<৪,২১৮,৪৭৬-৪৮৫>
অনুবাদকঃ জিহাদ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২১৮। সংসদ সদস্যদের সমাবেশে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষণ
|
বাংলাদেশ সরকার | ৬ জুলাই, ১৯৭১
|
বাংলাদেশ পরিষদ সদস্যবর্গ সমাবেশে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষণ
স্বাধীন বাংলাদেশের মাননীয় পরিষদ সদস্যবর্গঃ
আপনারা আমার সংগ্রামী অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর আমরা সবাই একসঙ্গে মিলিত হবার সুযোগ পেয়েছি। আজ জাতির ক্রান্তি-লগ্নে আমাদের এই সম্মেলনের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের মুক্তিফৌজের বীর নওজোয়ানেরা অপূর্ব বীরত্বের সাথে এখন শত্রুর মোকাবেলা করছে। হাজার হাজার যুবক পবিত্র মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংকল্পে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আত্মোৎসর্গের মহান আদর্শে তারা বলীয়ান।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ, আপনারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ বিশ্বাস করে তাদের দায়িত্ব আপনাদের অর্পণ করেছিল। আপনারা সবাই বাঙালীর স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিক বৈ আর কিছু নন। আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘদিনের সহচর হিসাবে তাঁর জীবনব্যাপী আদর্শ আর সংগ্রামের আমরা ধারক ও বাহক। আদর্শের জন্য, নীতির জন্য, নেতার কাছে আর বাংলার মানুষের কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য এই ধরণের অটুট মনোবল আর কোন দেশের জনপ্রতিনিধিরা দেখাতে পেরেছেন কিনা তাঁর নজীর আমার জানা নেই। আপনাদের বীরত্ব, আদর্শনিষ্ঠ, মনোবল ও ত্যাগের জন্য আমি অভিনন্দন জানাই। আপনারা গৃহহারা সর্বহারা হয়ে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করেছেন- তাই আপনাদের প্রতি আকুণ্ঠ আন্তরিক সালাম আর অভিনন্দন।
বন্ধুরা আমার, নির্বাচন-উত্তরকালে রমনার রেসকোর্স ময়দানে আমাদের মহান নেতা আপনাদেরকে শপথবাণী উচ্চারণ করিয়েছিলেন। সেদিন সাক্ষী ছিল রেসকোর্স ময়দানের লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী জনতা আর বাংলার নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ। আমি আজ গর্বের সঙ্গে বলব, মহান নেতার হাত ধরে আমরা যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে প্রতিজ্ঞায় আমরা অটুট এবং অটল রয়েছি। আপনাদের অসীম মনোবল বিগত কয়েক মাস যাবৎ স্বাধীনতা সংগ্রামকে জিইয়ে রেখেছে। অবশ্যি সঙ্গে সঙ্গে এই কথা বলতে হবে, আমাদের যে সমস্ত বীর সৈনিকেরা, মুক্তিফৌজের যে তরুণ সংগ্রামীরা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন তাঁদের অপূর্ব বীরত্ব বাংলার মানুষের জন্য এক গর্বের বস্তু। আর ভবিষ্যৎ ইতিহাসের জন্য তা এক অপূর্ব বীর গাঁথা।
৬-দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আপনারা জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন তা পালন করতে আপনাদের নেতা এবং তাঁর সহকর্মীবৃন্দ কী কী প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, তা আপনাদের জানা আছে।
জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ জানেন, একটা খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে আপনাদের সামনে পেশ করা হয়েছিল। সেই খসড়া শাসনতন্ত্র পর্যালোচনা ও পরীক্ষার জন্য ৩০ সদস্য বিশিষ্ট সাব-কমিটি যখন আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিল, তখনই মার্চ মাসের সেই ১লা তারিখে হঠাৎ জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব ভুট্টো সাহেবের পরামর্শে আর তাঁর অভিমান রক্ষার জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দেয়। সারা পৃথিবী জানে, আজকে পাকিস্তান দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার যদি কোন মূল আর সংগত কারণ থাকে, তাহলে সে অবস্থা সৃষ্টি আমরা করি নাই, করেছেন ইয়াহিয়া খান সাহেব আর ভুট্টো সাহেব। আর এর জন্য দায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকেরা, যারা ২৩ বছর পর্যন্ত বাংলার গরীব-চাষী মজুরের শোষণ করে পাহাড় গড়ে তুলেছে।
আওয়ামী লীগের মাননীয় সদস্যবৃন্দ, আমরা কি অপরাধ করেছি? আমাদের একমাত্র অপরাধ ২ বছর পর্যন্ত আমরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, বাংলার মানুষকে শোষণ করে, বাংলার চাষী-মজুরের রক্ত শোষণ করে কায়েমী স্বার্থবাদীরা আর পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদীরা যারা বাংলাকে আজ রিক্ত করেছে, তারাই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সেই সমস্যার সমাধান করতে চাইলাম বলে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমাদের নেতা নির্বাচন পরবর্তীকালেও একটার পর একটা চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু যারা কায়েমী স্বার্থবাদের দালাল, পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পুজিবাদের দালাল, পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ত প্রভুদের দালাল- আজ যারা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের ছত্রছায়ায় রাজনীতি করে শুধু বিসাল আর ভোগ করতে চায়, তারাই বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক প্রচেষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়ালো। আওয়ামী লীগের আন্তরিকতারকে তারা দুর্বলতা মনে করে তাকে বানচাল করতে চেষ্টা করলো।
১লা মার্চের পর থেকে প্রতিটি ঘটনা যে কত দ্রুতগাতিতে অগ্রসর হয়েছিল যে আপনারা নিজেদের চোখে দেখেছেন। আমরা স্পষ্ট মনে আছে- যেদিন ইয়াহিয়া খান সাহেব জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবী ঘোষণা করলেন, সেদিন পূর্বাণী হোটেলে আমরা সম্মেলনে আর একবারের মত বসেছিলাম। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে আমি ব্যক্রিগতভাবে একটার পর একটা প্রতিজ্ঞাবাণী উচ্চারণ করেছিলাম। আর আপনারা সেই প্রতিজ্ঞা প্রতিধ্বনিত করে আবার বলেছিলেন বাংলার মানুষের কাছে- আপনারা বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। দেশবাসী জানে বিশ্বাসঘাতকতা আপনারা করেন নাই। জঙ্গীশাহীর অত্যাচার, ইয়াহিয়ার প্রলোভন কোন কিছুই আপনাদের টলাতে পারে নাই। ইতিহাস এই কাহিনী একদিন স্বর্নাক্ষরে লিখে রাখবে বলে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস।
আপনারা নিজ নিজ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন- অসহোযোগ আন্দোলনের বাণী নিয়ে বাংলাদেশের হাটে, মাঠে, ঘাটে, বাংলাদেশের সরকারী আদালতে। বাংলার দেশ-প্রেমিক ছাত্র-জনতার সাহায্যে আপনারা যে অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন সৃষ্টি করেছিলেন, ইতিহাসে তাঁর নজীর নাই। সেই অসহযোগ আন্দোলনের সময় যখন আমরা একটা থেকে একটা সঙ্কটের মুখে উত্তরণ লাভ করেছিলাম, তখন ইয়াহিয়া খান সাহেব ১৫ মার্চ ঢাকায় আলোচনা করতে এসেছিলেন। ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা শুরু হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব , আপনি যদি বিন্দু মাত্র সত্য কথা বলেন, আজকে না হোক, কবরে গিয়েও যদি জবাব দেন- তাহলে অস্বীকার করতে পারবেন না যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম আলোচনাতেই আপনি স্বীকার করেছিলেন জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন, মার্শাল ল’ উঠিয়ে নেবেন এবং ৬ দফার ভিত্তিতে একটা অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র জারী করে ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দেবেন। এর ভিত্তিতে আলোচনা হলো। বঙ্গবন্ধুর আদেশে এবং নির্দেশে আমি এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন সাহেব, আলোচনা শুরু করলাম। জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেবের পক্ষে ছিলেন লেঃ জেঃ পীরজাদা, প্রক্তন বিচারপতি কর্নেলিয়াস, আর অর্থনীতিবিদ বাংলার মানুষের চিরশত্রু এম, এম, আহম্মদ। ২৪শে মার্চ পর্যন্ত আলোচনা হলো। ডকুমেন্টও তৈরী হলো। জাষ্টিস কর্নেলিয়াস সাহেব উপস্থিত ছিলেন। উনি যদি একজন সৎ-খ্রীষ্টান হয়ে থাকেন তাহলে তাকে এ কথা স্বীকার করতে হবে।
বন্ধুরা আমার, আপনারা বলতে পারেন, নিরস্ত্র মানুষকে কেন গুলি করে মারলো? কেন পরিষদ সদস্যদের বাড়িঘরে কামান চালানো হলো?
সেই ২৫শে মার্চের রাতের আধারে এই বীভৎস ঘটনার প্রতিবাদে আপনারা রুখে দাঁড়ালেন। বাংলার নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা মফঃস্বল শহরে, জেলা শহরে, গ্রামে, বন্দরে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করবো আমাদের ও বেঙ্গল রেজিমেণ্টের বীরত্ব আজকের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ই পি আর, আমাদের পুলিশ বাহিনী, আমাদের আনসার, আমাদের মোজাহিদরাও বাংলার মানুষের পাশে এসে দাঁড়াল। বন্দুক আর কামান তুলে নিল। আজ তারা সংগ্রামের পুরোভাগে। বাংলার গ্রামে, বন্দরে, গঞ্জে আপনারা দাঁড়ালেন। আমি কিভাবে যে আপনাদের শ্রদ্ধা জানাব তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না। যে সমস্ত মিথ্যাবাদী বলে আওয়ামী লীগের নেতারা আর সদস্যরা সংগ্রামের পুরোভাগে ছিল না তাঁদের আমি জবাব দিতে চাই। বাংলার মানুষ জানে আপনারাই আছেন পুরোভাগে। আমি জানি চট্টগ্রামে, ময়মনসিংহে, যশোরে, রংপুরে, খুলনায়, বরিশালে, ঢাকায়, ফরিদপুরে বাংলার সর্বত্র আপনাদের নেতৃত্বেই সংগ্রাম হয়েছে। নিজেদের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে আপনারা গ্রাম-বন্দরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাংলার সৈনিকদের পাশে পাশে আপনারা রয়েছেন। অকুতোভয় আপনারা লড়েছেন। বাংলার সৈনিকেরা যখন বুকের তাজা রক্ত মাতৃভূমির জন্য ঢেলে দিচ্ছেন এর পরে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা না করে আর কি পথ ছিল? স্বাধীনতার জন্য লড়াই না করে আর কি উপায় ছিল? মূলতঃ এবং বাহ্যত বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী রেখে যান। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু যদি গ্রেপ্তার হন, তবে স্বাধীনতা ঘোষণা তিনিই করে যাবেন। আর এই স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যই আমাদের সংগ্রাম করে যেতে হবে।
প্রিয় বন্ধুরা আমরা, ২৫শে মার্চের রাতের পরে আমরা বিছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। তাই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা করতে আমাদের একটু বিলম্ব হয়েছিল।
আমরা যে পাঁচজন শেখ সাহেবের পাশে ছিলাম এবং যাদের কাছে কথিত, লিখিত, অলিখিত সর্বপ্রকারের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু দিয়ে গিয়েছিলেন- ১৩ই এপ্রিল তারিখে বাংলার পূর্ব অঞ্চলে সর্বপ্রথমে একত্রিত হলাম। পরিষদের সদস্যবৃন্দ যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সামনে সেদিন আমি আমার সহকর্মীবৃন্দের তরফ থেকে স্বধীনতা কার্যকরী করার জন্য পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম। তখন যোগাযোগহীন অবস্থায় আপনাদের বেশীর ভাগই ছিলেন বাংলাদেশে শত্রুর দখলীকৃত এলাকার অভ্যন্তরে। তখন একটা সরকার গঠন না করলে স্বাধীনতা সংগ্রামকে পরিচালনা করা যাচ্ছিল না। সেইহেতু সেদিনের উপস্থিত বন্ধুদের কাছেই আমরা পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম।
১৯৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আর একটি অম্রকাননে দাঁড়িয়ে আমরা বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ এবং বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি।
স্বাধীনতা ঘোষণা করেই ১৭ই এপ্রিল সারা পৃথিবীর মানুষকে যা বলেছিলাম, আমরা বিশ্বাস করি তা অন্তরের বাণী। বিশ্বাস করি- ১৭ই এপ্রিলের এই ঘোষণা বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলের মর্মবেদনার এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গের বিরাট বিস্ফোরণ।
স্বাধীনতা ঘোষণার পর আমি আমার সহকর্মী জনাব তাজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তাঁর পরামর্শে এবং বঙ্গবন্ধুর পূর্বতম নির্দেশের বলে আমি জনাম খোন্দকার মোস্তাক আহম্মদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জনাম মনসুর আলী সাহেবকে অর্থমন্ত্রী আর জনাব কামারুজ্জামান সাহেবকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করেছিলাম। আমরা জানতাম, আপনারা যে প্রয়োজনে তাঁদেরকে দীর্ঘকাল নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছেন, আমি আপনাদের সবার সঙ্গে পরামর্শ না করেও নিঃসঙ্কোচে আর বিনা দ্বিধায় তাঁদেরকে সরকারের দায়িত্ব দিতে পারি।
তাঁদেরকে দায়িত্ব দেওয়ার পরে তিন মাস চলে গিয়েছে। এই তিন মাস যাবৎ আমি আপনাদের কাছে অকপটে স্বীকার করব- যা করার ছিল অনেক কিছু করা সম্ভবপর হয় নাই।
কিন্তু আপনাদেরকে আমি একটা কথা বলব, জনাব তাজউদ্দিন আহম্মদ এবং তাঁর মন্ত্রিসভায় সদস্যরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের সরকারের জন্মমুহূর্ত থেকেই, কর্নেল এ, জি, ওসমানীর মত একজন স্বনামধন্য দেশপ্রেমিক সমরবিশারদকে সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতিরূপে পেয়েছি। আপনারা জানেন, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী অসীম বীরত্বের সাথে একটি অসম লড়াই লড়ে যাচ্ছেন।
রণক্ষেত্রে পশ্চাদপসরণ পরাজয় নয়। যুদ্ধের প্রয়োজনে পশ্চাদপসরণ করতে হয় এবং যাতে পুনরায় তীব্র আক্রমণে জয়লাভ করা যায়। যেদিন হিটলারের বাহিনী ফরাসীদেশ আক্রমণ করেছিল সেদিন হাজার হাজার বছরের পুরাতন সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী ফরাসী সরকারও হিটলারের কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছিল। মাত্র ৩ দিনে সব ধ্বংস করে হিটলারের ট্যাংক বাহিনী প্যারিসের উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়েছিল। ফরাসী দেশের বীরনায়ক জেনারেল দ্য গল মাত্র মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে জেনারেল দ্য গল শক্তি সঞ্চয় করে যেদিন ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ফ্রান্সে অবতরণ করেছিলেন সেদিন হিটলারের বাহিনী তাঁর সামনে টিকতে পারেনি।
বৃটিশের মত শক্তিশালী সেনাবাহিনীকেও সিঙ্গাপুর থেকে হটে এসে বর্মা ত্যাগ করতে হয়েছিল। যুদ্ধে পশ্চাদপসরণ করতে হয় যুদ্ধের কলাকৌশল প্রয়োজনে। তাই বাংলার মুক্তিবাহিনী সামরিকভাব যদি কোন রণাঙ্গন থেকে পশ্চাদপসরণ করে তবে তাকে পরাজয় মনে করবেন না। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা পরাজিত হওয়ার জন্য রণক্ষেত্রে অস্ত্রধারণ করেনি। বীর মুক্তিযোদ্ধারা জয়লাভ করার জন্যই অস্ত্রধারণ করেছি। জয় আমাদেরই হবে।
আমি জানি, আজকে বাংলার ঘরে ঘরে কী হাহাকার! আমি জানি নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আপনাদের বুকের কী ক্রন্দনের রোল! আপনারা যখন শোনেন, আপনার শহরে, আপনার গ্রামে, আপনার গঞ্জে যারা একদিন বিশ্বাস করে, ভালবেসে, আপনাদের ভোট দিয়েছিল তাঁদের ঘরবাড়ি আজকে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, তখন কী মর্মবেদনায় আপনারা পীড়িত হন! আপনার প্রতিবেশী নারীদেরকে বর্বর পশুরা ইজ্জতের হানি করছে, জেনে আপনাদের কলিজা ফেটে যায়। এই ধরণের অত্যাচার পৃথিবীর ইতিহাসে কোন সৈন্যবাহিনী কোন দিন করে নাই। নারীরা ইজ্জত লুণ্ঠিত হচ্ছে আজ আবার বাংলাদেশে, হত্যা করা হয়েছে দশ লক্ষ নারী, পুরুষ আর শিশুকে। মসজিদ, মন্দির আর গীর্জা ধ্বংস হয়েছে। বাংলার ফসল আজকে মাঠে মাঠে লুটিয়ে পড়েছে। আমাদের তরুণদের আজকে হত্যা করা হচ্ছে, গুলি করে মারা হচ্ছে।
এই কাহিনীর মর্মবেদনা আপনাদের বুকের ভেতর যেমন বাজে, আমার বুকে যেমন বাজে আর সকলের বুকেও তেমনি বাজে। যদি বঙ্গবন্ধু আজকে আমাদের মাঝে উপস্থিত থাকতেন, তাঁর প্রিয় দেশবাসীর এই মর্মন্তদ দুঃখে তিনি অধীর হয়ে যেতেন তাঁদের মুক্তির জন্য। তাই বন্ধুরা! আপনাদের ব্যাথা বিশ্ববাসীকে বলার জন্য মন্ত্রীসভার সদস্যরা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। তাঁরা কি পর্যন্ত সফল হয়েছেন তাঁর বিচার করবেন আপনারা। কিন্তু একটা জিনিস আপনাদেরকে আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই- আপনারা সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে কাজের অগ্রগতি সম্ভম তাঁর পথ দেখিয়ে দিন।
বিশ্ববাসীর কাছে সারা পৃথিবীর পত্র-পত্রিকা আর কূটনৈতিক কার্যকলাপের দ্বারা আমরা এই কথা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে বাংলাদেশে আজ গণহত্যা চলছে। আজকে আপনাদের মন্ত্রিসভা নিরলস চেষ্টা দ্বারা সারা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে ইয়াহিয়া ভুল আর ভ্রান্ত, আর আমরা সঠিক পথে চলেছি। আজকে সারা পৃথিবীর পত্র-পত্রিকা তা গ্রহণ করেছে।
আজকে লন্ডনের “অবজারভার” “সানডেটাইম” বা যে-কোন পত্র-পত্রিকা দেখুন, ইয়াহিয়ার বর্বরতার নিন্দায় তাঁরা মুখর। যে আমেরিকা সারা পৃথিবীর রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করে, “নিউইয়র্ক টাইম” এবং অন্যান্য সমস্ত প্রভাবশালী পত্রিকাগুলি ইয়াহিয়াকে ধিক্কার দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ফরাসীদেশে, ইটালীতে, জার্মানীতে, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে এমন কি আরবেরও কোন কোন অঞ্চলে বিশেষ করে বৈরুতের আর সুদানের পত্রিকাগুলি আপনাদের পক্ষে আজকে মত প্রকাশ করে চলেছে।
আপনারা জিজ্ঞাস করতে পারেন যে এখন পর্যন্ত এই রাষ্ট্রের এই সরকারের স্বীকৃতি কেন লাভ করা সম্ভবপর হয় নাই? কূটনৌতিক প্রশ্নে বৃহৎ শক্তিবর্গ পৃথিবীতে নিজস্ব স্বার্থেরত কারণে অনেক কিছু করে।
কিন্তু জেনে রাখুন বিশ্বের জনমত আপনার পক্ষে সেখানে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলি আপনাকে স্বীকৃতি দিবেই। আমাদের বন্ধু ও প্রতিবেশী ভারতবর্ষ আমাদের লক্ষ লক্ষ শরনার্থীকে শুধু আশ্রয়ই দেয় নাই আমাদের দাবীর ন্যায্যতাকে স্বীকার করে নিয়ে সাহায্য করার জন্য স্বেচ্ছায় আজকে এগিয়ে এসেছে। সেই জন্য ভারত সরকারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
বন্ধুরা আমার, মুক্তিসংগ্রামে, স্বাধীনতা সংগ্রামে একদিকে যেমম সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করতে হয় চরম আঘাত হানার জন্য, তেমনি আর একদিকে কূটনৈতিক আক্রমণের দ্বারা শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে হয়। তৃতীয়তঃ দেশের অভ্যন্তরে মানুষের মনোবলকে শক্ত রাখতে হয়। আর শত্রুর মনোবল ভাঙ্গতে হয়।
বিদেশে কূটনৈতিক প্রচার চালিয়েছেন আপনার সরকার। মুক্তিফৌজকে সুগঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। হাজার হাজার ছেলে আজ মুক্তিফৌজে যোগ দেওয়ার জন্য, মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসছে। সবাইকে সমানভাবে সৈনিকের শিক্ষা দানের বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয় নাই। তাঁর একমাত্র কারণ আমাদের সীমিত সামর্থ।
এই সরকারের আয়ের কোনরকম সুনির্দিষ্ট বন্দোবস্ত নেই। শুধুমাত্র দান, খয়রাত, ঋণ আর কিছু বান্ধব মারফত টাকা সংগ্রহ করে কোনমতে সরকার চলছে। তাই যারা মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাবার জন্য ট্রেনিং গ্রহণ করতে বিভিন্ন অঞ্চলে এগিয়ে আসছেন, তাঁদের সবাইকে ট্রেনিং-এর সুবন্দোবস্ত করা সম্ভবপর হয় নাই। কি করে এই সীমিত সামর্থের মধ্যে ভাল ট্রেনিং-এর বন্দোবস্ত ও মুক্তিবাহিনীকে আরও জোরদার করা যায় আপনাদের মন্ত্রীসভার সদস্যরা তা আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। আমি বিশ্বাস রাখি, দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ব হয়ে আপনারা গঠনমূলক সমালোচনা দ্বারা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। মনে রাখবেন বর্তমান মুহূর্তে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ঐক্যের। সারা পৃথিবীর মানুষ যেন দেখতে পায় আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীরা, বঙ্গবন্ধুর শিষ্যরা, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়করা এক প্রাণ এক মন হয়ে বাংলার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। ঐক্যে কোনরকম ফাটল ধরলে তাঁর ফল মারাত্মক। কেউ কেউ বাইরে থেকেও নানা প্রকার প্ররোচনায় আমাদের মধ্যে ফাটল ধরাতে চেষ্টা করতে পারে। সেই সমস্ত প্রচেষ্টাকে আমাদের বানচাল করে দিতে হবে। আমি আপনাদের আশ্বাস দিতে পারি আমরা মন্ত্রীসভার সদস্যরা মনেপ্রাণে এক। তাঁদের প্রতিনিয়ত চিন্তা মাতৃভূমির স্বাধীনতাকে কি করে ত্বরান্বিত করা যায়। যে অটুট ঐক্য আজকে সরকারের মধ্যে বজায় আছে সেই অটুট ঐক্য আজকে আওয়ামী লীগের প্রতিটি নির্বাচিত সদস্য ও কর্মীদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে।
আমাদের প্রধান সেনাপতির বর্তমান রণকৌশল আমাদেরকে গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়েছে। এবং গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে বড় জিনিস হলো জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা। আপনারা যারা প্রতিনিধি আপনাদের কাছে আমার আকুল আবেদন গেরিলা যোদ্ধারা যে রণনীতি আর কৌশলে যুদ্ধ করে চলছে, সেই রণনীতি আর কৌশলে আপনারাই তাঁদের সর্বাধিক সাহায্য করতে পারেন- জনগণের মনোবল অটুট রেখে আর সমর্থন বজায় রেখে। বন্দুক নিয়ে যারা লড়াই করছে তারাও যেমন মুক্তিযোদ্ধা, আপনারাও তেমন মুক্তিযোদ্ধা। এই জনযুদ্ধ, ভাড়াটিয়া সৈন্যদের যুদ্ধ নয়। এটা হচ্ছে People’s War- এই People হচ্ছে সবচেয়ে Important factor.
আর সেই People-কে সংঘবদ্ধ করার দায়িত্ব জনসাধারণের প্রিনিধিদের। প্রতিটি সৈনিককে জনতার বন্ধু ভাবতে হবে। নির্যাতিত, নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত বাংলার মানুষ যেন ভাবে তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, তাঁদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের কর্মীরা, সৈনিকেরা তাঁদের বন্ধু। যদি আমরা জনগণের এই সমর্থনকে বজায় রাখতে পারি তাহলে, আমি আপনাদেরকে আশ্বাস দিতে পারি যে, আপনাদের বীর সৈনিকেরা, পৃথিবী যা ভাবছে তাঁর চেয়ে বহু আগে বাংলার স্বাধীনতা অর্জন করবে।
বন্ধুরা আমার, জনগণের সমর্থন আদায় করতে হলে আমাদের প্রত্যেকের কার্যকলাপে জনগণের বন্ধু, জনতার বন্ধু, নির্যাতিত চাষীর বন্ধু বলে নিজেদের প্রমাণ করতে হবে। অত্যাচারী মিল মালিকের বিরুদ্ধে আমরা নির্যাতিত শ্রমিকের বন্ধু। বাংলার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবির আমরা বন্ধু। এই বন্ধুত্ব প্রকাশের প্রধান উপায় হলো আওয়ামী লীগের প্রণীত ম্যানিফেষ্টোকে বার বার জনগণের সামনে তুলে ধরা। আওয়ামী লীগ ভোট পেলে যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি পালন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সে সমস্ত প্রতিশ্রুতি আমরা পালন করব। এই মুহূর্তে মুক্তিসেনানীর যে অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করবে সেই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতারা, অর্থনৈতিক, সামাজিক সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়েছি তাকে বাহ্য রূপ দেওয়ার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজে নামবেন। মনে রাখতে হবে, সেনাবাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করে যে স্বাধীনতাকে তাঁরা অর্জন করে দিবে, সেই স্বাধীনতাকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পটভূমিকায় রূপ দেওয়ার দায়িত্ব আপনাদের।
তাই বন্ধুরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের নীতি আদর্শে আপনারা অটল থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হচ্ছে আমাদের আদর্শ। বিশ বছরের ক্রমাগত সংগ্রামের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে এই আদর্শকে আমরা আজকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরছি। অসাম্প্রদায়িকতা বা ‘সেকুলারিজমের’ মহান আদর্শ বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে আমরা আজকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরছি। এই একটা বিষয়ে আপনাদের স্পষ্ট থাকতে হবে। কোন প্রকার সাম্প্রদায়িকতার মালিন্যে যেন আওয়ামী লীগের সদস্যবৃন্দের নাম কলঙ্কিত না হয় সে বিষয় আপনাদের লক্ষ রাখতে হবে। গণতন্ত্র অর্থই হলো অসাম্প্রদায়িকতা। যেখানে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি সেখানে গণতন্ত্র কোনোদিন কার্যকর হতে পারে না।
আজ আমরা গণতন্ত্র বিশ্বাস করি বলেই অসাম্প্রদায়িকতা বা সেকুলারিজমে বিশ্বাস করতে হবে। বাংলার প্রতিটি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানেরা মনে প্রত্যয় জন্মাতে হবে যে আপনারা সবারই বন্ধু আর ভবিষ্যৎ বাংলার সুখ আর সমৃদ্ধিকে সবাই আপনারা রূপ দিতে যাচ্ছেন।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক পদ্ধতি আমরা বহু পূর্বেই গ্রহণ করেছি। এ প্রশ্নে কারো মনে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে ব্যক্তিগত মালিকানা হ্রাস করতেই হবে। এই যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক মালিকানা অর্জন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাধ্যমে আপনাদেরকে দেশ গঠনের কাজে অগ্রসর হতে হবে।
বন্ধুরা আমার, আদর্শের উপর ফাটল যেন না হয়। বাংলার স্বার্থে পৃথিবীর যে দেশের সঙ্গে যে কোন জায়গায় বন্ধুত্ব করা দরকার তা আমরা করব। নিরেপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি আমাদের অবলম্বন। বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার জন্য আমরা সেই সমস্ত জাতির পাশেই দাঁড়াব। বহু রক্তের বদলে, বহু দুঃখের রজনী পার করে আমরা জেনেছি স্বাধীনতার লড়াই কি। আমরা জেনেছি সাম্রাজ্যবাদীরা যারা এখনো পৃথিবীর দিকে দিকে বিভিন্ন জাতিকে পদানত করে রেখেছে, সেই সমস্ত পদদলিত জাতির বুকের মর্মজ্বালা কি। একদিন আমেরিকাকে বৃটিশ রাজ্যের অধীন থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হয়েছিল। বোস্টনের বন্দরে যেদিন জাহাজ ডুবিয়ে দিল, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এবং জর্জ ওয়াশিংটনের অসি ঝলসে উঠল বোস্টনের তীরে তীরে। আর জেফারসনের বলিষ্ঠ কণ্ঠ যেদিন মানবতার জয়গান গাইল, সেদিনের আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছিল। তাহলে কেন আজ সাম্রাজ্যবাদী ইয়াহিয়ার জন্য অস্ত্র আসছে? আমি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে আপনাদের তরফ থেকে মনের বেদনা প্রকাশ করেছি, প্রতিবাদ জানিয়েছি পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে। বহু সংগ্রামের ভিতর দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়াকে তাঁর জাতীয় স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে হয়েছিল। জারের অত্যাচার, সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত, পরবর্তীকালে হিটলারের আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বীর রুশ জাতি স্বাধীনতার স্বর্ণশিখরে উপস্থিত হয়েছিল। আপনাদের মাধ্যমে আর একবার আমি মহান রুশ জাতির কাছে আবেদন জানাই, তাঁরা এই স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াক। চিরকাল বাংলার মুক্তিকামী মানুষ সোভিয়েত রাশিয়ার মানুষকে স্মরণ করবে।
আমাদের প্রতিবেশী চীনের বর্তমান নায়কেরা ইয়াহিয়ার সঙ্গে মিতালী গড়ে তুলছেন। জানি না পিছনে রাষ্ট্রগত স্বার্থ ছাড়া কি থাকতে পারে। আমরা তো চীনকে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি নাই। চীনের সাধারণ নায়করা যাই বলুন না কেন মহান জাতি চীনের প্রতি কোন অবিশ্বাস আমরা পোষণ করি না। চীনের সাধারণ মানুষকে আমরা আমাদের ভালবাসাই দেই। আর আবেদন জানাই, আপনারা আপনাদের নায়কদের বাধ্য করুন- যেখানে কৃষক-শ্রমিক মরছে, যেখানে একটা জাতি নির্যাতনে নিষ্পাষিত হচ্ছে সেখানে একটা অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী সরকারকে তাঁরা সমর্থন যেন না জানায়। একটা সাম্রাজ্যবাদী সরকারকে কী করে আজকে আপনাদের নায়করা সমর্থন করেছেন। তা একবার আপনারা দেখুন।
বন্ধুরা, মনে রাখতে হবে আমাদের স্বাধীনতা অন্য কেউ এনে দেবে না। নিজেদের স্বাধীনতা নিজেদেরকেই অর্জন করতে হবে। বাইরের কোন রাষ্ট্র স্বাধীনতার ফল এনে দেবে, এ ধারণা ভুল। দশ লক্ষ বাঙ্গালী রক্ত দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন রক্ত যখন আমরা দিতে শিখেছি তখন রক্ত আরো দেবো, বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো। দশ লক্ষ বাঙ্গালী বীর যারা প্রাণ দিয়েছে তাঁদের কসম দিয়ে আপনাদেরকে বলছি, আজকে স্বাধীনতার লড়াই-এ প্রয়োজন পড়লে আরো আমরা প্রাণ বিসর্জন দিব। তবু আপোস করব না। ইয়াহিয়া খান সাহেব তাঁর শেষ বেতার ভাষণে আমাদের হুমকি দিয়েছেন। এই ইয়াহিয়া খান বাংলার নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিদের সদস্যপদ বাতিল ব্যবস্থা করেছেন। ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমরা নির্বাচিত সদস্য নই। বাংলার মানুষ আমাদেরকে নর্বাচিত করেছে। তাঁদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্যই আজ আমরা গৃহহারা, সর্বহারা, আজ আমরা বনে জঙ্গলে ঘুরছি। কে তুমি ইয়াহিয়া? তোমাকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব কে দিয়েছে? পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণও তোমাকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয় নাই। নির্যাতিত পাঠান, বেলুচ, সিন্ধিদেরকেও তুমি শাসন করে চলেছো। পাঞ্জাবের চাষী-মজুরদের উপর অত্যাচারে তুমি জমিদারদের সহায়তা করেছো। তোমার হুমকি ও ঔদ্ধত্যের উত্তর রণক্ষেত্রে আমাদের বীর সৈনিকেরা দেবে।
সর্বশেষে আপনাদেরকে বলি সংকল্পে অটুট থাকতে হবে! দুর্বলতা কোনভাবে যেন আমাদের মনে স্থান না পায়। পরিপূর্ব স্বাধীনতাই আমাদের লক্ষ্য। স্বধীন সার্বভৌম বাংলার বিকল্প কোন প্রস্তাব, আপনাদের কাছে, বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তৎসত্ত্বে ইয়াহিয়া খান সাহেবের কাছে বলেছিলাম, আহবান জানিয়েছিলাম যুদ্ধ বন্ধ করুন। আমরা দশ লক্ষ মরেছি, তোমার ২৫ হাজার সৈনিককে তো ইতিমধ্যে মুক্তি বাহিনীর লোকেরা খতম করেছে। ২৫ থেকে ৩০ হাজার সৈন্য আহত হয়েছে। শুধু বাংলার ঘরে ঘরে মা-বোনেরা ক্রন্দন রোল নয়, পাঞ্জাবের ঘরেও তো ক্রন্দনের রোল। সেখানেও বিধবার মর্মভেদী হাহাকার তোমার কানে কি পৌঁছে না? তাই যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধান কর।
(১) বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার কর। (২) বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দাও। (৩) সমস্ত সেনাবাহিনী প্রত্যাহার কর। (৪) যে ক্ষতি করেছ তাঁর ক্ষতিপূরণ দাও। এই চারটি শর্ত আমি দিয়েছিলাম শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য। ইয়াহিয়া খান প্রত্যুত্তর দিয়েছেন আটাশে জুন তারিখ। আটাশের পর থেকে শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ রুদ্ধ হয়েছে। এখন বাংলার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে বাংলার মাঠে, প্রান্তরে, পদ্মা, মেঘনা, যমুনার কূলে যুদ্ধের মাধ্যমে।
আপনাদের সুযোগ প্রধান সেনাপতির নির্দেশে তাঁর সৈন্যবাহিনী রক্ত ঢেলে দিচ্ছে। তাঁদের সেই তপ্ত লহু আজ আপনাদের সংকল্পকে আরো দৃঢ় করুক। বাংলার যে শত শত সতী তাঁদের ইজ্জত দিয়েছে, তাঁদের ইজ্জতের শপথ- ইয়াহিয়া বাহিনীকে নির্মূল না করা পর্যন্ত, বাংলার স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের বিশ্রাম নাই। আপনারা সংকল্পবদ্ধ হউন, আপনারা শপথ করুন, মুক্তিযুদ্ধে যে কোন অবস্থায়, যে কোন অধ্যায়ে আপনারা ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
দীর্ঘকাল বহু সুখে-দুঃখে আমরা আপনাদের পাশে পাশে ছিলাম। আমরা প্রিয়তম নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন, আপনারা দীর্ঘকাল দিয়েছেন, স্নেহ দিয়েছেন, কোনদিন কী আমরা আপনাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছি? বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস, আপনাদের স্নেহ-ভালবাসার বিনিময়ে আমরা কি কোনোদিন আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছি? ২০-২২ বছরের ইতিহাস যদি একথা বলে সুখে-দুঃখে জয়-পরাজয়ে গৌরবে-অগৌরবে আপনাদের পাশে ছিলাম। আপনাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করি নাই। আজ আপনাদের কাছে আকুল আবেদন জানাব আবার আপনারা বিশ্বাস করুন। দেখুন আমরা কি করতে পারি, যদি না পারি তবে শুধু আপনাদের কাছে নয় অনাগত ভবিষ্যতের কাছে আমাদের কি জবাবদিহি করতে হবে না? আমার বিশ্বাস আমার মন্ত্রিসভার সদস্যরা এবং আমার প্রধান সেনাপতিও এ সম্বন্ধে সজাগ।
১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল এই তিন বছর আমি আপনাদের পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু এই তিন বছর কারাগারে ছিলেন। আইয়ুব-শাহীর দাপট আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমি দেখেছি তখনও আপনারা অধৈর্য হন নাই। আমি কোনোদিন ধৈর্য হারাই নাই। বহুবার আপনাদের বলেছি, সংগ্রামে জয়ী হতে হলে ধৈর্যের প্রয়োজন। বহুবার সংগ্রামের বহু কৌশল নিয়ে আপনাদের সাথে আমার মতবিরোধ হয়েছে। আজ আমি গর্বের সাথে বলতে পারি আমার প্রবর্তিত কৌশলের ফলে আমরা ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত তথা আইয়ুব-শাহীকে খতম করেছিলাম।
বিশ্বাসের বলে আপনারা আমাকে বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী হিসেবে প্রধান সহ-সভাপতি করেছিলেন। এই বিশ্বাসের বলে আপনারা আমাকে জাতীয় পরিষদে ডেপুটি নেতা করেছিলেন। আমি জানি, এই বিশ্বাসের বলে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আবার আপনারা আমাকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দিয়েছেন। আমার ভাগ্য এই যে, আমার নেতা, আমার ভাই, আমার প্রিয়তম বন্ধু শেখ সাহেব যখনই যান, তাঁর অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব ঘাড়ে পড়ে যায়। সেই কাজ চিরকাল আপনাদের পাশে পাশে থেকে করেছি। আজও আপনাদেরকে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- যদি বিশ্বাসঘাতকতা করি, যদি সংকল্পে কোনরকম মলিনতা দেখেন, যদি আপনাদের নীতি ও আদর্শ থেকে কোনোদিন বিচ্যুত দেখেন, আপনারা আস্তকুড়ে নিক্ষেপ করবেন। কিন্তু বাংলার এই সঙ্কট মুহূর্তে, জাতির স্বাধীনতার এই ক্রান্তিলগ্নে যেখানে শত শহীদের রক্তে আজকে ইতিহাস লেখা হয়েছে, আর সেখানে হাজার হাজার সৈনিক আজকে বনে-প্রান্তরে ইতিহাস লিখে চলছে, সেই মুহূর্তে আর একবার আপনারা আস্থা স্থাপন করুন। আমার বন্ধু তাজউদ্দিন সাহেব দীর্ঘদিন আপনাদের পাশে পাশে সংগ্রাম করেছেন, বহু জেল খেটেছে। আমার ভাই মোস্তাক সাহেব, মনসুর সাহেব, কামরুজ্জামান সাহেব দীর্ঘকাল সংগ্রামের পরীক্ষিত সেনাপতি। তাঁদের উপর আপনারা আস্থা স্থাপন করুন। একথা আমি বলব না, নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সমালোচনা আপনারা করবেন না। সমালোচনার উদ্দেশ্য হবে একটা- কী করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করা যায়।
আর যদি বাংলার স্বাধীনতা এই মন্ত্রীসভার নেতৃত্বে একদিন অর্জিত হয়, সেই গৌরব আপনারা নেবেন, আওয়ামী লীগের কর্মীরা নেবেন, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ নেবেন, মুক্তিযোদ্ধারা নেবেন। আর সেদিন যদি শুধু কিছু ধন্যবাদ মন্ত্রিসভার সদস্যদের দেন, তবে আমি কৃতার্থ হব। আপনাদের সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।
-জয় বাংলা