সাক্ষাৎকারঃ নায়েক সুবেদার আবদুল মতিন পাটোয়ারী

<১০, ১৬.৬, ৩৭৯-৩৮০>

সাক্ষাৎকারঃ নায়েক সুবেদার আবদুল মতিন পাটোয়ারী

মুজিবনগর গার্ড অব অনার দেওয়ার পর আমি ক্যাম্পে ফিরে যাই এবং সেখান থেকে আবার যুদ্ধে অংশ নেই। ২০শে মে তারিখে আমি আমার পেট্রোল নিয়ে মুজিবনগরে ছিলাম।খবর পেলাম পাকসেনাদের একটি প্লাটুন বল্লভপুর মিশনারী চার্চে এসেছে লুটতরাজ করতে। আমি আমার প্লাটুনকে দুই ভাগে ভাগ করে একটিকে নিয়ে আমি নিজে বাগুয়ানে এমবুশ করে থাকি, অপর দলটিকে বল্লভপুর রোডে জংশনে বসিয়ে রাখি। বেলা দেড়টার সময় পাকসেনারা ফিরছিল। আমি আক্রমণ করে বসি। প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনীর ১৭ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয় এবং ১টি গাড়ি সহ বহু অস্ত্র উদ্ধার করি।

আমি মুজিবনগরে পাক্কা ঘাঁটি করে থাকতাম। ৩রা জুন তারিখে পাকবাহিনীর  ৫০০/৬০০ সৈন্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ব্যাপক আক্রমণ করে বেলা ৪ টার সময়। আমাদের মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৪০ জন। একটি দল ছিল আমার নেতৃত্বে। অপরটি ছিল নায়েক সুবেদার তফাজ্জল হোসেনের নেতৃত্বে। পাকসেনারা সারিবদ্ধভাবে বাগুয়ানে কিছু প্রস্তুতি রেখে আমাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকসেনাদের আক্রমণে আমরা টিকতে ব্যর্থ হই।পিছু হটতে থাকি।একসময় পাকসেনারা আমাদের ঘাঁটি দখল করে নেয়। আমাদের ঘাঁটি দখলের পর পাকসেনারা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে আমাদের ঘর দুয়ারে আগুন লাগিয়ে দেয় আমরা তা দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি পুনরায় কিছু জওয়ান নিয়ে পিছন দিক থেকে আখক্ষেতে বসে সামরিক কায়দায় বড় রকমের আক্রমণের কমান্ড দেই। উদ্দেশ্য ছিল এটা বোঝানো যে আমরা বহু আছি। সাথে সাথে এলএমজি ব্রাশ চালাতে থাকি। এতে বহু পাকসেনা খতম হয়। বাকিরা সব পালাতে থাকে। পাকসেনারা পজিশন নেবার সুযোগ পায় না। আমরা আবার ঘাঁটি দখল করে নেই। পাকসেনা খতম হয় ২৮ জন, ২০জন আহত হয়। আমাদের পক্ষের কেউ হতাহত হয়নি। তারপর ১৪ই জুন, ২০শে জুন ও ২১শে জুন তারিখে পাকবাহিনীর সাথে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। একদিনের যুদ্ধে আমাদের কোন হতাহত হয়নি। পাকবাহিনী বেশকিছু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে।

১৭ই জুলাই তারিখের ঘটনা। আমাদের ইনফরমার ছিল ভাদু মণ্ডল। গোপালনগরে সে পাকসেনাদের সাথে থাকত। ভাদু মণ্ডল লোক মারফত খবর পাঠায় যে, ২৭শে জুলাই তারিখে ১০/১৫ জন পাকসেনা তার গরুর গাড়ী করে রেশন নিয়ে  মানিকনগরে যাবে নটোদা থেকে। ভাদু মণ্ডল বলে পাঠায় তার গাড়োয়ান যেন না মরে। আমি ১৫ জন নিয়ে একজন সিভিল গাইডের সহায়তায় অগ্রসর হয়ে বাগুয়ান এবং রতনপুর ঘাটের নিকটে এমবুশ করে বসে থাকি। গাইডও আমাদের সাথে ছিল। ভোর ৬টায় আমরা রেশন নিয়ে যাওয়া পার্টির উপর আক্রমণ করি। যুদ্ধ ১ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। মানিকনগরেও নাটোদা হাইস্কুলে পাকবাহিনীর ঘাঁটি ছিল। গোলাগুলির শব্দে পাকবাহিনীর দুটি পার্টি এসে আমাদের ঘিরে ফেলে। মানিকনগরে অবস্থিত পাকবাহিনীর উপর অপর দল আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীকে ব্যস্ত রাখে। আমাদের হ্যান্ডস- আপ করতে বলে। আমি বলি, ক্ষমতা থাকে তো এসে ধর। সামনা সামনি গোলাগুলি চলছে, ফায়ার করছি আর পিছু হটছি। আমাদের গাইড পিছনে পড়ে যায় এবং তাকে ধরে ফেলে। ঐ দিন বিকেলে ঐ অঞ্চলের সব লোকজন ডেকে নাটোদা স্কুলে দুহাত বেঁধে সবার সামনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুচিয়ে তাকে অত্যন্ত  নৃশংসভাবে হত্যা করে।পাকবাহিনী ঘোষণা করে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করলে এমন শাস্তি দেওয়া হবে। আমরা সবাই মূল ঘাঁটিতে আসতে সমর্থ হই।

২০শে জুলাই থেকে ৩০শে জুলাই পর্যন্ত আমি দল নিয়ে মানিকনগরে পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করি। রাতে এই অপারেশনগুলোতে বেসামরিক লোক যারা ছিল তাঁদের সাহসিকতায় আমি ও আমার অফিসাররা চমকিত হয়েছিলাম। দিনের বেলায় মেহেরপুর ঢুকে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর উপর সার্থক অপারেশন চালিয়ে তারা ভরা নদী সাঁতরে ফিরে এসেছে, পাকবাহিনীর বাঙ্কারে ঢুকে বিভিন্ন গ্রেনেড ছুঁড়েছে। এঁদের ত্যাগ সাহসিকতা মনে রাখার মত। লোকগুলো ছিলঃ (১) মোঃ সারি(২) রবী মণ্ডল (৩) মফিজ উদ্দিন (৪) রওশন আলী (৫) বরকত আলী (৬) জামান আলী (৭) নায়েক আলী । আরও অনেকের নাম এই মুহূর্তে মুনে পড়ছে না। একেক রাতে ৩/৪ বার অপারেশন করেছি।এই কয়েকদিনের অপারেশনে ৭০ জন পাকসেনা খতম  হয়।

৩রা আগস্ট তারিখে পাকসেনারা মানিকগঞ্জ ঘাঁটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। পাকসেনারা মোনাখালী ঘাটে এসে আবার ঘাঁটি গাঁড়ে। আমি মানিকগঞ্জ ঘাঁটি দখল করি। বহু মাইনও অন্যান্য গোলাবারুদ উদ্ধার করি।

১৩রা আগস্ট তারিখে পাকবাহিনীর একটি দল তাদের প্রতিরক্ষা মজবুত করা এবং গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কাঁটাতার নিয়ে যাচ্ছিল। আমি আমার পার্টি নিয়ে আক্রমণ করে বেশকিছু হতাহত করি।

২৪শে আগস্ট তারিখে পাকবাহিনীর একটি কোম্পানী নাটোদা থেকে মুজিবনগরের পথে  অগ্রসর হই। আমি একটি পার্টি নিয়ে বাগুয়ানে এবং অপরটি মানিকনগরে।সকাল দশটার সময় ওরা আমাদের আওতায় চলে আসে। আমরা ফায়ার ওপেন করি।যুদ্ধ প্রায় আড়াই ঘণ্টা হয়। পাকসেনারা ৯জন নিহত ও বেশকিছু আহত হয়ে পিছু হটে। আমাদের একজন এলএমজি ম্যান আহত হয়। যুদ্ধ চলা অবস্থায় ওখানকার ছোট ছোট ছেলেরা গোলাবারুদ মাথায় করে আমাদের সাপ্লাই দিত। অঞ্জলি নামে একজন খ্রিষ্টান নার্স সব সময় আমাদের সেবা শুশ্রূষা করতো। সে আগে গ্রাম রেকি করে আমাদের খবর দিত। সব সময় প্রথম সারিতে থাকতো।

এরপর ৯নং সেক্টরকে সাহায্য করার জন্য ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কোম্পানী নিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে খুলনা যাই। ওখানে ৮/১০ দিন বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেই। সেপ্টেম্বর মাসেই আমি মুজিবনগরে ফিরে আসি। তারপর ৩রা নভেম্বর মানিকনগর, ৬ই নভেম্বর রশিপুর ঘাট, ১২ই নভেম্বর মোনাখালী ঘাট, ১৮ই নভেম্বর রশিপুর ঘাটে, ১৯শে নভেম্বর মানিকনগর ঘাটে, ২৬শে নভেম্বর রশিপুর ঘাট, ৩০শে নভেম্বর রাজাপুর ঘাট, ১লা ডিসেম্বর রাজাপুর, ৩রা ডিসেম্বর রাজাপুর প্রভৃতি স্থানে আমার নিজের কমান্ডে যুদ্ধ করেছি। তারপর যৌথ অপারেশনে অংশ নেই।

স্বাক্ষরঃ আবঃ মতিন পাটোয়ারী

২১-১০-৭৪

Scroll to Top