<৯, ৪.৬, ২০৬-২০৯>
নরসিংদী–আশুগঞ্জ সশস্ত্র প্রতিরোধ
ব্রিগেডিয়ার মোঃ মতিউর রহমান বীর প্রতীক
(১৯৭১ সালের মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। বিবরণটি দৈনিক “সংবাদ” ৩ মার্চ ১৯৮৩-এ প্রকাশিত ‘সুবেদার মেজর সুলতান আহমদ বীরবিক্রম’ শিরোনামে তাঁর রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত)
সুবেদার মেজর সুলতানের আমলে আমার পরিচয় হয় ১৯৭১ সালের ১লা এপ্রিল নরসিংদীতে। আমি ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালে যশোর সেনানিবাসের ২৫ বেলুচ রেজিমেন্ট ছেড়ে ২৭শে মার্চ ময়মনসিংহ পৌঁছি। ময়মনসিংহে ইপিআর-এর সাথে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করি এবং তাঁদের কম্যান্ডার নিযুক্ত হই। ইপিআর-এর এক কোম্পানী নিয়ে নরসিংদী হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হই যুদ্ধ করার জন্য। ৩১শে মার্চ নরসিংদী পৌঁছি। সুবেদার মেজর সুলতান তখন ঢাকা থেকে সামান্য কয়েকজন লোকসহ নরসিংদী পৌঁছে এবং ১লা এপ্রিল আমার সাথে যোগ দেয়। ঢাকার লোকজন যখন মার খেয়ে দিশাহারা হয়ে শহর ছেড়ে পালাইতেছিল, তখন সুলতান সাহেব আমার সাথে কয়েকজন ইপিয়ার-এর লোকজন এবং ছাত্র ও জনতার সাথে যোগ দিয়ে ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঢাকা-নরসিংদী সড়কের বিভিন্ন এলাকায় সম্মুখ-সংঘর্ষে দুর্ধর্ষ শাস এবং শক্তিতে যুদ্ধ করেন। এরপর থেকে পুরো নয়টি মাস তিনি আমার সাথে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করে যান। নয় মাসের তার এবং বাকী সহকর্মীদের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। সব লিখতে গেলে অনেক দীর্ঘ এক ইতিহাস হবে। আজকের এই লেখায়, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস লিখব না। শুধু বাংলাদেশ রাইফেলস-এর একটি বীরযোদ্ধার সামান্য একটু বলছি, তাতেই বুঝা যাবে বাংলাদেশ রাইফেলস-এর সংগঠন কত তীক্ষ্ম এবং জাগ্রত।
ঢাকা-নরসিংদী সড়কে করইতলী, বাবুরহাট, পাঁচদোনা এবং অন্যান্য স্থানে সম্মুখ যুদ্ধের পর আমাদের নরসিংদী ত্যাগ করতে হয়।
১৩ই এপ্রিল সকালে আমরা আশুগঞ্জে পৌঁছানোর পর ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানীর ওখানে যাই। ব্রিগেডিয়ার নাসিম (তখন ক্যাপ্টেন) কোম্পানী কমান্ডার। তিনি আশুগঞ্জে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করুন। আমার সাথে তখন ৪০/৫০ লোকে এবং শুধু ব্যক্তিগত অস্ত্রশস্ত্র আছে। তিনি আমাকে বললেন, আপনি ভৈরবের সামনে নরসিংদীর দিকে রামনগর রেলওয়ে ব্রীজের ওখানে যেয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করুন। পাকিস্তান আর্মির অগ্রগতিকে ওখানে রোধ করতে হবে। যতক্ষণ সম্ভব রুখতে হবে। অসম্ভব হয়ে পড়লে এখানে আসবেন, একসাথে মিলে যুদ্ধ করব।
আমরা ১৩ই এপ্রিল বেলা ৯টার দিকে রামনগর পুলের নিক্ট পৌঁছি। এলাকায় পৌঁছে লোকজনকে স্থান নির্ধারিত করার পূর্বেই দেখতে পেলাম রেল লাইন ধরে পাকিস্তান আর্মি অগ্রসর হচ্ছে। বেলা ১০/১১টার দিকে তাদের সাথে আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়। তারা সমস্ত দিন চেষ্টা করল, কিন্তু আর অগ্রসর হতে পারল না। পুরা রাত গোলাগুলি চলে। পরদিন সকাল ৬টা ৩০ মিনিটের সময় ৬টা পাকিস্তানী স্যাবর জেট প্রথমে একবার উপর দিয়ে ঘুরে গেল। ফেরত আসার পথে আমাদের এলাকাসহ আশুগঞ্জ ও ভৈরব বোমা দেলে এবং স্ট্রাফিং শুরু করে। আমার সামনে থেকে যে পদাতিক বাহিনী এসেছিল তারা আরও একটু এগিয়ে এসে আমাদের উপর গুলিগোলা শুরু করে ব্যাতিব্যস্ত রাখে। বাম দিকে মেঘনা নদীতে নৌবাহিনীর গানবোট থেকে নদীর পূর্বপার্শ্বে লালপুরে ব্রিগেডিয়ার আঃ মতিন (তখন ক্যাপ্টেন) ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ প্লাটুন নিয়ে অবস্থান করছিল। ওখানে আমাদের অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ শুরু হয়। তার সাথে ৬/৭টা হেলিকপ্টার দিয়ে সেনাবাহিনীর লোকজন আমাদের পিছনে ভৈরব, আশুগঞ্জের পিছনে এবং ডান পার্শ্বের বিভিন্ন এলাকায় নামানো আরম্ভ করে। আমরা সম্মুখসমরে ব্যস্থ। তার সাথে দেখছি কি সুন্দর শক্তির প্রদর্শন। জলে, স্থলে এবং আকাশ থেকে আমাদের উপর আক্রমণ। দেখছি লোকজন বিমান বাহিনীর এবং সেনাবাহিনীর আক্রমণে ঘর ছেড়ে জীবন নিয়ে দিকশূণ্য হয়ে পালাচ্ছে আর দাউ দাউ করে জ্বলছে বাড়ীঘর। আমরা সামান্য কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামী চারদিক থেকে শত্রুদ্বারা বেষ্টিত।
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর আক্রমণ ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত চলতে থাকে। সাথে অন্যান্য বাহিনীর আক্রমণও চলতেই থাকে। আমাদের সাথে যা গোলাবারুদ ছিল তা দুই দিনের অনবরত যুদ্ধে শেষ হয়ে গেছে। ১৪ই এপ্রিল বিকেল ৩টার সময় ভাবছি কোন মতে ভৈরব পার হয়ে আশুগঞ্জে যেয়ে ২য় ইস্ট বেঙ্গল-এর কোম্পানীর সাথে মিশতে পারব কিনা। নিজেদের অবস্থান ঘুরে দেখলাম। কারো নিকট ২/৪ রাউণ্ড গুলি আছে। কেউ বা খালি হাতে বসা। কারণ যা কাঁধে করে আগের দিন নিয়ে এসেছিলাম তাই সে সম্বল ছিল আর তো কেউ কিছুই দিয়ে যায়নি। বেলা ৩টা ৩০ মিনিটের সময় দেখতে পেলাম ইউনিফর্ম পরা একজন লোক পিছন থেকে আমার খুবই নিকটে চলে এসেছে। তাকে মারতে মানা করলাম। উদ্দেশ্য, তাকে আত্মসমর্পণ করাবো। সে আত্মসমর্পণ করার পর দেখতে পেলাম সে আমাদের ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন জওয়ান। আশুগঞ্জের পিছনে হেলিকপ্টারে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর লোক নামার পর এবং বিমান বাহিনীর আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পর কোম্পানী নিজেদের স্থান ছাড়তে বাধ্য হয়। সে রাস্তা না পেয়ে এই দিকে এসেছে। মনে করেছে এই দিক দিয়ে বিপদের আশঙ্কা কম। ভাবলাম ওদের সাথে মিলে যুদ্ধ করার কথা ছিল, তা আর হলো না। এখন আমারা শেষ মুহূর্ত গুনছি। চারদিক থেকে পাকিস্তানী বাহিনী জাল গুটিয়ে আনবে আর আমাদের জীবিত ধরবে।
আরো যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মত গুলিগোলা বলতে কিছুই নেই। লোক ক্ষুধায় কাতর। ১১ই এপ্রিল নরসিংদীর পতনের পূর্ব থেকে ১৪ই এপ্রিলের মধ্যে অনেকের বেলা সামান্য আহার জুটেছে। মানুষের জীবন তার অনুভূতির নিক্ট কত করূণ এবং কঠোর অনুভব হয় তখন হয়ত বুঝতে পেরেছি। আমি কমান্ডার হিসেবে তাদেরকে গুলিগোলা দিতে পারছিনা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। খানা দিতে পারছিনা ক্ষুধার জ্বলা মিটাতে। কেউ আমাদের সাহায্য করবে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে এ রকম আশ্বাসও দিতে পারছিনা। কারণ, তখনও জানিনা কোথাও থেকে কেউ সাহায্য করবে কিনা, কে কোথায় যুদ্ধ করছে বা লোকজন যুদ্ধ করছে কিনা তাও জানিনা।
বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটে আমি মনস্থির করেছি এইস্থান আমাদের ছাড়তে হবে। খালি হাতে এখানে বসে মরার কোন অর্থ নেই। সুবেদার মেজর সুলতান (তখন নায়েক সুবেদার) সহ দু’জন আমার প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন। আমি ব্রহ্মপুত্র নদের রামনগর ব্রীজের পার্শ্বে যেখানে আমার অবস্থান ছিল আসতে বললাম। প্লাটুন কমান্ডার আসার পর জিজ্ঞেস করলাম কি অবস্থা। তারা বলল, স্যার আপনিতো ঘুরে দেখে এলেন। জওয়ানরা প্রায় শূণ্য হাতে বসা।
আমি বললাম, সুলতান সাহেব, মালেক সাহেব আমাদের এলাকা ছাড়তে হবে। খালি হাতে এখানে বসে মরার কোন অর্থ নেই। আমি কথাটা বলার সাথে সাথে দু’জনেই হাউমাউ করে শিশুর মত চিৎকার করে কেঁদে উঠল। বলল, স্যার কাপুরুষের মত পালিয়ে কোথায় যাব, দেশ কি স্বাধীন হবেনা? তাদের কান্নায় আমারও দুচোখে আশ্রু নেমে এলো। তাদের কানায় এবং আবেগে প্রায় ১৫/২০ সেকেন্ডের মত মনে হল আমি আমার চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। মানুষের জীবনে অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত থাকে। এই মুহূর্তটা আমার জীবনে কিভাবে মূল্যায়ন করব জানিনা। অনেক সময় মৃত্যু বাঞ্ছনীয় হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু তখন জীবন মনে হয় রাবার ইলাস্টিকের মত দীর্ঘ হয়।
একটু সুস্থির হয়ে বললাম, এখান থেকে চলে যাওয়ার অর্থ এই নয় আমরা আর যুদ্ধ করবনা। আজকে যদি এই হত আমাদের ৪০/৫০ জনকে গুলি করে মারলে তারা আমাদের স্বাধীনতা দিবে তাহলে আমি আপনাদের কমান্ডার হিসেবে কথা দিচ্ছি আমিই প্রথম মরতাম। যুদ্ধ আমাদের চালিয়ে যেতে হবে যতদিন বেঁচে থাকব, যতদিন দেশ স্বাধীন না হবে। এখান থেকে চলে যেয়ে আমরা গোলাগুলি সংগ্রহ করব, আবার যুদ্ধ করব। এখন এখানে খালি হাতে বসে থাকতে আস্তে আস্তে জাল গুটিয়ে আনবে এবং আমাদের জীবিত ধরবে আর গুলি করে মেরে ফেলবে। বুঝিয়ে বলার পর মেনে নিল। বলল, স্যার আপনি আমাদের কমান্ডার, আপনি যা ভাল বোঝেন তা আমরা নিশ্চয় মেনে চলব। তবে স্যার, আপনি ছেলেদের বুঝায়ে বলেন কারণ তারা মানসিকভাবে অতি জেদি হয়ে আছে। প্রত্যেকটা অবস্থানে যেয়ে জওয়ানদের বুঝিয়ে বলে ছোট ছোট গ্রুপে বিভিন্নভাবে অবস্থান ত্যাগ করতে বললাম। বলে দিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যাও, শুনেছি ওখানে ২য় ইষ্ট বেঙ্গল এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আছে। ওখানে যেয়ে যোগ দাও। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে আবার দেখা হবে। সুলতান সাহেব এবং মালেক সাহেবকেও তাদের লোকজনের পিছনে যাওয়ার হুকুম দিলাম। দু’জন আমার দু’কাঁধে মাথা রেখে শিশুর মত হাউ মাউ করে কাঁদল। একটা সৈনিজের এমনি এক পরিস্থিতির কান্না অনুভব করা যে কত হৃদয় বিদীর্ণকারী সে আমি বুঝেছি। যদিও এটা অতি ক্ষুদ্র ঘটনা, তবু আমার জীবের একটা বিশেষ ক্ষণ। দু’জন বলল, ‘স্যার আপনি যাবেন না?” বললাম, “আপনারা গেলে।”
ওরা চলে গেলে সমস্ত এলাকাটা ঘুরে দেখলাম এখনঈ কেউ বাকী আছে কিনা। সুলতান সাহেব যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করব।’
সবাই চলে গেলে নিঃসঙ্গতা আর অবসাদ মনটাকে ছেয়ে ফেলল/ জীবনটা মনে হচ্ছিলো সত্যি খুব দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এত গোলাগুলি হল, মরে গেলে তো রক্ষাই পেয়ে যেতাম। যাক আমি আমার কাহিনী লিখছি না, যাদের জন্য লিখছি ওখানেই ফিরে যাই। ১৪ই এপ্রিল রাতে যেয়ে কুলিয়ারচরে সুলতান সাহেব এবং তার সঙ্গী ১০/১৫ জন জওয়ানের সাথে দেখা। দেখে তাঁর কি আনন্দ। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হৈচৈ করে কিভাবে যে তিনি আনন্দ প্রকাশ করেছেন তা ঠিক বলতে পারব না।
তারপর থেকে কোনদিন সুলতান সাহেব আমার থেকে আর বিচ্ছিন্ন হননি। প্রতিটি অপারেশনে তিনি আমার সাথে ছিলেন। সিলেটের নলুয়া চা বাগানে দিনের বেলায় আমরা যে এমবুশ করি তার উপর সুলতান বীরবিক্রমে পদক পান। আখাউড়া আক্রমণেও সাথে ছিলেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন যুদ্ধে আমার সাথে ছিলেন।