শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠন ও তার যুদ্ধ তৎপরতা | বাংলাদেশ একাডেমীর দলিলপত্র | ১৯৭১ |
<১০, ২৩, ৫২৩-৫২৫>
সাক্ষাৎকারঃ এয়ার ভাইস মার্শাল আবদুল করিম খন্দকার*
১৮-১০-১৯৭৩
১৫ই মে সকালে আমরা আগরতলাতে পৌছি। ১৬ই মে সকালে আমি কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হই। কর্নেল ওসমানির সাথে আমার দেখা হয়। ১৯/২০শে মে দিল্লিতে যাই ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করার জন্য। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বিমান সংগ্রহ করে একটা বিমানবাহিনী গঠন করা। এব্যাপারে সম্ভাব্য ভারতীয় সাহায্যের জন্য আমার সাথে যারা ছিল তারাও ইতিমধ্যে দিল্লি পৌঁছে যায়। সেখানে ভারতীয় বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে আমার বিস্তারিত আলোচনা হয়। আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। আলোচনা করে বুঝতে পারলাম যে, রাজনৈতিক এবং নানাবিধ কারনে তারা এখন আমাদেরকে বিমান দিয়ে সাহায্য করতে পারবে না। তবে সময় আসলে তারা আমাদেরকে সাহায্য করবে। তারা পাকিস্তান বিমানবাহিনী সম্বন্ধে অনেক গুরুত্বপুর্ন গোপনীয় তথ্য জেনে নেয়।
মে মাসের শেষের দিকে আমরা কলকাতায় চলে আসলে, তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে আমরা স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহন করব। এই সময় আমাকে ডেপুটি চীফ অফ স্টাফের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং অপারেশনঃ বিমান বাহিনীর অন্যান্য অফিসারদের বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। মুক্তিবাহিনীর জন্য রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং এবং তাদেরকে বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো, এসব দায়িত্ব আমার ছিল। অস্ত্রশস্ত্র অ ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সেক্টরের প্রয়োজনানুসারে দেয়া হত। বিদেশী কোন রাষ্ট্র থেকে আমরা সরাসরি কোন সাহায্য পেতাম না। ভারত সরকার থেকে আমরা অস্ত্রশস্ত্র পেতাম। কিছু ওয়ারলেস সেট আমেরিকা থেকে বাঙ্গালীরা পাঠিয়েছিলো।
প্রথমে প্রত্যেক মাসে ২/৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া হত। কিন্তু পরে প্রত্যেক মাসে ১০/১২ হাজার গেরিলাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হত। শেষপর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ ১ হাজার গেরিলাকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল। প্রথমে প্রত্যেক গেরিলাকে এক মাসের ট্রেনিং দিয়ে ভিতরে পাঠানো হত। কিন্তু পরে ট্রেনিং-এর সময় কমিয়ে দু’সপ্তাহ করা হয়, যাতে করে বেশী লোককে ট্রেনিং দেয়া যেতে পারে। যখন দেখা গেল দু’সপ্তাহের ট্রেনিং-এ গেরিলারা ভাল কাজ করতে পারছে না, তখন এটা বাড়িয়ে তিন সপ্তাহ করা হল।
গেরিলা ট্রেনিং শেষ হবার পর গেরিলাদের প্রথমে ভারতীয় সেক্টর কমান্ডারের কাছে রিপোর্ট করতে হত। পরে ভারতীয় সেক্টর কমান্ডারদের সাথে আলাপ করে ঠিক করা হল সে গেরিলারা বাংলাদেশের সেক্টর কমান্ডারদের কাছে রিপোর্ট করবে।
ট্রেনিং শেষ হবার পর গেরিলাদেরকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনমত অস্ত্র জমা দিত না বা দিতে পারত না। অনেক সময় মাত্র একটা গ্রেনেড দিয়ে তাদেরকে অপারেশনের জন্য পাঠানো হত। এতে অনেক সময়ের অপচয় হয়েছে এবং অনেক গেরিলাকেও আমরা হারিয়েছি। পরে এ ব্যাপার নিয়ে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের বিতর্ক হয়। অবশ্য পরে গেরিলাদেরকে অস্ত্র দেয়া হত।
গেরিলা বাহিনীতে স্কুল-কলেজের ছাত্র এবং যুবকরা বেশীরভাগ যোগ দিয়েছিল। ট্রেনিং শেষ করার পর প্রত্যেক সেক্টরে কতজন গেরিলা পাঠানো হবে তা হেডকোয়ার্টার থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল এবং অস্ত্রশস্ত্রের পরিমানও নির্ধারন করে দেয়া হয়েছিল। গেরিলা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে গেরিলারা সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করছিল না। অবশ্য তার কারণও অনেক ছিল, যেমন – তারা অস্ত্রশস্ত্র পেত না, নেতৃত্ব বা সংগঠন ছিল না। পরে আমরা ভারতীয় গয়েন্দা বিভাগের লোকজনসহ বসে ঠিক করে দিতাম কোথায় গেরিলা অপারেশন চালাতে হবে এবং অপারেশনের পর আমাদেরকে তার বিশদ বিবিরন জানাতে হবে। প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই গেরিলা যুদ্ধ কার্যকরী হয়েছিল।
গেরিলা যুদ্ধের শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গ্রাম এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চলাচল মারাত্বক বিপন্ন হয়ে উঠছিল। কোথায় যে মুক্তিযদ্ধারা আছে তাও তারা বলতে পারত না। সব সময় একটা ভয় তাদের মধ্যে ছিল। মুক্তিবাহিনীর এই সাফল্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে পরাজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ।
প্রথমদিকে বিমানবাহিনীর সমস্ত পাইলট, টেকনিশিয়ান স্থল যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল। পরে স্থির করা হল একটা এয়ারফোর্স ইউনিট গঠন করতে হবে। ভারতীয় বিমানবাহিনী আমাদেরকে একটা অটার, একটা অলওয়েত হেলিকপ্টার এবং একটা ডিসি-৩ ডাকোটা বিমান দিয়েছিল।
পাইলটদের মধ্যে ছিল স্কোয়াড্রন সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন মরহুম মালেক, ক্যাপ্টেন মরহুম শরফুদ্দিন, ক্যাপ্টেন সাত্তার, ক্যাপ্টেন মুকিত, ক্যাপ্টেন শাহাব, ক্যাপ্টেন আকরাম, এবং এয়ারফোর্সের প্রায় ৭০ জন টেকনিশিয়ান। যেহেতু আমাদের কমসংখ্যক পাইলত এবং বিমান ছিল সেহেতু আমরা পরিকল্পনা নিলাম যে আমরা এমনভাবে অপারেশন চালাব যাতে করে আমাদের পাইলট বা বিমান না হারায় বা ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই সমস্ত বিমান বোমা, রকেট এবং মেশিনগান দিয়ে সজ্জিত করা হয়। ২৮শে সেপ্টেম্বর ন্যাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে বিমানবন্দরে এদেরকে একত্রিত করা হল। আমরা রাতে আক্রমণ চালাব ঠিক করলাম। প্লেনগুলোকে মাটির উপর ৩০০ ফুটের নিচ দিয়ে ফ্লাই করার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। কেননা ৩০০ ফুটের নিচে উড়লে রাডার স্ক্রীনেতা ধরা পরে না।
কোন নেভিগেশন সাহায্য ছাড়াই আমরা রাতে ট্রেনিং শুরু করি। বনজঙ্গলের মধ্যে গাছের ঠিক উপর দিয়েই আমরা উড়তাম। নিকটবর্তী এক পাহাড়ের চুড়ায় সাদা প্যারাসুট ফেলে সেটাকে টার্গেট করে মেশিনগান, রকেট, বমা ছোড়া হত বা নিক্ষেপ করা হত। আমি নিজে বিমানে উঠে ট্রেনিংয়ে সাহায্য করতাম। সারারাত ধরে ট্রেনিং এর কাজ চলত। অল্পদিন পরেই বুঝতে পারলাম যে নিচু লেভেলে উড়ে বাংলাদেশের অভুন্তরে গিয়ে আমরা কার্যকরভাবে অপারেশন চালাতে পারব।
৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ ঘোষণার আগে ভারতের মাটি থেকে আমরা যদি বিমান হামলা চালাতাম তাতে অনেক অসুবিধা ছিল। তাই ভারতের সাথে এ ব্যাপারে আমাদের একটা বঝাপড়া হয়েছিল কখন আমরা আক্রমন চালাব। সবশেষে সেই সুযোগ আসল।
৩রা ডিসেম্বর রাত দুটোর সময় একই সময়ে আমাদের বিমান চট্রগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তী অয়েল ডাম্প এবং নারায়নগঞ্জের কাছে গোদানাইলে বিমান হামলা চালায় এবং এ হামলা খুব কার্যকরী হয়েছিল। এর পর থেকে আমরা বিমানে দিনের বেলাতেও আক্রমন চালাতাম। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীকে আমরা এয়ার সাপোর্ট দিয়েছি। এমন অনেক জায়গা ছিল যেগুলো ভারতীয় পাইলটরা চিনত না বা জানত না, সেখানে আমাদের পাইলটরা গিয়ে আক্রমন চালিয়েছে। যুদ্ধর অগ্রগতির সাথে সাথে বিশাল এলাকা মুক্ত হতে লাগল। প্রথমত, মুক্ত এলাকাগুলোর প্রশাসন সেক্টর কমান্ডারদের উপর ন্যস্ত করা হয়। আমরা বুঝতে পারছিলাম যে, যুদ্ধ খুব সুন্দরভাবে চলছে। ১৪ই পর্যন্ত আমরা বুঝলাম যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে।
১৬ই ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ আমাকে ডেকে পাঠালেন। সেখানে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাম মনসুর আলী, খন্দকার মুশতাক সবাই উপস্থিত ছিলেন। আমাকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসাবে আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে যাবার জন্য বলা হয়। আমি ভারতীয় সামরিক বাহিনীর হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ করি। আমাকে দমদম বিমানবন্দরে যেতে বলা হয়। আমি কলকাতা দমদম বিমানবন্দরে গেলাম। সেখানে জেনারেল আরোরা, জেনারেল জেকব, এবং ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অনেক উচ্চপদস্থ অফিসার ছিল। আমরা বাংলাদেশের পথে প্রথমে আগরতলা আসলাম। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে রওনা হলাম।
ঢাকা বিমানবন্দরে রানওয়ে মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। রাস্তাঘাটে খুব বেশী লোকজন ছিল না। এ অবস্থা আমরা বিমানে বসে লক্ষ করছিলাম। বিমানবন্দরে খুব একটা ভিড় ছিল না। আমরা বিমান থেকে অবতরন করলাম। জেনারেল নিয়াজী আমাদেরকে সংবর্ধনা জানালেন।
আমরা বিমানবন্দর থেকে সোজা রেসকোর্সের মাঠে গেলাম। সেখানেও আস্তে আস্তে লোকের ভিড় হচ্ছিল। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু যেখান থেকে ভাষন দিয়েছিলেন সেখানে আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। জনগন আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। তারা জেনারেল আরোরাকে কাঁধের উপর উঠিয়ে নেয় এবং বিজয়োল্লাসে মেতে উঠে। জেনারেল নিয়াজীকে খুব বিমর্ষ দেখা যাচ্ছিল।
ভারতীয় সরকার এবং জনগন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অভুতপূর্ব সাহায্য এবং সহোযোগিতা করেছেন। ভারতকে সবসময় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করতে হয়েছে। বিশ্ব জন্মতের প্রতিক্রিয়া কি, সেটাও লক্ষ্য রাখতে হয়েছে। তাদেরকে অনেক অনেক ভেবেচিন্তে আমাদের মুক্তিসংগ্রামে সাহায্য করতে হয়েছে।
আমি বলতে চাই, তারা আবেগের বশবর্তী হয়ে কোন কিছু করেনি। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষন করেছে এবং ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে। রাজনৈতিক, কুটনৈতিক, এবং সামরিক দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে তারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সবকিছু করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের বিভিন্নদেশে সফর করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে উপমহাদেশের ঘটনাবলী অবহিত করেছিলেন। আমার মনে হয় ভারত যুদ্ধের জন্য প্রথমে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু বিভিন্ন দেশ সফর করার পর হয়ত ভারত যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
ভারত প্রথমে আমাদেরকে স্বীকৃতিও দেয়নি। কারন, যদি ভারত আমাদের প্রথম স্বীকৃতি দিত তাহলে হয়ত বিশ্বজনমত যুদ্ধের জন্য ভারতকে দোষারোপ করত। অবশ্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিছু কিছু কার্যকলাপ জনসাধারনের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। যুদ্ধে ভারতের জয়ের তিনটি প্রধান কারণ ছিলঃ ১। মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যাতায়াত ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছিল। সেনাবাহিনীর চলাচলে কোন নিরাপত্তা ছিল না। তাদেরকে সব জায়গায় প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ২। ভারতীয় বিমানবাহিনীর অভুতপূর্ব সাফল্য যুদ্ধের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল। বিমানবাহিনীর আক্রমনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সব জায়গা থেকে পিছু হাটতে বাধ্য হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের সাহায্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমস্ত গোপনীয় তথ্য জেনে নেয়।
স্বাক্ষরঃ আবদুল করিম খন্দকার
১৮-১০-১৯৭৩
*১৯৭১ এর মার্চে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসাবে কর্মরত ছিলেন।