<১০, ১৪.২, ৩৫৪–৩৫৫>
সাক্ষাৎকারঃ নায়েক মোঃ আমিনুল্লাহ
১২–০৬–১৯৭৩
৩০শে মে আমি ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মহিসকুন্তি (কুষ্টিয়া জেলা) হামলা করিতে রওয়ানা হই। শত্রুর সংখ্যা খুব বেশী জানিতে পারিয়া মাঝ পথে আমার কিছু মুক্তিযোদ্ধা পিছনে পালাইয়া যায়। আমি মাত্র ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে পাক বাহিনীর এক কোম্পানী সৈন্যের উপর বেলা ৩টার সময় অতর্কিত আক্রমণ চালাই। ফলে পাক সৈন্য ৩২ জনের মৃত্যু হয় এবং ৩৫ জন আহত হয়, যাহা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হইতে প্রচার করা হইয়াছিল।
১৫ই জুন আমাকে বেতার যোগাযোগের জন্য আবার লালগোলা ডাকা হয়। আমি পুরা সাব-সেক্টর ৪নং এর বেতার পরিচালনা করি এবং কোয়ার্টার মাষ্টারের কাজও পরিচালনা করিয়া থাকি।
২০শে সেপ্টেম্বর মেজর সাহেব আমাকে নিয়া স্পেশাল অপারেশনের জন্য সাব-সেক্টর ৩ ও ৭ নং সেক্টর মেহেদীপুর যান এবং এখানে আমাদের নেতৃত্বে সোনা মসজিদ (রাজশাহী) এলাকায় দুটি বড় অপারেশন সমাধা হয়। এতে মিত্রবাহিনী আমাদিগকে আর্টিলার দ্বারা সাহায্য করে যার ফলে আমরা ধোবড়া পর্যন্ত দখল করি। এই সময় বহু পাকসৈন্য হতাহত হয় এবং বাদবাকী ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। এখানে উল্লেখ থাকে যে, ১৫ সেপ্টেম্বর আমার কাজে মুগ্ধ হইয়া মেজর সাহেব আমাকে হাবিলদার হইতে নায়েক সুবেদারে পদোন্নতি দেন।
১লা অক্টোবর আমাকে সম্মুখযুদ্ধের জন্য এক প্লাটুনের পরিচালনভার দেওয়া হয় এবং আমি হাকিমপুর ঘাট হইতে আস্তে আস্তে অগ্রসর হইতে থাকি। এতে বহু বড় বড় অপারেশন করিয়াছি এবং শত্রুকে পিছনে হটিতে বাধ্য করিয়াছি।
১০ই অক্টোবর আমাকে ৪নং সাব-সেক্টরে ‘বি’ কোম্পানী পরিচালনার ভার দেওয়া হয়।
১২ই নভেম্বর আমি ইসলামপুর পাক ঘাঁটিতে হামলা করি। এতে বহু রাজাকার ও পাক সৈন্য হতাহত হয় এবং দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার সহকর্মী হাবিলদার জামান সাহেব শত্রুর গুলিতে বাগডাঙ্গায় আহত হন। আমি আমার বেতারে খবর পাইয়া দৌড়াইয়া গিয়া তিন মাইল দূর হইতে তাহাকে উদ্ধার করিয়া আনিতে সক্ষম হই। প্রকাশ থাকে যে, তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাকে বন্ধুর মত সাহায্য করিয়াছেন।
১২ই ডিসেম্বর যুদ্ধ পুরাদমে শুরু হয়ে যায়। আমি আমার ঘাঁটি (হাকিমপুর) হইতে নবাবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হইতে থাকি। পথে পোড়াগ্রামে শত্রুর ঘাঁটির সম্মুখীন হই এবং তাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়। শত্রুরা বহু মৃতদেহ ও অস্ত্রশস্ত্র ফেলিয়া পলায়ন করিয়া বাহারমপুর গ্রামে ঘাঁটি স্থাপন করে।
১৩ই ডিসেম্বর আমি ও আমার দল শত্রুর এলাকায় গিয়া এম্বুশ পাতি। দুইখানা সৈন্যবাহী গাড়িসহ অগ্রসররত বহু শত্রুকে সমূলে ধ্বংশ করি। শহীদ সিপাহী নজিরউদ্দিনের কবর ঐ স্থানেই বিরাজমান।
১৪ই ডিসেম্বর আমরা নবাবগঞ্জ দখলের উদ্দেশ্যে নবাবগঞ্জ পাকঘাঁটির উপর হামালা চালাই। সারাদিন যুদ্ধ চলে এবং এতে বহু পাক সৈন্য হতাহত হয়। দুঃখের বিষয় আমাদের ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা এখানে শহীদ হন। আমরা নবাবগঞ্জ শহরে উঠিয়া পড়ি। বিকাল বেলা রাজশাহী হইতে ৫০/৬০ গাড়ী পাক সৈন্য নবাবগঞ্জ ঢুকিয়া পড়ে যাহার জন্য আমাকে একটু পিছু হটিয়া যাইতে হয়। রাত্রী ১২টার সময় তাহার তাহাদের ১৪০ জন মৃতদেহসহ পাকা রাস্তার ওভারপুল উড়াইয়া রাজশাহীর দিকে পলায়ন করে।
১৫ই ডিসেম্বর আমরা নবাবগঞ্জ দখল করিয়া দেখিতে পাই বহু পাঞ্জাবীর মৃত দেহ ই-পি-আর লাইনের বাগানে পড়িয়া আছে। এবং অনেকেই মরিচার ভিতর দাফন করিয়া রাখিয়াছে। তারপর আমরা রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হইতে থাকি কিন্তু অভয়া পুল ভাঙ্গা থাকায় পার হইতে দেরি হয়।
১৬ই ডিসেম্বর আমি গোদাগাড়ীতে ১৪০ জন রাজাকারকে অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পন করাইতে সক্ষম হই এবং শত্রুর পিছন পিছন ধাওয়া করি।
ঐদিন সন্ধ্যা ৭টার সময় রাজশাহী দখল করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় শত্রুদের আর পাওয়া যায়না। তারা নাটোর গিয়া আত্মসমর্পণ করিবে বলিয়া খবর পাঠায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ঐদিনই আমাদের বিজয় দিবস- ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১।
**বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত।