সশস্ত্র সংগ্রামে গেরিলা বাহিনী
শিরোনাম | সূত্র | সময়কাল |
১৬। বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে গেরিলা বাহিনীর গঠন ও যুদ্ধ তৎপরতার বিবরণ। | ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ ৮ ই জানুয়ারী, ১৯৭২ |
এপ্রিল-ডিসেম্বর ১৯৭১ |
<৯, ১৬.১, ৪৫০-৪৫১>
কাদের বাহিনীর গঠন ও যুদ্ধ তৎপরতা-১
সাক্ষাৎকারঃ কাদের সিদ্দিকী
১৯৭২
(দৈনিক পূর্বদেশ (৮ই জানুয়ারি ১৯৭২)-এ প্রকাশিত “বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার” থেকে সংকলিত। সাক্ষাৎকারটি যৌথভাবে গ্রহণ করেছিলেন কাদের বাহিনীর সদস্য রফিক আজাদ ও মাহবুব সাদিক)
প্রশ্নঃ স্যার, কি করে আপনি এই বিরাট সংগঠন গড়ে তুললেন, একটু বলবেন কি?
উত্তরঃ ৩রা এপ্রিল নটিয়াপাড়া যুদ্ধের পর আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। পাক বাহিনী টাঙ্গাইলে আসে। ১৯শে এপ্রিল ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসরমান পাক বাহিনীকে কালিহাতীতে বাঁধা দেই। নেতৃত্বে ছিলো ইপিআর। এখানেই আমি প্রথম গুলি ছুড়ি। পাক বাহিনীর একজন মেজর সহ অসংখ্য লোক মারা যায়। আমরা ডিফেন্স উঠিয়ে ছত্রভঙ্গ হই। গ্রাম গ্রামান্তরে ঘোরাঘুরির পর সংবাদ পাই পাহাড়ে একটি ইপিআর-এর প্লাটুন আছে। এই প্লাটুনকে খুজতে থাকি। আমার সঙ্গে এগারো জন ছিলো। ছিলো মনি, খোরশেদ আলম ও শাহজাহান। এক রাতে ৪১ মাইল পথ হেটে আড়াইপাড়া মাদ্রাসায় আস্তানা গড়ি। এই সময় পাহাড়ের হামিদুল হকের সঙ্গে দেখা পাই। ইপিআর্ִদের রেখে যাওয়া কিছু অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত হয়। এই পর্যায়ে আমার সংগঠনের সদস্যসংখ্যা একশতে দাড়ায়। এখান থেকেই সত্যিকারের সূত্রপাত।
প্রশ্নঃ স্যার, আপনার নেতৃত্বে কখন কোথায় প্রথম যুদ্ধ হয়?
উত্তরঃ কালিহাতী থেকে তিন মাইল দূরে চারান নামক গ্রামে। তারিখটা ২২শে মে। এখানে আমি এলএমজি ব্যবহার করি।
প্রশ্নঃ জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধে আপনার সঙ্গে কি ধরনের সহযোগিতা করতো?
উত্তরঃ প্রথম দিকে তারা পাক বাহিনীর ভয়ে ছিলো। অচিরেই এই ভয় কেটে যায় এবং তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা শুরু করে।
প্রশ্নঃ আপনি কোথা থেকে হাতিয়ার পেতেন? আপনাকে কারা হাতিয়ার সরবরাহ করতো?
উত্তরঃ কেন, চীন ও আমেরিকা। অবাক হচ্ছেন বুঝি? অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা তারা পাক বাহিনীকে হাতিয়ার দিতো, আমরা পাক বাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নিতাম।
প্রশ্নঃ স্যার, আপনার জওয়ানদের কতটুকু প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠাতেন?
উত্তরঃ যারা দেশমাতৃকার যোগ্য সন্তান তারা নিজের মাকে রক্ষা করার জন্য খালি হাতেও লড়তে পারে। ট্রেনিং-এর চেয়ে আদর্শ চেতনাই বড়। ট্রেনিং দিয়ে তাদের যুদ্ধ শিখাতে হয়নি, শত্রুর মোকাবেলা করেই তারা যুদ্ধ করতে শিখেছে।
প্রশ্নঃ আপনার পরিচালিত অধিকাংশ যুদ্ধগুলো চোরাগোপ্তা না সম্মুখসমর?
উত্তরঃ অধিকাংশ সম্মুখসমর। ব্যতিক্রম কেবল মাকড়াই’র যুদ্ধ।
প্রশ্নঃ যুদ্ধক্ষেত্রে ধৃত শত্রুদের ব্যাপারে আপনি সাধারণতঃ কি ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন?
উত্তরঃ যতক্ষণ শত্রুর হাতে হাতিয়ার থাকতো ততক্ষণই সে আমার বাধ্য। কিন্তু বন্দী ও আত্মসমর্পিত শত্রুর প্রতি আমার কোনো দ্বেষ ছিলো না। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হতো।
প্রশ্নঃ স্যার আপনি নিজে যে সমস্ত যুদ্ধ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনটি এবং কেনো?
উত্তরঃ ধলাপাড়ার কাছে মাকড়াই-এর যুদ্ধ, ২১শে নভেম্বর বাঁশাইলের কামুটিয়ার নদীর ধারে সংঘটিত যুদ্ধ। মাকড়াইতে দশ মিনিটের যুদ্ধে ৩৮ জন খান সেনাকে হত্যা করি। কামুটিয়ার খান সেনাদেরও পাকা বাংকার ধূলিস্যাৎ করে তাদের তিন মাইল দূরে তাড়িয়ে দেই।
প্রশ্নঃ স্যার যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর প্রতি আপনার কখনো অনুকম্পা হতো?
উত্তরঃ হ্যা, মাঝে-মধ্যে কখনো হতো বৈকি।
প্রশ্নঃ নয়মাসে আপনার জীবনের প্রতি কোনো যুদ্ধে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি এসেছিলো, কেমনভাবে এবং কেনো?
উত্তরঃ নাগরপুরের। আকস্মিকভাবে একটি চরম অসুবিধাজনক অবস্থান থেকে শত্রুর উপর গুলি চালাচ্ছিলাম। তিন দিকেই আমাদের সবার রাস্তা বন্ধ ছিলো। চতুর্থ দিকে কেবল পানি আর পানি। ইতিমধ্যে আমার দিকে অগ্রসরমান শত্রুর কমান্ডারকে নিজের দলের ছেলে মনে করে তাকে অনেক কাছে এগুতে দেই। ৪০ গজ দূরে থাকতে তাকে শত্রু বলে চিনতে পেরে গুলি ছুড়তে থাকি। পরে তিন দিকের শত্রু বেষ্টনী ভেদ করে নিরাপদ আশ্রয়ে যাই।
প্রশ্নঃ স্যার, মুজিবনগর থেকে আপনি কখনো সক্রিয় সাহায্য পেয়েছেন?
উত্তরঃ আগষ্ট মাসের পূর্ব পর্যন্ত মুজিবনগর থেকে কোনো সাহায্য পাইনি। পরে অবশ্য পেয়েছি।
প্রশ্নঃ আপনার অধিনে যে সব জওয়ান আছে তাদের মধ্যে কে কে আপনাকে প্রায় অধিকাংশ যুদ্ধে ছায়ার মতো অনুসরণ করতো?
উত্তরঃ সবু, খোকা, হালিম, ফজলুল হক, আবদুল্লা, ফজলু, আজাহার, লতিফ, দুলাল, মাসুদ, বেনু, শামসু, সাখাওয়াত এবং আরো কয়েকজন।
প্রশ্নঃ মুক্তিযুদ্ধে আপনাকে কে প্রেরণা জোগাতেন?
উত্তরঃ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।