শাহ জাহাঙ্গীর কবীর আওয়ামী লীগ দলীয় জাতীয় সংসদ সদস্য (১৯৭৩)

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ১৫তম খণ্ডের ২৯৩ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ৩৭ নং দলিল থেকে বলছি…

শাহ জাহাঙ্গীর কবীর

আমার নির্বাচনী এলাকা ছিলো রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহকুমার গোবিন্দগঞ্জ থানা। আমি ৪ঠা এপ্রিল ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থান করেছি। এরপর পলাতক রংপুর ও বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি ভারতে যাইনি।

আমার এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলগুলোর মাঝে সাইপাল, সাঁতারপাড়া, কাঁটাখালী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মহিমাগঞ্জ নামক বিখ্যাত বন্দর এলাকাটি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। এখানকার বিভিন্ন পাটের গুদাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো।

কাঁটাখালী ব্রীজের কাছে ছিলো পাক বাহিনীর ক্যাম্প। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে লোকজন ধরে এনে হত্যা করতো। আমার এলাকায় প্রায় এক থেকে দেড় হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছিলো। ছাত্রনেতা লতিফ, আমজাদ নামক জনৈক ব্যক্তি, মাসুম চৌধুরী, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা, বাতাসু, এমাদাদুদ্দিন, কাদের সরকার প্রমুখ অনেক লোকই পাক বাহিনীর দ্বারা নিহত হয়েছেন।

২৮ শে মার্চ পাক বাহিনী প্রথম আক্রমণ করে কাঁটাখালী ব্রীজের আশেপাশের এলাকা। গ্রামের প্রায় কয়েক হাজার লোক ব্রীজটিকে অকেজো করে দেবার জন্য আসলে বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাক বাহিনী খবর পেয়ে এগিয়ে আসে। স্বয়ংক্রিয় অস্র দিয়ে তারা ব্যাপক গুলি চালায়। এতে অকুলস্থলেই প্রায় ৬ জন শহীদ হয়। এই শহীদদের মাঝে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মান্নানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাক বাহিনী চলে গেলে এ এলাকা আবার মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়। এরপর ১৭ই এপ্রিল রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে একদল পাক সৈন্য ট্যাংক ও মর্টার নিয়ে এই এলাকা দখল করার জন্য এগিয়ে আসে। মুক্তিবাহিনী ও ইপিআর বাহিনীর প্রবল মর্টার আক্রমণের মুখে পশ্চাদপসরণ করে।

এরপর থেকেই মুক্তিবাহিনী বিচ্ছিন্ন অথচ সুপরিকল্পিতভাবে পাক বাহিনীকে আক্রমণ করেছে। মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্য ছিলো রেলপথ, সড়ক সেতু অকেজো করে দেওয়া। এই তৎপরতায় মুক্তিবাহিনী ব্যাপক সফলতা অর্জন করে। ডিসেম্বরের প্রথমেই আমার এলাকা মুক্ত হয়। হিলি পুনর্দখল করে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী এগোতে থাকলে পাক বাহিনী ফাঁসিতোলা নামক স্থানে তাদের গতিরোধ করে। সেখানে তুমুল ট্যাংক যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনী বগুড়ার দিকে পশ্চাদপসরণ করার ফলে সম্পূর্ণ এলাকাটি মুক্ত হয়।

উল্লেখিত কাঁটাখালী ব্রীজের কাছে পাকবাহিনীর যে ঘাটি ছিলো সেখানে তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে মেয়েদের উপরে পাশবিক অত্যাচার করতো। এই এলাকায় প্রায় শ’খানেক মেয়ে নির্যাতিত হয়েছে বলে জানা গেছে।

মাসুম চৌধুরীকে হত্যার ঘটনাটিই আমার কাছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মনে হয়। এই প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আমাদের এলাকায় সবচেয়ে সজ্জন ব্যাক্তি ছিলেন। কামাদিয়া হাট থেকে পাক বাহিনী তাকে ধরে। হাটের লোকদের জড়ো করে পাক বাহিনী মাসুম চৌধুরীকে নির্দেশ দেয় এদের মাঝ থেকে আওয়ামী লীগ কর্মীদের খুজে বের করে দিতে। বহু লোককে চেনা স্বত্বেও এই জনদরদি ব্যাক্তি কাউকেই আওয়ামী লীগ কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করেন নি। এরপর পাকবাহিনী তাকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে চলে যায়। স্বাধীনতার পর ক্যান্টনমেন্টের মাটি খুঁড়ে তার লাশ আবিস্কার করা হয়। এবং আশ্চর্য হয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করি যে, দীর্ঘ সময়েও তার লাশে কোনো রূপ পচন ধরেনি। সম্পূর্ণ অবিকৃত লাশটিকে তুলে এনে আমরা তার পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করি।

-শাহ জাহাঙ্গীর কবির
(সাবেক গণপরিষদ সদস্য, রংপুর)
৭ জুন, ১৯৭৩

Scroll to Top