লে. কর্নেল ডা. নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

৮১। লে. কর্নেল ডা. নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর (৪৯৭-৪৯৮)

লে. কর্নেল ডা. নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

সুত্র -‘বাংলাদেশে গণহত্যা’ বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২

শামসুল হক আলী নুর

“আমার হাতে একটা পিস্তল তুলে দিয়ে তিনি বললেন, কর্নেল শাহনুরের বদলা হয়তো আমার ওপর থেকেই ওরা নেবে। তোমাকে আত্মরক্ষার জন্যে পিস্তল দিয়ে গেলাম। ওরা তোমার ওপরও আক্রমণ চালাতে পারে। কথাগুলো বলেই তিনি বাইরে এসে দাঁড়ালেন। সশস্ত্র পাকসেনারা তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল। তারপর তিনি আর ফিরে আসেননি।”

পাক-হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত ৪০ ফিল্ড এ্যাম্বুলেন্সের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডা. নুরুল আবসার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের পত্নী মিসেস জেবুন্নেসা জাহাঙ্গীর বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কথাগুলো বললেন।

“বাংলার মাটি আর বাংলার মানুষের প্রতি ভালবাসাই ছিল তার সবচেয়ে বড় অপরাধ। তা না হলে কেন এমন হবে? আমার স্বামী কোনো অন্যায় করেননি। তবু কেন ওরা আমার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করলো? তিনি বাঙালী-এটাই কি তার সবচেয়ে বড় অপরাধ?” একটু থেমে থেমে কথা বলছিলেন মিসেস জেবুন্নেসা জাহাঙ্গীর।

তিনি বলেছিলেন একাত্তরের ঊনিশে মার্চের একটি ঘটনা। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে উচ্চ পদস্থ আর্মি অফিসারদের জরুরি কনফারেন্স। আলোচনার বিষয়-বাংলাদেশের যুবসমাজকে সমূলে উৎখাত করতে হবে। উক্ত কনফারেন্সে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি, লে. কর্নেল ইয়াকুব মালিক, মেজর আগা বোখারী, মেজর সুলতান (বেলুচ রেজিমেন্টের লোক) সহ অনেক উচ্চপদস্থ পাক আর্মি উপস্থিত ছিল। সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো-বাংলার সংগ্রামী যুব সমাজকে এলোপাতাড়ি ভাবে হত্যা করা হবে। কিন্তু প্রস্তাবের বিরোধীতা করলেন লে. কর্নেল জাহাঙ্গীর। না, তা হতে পারে না, অসম্ভব। দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে তিনি সেদিন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

আর এর পর থেকেই কোনো কনফারেন্সে জনাব জাহাঙ্গীরকে ডাকা হতো না। তিনি যেতে চাইলেও তাকে ঢুকতে দেয়া হতো না।

এর ক’দিন পর সাহেবজাদা ইয়াকুব আমার স্বামীকে ডেকে পাঠান এবং ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যেতে বারণ করেন। বললেন মিসেস জাহাঙ্গীর।

তারপর এলো পঁচিশে মার্চ। সেদিন রাত সাতটার দিকে ব্রিগেডিয়ার শফি, লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরকে ডেকে পাঠান ক্লাবে। ক্লাব থেকে ফিরে এসে তিনি আমাকে জানান আজ রাতের বেলায় ওরা হয়তো বাঙালীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওদের কথাবার্তায় তাই মনে হয়েছে। কথা শেষ না হতেই ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাতি নিভে গেলো। রাতে আমরা আর ঘুমাইনি। শুধু মেশিনগান, কামান আর ট্যাংকের শব্দে বারবার শিউরে উঠলাম। মাঝে মাঝে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আগুন দেখা গেলো। আমার স্বামী আমাদের সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।

ভোরবেলা দেখলাম আমাদের বাসার সম্মুখে আরটিলারি গান বসিয়ে ওরা কয়েকজন বসে আছে। যেন আমরা বাইরে বেরুতে না পারি।

লে. কর্নেল জাহাঙ্গীর বুঝতে পারলেন তিনি বন্দি। আর তাই তিনি ফোন করে তার ইউনিটের বাঙালী সৈনিকদের সুযোগ বুঝে পালিয়ে গিয়ে বাংলার মুক্তি সংগ্রামে শরিক হতে বললেন। দূরালাপনীতে তিনি তার বাঙালী সৈনিকদের বললেন মরতে যদি হয় তাহলে বীরের মতোই মরো। আমিও তোমাদের কাতারে এসে শামিল হচ্ছি। কথা শেষ করে ব্রিগেডে যাবার উদ্দেশ্যে বাইরে এসে দাঁড়াতেই পশ্চিমা হানাদার বাহিনী তাকে বাধা দেয় এবং বলে, আপনার বাইরে যাওয়া চলবে না।

২৯শে মার্চ রাতে তিনি খবর পেলেন চট্টগ্রামের কুমিরায় যুদ্ধ করতে গিয়ে বাঙালী সৈনিকদের হাতে লে. কর্নেল শাহনুর নিহত হয়েছেন।

৩০ শে মার্চ খুব সকালে একদল পাঞ্জাবী দানব বাসা থেকে তাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেলো, যাবার আগে আত্মরক্ষার জন্য তিনি আমাকে একটি পিস্তল দিয়ে গেলেন। এরপর আমি তার আর কোনো খোঁজ পাইনি।

স্বামী নেই, ঘরে খাবার নেই। দুধের শিশু কাঁদছে, দুধ নেই। এক ফোঁটা পানিও নেই। ঘরের বাইরে গোলাগুলি চলছে। বাইরে বেরুবার পথ বন্ধ। এক ফোঁটা পানির জন্য ছটফট করছে আমার সন্তানরা। তবু দানবরা পানি দেয়নি। খাবার দেয়নি। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিসেস জাহাঙ্গীর। ঠিক সেই সময় মিসেস জাহাঙ্গীরের ছোট ছেলে আরিফ বললো, পানির জন্য আমরা আল্লাহর কাছে কত কেঁদেছি। তারপর থেকেই আল্লাহ বৃষ্টি দিয়েছেন। আর আমরা সেই বৃষ্টির পানি পান করেছি। পাত্রে জমিয়ে রেখেছি।

বৃষ্টি না হলে ছেলেমেয়েদের বাঁচানো যেত না, অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন মিসেস জাহাঙ্গীর।

এমনিভাবে ক’দিন অনাহারে কাটার পর নরপিশাচরা তাদেরকে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি স্কুলে আটক করে রাখে। সেই স্কুলে বাঙালী আর্মি অফিসার ও সৈনিকদের অনেক পরিবারকে আটকে রাখা হয়েছিল।

তারপর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে মিসেস জাহাঙ্গীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে তিন শিশু সন্তান মারুফ (১৩), আরিফ (১০) ও দু’বছরের মিমির হাত ধরে বেরিয়ে এলেন। তিন শিশু সন্তানসহ মিসেস জাহাঙ্গীর প্রাণে বাঁচলেন বটে, কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বামীকে।

মিসেস জেবুন্নেসা জাহাঙ্গীর আমাকে জানান যে, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত অধিকাংশ বাঙালী অফিসার ও সৈনিকদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে তাঁর স্বামী লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরসহ লেফটেন্যান্ট ফারুক, ক্যাপটেন হুদা, ক্যাপটেন বদরুল আলম, মেজর ইসলাম, মেজর খালেক, মেজর মুহিদুল জামালের নাম তাঁর স্মরণ আছে বলে তিনি আমাকে বলেন।

উল্লেখযোগ্য যে, সবাধীনতা লাভের পর কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে অসংখ্য বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। সে সব বধ্যভূমি থেকে লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরসহ অগণিত বাঙালী আর্মি অফিসার ও সৈনিকদের নরকঙ্কাল উদ্ধার করা হয়।

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে লে. কর্নেল জাহাঙ্গীরের দেহাবশেষ সমাধিস্থ করেন।“

Scroll to Top