সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী

<১০, ২১.৪, ৪৯১-৪৯৫>

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী

৩১-১১-১৯৭৩

 

সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নির্দেশে কোনাবনে প্রথম প্রতিষ্ঠা করি বাংলাদেশে গোলন্দাজ বাহিনী। ৫৯ মাউন্টেন রেজিমেন্টের একটি ব্যাটারী নিয়ে এর যাত্রা। এই ব্যাটারীর সাথে প্রায় দেড় মাস থাকার পর আমি প্রয়োজনের তাগিদে পাকিস্তান থেকে আগত ক্যাপ্টেন পাশার কাছে আমার দায়িত্ব হস্তান্তর করে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার হিসেবে যোগদান করি।

প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টে তখনি কমান্ডিং অফিসার ছিলেন তদানীন্তন মেজর (বর্তমানে কর্নেল) মাঈনুল হোসেন চৌধুরী। এই রেজিমেন্টটি তদানীন্তন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে সিনিয়র টাইগার হিসেবে পরিচিত ছিল। সিনিয়র টাইগার তখন কামালপুর অপারেশনে ব্যস্ত ছিল। এই ব্যস্ততার মধ্যে আমি আমার দায়িত্ব ভার গ্রহন করি। যেহেতু প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের এলাকাভিত্তিক দায়িত্ব ছিল মহমনসিংহ থেকে রংপুর পর্যন্ত সেহেতু আমাকে রংপুরের কোদালকাটি নামক স্থানে শত্রুর উপর হামলা চালাবার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আমার সাথে সাথে মেজর জিয়াউদ্দিন ব্যাটালিয়ানের নতুন কমান্ডিং অফিসার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। তাঁর নির্দেশে আমি কোদাল মাটিতে সাময়িকভাবে ডিফেন্স স্থাপন করি। পরদিন পুরা এলাকা দেখার পর রাত্রি প্রায় ২টার সময় শত্রুঘাটি পুরোপুরি ঘেরাও করে ফেল।শত্রুরা চারদিক অবরুদ্ধ হবার পর আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। এ সময় এক প্লাটুনের উপর সাংঘাতিকভাবে আক্রমণ চলে এবং তারা প্রায় আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সাথে সাথে আমি শত্রুর উপর প্রতি-আক্রমণ চালাই। আক্রমণের ফাঁকে পঢ়ায় হাতাহাতি চলতে থাকে। আক্রমণের ফলে উভয়পক্ষে যথেষ্ট হতাহতের পর শত্রুপিছু হটতে বাধ্য হয়। শত্রু উপায়ান্তর না দেখে নিরীহ গ্রামবাসীর উপর তাদের জিঘাংসা চরিতার্থ  করে।

ধলাই অপারেশেন (২৮শে অক্টোবর, ১৯৭১) : ধালাই সিলেট জেলার একটি অংশ। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ধালাই রনাঙ্গন প্রখ্যাত ছিল। এই অপারেশনটা চালাবার জন্য প্রথম রেজিমেন্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যদিও এটি ছিল পাক-বাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি তথাপি প্রথম রেজিমেন্টের এ-কোম্পানী কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুব (শহীদ) তার কোম্পানী নিয়ে একবার শত্রুর উপর আঘাত হানেন। কিন্তু স্বপক্ষের বেশ কিছু আহত সৈনিক নিয়ে তাকে ফিরে আসতে হয়। এদের মধ্যে যারা মারাত্মকভাবে আহত হন তাদের মধ্যে প্রথম দুইজন হচ্ছেন সুবেদার ইব্রাহীম এবং অন্যজন হচ্ছেন রকেট লাঞ্চার-এর নাম্বার ওয়ান হাওয়ালদার সোবহান। এদের দু’জনকেই ঘটনাস্থল থেকে হেলিকপ্টারে মুক্তিবাহিনী বেইস হসপিটালে পাঠানো হয়। এরপর আমি সফলতার সঙ্গে খেজুরীচর টার্গেটকে দখল করার পর তদানীন্তন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ধালাই দখল করার ভার আমার উপর ন্যস্ত করেন। যদিও আমি জানতাম এই রনাঙ্গণ থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম ছিল তথাপি দৃঢ়তার সঙ্গে আমাকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে একদিন ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) হাফিজউদ্দিন ঠাট্টা করে বলেছিলেনঃ তোমার নতুন যে প্যান্টটা তৈরী করেছ তা অন্ততঃ একবার পরে যাও। নতুবা মরে গেলেও দুঃখ থেকে যাবে।

১৯৭১ সালের ২৭শে অক্টোবর রণাঙ্গনের দামামা বেজে ওঠে। যাহেতু পুরা ব্যাটালিয়ন এতে অংশগ্রহন করেছিল সেহেতু পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘এ’এবং ‘ডি’কোম্পানি ২৭শে অক্টোবর রনাঙ্গনের দিকে যাত্রা করে। তাদের দায়িত্ব ছিল পেছন থেকে যাতে শত্রু যোগাযোগ করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং শত্রু যাতে সৈন্য এবং রসদ-সরঞ্জামাদি পরিবহন করতে না পারে তা নিশ্চিত করা। ধালাই এলাকায় বেশ এক অংশ জুড়ে পাকিস্তানি সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল। এমনকি প্রত্যেকটা বাংকার কংক্রিটে নির্মাণ করা হয়েছিল। বাংকারগুলো এমন ধরনের ছিল যে এর ভেতর থেকে বের হবার প্রয়োজন খুব একটা হতো না। কারন রসদ সরঞ্জামাদি প্রচুর পরিমাণে মওজুত থাকত। রণকৌশলের দিক থেকে সন্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়াছিল আমার পরিকল্পনা। সেদিক থেকে বিচার করে ২৭শে অক্টোবর সকাল ৪টার সময় আমি কোম্পানী নিয়ে অগ্রসর হই। বলাবাহুল্য, ক্যাপ্টেন নুর প্রথমবারের মত সেদিন আমার সাথে যোগ দেন। তিনি আমার এক নম্বর প্লাটুন নিয়ে বাম দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকেন এবং আমি আমার দুই নম্বর ও তিন নম্বর প্লাটুন নিয়ে ডান দিক দিয়ে অগ্রসর হতে থাকি। টার্গেট থেকে যখন আমি প্রায় ৫০ গজ দুরে ছিলাম তখন কিছু গোলাগুলির আওয়াজ শুনি। অয়ারলেসে জানতে পারলাম যে ক্যাপ্টেন নুর প্রায় শত্রুঘাটির ভিতরে ঢুকে গেছে। এই সময় আমি সুযোগ বুঝে শত্রুর উপর আক্রমণ চালাই। এখন শুধু বুলেটের আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। শত্রু প্রত্যক্ষভাবে আমার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অবশেষে শত্রুর অধিকাংশ আমার উপর নিয়োজিত হয়। সুতরাং এ সময় ক্যাপ্টেন বেশ হতাহত হয়। তিনি একটু পিছে এসে ডিফেন্স নেন এবং আহতদেরকে পেছনে পাঠাবার বন্দোবস্ত করেন। আমিও আর অগ্রসর হতে পারছিলাম না। তাই ডান দিকের বেশ একটা অংশ দখল করে শত্রুর নাকের ডগার উপরে বসে যাই। আমার সাথে বেশ কিছুসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়েছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ হামিদুর রহমান। এই যুদ্ধে আরও দু’জন জোয়ান তাদের দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেন-তাদের একজন হলেন হাওলাদার মকবুল হোসেন ও অপরজন সিপাই আব্দুর রহমান, যিনি দুলে পুলিশবাহিনী থেকে আমাদের সাথে যোগ দেন। তুমুল যুদ্ধের পর ব্রিগেড কমান্ডার জিয়াউর রহমান সাহেব আমাকে যেখানে ছিলাম সেখানে থাকতে নির্দেশ দেন।

পাত্রখোলা চা-বাগানের যুদ্ধঃ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ‘এ’‘বি’এবং ‘ডি’কোম্পানী যারা পাত্রখোলা চা বাগানের মধ্যে তাদের আধিপত্য করেছিলেন তাদের উপর বেশ কয়েকটা আক্রমণ চলে। কিন্তু আক্রমণের ফলে যথেষ্ঠ হতাহতের পর শত্রু পিছু হটতে বাধ্য হয়। যেহেতু এই স্থানটা দখল করা ছিল একান্ত প্রয়োজন সেহেতু বড় ধরনের একট পরিকল্পনা গ্রহন করে হয়েছিল। ২৯শে অক্টোবর সকাল ৫টার সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় জাঠ ব্যাটালিয়ন আমাদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, কিন্তু সেখানেও আমরা বেশ একটা সুবিধা করতে পারিনি। পর্যায়ক্রমে এক ব্রিগেড ভারতীয় সৈন্য এক ডিভিশন আর্টিলারী নিয়ে আমাদের সাথে অংশগ্রহণ করে। এভাবে একটানা পাঁচদিন যুদ্ধের পর শত্রুপক্ষ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। উল্লেখযোগ্য যে, যুদ্ধে ভারতীয় কমান্ডার এবং দ্বিতীয় জাঠ ব্যাতালিয়নের কমান্ডিং অফিসার আহত হন। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষ যথেষ্ঠ দৃঢ়তার পরিচয় দেয়।

ধালাই যুদ্ধের ফলাফলঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনবরত পাঁচদিন যুদ্ধের পর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তাদের মধ্যে অবশ্য প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বাকী সৈন্যদের মধ্যে অনেকে ধরা পরে এবং অনেকে পালিয়ে যায়। পরাজয়ের একমাত্র কারন ছিল শত্রুর লাইন অব কমিউনিকেশন চতুর্দিক থেকে কেটে দেওয়া হয়। তাই সম্মুখসমরে তারা সুবিধা করতে পারেনি। এ যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা পুরোপুরি নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবুও আনুমানিক বলা চলে আমাদের নিহতের চেয়ে আহতই বেশী হয়েছে। অন্যদিকে, শত্রুর নিহতের সংখ্যা ছিল বেশী। ধালাই যুদ্ধে পরাজয়ের পর সিলেটে শত্রু বাহিনীর ছোটাছুটি অনেক পরিলক্ষিত হয়। কারন যে ক’টি বিখ্যাত ঘাঁটি ছিল তার মধ্যে ধালাই ছিল অন্যতম। এখান থেকেই প্রায় ৫০ মাইল এলাকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হতো।

সিলেট যুদ্ধের পরিকল্পনাঃ ১৯৭১ সালের ২০শে নভেম্বর প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট সিলেটে সমস্ত শত্রুর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি দখল করার জন্যে সিলেটের ভিতর দিয়ে ‘এডভান্স টু কন্ট্যাকট’চালাবার জন্য পরিকল্পনা করা হয়। ২০শে ঈদের নামাজের পর ভারতে সীমানা অতিক্রম করে বালা গ্রামের কিছু পিছনে অবস্থান করি। সমস্ত এলাকা দেখার পরে রাত প্রায় আটটার সময় পুরা ব্যাটালিয়ন নিয়ে আমরা কউএকটি টার্গেটের দিকে অগ্রসর হই। উল্লেখযোগ্য যে, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বেশ কয়েকটি টার্গেট এখানে ছিল। এদের মধ্যে যেগুলোতে সৈন্যসংখ্যা বেশী ছিল সেগুলোর মধ্যে আটগ্রাম, চারগ্রাম ও বালা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট কতকগুলো শত্রু ছাউনি থাকাতে অগ্রসর হওয়া বেশ দুষ্কর ছিল। কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পরেই চারদিক থেকে ছোট ছোট অস্ত্রের গোলাগুলি আসতে থাকে, ফলে আমাদেরকে কিছুক্ষণের জন্য অবস্থান নিতে হতো। পুরা ট্রুপসকে পিছনে রেখে কোম্পানী কমান্ডারকে তার দল নিয়ে রেকি করতে হত, তারপর আবার পথ চলতে হত। এভাবে রাত প্রায় ২টার সময় আমি ‘সি’কোম্পানীকে নিয়ে বালায় অবস্থিত টার্গেট থেকে প্রায় ১০০ গজ দুরে ডিফেন্স নিই। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ৪৫ গুর্খা বাহিনীও আমাদের সাথে অঙ্গশগ্রহণ করেছিল। ৪৫ গুর্খা বাহিনীর সাথে ছিল আমাদের ‘ডি’কোম্পানী। তাদের দায়িত্ব ছিল আটগ্রামের শত্রু ঘাটি দখল করা। সব কোম্পানী নিজের দায়িত্ব পালন করার জন্য সুবিধামত টার্গেটের নিকটবর্তী কোন জায়গায় হাইড-আউট করেছিল। শত্রু বাঙ্কারগুলো ইতস্তত বিক্ষিত থাকাতে আমাআদের নড়াচড়া একটু সাবধানেই করতে হতো। আমাদের এইচ-আওয়ার ছিল সকাল ৬টা। সুতরাং এইচ-আওয়ারের পাঁচ মিনিট আগে গোলন্দাজ বাহিনীকে ডাকা হয়-যাকে বলা হয় প্রি-আওয়ার গোলাবর্ষণ। ৫ মিনিট নর্মাল ফায়ার এর পর গোলন্দাজ চপ হয়ে যায়। তার সাথে বাল, চারগ্রাম ও আটগ্রামের উপর বঙ্গশার্দুল ও গুর্খারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। অর্ধ ঘন্টার ও বেশী সময় তুমুল গোলাগুলির পর তিনটি শত্রু ঘাঁটিই আমাদের করায়ত্ত হয়। এদের মধ্যে শত্রুর সবচেয়ে বেশী ক্ষয়ক্ষতি হয় আটগ্রামে। এটা শত্রুর ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার এবং দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ছিল। এখানে বেশকিছু এ্যামুনিশন ডাম্প ও ছিল। অবশ্য শত্রু সহজেই আত্মসমর্পন করেনি। যথেষ্ঠ হতাহতের পর কিছু আত্মসমর্পণ করে এবং কিছু এদিক ওদিক পালিয়ে যায়। আটগ্রামের শত্রুর হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০ জন, এদের মধ্যে ৪জন অফিসার ছিলেন। যথেষ্ঠ গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয়। এখানে শত্রু বেশকিছু গোলাবারুদ ফেলে যায় এবং হতাহতের সংখ্যা ছিল শত্রু পক্ষে ১০-১৫ জন এবং অস্ত্রসংবরণ করে ৭জন। চারগ্রামে অবশ্য শত্রু যথেষ্ঠ ছিল। কিন্তু আমাদের আক্রমণের আশংকা বুঝতে পেরে তারা পশ্চাদপসরণ করে এবং কোনরকম বাঁধা ছাড়াই আমরা চারগ্রাম দখল করি। এখানে অবশ্য হতাহতের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।

বালা দখল করার পর আমরা করিমগঞ্জের দিকে রওনা হই। করিমগঞ্জ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট দখল করতে সমর্থ হয়। অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন মেজর (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) এ. জে. এম আমিনুল হক।

এরপর করিমগঞ্জ থেকে আমরা বৈয়ামপুর রওনা হই এবং বৈয়ামপুর আমাদের দখল নেয়ার পরিকল্পনা করি। কিন্তু বৈয়ামপুর যাবার পথে পাকসেনা আমাদের উপর এ্যামবুশ করে। ফলে আমাদের দু’জন যোদ্ধা শহীদ হন, দু’জন নিখোঁজ হন এবং ৬জন গুরুতরভাবে আহত হন। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত গুরুতরভাবে আহত হন। তিনি আহত হবার পর আমি সি কোম্পানী ক্যাপ্টেন নূরকে হস্তান্তর করে ‘এ’কোম্পানী দায়িত্ব গ্রহণ করি। বৈয়ামপুর ছিল করিমগঞ্জ থেকে প্রায় ৩৫/৪০ মাইল দুরে। এ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মাহবুব আর্টিলারী শেলিং করেন। পাকসেনারাও আর্টিলারী শেলিং করা থেকে বিরত ছিল না। আর্টিলারী শেলিং বিনিময়ের এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন মাহবুব হঠাত চিৎকার করে ওঠেন। শেলিং এর টুকরা তার শরীরে আঘাত করে। অতঃপর ক্যাপ্টেন মাহবুবকে সরিয়ে নেয়া হয়। কিছুক্ষণ পর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং শহীদ হন। তার সিগনালারও শহীদ হন এবং রানার আহত হন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই তিনজন মুক্তিসেনার নাম অবিস্মরণীয় থাকবে যুগ যুগ ধরে, এই আশাই আমি রাখি। পরদিন সকালে ৩১তম রেজিমেন্ট আমাদের আক্রমণ করে। কিন্তু এ আক্রমণে তারা ব্যর্থ হয় এবং তিনজন অফিসার ও তিনজন সুবেদার নিহত হয়। ১২ জন পাঞ্জাবী আমাদের হাতে বন্দী হয়।

এর পরদিন সকালে আমরা বৈয়ামপুর থেকে শহীদপুরের দিকে যাত্রা করি এবং এখানেও যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি। আমাদের নয়জন হতাহত হন। তারপর আমরা কচুয়া পর্যন্ত অগ্রসর হই এবং ডিফেন্স নিই। ই-পি-আর বাহিনী ইতিপূর্বেই কানাইঘাট দখল করেছিল। আমরা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হই।

রণকৌশলের দিক থেকে বিচার করলে কোন দূরদর্শী সেনাবাহিনীই তার শত্রুকে পেছনে ফেলে রাখতে চায় না, কারন পিছনের আক্রমণকে প্রতিহত করা অনেক সময় কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। সে জন্যে আমরা শত্রুঘাটির মধ্য দিয়ে আডভান্স টু কন্টাকট শুরু করি। কানাইঘাট থেকে বিকাল ৫টার সময় আমরা সিলেট এম. সি. কলেজ অভিমুখে যাত্রা করি। কারন আমরা জানতাম এম. সি. কলেজকে পাকিস্তানি বাহিনী বিরাট একটা দুর্গে পরিণত করেছিল। সেই দুর্গকে অবরোধ করে দুখল করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। পরদিন বিকেল ৫টার সময় আমরা কেওয়াচরা চা বাগানে ডিফেন্স স্থাপন করি। রাত্রিবেলা পেট্রোল পার্টি পাঠানো হয়েছিল শত্রুর গতিবিধির খোঁজখবর নেয়ার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার পেট্রোল পার্টি শত্রুর এ্যামবুশে পড়ে এবং একজন নিখোঁজ হয়। শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে খোঁজখবর পাওয়ার পর সকালবেলা আমি আমার কোম্পানীকে নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলাম। কিন্তু শত্রু দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কতক্ষণ ডিফেন্স থাকি। এই দুই ঘন্টার মধ্যেই অন্যান্য কোম্পানীও আমার বামদিকে গিয়ে অবস্থান নেয়। আমার কোম্পানীকে ফর্ম-আপ করে শত্রুর উপরে চার্জ করি। ফলে আমার একজন শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন। শত্রু পিছু হটতে বাধ্য হয়। তাদের পক্ষেও যথেষ্ঠ হতাহত হয়। সেদিন সেখানেই অবস্থান করার পর সন্ধ্যার সময় আমরা এম.সি. কলেজ অভিমুখে যাত্রা করি। পরদিন সকাল চারটার সময় এম.সি. কলেজের টিলার উপরে এসে আমরা শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করছিলাম। শত্রু কিন্তু আমাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে একটুও সজাগ ছিল না। সুতরাং ডিফেন্সের ভিতর দিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল। আমরা এক ফাক দিয়ে পজিশন নেয়ার বন্দোবস্ত করছিলাম কিন্তু যথেষ্ঠ পাঞ্জাবী সেনা একসঙ্গে দেখাতে নিজেকে আর দাবিয়ে রাখতে পারছিলাম না। তাই পজিশন না নিয়েই ছয়টা মেশিনগান দ্বারা তিন দিক থেকে ফায়ার শুরু করলাম। শত্রুর মাথায় যেন বজ্র ভেঙ্গে পড়ল। তারা পাগলের মত এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল। এর ভিতরেই বেশ কিছু পাঞ্জাবী সৈন্য নিহত হয়। কিছু সৈন্য হাত তুলে স্যালেন্ডার করে। আর্টিলারী রেজিমেন্ট তাদের অস্ত্র নিয়ে তাড়াহুড়া করে স্মল আর্মস রেঞ্জের বাইরে চলে যায়। শত্রুপক্ষে বেশ কিছু হতাহতের পর তারা আমাদের অবস্থান থেকে আরও একটু উঁচু টিলা দখল করে। তাদের সমস্ত শক্তি তারা টিলার উপর নিয়োগ করে। এরপর আমাদের ‘ডি’এবং ‘বি’কোম্পানির উপরে কয়েকটা মেশিনগান দিয়ে ফায়ার শুরু করে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে আর্টিলারী ফায়ারও চলতে থাকে। পরে ‘বি’এবং ‘ডি’কোম্পানির যথেষ্ঠ ক্ষতি সাধিত হয়। তাদের একজন প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার ফয়েজসহ বেশকিছু লোক নিহত হয়। যারা আহত হয়েছিল তাদেরকে আমরা পিছনে নিয়ে যাই। এভাবে আরও কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর ‘বি’এবং ‘ডি’কোম্পানী একটু আড়ালে গিয়ে অবস্থান করে। তারপর আমার উপর ‘ডি’এবং ‘বি’কোম্পানির দায়িত্ব অর্পিত হয়। আমি শত্রুকে আর এক পা-ও সম্মুখে এগুতে দিইনি। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর আমার দুইজন লোক আহত হয়।

১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৭ই ডিসেম্বর এগারটা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ চলতে থাকে এবং আর্টিলার সমর্থনে আমরা কিছুদুর এগুতে সমর্থ হউ। তারপরেই আসে আত্মসমর্পণের পালা। পাকবাহিনী তাদের সমস্ত হাতিয়ার আমাদের নিকট সমর্পণ করে।

পরিশেষে বলতে হয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এমনি যুদ্ধ পরিচালনা করা বাঙ্গালী ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। যেখানে ছিল না বল, জন, অস্ত্রশস্ত্র সেখানে গড়ে ওঠে এক দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী। এদের নেতৃত্বে পুরো জাতিই মুক্তিবাহিনীর রূপ ধারণ করে। বাঙ্গালী যে যেখানেই ছিল কিছু সংখ্যক লোক ছাড়া বাকী সবাই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সবশেষে আমি স্মরণ করি তাদেরকে, যারা মাতৃভূমির জন্যে নিজের শেষ রক্তটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন। আমি স্মরণ করি তাদেরকে, যারা এই মুক্তিযুদ্ধের চরম দুঃসময়ে আমার সাথে ছিলেন এবং আমাকে প্রেরণা যুগিয়েছেম।

স্বাক্ষরঃ ক্যাপ্টেন এম, এ, কাইয়ুম চৌধুরী

৩০-১১-১৯৭৩

Scroll to Top