃথকভাবে এই বাদানুবাদ নিয়ে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বর্ণনা দিয়েছেন।
বাদানুবাদের সময়টাতে ক্রমাগত উত্তেজনা তুঙ্গে উঠছিলো। কারণ প্রতিদিন বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের দখলদারিত্ব বাড়ছিলো। বাংলার আমজনতা রাজনীতি সচেতন ও বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে আমাদের এক বন্ধু মঈদুল হাসান আমাকে জানান যে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থেকে পাওয়া একটি জরুরী খবর তিনি বঙ্গবন্ধুর নিকট পৌঁছে দিতে চান। খবরটি কে পাঠিয়েছে, সে তা সেই সময়ে না বললেও পরে আমাকে জানায় যে যে, খবরটির সোর্স ছিলেন এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দকার, যিনি তখন পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের গ্রুপ ক্যাপ্টেন ছিলেন। আমি মঈদকে এক রাতে ১০ টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে নিয়ে গেলাম। তিনি বঙ্গবন্ধুকে জানালেন যে পাকিস্তানী সেনারা সমর প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং আক্রমণ করার জন্য তৈরি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু খবরটি টুকে নিলেন যদিও তিনি এই প্রস্তুতি সম্পর্কে আগেই অবগত আছেন বলে জানালেন।
বাদানুবাদ চলাকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) নেতার সাক্ষাৎ লাভ করার সুযোগ হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, দৈনিক সংবাদ এর প্রোপ্রাইটর আহমেদুল কবির এর সাথে এনডব্লিউএফপি-এর আব্দুল ওয়ালী খান এবং বেলুচিস্তানের ঘাউস বাক্স বাইজেনজো অবস্থান করছিলেন। ওয়ালী খান এবং বাইজেনজো দুজনেই তাদের উপলব্ধির কথা আমাকে জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন যে ইয়াহিয়া, মুজিব এবং ভুট্টোর মধ্যে আলোচনা পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্র প্রদেশগুলোর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করবে। এই পাঠান এবং বেলুচদের উপলব্ধির কারন এই যে, ভুট্টো আলোচনায় তার নিজের নির্বাচনী এলাকা পাঞ্জাব এবং সিন্ধুর এর সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে অধিকতর ক্ষমতায়ন দাবী করছিলেন। মুজিবের পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবীর বিপরীতে ভুট্টো শুধু পাঞ্জাব আর সিন্ধু নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানের পুরোটা নিজের করায়ত্ত্ব করতে চেয়েছিলেন। যেহেতু পিপলস পার্টি এনডব্লিউএফপি এবং বেলুচিস্তানের দু’টো নির্বাচনেই হেরেছিল, সেহেতু ভুট্টো আশংকা করেছিলেন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামীলীগ পাঠান আর বেলুচদের সাথে নিয়ে পিপলস পার্টিকে কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে একেবারেই ছুঁড়ে ফেলে দিবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে পাঞ্জাবের একক ক্ষমতা খর্ব করবে। ন্যাপ নেতারা এই ভেবে ভয় পেয়েছিলেন যে পূর্বের স্বায়ত্ত্বশাসনের বিনিময়ে হয়তো মুজিব পশ্চিমের ক্ষুদ্র প্রদেশগুলো ভুট্টোর হাতে ছেড়ে দিয়ে তাদের চলমান স্বায়ত্ত্বশাসনের আন্দোলন চাপা দিবেন। পরবর্তীতে দেখা গেল যে মুজিবের ভূমিকা সম্পর্কে তাদের ধারনা ছিল একেবারেই পুঁথিগত। যদিও ঘটনাক্রমে দেখা যাচ্ছে যে তাদের স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার ঠিকই পাঞ্জাব আধিপত্যে হারিয়ে গেল, প্রথমে ভূট্টো এবং বর্তমানে সামরিক জান্তার হাতে।
পাকিস্তানী জেনারেলদের আলোচনায় গড়িমসি দেখে আমার ধারনা হচ্ছিলো যে ওরা বাংলাদেশে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য সময়ক্ষেপণ করছিল। ২৪শে মার্চ ন্যাপ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য ক্ষুদ্র অঞ্চলভিত্তিক দলের নেতারা ঢাকা ছাড়েন। এ থেকে বুঝা গিয়েছিল যে তাদেরকে ইয়াহিয়া খানই এ নির্দেশ দিয়েছিলেন আর সেনারা শীঘ্রই মাঠে নামছে।
২৫শে মার্চ সন্ধ্যায়, আনুমানিক ৫/৬টার দিকে তারিক আলীর পিতা স্বনামধন্য সাংবাদিক মাজহার আলী খানকে নিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে ধানমন্ডি ৩২ এর বাসায় যাই। মাজহার সাহেব ফোরামে একটি কলাম লিখতেন। ঐ সময় বাড়িটি সাংবাদিকে জনাকীর্ণ ছিল। উনারা উপলব্ধি করেছিলেন যে হয়তো পাক সেনাদের সাথে ঘটনাবলী পরিশিষ্ট হয়ে গেছে।
মাজহার আলী খান বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন। সেখানে সর্বদাই ভিড় থাকতো বলে এ ব্যাপারে তাকে প্রস্তুত করে রেখেছিলাম। বঙ্গবন্ধু মাজহারকে আগে থেকেই চিনতেন যখন তিনি মিয়া ইফতিখার উদ্দিনের মালিকানাধীন পাকিস্তান টাইমস এর সম্পাদনা করতেন। তিনি তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন এবং রুমে শুধু আমাদের দুজনকে রেখে বাকিদের যেতে বললেন।
বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন যে আর্মি সেনা অভিযানে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমার মনে আছে তিনি বলেছিলেন, “ ইয়াহিয়া মনে করে যে আমাকে মেরে সে আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পারবে। কিন্তু তার ধারনা ভুল। আমার কবরের ওপরেই স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মিত হবে।” তার মৃত্যু অবধারিত এবং সেটি তিনি মেনে নিয়ে বাকিটা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে মনে হয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এই মিটিং এর পর মাজহার আলী আসন্ন রক্তবন্যা সম্পর্কে কয়েকজন পিপিপি নেতার মনোভাব জানতে চেয়েছিলেন। ৩২ নম্বর থেকে আমরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এ যাই। সেখানে মাহমুদ আলী কাসুরীর সাথে দেখা হয়। তার স্বভাবজাত দাম্ভিক স্বরে কাসুরী আমাকে এই বলে অভিবাদন জানালেন যে, “ মনে হচ্ছে আওয়ামীলীগ নিষ্পত্তি চাইছে না”। যেহেতু আমার জানামতে প্রেসে পাঠানোর জন্য একটি চুক্তির খসড়া ইতোমধ্যেই তৈরি ছিল, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে এই খবর তিনি কোথায় পেলেন। উত্তরে তিনি জানালেন যে জেনারেল পীরজাদা তাকে এমনটিই বলেছেন। যেহেতু পীরজাদা আলোচনার টেবিলে একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন, সেহেতু তারা নিশ্চয়ই পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের একটি ভিন্ন গল্প শোনাচ্ছিলেন আর সেনা অভিযানের ভিত্তি তৈরি করছিলেন। কাসুরী বলে চললেন, লিংকন যেভাবে আমেরিকার অখণ্ডতা রক্ষার জন্য রক্তপাতের মাধ্যমে সিভিল ওয়ার লড়েছিলেন এখানেও দরকার হলে তা করা হবে। ভিয়েতনামে আমেরিকার চালানো গণহত্যা বিষয়ক বারট্রান্ড রাসেল ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইবুনালের একজন সুপরিচিত জুরিস্ট ছিলেন কাসুরি। আশা ছিল বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানী আর্মিদের আসন্ন গণহত্যার বিষয়েও তিনি সোচ্চার থাকবেন যেমনটি তিনি ভিয়েতনামিদের প্রতি দেখিয়েছেন।
পাকিস্তানী জেনারেলদের এই শঠতা সম্পর্কে নিশ্চিত জেনে আমি সার্কিট হাউস সারিতে কামাল হোসেনের বাসায় গেলাম এবং জানালাম যে পীরজাদা পিপিপির সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে বানোয়াট গল্প প্রচার করছেন এবং হামলা চালানোর প্রেক্ষাপট মোটামুটি তৈরি। সেখান থেকে আমি গুলশানের বাড়িতে ফিরে এলাম। খবর আসছিল যে আর্মিরা আওয়ামীলীগ কর্মীদের রাস্তার ব্যারিকেড সরাতে বাধ্য করছিল। আনুমানিক রাত ৯/১০টার দিকে আমরা প্রথম গোলাবারুদের শব্দ শুনতে পাই যাতে বুঝতে পারছিলাম যে ইপিআর এবং পুলিশ ব্যারাকে পাকিস্তানী আর্মিদের আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। আমি বঙ্গবন্ধুর অবস্থা জানার জন্য ৩২ নম্বরের সরাসরি ফোন নাম্বারে ফোন করলাম। জানি না কে ধরেছিল তবে ফোনের সেই স্বরটি নির্দেশ করেছিল যে বঙ্গবন্ধু সেখানেই আছেন। পরের কলগুলোর জবাব কেউ দিলোনা। কিছুক্ষণ পরে সকল টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
পরের ৩৬ ঘন্টা আমরা ভারী আর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রের ঝনঝনানি শুনলাম, দেখতে পাচ্ছিলাম দূরের আকাশে আর্মিদের গোলাগুলির আলোকচ্ছটা। ২৬ তারিখে ইয়াহিয়ার ঘোষণা কানে এল। আমাদের সবার কাছেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তবে কখন শেষ হবে সেটা বুঝতে পারছিলাম না।
পরবর্তী ৩৬ ঘণ্টায়, টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় আর গুলশানের বাড়িটিতে অবরুদ্ধ থেকে আমরা শুধু গণহত্যার আর্তনাদই শুনেছি। ২৭ শে মার্চের সকালে কারফিউ তুলে দেওয়া হল। আমি প্রথমেই কিছু কারণবশতঃ হেঁটে গুলশানের ফোর্ড ফাউন্ডেশন গেস্ট হাউসে গেলাম যেখানে সরবন হতে আগত পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্সের ভিজিটিং স্কলার ড্যানিয়েল থরনার অবস্থান করছিলেন। ধানমন্ডিতে প্রফেসর নুরুল ইসলাম ঠিক আছেন কিনা, তা অনতিবলম্বে গাড়ি চালিয়ে দেখে আসার জন্য আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম। বাড়ী ফিরে এসে দেখলাম আমার বন্ধু মঈদুল হাসান এবং পাকিস্তান টোব্যাকোর জনাব এ আলম আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। মঈদ আমাকে তৎক্ষণাৎ বাড়ী ছেড়ে যেতে বললেন। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম যে, সশস্ত্র বাহিনী পাইকারি মাত্রায় গণহত্যা শুরু করে দিয়েছে। কামাল হোসেন এর বাসায় তিনি খবর নিয়ে জানতে পেরেছেন যে আর্মি তাকে তুলে নেবার জন্য সেখানে গিয়েছিল। তবে সেখানে তাকে পাওয়া যায় নি।
আমার ধারনা ছিল না যে আমিও আর্মির টার্গেট হতে পারি, কারন কেউ একজন বলেছিল যে আর্মি শুধু রাজনৈতিক কর্মীদেরকেই ধরবে। তারপরও মঈদ আমাকে বিপদের সম্ভাবনা এড়াতে বাসা থেকে চলে যেতে বললো।
আমার পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি যেতে চাছিলাম না। কিন্তু আমার স্ত্রী বললেন যে আমার উপস্থিতি তাদেরকেও বিপদে ফেলতে পারে। এছাড়া আমি বাড়িতে না থাকলেই সে নির্ভয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঢাকার বাইরে চলে যেতে পারবে এবং আমিও নির্বিঘ্নে স্বাধীনতা সংগ্রামে কাজ করতে পারবো।
প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি আমার পরিবারকে ছেড়ে ঐদিন সকালে গুলশানের আরেকটি বাড়ীতে উঠলাম। মঈদ বিকেলে আমাকে জানালো যে, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে গণহত্যার চিহ্ন দেখেছেন। জগন্নাথ হলের বিপরীতে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক, প্রফেসর আনিসুর রহমানেরা যে ব্লকে থাকতেন, সেই ব্লকের মেঝে এবং সিঁড়িতে প্রচুর রক্ত দেখেছেন। সব কিছু তছনছ করা হয়েছে। প্রফেসর রাজ্জাককে আর্মিরা হত্যা করেছে বলে শুনলাম। তিনি আমাদের বন্ধু ছিলেন বলে শুধু নয়, পাকিস্তানী আর্মিরা যে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে জড়িত ছিলেন না এমন ব্যক্তিদেরকেও হত্যা করছে, সেটা জেনে আরও বেশী মর্মাহত হলাম।
২৭ তারিখের রাতটা আমি আমার নতুন আশ্রয়ে কাটালাম। পরদিন সকালে মঈদ এসে জানালেন যে গত সন্ধ্যায় কারফিউর পরপরই, আর্মি আমাকে তুলে নেবার জন্য আমার বাড়ীতে গিয়েছিল। পরে আমার স্ত্রীর কাছে শুনেছিলাম যে কর্নেল সাঈয়েদউদ্দীন এর নেতৃত্বে দুই ট্রাকভর্তি পাক আর্মি আমাদের বাড়িতে এসেছিল। এই কর্নেলই ২৫শে মার্চের রাতে বঙ্গবন্ধুকে তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করেছিল বলে জানা যায়।
পাকিস্তানী আর্মিরা যখন আমাদের বাড়িতে এসেছিল, তখন ৮ বছর বয়সী আমার বড় ছেলে তৈমুর বাড়িতেই ছিল। তাকে কর্নেল সাঈয়েদউদ্দীন আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। সে অস্ত্রধারী এত এত সেনার মাঝেও যথেষ্ট ঠাণ্ডা মাথায় সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল। আমার স্ত্রী সালমা সৈন্যদের আসতে দেখে এবং তৈমুরের জন্য ভয় পেয়ে বাড়ীতে লুকোতে চেয়েছিলেন কিন্তু অস্ত্রের মুখে সৈন্যরা তাকে আটকে ফেলে। কর্নেল সাঈয়েদউদ্দীন আমার প্রতিবেশীদেরকেও আমার অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে। যখন জানতে পারল যে আমি ঐদিন সকালেই বাড়ী ছেড়েছি, তখন সে আমার স্ত্রী-সন্তানদের বন্দী করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল যাতে “আমি বের হয়ে আসি”। যাই হোক, আমার প্রতিবেশীরা তাদেরকে ছেড়ে দেবার জন্য তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন।
পাকিস্তানী আর্মিরা যেহেতু তাদের অপারেশনের প্রথম ৪৮ ঘন্টাতেই আমার খোঁজে গিয়েছিল, সেহেতু আমি বুঝতে পারলাম যে আমি তখন তাদের একজন তালিকাভুক্ত লক্ষ্যতে পরিণত হয়েছিলাম। মঈদ আমাকে উপদেশ দিল যে আমার ঢাকার বাইরে যাওয়া উচিত। কারন এখানে বাড়ি বাড়ি তল্লাশী শুরু হতে পারে এবং আমাকে পাওয়া গেলে আশ্রয়দাতার কপালেও দুর্ভোগ নেমে আসবে। সময়টা এমন ছিল যে আমরা জানতাম না যুদ্ধটা কোনদিকে গড়াবে আর তাতে আমাদেরই বা কি করার থাকবে। আমি আমার স্ত্রী কে একটি চিরকুট পাঠালাম যেন সে ঢাকা ছেড়ে যায় আর যদি সম্ভব হয় তাহলে দেশের বাইরে চলে যেতে যাতে আমি স্বচ্ছন্দে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় থাকতে পারি।
ঢাকা ছাড়ার প্রস্তুতির জন্য প্রথমে মঈদ আমাকে গুলশানে মোকলেসুর রহমান (সিদু মিয়াঁ)-র বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। সেখান থেকে নদী পাড় হয়ে বারাইদ নামক একটি গ্রামে সিদু মিয়াঁর শ্বশুর জনাব মতিন এর বাড়িতে উঠলাম। গুলশান থেকে বারাইদ আসার পথে দীর্ঘ প্রান্তরে আমি পলায়নরত গণমিছিলে মিশে গিয়েছিলাম। এরা সকলেই ঢাকা থেকে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। এই গণমিছিলে আমি আনিসুর রহমানের দেখা পেলাম যিনি আমাকে জানালেন গত ২৫-২৬ তারিখ তারা কী বিভীষিকাময় সময় পার করেছেন। তিনি জানালেন যে কিভাবে আর্মিরা তাদের ব্লকের নিচতলার বাসিন্দা অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা গুলি করে মেরেছে। মেরেছে উপর তলায় বসবাসরত পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকে। শুধু ভাগ্যের জোরে প্রফেসর রাজ্জাক বেঁচে গিয়েছিলেন। কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্য তার দ্বিতীয় তলার বাসার দরজায় ধাক্কাধাক্কি করেছিল। তিনি দরজা খুলতে কিছু সময় নিয়েছিলেন আর তাতে পাকিস্তানীরা ভেবেছিলো যে বাসা খালি। ফলে দরজা খোলার আগেই পাকিস্তানীরা চলে গেল। প্রফেসর রাজ্জাকের সামনের বাসাতে থাকা আনিস বেঁচে গিয়েছিলেন এই কারনে যে তার বাসার দরজাগুলোর একটি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ ছিল। ফলে এক্ষেত্রেও বাইরে থেকে মনে হয়েছিল যে বাসায় কেউ নেই। দু’ রাত এক দিন যাবত সেনারা যখন সিঁড়ি থেকে লাশগুলো সরাচ্ছিলো, তখন আনিস স্ত্রী এবং দুই কন্যা কে নিয়ে পুরোটা সময় তার বাসার মেঝেতে কাটিয়েছেন।
জনাব মতিন এর বারাইদ গ্রামে আমাদের অনেক বন্ধুর সাথে দেখা হল। সেখানে পেলাম জামিল চৌধুরী ও তার পরিবারকে, মোকাম্মেল হক ও তার পরিবার (যিনি জনাব মতিন এর জামাতা), ঢাকা টেলিভিশনের মোস্তফা মনোয়ার। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে যেহেতু আমি আর্মিদের সরাসরি টার্গেট এবং হয়তো আনিসও, সেহেতু আমরা বর্ডার পেরিয়ে ভারতে যাব এবং বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য প্রচারণা শুরু করব।
২৯শে মার্চ এর ভোরে গাইড হিসেবে মতিন সাহেবের একজন আত্মীয় জনাব রহমতউল্লাহর সাথে আনিসুর রহমান, মোস্তফা মনোয়ার, একজন স্থানীয় স্কুলশিক্ষক জনাব রশীদ এবং আমি আগরতলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সিদু মিয়া আর মঈদ আমাদের নদীর পাড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল।
এখান থেকে আমরা নৌকায় শীতলক্ষ্যা ধরে নরসিংদীর দিকে আসছিলাম। সারাটা পথ জুড়ে দেখেছি মানুষ ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছিল। নরসিংদীতে এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার জন্য আমরা লঞ্চ খুঁজছিলাম। এতক্ষণ পর্যন্ত দেখেছি শুধু উদ্ভ্রান্ত জনতা আর্মির ভয়ে ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছিল। গুঞ্জন শুনছিলাম যে চট্টগ্রামে কিছু প্রতিরোধ হয়েছে তবে সেটা কোনমতেই পুরোদমে প্রতিরোধ যুদ্ধ বলা যায় না। প্রথম আমরা যুদ্ধের চিহ্ন দেখলাম একটা লঞ্চে। সেটা মেঘনা পাড়ি দিয়ে যাত্রী নিতে নরসিংদী আসছিলো। সেখানে বাংলাদেশের একটা পতাকা করে উড়ছিল।
কিছুটা চলার পর লঞ্চটি তীরে ভীড়ানো হচ্ছিলো, যদিও ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখনো অনেক দূর। সেখানে কিছু ছাত্র আমাদেরকে লঞ্চ থেকে নেমে তাদের সাথে যেতে বলল। এতদূর এসে আনিস এবং আমার কারোই পরিচয় প্রকাশে ভয় ছিল না, যদিও ভিড়ের মাঝে পাকিস্তানী গোয়েন্দা চর থাকতে পারতো। তবুও আমরা ইতস্তত করতে করতে তীরে নেমে পড়লাম। এখানকার যে পরিস্থিতি তৈরি হলো, তার জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। কারণ কয়েকজন আমাদের পরিচয় নিয়ে সন্দিহান ছিল। পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে বুঝতে পেরে মোস্তফা মনোয়ার উপস্থিত বুদ্ধিতে বললেন যে আশপাশের এলাকার মধ্যে কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আছে কিনা এবং যদি থাকে তাকে ডেকে পাঠানো হোক, তাহলে সে তার শিক্ষকদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারবে।
আনিস এবং আমি বললাম যে আমাদের সংগ্রাম পরিষদের নেতার কাছে নিয়ে যাওয়া হোক যাতে আমরা নির্ভয়ে আমাদের বিস্তারিত পরিচয় দিতে পারি, এই উত্তেজিত জনতার ভিড়ে আমরা পরিচয় দিতে চাই না। এমন সময় ঢাকার অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস (যেখানে আমি কয়েকবার গিয়েছিলাম) সেখানকার একজন পিয়ন আমাকে চিনতে পারলেন এবং সবাইকে আমাদের কথা শোনার জন্য আশ্বস্ত করলেন। এরপর সংগ্রাম পরিষদের প্রধান যিনি আওয়ামীলীগেরও একজন নেতা ছিলেন, তিনি এবং অন্যান্য আরও কয়েকজন মিলে আমাদেরকে স্থানীয় একটি স্কুলে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমরা আমাদের পরিচয় বললাম কিন্তু আমাদের পরিচয় নিশ্চিত করানোর কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কেউ কেউ আমার নাম শুনেছে কিন্তু আমরাই যে তারা সেটা বিশ্বাস করাতে কষ্ট হচ্ছিল। তারপরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে আপাতত আমরা বাইরে অপেক্ষমান জনতাকে বলব যে আমাদের পরিচয় সম্পর্কে দেওয়া তথ্য গ্রহনযোগ্য হয়েছে। আমরা বাইরে আসামাত্র মুকতাদা নামের একজনকে দেখা গেল। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে আমার এবং আনিসের সরাসরি ছাত্র ছিল। সাথে ছিল তার চাচাত ভাই মোফাকখের, ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। তারা পাশের গ্রামে থাকতো। মোস্তফা মনোয়ারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খুঁজে আনার আবেদন পেয়ে আমাদেরকে চিনিয়ে দেবার জন্য তারা কয়েক মাইল দূর থেকে ছুটে এসেছে।
আমাদের পেশা, পরিচয় ইত্যাদি নিশ্চিত হওয়া মাত্র আমরা এলাকাটিতে আমরা তারকাখ্যাতি পেয়ে গেলাম। আমাদেরকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হল। এক পর্যায়ে গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আমাদের দেখতে আসছে। যা হোক, গুজব আস্তে আস্তে কেটে গেল কিন্তু আমাদের পরিচয় গোপন রাখা গেল না এবং আমরা বুঝলাম যে আমাদের যাওয়া উচিত।
আমাদেরকে স্থানীয় নেতারা জানালেন যে গ্রামের সাধারন মানুষ পাকিস্তানী চর আর ছত্রীসেনা সম্পর্কে সজাগ আছে। স্থানীয় জনগন হাতের কাছে যেই অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছে, তা যোগাড় করে রেখেছে এবং তীক্ষ্ণভাবে সতর্ক আছে। এতে আবারো নিজের চোখে দেখে আশ্বস্ত হলাম যে, বিগত চার সপ্তাহে গ্রামের সাধারন মানুষ নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী পাকিস্তানী আর্মিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রস্তুতি নিয়েছে। স্থানীয় নেতাদের নেতৃত্বে তাঁরা সারা দেশেই নিজেদের সংগঠিত করেছে।
এই এলাকা থেকে মুকতাদা আর মোফাকখের আমাদেরকে তাদের গ্রামে নিয়ে গেল। বর্তমান ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ, মোফাকখের এর ভাই প্রফেসর নোমান এর বাসায় গেলাম। সেখানে ঠিক হলো যে, আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করব তবে রাতেই ভ্রমন করবো। কারন আঁচ করা যাচ্ছিলো যে হয়তো পাকিস্তানী আর্মিরা নদীতে টহল দিচ্ছিলো। ৩০শে মার্চের প্রথম প্রহরে আমরা নৌকায় চড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সাথে ছিল মুকতাদা, মোফাকখের এবং তার তার বড় ভাই মোহাদ্দেস। সে রেডিও পাকিস্তানে কাজ করত। আমরা সেখানে রশিদ আর রহমত উল্লাহকে বিদায় জানালাম। বললাম যে, যদি সম্ভব হয় তবে আমাদের পরিবারের কাছে আমাদের খবর পৌঁছে দিতে।
৩০শে মার্চের ভোরে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামলাম। শহরের রাস্তা ঘুরে প্রথমেই লক্ষ্য করলাম যে বাংলাদেশের পতাকাওয়ালা একটি আর্মি জীপ টহল দিচ্ছে। ঐ সময়েই ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল এক টুকরো স্বাধীন বাংলাদেশ। বুঝাই যাচ্ছিল শহর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রনে। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেখা করার সুযোগও হয়েছিল। সেই বিকেলে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস গ্যাস কোম্পানির রেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মোশারফের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাদের জানালেন যে কিভাবে তিনি তার ইউনিট নিয়ে পাকিস্তানী কমান্ডিং অফিসারকে গ্রেপ্তার করেছেন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে মুক্ত করেছেন। এখন তারা পাকিস্তানী আর্মির আক্রমন প্রতিহত করার পরিকল্পনা করছেন।
মেজর মোশাররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিরক্ষা তদারকি করার সময় আমাদেরকে সাথে নিয়ে গেলেন। যখন রাত নামল, তখন তিনি আমাদের তিনজনকে নিয়ে তিনি তেলিপাড়া চা বাগানের কাছের কমান্ড পোস্টটিতে নিয়ে গেলেন। এটিও পাকিস্তানীদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানী বিমান হামলার ভয়ে সাবধানতাস্বরূপ পুরো এলাকা অন্ধকার করে রাখা হয়েছিল। বাগানের ম্যানেজারদের বাংলোর সব আলো নিভিয়ে রাখা হয়েছিল। সেখানে মেজর মোশাররফ আমাদেরকে তার ব্যাটেলিয়নের এতদূর আসাবার গল্প শোনালেন আর কুমিল্লায় তার বেস ক্যাম্পে বাঙালি সহকর্মীদের ওপর কিভাবে গনহত্যা চালানো হয়েছে, তার বর্ণনা দিলেন। সমস্যা হল, অন্যান্য প্রতিরোধ গড়ে ওঠা এলাকার সাথে তার তেমন যোগাযোগ ছিল না এবং চট্টগ্রামের যুদ্ধের খবর তিনি রেডিওতেই পাচ্ছিলেন।
ঐ রাতে আমরা রেডিওতে শুনলাম যে প্রবাসী বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য অস্ত্র কিনতে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। মোশাররফ আমাদের অনুরোধ করলেন যেন আমরা সীমানা পাড়ি দিয়ে ভারতীয় কতৃপক্ষের কাছে আরও গোলাবারুদ সরবরাহের অনুরোধ জানাই এবং প্রবাসী বাঙালিদের সংগৃহীত অর্থ দিয়ে বিদেশ হতে অস্ত্র কিনতে সাহায্য করি। মোশাররফ আশংকা করছিলেন যে তাদের প্রতিরক্ষা শক্ত হলেও শীঘ্রই যদি তারা যদি আরো অস্ত্র নতুন সরবরাহ না পায় তাহলে পাকবাহিনীর সামনে তাঁরা টিকতে পারবে না। তিনি আমাদেরকে আরও জানালেন যে তিনি এবং তার অন্যান্য অফিসাররা বিদ্রোহীদের অবস্থানে আছেন। তারা বেসামরিক কর্তৃপক্ষের দিক নির্দেশনা চান। তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন যে সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের অধীনে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল অফিসার এবং অন্যান্যদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী গঠন করা যেতে পারে। এমন একটি কতৃপক্ষ গঠন করার মত ক্ষমতা যে আমার ছিল না, খালেদ সেটা জানতো না। তবে আমাকে জোর করল যেন নির্বাচিত কোন রাজনৈতিক নেতার দেখা পেলে অন্তত তাকে যেন আমি এই সংবাদটি পৌঁছে দিই। ঐ সময়েই, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করে, ক্যান্টনমেন্ট এ ফেলে আসা পরিবারের নিরাপত্তা ভুলে এগিয়ে আসা এই নিষ্ঠাবান সৈনিকদের দেখে আমরা অভিভূত হয়েছিলাম।
পরের দিন অর্থাৎ ৩১ শে মার্চ ভোরবেলা, মেজর মোশাররফ একটি জিপে করে আমাদের ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় পাঠিয়ে দিলেন। মনে হলো, ততদিনে সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়েছে এবং মানুষ নির্বিঘ্নে পারাপার করছিল।
আগরতলায় আমরা জানতে পারলাম যে, বাংলাদেশীদের এক বিরাট বহর স্পোর্টস স্টেডিয়ামে অবস্থান করছেন। সেখানে আমরা এম আর সিদ্দিকি, তাহের উদ্দিন ঠাকুরসহ অনেক আওয়ামীলীগ সংসদ সদস্য এবং চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লা থেকে আসা অনেক ছাত্র-শ্রমিকের দেখা পেলাম।
জানতে পারলাম যে এম আর সিদ্দিকী এবং ঠাকুর ঐদিন সন্ধ্যায় ভারত সরকারের কাছে গণহত্যার বিষয়াদি তুলে ধরার জন্য ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীকে সাথে নিয়ে প্লেনে চেপে দিল্লী যাচ্ছেন। তারা ভারত সরকারের কাছে বাঙালিদের প্রতিরোধ ধরে রাখার জন্য সহায়তা চাইবেন। সিদ্দিকীর কাছে শুনলাম অন্যান্য আওয়ামীলীগ নেতারা বেঁচে আছেন কিংবা থাকলে কে কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি নিজে চট্টগ্রামে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং শুধু সেই প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করার জন্যে সামরিক সহায়তা চাইতে ত্রিপুরায় এসেছেন ।
সিদ্দিকী এবং ঠাকুরের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, তাদের নিজেদের তেমন দিল্লীতে উচ্চ পর্যায়ে জানাশোনা নাই। তারা অনুধাবন করল আনিস এবং আমার ভারতীয় কয়েকজন বড় বড় অর্থনীতিবিদদের সাথে পরিচয় নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সমস্যা গুরুত্বের সাথে তুলে ধরতে সহায়তা করবে। সুতরাং সন্ধ্যায় এম আর সিদ্দিকীদের সাথে আমাদেরও যেতে রাজী করানো হলো। সেখানে যেতে আগরতলা থেকে দিল্লী পর্যন্ত বিমান ভ্রমনে আমাদের একমাত্র সম্বল ছিল ধার করা পাজামা পাঞ্জাবি।
৩১শে মার্চ, ১৯৭১-এ দিল্লীতে নেমে আনিস এবং আমি অমর্ত্য সেনকে ফোন করলাম। তিনি তখন দিল্লীর অর্থনীতি বিষয়ক অধ্যাপক ছিলেন। তিনি এবং তার স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে আমাদেরকে তাদের দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় নিয়ে গেলেন। পরদিন সকালে প্রফেসর সেন আমাদেরকে তৎকালীন ভারত সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সিপিএম সরকারের অর্থমন্ত্রী ডঃ অশোক মিত্রের বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। ডঃ মিত্র তৎক্ষণাৎ আরেকজন সুপরিচিত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর পি এন ধর কে ডেকে পাঠালেন। প্রফেসর ধর তখনকার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর একজন সচিব ছিলেন। প্রফেসর ধরকে আমি এবং আনিস যতটুকু জানতাম গণহত্যার পটভূমি, ঢাকায় গণহত্যার ব্যাপকতা এবং বাংলাদেশীদের প্রতিরোধের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত বললাম। প্রফেসর ধর আমাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব পি এন হাকসারের নিকট নিয়ে গেলেন, যার কাছে আমরা আমাদের কথাগুলো পুনরায় বললাম।
আমরা জানি না যযে এটাই স্বাধীনতা সম্পর্কে ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ে প্রথম যোগাযোগ কিনা। তবে যে সময়ে আমরা দিল্লী গিয়েছিলাম, সে সময়ে তাজউদ্দীন আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল হকও দিল্লীতে গিয়ে আরও নানান দিক তুলে ধরে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ মজবুত করেছিলেন। পৌঁছানোর পরপরই আমাকে তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হয়। তিনি আমাকে বললেন যে তিনি নিজেই জানেন না যে তার কোন কোন সহকর্মী বেঁচে আছেন। তিনি বললেন যে আর্মি অভিযানের আগাম খবর পেয়ে কিভাবে আমিরুল ইসলাম, ডঃ কামাল হোসেন আর তিনি ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে গিয়েছিলেন। তারা চেষ্টা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের সাথে যেতে অস্বীকার করেছিলেন এবং তাদেরকে আত্মগোপন করতে বলেছিলেন। তাজউদ্দীন এবং ইসলাম তখন কামাল হোসেনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে ধানমন্ডিতে লুকিয়ে ছিলেন। এরপর তাদের সকল যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। পরবর্তীতে তাজউদ্দীন এবং ইসলাম কুষ্টিয়া হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন।
দিল্লীতে থাকাকালীন রেডিওতে ডঃ কামাল হোসেনকে পাকিস্তানী আর্মিদের বন্দী করার খবর শুনে আমরা বিচলিত হয়ে পড়ি। যাহোক, ততদিনে আমরা জানতে পারলাম যে একের পর এক আওয়ামীলীগ এর একজন বড় নেতারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে এসে পড়ছেন। তাজউদ্দীন আহমেদ স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেবার জন্য দ্রুত তাদের সাথে দেখা করতে বিমানে চড়ে সীমান্তে চলে আসার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন।
এমন একটি সরকারকে কার্যকরী ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে একটি আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখিত হওয়া প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণা যা প্রথমে আওয়ামীলীগের আব্দুল হান্নান এবং পরে মেজর জিয়াউর রহমান রেডিওতে সম্প্রচার করেছিলেন, সেটা এখন আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত করে দিতে হবে।
তাজউদ্দীন আহমেদ আমাকে নির্ভরতার সাথে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং এর প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশীদের ওপর পাকিস্তানী আর্মির গণহত্যা সংক্রান্ত আরেকটি বিবৃতি রচনার দায়িত্ব দিলেন। এগুলো ঐতিহাসিক দলিল হতে যাচ্ছে ভেবে আমি বেশ উত্তেজনার সাথে দায়িত্বটি নিলাম। মূল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বিষয়বস্তু এবং খালেদ মোশাররফ এর সেই অনুরোধ এর ওপর ভিত্তি করে আমার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচিত হল। (খালেদ মোশাররফের অনুরোধটি ছিল, যেসব বাঙালিরা এতদিন পাকিস্তানী আর্মিতে কর্মরত থাকার পরে ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ এর পর বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করছে তাদেরকে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের আর্মিতে অন্তর্ভুক্ত করা সংক্রান্ত)।
পরবর্তীতে জানলাম যে আমার রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি এ ধরনের দলিলের আইনগত ঘাটতি পূরণের জন্য সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু আমার দেয়া কয়েকটা উপাদান দিয়েই ঘোষণাপত্রের মূল অংশটি রচিত হয়েছে। যাই হোক, পটভুমির সম্পর্কিত আমার রচিত বিবৃতিটি অবিকৃত রইল এবং কুষ্টিয়ার সেই বাগান, যা আজ মুজিবনগর বলে পরিচিত, সেখানে ১৪ই এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমেদ বিশ্ববাসীর কাছে এটিই তুলে ধরেছিল। সেখান থেকে যে বাক্যটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে তা হল, “পাকিস্তান মরে গেছে আর পর্বতসমান লাশের নিচে চাপা পড়েছে” যেটি ছিল সে সময়ে আমার সত্যিকারের অনুভূতি। এটি ছিল আমার পরবর্তী সকল কাজের ভিত্তিস্বরূপ।
তাজউদ্দীন এবং ইসলাম এর সাথে অবস্থানকালে বিবিসিতে শুনলাম যে পাকিস্তানে দাতাগোষ্ঠীর কাছে নবায়নকৃত সহায়তা প্রার্থনার জন্য এক জরুরী মিশনে এম এম আহমেদ ওয়াশিংটন যাচ্ছেন। তাজউদ্দীন আহমেদ বুঝলেন যে আমাদের রাজনৈতিক সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে বৈদেশিক সহায়তার নামে এই যুদ্ধে অর্থায়ন প্রতিহত করতে হবে। তাজউদ্দীন আমাকে দায়িত্ব দিলেন যত শীঘ্র সম্ভব লন্ডন এবং ওয়াশিংটন গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের প্রধান প্রধান দাতাদেরকে পাকিস্তানকে সহায়তা প্রদান বন্ধের আহবান জানাতে। আমার দ্বিতীয় দায়িত্ব ছিল পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত সকল বাঙালি কর্মকর্তাদের ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করাতে। আমেরিকার মিশন আমার বিশেষ লক্ষ্য ছিল। কারন দক্ষ বাঙালি অফিসারদের অনেকেই সেখানে অবস্থান করছিলেন। তাদের নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়া বিরাট গুরুত্ববহ একটি প্রচারণা হবে এবং বাংলাদেশের জন্যেও সহায়ক হবে।
এপ্রিলের মাঝামাঝি আমি লন্ডন পৌছাতে পারলাম। সেখানে গিয়ে আমি জানতে পারলাম যে আমার স্ত্রী তিন সন্তানকে নিয়ে পাকিস্তান থেকে বের হতে পেরেছে এবং তারা এখন জর্ডানে তার বোনের কাছে আছে। খবরটা শুনে আমি পুরোপুরি নির্ভার বোধ করলাম। এখন আমি প্রকাশ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলতে পারব। লন্ডনে আমি তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করলাম। লন্ডনে যারা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন এবং গনহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন, তিনি তাঁদের মাঝে অন্যতম ছিলেন।
লন্ডনের এক সাংবাদিক ব্রায়ান লেপিং এর সাহায্যে আমি ব্রিটিশ লেবার পার্টির সাথে যোগাযোগ করে হাউস অফ কমন্সে একদল লেবার পার্টির এমপির সামনে বক্তৃতা দিয়েছিলাম। সেখানে পাকিস্তান সরকারকে সহায়তা বন্ধের জন্য ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টিকে চাপ দেবার ওপর আমি জোর দিয়েছিলাম। তারা খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব দেখালো। পরে আমি হাউস অফ কমন্সে লেবার পার্টির তৎকালীন ছায়া মুখপাত্র ডেনিস হিলে-র সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম।
আমার স্ত্রীর পরিবারের সাথে পরিচিত স্যার ডগলাস ডডস পার্কারের মাধ্যমে আমি টরি সরকারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়েছিলাম। তিনি আমাকে তৎকালীন টরি সরকারের পররাষ্ট্র সচিব স্যার আলেক ডগলাস হোম এর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দিতে পারতেন। উনিও আমার স্ত্রীর পরিবারের পরিচিত ছিলেন। ডড্স পার্কার বললেন যে বাংলাদেশের ঘটনাবলীর খবর তিনি পররাষ্ট্র সচিবকে পৌঁছে দিবেন এবং তিনি তা করেছিলেন। কিন্তু পররাষ্ট্র সচিবের কাছ থেকে আমি কখনোই সরাসরি সাড়া পাইনি। তিনি বাংলাদেশের “বিদ্রোহী” সরকারের একজন মুখপাত্রের সাথে আলোচনার রাজনৈতিক ঝুকি নিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। পরবর্তীতে আমি তার ব্যক্তিগত সচিব নিকোলাস বেরিংটনের মাধ্যমে আবার চেষ্টা চালিয়েছিলাম। উনি আমার পূর্বপরিচিত ছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। তবে বাংলাদেশের ব্যাপারে সব তথ্য পররাষ্ট্র সচিবের কাছে পৌঁছানোর ব্যাপারে বেরিংটন আমাকে বেশ সাহায্য করেছিলেন।
ওদিকে, এম এম আহমেদ আসার পরে ওয়াশিংটনেই ঘটছিল আসল ঘটনা। আমরা জানতে পারলাম যে পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্য শোচনীয় হয়ে পড়েছিল এবং জরুরী ভিত্তিতে বিদেশী সাহায্যের দরকার ছিল। বাংলাদেশের পাট রপ্তানী আর রাজস্ব বাধাগ্রস্থ হওয়াতে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য নতুন সাহায্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল।
এপ্রিলের শেষে আমি আমেরিকায় পৌঁছালাম। সেখানে দৈবক্রমে আমার সাথে প্রফেসর নুরুল ইসলাম এবং প্রফেসর আনিসুর রহমানের সাথে দেখা হয়ে গেল। তারা নিজেদের মত করেই সেখানে গিয়েছিলেন। প্রফেসর ইসলামের ঢাকা ছেড়ে আসাটা রীতিমত নাটকীয় ছিল। তিনি অবশ্য রওয়ানা হবার আগে দিল্লীতে আমার সাথে একবার দেখা করেছিলেন।
আমি বিশ্ব ব্যাংকে কর্মরত একজন সিএসপি অফিসার হারুন উর রশীদকে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন গেলাম। বিমানবন্দরে পাকিস্তানের ওয়াশিংটন দূতাবাসের অর্থনীতি বিষয়ক মিনিস্টার এ এম এ মুহিত আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। সেদিন সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন দূতাবাসের সমস্ত বাঙালির সাথে সাক্ষাৎ করলাম। সেই সম্মানিত গ্রুপের প্রধানদের মধ্যে ছিলেন মরহুম এনায়েত করিম, শামসুল কিবরিয়া যিনি পরে পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন, প্রফেসর আবু রুশ্দ মতিনুদ্দিন যিনি সেখানকার শিক্ষা বিষয়ক কর্মকর্তা ছিলেন, মোয়াজ্জেম আলী যিনি সম্ভবত তৃতীয় সচিব ছিলেন, বেশ কয়েকজন নন-পিএফএস অফিসার যেমন রুস্তম আলী, রাজ্জাক খান এবং শরিফুল আলম। ঐ সময় এদের কেউই ইস্তফা দেননি। তারা সকলেই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে গোপনে ইউএস কংগ্রেস সদস্য, এমনকি স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর লোকজনের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছিলেন। আমি তাদের কাছে তাজউদ্দীন আহমেদের ইস্তফা দেবার আহবান পৌঁছে দিলাম। তারা সকলেই এতে রাজী ছিলেন। কিন্তু পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশী জনতার নিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁরা আশ্বস্ত হবার পাশাপাশি তাদের ইস্তফার ফলে যে বাস্তবধর্মী সমস্যার সৃষ্টি হবে, সে সংক্রান্ত ব্যাপারেও আশ্বস্ত হবার নিশ্চয়তা চাইছিলেন। এর আগ পর্যন্ত তাঁরা বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলতে রাজি হলেন, তবে তা জনসম্মুখে নয়।
এ সময় রাজ্জাক খান, শরিফুল আলম এবং একজন বাংলাদেশী ছাত্র মহসিন সিদ্দিকী পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ করে দেবার জন্য আমার আহবান প্রচারে প্রেস, টিভি এবং কংগ্রেস এর সাথে যোগাযোগের কাজে প্রকাশ্যে নেমে পড়লেন। আমাকে মোক্ষম সময়ে বেশ কয়েকবার টিভি তে উপস্থিতির সুযোগ দেওয়া হল যা বাংলাদেশের জন্য প্রচারণায় বেশ মুল্যবান ছিল। বিশেষ করে ওয়ারেন উনা নামের একজন জনপ্রিয় সাংবাদিক এবং টিভি ভাষ্যকার এ কাজে অনেক সাহায্য করেছেন। পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত থাকা সত্ত্বেও রাজ্জাক এবং আলম আমার জন্য এক ধরণের সচিবালয়ের মতোই কাজ করেছিলেন।
প্রেসে আমি কথা বলেছিলাম ওয়াশিংটন স্টারের হেনরি ব্রেডশার, ওয়াশিংটন পোস্ট এর লুইস সিমন, বাল্টিমোর পোস্ট এর এডাম ক্লাইমার, নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেন ওয়েলস এবং একটি বড় সাপ্তাহিক, নিউ রিপাবলিকের গিলবার্ট হ্যারিসনের সাথে। এগুলো ওয়াশিংটনের প্রধান প্রধান পত্রিকা ছিল এবং এ পত্রিকাগুলোর কলাম লেখকেরা কংগ্রেস এর মতামতে অনেক প্রভাব রাখতেন। এম এম আহমেদের ওয়াশিংটনে অবস্থানকালীন সময়ে পাকিস্তানে গণহত্যা বন্ধ না করা পর্যন্ত সাহায্যের প্রতিশ্রুতি বাতিল করার জন্য অনুরোধ করে প্রায় একই সময়ে চারটি প্রধান পত্রিকায় সম্পাদকীয় ছাপানোর ঘটনা ছিল বাংলাদেশের জন্য এক বড় ধরনের অভ্যুত্থান।
আমি কংগ্রেসেও সক্রিয় ছিলাম। এখানে আমি ঐ সময়ে বাংলাদেশের জন্য দুজন সক্রিয় সমর্থক সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এবং সিনেটর ফ্রাংক চার্চ এর সংস্পর্শে ছিলাম। উনারা সিনেট বৈদেশিক সম্পর্কে কমিটির পদধারী সদস্য ছিলেন। সিনেটর চার্চ এর সহকারী টম ডেইন, সাথে সিনেটর কেনেডির সহকারী গেরি টিঙ্কার এবং ডেইল ডেইহেন বাংলাদেশের জন্য সক্রিয় মুখপাত্রের ভুমিকা পালন করার ফলে এদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন। তাদের মাধ্যমে আমি বেশ কয়েকজন সিনেটরের সাথে সাক্ষাৎ করি। সে সময় কেনেডি, চার্চ এবং গেলাঘেরের নেতৃত্বে প্রতিনিধি পরিষদে কংগ্রেসম্যান এবং সিনেটররা পাকিস্তানে গণহত্যার নিন্দা জানানো এবং পাকিস্তানে সাহায্য স্থগিতের জন্য জোর দাবী জানান। তথ্য ও উপাত্তসহ এইসব বিবৃতির অনেকগুলো এবং ২৬ শে মার্চ এর পর বাংলাদেশ হতে প্রেরিত চিঠিগুলো কংগ্রেশনাল রেকর্ডে স্থান পায়।
এ পর্যায়ে আমি জানতে পারলাম যে সিনেটর সিমিংটনের নেতৃত্বে আমার পুরনো পাকিস্তানী বন্ধুরা একটি চা চক্রের আয়োজন করছেন যেখানে এম এম আহমেদ সিনেটরদের নিকট পাকিস্তানের ঘটনাবলী ব্যাখ্যা করতে পারবেন। সেখানে গুটিকয়েক লোকজন এসেছিলেনও বটে কিন্তু হিলে আমার বন্ধুরা বললো যে আমাদেরও এরকম কিছু একটা করা উচিত। চার্চ এবং কেনেডি যেহেতু ডেমোক্রেটিক পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নেতৃস্থানীয় তাই সিনেটের প্রায় মধ্যপন্থী একজনকে দিয়ে আমার সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজনের চিন্তা করা হল, যাতে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেটিক দু’দলের লোকদেরই টানা যায়। ওহাইয়োর সিনেটর স্যাক্সবি এটি আয়োজনে রাজী হলেন। এতে এম এম আহমদের পার্টির চাইতে সংখ্যায় বেশী এবং অনেক গুরুত্বপূর্ন সিনেটরদের সমাগম শুরু হলো। এর ফলে অন্যান্য অনেকের মাঝে সিনেটর চার্চ, ফুলব্রাইট, সিনেট বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির সভাপতি, সিনেটের সংখ্যালঘিষ্ঠ দল রিপাবলিকান পার্টির নেতা সিনেটর স্কটের সামনে আমার কথা বলতে পেরেছিলাম। পাকিস্তানী গণহত্যার বাস্তব প্রেক্ষাপট এবং পাকিস্তানের প্রধান দাতা হিসেবে এতে আমেরিকার দায় সংক্রান্ত আমার বক্তব্য আমেরিকান রাজনীতির এইসব গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিরা ধৈর্য সহকারে শুনেছিলেন। সিনেটে আমাদের এইসব প্রাথমিক পদক্ষেপের ফলাফল হিসেবে মার্কিন বৈদেশিক সহায়তা বিলে স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনী আনা হয়। বাংলাদেশে গণহত্যা চলাকালীন পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য বন্ধ রাখাই এর উদ্দেশ্য ছিল। তবে এটাও অনেক পরের ঘটনা, আমাদেরকে এর জন্য আরও যুদ্ধ করতে হয়েছিল।
সিনেটে আমাদের সাফল্য দেখে এম এম আহমেদ ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করতে যাচ্ছেন বলে শুনলাম। এতেও তাকে হারাবো বলে আমরা ঠিক করলাম। রাজ্জাক খান এবং তার সহযোগীদের সহায়তায় আমাদের নিজস্ব সম্মেলন আয়োজন করে তা পেরেওছিলাম। এতে প্রেস, রেডিও এবং টিভি প্রতিনিধির ভালোই উপস্থিতি ছিল। ভয়েস অফ আমেরিকা আমার উদ্ধৃতি নিয়ে সারা বিশ্বজুড়ে প্রচার করেছিল। ডন পত্রিকার প্রতিনিধি নাসিম আহমেদ (যিনি পরে ভুট্টোর অধীনে তথ্য সচিব হয়েছিলেন) এবং সাথে আরেকজন সাংবাদিক কুতুবউদ্দিন আজিজ আমার প্রচারণা ভণ্ডুল করার জন্য গিয়েছিলেন। নাসিম আহমেদ আমার প্রেস কনফারেন্সে ছিলেন। কিন্তু আমাকে কোন সিরিয়াস প্রশ্ন করার চেয়ে উনি বরং কে কে সেখানে উপস্থিত আছেন, তা দেখতেই বেশী মনযোগী ছিলেন। আমাদের প্রেস কনফারেন্সের সার্থকতা এবং বাংলাদেশকে যেভাবে তুলে ধরা হচ্ছিল তা দেখে এম এম আহমেদ আশাহত হয়ে গেলেন আর পরবর্তীতে নিজের কনফারেন্স বাতিল করলেন।
মার্কিন কংগ্রেস এবং মিডিয়া আমাদের কথা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে শুনলেও নিক্সন প্রশাসনের উপরের স্তরে যাওয়াটা অনেক বেশী কঠিন ছিল। আমরা হেনরি কিসিঞ্জারের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের দিকে নজর দিলাম। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সেমিনারগুলোতে অনেক বাঙালিদের পড়িয়েছেন। তাই ভাবলাম স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তার ভাল ধারণা থাকবে। শীঘ্রই আমরা বুঝতে পারলাম যে বাংলাদেশের জন্য আমেরিকার প্রশাসনের দরজা বন্ধ। পরামর্শ পেলাম যে ক্যামব্রিজে গিয়ে কিসিঞ্জারের সাবেক সহকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য, যদি তাঁদের সহায়তায় কিসিঞ্জারের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়। তারা স্বনামধন্য কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ছাড়াও কিসিঞ্জারের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে বিবেচিত, যেমন অধ্যাপক ডর্ফম্যান। সরকারি অধিদপ্তরের অধ্যাপক স্যামুয়েল হান্টিংটনের সাথেও আমি দেখা করেছিলাম। তিনি কিসিঞ্জারের সহকর্মী ছিলেন। এছাড়া হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের প্রফেসর লজ এর সাথেও আমি দেখা করেছিলাম। উনি কিসিঞ্জারের আরেকজন নিকট বন্ধু ছিলেন। এসব যোগাযোগের কোনটিই তেমন কাজে লাগেনি।
ওয়াশিংটনে কর্মকর্তা পর্যায়ে আমি এনায়েত করিমের বাসায় সর্বোচ্চ দেখা করতে পেরেছিলাম ক্রেইগ বেক্সটারের সাথে। উনি ছিলেন স্টেট ডিপার্টমেন্টে বাংলাদেশ ডেস্কের কর্মকর্তা ছিলেন। আমি তৎকালীন বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক টম হেক্সনারের সহায়তায় ইউএস এইড এর ডেপুটি ডিরেক্টর মরিস উইলিয়ামসের সাথেও দেখা করেছিলাম। উইলিয়ামসের মাধ্যমে পাওয়া মেসেজটির জন্য এই সাক্ষাৎকারটি আমার বিশেষভাবে স্মরণে আছে। সেটি ছিল এই যে, বাংলাদেশ যদি চায় যে তার ব্যাপার ওয়াশিংটন আরও গুরুত্ব দিবে। তবে তাকে সামরিক সক্ষমতা প্রমান করতে হবে।
ওয়াশিংটনে আমার অন্যতম লক্ষ্য ছিল বিশ্বব্যাংক। এটি ছিল পাকিস্তানে দাতাগোষ্ঠীসমূহের প্রধান এবং প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রধান মুখপাত্র।
বিশ্বব্যাংকে আমার প্রথম যোগাযোগ মাধ্যম ছিল তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ইংরেজ আই পি কারগিল যিনি পাকিস্তান কনসোর্টিয়ামের সভাপতি এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি আই সি এস এর সময় থেকে এম এম আহমেদ এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং পাকিস্তানের ঘটনাবলী সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী অবগত ছিলেন। প্যারিসে অনুষ্ঠিত কনসোর্টিয়ামের সাম্প্রতিক সম্মেলনে কারগিল এর উপদেশে সদস্যরা একমত হন যে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত মিশনের রিপোর্ট না দেওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানে সহায়তা বন্ধ রাখা হবে। কারগিল আমার কথা দীর্ঘ সময় ধরে শুনেছিলেন এবং তার প্রত্যুত্তর দেখে আমি বুঝেছিলাম যে, বাংলাদেশে মিলিটারি কার্যক্রম বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত নতুন কোন সাহায্যের প্রতিশ্রুতির দেয়ার সম্ভাবনা নেই।
কারগিল এর পরে আর থাকে শুধু বিশ্ব ব্যাংকের স্বর্গীয় প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা। বিশ্বব্যাংকের বন্ধুদের অনেক প্রচেষ্টার পর ম্যাকনামারা আমার সাথে সাক্ষাতে রাজী হয়েছেন বলে আমাকে জানানো হল। আমাকে বলা হল যে তার কম্পিউটারের মতো প্রখর মস্তিষ্ক শুধু প্রামাণ্য তথ্যগুলোই গ্রহণ করে এবং সেগুলো আমাকে যতদূর সম্ভব সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করতে হবে। এর প্রস্তুতি হিসেবে ওয়াশিংটনে অন্যান্য বাংলাদেশীদের সহায়তায় আমি পাকিস্তানে সহায়তা বন্ধের জন্য একটি নিবন্ধ প্রস্তুত করলাম। পেপারটি পরে মুদ্রন করে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। আমার যতদূর মনে আছে পেপারটির শিরোনাম ছিল “ পাকিস্তানে সহায়তাঃ পেছনের কথা এবং ভবিষ্যতের বিকল্প”। আমাদের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় যখন এটি তুলে ধরা হলো, তখন মনে হলো ম্যাকনামারার মানবিক দিকটি হয়তো নাড়া দিয়েছিল। অন্তত উনি আমাকে সংকটের তীব্রতায় সত্যিকার উদ্বেগ দেখিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ম্যাকনামারার ভূমিকা আলাদা করে দেখার অবকাশ ছিল না। যা দেখা গিয়েছিল তা হলো, বিশ্বব্যাংক পাকিস্তানে একটি মিশন পাঠিয়েছিল এবং মিশনটি তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে পাকিস্তান আর্মির ভয়াবহ নৃশংসতার বিবরণ ছিল। সাথে ছিল সেখানে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ভেঙ্গে পড়ার চিত্র। হারুন উর রশীদ এর ফাঁসকৃত সেই রিপোর্টটি নিউইয়র্ক টাইমস এ প্রকাশিত হয়েছিল। এটি আমেরিকার অভ্যন্তরে স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনীর পক্ষে লবিস্টদের অনেক সাহায্য করেছিল এবং ১৯৭১-এর জুনে পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়ামের সদস্যদের নতুন সাহায্য প্রদান থেকে বিরত থাকতে প্রভাবিত করেছিল।
কংগ্রেস, বিশ্বব্যাংক এবং মিডিয়ার বাইরে আমি আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশী কমিউনিটির গড়ে ওঠা কিছু দলের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। তাদের মধ্যে প্রধান একটি গ্রুপ, যার সভাপতি ছিলেন প্রয়াত এফ আর খান, বাংলাদেশের পক্ষে আমেরিকায় জনমত গঠন আর স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহে কাজ করছিলেন।
আমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল এসব গ্রুপের সংগৃহীত তহবিল হতে ওয়াশিংটনে পাকিস্তান মিশনে এবং নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত বাঙালিদের ইস্তফা দানের পর সহায়তা প্রদানের জন্য তাদের আশ্বস্ত করা। বাঙালি কমিউনিটি এবং মিশনে কর্মরত বাঙালিদের মধ্যে কিছু ভুল বুঝাবোঝি ছিল যা আমি দূর করার চেষ্টা করেছিলাম। ওয়াশিংটনে আমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল মিশনের সকল সদস্যকে একত্র করা, তাদের চলার জন্য আর্থিক প্রয়োজনের প্রাক্কলন করা এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যাতে তারা কাজ পারে, সেরকম একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো। একটা তারিখও ঠিক হয়েছিলো, সম্ভবত ১লা জুলাই, যেদিন তারা একত্রে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাহার করবেন এবং বাংলাদেশের জন্য দায়বদ্ধতা প্রকাশ্যে ঘোষনা করবেন। ওয়াশিংটন থেকে আমি নিউইয়র্কে গেলাম। সেখানে বাঙালি কমিউনিটির প্রতিনিধিদের সাথে কথা বললাম। এছাড়া শিকাগোতে এফ আর খানের সাথে কথা বলে আমেরিকায় বাংলাদেশ মিশনের জন্য তাদের সংগৃহীত তহবিলের একটা অংশ বরাদ্দ দিতে অনুরোধ করলাম।
এসব বড় বড় কাজের পাশাপাশি যেটুকু সময় আমার অবশিষ্ট থাকতো, তাতে আমি বিভিন্ন ব্যক্তি কিংবা গ্রুপের সাথে মিটিং করতাম যাদেরকে কোন না কোনভাবে বাংলাদেশের জন্য কাজে লাগানো যেত। নিউইয়র্কে আমি সাক্ষাৎ করেছিলাম নিউইয়র্ক টাইমসের জিম ব্রাউনের সাথে যিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনামুলক নিবন্ধ লিখেছিলেন।
আমি পরে আরও কয়েকবার টিভিতে গিয়েছিলাম। সুলতানা আলমের আমন্ত্রনে আমি ফিলাডেলফিয়ায় একটি অত্যন্ত মূল্যবান সফরে গিয়েছিলাম। ক্রিপেনডর্ফে তার তৈরি করা বাংলাদেশের সমর্থনে গঠিত একটি গ্রুপের সামনে ভাষণ দিয়েছিলাম। অন্যান্য বাঙালিদের দ্বারা আয়োয়িত বাঙালিদের কিংবা আমেরিকানদের অনেক গোষ্ঠীও শ্রোতা হিসেবে প্রস্তত থাকতো।
আমেরিকায় আমার অবস্থানের শেষের দিকে একটি বাঙালি কর্মী গোষ্ঠীর আমন্ত্রণে একদিনের জন্য অটোয়াতেও গিয়েছিলাম। তারা মনে করেছিল যে বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র হিসেবে সেখানে আমার উপস্থিতি তাদের কাজে লাগবে। অটোয়াতে পৌঁছেই আমি একটি জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন করলাম। এরপর অটোয়ার কয়েকজন সংসদ সদস্যর সাথে দুপুরের খাবারে অংশগ্রহণ করলাম যেখানে সংসদের বিরোধী দলীয় ছায়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী সভাপতিত্ব করেছিলেন। বিকেলে একটি ব্যক্তিগত ক্লাবে মন্ত্রীসভার একজন সদস্যের সাথে গোপন বৈঠকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। মন্ত্রী হিসেবে তিনি আমার সাথে প্রকাশ্যে আলোচনা করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু তিনি আমার কথা সহমর্মিতার সাথে শুনেছিলেন। সন্ধ্যায় আমি অটোয়াতে একটা বাঙালি গোষ্ঠীর সাথে আলোচনা করলাম। আমার একদিনের অটোয়া সফর পুরো ক্যাম্পেইনে অন্যতম ফলপ্রসূ দিন ছিল।
মে মাসের শেষের দিকে আমি লন্ডন ফিরে এলাম। লন্ডনে আমার স্বল্প সময় অবস্থানকালে দেখলাম যে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত প্রবলতর হচ্ছে। কিউ গার্ডেনসে আমি জুডিথ হার্টের নিজের বাড়িতে দেখা করলাম। তিনি বৈদেশিক সাহায্য বিষয়ক লেবার পার্টির সামনের সারির মুখপাত্র ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি লেবার পার্টির সরকারের সময়ে বৈদেশিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী হন। আমার সাথে আলোচনার পর লেবার পার্টির বিরোধীদলের পক্ষ থেকে তিনি হাউস অফ কমন্সে একটি শক্তিশালী বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি দাবী করেন যে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত নেতাদের সাথে একটি আলোচনা অনুষ্ঠিত হবার আগ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য হতে পাকিস্তানে যেন আর কোন সাহায্য পাঠানো না হয়।
টরি এবং লেবার উভয় দলেরই বেশ কয়েকজন এমপির সাথে আমার ভাব বিনিময় করার সুযোগ হয়েছিল। এছাড়া আবারো স্বল্প পরিচিত নিকোলাস বেরিংটনকে ব্যবহার করে স্যার এলেক ডগলাস হোমের কাছে আমাদের চিন্তাভাবনা পৌঁছে দেয়ার সুযোগ হয়েছিল। এছাড়া প্যারিসে অনুষ্ঠিত কনসোর্টিয়ামে যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিয়োজিত কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে আমি কথা বলি এবং তাদের স্মারকলিপি পৌঁছে দিই।
ওয়াশিংটনে ম্যাকনামারা এবং মার্কিন কংগ্রেস এর কাছে পাকিস্তানে সহায়তা বন্ধ করার জন্য যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল, সেগুলোই যুক্তরাজ্যে বাঙালি কমিউনিটির প্রচারনায় মূল প্রচারণা প্রেক্ষাপট হয়ে দাঁড়ালো। যুক্তরাজ্যে প্রচুর প্রবাসী বাঙালি অবস্থান করছিলেন। তারা তহবিল সংগ্রহে আর পাকিস্তানে সহায়তা বন্ধের জন্য জনমত গঠনে বেশ সক্রিয় ছিলেন। এজন্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রধান মুখপাত্রের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এবং পূর্ব লন্ডনের লিভারপুল স্ট্রিট ষ্টেশনের কাছে তিনি আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য একটি অফিস খুলেছিলেন।
সেবার এবং পরবর্তীতে লন্ডন সফরগুলোতে গঙ্গা রেস্টুরেন্ট-এর মালিক তাসাদ্দুক আহমেদ এবং তার স্ত্রী রোজমেরি আমার জন্য মিটিঙের আয়োজনে অনেক সাহায্য করেছেন এবং গেরাদ স্ট্রিটে রেস্টুরেন্ট এর উপরে তাদের গুদামঘরটি একরকম আমাদের লন্ডন অফিসের মতোই ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। সেখানে কয়েকটি মজার ঘটনা ঘটেছিল। নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নির্বাসিত নেতা ফিযো এর সাথে একটি আলোচনার আয়োজন করা হল এই ভেবে যে, তার সাথে বেইজিংয়ে চীন প্রশাসনের একটি সংযোগসূত্র ছিল। তাই বাংলাদেশের আন্দোলন সম্পর্কে তার মাধ্যমে চিনকে অন্যান্যবারের চেয়ে আরো পরিষ্কারভাবে জানানো যাবে। ফিযো আলোচনার সময় গঙ্গা রেস্টুরেন্টে তার মেয়েকে নিয়ে এলেন। আলোচনায় মনে হচ্ছিলো যে তিনি চাইনিজদের সাথে আমাদের ব্যাপারে কথা বলার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার চাইতে নাগাদের পক্ষে আমাকে টানতেই বেশী উদ্বিগ্ন ছিলেন। আলোচনাটি তাই মজার কিন্তু নিষ্ফল ছিল।
যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে আমি বাংলাদেশ বিষয়ে কিছু লেখালেখির সুযোগ পেয়েছিলাম। দ্য নিউ স্টেটসম্যান নামের বামঘেঁষা সাপ্তাহিকীটির সাথে আমি আমার পুরণো যোগাযোগ নবায়ন করলাম আর সেখানে বাংলাদেশে গণহত্যা এবং বৈদেশিক সাহায্যের উপর ইয়াহিয়া সরকারের টিকে থাকার বিষয়ক একটা লেখা পাঠালাম। নিউ স্টেটসম্যানের সম্পাদক পরবর্তীতে আমার লেখার ওপর ভিত্তি করে প্রথম পেজে একটি সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। সেখানে তিনি পাকিস্তানে যুক্তরাজ্যের সব ধরনের সাহায্য বাতিলের আহ্বান জানিয়েছিলেন। সাউথ এশিয়ান রিভিউয়ের সম্পাদক জন হোয়াইট এর অনুরোধে সেখানে একটি লেখা দিয়েছিলাম যাতে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানী আর্মি ঝাঁপিয়ে পড়া পর্যন্ত আলাপ আলোচনার বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করেছিলাম। আমি গার্ডিয়ানেও একটি লেখা পাঠিয়েছিলাম।
আমি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ইউনিয়নে আকবর নরমান এবং তারিক আব্দুল্লাহ নামক দু’জন সহানুভূতিশীল পাকিস্তানীর আয়োজিত একটি বড় বাস্তবধর্মী রাজনৈতিক আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে বহু লোক সমাগম ছিল এবং সেখানে প্রফেসর ড্যানিয়েল থরনিয়ার বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যিনি পিআইডিই (পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব ডিবেলাপমেন্ট ইকনমিক্স)-এর সাথে কাজ করাকালীন ঢাকা অবস্থানসূত্রে পাক আর্মির গণহত্যার একজন সাক্ষী ছিলেন। তিনি পারিসের সরবনে ফিরে এসে বাংলাদেশের জন্য নেতৃস্থানীয় সোচ্চারকন্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। ড্যানিয়েল ছাড়াও অন্য এক পাকিস্তানী তারিক আলী পাকিস্তানী আর্মি কর্মকাণ্ডের জন্য কড়া সমালোচনা করেছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছিলেন। তিনি অবশ্য এই বিপ্লবী উত্থানের মধ্য দিয়ে দুই বাংলা এক হওয়ার সম্ভবনা দেখেছিলেন। পাকিস্তানী আর্মির কড়া সমালোচনা দেখে তাকে গ্যালারীর পেছনদিকের একজন পাকিস্তানী ইন্টেলিজেন্স অফিসার প্রশ্নবানে জর্জরিত করেছিলেন। এই আলোচনায় ভুট্টোর পিপলস পার্টির একজন প্রতিনিধিও বক্তৃতা রেখেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানী যুক্তি তেমন একটা ধোপে টিকে নি। আমি ছিলাম সর্বশেষ বক্তা। শ্রোতাদের কাছ থেকে বেশ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম। সবখানেই এ ধরণের জনসভায় এরকম প্রতিক্রিয়া পাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের ছিল।
লন্ডন থেকে আমি প্যারিসে পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়ামের সেই চরম গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের উদ্দেশ্যে গেলাম। সেটি ছিল খুব সম্ভবত জুনের ৭ তারিখে। বড় চালানের নতুন পণ্য সহায়তা পাবার আশায় পাকিস্তানীরা এই মিটিংটির ওপর নির্ভর করেছিল। যুদ্ধের কারণে তাদের আমদানী সক্ষমতা কমে গিয়েছিল।
প্যারিসে আমি ড্যানিয়েল এবং এলিস থরনারের বাসায় ছিলাম। এই থরনার দম্পতির আশ্রয়ে আরও ছিলেন ডঃ হাসান ইমাম, যিনি পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব ডিবেলাপমেন্ট ইকনমিক্স-এ ছিলেন এবং সম্প্রতি ভারত হয়ে প্যারিসে এসেছেন। ম্যাকনামারার নিকট উপস্থাপিত স্মারকলিপির ওপর ভিত্তি করে ড্যানিয়েল, হাসান ইমাম এবং আমি মিলে কনসোর্টিয়ামের জন্য একটি স্মারকলিপি প্রস্তুত করলাম। তারপরে এটি মিটিংয়ের আগের রাতে প্রত্যেক প্রতিনিধি নেতাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। তাদের মধ্যে আমরা কয়েকজন প্রতিনিধির সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছিলাম। কেউ কেউ আমাদের কথা শুনেছিল। বাকিদের কাছে যাওয়া যায় নি। মিটিংয়ের আগের রাতে আমি ভোটাও নামের আমেরিকান বংশোদ্ভূত বিশ্বব্যাংকের সহকারী প্রধানের সাথে দেখা করেছিলাম। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে কনসোর্টিয়াম নতুন সহায়তা দেবে এমন সম্ভাবনা কম। বিশ্বব্যাংকের সহ-সভাপতি পিটার কারগিলের সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছিল। তিনি সদ্য পাকিস্তান থেকে ফিরেছিলেন। তিনি তার সহকারীর দেয়া মতামতের নিশ্চয়তা প্রদান করলেন কিন্তু আমাকে বললেন মিটিং শেষে দেখা করতে।
কনসোর্টিয়ামে আমাদের তিনজনের তদবিরকারী দল ছাড়াও একদল বাঙালি প্যারিসে মিটিং অনুষ্ঠিত হবার সময় ভবনের সামনে প্রতিবাদ করতে এসেছিলেন। পাকিস্তানে সহায়তা বন্ধের দাবিতে তাদের হাতে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডও উপস্থিত ছিল।
কনসোর্টিয়াম শেষ হবার পরদিন সকালে প্রাতঃরাশের সময় আমি পিটার কারগিলের সাথে পাঁচ তারকা হোটেল রয়েল মন্স্যুতে দেখা করলাম। তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। তিনি আমাকে সুসংবাদ দিলেন যে বাংলাদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানে কোনো নতুন সহায়তা না দেওয়ার ব্যাপারে কনসোর্টিয়ামে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে ঢাকা এবং ইসলামাবাদ ঘুরে কারগিলের দেওয়া রিপোর্টের প্রভাব ছিল। মিটিংয়ে তিনি পাকিস্তানের অত্যন্ত অস্থিতিশীল অবস্থার কথা নিশ্চিত করেছেন। কোনো কোনো সদস্য আরও কড়া কড়া কথা বলেছেন। তবে বেশিরভাগই পাকিস্তানী বর্বরতার বিরুদ্ধে নিজ দেশে জনগনের চাপের মুখে খুশি মনে নতুন সহায়তা প্রদানের জন্য পাকিস্তনের উন্নয়ন পরিস্থিতি নেই মর্মে অজুহাত দেখিয়েছিলেন। মার্কিন প্রতিনিধিদল পাকিস্তানে সাহায্যের দোহাই দেবার চেষ্টা করলেও শক্ত ভাবে বিতর্কে না জড়িয়ে শেষ পর্যন্ত কনসোর্টিয়ামের সিদ্ধান্তের সাথে সহমত পোষণ করেছিল।
পাকিস্তানের জন্য কনসোর্টিয়ামের মিটিংটি ছিল একটি বড় ধরনের ধাক্কা আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজুড়ে চলা সংগ্রামের জন্য ছিল একটি বিরাট জয়।
কনসোর্টিয়ামে কাজ করা ছাড়াও আমার উপস্থিতিকে ড্যানিয়েল প্রভাবশালী ফরাসী বুদ্ধিজীবীদের নিকট বাংলাদেশকে উপস্থাপন করতে কাজে লাগিয়েছিলেন। ফরাসী সাংবাদিকসহ আরও কয়েকজন নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার জরুরী কয়েকটি মিটিং ছিল। যেমন রেয়মন্ড এরম, লুইস ডুমন্ট দ্য সোশাল এন্থ্রোপোলজিস্ট এন্ড দ্য এরাবিস্ট, ম্যাক্সিম রবিনসন। আমি সরবনেও কয়েকটি সেমিনার করেছিলাম। আমরা জানতে পারলাম যে ফ্রান্স পাকিস্তানে অস্ত্রের অন্যতম বড় যোগানদাতা। আমাদের লক্ষ্য ছিল প্রভাবশালীদের মতামত জোগাড় করে এসব বিক্রয় বাতিল করা। পরে দেখা গেল পাকিস্তান অস্ত্র সংক্রান্ত তাদের পুরণো দেনা পরিশোধের জন্য যে সময় কাঠামোর পুনর্বিন্যাস চাইছিল, ফরাসী সরকার তাতেই বেশী মনযোগী ছিল। আর্থিক কারনে ক্রমান্বয়ে ফরাসী অস্ত্রের চালান বন্ধ হয়ে গেল।
প্যারিস থেকে আমি রোমে গেলাম। সেখানে স্বল্প সময়ের অবস্থানে আমি বিশ্ব খাদ্য সংস্থা-কে এই বলে স্মারকলিপি দিলাম যে, পাকিস্তানে খাদ্য সাহায্যের যে অংশ বাংলাদেশ অংশের জন্য দেখানো হয়, তা বাংলাদেশ সরকারের নিকট পাঠানো হোক। এরা সীমান্ত পাড়ি দেয়া মানুষগুলোর মাঝে তা বিতরণ করবে। এই উদ্দেশ্যের বাইরে পাকিস্তানে ইতালি সহায়তা বন্ধের জন্য আমি ইতালির তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটস, কম্যুনিস্ট আর সোশালিস্ট কর্তাব্যক্তিদের সাথে কথা বলেছিলাম। ইটালি কিন্তু পাকিস্তান কিংবা অন্য কোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য তেমন বড় দাতা কখনোই ছিল না। এটা শুধু তাদের প্রতি একটি ইশারা ছিল মাত্র।
রোম থেকে আমি কেন্দ্র অর্থাৎ মুজিবনগর সরকারের কাছে আমার প্রচারণার প্রতিবেদন জমা দিতে গেলাম। ১৯৭১ এর জুলাই মাসে সেখানে থাকাকালীন আমি আমার অনেক বন্ধু এবং একাডেমিক সহকর্মীকে দেখতে পেলাম। আমরা ভাবলাম যে, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশনা দেবার জন্য কিছু করা উচিৎ। এই চিন্তা হতে আমি বাংলাদেশের মন্ত্রীপরিষদের কাছে প্রস্তাব করলাম যে, বাংলাদেশ পরিকল্পনা বোর্ড গঠন করা হোক। সদস্য হিসেবে প্রফেসর মোশাররফ হোসেন, প্রফেসর সারওয়ার মুর্শেদ, ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ স্বদেশ বসু এবং আমি থাকব বলে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম। ধারণাটা একসময় গৃহীত হয়েছিল কিন্তু বাস্তবায়িত হতে কিছু সময় নিয়েছিল। একমাস কেন্দ্রে থাকার পর আমি যখন ইউরোপ হতে ফিরে আসি, তখন সমস্ত ধকল গেল প্রফেসর হোসেনের ওপরে। প্রফেসর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী শেষ পর্যন্ত এলেন। তাকে বোর্ড এর সভাপতি করা হল। বোর্ডটি একটি অফিসের জন্য জায়গা আর গবেষণার জন্য অল্প বরাদ্দ খুঁজে পেল এবং যুদ্ধ শেষ হবার কাছাকাছি সময়ে মন্ত্রীপরিষদের জন্য কয়েকটি পলিসি পেপার তৈরির কাজ শুরু করে দিল।
কেন্দ্রে থাকাকালীন আমার সাথে মেজর খালেদ মোশাররফের আবার দেখা হয়েছিল। তিনি ততদিনে বাংলাদেশ আর্মির সদস্য হয়ে গেছেন এবং একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তিনি আমাকে বেলোনিয়ার যুদ্ধের বর্ণনা দিলেন। বললেন যে ব্রিটিশ টিভি সাংবাদিক ভানিয়া কিউলি তাদের সাথেই ছিলেন। এই সাংবাদিককে আমি আগেই লন্ডনে বলেছিলাম যুদ্ধ দেখতে চাইলে খালেদের সাথে দেখা করার জন্য। এরপর আমি মেজর জিয়াউর রহমানকে প্রথম বারের দেখলাম যিনি ছিলেন আরেকজন সেক্টর কমান্ডার। জিয়া তখন ব্যক্তিত্বের দিক থেকে খালেদের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন। জিয়ার কাছ থেকে আমি তার চট্টগ্রামে যুদ্ধের বর্ণনা এবং বর্তমানে যুদ্ধের বিশ্লেষণ শুনলাম। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর এবং ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারের সাথেও আমার দেখা হল।
মুক্তিবাহিনীর যার সাথেই আমার কথা হচ্ছিলো, সবাই তরুণদের মুগ্ধকর গল্প শোনাছিলেন যারা জোয়ারের মতো প্রতিরোধ গড়তে ছুটে এসেছিল। গেরিলা যুদ্ধ কিভাবে সংগঠিত হচ্ছে, তা আমি মেজরদের কাছ থেকে জেনেছিলাম। তাদের সকলেরই একই অভিযোগ ছিল যে, অপ্রতুল আর সেকেলে অস্ত্রগুলোই প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের প্রধান বাঁধা। পরে আমি জানতে পারলাম, সবে আগস্ট মাস থেকে মুক্তি বাহিনীকে অস্ত্র সরবারহের ব্যাপারে ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদেশের মন্ত্রীপরিষদের কাছে আমার প্রতিবেদন জমা দেওয়া আর পরিকল্পনা বোর্ড গঠনের প্রস্তাব দেবার পর আমি পাকিস্তানে সহায়তা বন্ধের জন্য ইউরোপ আমেরিকায় জনমত গঠনের কাজে ফিরে গেলাম। এবার আমার কাছে মন্ত্রীপরিষদের দেয়া অফিসিয়াল কাগজ ছিল যাতে আমাকে ‘অর্থনৈতিক বিষয়াদি সংক্রান্ত বিশেষ দূত’ হিসেবে পদায়ন করা হয়েছিল।
আগস্ট মাসে আমি লন্ডনে ফিরে এসে দেখলাম যে, স্থানীয় বাঙালিদের প্রচারনা তুঙ্গে উঠেছে। ট্রাফলগার স্কয়ারে একটি বিশাল র্যালীর আয়োজন করা হয়েছিল। প্রেসের সমর্থন শক্ত ছিল, সংসদে সকল দলের মুখপাত্রগন পাকিস্তানে সহায়তা বন্ধের ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন এবং টরি সরকার পাকিস্তানে নতুন সহায়তা প্রত্যাখ্যানে বাধ্য হল।
লন্ডনে চাথম হাউসে রয়েল ইন্সটিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্সের আহবানে আয়োজিত একটি সভায় আমাকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এখানে আমন্ত্রিত সকলেই গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আমার স্ত্রী পুত্র ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যে চলে এসেছিলেন। আমি সময়মতো লন্ডন ফিরতে না পারায় আমার পরিবর্তে আমার স্ত্রী সালমা বক্তৃতা করেন। আরও বক্তব্য দেন পাকিস্তান হতে সদ্য ফেরত লেবার পার্টির এমপি আর্থার বটমলি। উনি ছিলেন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে যাওয়া ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি ডেলিগেশনের প্রধান। বটমলেয়ের চাক্ষুষ রিপোর্টের পাশাপাশি পরিস্থিতি সম্পর্কে সালমার হৃদয় নাড়া দেয়া বর্ণনার মাধ্যমে এটি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কার্যকর ফোরামে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীতে অক্টোবর মাসে চাথম হাউসে আমাকে আবার বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল।
যুক্তরাজ্য থেকে আমি ওয়াশিংটনে ফিরে গেলাম। সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ওয়াশিন্টন দূতাবাস এবং জাতিসংঘের সমস্ত বাঙালি কর্মকর্তা কর্মচারী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করলেন। এটি ছিল এক বিরাট কূটনৈতিক অভ্যুত্থান। তারা ছিল সংখ্যায় অনেক ভারী এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিষয়ক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক দক্ষ কর্মকর্তারা সেখানে ছিলেন। এস এ করিম ছিলেন জাতিসংঘের পাকিস্তান মিশনে স্থায়ী সহকারী প্রতিনিধি এবং সকলের বয়োজ্যেষ্ঠ। তিনি নিউইয়র্ক থেকে চলে এলেন এবং একটি জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তাদের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হল। এনায়েত করিমের অনুপস্থিতি সন্দেহের উদ্রেক করেছিল। কিন্তু জানা গেল তিনি কয়েকদিন আগে মারাত্মকভাবে হৃদক্রিয়া আটকে হাসপাতালে ভর্তি আছেন এবং সেখান থেকেই তিনি বাঙালিদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলেন।
জুনের শুরুর দিকে আমরা পর্যবেক্ষণ করলাম যে, পাকিস্তানে পাঠানো ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-আইএমএফ এর ফ্যাক্ট মিশনের রিপোর্টটি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কেউ একজন নিউ ইয়র্ক টাইমস এর কাছে ফাঁস করে দিয়েছেন। শুধু কনসোর্টিয়ামের ওপর নয় বরং আমেরিকার সাধারন জনগন, কংগ্রেস এমনকি আমেরিকা বাদে অন্য দাতাদের ওপরও এই রিপোর্টটির তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ছিল।
এতদিনে আমেরিকাতে বাংলাদেশ আন্দোলন তদবিরের দিক থেকে সুসংগঠিত হয়ে উঠেছে। প্রতিশ্রুতিশীল এবং আদর্শবান আমেরিকানদের নিয়ে গঠিত বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলাদেশের জন্য তাদের সময় এবং শ্রম দিচ্ছিল, যা দেখে আমেরিকান নাগরিকদের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য সমর্থন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর গ্রুপটি ছিল ওয়াশিংটন ভিত্তিক ‘বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র’। এরা স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনীর জন্য তদবিরের সমন্বয় করছিল।
বাঙালি কূটনৈতিকদের সংখ্যা আর জনগণের মধ্যে আমেরিকান কংগ্রেসে বাংলাদেশে বিপুল জনসমর্থন দেখে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশে স্থায়ী মিশন স্থাপনের জন্য মনস্থির করা হল। এটি ওয়াশিংটনের কানেক্টিকাট এভিনিউতে উপশহরে অবস্থিত ছিল। এম আর সিদ্দিকীকে মিশনের প্রধান করা হল এবং ইস্তফা দানকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এতে নিয়োগ করা হল। এস এ করিমকে জাতিসংঘ এবং নিউইয়র্ক অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হলো।
ওয়াশিংটনে নবগঠিত মিশন এবং বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র সেখানে স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনী প্রণয়নে লবিঙের প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল। এই সংশোধনীতে দাবী করা হয়েছিল যে, মার্কিন বৈদেশিক সাহায্য আইনে একটি অংশ যোগ করা হোক। তা অনুযায়ী গণহত্যা বন্ধ না করা এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে সংলাপ শুরু করার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানে মার্কিন সহায়তা বন্ধ থাকবে। একজন পদধারী রিপাবলিকান আর একজন ডেমোক্রেটের নেতৃত্বাধীন মার্কিন সিনেটের এই দ্বি-দলীয় গ্রুপ ইতোমধ্যে সিনেটে প্রচুর সমর্থক যোগাড় করে ফেলেছিল।
ঐ মুহূর্তের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল সিনেটে সংশোধনীটির জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট লাভ করা। এই সংশোধনীটির প্রতি জোরালো সমর্থন থাকলেও এর সমর্থকদের আমেরিকা প্রশাসন থেকে আসা বিপরীত জোরালো চাপও সহ্য করতে হয়েছিল। প্রশাসন এই অজুহাতে ইয়াহিয়া প্রশাসনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলো যে ইয়াহিয়া প্রশাসন তাদের অনুগত এবং সহায়তা কমিয়ে দেয়া হলে পাকিস্তানীদের ওপর তাদের প্রভাব খর্ব হবে। এই অজুহাতে পাকিস্তানে তাদের অস্ত্র এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশের চালান অব্যাহত ছিল যা সিনেটে বক্তৃতাকালে সিনেটর কেনেডির প্রকাশ করে দেন। ইস্ট কোস্টে বন্দরে একটি নোঙ্গর করা জাহাজে করে পাকিস্তানে অস্ত্র যাচ্ছে ভেবে একদল আমেরিকান সমর্থক তা নৌকায় করে ঘেরাও করেছিল, যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ওয়াশিংটনে ফিরে আমার কাজ তাই হয়ে পড়ে হিলে স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনী বিলের পক্ষে সমর্থন জোরালো করা। এ কাজে আমি বাংলাদেশ মিশন এবং বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্রের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করেছিলাম। তথ্য কেন্দ্র লবিং করার জন্য স্টাফ বিষয়ক কাজটা নিয়েছিল। এতে তারা পর্যাপ্ত গবেষণার মাধ্যমে প্রত্যেক কংগ্রেসম্যানের নথি তৈরি করেছিল, যাতে সকলের রাজনৈতিক অবস্থান এবং ভীতি বর্ণিত ছিল। তদবিরের জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছিল। বাঙালি এবং ওয়াশিংটন ও সারা দেশের অন্যান্য সহানুভূতিশীল আমেরিকানদের লবিং কার্যক্রম চালানোর জন্য ওয়াশিংটনে এসে কিছু সময় দেবার জন্য রাজী করানো গিয়েছিল। এই একত্রিত হওয়াতে আরও বেশী সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল। মানুষ কাজ থেকে ছুটি নিয়েও কিছু সময় ওয়াশিংটনে এসে লবিঙে সমর্থন জানাতো। আমেরিকানদের পাঠানো হত তাদের নিজ নিজ স্টেটের সিনেটরদের কাছে। আর বাঙালিদের লক্ষ্যকৃত সিনেটর নির্দিষ্ট করে দেওয়া হত।
এই লবিং কাজে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকে আমেরিকার রাজনীতির জটিলতা এবং রাজনৈতিক মতামত গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা হয়েছিল। কিছু আমেরিকান গ্রুপের সদস্য এবং হিল এ কর্মরত ব্যক্তিরা বাংলাদেশের জন্য যেরকম নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তা ভোলার নয়। আমার বিশেষ করে মনে পড়ে বাংলাদেশ গ্রুপের টম ডাইনের স্ত্রী জোয়ান ডাইনের কথা। তিনি হিলে আমাদের সমর্থকদের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠাবান ছিলেন। মনে পরে ডেইভ ওয়েইসবার্গ নামক একজন তরুণ স্নাতকের কথা, যিনি বিআইসি’র পূর্ণকালীন সচিব হয়েছিলেন। তাদের সহায়তা করেছিলেন কায়সার হক নামের একজন তরুণ বাঙালি, যিনি নিজেও যথেষ্ট কাজ করেছিলেন। হিলে কর্মরত টম ডাইন, গেরি টিংকর এবং ডেইল ডাইহান প্রথম থেকেই বন্ধু ছিলেন। পরে সেখানে সিনেটর স্যাক্সবির সহকারী মাইক গার্টনার এলেন। সিনেটর স্যাক্সবি তো মে মাসের শুরু থেকেই বাংলাদেশের জন্য একনিষ্ঠ সমর্থক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নিজ প্রশাসনের বিল সংশোধনের সহ-পৃষ্ঠপোষকই হয়ে গেলেন। এজন্য তাকে হোয়াইট হাউসের অনেক চাপ সহ্য করতে হয়েছিল। এ সময়ে মাইক গেস্টনার ছিলেন তার অক্লান্ত পরামর্শ আর সমর্থনদাতা।
স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনী সিনেটে বাতিল হবার উপক্রম হয়েছিল। এখানে একটা অদ্ভুত জোট গড়ে ওঠে। ফ্রাংক চার্চ এর মত উদারপন্থি সিনেটরের সাথে দক্ষিণাঞ্চলীয় রক্ষণশীলরা এক হয়ে উঠল। উদারপন্থিগণ বলছিলেন যে পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য ইয়াহিয়ার বর্বরোচিত গণহত্যায় অপব্যবহৃত হচ্ছে। সকল উদারপন্থি সমর্থকগণ একই সুরে বলছিলেন। এবারে তাদের সাথে যুক্ত হল রক্ষণশীলের দল। এরা জাতিসংঘে চীনের অন্তর্ভূক্তিতে সাধারন পরিষদে তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশের উল্লাস দেখে এমনিতেই রাগে ফুঁসছিলেন। ১৯৭১ সালে আসলেই কমিউনিস্ট চীন বিপ্লবের সফলতার পর দীর্ঘ ২২ বছর পরে জাতিসংঘ থেকে তাইওয়ানকে সরিয়ে দেয়। জাতিসংঘের এ সমস্ত ঘটনা রক্ষণশীল কংগ্রেসম্যানদের মাথা খারাপ করে দিয়েছিল। এরা একে মার্কিন সহায়তার উপর নির্ভরশীল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অকৃতজ্ঞতা হিসেবে দেখেছিল। সাহায্য বন্ধ করে তারা এদেরকে একটা শাস্তি দিতে চেয়েছিল।
এসব জানাজানি হয়ে গেলে, সিনেটে পুরো সহায়তা বিলটাই হেরে গেল। স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনীর প্রয়োজন হলো না। পুরো জিনিসটাই বাকি বিশ্বের জন্য অবশ্যই অনেক বড় ঘটনা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের লবিং প্রচেষ্টার জন্য এটা একটা বিজয় বলেই গণ্য হলো। কারণ এটি সকল সাহায্য গ্রহীতাদের মধ্যে পাকিস্তানে নতুন সাহায্যের চালান বন্ধ করে দিলো।
যাই হোক, এই বিজয় কিন্তু আমেরিকা প্রশাসনকে অন্যান্য ছিদ্রপথে পাকিস্তানকে সহায়তা প্রদান থেকে বাঁধা দিতে যথেষ্ট ছিল না। ততদিনে ন্যাটো জোটের মধ্যে আমেরিকা একাই ইয়াহিয়া প্রশাসনের সমর্থনে রক্ষাকবচ হয়ে গিয়েছিল। তাই অন্তত পাক জান্তার সাথে চুক্তি বহির্ভূত সহায়তা বন্ধে কংগ্রেস এবং আমেরিকান জনগনের মধ্যে লবিং চালিয়ে যাওয়াটা আবশ্যক ছিল।
ওয়াশিংটনে যখন লবিং চলছিল, পাকিস্তানের দাতা কনসোর্টিয়াম তখনো একটি প্রভাব বিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিল। অক্টোবর, ১৯৭১-এ ওয়াশিংটনের শেরাটন হোটেলে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আইএমএফ এর বার্ষিক সভা ছিল আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য। যদিও মিটিংটির আলোচ্যসূচিতে পাকিস্তানের প্রতি সহায়তার বিষয়টি ছিল না, তথাপি আমাদের বন্ধুরা বললো যে পাকিস্তানীরা তাদের দায় পরিশোধের জন্য কনসোর্টিয়ামের কাছে সময় পুনর্বিন্যাসের আবেদন করার পাশাপাশি আবার নতুন সহায়তা প্রার্থনার জন্য এই মিটিংটিকে কাজে লাগাতে পারে। এ এম এ মুহিত এবং আমি মিলে পাকিস্তানের অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করে স্বাধীনতা যুদ্ধের এই চরম মুহূর্তে পাকিস্তানে আর সাহায্য প্রদানে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে একটি নতুন একটি ডকুমেন্ট প্রস্তুত করলাম।
সভায় অংশগ্রহনের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে কনসোর্টিয়ামে আসা প্রতিনিধিদের কাছে আমাদের কাগজপত্র পৌঁছে দেয়া, তাদের সাথে কথা বলা সহ যাবতীয় দায়িত্ব মুহিত এবং আমি নিজেই নিলাম। একদিনের জন্য প্রফেসর নুরুল ইসলাম তার কাজের মূল জায়গা ইয়েল থেকে বিমানে করে এসে আমাদেরকে সাহায্য করেছিলেন। হোটেল এর বাইরে বিআইসি গ্রুপ ছোট করে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিল। অন্যদের মাঝে জোয়ান ডাইন তার শিশুসন্তান এমিকে হাতগাড়িতে চড়িয়েই নিয়ে এসেছিল। একসময় মুহিত বাইরে প্রতিবাদকারীদের সাথে ছিলেন আর নিরাপত্তা রক্ষীরা তখন শেরাটন চত্বর থেকে সবাইকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে আমি প্রতিবাদকারীদের কাছ থেকে দূরে ছিলাম এবং মুহিতের কাছ থেকে আমাদের কাগজপত্র নিয়ে হোটেলের অভ্যন্তরে কাজ চালাতে পেরেছিলাম।
এটা ছিল আমাদের জন্য আরেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। কক্ষে, বারান্দায় যেখানে যাকে পাই ধরে ধরে আমাদের কথাগুলো বোঝানো। কেউ কেউ শুনেছিল, কেউ কেউ এড়িয়ে গেল। কয়েজনের সাথে দেখা হয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এরকম একজন ছিল আমার ১৮ বছরের পুরনো ক্যামব্রিজের সহপাঠী শাহ পুর সিরাজী। তিনি তখন ইরানের ব্যাংক মারকাযির গভর্নর ছিলেন। সুযোগ পেয়ে পাকিস্তান মিলিটারীকে ইরানের শাহ-এর সাহায্য সহযোগিতার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। শাহপুর দাবী করলেন যে ইরানের শাহ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করার জন্য ইয়াহিয়াকে অনুরোধ করেছিলেন। কথাটা যাচাই করা আমার পক্ষে আর সম্ভব হয় নি।
আরেক পর্যায়ে ক্যামব্রিজের আরেক বন্ধু তৎকালীন শ্রীলংকা সরকারের অর্থনীতি বিষয়ক সচিব লাল জয়াবর্ধনের সাথে দেখা হল। লাল তারপর প্রফেসর ইসলাম এবং আমার সাথে শ্রীলংকার অর্থমন্ত্রী ট্রটস্কাইতি এন, এম পিরার সাথে একটি আলোচনার ব্যবস্থা করে দেন। আমরা তাকে অস্ত্র এবং সৈন্য পরিবহনে সুবিধার্থে শ্রীলংকায় পিআইএ এবং পাকিস্তান এয়ার ফোর্স এর অবতরণের জন্য অনুমতি প্রদান বিষয়ে ধরেছিলাম। তিনি তখন তা প্রত্যাখ্যান করলেন এবং বললেন যে প্রদত্ত অবতরণ সুবিধার এমন অপব্যবহার যাতে না হয়, তিনি তা খেয়াল রাখবেন। এক্ষেত্রেও তিনি তার কথা রাখতে পেরেছিলেন কিনা, তা আমার জানা সম্ভব হয় নি।
ঐ সময় আমি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে জড়িত ছিলাম। তা হলো জাতিসংঘে প্রচারণা। ১৯৭১-এর অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অধিবেশনে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য বাংলাদেশ একটি দলকে মনোনিত করেছিল। সেই দলটির প্রধান ছিল বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সদস্যদের মধ্যে আমি ছাড়াও ম্যানিলা থেকে ইস্তফা দানকারী রাষ্ট্রদূত কে কে পন্নী, ইরাক থেকে ইস্তফা দানকারী রাষ্ট্রদূত এ ফতেহসহ ডঃ এ আর মল্লিকের মতো আরো অনেকেই ছুটে এসেছিলেন সেই প্রতিনিধি দলে যোগদান করার জন্য। জাতিসংঘে আমাদের প্রচারণার উদ্দেশ্য ছিল সাধারন পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত সমূহের মধ্যে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধে যেন একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে এখানে আমাদের কার্যক্রম ছিল আরও হতাশাজনক। অধিবেশনে কয়েকজনের এবং কয়েকটি কমিটির বক্তব্যে আমাদের পক্ষে কিছু কথা উঠে আসলেও, তা থেকে কিছুই হলো না। কারণ জাতিসঙ্ঘের কোন সদস্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ হবে বলে বেশীরভাগ দেশই এ ব্যাপারে আওয়াজ তুলতে অনিচ্ছুক ছিল। যেহেতু ভেটো ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো দেশই ঐ পর্যায়ে জনসমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসে নি, তাই প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের প্রচেষ্টার কোন উল্লেখযোগ্য ফলাফলও ছিল না।
এই সময় আমি বাংলাদেশের পক্ষে বেশ কয়েকটি বক্তব্য দিয়েছিলাম। এগুলোর মধ্যে ছিল ফিলাডেলফিয়া ও সাইরাকুস বিশ্ববিদ্যালয় দু’টিতে জনবহুল সভা। এছাড়া এমআইটিতে-ও একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে আমার সাথে ছিলেন বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরী এবং ডঃ মহিউদ্দীন আলমগীর। প্রফেসর আনিসুর রহমান আমার জন্য সেখানকার উইলিয়ামস কলেজে একটি সভার আয়োজন করেছিলেন। এছাড়া প্রফেসর নুরুল ইসলামের ইয়েল কলেজেও একটি সভার আয়োজন করেছিলেন। বেশীরভাগ অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করার জন্য পাকিস্তানীরা দলে দলে যেত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাগের চাইতে দুঃখই পেত বেশী আর সাধারণ কয়েকটি প্রশ্নই শুধু করত।
আমি মাঝে মাঝে টিভিতে যাওয়া এবং সাময়িকীর জন্য লেখা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। সেখানে থাকাকালে একেবারে শেষের দিকে টিভিতে গিয়ে দু’বার খুব মজার ঘটনা ঘটল। প্রথমটি বোস্টনের সরকারী টেলিভিশনে। অনুষ্ঠানটি খুব জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে হতো। সেটি একটি আদালতে মামলা ভিত্তিক আয়োজিত হতো যেখানে দু’জন আইনজীবী পক্ষে এবং বিপক্ষে কথা বলতেন। প্রত্যেকে তিনজন করে সাক্ষী উপস্থিত করতে পারতেন। যতদূর মনে পরে, সেদিনের বিষয় ছিল বাংলাদেশের জন্য আমেরিকা সরকারের সমর্থন প্রদানের ওপর আলোচনা। আমাদের পক্ষের উকিল কে ছিলেন, তা আমি মনে করতে পারছি না। কিন্তু প্রতিপক্ষের প্রধান ছিলেন আমেরিকার অন্যতম প্রধান রক্ষণশীল সাপ্তাহিকী ন্যাশনাল রিভিউ-এর স্বত্ত্বাধিকারী উইলিয়াম রাশার। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন সুপরিচিত ডানপন্থী ব্যক্তিত্ব উইলিয়াম এফ বাকলে জুনিয়ার। রুশার ছিলেন বাকলের চাইতে, এমনকি গেঙ্গিস খানের চাইতেও রক্ষণশীল। উপমহাদেশ সম্পর্কে তার ধারণা ছিল জন ফস্টার ডালেসের সময়কাল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তিনি ইন্ধিরা গান্ধির ভারত এবং ১৯৫০ সাল সময়কার ইন্দিরার পিতার ভারত সম্পর্কে পার্থক্য করতে পারছিলেন না আর কৃষ্ণ মেননকেই তখনো ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলে ধরে নিয়েছিলেন।
অনুষ্ঠানটির দর্শক খুব বেশী ছিল না। কিন্তু এটি মজার ছিল কারণ তা বাংলাদেশের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি বের করে এনেছিল। রাশার অনুষ্ঠানটির জন্য টিভির একজন কর্মীকে পাকিস্তানে পাঠালেন ভুট্টোর সাক্ষাতকার নেবার জন্য। এরকম একটি পক্ষপাতমূলক ভিডিও প্রযোজনা করে আমাদেরকে স্টুডিওতে দেখানো হয়েছিল। রাশার নিউ জার্সির কংগ্রেসম্যান ফ্রেলিংঘুসেন এবং পাকিস্তানে আমেরিকার একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত, পেপসি কোলার ধনকুবের ব্যবসায়ীকেও জড়ো করেছিলেন। যাকে নিক্সনের নির্বাচনী প্রচারণার খরচ যুগিয়েছিল বলে পুরষ্কার স্বরূপ সেখানে পাঠানো হয়েছিল। বাংলাদেশের পক্ষে আমাদের উকিল নিয়ে এসেছিলেন লেবার পার্টির এমপি জন স্টোনহাউসকে, যিনি ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের পক্ষে অন্যতম বাকপটু প্রচারক ছিলেন। উনি বিশেষ করে সেই অনুষ্ঠানটিতে অংশ নেবার জন্য লন্ডন থেকে উড়ে এসেছিলেন। আর ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম কে রাগোস্ত্রা। তিনি ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূতাবাসে এল কে ঝা এর ডানহাত ছিলেন এবং বর্তমানে ভারত সরকারের পররাষ্ট্র সচিব। সবশেষে অনুষ্ঠানে একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে ছিলাম আমি। স্টুডিও দর্শকে পরিপূর্ণ ছিল এবং আমাকে বলা হয়েছিল যে আমি নাকি টিভি দর্শকদের জন্য একটি প্রাণবন্ত উপস্থাপনা করেছিলাম।
টিভিতে আমার দ্বিতীয় উপস্থিতি ছিল আরও ঐতিহাসিক। এর আগে জাতিসঙ্ঘে প্রতিনিধিত্বকালে আমরা অনেক বেশী সক্রিয় হলাম যখন ভারত-পাকিস্তানের শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব প্রকাশ্যে আসার পরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারন পরিষদে বাংলাদেশ ইস্যু শেষ পর্যন্ত উঠে এলো। উত্তর ভারতের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর হামলার ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সীমান্তে উত্তেজনা চরম পর্যায়ে পৌছালো। যে পাকিস্তান এতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ ইস্যু জাতিসংঘের আলোচ্যসূচিতে আনতে চায় নি, তারাই এখন এটাকে ইন্দো-পাকিস্তান শান্তির হুমকি হিসেবে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে তৎপর হয়ে উঠল। বাংলাদেশে ভারত সেনাবাহিনীর সফল অগ্রগামিতা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিলো। ফলে পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে ভারত সেনাবাহিনীকে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক সহায়তা চাইতে বাধ্য হলো। এ ব্যাপারে তারা আমেরিকা এবং চীনের শক্ত সমর্থন পেয়েছিল। পাকিস্তানের জন্য এই তদবির ছিল জাতিসংঘে চিনের প্রথম প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড। যুদ্ধবিরতি এবং সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারন পরিষদে অপ্রতিরোধ্য সমর্থন পাচ্ছিলো। স্পষ্টতই বেশীরভাগ সদস্য এই ইস্যুতে একমত হয়েছিল কারণ তারা ভাবছিল যে এতে একটি যুদ্ধের অবসায়ন হতে যাচ্ছে। ফলে আমেরিকা এবং চীনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যাচ্ছিলো। শুধু ভেটো দিয়ে বাঁধ সাধলো সোভিয়েত ইউনিয়ন।
এই ভেটোকে পাশ কাটানোর জন্য সাধারণ পরিষদে একই ধরনের একটি সিদ্ধান্তপত্র আনা হল যেখানে একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সদস্যদের সমর্থন ছিল আরো বেশী। ফলে জানা ছিল যে এখানে এই রেজ্যুলেশন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। আমি পরবর্তীতে এই বিতর্কে সকলের বক্তৃতা পর্যালোচনা করে দেখলাম, খুব অল্প দেশই পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন থেকে এটি করেছিল। বেশীরভাগ দেশ যুদ্ধবিরতি সায় দিয়েছিল কারণ এটাকে আন্তর্জাতিক রীতিতে ‘শান্তিনীতি’ বলেই ধরে নেয়া হয়।
আমরা বাংলাদেশীরা ছিলাম জাতিসংঘে এই নাটক দেখা গ্যালারীর দর্শক। আমাদের প্রচেষ্টা অনেকের ব্যক্তিগত সহানুভূতি আদায় করতে পেরেছিল। কিন্তু সাধারণ পরিষদে আমাদের পক্ষে বলার মত তেমন কাউকে পাচ্ছিলাম না। বক্তারা সকলেই ৯ মাসের আগ্রাসন আর পাকিস্তানী আর্মির গণহত্যা বেমালুম ভুলে সদ্য উদ্ভুত ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের দিকে মনোযোগ দিয়েছিল।
নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিধিদের কাছে লবিঙে অংশ নেয়ার ছাড়াও আমি নিউ ইয়র্কের একটি পাব্লিক টেলিভিশনে আমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। এই চ্যানেলটি অন্যদের তুলনায় আলাদা ছিল এই কারনে যে, জাতিসংঘের সাধারন ও নিরাপত্তা পরিষদের কার্যক্রম শুধু এই চ্যানেলটিতেই দেখানো হত। আমাদের অনুষ্ঠানটি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের আদলেই সাজানো হয়েছিল। দুটি প্যানেলের একটি সেট সাজানো হয়েছিল। একটি আমেরিকানদের নিয়ে। যতটুকু মনে পরে, এখানে ছিলেন টম ডাইন, নিউজউইক ম্যাগাজিন-এর আর্নল্ড ডি বর্সগ্রেইভ এবং অন্য আরেকজন সুপরিচিত ব্যক্তি। তাদের তিনটি পক্ষের সাথে আলোচনা করতে হয়েছিল। পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন নিউইয়র্কে পাকিস্তানের কনসাল-জেনারেল নাজমুস সাকিব খান, ভারতের পক্ষে ভারতীয় কনসাল-জেনারেল এবং বাংলাদেশের পক্ষে আমি। পাকিস্তানের কনসাল-জেনারেলকে আমার সাথে একই প্লাটফরমে বসতে নিষেধ করা হয়েছিল। তাই ভারতীয় কনসাল-জেনারেল এবং তিনি পর্দায় এক সাথে এলেন আর আমি এলাম পরে। তাই আমার বেলায় মনে হচ্ছিলো যেন আমি একক ভাবে ছিলাম। কাকতালীয়ভাবে আমি যখন এলাম, তখন সাধারন পরিষদে ভোট গণনার ফল প্রকাশ হচ্ছিলো। আমার বিবৃতি শুরু হওয়া মাত্র ক্যামেরা জাতিসংঘের অধিবেশনের দিকে ফিরে গেল। রিপোর্টে দেখা গেল তাৎক্ষনিক যুদ্ধবিরতি এবং সীমানা অতিক্রমকারী সৈন্যদের ফেরত পাঠানোর প্রস্তাবে বিপুল ভোট পড়েছে। ক্যামেরা আবার আমার কাছে ফেরত এল এবং সাক্ষাতকার গ্রহণকারী স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রতিকূল এই ঘটনা সম্পর্কে আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানতে চাইল। যতটুকু মনে পড়ে, নিজেকে দ্রুত গুছিয়ে নিয়ে আমি বলেছিলাম, “পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞ হতে উদ্ভুত এই যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশকে এই সাধারন অধিবেশনের আলোচনায় ডাকা হয় নি। বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণ তাই জাতিসংঘের এই গৃহীত সিদ্ধান্তের কোন অংশ নয় এবং বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানের আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলবে।” বাংলাদেশে অবস্থা নিয়ে আমার বিবৃতি এবং জাতিসংঘে বিতর্কের পরে উদ্ভূত পরিস্থিতি সাদরে গৃহীত হয়েছিল। কিছু দিন পর নিউ ইয়র্কের রাস্তায় আমার কথাগুলো শুনে থাকা এক আগন্তুক আমাকে থামিয়ে আমার বিবৃতির জন্য বাহবা জানিয়েছিলেন।
যা হোক, টিভি তারকার ভূমিকা ছিল ক্ষণস্থায়ী। আসল নাটক চলছিল বাংলাদেশে এবং জাতিসংঘের আনাচে কানাচে। আমরা জানতে পারলাম যে, শেষ মুহুর্তে সরকারে অন্তর্ভুক্ত হওয়া জুলফিকার আলী ভুট্টো নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার জন্য নিউইয়র্ক আসছেন। যদিও ভূট্টোর আসার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বাংলাদেশের মাটিতে ঘটছিল। ভারতীয় এবং বাংলাদেশী বাহিনীর দর্শনীয় অগ্রগামিতা আর পাকিস্তানী ব্যুহের একেবারেই ভেঙ্গে পড়া জাতিসংঘের বিতর্কে তাদের অবস্থান খারাপ করে দিয়েছিল। একজন সাংকেতিক বার্তা নিয়ে কর্মরত কেরানীকে বলা হয়েছিল জাতিসংঘের পাকিস্তানী দূতাবাসে থেকে যেতে। তিনি জানালেন যে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুমতি চেয়ে জেনারেল নিয়াজির পাঠানো সাংকেতিক বার্তা এসে পৌঁছেছে। আমরা আরও জানতে পারলাম যে, পাকিস্তানী সৈন্যদের নিরাপদে আত্মসমর্পণের নিশ্চয়তা চেয়ে পাঠানো রাও ফরমান আলীর একটি বার্তা ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মারে হেনরি জাতিসংঘের মহাসচিবের কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন।
ভুট্টো বিমানবন্দরে নেমেই তার জন্য ভয়াবহ এই সংবাদগুলো পেলেন। নিরাপত্তা পরিষদে তার চক্রান্তের পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। এত কিছুর জন্য একেবারেই অপ্রস্তুত ভুট্টো নিভৃতে চলে গেলেন এবং পরের কয়েকদিন জাতিসংঘে আমেরিকা এবং চীনের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিনিধি যথাক্রমে জর্জ বুশ এবং হুয়ান হুয়াং এর সাথে একান্তে আলাপচারিতায় কাটালেন। তারা গোপনে কি আলাপ করেছিলেন জানিনা তবে কয়েকদিন আত্মসমর্পণের ব্যাপারে কিছু শোনা গেল না। বুশ বর্তমানে রিগ্যান প্রশাসনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। মনে হলো, ইসলামাবাদ থেকে নিয়াজি এবং ফরমান আলীর আর্জি এই বলে খারিজ করা হল যে নতুন সাহায্য পাঠানো হচ্ছে। তার মানে ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোকে উত্তর থেকে চীন এবং সমুদ্র থেকে আমেরিকা হস্তক্ষেপ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। হঠাৎ আমরা দেখলাম যে নিরাপত্তা পরিষদে আরেকটি অধিবেশন ডাকা হলো যেখানে ভুট্টো ভাষণ দিবেন।
আবারো জাতিসংঘে বাংলাদেশী প্রতিনিধি দলকে নিরাপত্তা পরিষদের গ্যালারিতেই বসে ভুট্টোর ভাঁড়ামি দেখতে হলো। আমরা নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করে যুদ্ধবিরতি চেয়ে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করাতে চেষ্টা করছিলাম। এর পিছে আমরা সময় দিচ্ছিলাম আর এটা বুঝাতে চাচ্ছিলাম যে বাংলাদেশের জন্ম অনিবার্য। বেশীরভাগ মুখপাত্র একমত ছিলেন যে, ‘বাংলাদেশ’ একটি বাস্তব সত্ত্বা এবং সর্বোত্তম সমাধান হলো পাকিস্তান আর্মিকে দ্রুত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করার মাধ্যমে যৌথ বাহিনীর অনতিবিলম্বে জয় লাভ করা। তারা বললেন, নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকান আর চিনারা যারা দেখাতে চাইছে যে ইয়াহিয়া খানের জন্য তারা তাদের সামর্থ্যের সবই করেছেন। এটা একটা নাটক ছাড়া আর কিছুই নয়। এই মিটিংগুলোতে জাপানের প্রতিনিধিদের মাঝে আমার আরেকজন অক্সফোর্ড সহপাঠি আমার সাথে নিয়মিত দেখা করতো এবং নিরাপত্তা পরিষদের মনোভাব আর অগ্রগতি সম্পর্কে খবরাখবর দিত।
পাক আর্মির আত্মসমর্পণ আগমুহূর্তে আমি নিরাপত্তা পরিষদের বিতর্ক দেখেছিলাম। ভুট্টো যখন নিরাপত্তা পরিষদে তার কাজ করছিলেন, তখন খবর এলো যে নিক্সন আমেরিকার সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে যেতে বলেছেন। এর কোনো উদ্দেশ্য এখন পর্যন্ত বলা হয় নি। আমেরিকা প্রশাসন একগুয়েভাবে ভারতকে শাসিয়ে যাচ্ছিল এবং বাংলাদেশে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়া পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য কিছু একটা বুদ্ধি যে বের করবে তা অনুমান করা কঠিন ছিল না। ধারনা ছিল যে, এমন একটি হস্তক্ষেপ যা নিয়াজি সুদীর্ঘকাল ধরে চাইছিলেন, সেটার হয়তো ছক আঁকা হয়ে গেছে। এ হতে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার ভিত্তি মজবুত করা যাবে এবং এমন একটি মীমাংসা হবে যা থেকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা অটুট থাকবে। তাই বাংলাদেশকে ঘিরে যে বড় নাটক চলছিল, সেটি ঢেকে রাখার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের নাটকটা ছিল একটি উছিলা মাত্র।
উত্তর পূর্ব থেকে ভারতে চীনের সম্ভাব্য আক্রমন কিংবা মনোযোগ সরানোর চেষ্টা পাকিস্তানের জন্য ছিল অন্যতম আশা। আমাদের কানে এসেছিল যে কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় আর্মি জেনারেলকে ভুট্টো পিকিং পাঠিয়েছেন। আমি নিজেও আগে এমন একটি সম্ভাবনার বিষয়ে ভেবেছিলাম। অক্টোবরের শেষ দিকে আমি প্যারিসে বেইজিংয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত কে এম কাইসার এর সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছিলাম। পাকিস্তানী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহূত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলনে যোগ দিতে কে এম কাইসার জেনেভায় এসেছিলেন। সেখান থেকে আমার সাথে দেখা করার জন্য তিনি গোপনে প্যারিস আসেন এবং আমাকে এই গুপ্ত তথ্যটি দেন যে চিন পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ করবে না। তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র এবং কূটনৈতিক সহায়তা দেবে কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষে যতই প্রকাশ্যে তর্জন-গর্জন করুক না কেন, চিনের সাথে আওয়ামীলীগের গোপনে রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছে। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে আমি যেন এসব তথ্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠাই। আমি সে দায়িত্ব পালন করেছিলাম। পরে জানলাম যে আমি ছাড়াও বেইজিংয়ে পাকিস্তান অ্যাম্বাসীতে কর্মরত বাঙালিদেরকেও ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে এ ধরনের তথ্য পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছিল। এই তথ্যের পিছে এই অঞ্চলে মিলিটারি কৌশলে আর কী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল, তা আমি বলতে পারি না।
নিরাপত্তা পরিষদের ভেতরে এবং বাইরে আমেরিকা, চিন আর পাকিস্তানের সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া যৌথ বাহিনী কত দ্রুত পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করাতে পারে, তার সামর্থ্যের ওপর উত্তেজনা নির্ভর করছিল। ডিসেম্বরের ১০ তারিখের দিকে আত্মসমর্পণ নিশ্চিত মনে হচ্ছিলো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মোড় ঘুরে গেল ইসলামাবাদের নির্দেশে। ইসলামাবাদ চেয়েছিল বাইরের খেলোয়াড়দের খেলার জন্য কিছুটা সময় দিতে। আমি যখন নিউ ইয়র্ক থেকে লন্ডনের বাসায় ফিরে যাচ্ছিলাম, বাতাসে তখন তীব্র উত্তেজনা। সপ্তম নৌবহরের মাধ্যমে আমেরিকা এই যুদ্ধকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উন্মোচিত করেছে। এটি এখন আর কেবল কল্পনার মাঝে সীমাবদ্ধ নেই।
অক্সফোর্ডে থাকাকালীন আমি পাকিস্তান আর্মির আত্মসমর্পণের উল্লাসজনক সংবাদটি শুনলাম। আমি ঢাকার রেসকোর্সে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা সিং এর কাছে জেনারেল নিয়াজির হাত নিচু করার দর্শনীয় ঘটনাটি টিভিতে দেখলাম। আজ পর্যন্ত এটি উদঘাতিত করা যায় নি যে, জেনারেল নিয়াজির বাহিনী আর একটু সময়ক্ষেপণ করতে পারলে কি আসলেই আমেরিকার সপ্তম নৌবহর হস্তক্ষেপ করতো? নাকি পাকিস্তানের সত্যিকারের মিত্র হিসেবে নিজেকে দেখানোর জন্য নিক্সনের এটা একটি গণসংযোগ প্রচেষ্টা ছিল মাত্র। এ ধরনের হস্তক্ষেপে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যে সমর্থন ছিল না, তা নিশ্চিত। এই ইস্যুতে মিডিয়া অত্যন্ত সোচ্চার ছিল। ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে কিসিঞ্জারের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছিল যে নিক্সন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টকে ভারতের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এটি আগেই জ্যাক এন্ডারসন ফাঁস করে দিয়েছিলেন, যা বহু জায়গায় উদ্ধৃত করা হয়েছে। চার্চ, কেনেডি এবং বাংলাদেশের অন্যান্য বন্ধুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের সদস্যরা আমেরিকার এ ধরণের নগ্ন হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করছিলেন। তাই ধারনা করা যায় যে, আমেরিকার জনগন, মিডিয়া এবং কংগ্রেস যদি বাংলাদেশের প্রতি এরকম সহানুভূতিশীল না হতো কিংবা উদাসীন হতো, তবে নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন আরও অনেক দূর নিয়ে যেতেন। এ থেকে বলা যায় যে, নিষ্ঠুর নিক্সন প্রশাসনের মাথার ওপর এমন তীব্র প্রচারণা বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যহীন ছিল না।
পাকিস্তানে নতুন সহায়তা প্রদানের প্রশ্ন যেন পুনরায় ফিরে না আসে, সেজন্য দাতাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ শেষ পর্যন্ত চলমান ছিল। অর্থাৎ নভেম্বর এর শুরুর দিকে পাকিস্তান কনসোর্টিয়ামের জন্য আরেকটা মিটিঙে শেষ বারের মতো আমাকে আরেকবার প্যারিস যেতে হয়েছিল। কারগিল এর সাথে এই আরেকটা প্রাতরাশের মিটিংয়ে আমাকে নিশ্চিত করা হল যে, আমেরিকার যথেষ্ট চাপ সত্ত্বেও কনসোর্টিয়ামের সদস্য দেশগুলো পাকিস্তানে নতুন সাহায্য কিংবা পুরনো দায় পরিশোধের বিষয়ে সময় পুনর্বিন্যাসের সহায়তা করার কোনোটাতেই রাজী ছিল না। তাদের এই অবস্থানের কারণে পাকিস্তান হুমকি দিয়েছিল তারা তাদের দায় পরিশোধ নিয়ে একমুখী খেলাপিকরণের ঘোষণা দিবে। তবে তারা এমন একটি নীতিগত পরিবর্তনের ফলে সহায়তার সারিতে থাকা জাপানের মতো দেশগুলোর কাছ থেকে সাথে সাথে সাহায্য হারাবে। কারণ জাপানের মতো দেশগুলো এ ধরণের খেলাপিকরণের হুমকির ব্যাপারে আইনগতভাবে শক্ত। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংক ভাবলো সকলেই বাড়াবাড়ি করছে। তাই এটি পাকিস্তান এবং কনসোর্টিয়ামের মধ্যে সমঝোতা করানোর জন্য উঠে পড়ে লাগলো। যার ফলে পাকিস্তান হয়তো খেলাপি অবস্থানে যায় নি।
এখানে আবারো পাকিস্তানে নতুন সাহায্য না দেওয়ার জন্য দাতাদের আশ্বস্ত করতে পারাটা আমাদের প্রচারণার মাঝারি ধরণের সফলতা হিসেবেই ধর্তব্য। সেই মে মাসে আমার প্রচারণার শুরু থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ হওয়া পর্যন্ত কনসোর্টিয়ামের একটা দেশও আসলে পাকিস্তানকে নতুন কোন সহায়তা দেয় নি। তবে দাতা দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সাহায্য হিসেবে খাদ্য এবং যাতায়াতের জন্য যন্ত্রপাতি আকারে ত্রাণ এসেছে। এটি তাদের মানবিক আচরনের বহিঃপ্রকাশ ছিল। বাস্তবে পাকিস্তানের জন্য প্রচুর সহায়তা সারিবদ্ধভাবে ছিল। কারণ বাংলাদেশ অঞ্চলে তার চলমান আমদানী মারাত্মকভাবে কমে গিয়েছিল। তাই এটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে চলছিল এবং দুর্বল হয়ে পড়েছিল। দায় পরিশোধের চাপে পাকিস্তান আগেও একবার খেলাপিকরণের হুমকি দিয়েছিল। এই অনৈতিক পথের মাধ্যমে সুবিধা নেবার জন্য পরিষ্কারভাবেই পাকিস্তানের আরও কিছুদূর আসার দরকার ছিল। যেন ন্যূনতম পশ্চিম পাকিস্তানে বর্তমান আমদানী এবং ভোগ তাদের সামর্থ্যের মধ্যে গ্রহণযোগ্য স্তরে টেকসই অবস্থানে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান নিজেও চেয়েছিল সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষমাণ এবং নতুন সাহায্য যেন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের প্রচেষ্টা ছিল ইতোমধ্যে প্রতিশ্রুত সহায়তা বাতিল করার জন্য দাতাদের বুঝানো, যা কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতার কারণে তেমন সফল হয় নি।
এভাবে আমাদের প্রচারণা যতটা না তাদের দৃশ্যমান কাজকর্ম কমিয়ে আনার ব্যাপারে প্রভাব ফেলেছিল, তার চাইতে বেশী প্রভাব ফেলেছিল ছিল রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে। কিন্তু তারা পুরো সময় জুড়েই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল এবং নতুন সহায়তা ছাড়া তাদের নাভিশ্বাস উঠছিল। সন্দেহের অবকাশ থেকে যায় যে, স্বাধীনতা যুদ্ধ যদি আর কিছু দিন প্রলম্বিত হতো, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি এবং জনগণ তীব্র সংকটে পড়তো কিনা।
প্যারিসে ‘পুরাতন’ পাকিস্তানের জন্য কনসোর্টিয়ামের সর্বশেষ মিটিংয়ে নভেম্বরে আন্দ্রে মার্লো নামক বিদগ্ধ ফরাসী নোবেলজয়ীর সাথে দেখা করার বিশেষ সুযোগ হয়েছিল। আমরা আগেই পত্রিকা মারফত জেনেছিলাম যে, মার্লো প্রকাশ্যে বাংলাদেশের জন্য তার সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে তিনি মুক্তিবাহিনীর সাহায্যার্থে ফরাসী যুদ্ধের সময়কার জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী সহযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করবেন। মার্লো নিজে ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব এবং অসুস্থ। তাই তার প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত ছিল, তা পরিষ্কার ছিল না। কিন্তু ড্যানিয়েল থর্নার চেয়েছিলেন, বাংলাদেশে সরকারের একজন দাপ্তরিক প্রতিনিধি যেন তার সাথে অন্তত দেখা করে এই পদক্ষেপের জন্য অভিবাদন জানাক।
ড্যানিয়েল আমাকে প্যারিসের শহরতলীতে মার্লোর বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমি প্রথমবারের মতো এই মানুষটির দেখা পেলাম। ম্যালরক্স প্রবল উৎসাহের সাথে কথা বলছিলেন। তিনি বললেন যে, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে তিনি প্রজাতন্ত্রের হয়ে পাইলটের কাজ করেছিলেন। তারপর থেকে নিজের দেশ ছাড়া আর কোনো দেশের কোন ঘটনায় তিনি এভাবে আন্দোলিত হন নি। বাংলাদেশের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার্থে তিনি এতই দায়বদ্ধতা বোধ করছিলেন যে, তার বৃদ্ধ বয়স এবং অসুস্থ শরীর সত্ত্বেও তিনি তার পুরনো সহযোদ্ধাদেরকে বাংলাদেশের যুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন। তারা তার ডাকে সাড়াও দিয়েছিল। তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন যে তারা বিস্ফোরক এবং যোগাযোগের জন্য মূল্যবান দক্ষ বিষয়াদি শিখিয়ে দিতে পারবেন, যা গেরিলা যুদ্ধের জন্য অত্যাবশ্যক। তিনি মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য বিস্ফোরক এবং যোগাযোগের নানান যন্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুরো একটি দল নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এরপর তিনি এই অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা এবং যুদ্ধে জড়ানোর বাস্তব সমস্যা বিষয়ক বিশদ এক কারিগরী আলোচনায় আমাকে নিয়ে গেলেন। দুঃখজনকভাবে এখানে আমি তাকে পরামর্শ দেওয়ার মত যথেষ্ট যোগ্য ছিলাম না। কিন্তু আমি তাকে তার উদ্যোগের জন্য বাংলাদেশের জনগণ এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালাম এবং তার প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশ সরকারের কাছে পৌঁছে দেব বলে কথা দিলাম। সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়াও তিনি আমাকে কথা দিলেন যে তিনি গ্যালিস্ট মন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলবেন এবং ফ্রান্স সরকার যাতে পাকিস্তানে কোন অস্ত্র না পাঠায়, সেজন্য তার প্রভাব ব্যবহার করবেন। অবশ্য পাকিস্তানের দায় পরিশোধের ব্যর্থতার কারনে এটি এমনিতেই বাতিল হয়েছিল। মনে হয়েছিল, অস্ত্র বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ফরাসীরা রাজনৈতিক চাপের চেয়ে হিসাব বইয়ের দ্বারাই বেশী তাড়িত হয়েছিল।
আগেই বলেছিলাম, ১৬ই ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের খবর এলো, আমি তখন অক্সফোর্ডে ছিলাম। বছরের শুরুর দিকে আমি অক্সফোর্ডের ‘রানী এলিজাবেথ হাউজ’-এর পক্ষ থেকে একটা ফেলোশিপ পেয়েছিলাম। যা থেকে অক্সফোর্ডে আমার পরিবারকে মোটামুটি চালানো যেত। সেই ফেলোশিপের একাডেমিক কাজে আমি খুব কম সময়ই দিতে পেরেছিলাম। কারণ আমার পুরোটা সময় আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলাম। তাই আমি পরিবারের সাথে থেকে অক্সফোর্ডের ফেলোশিপ ব্যবহার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পটভূমি এবং উত্তোরণের উপর একটা বই লিখব বলে ঠিক করলাম। কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার নতুন প্রভাতের অনুভূতি থেকে আর ওখানে রয়ে যেতে পারলাম না। অতএব কলকাতা হয়ে বাংলাদেশে ফেরার জন্য রওনা দিলাম। কারণ ঢাকায় সরাসরি কোন বিমান যাচ্ছিলো না।
কলকাতায় আমার সাথে অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, ডঃ স্বদেশ বসু আর ডঃ আনিসুজ্জামানের দেখা হল। তারা শেষের মাসগুলোতে শরণার্থী পুনর্বাসন এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের নীতিমালা তৈরিতে অনেক পরিশ্রম করেছেন।
মোশাররফ ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার সাথে ঢাকায় ফিরে গিয়েছিলেন। পরে আবার এসেছেন তার পরিবারকে ফিরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করতে। ৩১শে ডিসেম্বর আমি আর মোশাররফ, সাথে কামরুজ্জামান ও তাঁর পরিবার এবং জোহরা তাজউদ্দীন আর উনার পরিবার ভারতীয় এয়ারফোর্সের পুরাতন ডিসি-৩ বিমানে করে ঢাকায় এলাম। বিমানবন্দরে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে দেখা হলো। তাকে আমি এর আগে এপ্রিলের সেই সংকটময় দিনে সর্বশেষ দেখেছিলাম, যখন বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে তার সেই ঐতিহাসিক বিবৃতিটির খসড়া তৈরি করেছিলাম। শীতের একটি সকাল ছিল সেদিন, কিন্তু সূর্য কিরণ দিচ্ছিলো। আমাদের মনে হচ্ছিলো যেন নতুন বছরটি বাংলাদেশের সুদীর্ঘ বঞ্চনা আর যুদ্ধবিধ্বস্ত জনগণের জন্য বয়ে আনবে আশা আর সম্ভাবনার এক নতুন পৃথিবী।
-রেহমান সোবহান
ডিসেম্বর, ৮৩