শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩। ২ নম্বর সেক্টর ও ‘কে’ ফোর্সের যুদ্ধের বিবরণ। | সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ* ১৯৭৪-১৯৭৫ | ……………… ১৯৭১ |
সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ
সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আমি আমার যুদ্ধের এলাকাকে কয়েকটি সাব-সেক্টর-এ বিভক্ত করে নেই। আমার সাব-সেক্টরগুলি নিম্নলিখিত জায়গায় তাদের অবস্থান গড়ে তুলি।
(ক) গঙ্গাসাগর, আখাউড়া এবং কসবা সাব-সেক্টরঃ এর উপ-অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন। তার সঙ্গেছিল লেঃ ফারুক, ক্যাপ্টেন মাহবুব এবং সেকেন্ড লেঃ হুমায়ূন কবির। এখানে ৪র্থ বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানী এবং ই, পি, আর-এর দুটি কোম্পানী ছিল। এদের সঙ্গে মর্টারের একটা দল ছিল। এই সাব সেক্টর কসবা, আখাউড়া, সাইদাবাদ, মুরাদনগর, নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত তাদের অপারেশন চালাত।
(খ) দ্বিতীয় সাব-সেক্টর ছিল মন্দভাগেঃ এর উপ-অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন গাফফার (বর্তমানে মেজর)। তার অধীনে চার্লি কোম্পানী এবং একটা মর্টারের দল ছিল। এ দলটি মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন হতে কুটি পর্যন্ত তাদের অপারেশন চালাতো।
(গ) তৃতীয় সাব-সেক্টরে ছিল শালদা নদীঃ এর উপ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী (মরহুম)। এর অধীনে এ কোম্পানী এবং ই,পি,আর-এর একটা কোম্পানী ছিল। এ দলটি শালদা নদী, নয়নপুর এবং বুড়িচং এলাকা পর্যন্ত তাদের অপারেশন চালাত।
(ঘ) চতুর্থ সাব-সেক্টর ছিল মতিনগরেঃ কমান্ডে ছিল লেঃ দিদারুল আলম। হেডকোয়ার্টার কোম্পানীর কিছুসংখ্যক সৈন্য এবং ই,পি,আর-এর একটা কোম্পানী গোমতীর উত্তর বাঁধ থেকে কোম্পানীগঞ্জ পর্যন্ত এই সাব-সেক্টরে অভিযান চালাতো।
(ঙ) গোমতীর দক্ষিণে ছিল নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরঃ এর উপ-অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন আকবর এবং লেঃ মাহবুব। এ দলটির অপারেশন কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর এবং লাকসাম পর্যন্ত ছিল।
(চ) রাজনগর সাব-সেক্টর ছিল সর্বদক্ষিণেঃ এ সাব-সেক্টরের উপ-অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, ক্যাপ্টেন শহীদ এবং লেঃ ইমামুজ্জামান। এই সাব-সেক্টর বেলুনিয়া, লাকসামের দক্ষিণ এলাকা এবং নোয়াখালীতে অপারেশন চালাতো। এই সাব-সেক্টরে ৪র্থ বেঙ্গল এর ‘বি’ কোম্পানী, ই, পি, আর-এর ১টি কোম্পানী ও গণবাহিনীর লোক নিয়ে তৈরি এক সদ্যগঠিত কোম্পানী। জুলাই মাসে পাকিস্তানী সেনারা কসবা এবং মন্দভাগের পুনঃদখলের প্রস্তুতি নেয় এবং কুটিতে ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের বাহিনী এবং গোলন্দাজ বাহিনী সমাবেশ করে। ক্যাপ্টেন গাফফারের অধীনে মন্দভাগ সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুসেনাদের মোকাবেলার জন্য তৈরি ছিল। জুলাই মাসের ১৯ তারিখে শত্রুসেনারা একটা কোম্পানী নিয়ে শালদা নদীতে নৌকাযোগে অগ্রসর হয়। সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে মন্দভাগ সাব-সেক্টরের একটা প্লাটুন মন্দভাগ বাজারের নিকট শত্রুদের এই অগ্রবর্তী দলটির উপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। এ সংঘর্ষে শত্রুসেনারা সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি হয়ে যায়। শালদা নদীর তীর থেকে সুবেদার ওহাবের প্লাটুন্টি শত্রুসেনার উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে অন্ততঃপক্ষে ৬০/৭০ জন লোক হতাহত হয় এবং অনেকেই নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ হারায়। এই আক্রমণে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল কাইয়ূম, ৫৩ তম গোলন্দাজ বাহিনীর কুখ্যাত অফিসার ক্যাপ্টেন বোখারী, আরো তিন-চারজন অফিসার এবং ৮/১০ জন জুনিয়র অফিসার প্রাণ হারায়। ক্যাপ্টেন বোখারী ২৫ মার্চের পর থেকে কুমিল্লা শহরে অনেক হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ছিল। তার মৃত্যুতে কুমিল্লাবাসীরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়। শত্রুসেনারা শালদা নদীতে এই বিরাট পর্যুদস্তের পর তাদের বাহিনীকে পিছু হটিয়ে কুটিতে নিয়ে যায়। এবং আমি আমার ঘাঁটি মন্দভাগ ও শালদা নদীতে আরো শক্ত করে তুলি।
পাকিস্তানের ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে লাইন সম্পর্কে জেনারেল টিক্কা খাঁ দম্ভ করে ঘোষণা করেছিল যে ওটা জুলাই মাসের মধ্যে খুলবে। তাঁর সেই আশা চিরতরে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পাকিস্তান আমলে এই রেললাইনে ট্রেন চলেনি। ইতিমধ্যে জুলাই মাসে আমি খবর পাই যে, পাকবাহিনী বেলুনিয়াতে ঢোকার চেষ্টা করছে। আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম কে নির্দেশ দেই যেন তাদেরকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ছাগলনাইয়াতে পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। পাকবাহিনী ছাগলনাইয়ার উপরে ফেনীর দিক থেকে চট্টগ্রাম সড়কের উপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে তাদের ২০/২৫ জন লোক হতাহত হয়। শত্রুসেনারা পিছু হটে যায়। কিন্তু তাঁর কয়েকদিন পরে পাকসেনারা ছাগলনাইয়ার দক্ষিণ থেকে ফেনী-চট্টগ্রাম পুরনো রাস্তায় অগ্রসর হয়। এবং ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের সৈনিকদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আমাদের কিছুসংখ্যক হতাহত হওয়ায় এবং শত্রুদের গোলার মুখে টিকতে না পেরে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমার কাছে পরবর্তী কর্মপন্থার নির্দেশ চেয়ে পাঠান। আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে বলি ছাগলনাইয়া থেকে তাঁর সৈন্যদের সরিয়ে বেলুনিয়ার সাব-সেক্টর রাজনগরে আনার জন্য। আমাদের এই মুভে বেলুনিয়াতে অবস্থিত শত্রুসেনারা ঘিরে যাওয়ার আতঙ্কে বেলুনিয়া থেকে ফেনীতে পশ্চাদপসরণ করে এবং ফেনীতে তাদের প্রধান ঘাঁটি গড়ে তোলে। বেলুনিয়া শত্রুমুক্ত হওয়ায় আমি আমি বেলুনিয়াকে শত্রুকবল থেকে মুক্ত রাখার দৃঢ়মনস্থ করি। ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে বান্দুয়াতে (ফেনী থেকে ২ মাইল উত্তরে) এবং ইমামুজ্জামানকে তাদের নিজ নিজ কোম্পানী নিয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করার নির্দেশ দেই। বান্দুয়াতে সম্মুখবর্তী অবস্থান গড়ার পথ মুন্সিরহাটে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের অধীনে আমার সেনাদল বেশ মজবুত প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে। বেলুনিয়া একটি ১৭ মাইল লম্বা এবং ১৬ মাইল চওড়া বাঙ্কার। এই বেলুনিয়াতে আমরা যে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তুলি সে প্রতিরক্ষাব্যূহকে ধ্বংস করার জন্য পাকসেনারা এর পর থেকে যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়ে যায়। পরবর্তীকালে অনেক যুদ্ধে তাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি এবং সৈন্য হতাহত হয়। বেলুনিয়া সেক্টর পাকসেনাদের জন্য ভয়ংকর বিভীষিকা রূপ ধারন করে। এর সঙ্গে সঙ্গে এই স্থানের জনসাধারণও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ও কষ্ট স্বীকার করে। এখানকার জনসাধারণের কষ্টকে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। পাকবাহিনীর গোলার আঘাতে প্রতিটি বাড়ি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ও অনেক নিরীহ লোক মারা যায়। কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণ কোনদিনও তাদের মনোবল হারায়নি। যুদ্ধ যতদিন চলে ততদিনই তারা মুক্তি বাহিনীর অসামরিক ব্যবস্থাপনায় হাসিমুখে সাহায্য করে। অনেকক্ষেত্রে তারা সেনাবাহিনীর সাথে সাথে রক্ষাবুহ্য শক্তিশালী করার জন্য পরিখা খননে ও অন্যান্য কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্য করে। মে মাসে আমাদের মুন্সিরহাট ডিফেন্স এবং বান্দুয়ার অবস্থানটি বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে। এ জায়গাটি আমরা এজন্যে প্রতিরক্ষা ঘাঁটির জন্য মনোনিত করেছিলাম। জায়গাটার সামনে কতগুলো প্রাকৃতিক বাধাবিঘ্ন ছিল যেগুলি শত্রুসেনার অগ্রসরের পথে বিরাট বাধাস্বরূপ। এতে শত্রুসেনাদের নাজেহাল করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। আমাদের অবস্থানটি মুহুরী নদীর পাশ ঘেঁষে পশ্চিম দিক থেকে ছিলোনিয়া নদীকে ছাড়িয়ে পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ব্যূহটি কমপক্ষে ৪ মাইল চওড়া ছিল। আমরা এই অবস্থানটি এইভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম যে, শত্রুসেনাদের বাধ্য হয়ে আমাদের ঘাঁটি আক্রমণ করার সময় প্রতিরক্ষার শুধু সামনে ছাড়া আর কোন উপায়ে আসার রাস্তা ছিলনা। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রুসেনাদের আসার মনোনীত জায়গাগুলোতে এলে সবচেয়ে বেশি ধ্বংস করা যায়। পরবর্তীকালে আমাদের এ পরিকল্পনা ঠিকই কাজে লেগেছিল। যেসব জায়গা দিয়েই শত্রুরা আসার চেষ্টা করেছে যথেষ্ট হতাহত হয়েছে। এই সেক্টরে প্রথমে আমাদের সৈন্যসঙ্খ্যা ছিল দূ’কোম্পানী(৩০০ জনের মত) এবং কিছুসংখ্যক গণবাহিনী। শত্রুওসংখ্যা আমাদের চেয়ে সব সময় বেশীছিল এবং এছাড়া শত্রুদের ছিল শক্তিশালী অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিমান বাহিনী ও ট্যাংক। আমাদের মুন্সিরহাটে প্রধান ঘাঁটি সম্বন্ধে শত্রুদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য বন্দুয়া রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ছিলোনিয়া নদীর উপর একটি অগ্রুবর্তী ঘাঁটি স্থাপনের নির্দেশ দেই। এটা ছিল ডিলেয়িং পজিশন। এ পজিশনের সামনে রাস্তা ও রেলের সেতুগুলি ধ্বংস করে দেয়া হয় যাতে শত্রুদের অগ্রসরে আরো বাধার সৃষ্টি হয়। শত্রুসেনার সম্ভবত অগ্রসরের রাস্তার পশ্চিম এবং পূর্ব পার্শ্বে রাস্তার দিকে মুখ করে আমরা বেশ কতগুল উঁচু জায়গায় এবং পুকুরের উঁচু বাঁধে শক্ত এবং মজবুত বাঙ্কার তোইরি করি এবং তাতে হালকা মেশিনগান এবং মেশিনগান লাগিয়ে দেই। এ ছিল একরকমের ফাঁদ যাতে একবার অবস্থানের ভিতরে অগ্রসর হলে দু’পাশের গুলিতে শত্রুসেনারা ফিরে যেতে না পারে। এসব বাঙ্কার এমনভাবে লুকানো ছিল যে সম্মুখ থেকে বোঝার কোন উপায় ছিল না।
৭ই জুনের সকাল। আমরা জানতে পারলাম শত্রুসেনারা ফেনী থেকে বেলুনিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ১০টার দিকে বন্দুয়ার আশে পাশে শত্রুসেনারা এসে জমা হতে লাগলো এবং প্রথম্বারের মত আমাদের পজিশনের উপর গোলাগুলি চালাতে লাগলো। আমার নির্দেশ ছিল যে শত্রুদের এই গোলাগুলির কোন জবাব যেন না দেয়া হয়। শত্রুসেনারা বন্দুয়া সেতুর উপর একটা বাঁশের পুল নির্মাণ করে যেমনি পার হওয়ার চেষ্টা করছিল, ঠিক সে সময় আমাদের অগ্রবর্তী ডিলেয়িং পজিশনের বীর সৈনিকরা তাদের উপর গুলি চালায়। এতে প্রথম সারিতে যে সব শত্রুসেনা সেতু অতিক্রম করার চেষ্টা করে তারা সবাই গুলি খেয়ে পানিতে পড়ে যায়। এ পর্যায়ে শত্রুসেনাদের অন্তত ৪০/৫০ জন লোক হতাহত হয়। এরপর শত্রুসেনারা পিছে হতে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার প্রবল গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় তীব্র আক্রমণ চালায়। আমাদের ডিলেয়িং পজিশনের সৈনিকরা শত্রুদের আরো বহুসংখ্যক লোক হতাহত করে বীরত্বের সাথে আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে কিন্তু আক্রমণ যখন আরও তীব্ররূপ ধারণ করে ডিলেয়িং পজিশন কে তারা পরিত্যাগ করে প্রধান ঘাঁটি মুন্সিরহাটে পিছু হটে আসে। শত্রুরা কিছুটা সফলতা লাভ করায় আরো প্রবল বেগে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং ছিলোনিয়া নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এখানে এসে তারা নদী পার হওয়ার সকল প্রস্তুতি নেয়। আমাদের প্রধান ঘাঁটি থেকে ৮০০ গজ সামনে আনন্দপুর নামক গ্রামে শত্রুসেনারা তাদের সমাবেশ ঘটাতে থাকে। নদী পার হয়ে আমাদের আক্রমণ করার জন্য শত্রুরা সকল প্রস্তুতি নিতে থাকে। নদী পার হবার পূর্ব মুহূর্তে কামানের সাহায্যে আমাদের ঘাঁটির উপর তারা প্রবল আক্রমণ আরম্ভ করে। তারা বৃষ্টির মতো গোলা আমাদের অবস্থানের উপর ছুড়ছিল। এ আকস্মিক আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্য আমরা ভালভাবেই বুঝতে পারছিলাম। এই সুযোগে পাকসেনারা নদী পার হবার জন্য নৌকা এবং বাঁশের পুলের সাহায্যে এগিয়ে আসতে থাকে। যদিও আমরা শত্রুদের কামানের গোলায় যথেষ্ট বিপর্যস্ত ছিলাম তবুও মানসিক দিক দিয়ে আমাদের সৈন্যদের মনোবল ছিল বিপুল। ওদের বেশ সংখ্যক সৈন্য নদী পার হয়ে আমাদের অবস্থানের ২০০/৩০০ গজ ভিতরে চলে আসে এবং কিছুসগখ্যক তখনও নদী পার হচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে আমাদের মর্টার এবং মেশিনগান গর্জে উঠে। আমাদের এ অকস্মাত পাল্টা উত্তরে শত্রুসেনারা অনেক হতাহত হতে থাকে। তবুও তারা বাধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে প্রবল বেগে অগ্রসর হতে থাকে। আর আমাদের সৈনিকরাও তাদের ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি করতে থাকে। তবুও টাটা নিঃসহায় অবস্থাতে ও দক্ষতার সাথে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু আল্লাহ হয়তো অদের সহায় ছিলেন না। এ স্ময়ে তারা আমাদের সামনের মাইন ফিল্ডের মুখে এসে পড়ল। তাদের পায়ের চাপে একটার পর একটা মাইন ফাটতে আরম্ভ করলো। আমাদের চোখের সামনে অনেক শত্রুসেনা তুলোর মত উড়ে যেতে লাগলো। আমাদের গোপনে অবস্থিত পাশের মেশিনগাঙ্গুলির বৃষ্টির মতো গুলি ও মাইনের আঘাত তাদের মধ্যে একটা ভয়াভহ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। শধু কয়েকজন শত্রু এসব বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আমাদের কয়েকটি অগ্রবর্তী বাঙ্কারের সামনে পর্যন্ত পৌছায়, কিন্তু আমাদের সৈনিকরা গ্রেনেড হাঁতে তাদের জন্য প্রস্তুত ছিল এবগ তারা সেখানেই আমাদের গ্রেনেডের মুখে ধ্বংস হয়। এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে শত্রুসেনারা আর সামনে এগোতে সাহস পায়নি। যারা পিছনে ছিল তারাও এই সংকট জনক অবস্থা এবং ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পিছন দিকে পলায়ন করতে শুরু করে। শত্রুসেনাদের পালাতে দেখে আমাদের সৈনিকরাও উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে এবং আরো প্রবল গতিতে তাদের গুলি করে মারতে থাকে। আমাদের মর্টারও পসগচাদপসরণরত শত্রুদের উপর অনবরত আক্রমণ চালিয়ে তাদের হতাহত করতে থাকে। আমাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে ওদের খুব কম সৈন্য ছিলোনিয়া নদীর অপর পারে পিছু হটে যেতে সক্ষম হয়। এ সময় আমাদের উপর শত্রুসেনারা অনবরত কামানের গোলা চালিয়ে যাচ্ছিল যাতে তাদের বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত যে সমস্ত অবশিষ্ট সৈনিক ছিল তারা নিরাপদে আরো পশ্চাৎঘাঁটি আনন্দপুর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। এর কিছু পরে দুটোর সময় তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে নীরবতা নেমে আসে। আমরা কিছুক্ষণ আবার তাদের পুনঃআক্রমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি কিন্তু পরে জানতে পাই যে তাদের অবস্থা সত্যি বিপর্যস্ত এবং তাদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। পুনঃআক্রমণের শক্তি আর তাদের নেই। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের অন্ততঃপক্ষে ৩০০ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায় এবং ছিলোনিয়া নদীতে কত ভেসে গেছে সেটারও হিসাব আমরা পাই না। পরে জানতে পারি যে পাকিস্তানীরা একটা ব্যাটালিয়নের চেয়েও বেশি সৈন্যদল নিয়ে এ আক্রমণ চালিয়েছিল এবং ব্যাটালিয়নের ৬০ ভাগের মত লোক নিহত বা আহত হয়েছে। এদের অনেকের কবর এখনও ফেনীতে আছে।
এর পর থেকে শত্রুসেনারা আনন্দপুরে স্থায়ী ঘাঁটি করার জন্য বাঙ্কার খোঁড়ার কাজ শুরু করে দিল। আস্তে আস্তে ওদের সৈন্যসংখ্যাও অনেক বেড়ে যেতে লাগল। আমরা খবর পেলাম ওরা প্রচুর অস্ত্র এবং নতুন সৈন্য চট্টগ্রাম এবং ঢাকা থেকে এনে সমাবেশ করছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর কামান ও ট্যাঙ্ক তারা নিয়ে এসেছে। ৭ই জুনের বেলুনিয়া যুদ্ধের পর তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং হতাহতের সংখ্যা দেখে পাকিস্তানীরা বুঝতে পেরেছিল যে আমি এই জায়গাতে তাদের সঙ্গে আবার সম্মুখ সমরে যুদ্ধের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সে জন্য আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদেরকে আমি ফাঁদে ফেলার জন্য তৈরি ছিলাম। পাকসেনারা আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হয়ে সে ফাঁদে পা দিয়ে যথেষ্ঠ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। সেই কারণে ভবিষ্যতে যাই করুক খুব সতর্কতার সাথে কাজ করার প্রস্ততি নিতে থাকে। বেলুনিয়ার বিপর্যয় পাকিস্তানী সেনাদের সবাইকে বিচলিত করে তোলে। তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়, যে কোন উপায়ে বেলুনিয়াকে পুর্নদখল করতেই হবে। তাই তাদের সৈন্য সমাবেশ চলতে থাকে। জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, চীফ অফ স্টাফ স্বয়ং জুলাই মাসে ফেনীতে আসেন বেলুনিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং পরিচালনার জন্য। আমি আমার প্রতিরক্ষার অবস্থান আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করি। মন্দভাগ থেকে ক্যাপ্টেন গাফফারকে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর ‘সি’ কোম্পানী নিয়ে এবং আরো কিছু মর্টার নিয়ে বেলুনিয়া সেক্টরে গিয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ আরো শক্তিশালী করে তোলার নির্দেশ দেই। যেহেতু আমার কাছে আর কোন সৈন্য ছিল না, তাই আমি এ তিনটি কোম্পানী দিয়ে জাফর ইমামকে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য তৈরী থাকার নির্দেশ দেই। শত্রুরা আমাদের প্রতিরক্ষা থেকে মাত্র ৮০০ গজ দূরে গতিয়ানালার অপর পারে তাদের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। উভয়পক্ষে অনবরত গোলাগুলি বিনিময় হত, আর তাছাড়া শত্রুদের গোলন্দাজ বাহিনী আমাদের ঘাঁটির উপর অবিরাম শেলিং চালিয়ে যেত। আমাদের সৈনিকদের বাঙ্কার ছেড়ে বাইরে চলাফেরার উপায় ছিল না। কিন্তু শত্রুর এই গোলাগুলির এবং আর্টিলারী ফায়ারিং-এর মধ্যেও আমাদের বীর বঙ্গশার্দুলরা তাদের মনোবল হারায়নি এবং এতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তারা এ গোলাগুলিকে যুদ্ধক্ষেত্রে বাজনার মত মনে করত। মাঝে মাঝে আমাদের সৈনিকরা পরিত্যক্ত গ্রামের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে শত্রুদের অনেক হতাহতও এবং অনেক সময় ১০৬ মিলিমিটার ট্যাঙ্কবিধ্বংসী-কামানের সাহায্যে তাদের বাঙ্কার উড়িয়ে দিয়ে আসত। এসব আকস্মিক আক্রমণাত্নক কার্যে শত্রুরা যথেষ্ট ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত এবং তাদের যথেষ্ট হতাহত হত। তারপরই তারা শুরু করত গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে অবিরাম বৃষ্টির মত গোলাগুলি। এভাবে জুলাই মাসের ১৭ তারিখ পর্যন্ত চলল। পাকিস্তানীদের যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখে ঐ এলাকার জনমনে যথেষ্ট ত্রাসের সৃষ্টি হয়। প্রথমবারের আক্রমণে যদিও জনসাধারনের বেশী ক্ষতি হয়নি, সেহেতু সেবার শত্রুসেনারা ছিল আমাদের হাতে পর্যুদস্ত। যুদ্ধের বিভীষিকা তারা প্রত্যক্ষভাবে সেবার দেখেছিল, কিন্তু এবারের পাকবাহিনীর প্রস্তুতির খবরে সত্যি তারা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। এ সময় ছিল ভরা বর্ষা। সব জায়গাতে ছিল পানি। পানি ভেঙ্গে ছেলেমেয়ে নিয়ে শত্রুদের অকস্মাৎ আক্রমণের মুখে নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়া অসম্ভব হতে পারে। এ জন্য আমরা স্থানীয় লোকদের নির্দেশ দেই যাতে তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আগেই দূরে সরে যায় বা সরে যেতে পারে। কেউবা সেচ্ছায় আর কেউবা নিরুপায় হয়ে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে স্ব স্ব স্থানে রয়ে যায়। আমাদের সৈনিকরা প্রতিরক্ষাব্যূহের উন্নতি চালিয়ে যেতে থাকে। যে সব জায়গাতে শত্রুদের আমাদের অবস্থানের ভিতরে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা ছিল আমরা সেসব জায়গাতে মাইন লাগাতে থাকি। ১৭ জুলাই রাত ৮টায় আমাদের উপর শত্রুরা অকস্মাৎ আক্রমণ শুরু করে দেয়। প্রায় আধাঘন্টা পর তিনটা হেলিকপ্টার আমাদের অবস্থানের পাশ দিয়ে পিছনের দিক চলে যায়। চারিদিকে অন্ধকার ছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। হেলিকপ্টারগুলো অবস্থানের পিছনে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সৈনিকরা বুঝতে পেরেছিল যে শত্রুসেনারা প্রতিরক্ষা ব্যূহের পিছনে ছত্রীবাহিনী নামিয়েছে। আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলো থেকেও খবর আসতে লাগল যে শত্রুরা মুহুরি ও ছিলোনিয়া নদীর পাড় দিয়ে এগিয়ে আসছে। ওদের সঙ্গে ট্যাঙ্কও আছে। অবস্থানের সামনে বিপুল সৈন্য নিয়ে শত্রুর আক্রমণের প্রতিরক্ষা আর পিছনে তাদের ছত্রীবাহিনী আমাদের সৈনিকদের পিছন থেকে ঘিরে ফেলার জন্যও প্রস্তুত। এরকম একটা সংকটময় অবস্থাতেও ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম এবং ক্যাপ্টেন গাফফার এবং লেঃ ইমামুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন শহীদের নেতৃত্বে সামান্য শক্তি নিয়েও যুদ্ধের জন্য আমাদের সৈনিকদের মনোবল ছিল অটুট। আমার সব অফিসার ঐ চরম মূহুর্তে তাদের সাহস এবং দৃঢ়প্রত্যয়ের পরিচয় দিয়েছিল। রাত তখন সাড়ে ৯টা। বৃষ্টি বেশ একটু জোরালো হয়ে উঠেছে। শত্রুরা তাদের অগ্রসর অব্যাহত রেখেছে। এ সময়ে ক্যাপ্টেন গাফফারের অবস্থানের পিছন থেকে শত্রুরা হামলা চালায়। ক্যাপ্টেন গাফফার এবং তার সৈনিকরা বীরত্বের সাথে শত্রুসেনাদের হামলা মোকাবেলা করে। প্রায় ১ ঘন্টা যুদ্ধের পর শত্রুসেনারা বেশ কিছু হতাহত সৈনিক ফেলে ক্যাপ্টেন গাফফারের অবস্থান থেকে বিতাড়িত হয়ে যায়। এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কোম্পানীর সামনেও শত্রুরা আক্রমণ চালায়। শত্রুদের ট্যাঙ্কগুলিও আস্তে আস্তে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে আসছিল। শত্রুদের কামানের গুলি সমস্ত অবস্থানের উপর এসে পড়ছিল। লেঃ ইমামুজ্জামান,যাঁর কোম্পানী সবচেয়ে বামে ছিল, সেখানেও শত্রুরা আস্তে আস্তে চাপ দিতে থাকে। ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমাকে এ পরিস্থিতির কথা জানায়। আমি বুঝতে পারলাম যে শত্রুসেনারা ডানে, বামে হেলিকপ্টারের সাহায্যে আমার প্রতিরক্ষাব্যূহের পিছনে পজিশন নিয়েছে এবং আস্তে আস্তে আমার সমস্ত ট্রুপসদের ঘিরে ফেলার মতলব এঁটেছে। শত্রুর চাপ আস্তে আস্তে বেড়েই চলছিল। উভয়পক্ষেরই হতাহত ক্রমেই বেড়ে চললো। তাদের অনেকেই আমাদের মাইন ফিল্ডের ভিতরে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছিল, কিন্তু তবুও তারা অগ্রসর হচ্ছিল। ইতিমধ্যে আমার ৫ জন লোক নিহত ও ৩৫ জন লোক আহত হয়। এই অন্ধকারে সমস্ত অবস্থান জুড়ে চলছিল সম্মুখসমরে হাতাহাতি যুদ্ধ। যদিও শত্রুদের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশী হচ্ছিল, তবুও আমার পক্ষে ৩০/৪০ জন- হতাহতের পরিমাণ খুবই মারাত্নক ছিল। তাছাড়া আমার সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেক কম আর অস্ত্রশস্ত্রেও ছিলাম আমি তাদের চেয়ে অনেক দূর্বল। আমি বুঝতে পারলাম সকাল পর্যন্ত তারা যদি আমাকে এভাবে ঘিরে রাখতে পারে, তাহলে তাদের বিপুল শক্তিতে দিনের আলোতে এবং ট্যাংক ও কামানের গোলায় আমার সৈন্যদের সম্পূর্নরূপে ধ্বংস করে দেবে।
রাতের অন্ধকারে তাদের ট্যাঙ্ক এবং কামানের গোলা আমাদের উপর কার্যকরী হয়নি। কিন্তু দিনের আলোতে এসব অস্ত্র আমার অবস্থানের জন্য মারাত্নক হয়ে দাঁড়াবে। আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে বর্তমান অবস্থান থেকে ডাইনে বা বামে সরে গিয়ে শত্রুদের এড়িয়ে পিছনে এসে চিতুলিয়াতে নতুন প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করার নির্দেশ দেই। এ নির্দেশ অনুযায়ী রাত ১টায় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, ক্যাপ্টেন শহীদ এবং ক্যাপ্টেন গাফফার তাদের স্ব স্ব দল নিয়ে শত্রুদের এড়িয়ে চিতুলিয়াতে নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থানে পৌঁছে। পৌছার সঙ্গে সঙ্গে নতুন অবস্থানের জন্য তৈরী শুরু হয়ে যায়। তখন সকাল ৯টা কি ১০টা। আমি নিজেই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলাম লেঃ ইমামুজ্জামান এবং তার দলটি না পৌঁছানোর জন্য। যখন প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরী চলছিল আমি তিন-চারজন সিপাই সঙ্গে নিয়ে আগে অগ্রসর হয়ে যাই- শত্রুদের সম্বন্ধে জানবার জন্য। চেতুলিয়া থেকে বেশ কিছু দূর আগে মুন্সিরহাটের নিকট যেয়ে দেখতে পাই যে শত্রুরা সকাল পর্যন্ত মুন্সিরহাটে রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে এবং এর আগে আর অগ্রসর হওয়ার সাহস করেনি। তারা ভাবছিল যে আমাদের পিছনের পজিশনগুলো হয়ত এখনও আছে। আমরা যে রাত্রে এসব ঘাঁটি ত্যাগ করে চেতুলিয়াতে নতুন ব্যূহ রচনা করেছি এ সম্বন্ধে তারা সকাল ১০টা পর্যন্ত জানতে পারেনি এবং তারা খুব সতর্কতার সাথে অগ্রসর হচ্ছিল। আমি প্রায় ১টা পর্যন্ত আমার রেকি বা অনুসন্ধান শেষ করে চেতুলিয়াতে ফেরত আসি, ঠিক এই মুহূর্তে শত্রুদের আরো তিন চারখানা হেলিকপ্টার আসে এবং আমাদের অবস্থানের ৭০০/৮০০ গজ ডানে রেলওয়ে লাইনের উঁচু বাঁধের পিছনে অবতরণ করে। এছাড়া আরো দুটি হেলিকপ্টার আসে যেগুলি আমাদের বামে আধা মাইল দূরে একটা পুকুরের বাঁধের পিছনে অবতরন করে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেদিক থেকে ভয়ংকর গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাই। আমি বুঝতে পারলাম শত্রুরা আমার ট্রুপসদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে এবং আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান তখনও কিছুই তৈরী হয়নি। এ সময় ছিল আমার পক্ষে চরম মুহূর্ত। বাম থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আরো প্রচন্ড হচ্ছিল। আমি তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নেই এবং ক্যাপ্টেন জাফর, ক্যাপ্টেন গাফফারকে নির্দেশ দেই এখনই এই মুহূর্তে তাদের নিজ নিজ কোম্পানী নিয়ে বর্তমান অবস্থান পরিত্যাগ করার জন্য। আমি এবং আমার সমস্ত সৈন্যকে অবস্থানটি পরিত্যাগ করার আধা ঘন্টার মধ্যে শত্রুরা সেদিন আক্রমণ চালায়।
এবারও শত্রুসেনারা আমাকে এবং আমার সেনাদলকে সামান্য মুহূর্তের জন্য ধরার সুবর্ণ সুযোগ আবার হারিয়ে ফেলে। হয়তবা এ ছিল পরম করুণাময় আল্লাহর আশীর্বাদ। আমি পরে জানতে পারি আমার অবস্থানের বাম থেকে যে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম তা ছিল লেঃ ইমামুজ্জামানের সৈনিকদের সঙ্গে পাকসেনাদের সংঘর্ষ। পাকসেনারা হেলিকপ্টারযোগে বামে অবতরণ করেছিল সে সময় লেঃ ইমামুজ্জামানের সৈন্যদলের সামনে পড়ে যায়। এতে তাদের যথেষ্ঠ ক্ষয়ক্ষতি হয়। লেঃ ইমামুজ্জামান শত্রুদের প্রচন্ড আঘাত হেনে পরে বাম দিক দিয়ে পিছনে হটে আসে এবং আমার সঙ্গে মিলিত হয়। যদিও আমাকে অবস্থান পরিত্যাগ করতে হয়েছিল এবং পাকবাহিনী বেলুনিয়া পুনঃদখল করে নেয় তবুও শত্রুদের যা হতাহত হয় তা ছিল অপূরনীয়। আমাদের পশ্চাদপসরন একটা রণকৌশল ছিল। সৈন্য, অস্ত্র, গোলাবারুদ সবকিছুই ছিল নগণ্য। সে তুলনায় শত্রুদের শক্তি ছিল বিরাট। আমার তখনকার যুদ্ধের নীতি এবং কৌশলই ছিল শত্রুদেরকে অকস্মাৎ আঘাত হানা বা তাদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে আমার মনোনীত জায়গা অগ্রসর হতে দেওয়া এবং তাদেরকে পর্যুদস্ত এবং ধ্বংস করা-শত্রুদের এভাবে ব্যতিব্যস্ত রেখে আস্তে আস্তে নিজের শক্তি আরো গড়ে তোলা এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করা। অংকুরেই ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। এ পরিপ্রেক্ষিতে সব সংঘর্ষেই আমি পাক সেনাবাহিনী কে আঘাত হানতাম অতর্কিতে। আবার যখন যথেষ্ঠ ক্ষতিসাধন হত তখন অকস্মাৎভাবেই সংঘর্ষ এড়িয়ে অন্য জায়গায় চলে যেতাম। এতে শত্রুরা আরো মরিয়া হয়ে উঠত এবং পাগলের মত আমার নতুন অবস্থানে এসে আঘাত হানত। বারবারই এ রণকৌশল পুনরাবৃত্তি হত। যে সময় বেলুনিয়ার সম্মুখসমর চলছিল, ঠিক সে সময় আমি শত্রুর পিছনের এলাকায় আঘাত হানার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। আমার হেডকোয়ার্টারস-এ অন্ততঃপক্ষে চারহাজার গেরিলা সে সময় প্রশিক্ষণরত ছিল। এদেরকে আমি বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে বিশেষ বিশেষ ধরনের গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতিতে শিক্ষা দিচ্ছিলাম। একটি দলকে শিক্ষা দিচ্ছিলাম ডিমোলিসন (বিস্ফোরক) ব্যবহার- যাদের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল দেশের অভ্যন্তরে যত রাস্তা ও রেলওয়ে সেতু আছে সেগুলি ধ্বংস করে দেওয়া- যাতে শত্রুরা অনায়াসে যাতায়াত করতে না পারে এবং বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে পাক সেনাদল তাদের রেশন ঠিকমত পোঁছাতে না পারে। এ ছাড়া এ দলটির আরো কাজ ছিল শিল্পক্ষেত্রে-কিছু মনোনীত শিল্পকে সাময়িকভাবে অকজো করে দেওয়া। বিশেষ করে ঐ সব শিল্প, যাদের তৈরী মাল পাকবাহিনী বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে। এসব শিল্প অকেজো করার সময় আমাকে অনেক সতর্কতার সাথে পরিকল্পণা করতে হয়েছে, যেহেতু সব শিল্পই আমাদের দেশের সম্পদ এবং এগুলি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিলে পরবর্তীকালে স্বাধীনতার পর আমাদের নিজেদেরই আবার সংকটের সম্মুখীন হতে হবে, সে কারণে প্রতিটা টার্গেট সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরিকল্পণাগুলিকে যথেষ্ঠ বিবেচনার সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে হত এবং তারপরই সিদ্ধান্ত গ্রহন করতাম। শিল্পগুলিকে ধ্বংস না করে এগুলিকে সাময়িক অকেজো করার এক অভিনব পদ্ধতি আমি খুঁজে পাই। আমার সেক্টর-এর বেশীরভাগ শিল্প ঢাকার চারপাশে- ঘোড়াশাল এবং নরসিংদীতে অবস্থিত ছিল। আমি জানতে পেরেছি যে, এসব শিল্পের জন্য বৈদ্যুতিক শক্তি সাধারণত সাজিবাজার পাওয়ার হাউস ও কাপ্তাই থেকে পাওয়ার লাইনের মাধ্যমে আসে। আমি আমার গেরিলাদের প্রথম টার্গেট দেই ওই সব পাওয়ার লাইন উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। প্রতি সপ্তাহে ২০টি টিম বিভিন্ন এলাকায় পাওয়ার লাইন ধ্বংস করতে থাকে। এর ফলে প্রায় ৭৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ শিল্প এলাকাগুলোতে বন্ধ হয়ে যায়। পাকবাহিনী নিরুপায় হয়ে প্রত্যক পাইলনের নীচে এন্টি-পার্সোনাল মাইন পুঁতে রাখত যাতে আমার লোকজন পাইলনের কাছে আসতে না পারে। তারা সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউস থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে শুরু করে। আমি যখন এ খবর জানতে পারি, তখন সিদ্ধিরগঞ্জের সরবরাহ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ যাতে না যেতে পারে তার পরিকল্পনা করতে থাকি। আমার হেডকোয়ার্টাস থেকে তিনটি দলকে ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ পদ্ধতি সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য আনার জন্য প্রেরন করি। এক সপ্তাহের মধ্যে তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে যায় এবং আমাকে সমস্ত খবর পৌঁছায়। তারা আরো জানায়, পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী দল ট্যাঙ্কসহ সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে আস্তানা গড়েছে। চতুর্দিকে বাঙ্কার প্রস্তত করে সে জায়গাটি পাহারা দিচ্ছে। সে কেন্দ্রটিকে অকেজো করতে হলে একটা বিরাট যুদ্ধের পর সেটিকে দখল করতে হবে। শত্রুঘাঁটি যেরূপ শক্তিশালী ছিল তাতে সফল হাওয়া সম্ভব হতেও পারে , নাও হতে পারে। আর তাছাড়া আমি প্রকৃতপক্ষে কেন্দ্রটি সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দেওয়ার পক্ষেপাতী ছিলাম না। আমি এসব ভেবে অন্য পন্থা অবলম্বন করার জন্য চিন্তা করতে থাকি। এই সময়ে ওয়াপদার একজন ইঞ্জিনিয়ার আমার কেন্দ্র আসেন। তাঁর সঙ্গে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আমার যে অনুসন্ধান দলটি খবরাখবর এনেছিল, তারা আসার সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রের একটা নীলনকশা ওয়াপদার প্রধান দপ্তর থেকে চুরি করে এনেছিল। আমি ইঞ্জিনিয়ার জনাব ভূইয়াকে এ নীলনকশা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহের একটা সম্পূর্ণ মডেল আমার হেডকোয়ার্টারে-এ তৈরীর নির্দেশ দেই। ইঞ্জিনিয়ার জনাব ভূঁইয়া আমার নির্দেশ অনুযায়ী ঢাকা, টঙ্গি, ঘোড়াশাল, নারায়নগঞ্জের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের একটা পূর্ণাঙ্গ মডেল তৈরী করেন। সে মডেলের উপর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সাথে আলোচনাকালে আমি বুঝতে পারি যে, ঢাকাতে মোট ন’টি জায়গাতে (পোস্তাগোলা, ডেমরা, হাটখোলা, জংসন, খিলগাঁও, মতিঝিল, ধানমণ্ডি, শাহবাগ, কমলাপুর, উলন) গ্রীড সাবস্টেশন আছে এবং এই সাবস্টেশনগুলি যদি আমরা ধ্বংস করে দিতে পারি তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। এও বুঝতে পারি যে, বিদ্যুৎ সরবরাহ সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে মোটামুটি তিনটি লাইনে আসে এবং যদি সবগুলো সাবস্টেশন একসঙ্গে উড়িয়ে না দেয়া যায়, তাহলে বিদ্যুৎ সরবরাহ অন্য পথ দিয়ে চলবে। ঢাকার এবং শিল্প এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ অকেজো করে দেওয়ার জন্য আমি জুলাই মাস থেকে ১৬টি টিম ট্রেইন করতে থাকি। এসব টিমে ৮ থেকে ১০ জন গেরিলাকে এভাবে ট্রেনিং দেই যাতে তারা সাবস্টেশন গুলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি খুব কম সময়ের মধ্যে চিনে নিতে পারে এবং সেগুলো অনায়াসে ধ্বংস বা অকেজো করে দিতে পারে। ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা এমনভাবে করা হয় যাতে তারা এ কাজে সম্পূর্ন পারদর্শিতা অর্জন করে। দু’মাস ট্রেনিং-এর পর এসব টিমগুলোকে আমার হেডকোয়ার্টারে মডেলের উপর একটা পূর্ণাঙ্গ রিহার্সালের বন্দোবস্ত করি যাতে প্রত্যেকটা টিমের প্রতিটি ব্যক্তির তার কার্য সম্বন্ধে কোন সন্দেহ না থাকে। নিজ নিজ কার্য যাতে তৎপরতার সাথে করতে পারে সে জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়। এ টিমগুলি কে আমি কসবার উত্তরে আমাদের যে গোপন প্রবেশপথ ছিল, সে পথে ঢাকাতে প্রেরন করি। টিমগুলি নবীনগর এবং রূপগঞ্জ হয়ে নদীপথে ঢাকার উপকন্ঠে পোঁছে এরা প্রথম তাদের রেকি (সন্ধানী) সম্পন্ন করে। অনুসন্ধানের পর জানতে পারে যে কতগুলো সাবস্টেশনে পাকিস্তানীরা ছোট ছোট আর্মি পাহারা দলের বন্দোবস্ত করেছে। আবার কোন কোনটিতে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ কিম্বা রাজাকার দ্বারা পাহারার বন্দোবস্ত করেছে। দলগুলি তাদের সমস্ত সরঞ্জাম এবং অস্ত্র ঢাকাতে বিভিন্ন জায়গাতে লুকিয়ে রেখে বর্তমান অবস্থান সম্বন্ধে আমাকে খবর পাঠায় এবং নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। আমি বুঝতে পারলাম যদিও কোন কোন জায়গায় ছোট ছোট পাহারার বন্দোবস্ত করা হয়েছে তবুও এগুলি ধ্বংস করার সুযোগ এখনই। এরপর পাহারা আরও সুদৃঢ় হওয়ার আশঙ্কা আছে। সে জন্য আর কালবিলম্ব না করে সবগুলো পাওয়ার সাবস্টেশন একযোগে অতিসত্বর ধ্বংস করার বা অকেজো করার নির্দেশ পাঠাই। আমার নির্দেশ পাওয়ার পর সব টিমই নিজ নিজ কমান্ডারদের নেতৃত্বে একযোগে জুন মাসের ২৭ তারিখের রাতে অকস্মাৎ তাদের আক্রমন চালায়। তারা এইসব আক্রমণে ধানমণ্ডি, শাহবাগ, পোস্তাগোলা, উলন, মতিঝিল, ডেমরা প্রভৃতি সাবস্টেশনগুলি ধ্বংস বা সাময়িক অকেজো করে দিতে সক্ষম হয়েছিল। আক্রমণের সময় আমার লোকদের সঙ্গে অনেক জায়গায় পাকসেনাদের সংঘর্ষ হয়- বিশেষ করে ধানমণ্ডি সাবস্টশনে। এই দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিল রুমি। সে একাই স্টেনগান হাতে পাকসেনাদের উপর হামলা চালায় এবং সকলকে গুলি করে মেরে ফেলে। তার অসীম সাহসিকতার ফলে অন্যান্য লোকরাও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে এবং পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সাবস্টেশনটি ধ্বংস করে দেয়। এরূপ সংঘর্ষ শাহবাগ ও ডেমরাতে ঘটে। বাকি জায়গাগুলোয় আমার লোকেরা এমন অকস্মাৎভাবে সাবস্টেশনগুলির ভিতরে ঢুকে পড়ে যে পাকসেনারা বা পাকিস্তানী পুলিশেরা কিছু বোঝার আগেই তাদের হাতে বন্দী বা নিহত হয়। এ অপারেশন-এ অন্তত ৭৫ শতাংশ সফলতা লাভ করি। ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ ২৪ ঘন্টার জন্য সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। যদিও পাকিস্তানীরা বিমানযোগে সাবস্টেশনের যন্ত্রপাতি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসে এবং কিছুটা সরবরাহ পুনরুদ্ধার করে-তবুও শিল্প এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চিরতরে কমে যায়। এতে পাটকলগুলি চালাবার প্রচেষ্টা অনেকাংশে কমে যায়।
এ সময়ে আমি আরো জানতে পারি যে, প্রিন্স সদরুদ্দিন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ঢাকায় আসছেন সরেজমিনে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য। জেনারেল টিক্কা খান সে সময়ের প্রস্ততি নিচ্ছিল প্রিন্স সদরুদ্দিনকে বাংলাদেশের সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থা দেখাবার জন্য। আমি তার এই প্রচেষ্টা বানচাল করার জন্য আরো পাঁচটি দল তৈরী করি। তাদের কাজ ছিল ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় গ্রেনেড বিষ্ফোরণ ঘটানো এবং অবস্থা যে স্বাভাবিক নয় সে সম্বন্ধে প্রিন্স সদরুদ্দিনকে বুঝিয়ে দেওয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী দলগুলি ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বিষ্ফোরণ ঘটায়-প্রিন্স সদরুদ্দিনের অবস্থানকালে। সবচয়ে বড় বিষ্ফোরণ ঘটায় মতিঝিলে। আলম এবং সাদেক এ দুজন গেরিলা ১টা গাড়ীর ভিতরে ৬০ পাউন্ড বিষ্ফোরক রেখে মতিঝিল হাবিব ব্যাঙ্ক বিল্ডিং-এর সামনে বিলম্বিত ফিউজের মাধ্যমে ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটায়। এ বিস্ফোরণের ফলে হাবিব ব্যাঙ্কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই ঘটনায় সমস্ত ঢাকা শহরে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জনসাধারন সঙ্গে সঙ্গে সব কাজ কর্ম বন্ধ করে দেয়। সেদিন রাতেই প্রিন্স সদরুদ্দিন যখন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিশ্রাম করছিলেন এ দলটি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বারান্দায় আরেকটা বিস্ফোরক ভর্তি গাড়ী বিস্ফোরণ ঘটায়। চতুর্দিকে এসব বিস্ফোরণে জাতিসংঘে মহামান্য পর্যবেক্ষক বেশ ভাল করে বুঝতে পেরেছিলেন যে টিক্কা খান যাকে স্বাভাবিকভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছে, তা স্বাভাবিক নয়। ঢাকার অপারেশন যখন চলছিল তখন আমি আমার বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের মিলিত দল বিভিন্ন থানায় পাঠাচ্ছিলাম থানাগুলি দখল করে নেওয়ার জন্য। এই দিনগুলি ছিলো বিশেষ অসুবিধার-কারণ আমার ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছেলেরাও সেনারা সবাই ছিল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ছিল না শুধু অস্ত্র আর গোলাবারুদ। অনেক চেষ্টা করেও গোলাবারুদ আর অস্ত্রের কোন ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না।
আমাদের বন্ধুরা সবসময় আশ্বাস দিত ‘এই অস্ত্র এসে পড়ছে’। কোন সময় বলত ট্রেনে মালভর্তি হয়ে গেছে, বন্যার জন্য আসতে পারছে না, কেননা রেললাইন বন্ধ। আবার কোন সময় বলত ফ্যাক্টরিতে তৈরী হচ্ছে। এমনও সময় গেছে যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিকল্পনা তৈরীর পর আমাদের সে পরিকল্পনা পরিত্যাগ করতে হতো অস্ত্রের অভাবে। নিজেদের কাছে যে সব অস্ত্র ছিল সেসবেরও গোলাবারুদ অত্যন্ত রেশনিং-এর পরেও প্রায় শেষ হওয়ার পথে ছিল। এ সময় সমস্ত মুক্তিবাহিনীতে হতাশার ভাব পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় বহু অনুরোধের পর হয়ত ৩০৩ রাইফেলের ৫ রাউন্ড করে গুলির সাহায্য পেতাম। এ ধরনের যুদ্ধের জন্য যা ছিল অতি নগণ্য। এসব অসুবিধা এবং সংকটের মধ্যেও আমরা ভেঙ্গে পড়িনি। আমি আমার সেনাদলকে নির্দেশ দেই, যে উপায়ে হোক আর যেখানেই হোক পাক বাহিনীকে এ্যামবুশ করে যা অতর্কিতে আক্রমন করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদেরকে সজ্জিত করে তুলতে হবে। এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। সকলকে আত্ননির্ভরশীলতা এবং আত্নবিশ্বাস আরো বাড়াতে হবে। আমার এ নির্দেশ বেশ কাজে লাগে।সকলেই আবার পূর্ণ উদ্দ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।
জুলাই মাসে টিক্কা খান আবার মন্দভাগ এবং শালদা নদী পুনর্দখল করার প্রচেষ্টা চালায়। পাকিস্তানীরা বেলুচ কুট্টি নামক জায়গায় সৈন্য সমাবেশ করে। আমাকে এ খবর আমাদের লোকেরা পৌঁছায়। আমি ক্যাপ্টেন গাফফারকে মন্দভাগের অবস্থান আরো এগিয়ে বাজারের নিকট অবস্থান শক্তিশালী করার নির্দেশ দেই। শত্রুসেনারা সকালে বেলুচ রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানীকে সামনে রেখে অগ্রসর হয়। সকাল সাড়ে দশটায় শত্রুসেনারা অবস্থানের অগ্রবর্তী স্থান পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং আমাদের মাইনফিল্ডের ভিতর আটকা পড়ে যায়। তবুও তারা অগ্রসর হতে থাকে। তারা যখন আমাদের থেকে ৫০ গজের মধ্যে এসে পড়ে, ক্যাপ্টেন গাফফারের সেনাদল তাদের উপর অকস্মাৎ গুলিবর্ষণ শুরু করে। শত্রুরা আমাদের অবস্থান এত সামনে আছে তা জানত না। চতুর্দিকের গুলিতে তাদের দুটি কোম্পানী সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং শত্রুসেনারা চারিদিকে ছুটাছুটি করতে থাকে। এতে তাদের নিহতের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। ৩১ বেলুচ কিছুক্ষন পর তাদর আক্রমন পরিত্যাগ করে। কিন্তু এক ঘন্টা পরে পাক সেনারা শলদা নদীর দক্ষিন তীরের সাথে আমাদের অবস্থানের ডান পাশ দিয়ে পিছনে আসার চেষ্টা করে। তারা যে এরূপ একটা কিছু করতে পারে ক্যাপ্টেন গাফফার তা পূর্বেই অনুমান করেছিল। এ জন্য ক্যাপ্টেন গফফার তৈরীও ছিল। সুবেদার ওহাবের অধীন একটি কোম্পানীকে সে আগে থেকেই শালদা নদীর দক্ষিণ তীরে এ্যামবুশ পজিশনটির ফাঁদে পড়ে যায়। নিরুপায় হয়ে তারা অবস্থানটির উপর প্রবল আক্রমণ চালায় কিন্তু আমাদের গুলির মুখে এ আক্রমণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আর উপায় না দেখে পরবর্তী আক্রমণ স্থগিত রেখে পাকসেনারা পিছু হটে যায়। ক্যাপ্টেন গাফফারের সেনাদল ও সুবেদার ওহাবের সেনাদল পশ্চাৎগামী শত্রুদের পিছনে ধাওয়া করে। এ সময় চতুর্দিক ধানক্ষেতে এবং অন্য জায়গায় বেশ পানি ছিল। শত্রুরা এসব পানি ভেঙ্গে পশ্চাদপসরণ করার সময় অনেক আহত ও নিহত হয়। যুদ্ধের শেষে সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে খুঁজে আমরা অন্তত ১২০টা মৃতদেহ খুঁজে পাই এবং আরো অনেক মৃতদেহ যেগুলি পানিতে ছিল, খুঁজে পাওয়া যায় না। এ যুদ্ধের ফলাফল আমার পক্ষে অনেক লাভজনক ছিল। আমরা ৮টা মেশিনগান, ১৮টা হালকা মেশিনগান প্রায় দেড়শ (১৫০) রাইফেল, ২ টা রকেট লাঞ্চার, ২ টা মর্টার ও অজস্র গোলাবারুদ হস্তগত করি। আরো অনেক অস্ত্রশস্ত্র যেগুলি পানিতে ছিল সেগুলি খুঁজে পাওয়া যায়নি। মৃতদেহগুলির মধ্যে ১ জন ক্যাপ্টেন, ১জন লেফটেন্যান্ট এবং আরো কয়েকজন জুনিয়ার কমিশন্ড অফিসার কে সনাক্ত করা হয়। শত্রুরা এই সময় বৃষ্টি এবং বন্যার জন্য আমাদের হাতে বেশ নাজেহাল হচ্ছিল এবং তাদেরকে বাধ্য হয়ে গতিবিধি শুধু রাস্তায় সীমিত রাখতে হচ্ছিল। কিন্তু আমরা শত্রুদের এ দুর্বলতা সম্পুর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারছিলাম না যেহেতু তখন আমরা অস্ত্রশস্ত্রের দিকে দুর্বল ছিলাম-যদিও ইতিমধ্যেআমাদের বেশ সংখ্যক লোক ট্রেনিং পেয়ে প্রস্তুত ছিল। অস্ত্রের অভাবে এসব ট্রেনিং প্রাপ্ত লোকদের আমরা ভেতরে পাঠাতে পারছিলাম না। শত্রুরা আমাদের দুর্বলতা বুঝতে পেরে তাদের গতিবিধি আরো বাড়াবার জন্য জলযানের যোগাড় করতে লাগল- বাংলাদেশের যত লঞ্চ, স্টিমার, স্পীডবোট ছিল, সেগুলি দখল করে মেশিনগান ফিট করে এগুলিকে গানবোট হিসাবে ব্যবহার করতে লাগল।
আমাদের কাছে খবর আসে যে, শত্রুরা ‘পাক বে’ কোম্পানীকে তিনশত ফাইবার গ্লাস স্পীডবোট তৈরীর নির্দেশ দিয়েছে। নারায়নগঞ্জের ‘পাক বে’ ডকইয়ার্ডে এসব স্পীডবোট তৈরীর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। এই ‘বে’ কোম্পানীর একজন অফিসারের ভাই আমার মুক্তিবাহিনীতে ছিল। সে এসে খবর দেয় যে এই স্পীডবোটে লাগাবার জন্য তিনশ ইঞ্জিন সদ্য আনা হয়েছে এবং সেগুলি ‘পাক বে’র গুদামে মওজুত রাখা আছে। আমি তৎক্ষণাৎ সেই ছেলেটিকে আরো দশজন গেরিলা মনোয়ন করার নির্দেশ দিই এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে, ফাইবার গ্লাস স্পীডবোট প্রস্তুত হয়ে গেলে শত্রুদের গতিবিধি অনেক গুণে বেড়ে যাবে, এই বর্ষার মওসুমে শত্রুসেনারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছাতে পারবে। তখন আমাদের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সুদূর গ্রামের গোপন অবস্থানগুলি অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে পড়বে। সে জন্য এই মেশিনগুলিকে এখনই ধ্বংস করে দিতে হবে। নির্দেশমত মনোনীত দলটিকে প্রশিক্ষণের পর নারায়ণগঞ্জ পাঠিয়ে দিই। নারায়ণগঞ্জ এসে তারা প্রথম ‘পাক বে’র গুদামটি রেকি (অনুসন্ধান) করে এবং জানতে পারে যে, দু’জন পুলিশ এবং দু’জন চৌকিদার যে গুদামটিতে মেশিনগান রাখা আছে সেখানে পাহাড়া দিচ্ছে। সেদিন সন্ধ্যায় আমার দলটি অতর্কিত পুলিশদের নিরস্ত্র করে ফেলে এবং পুলিশ ও চৌকিদারদের একটি কামড়ায় বন্ধ করে গুদামের তালা ভেঙ্গে গুদামে প্রবেশ করে। গুদামের ভিতরে ডিজেল এবং পেট্রোল ছিল। সেগুলি সব মেসিনের উপর ঢেলে দেয় এবং যে সব ফাইবার গ্লাস নৌকা প্রস্তুত ছিল তাতেও ঢেলে দেয়। এরপর অগ্নিসংযোগ করে বেড়িয়ে আসে। কয়েক সেকেণ্ডের ভিতর সমস্ত মেশিনে এবং ফাইবার গ্লাস নৌকাগুলিতে আগুন লেগে যায় এবং বিষ্ফোরণ ঘটে। এই বিষ্ফোরণে শত্রুদের সমস্ত মেশিন এবং ৩০০ নৌকা ধ্বংস হয়ে যায়।
এ অপারেশনের ফলে পাক বাহিনী তাদের গতিবিধি অনেকাংশ সীমিত করতে বাধ্য হয়। অপরদিকে এই অপারেশনের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সুদূঢ় গ্রামাঞ্চলে তাদের গোপন স্থান বিপদমুক্ত রাখা সম্ভব হয় এবং তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পাকসেনাদের উপর আক্রমন চালাতে থাকে।
২রা জুলাই সকাল সাড়ে ৫টায় সময় একটা দল মোঃ হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে শত্রুদের লাটুমুড়া অবস্থানের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায় এ আক্রমণে মার্টারের সাহায্যও নেইয়া হয়। আক্রমণে ফলে ১২ জন পাকসেনা নিহত অ ৪ জন আহত হয়।
কুমিল্লাতে আমাদের এ্যাকশন তীব্রতর হওয়ার জন্য পাকসেনারা কুমিল্লার উত্তরে গোমতী বাঁধের উপর তাদের অবস্থান তৈরী করে এবং এরপরে তারা তাদের কর্তৃত্ব আরও উত্তরে বাড়ানোর জন্য টহল দিতে শুরু করে। পাকসেনারা যাতে শহরের বাইরে কর্তৃত্ব পুনঃস্থাপন করতে না পারে সেজন্য আমি ‘বি’ কৌম্পানীর দু’টি প্লাটুনসহ কোটেশ্বর নামক স্থানে শক্তিশালি ঘাঁটি গড়ে তুলতে নির্দেশ দেই। পাকসেনারা ২/৩ দিন এই এলাকায় সম্মুখবর্তী জায়গায় তাদের টহল বজায় রাখে। এরপর ৪ ঠা জুলাই পাকসেনাদের একটি ভারী দল সকাল ৪ টার সময় আমাদের অবস্থানের আধামাইল পশ্চিম কোটেশ্বর গ্রামের ভিতর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সকাল ৪ টা ১৫ মিনিটে তারা আরো অগ্রসর হয়ে আমাদের ২০০/৩০০ গজের মধ্যে পৌঁছে। এ সময় আমাদের সৈন্যরা তাদের উপর গুলি চালায়। পাকসেনারা ২/৩ ঘন্টা প্রবল চাপ চালিয়ে যায় অগ্রসর হবার জন্য কিন্তু আমাদের গুলির মুখে বারবারই পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। এরপর তারা ৫০০/৬০০ গজ পিছু হটে গিয়ে আমাদের বামে ‘সারিপুরের’দিক থেকে আবার অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। এবারও পাকসেনারা আমাদের গোলাগুলির সামনে টিকতে না পেরে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের কমপক্ষে ৩০জন হতাহত হয়। আমাদের ১ জন প্রাণ হারায়।
হোমনা থানা পাকসেনাদের জন্য সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। ঢাকাতে যেসব গেরিলাকে পাঠাতাম অপারেশনের জন্য, তারাও এই হোমনা দিয়ে যাতায়াত করত। সে জন্য পাকসেনারা লঞ্চে করে সব সময় দাউদকান্দি থেকে হোমনা টহল দিয়ে আসত। আর হোমনায় দালাল পুলিশেরা পাকসেনাদের মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে খবরাখবর দিতো। এ পুলিশ স্টশনটি আমার আমার জন্য বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে জন্য এই থানাটি দখল করে নেয়ার জন্য আমি হাবিলদার গিয়াসকে নির্দেশ দেই। হাবিলদার গিয়াস তার সেনাদল ও স্থানীয় গেরিলাদের নিয়ে থানাটি আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়। তারা খবর নিয়ে জানতে চায় যে, থানাতে বাঙালী দালাল পুলিশ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশও যথেষ্ঠ আছে। থানা রক্ষার্থে পুলিশ থানার চতুর্দিকে বাঙ্কার তৈরী করেছে এবং কয়েকয়েকটা হালকা মেশিনগানও তাদের কাছে আছে। সম্পূর্ণ খবরাখবর নিয়ে হাবিলদার গিয়াস থানা আক্রমণের একটা পরিকল্পনা নেয়। ১লা জুলাই রাত ১১টার সময় হাবিলদার গিয়াস তার গনবাহিনী ও নিয়মিত বাহিনীকে নিয়ে থানাটি অতর্কিতে আক্রমণ করে। এ আক্রমণে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশরা হালকা মেশিনগানের সাহায্য বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আক্রমণের মুখে তারা সবাই নিহত হয়। হাবিলদার গিয়াস থানাটি দখল করে নেয়। এর ফলে থানার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র তার হস্তগত হয় এবং আমাদের ঢাকা যাবার রাস্তাও শত্রুমুক্ত হয়।
আমাদের একটি প্লাটুন মিয়াবাজার থেকে ফুলতুলীতে টহল দিতে যায়। রাত ৩টার সময় তারা দেখতে পায় পাকসেনাদের ১টি জীপ এবং ২টি ট্রাক কুমিল্লা থেকে দক্ষিণের দিকে টহল দিতে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্লাটুনটি কুমিল্লা চট্টগ্রাম রাস্তার উপর এ্যামুশ-এর জায়গায়অ তারা ১টি মেসিনগান রাস্তার দুদিঙ্ক থেকে লাগিয়ে পাকসেনাদের জন্য অপেক্ষা করে। রাত সারে ৪টায় পাকসেনাদের গাড়ীগুলি মিয়াবাজার অবস্থানে ফেরত আসে। আসার পথে গাড়ীগুলি আমাদের এ্যামুশ-এ পড়ে যায়। এ্যামবুশ পার্টি খুব নিকটবর্তী স্থান থেকে মেশিনগান এবং হালকা মেশিনগানের গুলি চালিয়ে গাড়ীগুলি ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। পাকসেনারা গাড়ী থেকে লাফিয়ে নীচে নামার চেষ্টা করে কিন্তু এতেও তাদের অনেক লোক মেশিনগানের গুলিতে হতাহত হয়। পাকসেনাদের কমপক্ষে ৩ জন অফিসার সহ ২১ জন নিহত ১৫ জন আহত হয়। পরে খবর পাওয়া যায় যে নিহতের মধ্যে ১ জন লেঃ কর্ণেলও ছিলেন। এ এ্যামবুস সময় পাকসেনারা কুমিল্লা বিমানবন্দর তাদের সাথীদের সাহার্য্যেথে কামানের সাহায্যে আমাদের এ্যামবুশ অবস্থানের উপর প্রচন্ড গোলা ছুঁড়তে থাকে। গোলার মুখে বেশীক্ষন টিকতে না পেরে আমাদের এ্যামবুশ পার্টি স্থানটি পরিত্যাগ করে পিছু হটে আসে।
জুলাই মাসের ১ লা তারিখে পাকসেনারা আবার তাদের শালদা নদী ও কসবা অবস্থানের ভিতরে যোগাযোগের স্থাপনের চেষ্টা চালায়। সকাল ১০টার সময় শালদা নদী থেকে পাকসেনারাদের একটি দল কসবার দিকে অগ্রসর হয়। এই দলটি কিছুদূর অগ্রসর হবার পর মন্দভাগের নিকট গফফারের ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানী, পাকসেনারা যখন তাদের অবস্থানের সামনে দিয়ে কসবার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, ঠিক সে সময় তাদের উপর অতর্কিত হমলা চালায়। পাকসেনারা আর অগ্রসর হতে পারে না এবং ছত্রভঙ্গে তাদের মৃতদেহগুলি ফেলেই শালদা নদীর অবস্থানে পালিয়ে যায়। পালানোর পথে আমাদের মর্টারের গোলাও তাদের যথেষ্ঠ ক্ষতিসাধন করে। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের ৮ জন আহত ও ৩ জন নিহত হয়।
পাকসেনারা জুলাই মাসের ৩ তারিখে ফেনী থেকে দুটি কোম্পানী নিয়ে বেলুনিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। রাস্তায় তারা ‘শালদা বাজার’ নামক স্থানে সাময়িক অবস্থান নেয়। এই সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের ১টি প্লাটুন ৩ মর্টারসহ দুপর দুটার সময় শত্রুদের এই দলটির উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাদের মনোবল বেলুনিয়াতে আগে থেকেই যথেষ্ট কমে গিয়েছিল। এ ছাড়া সে সময়ে বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির মধ্যে সাময়িকভাবে বানানো ট্রেঞ্চগুলোতে থাকাও বেশ অসুবিধাজনক হয়ে পড়েছিল। অতর্কিত আক্রমণের ফলে মেশিনগান ও মর্টারের গোলাগুলিতে তদের অসংখ্য লোক হতাহত হয়। পরে জানা যায় যে, তদের অত্যন্তপক্ষে ৩০ জন লোক নিহত ও ২০ জন লোক আহত হয়েছে। পাকসেনারা এরপর শালদা বাজারের পার্শ্ববর্তী সাহেবনগর ও অন্যান্য গ্রামগুলি থেকে স্থানীয় লোকদের অন্য স্থানে চলে যেতে বলে। মতলববাজার এলাকাতে মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুনকে লেঃ মাহবুব পাঠিয়ে দেয়। এই প্লাটুনটি মতলব এলাকায় গিয়ে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। সেখানে তারা জানতে পারে মতলব থানাতে পাকিস্থানী পুলিশ এবং রেঞ্জার মোতায়েন করা হয়েছে। এ পুলিশের অত্যাচারে স্থানীয় লোকরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। পাকিস্থানী পুলিশরা স্থানীয় দালালদের সহয়তায় শাসনকার্য আয়ত্তাধীন আনার চেষ্টা করেছে। আমাদের দলটি মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে এই থানাকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা থানার সম্বন্ধে সকল খবর যোগাড় করে। জুলাই মাসের ২ তারিখের রাতে গেরিলা দলটি থানার উপর আক্রমণ করে। পাকিস্থানী পুলিশ ও রেঞ্জাররা এই আক্রমণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে কিন্তু তীব্র আক্রমণের মুখে ৫ জন পুলিশ নিহত এবং ৭ জন আহত হয়। ঠিক এই সময়ে গেরিলাদের নিকট যে হালকা মেশিনগানটি ছিল সেটা খারাপ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে গেরিলা আক্রমণ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। গেরিলাদেরও ১ জন নিহত হয়। কিন্তু এই আক্রমণের পর থেকে পাকিস্থানী পুলিশরা আর থানার বাইরে আসার সাহস পায়নি। সমস্ত মতলব থানা এলাকা মুক্তিবাহিনী আয়ত্তাধীন এসে যায়।
শালদা নদীতে আমাদের কার্যকলাপ সব সময় চালানো হচ্ছিল। মেজর সালেকের এক পেট্রল পার্টি খবর আনে যে রেলওয়ে সড়কের পূর্ব দিক দিয়ে একটি ছোট রাস্তা পাকসেনারা তদের শালদা নদী ও নয়ানপুর অবস্থানের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য ব্যবহার করে। মেজর সালেক ৫ জনের একটি ডিমোলিশন পার্টি পাঠিয়ে সেই রাস্তার উপর মাইন পুঁতে দেয়। ৯ই জুলাই সকাল সাড়ে ৫টার সময় পাকিস্থানীদের একটি প্লাটুন শালদা নদী থেকে নয়ানপুর যাবার পথে এইসব এন্টি-পার্সোনাল মাইনের উপর পড়ে যায়। মাইন বিষ্ফোরণে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়। পাকসেনারা বিপর্যস্ত হয়ে শালদা নদীতে ফিরে আসে।
৬ই জুলাই পাকসেনারা প্রায় ১টি ব্যাটালিয়ন নিয়ে মন্দভাগ বাজার পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সেখান থেকে তারা সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের ‘এ’ কোম্পানি এবং ‘সি’ কোম্পানি মেজর সালেক এবং ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে পাকসেনাদের শালদা নদী এঙ্কলেভ এর ভিতর অগ্রসর হটে প্রচণ্ড বাঁধা দেয়। পাকসেনারা তাদের ফিল্ড আর্টিলারি মন্দভাগ বাজার পর্যন্ত নিয়ে আসে এবং কামানের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর এবং পার্শবর্তী গ্রামগুলোতে তীব্র গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এই গোলাবর্ষণে আমাদের ১১ জন আহত হয় এবং অন্তত ৩২ জন বেসামরিক ব্যাক্তি হতাহত হয়। পাকসেনারা তাদের আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে এবং শালদা নদী এঙ্কলেভ দখল করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। আমাদের মুক্তিসেনারাও তাদের এ আক্রমণে তীব্র বাঁধা দিতে থাকে। যদিও আমাদের মর্টারের গোলা তাদের কামানের অবস্থান পর্যন্ত পৌছতে পারেনি তবুও মর্টারের গোলা এবং মেশিনগুলোতে তাদের আক্রমণ প্রতিহত হয়ে যায়। তারা পিছু হটে মন্দভাগ বাজারে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। মেজর সালেক পাকসেনাদের শালদা নদীর অবস্থানের বিরুদ্ধে তার কার্যকলাপ আরও তীব্রতর করার জন্য ৯ই জুলাই পাক অবস্থানের উপর ঘোরাফিরা করছিল, ঠিক সে সময় আমাদের কামানগুলি এবং মর্টার পাকসেনাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এই গোলাবর্ষণ প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে চলে। এই অকস্মাৎ প্রচণ্ড মর্টার এবং কামানের গোলাবর্ষণে শত্রুরা হতভম্ভ হয়ে পড়ে। এতে তাদের অনেক হতাহত হয়। পরে জানতে পারা যায় যে এই গোলাগুলিতে ১৯ জন পাকসেনা নিহত এবং ১১ জন আহত হয়। একটি মেশিনগান বাঙ্কার সহ তিনটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। কামানের গোলার আঘাতে তাদের একটি এম্যুনিশন ডাম্প বিস্ফোরিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এর পড় দিন একটি স্পিড বোট পাকসেনাদের নিয়ে শালদা নদী হয়ে পশ্চিম দিকে যাচ্ছিল। আমাদের পেট্রোল পার্টটি, যেটি আগে থেকেই শালদা নদীর পিছনে অবস্থান নিয়েছিল, তারা পাকবাহিনীর স্পীড বোট এম্বুশ করে। এম্বুশের সময় আমাদের গুলির আঘাতে স্পিড বোট ডুবে যায়। ১২ জন পাকসেনা গুলিতে না হয় পানিতে ডুবে মারা যায়। মরিতদের মধ্যে ১ জন মেজর ও ১ জন ক্যমাটেন ছিল এবং তাদের মদমর্যাদার ব্যাজ এম্বুশ পার্টি নিয়ে আসে। এম্বুশ পার্টি পানি থেকে একটি মেশিনগান, একটি ওয়ারলেস সেট এবং একটি ম্যাপ (যাতে শত্রুর অবস্থাগুলি চিনহিত ছিল) উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। এর পরই পাকসেনাদের কামানের গোলা আমাদের দলের উপর পড়তে থাকে। আমাদের দল তখন বাধ্য হয়ে এম্বুশ স্থান পরিত্যাগ করে।
১০ই জুলাই পাকসেনারা একটি কোম্পানি নিয়ে বিকেল ৪তার সময় পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। পাকসেনারা শালদা নদীর উঁচু স্থান সাগরতলা স্থানটি দখল করার জন্য অগ্রসর হয়। তাদের সঙ্গে তাদের গোলন্দাজ বাহিনীও সহায়তা করে। কিন্তু সাগরতলা উঁচু অবস্থানের উপর আমাদের যে প্লাটুন টি ছিল সেটি এবং রেললাইনের পশ্চিমে আমাদের আরেকটা প্লাটুন তাদেরকে প্রচণ্ডভাবে বাঁধা দ্যায়। তাদের প্রায় ৩০/৪০ জন হতাহত হয়। এরপর তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে শালদা নদীতে নিজ অবস্থানে পালিয়ে যায়।
পাকিস্তানীদের একটি দল নবীনগরে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। পাকসেনাদের নবীনগরে অবস্থানের পড় আমাদের নরসিংদী, ভৈরববাজার এবং কালীগঞ্জে যাতায়াতের রাস্তায় বাঁধার সৃষ্টি হয়। পাকসেনারা কয়েকজন স্থানীয় দালালের সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর জন্য সমস্ত এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করে। ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন এই এলাকাকে পুনরায় বিপদমুক্ত করার জন্য ১৬ জনের একটি দলকে হাবিলদার আওয়ালের নেতৃত্বে নবীনগর পাঠায়। হাবিলদার আওয়াল কষবার উত্তর দিয়ে অনুপ্রবেশ করে নবীনগরের ৩ মাইল পশ্চিমে তার গোপন ঘাঁটি স্থাপন করে। এরপর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় পাকসেনাদের অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ খবর যোগাড় করে। এর পর ৮ই জুলাই সকাল ৬টায় পাকসেনাদের নবীনগরের অবস্থানটির উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। এ অতর্কিত আক্রমণের জন্য পাকসেনারা মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা। তারা হকচকিয়ে যায় এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি পাকসেনাদের ৭জন ও ৫জন দালালকে নিহত করতে সক্ষম হয়। সঙ্ঘর্ষে আমাদের ১ জন আহত হয়। আমি এসময় ঢাকাতে আরও কয়েকটি গেরিলা পার্টি পাঠাই। এই দলগুলি আগের প্রেরিত দলগুলির সাথে যোগ দ্যায় এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও পার্শবর্তী এলাকায় তাদের গেরিলা কার্যকলাপ চালিয়ে যায়। একটি দল জুলাই মাসের প্রথমেই পাকসেনাদের ছোট একটি এম্যুনিশন পয়েন্ট আক্রমণ করে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে পাকবাহিনী সমস্ত ঢাকাতে সান্ধ্য আইন জারি করে এবং ঢাকা শহরে প্রহরার ব্যাবস্থা করে। ঐ দিনই দুজন গেরিলা নিউমার্কেটের নিকট পাকসেনাদের একটি জিপের ভিতর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ফলে ১জন অফিসার ও ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৫ই জুলাই নারায়ণগঞ্জে ২ জন আর একটি দল গুলশান সিনেমা হলের পর্দার ভিতর ১টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ফলে পর্দাটি সম্পুর্ন পুড়ে যায় এবং নিকতবর্তী ৫জন দালালও আহত হয়। সমস্ত নারায়ণগঞ্জে এবং ঢাকায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। ৪ঠা জুলাই দুপুর ১২টার সময় ৫জন গেরিলার একটি দল পাগলাটে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাইল উড়িয়ে দ্যায়। ১০ জনের গেরিলার একটি দল নিউমার্কেটের নিকট পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এবং পাকসেনাদের একটি মিলিত দলের উপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ফলে ৮ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়।
এদিকে ১১ই জুলাই সকাল ৮টা থেকে অকস্মাৎ পাকসেনারা ভারি কামান এবং মর্টারের সাহায্যে আমাদের শালদা নদী অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গোলাগুলি চালাতে থাকে। এই গোলাগুলির ফলে আমাদের শালদা নদী অবস্থানে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। পাকসেনাদের গোলাগুলি সমস্ত দিন ধরে চলতে থাকে। মর্টার স্প্লিন্টারের আঘাতে ৪র্থ বেঙ্গলের হাবিলদার তাজুল মিয়া এবং সিপাই আব্দুর রাজ্জাক মারাত্মকভাবে আহত হয়। এছাড়াও দুজন বেসামরিক লোক নিহত ও ৮জন বেসামরিক লোক আহত হয়। কিন্তু বিকেলের দিকে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায় এবং আক্রমণও হয়নি।
৯ই জুলাই পাকসেনারা আমাদের কোটেশ্বর অবস্থানের উপর সকাল ৬টায় আবার তাদের আক্রমণ শুরু করে। আমাদের কোটেশ্বর অবস্থানের সৈন্যরা মর্টার এবং কামানের সহায়তায় পাকসেনাদের এই আক্রমণের মোকাবিলা করে। পাকসেনারা প্রথমে দুটি কোম্পানি নিয়ে আক্রমণ চালায়। পরে আরও দুটি কোম্পানিকে শক্তি বৃদ্ধির জন্য নিয়ে আসে। ৩/৪ ঘণ্টা যুদ্ধের পড় আমাদের কামানের গোলায় এবং মেশিনগানের গুলিতে পাকিস্তানীদের আক্রমণ ব্যাহত হয়। এ যুদ্ধে পাকসেনাদের অন্তত ২৪/২৫ জন নিহত হয়। তারা আক্রমণ বন্ধ করে পিছু হটে যায়।
আমাদের Petrol পার্টি ৯ই জুলাই পাকসেনাদের কোম্পানি হেডকোয়ার্টার রেকি করে এবং অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারে। আমাদের কামানগুলি এই কোম্পানি হেডকোয়ার্টারের উপর প্রচণ্ড গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। ফলে দুজন পাকসেনা নিহত এবং ৬জন আহত হয়। এর মধ্যে একজন অফিসার ও তার Signaller ছিল। স্থানীয় লোকেরা অফিসারটিকে কাঁধে ব্যাজ দেখে সনাক্ত করতে পেরেছিল। শত্রুদের মনোবল ভেঙ্গে গিয়েছিল।
১০ই জুলাই রাতে ক্যাপ্টেন গাফফার ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি থেকে দুটি সেকশন সালদা নদীর পশ্চিমে কামালপুর এবং মাইঝখাইরের ভিতর এম্বুশ অবস্থানের ভিতর এসে পড়ে – ঠিক সে সময় পাকসেনাদের সম্মুখবর্তী অংশের উপর আমাদের সৈন্যরা গুলি চালাতে শুরু করে। অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনারা হতভম্ভ হয়ে যায় এবং কিছু বোঝার আগেই তাদের অনেক লোক হতাহত হয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে তারা পেছনের দিকে পালাতে শুরু করে। এঅবস্থাতেও তাদের অনেক হতাহত হয়। সঙ্ঘর্ষে পাকসেনাদের একজন মেজর, দুজন ক্যাপ্টেন ও ৮জন সিপাই নিহত হয়। আমাদের Ambush পার্টি ১টি MIGA মেশিনগান এবং Am-PRC-10 Wireless Set হস্তগত হয়।
হোমনাতে হাবিলদার গিয়াসের অধীনে যে মুক্তিবাহিনীর দলটি হোমনা থানায় আক্রমণ চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়, সেই দলটি এ এলাকাতেই তাদের ঘাঁটি গড়ে তোলে। এ দলটির কার্যকলাপে পাকবাহিনী নিকটবর্তী সমস্ত থানাগুলিকে আরও শক্তিশালী গড়ে তোলে। পাকসেনারা রাস্তার প্রত্যেকটি সেতুর উপর তাদের কড়া পাহারার ব্যাবস্থা করে। প্রতিটি হাঁট বাজার এলাকাতেও তারা ক্যাম্প তৈরি করে। এছাড়া নিকটবর্তী সমস্ত এলাকার চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ডেকে ‘শান্তি কমিটি’ গড়ার কড়া নির্দেশ দ্যায়। প্রতিটি এলাকার চেয়ারম্যানকে স্থানীয় লোক নিয়োগ করে পাকসেনাদের অধীনে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করে এবং তাদের কাজ করতে বাধ্য করে। কন স্থানীয় লোক যদি তাদের নির্দেশমোট কাজ করতে অস্বীকার করত, পাকসেনারা তাদের পিতামাতা বাড়িঘরের ক্ষতি করে বা ভয় দেখিয়ে তাদের নির্দেশমত কাজ করাতে বাধ্য করত। পাকসেনারা স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় হাবিলদার গিয়াসের দলটির সঠিক সন্ধান পায় এবং তাদের অবস্থিতি সম্বন্ধে পাকবাহিনীর মন্তব্য আমরা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পাই। তাদে ধারণা ছিল যে হোমনা এবং দাউদকান্দি এলাকাতে কমপক্ষে আমাদের ৬ হাজারেরও বেশী লোক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য পাকসেনারা কখনো রাতে তাদের ক্যাম্পগুলির বাইরে আসতে সাহস পেতনা। এছাড়া কোন সময়েই দলে ভারি না হলে ক্যাম্পের বাইরে টহলে বের হতোনা। পাকসেনাদের ভীতসন্ত্রস্ত মানসিক অবস্থার জন্য আমাদের দলটির নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে সুবিধা হয়। সপ্তাহে একদিন কি দুদিন লঞ্চের সাহায্যে পাকসেনাদের এসব ক্যাম্পে রসদ যোগানো হত। এ সংবাদ আমাদের দলটি জানতে পারে। ৬ই জুলাই দাউদকান্দি থানার অন্তর্গত মাসিমপুর বাজারের অর্ধমাইল পশ্চিমে জয়পুর গ্রামে শাখানদীর পাড়ে হাবিলদার গিয়াস তার দলটি নিয়ে পাকসেনাদের জন্য একটি এম্বুশ পাতে। সকাল ১০টার সময় পাকসেনাদের দুটি লঞ্চ দাউদকান্দির দিক থেকে গোমতী হয়ে এই শাখানদীতে আসে। লঞ্চগুলি এম্বুশের সামনে পড়তেই আমাদের দলটি অতর্কিতে গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। পাকসেনারা নদীর ভিতর থেকে অ্যামবুশ দলটির উপর হামলা না করতে পারায় এবং তীরে অবস্থিত এম্বুশ পার্টির তীব্র গোলাগুলিতে লঞ্চগুলির যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। উপায়ান্তর না দেখে লঞ্চগুলি পিছু হটে যায় এবং দাউদকান্দির দিকে পালিয়ে যায়। পড়ে বিভিন্ন সূত্রে আমরা খবর পেয়েছি যে অন্তত ২০/২৫ জন পাকসেনা আহত বা নিহত হয়েছে। লঞ্চগুলি অ্যামবুশের ভিতর পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া সম্বভ হয়নি, কারণ এম্বুশ পার্টির নিকট রাইফেল এবং হাল্কা মেশিনগান ছাড়া বড় অস্ত্র, যেমন রকেট কিংবা কামান ছিলোনা, তবুও এ এম্বুশের ফলাফল ছিল আমাদের বিশাল সাফল্য। ফলে পাকসেনারা এ এলাকায় চলাফেরা কমিয়ে দ্যায়। এতে আমাদের কর্তৃত্ব ও স্থানীয় লোকের মনোবল আরও বেড়ে যায়। এর পড় হোমনা ও দাউদকান্দি থানার জনসাধারণ সতস্ফুর্তভাবে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।
৪র্থ বেঙ্গলের ‘বি’কোম্পানির একটি প্লাটুন চৌদ্দগ্রাম এলাকায় পাকসেনাদের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। পাকসেনারা কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক খোলার জন্য তাদের প্রচেষ্টা দিন দিন বাড়িয়ে যাচ্ছিল। যাসব সড়ক সেতু আমরা ধ্বংস করে দিয়েছিলাম সেগুলি পুননির্মান করার চেষ্টা করছিল। ৯ই জুলাই সকাল ৮টায় আমাদের প্লাটুনটি চৌদ্দগ্রামের উতরে স্রকের উপর বালুজুরি ভাঙ্গাল্পুরের নিকট অ্যামবুশ পাতে। ১১টার সময় পাকসেনারা একটি সিআর বি ট্রাকে করে এবং দুটি জিপে রাস্তা দিয়ে আসে এবং ভাঙ্গালপুড়ের নিকট থামে। পুলটি মেরামত করার কাজের প্রস্তুতি চলতে থাকে। ঠিক সে সময়ে আমাদের এম্বুশ পার্টি তাদের উপর গোলাগুলি চালাতে থাকে। এর ফলে পাকসেনাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। অ্যামবুশ পার্টির গুলিতে তাদের অনেক হতাহত হয়। পাকসেনারা পুলের নিকট থেকে পিছু হটে অবস্থান নেয় এবং পড়ে চৌদ্দগ্রাম থেকে আরও পাকসেনা এসে তাদের সাথে যহ দ্যায়। এরপর পাকসেনারা আমাদের এম্বুশ অবস্থানের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। আমাদের দলটিও একটু পিছু হটে উঁচু জায়গায় আরও শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে। পাকসেনারা ৩টার সময় মর্টার, কামান, মেশিন গানের সহায়তায় আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ করে। আমাদের গুলিতে পাকসেনারা পর্যদুস্ত হয়ে ৩/৪ ঘণ্টা যুদ্ধের পড় বিকেল ৫টায় আক্রমণ পরিত্যাগ করে পিছু হটে যায়। যুদ্ধে পাকসেনাদের ৩০ জন নিহত ও ৬ জন আহত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রের চারিদিক মৃতদেহগুলি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ফেলে রেখে তারা পালিয়ে যায়। পাকসেনারা পিছু হটার পর আমাদের দলটি অনেক অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয় এবং শত্রুদের ক্ষতিগ্রস্ত ট্রাকটিও নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয় কিন্তু ট্রাকটির এত বেশী ক্ষতি হয়েছিল যে এটা আনা সম্ভব হয়নি এবং টট্রাকটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া হয়। পাকসেনাদের যে দুজন দালাল যুদ্ধের সময় পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল তারাও গুলিবিদ্ধ হয়। পাকসেনারা পিছু হটে যাবার পথ আমাদের দলটি তাদের ২/৩টি পেট্রল ও পর্যবেক্ষন ঘাঁটিতে অবস্থিত পাকসেনাদের তাড়িয়ে দেয়। বিকেল সাড়ে ৪টার সময় পাকসেনাদের একটি জঙ্গি বিমান যুদ্ধক্ষেত্র পর্যবেক্ষন করে এবং আমাদের দলটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের দলটি সেখান থেকে একটু দূরে সরে যাওয়াতে জঙ্গি বিমানটি কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে চলে যায়। এ সঙ্ঘর্ষের পর ১০ই জুলাই সন্ধ্যায় একটি এম্বুশ পার্টি উক্ত অবস্থানের ১ মাইল দক্ষিণে লেঃ ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে আবার এম্বুশ পাতে। আমাদের ধারনা ছিল যে, পাকসেনারা আবার উক্ত সেতুর নিকট আসবে। ১০ই জুলাই সারাদিন পাকসেনাদের জন্য তারা অপেক্ষা করে থাকে কিন্তু আমাদের ধারনা মত সেদিন না এসে ১১ই জুলাই ১১টার সময় পাকসেনাদের একটা কোম্পানি দুটি গাড়ী সহ আস্তে আস্তে ভাঙ্গা সেতুর দিকে মিয়াবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। পাকসেনারা যখন এম্বুশ অবস্থানের ভিতর পৌঁছে ঠিক সেই সময় এম্বুশ পার্টি তাদের উপর প্রচণ্ড গোলাগুলি চালাতে থাকে। এতে শত্রুদের বেশ হতাহত হয়। তারা পিছু হটে গিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং উভয়পক্ষে যুদ্ধ সারাদিন ধরে চলতে থাকে। এ যুদ্ধে পাকসেনাদের ১০/১৫ জন আহত হয়। বিকেল ৩টায় পাকসেনারা যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে আবার পিছু হটে যায়। আমাদের দলটি রাত ২টা পর্যন্ত পুনরায় আক্রমনের অপেক্ষায় থাকে। এরপর বালুজুরির ভগ্নাবশেষ সেতুটি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হলে লেঃ ইমামুজ্জামান তার দলটি নিয়ে ঘাঁটিতে চলে আসে। আসার পথে চৌদ্দগ্রাম লাকসাম রোডের উপর বাংগোডার পশ্চিমে এবং চৌদ্দগ্রামের উত্তরে আরেকটা ভাঙ্গা ব্রিজের নিকট এন্টি ট্যাঙ্ক এবং এন্টি পার্সোনাল মাইন পেতে রাখে। মাইন পাতার সময় আমাদের কমান্ডো প্লাটুনের দুজন লোক দুর্ঘটনায় সামান্য আহত হয়।
এ সময় পাকিস্তানীরা ফেনী দিয়ে চট্টগ্রাম রেল লাইন পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে। আমরা রাজনগর সাবসেক্টর থেকে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম একটি প্লাটুন ও ইঞ্জিনিয়ার এর একটি দলকে এক্সপ্লোসিভ সহ মিয়াবাজারের দক্ষিণে পাঠিয়ে দেয়। এ দলটি সরিসদি রেলওয়ে ব্রিজ সম্বন্ধে খবরাখবর নেয় এবং গোমতীর নিকট সরিসদি রেলওয়ে ব্রিজটি আক্রমণ করার জন্য বেছে নেয়। কিছু সংখ্যক স্থানীয় দালাল পাকবাহিনীর অস্ত্র দিয়ে এই ব্রিজটি পাহার দিত। ১৩ই জুলাই রাত ১১টার সময় দলটি সরিসদি ব্রিজটি আক্রমণ করে। পাহারারত সশস্ত্র দালালদের কিছু নহত এবং বাকিদের তারিয়ে দিয়ে তারা ডিমলিশন লাগিয়ে ব্রিজটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে পাকিস্তানীরা শুধু ফেনী এবং গুণবতীর মধ্যে ট্রেন মাঝে মাঝে চলাচল চালু রাখত। অবশ্য এর আগে ট্রেন চলাচল করতে পারত না। এ দলটি পাকিস্তানীদের নয়াপুর বি ও পি অবস্থানের উপর ৩ মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। এর ফলে দুজন পাকসেনা নিহত ও ৭ জন আহত হয়।
১৩ই জুলাই রাত ১০টায় পাকসেনাদের দত্তসার দীঘি এবং আমতলা অবস্থানগুলির ওপর ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে দুটি দল আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের পাকসেনাদের ১৫ জন আহত ও কিছু নহত হয়। শালদা নদীতে পাকসেনারা আবার নতুন করে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। ১১ই জুলাই পাকসেনারা আমাদের শালদা নদী অবস্থানের দিকে মারমুখী পেট্রলিং চালাতে থাকে। আমাদের সৈন্যরাও মেজর সালেকের নেতৃত্বে তাদের অবস্থানের সাহসের সঙ্গে পাকসেনাদের উপর লক্ষ রাখে। ১২ই জুলাই রাত ৮টায় পাকসেনারা প্রচণ্ডভাবে আমাদের সালদা নদী অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি মেজর সালেকের নেতৃত্বে এ আক্রমণ মোকাবিলা করে। আমাদের সৈন্যদের গুলির আঘাতে পাকসেনাদের প্রচুর হতাহত হয়। তারা পর্যদুস্ত হয়ে আক্রমণ পরিত্যাগ করে রাত ১১টায় পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। সমস্ত রাত উভয় পক্ষে গোলাগুলি চলতে থাকে। ভোর ৫টায় পাকসেনারা একটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে আবার সালদা নদীর দক্ষিণে গরঙ্গলা অবস্থানের উপর নতুনভাবে আক্রমণ শুরু করে। সেই সঙ্গে তারা আমাদের আশাবাড়ি অবস্থানেও হামলা চালায়। এই দুই আক্রমণ ও আমাদের মেশিনগানের গুলি ও মর্টারের গোলার সামনে তারা পর্যুদস্ত হয়। পাকসেনাদের অসংখ্য হতাহত হয়। দিনের আলোতে আমাদের সৈন্যরা বাঙ্কার থেকে অগ্রসরমান শত্রুদের হতাহত করে। পাকসেনারা তাদের আক্রমণ ভঙ্গ করে দিতে বাধ্য হয় এবং পিছু হটে যায়। আমাদের সৈন্যরা পলায়নপর শত্রুদের তাড়া করে। যুদ্ধের সময় আমাদের মর্টারের গোলাতে পাকসেনাদের চাপাইতে অবস্থিত একটি এম্যুনিশন এবং রেশন স্টোরে বিস্ফোরণ ঘটে, ফলে ২১ জন আহত ও কিছু সংখ্যক নিহত হয়। ঐ দিনই লেঃ হুমায়ুন কবিরের একটি দল পাকসেনাদের লাটুমুড়াতে যে অবস্থান ছিল তাঁর পিছনে অবস্থান চালায় এবং বেশ কয়েকজন আহত ও নিহত করে। পাকসেনাদের গসাইলস্থ বি ও পি র একটি টহলদার ক্যাপ্টেন গাফফারের একটি দল সন্ধ্যা ৬টায় মন্দভাগ বাজারের শত্রু অবস্থানের উপর এবং নক্তের বাজার শত্রু অবস্থানের উপর মর্টারের সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকসেনাদের ১২ জন নিহত হয় এবং বেশ কয়েকটি বাঙ্কারও ধ্বংস হয়। পাকিস্তানীরা আমাদের মন্দভাগ অবস্থানের উপর কামানের সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালায়। এতে আমাদের ১ জন নায়েক এবং ৩ জন সিপাই আহত হয়।
আমাদের স্পেশাল কমান্ডোরা জুলাই মাস্যা ৯,১০,১১ তারিখ ঢাকা শহরে তাদের কার্যকলাপ আরও তীব্র করে। গেরিলা কমান্ডার হাবিবুল আলম এবং কাজির নেতৃত্বে একটি ইম্প্রুভাইজড টাইম বোমা ফার্মগেঁটের নিকট পাঞ্জাবিদের ‘মাহরুফ রেস্টুরেন্টে’ স্থাপন করা হয়। এই রেস্টুরেন্টে পাকসেনারা এবং দালালরা সবসময় আসতো। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী বোমাটি বিস্ফোরিত হয় এবং এতে ১৬ জন পাকসেনা কয়েকজন দালাল সহ হতাহত হয়। এর মধ্যে ৮ জন মারা যায় এবং ১২ জন আহত হয়। হলিক্রস কলেজ ভবনেও কিছু ক্ষতি হয়।
৪ জনের আরেকটি গেরিলা দল ডি আই টি ভবনের নিকট প্রহরা রত ২ জন পাকসেনাকে নিহত করে। এই পার্টি এর পড় সিদ্দিক বাজারের নিকট ১টি টহলদার পাকসেনাদলকে এম্বুশ করে এবং ২/৩ জন পাকসেনা এতে নিহত হয়। মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক , স্টেট ব্যাংক, নাজ সিনেমা হল, ওয়াপদা ভবন ইত্যাদি স্থানে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এসব ঘটনার ফলে সমস্ত ঢাকায় আতংকের সৃষ্টি হয়। পাকসেনারা ব্যাতিব্যাস্ত ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। ঢাকার স্বাভাবিক অবস্থাও সম্পুর্ন নষ্ট হয়ে যায় এবং এলাকাবাসীদের মনোবল আরও বেড়ে যায়।
জুন মাসে আমি যখন পাকসেনাবাহিনীর সঙ্গে সব ফ্রন্ট যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলাম সে সময় আমি বুঝতে পারলাম যদিও আমাদের যোদ্ধাদের আঘাতে পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল এবং যতই আমাদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছিল তবুও আমাদের চেয়ে তাদের শলি অনেক বেশী ছিল। বিশেষ করে যেখানে পাকসেনারা শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে বাঙ্কারে অবস্থান নেয় সেখান থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করা আমাদের পক্ষে বিশেষ করে সব সময় সম্ভব হতনা। আমি সবসময়ে সংগঠিত গোলন্দাজ বাহিনীর অভাব আনুভব করতাম। বাংলাদেশে অবস্থিত পাকসেনাদের বেশ কয়েকটি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ছিল। এসব রেজিমেন্টে যেসব বাঙলাই নিযুক্ত ছিল ২৫শে মার্চের পড় অনেককে পাকসেনারা হত্যা ও বন্দি করে। আবার অনেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায় এবং পরে সেসব গোলন্দাজ বাহিনীর সৈন্যরা আমাদের সেক্টরে যোগ দেয়। তাদের আমি বিভিন্ন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুদ্ধে নিয়োগ করি। যুদ্ধে এসব সৈন্যরা যথেষ্ট সাহসেরও পরিচয় দিয়েছে। এসব সৈন্যদের নিয়ে আমি একটি গোলন্দাজ বাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে গোলন্দাজ বাহিনীর সব সৈন্যকে কনাবনে একত্রিত করা হয়। একটি নতুন রেজিমেন্ট গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট কষ্টের সম্মুখীন হটে হয় এবং সেই কষ্ট নতুন রেজিমেন্টটিকেও বহন করতে হয়। এদের কোন থাকার জায়গা ছিল না , খাওয়া এবং রানার কোন ব্যাবস্থাও ছিলোনা। রেজিমেন্টের জন্য বিভিন্ন রকমের প্রকৌশলী লোকের দরকার হয়, কিন্তু সব রকমের সৈন্য আমাদের ছিলোনা। তাছাড়া সবচেয়ে বড় জিনিস কামান এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি যা একটি গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য নিতান্ত প্রয়োজন ছিল। আমি পার্শবর্তী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মিলিটারি অধিনায়কদের সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং অস্ত্রের জন্য অনুরোধ জানাই। অনেক ছোটাছুটির পর তারা কয়েকটি ৩.৭ ইঞ্চি ছোট কামান আমাদের দেয়। এই কামানগুলি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার ছিল এবং সম্ভবত সেকেলে হিসাবে পরিত্যাক্ত ছিল কিন্তু তবুও এগুলি পাবার পড় আমার গোলন্দাজ বাহিনীর লোকদের মধ্যে একটি নতুন সাড়া জাগে। তারা তৎক্ষণাৎ এই কামানগুলি প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে দেয়। প্রকৌশলী লোকের অভাব থাকায় বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং গণবাহিনী থেকে লোক ভর্তি করে তাদের ট্রেনিং দেয়া হয়। এসময় ক্যাপ্টেন পান্না পাকিস্তান থেকে কোন রকমে সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তিনি গোলন্দাজ বাহিনীর লোক ছিলেন। ক্যাপ্টেন পান্না রাত দিন খেতে আমাদের এই গোলন্দাজ বাহিনীকে ট্রেনিং করিয়ে শত বাঁধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে মোটামুটি যুদ্ধের জন্য উপযোগী করে তোলেন। এভাবে বাংলাদেশের প্রথম গলন্দাজ বাহিনীর জন্ম হয়। জন্মের পর থেকে ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্ট বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে জুলাই মাস থেকে আমরা কয়েকটি সাবসেক্টরে কমান্ডার অপারেশনকে ফলপ্রসূ করে তোলে। বিশেষ করে সালদা নদী, কোনাবনে প্রথম এই রেজিমেন্ট এর সহায়তার জন্যই পাকবাহিনীর বারবার আক্রমণ ক্যাপ্টেন গাফফার এবং মেজর সালেক প্রতিহত এবং পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়। ক্যাপ্টেন পাশার নেতৃত্বে আমাদের সদ্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত গোলন্দাজ বাহিনীর সৈন্যরা অনেকসময় এমন ভাবে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে যে গোলন্দাজ বাহিনীর ইতিহাসে তা বিরল। পাকসেনাদের নিকট ছিল অত্যাধুনিক কামান, আর সেসব কামানের গোলা নিক্ষেপের ক্ষমতা ছিল বেশী। সব সময় পাকসেনাদের চেষ্টা ছিল তাদের কামানের গোলাতে আমাদের এই ছোট পুরাতন কামানগুলিকে বিনষ্ট করে দেয়া। সেজন্য দিনরাত আমাদের প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট কোন জায়গাতেই বেশিক্ষণ এক স্থানে থাকতে পারতোনা। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানীদের অর্ধেক গোলা তাদের উপর পড়ে। তাছাড়া আমাদের পুরাতন কামানগুলির গোলা ক্ষেপণের দূরত্ব ছিল পাকিস্তানীদের অর্ধেকের কম। সে কারণে অধিকাংশ সময় আমাদের প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট এর লোকেরা তাদের কামানগুলি মাথায় করে নিকটে বা পশ্চাতে দুর্গম রাস্তায় নিয়ে যেত এবং শত্রুদের উপর আক্রমণ করত। এসব আক্রমণের ফলে পাকসেনারা ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পড়ত। ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্ট এর কৌশল কতকটা কমান্ডো ধরণের। পরবর্তী পর্যায়ে প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট আমাদের মুক্তিবাহিনী যখন ডিসেম্বর মাসে ফেনী, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়, তখন কে ফোর্সের ৪র্থ বেঙ্গল, ১০ ম বেঙ্গল এবং ৯ম বেঙ্গলকে পাক বাহিনীদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সাহায্য করে। গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য হবে এটা গৌরবের দৃষ্টান্ত।
জুলাই মাসের ১২ তারিখে লেঃ হুমায়ুন কবির সি এন্ড বি রাস্তার উপর একটি প্লাটুনের পেট্রল পাঠায়। এই পেট্রোলটি শত্রুর গতিবিধি সম্বন্ধে খবরাখবর নেবার জন্য কুটি পর্যন্ত অগ্রসর হয়। দুপুর দুটার সময় এই পেট্রোল পার্টি যখন কুটির নিকট দিয়ে টহল দিচ্ছিল তখন তারা দেখতে পায় অনেক গাড়িতে কুমিল্লা থেকে পাকিস্তানীরা সৈন্য সমাবেশ করছে। কুটিতে গাড়ী থেকে নেমে ওদের একটি ব্যাটালিয়নের মত দল মন্দভাগ বাজারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের পেট্রোলটি বুঝতে পারে যে, এই পাকসেনারা নয়নপুর, মন্দভাগ বাজারের দলটি বাজারের দিকে এসে অবস্থান নেয় এবং দোকানের ভিতর বাঙ্কার তৈরি করতে থাকে। এছাড়া তাদের অবস্থানের চতুর্দিকে পাট এবং ধান কেটে পরিষ্কার করে ফেলে যাতে তাদের গুলি সামনে আমাদের অবস্থানে এসে পড়ে। এসব সংবাদ পেট্রোল হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে। সংবাদ পাবার পর আমি পাকসেনাদের ঘাঁটিগুলি শক্তিশালী হয়ে ওঠার আগেই তাদের উপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেই। ক্যাপ্টেন গাফফারকে ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানি দিয়ে ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্টের কামানগুলি মন্দভাগ বাজারের নিকট পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সন্ধ্যা হবার আগেই ছোট ছোট কয়েকটি দল পাঠিয়ে বাজারটি এবং শত্রু অবস্থানটি সম্পূর্ণ খবরাখবর নেয়। সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন গাফফার তাঁর কোম্পানি এবং ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্টের সহায়তায় মন্দভাগ বাজারের শত্রু অবস্থানের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। আমাদের কামানগুলি গোপন পথে নৌকাযোগে বাজারের পার্শবর্তী গ্রামে অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন গাফফারের আক্রমণের ঠিক পূর্ব মূহুর্তে কামাগুলি থেকে অতি নিকতবর্তী শত্রু অবস্থানের বাঙ্কারগুলি এবং বাজারের ঘরগুলিকে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করতে থাকে, ফলে অনেক বাঙ্কার এবং ঘর ধ্বংস হয়ে যায় এবং বাজারে অবস্থিত পাকসেনারা আহত ও নিহত হয়। এত নিকট থেকে অতর্কিত কামানের গোলার আক্রমণ পাকসেনারা আশা করতে পারেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকসেনাদের অন্তত ৬০/৭০ জন হতাহত হয়। পাকসেনাদের আর্তনাদ এবং চিৎকার আমাদের লোকরাও শুনতে পায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের প্রতিরোধশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে এবং তারা অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। দুঘণ্টা যুদ্ধের পর মন্দভাগ বাজার এবং অনেক অস্ত্রশস্ত্র ক্যাপ্টেন গাফফারের দখলে আসে। এর পরদিন আমাদের একটি পার্টি শালদা নদীতে এম্বুশ পাতে। পাকসেনাদের একটি স্পিডবোট দুপর ১টায় এম্বুশ পড়ে যায়। এম্বুশ পার্টির গুলিতে স্পিডবোটটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং ২০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। কেউ কেউ নদীতে পড়ে ভেসে যায়। এম্বুশ পার্টিটি পরে নিরাপদে মন্দভাগ অবস্থানে আসে। আমাদের হেডকোয়ার্টারে খবর পাই যে , দাউদকান্দিতে পাকসেনারা ফেরিঘাটের নিকটে ঘাঁটি স্থাপন করেছে। এখানে প্রায় দুকোম্পানির মত পাকসেনা বাঙ্কার নির্মান করে ঘাঁটিটি বেশ শক্তিশালী করে তোলে। এখানে পাকসেনারা ঢাকা-কুমিল্লাগামী প্রতিটি গাড়ি দাঁড় করিয়ে অনুসন্ধান চালায়। তাছাড়া নিকটবর্তী একটা স্পিডবোটে টহল দেয়। আমরা একটি প্লাটুন দাউদকান্দিতে পাঠিয়ে দেই। এদের সঙ্গে আরেকটি দল পাঠানো হয় সৈয়দনগর ওয়ারলেস স্টেশন এবং ইলিয়টগঞ্জ রাস্তার সেতু ধ্বংস করার জন্য। আমাদের দলগুলি দাউদকান্দিতে যেয়ে গৌরীপুর নামক স্থানে তাদের ঘাঁটি তৈরি করে। এরপর শত্রুদের গতিবিধি সম্বন্ধে খবর নেয়। ১৩ই জুলাই সন্ধ্যা ৮টার সময় প্লাটুনটি দাউদকান্দির উত্তরে গোমতী নদীতে পাকসেনাদের একটি টহলদারি স্পিডবোটকে এম্বুশ করে। এই এম্বুশে একজন লেফটেন্যান্ট এবং ২০ জন পাকসেনা নিহত হয়। অফিসারটির র্যাঙ্কের ব্যাজ এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসা হয়। এরপর এই দলটি পরদিন রাতে সৈয়দনগর ওয়ারলেস স্টেশন ধ্বংস করে দেয়। দলে ওপর অংশ ইলিয়টগঞ্জ নতুন সেতুটি ডেমলিশন লাগিয়ে দুটি স্প্যান উড়িয়ে দেয়। তাদের কাজ সম্পূর্ণ করে দলগুলো নিরাপদে হেডকয়ার্টারে ফেরত আসে।
কুমিল্লা-চাঁদপুর রাস্তায় হাজীগঞ্জের নিকট রামচন্দ্রপুরের ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার পর পাকসেনাদের যোগাযোগ ব্যাবস্থার বেশ অসুবিধা হয়। পাকসেনারা ঐ জায়গাতে ফেরীর বন্দোবস্ত করে। এই ফেরী যোগাযোগ বিনষ্ট করার জন্য লেঃ মাহবুব একটি কোম্পানি রামচন্দ্রপুরে পাঠায়। ৬ই জুলাই ভোরে এই দলটি রামচন্দ্রপুর ফেরিঘাটের নিকট এসে এম্বুশ পাতে। ঐ দিনই সকাল ৭টার সময় পাকসেনাদের একটি দল রামচন্দ্রপুর ফেরিঘাটে আসে। তাদের জিনিসপত্র তখন ফেরিঘাটে উঠছিল ঠিক সেই সময় এম্বুশ পার্টি তাদের উপর গুলি চালায়। এতে পাকসেনাদের ৪জন নিহত হয়। উভয়পক্ষে প্রায় ঘণ্টা খানেক গোলাগুলি চলে। গোলাগুলির সংবাদ পেয়ে চাঁদপুর থেকে পাকসেনাদের প্রায় দুই কোম্পানি সৈন্য সাহায্যের জন্য আসে। পাকসেনারা ফেরিঘাটের কিছু দূরে এসে গাড়ী থেকে নামে এবং এম্বুশ অবস্থানে অগ্রসর হবার জন্য প্রস্তুত হয়। ঠিক সেই সময়ে আমাদের অন্য এম্বুশ পার্টিটি তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকসেনারা সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাদের ৩১ জন নিহত এবং ৫৪ জন আহত হয়। আমাদের এন সি ও এবং একজন সিপাই গুরুতর আহত হয়। এরপর আমাদের দলটি এম্বুশ অবস্থান পরিত্যাগ করে। আসার পথে ৮ই জুলাই মুদ্দাফরগঞ্জ সড়কসেতুটি উড়িয়ে দিয়ে আসে। এর পর পাকসেনারা সেতুটির নিকতবর্তী কয়েকটি গ্রামে মর্টারের সাহায্যে গোলাগুলি করে। সে সময়ে পাকসেনাদের অভ্যর্থনার জন্য অনেক স্থানীয় দালাল শান্তি কমিটি সভার আয়োজক এবং মিছিল করে পাকসেনাদের অভ্যর্থনার জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই মিছিলের উপর গুলি চালিয়ে অনেককে তাদের হত্যা করে।
আমাদের চাঁদপুর কোম্পানি যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন করার কার্যকলাপ আরও বৃদ্ধি করে। স্থানীয় লোকদের সহায়তায় হাজীগঞ্জ এবং লাকসাম, চাঁদপুর ও কুমিল্লার সি এন্ড বি রাস্তা ও রেলওয়ে সড়কের ২০০ গজ কেটে ধ্বংস করে দেয়া হয়। এ সময়ে পাকিস্তানীরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ইঞ্জিনিয়ার, ইঞ্জিন ড্রাইভার এবং শ্রমিক এনে রাস্তা মেরামত করার চেষ্টা চালায়। আমাদের গেরিলারা এইসব পাকিস্তানী রেলওয়ে কর্মচারিদের মেরে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। এর ফলে রেল এবং সড়ক যোগাযোগ সম্পুর্ন বন্ধ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে ২৬শে জুলাই পাকবাহিনী একটি কোম্পানিকে চাঁদপুর থেকে এই এলাকায় পাঠায়। পাকসেনাদের এই কোম্পানিটি রেলওয়ে লাইনের সঙ্গে সঙ্গে লাকসামের দিকে অগ্রসর হয়। ঠাকুর বাজারের নিকট আমাদের একটি এম্বুশ পার্টি আগে থেকেই অবস্থান নিয়েছিল। দুপুর ২টার সময় পাকসেনাদের এই কোম্পানিটি যখন এম্বুশ অবস্থানের মাঝে আসে তখন আমাদের দলটি তাদের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে পাকসেনাদের একজন জে সি ও সহ ২২জন পাকসেনা আহত হয়। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে চাঁদপুর পলায়ন করে। এর পরদিন গেরিলারা মধু রেলওয়ে স্টেশনের নিকট রেলওয়ে এবং সড়ক সেতু ধ্বংস করে দেয় এবং যে পাকিস্তানী ইঞ্জিনিয়ার পরিদর্ষনের জন্য আসে তাকেও আহত করে।
আমাদের ঢাকার গেরিলা দল তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল। ব্রিটিশ সরকারের একটি পার্লামেন্টারি দল বাংলাদেশের সে সময়ের পরিস্থিতি সারেজমিনে জানার জন্য ঢাকায় আসে। এই দলটি ঢাকা ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থান করছিল। ২৪শে জুন সকাল সাড়ে ৭টায় হোটেলের ভিতরে লবিতে বসে বিমান বন্দরে যাবার অপেক্ষা করছিল। ঠিক সে সময়ে আমাদের ৩ জন গেরিলা হোটেলের সামনে বারান্দায় দুটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় এবং পরিষদীয় দলটিকে ঢাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করায়। এর কদিন পর আমাদের গেরিলারা জানতে পারে যে নারিন্দায় গউরিমা মন্দিরে পাকিস্তানীদের অনেক দালাল সমবেত হয়ে আলোচনার আয়োজন করছে। দালালরা যখন আলোচনায় ব্যাস্ত ঠিক সেই সময়ে আমাদের গেরিলারা আলোচনায় একটি বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে প্রায় ২০/২৫ জন পাক দালাল হতাহত হয়। ঢাকার গেরিলা দল টি এন্ড টি বিভাগের একজন পাকিস্তানী উর্ধতন কর্মচারির গাড়ীতে এম-১৪ মাইন দিয়ে বুবিট্র্যাপ লাগিয়ে রাখে। ফলে পাকিস্তানী অফিসারটি গাড়ীসুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। পাকিস্তানী অফিসাররা মাঝে মাঝে ধানমন্ডির সাংহাই চাইনিজ রেস্টুরেন্টে সান্ধ্যভোজে আসত। এই সংবাদ পাবার পর আমাদের একটি গেরিলা দল ৮ই জুলাই রাত ৯টায় পাকিস্তানী অফিসাররা সেখানে আসলে তাদের উপর গ্রেনেড ছোঁড়ে। ফলে ২/৩ জন পাকিস্তানী অফিসার নিহত হয়। পাকিস্তানী পুলিশরা এ সময়ে রাতে ট্যাক্সিতে বা জিপে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় পেট্রলিং করত। এসব টহলদার পাকিস্তানী পুলিশদের এম্বুশ করার জন্য ঢাকার গেরিলা দল একটি পরিকল্পনা নেয়। তাদের গতিবিধি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ খবরাখবর নেয়া হয়। ১০ই জুলাই একটি পাকিস্তানী টহলদার পুলিশ পার্টি ধানমণ্ডির রাস্তা নং ২ এর দিকে যাচ্ছিল। গেরিলাদের একটি পার্টি তাদের পিছি নেয়। পুলিশের পেট্রোলটি ২ নং রাস্তার মোড়ে যখন তেদের গতি কমিয়ে দেয় ঠিক সে সময়ে গেরিলারা তাদের গাড়ীতে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায়। এতে একজন অফিসার সহ ৫ জন পাকিস্তানী পুলিশ নিহত হয়। আমাদের গেরিলা দলটি নিরাপদে সে স্থানটি পরিত্যাগ করে। এর কদিন পর আমাদের আরেকটি গেরিলা দল নিউ বেইলি রোডে পাকবাহিনীর একটি জিপের ওপর এক্রমন চালায়। এই আক্রমণে ৩/৪ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং জিপটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত আমাদের গেরিলা দলটি পোস্ট অফিসের ভিতর বিস্ফোরণ ঘটায় এবং মণ্ডলপাড়া ও চৌধুরীবাড়ী ইলেকট্রিক সাবস্টেশনটি ১২ই জুলাই রাত সাড়ে ১০টার সময় ধ্বংস হয়। এছাড়া সিদ্ধির নগর ও আশুগঞ্জের সাথে একটি বৈদ্যুতিক পাইলন উড়িয়ে দেয়। সিদ্ধিরগঞ্জ এবং নরসিংদীর মাঝে দুটি বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে কাঞ্চন এবং কালীগঞ্জের বেশ কয়েকটি শিল্প কারখানা বিদ্যুতের ওভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এর কিছুদিন পর ফতুল্লা এবং ঢাকার মাঝে পাগলা রেলওয়ে সেতুটি উড়িয়ে দেয়। ফলে নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার মাঝে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এসময়ে আমার হেডকোয়ার্টারে খবর আসে যে পাক সরকার পাক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই পরীক্ষাকে বানচাল করে দেয়ার জন্য আমরাও একটা পরিকল্পনা নেই। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার হেডকোয়ার্টার থেকে ঢাকার গেরিলা দলগুলিকে নির্দেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই নির্দেশ অনুযায়ী পরীক্ষার দিন সিদ্ধেশ্বরী স্কুল এবং আরও অন্যান্য স্কুলে পরীক্ষার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটান হয়। ফলে খুব কম সংখ্যক ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দেয়ার জন্য পরীক্ষা হলে আসে। ১৫ই জুলাই রাতে এই গেরিলা দল বকশীবাজারে অবস্থিত বোর্ড অফিস আক্রমন করে। ডিমলিশন দিয়ে বোর্ড অফিসের কিছু অংশ উড়িয়ে দেয়া হয়। তর ফলে বোর্ডের বেশ কিছু দলিল এবং কাগজপত্র ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে এই পরীক্ষা প্রহসনে পরিণত হয় এবং অনেক ছাত্র ছাত্রী ইচ্ছাকৃতভাবেই পরীক্ষা বর্জন করে।
হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে আমাদের মুরাদনগরের দলটি ১৬ঈ জুলাই রাত ১টার সময় ইলিয়টগঞ্জের দেড় মাইল পশ্চিমে পুঁতিয়া গ্রামের সামনে কুমিল্লা-দাউদকান্দি সড়কের উপর কয়েকটি এন্টি ট্যাঙ্ক মাইন পুঁতে রাখে। পরদিন সকালে পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীনে একটি অয়াপদা ট্রাক মাইনের উপর বিস্ফোরিত হয়। ফলে ট্রাকটি ধ্বংস হয়ে যায়। ট্রাকে অবস্থানরত একজন পাকসেনা , দুজন রাজাকার ও ড্রাইভার সহ সবাই নিহত হয়। ফলে ৫জন পাকসেনা, ১ জন মেজর ও ৬জন রাজাকার নিহত হয়। এই সংবাদ পেয়ে কুমিল্লা থেকে পাকসেনারা ৩০টি গাড়িতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। পাকসেনাদের গাড়িগুলি ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে এসে দাড়ায়।
সামনের গাড়ী থেকে বেশ কিছু সংখ্যক পাকসেনা নেমে আস্তে আস্তে ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হয়। তারা রাস্তার পাশ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। অগ্রসর হবার সময় আমাদের পুঁতে রাখা এন্টি পার্সোনাল মাইনের বিস্ফোরণে তাদের ৬/৭ জন বিস্ফোরিত হয় এবং আরও অনেক আহত হয়। এরপর পাকসেনারা আর সম্মুখে অগ্রসর হয়নি। সমস্ত দিন পাকসেনারা মাইন ডিটেক্টরের সাহায্যে ঘটনাস্থলের চতুর্দিকে তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চালায়। সমস্ত বেসামরিক যাতায়াতও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর পাকসেনারা পার্শবর্তী গ্রাম গুলিতে মুক্তি বাহিনীর সন্ধানে তল্লাশি শুরু করে। হাবিলদার গিয়াসের দলের একজন নায়েক মস্তফা কামাল স্থানীয় লোকদের সাথে মিশে পাকসেনাদের দুরবস্থা দেখে। দাউদকান্দি থেকে পশ্চিম নারায়ণগঞ্জে এবং দাউদকান্দি সড়কের উপর বাউসিয়ায় একটি গুরুত্তপূর্ণ সেতু ছিল। এই সেতুটি সম্পূর্ন কংক্রিটের তৈরি। এবং বেশ মজবুত। এই সেতুটি ধ্বংস করার জন্য জুলাই মাসের প্রথমে আমি মোঃ রফিক নামে বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত গেরিলাকে মনোনীত করি। তার সঙ্গে আরেকটি গেরিলাকে দিয়ে এই সেতু রেকি করার জন্য পাঠাই। মোঃ রফিক সেতুটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে রেকি করে এবং একটি নকশা বানিয়ে নিয়ে আসে। এরপর অধ্যাপক মুনির চৌধুরীর ছেলে ভাষণের নেতৃত্বে ১০ জনের একটি ডিমোলিশন পার্টিকে রফিকে সঙ্গে নিয়ে বাউসিয়া সেতুটি ধ্বংস করার জন্য পাঠিয়ে দেই। এই দলটি প্রথম মুরাদনগরে গিয়ে তাদের স্থায়ী ঘাঁটি করে। এর পর তারা গোমতী নদী পাড় হয়ে বাউসিয়াতে পৌঁছে। সেখানে একদিন থাকার পর স্থানীয় গেরিলাদের সাহায্য নিয়ে ১২ই জুলাই রাতে বাউসিয়া সেতুতে ডিমলিশন লাগায়। কিন্তু ডেমলিশন বিস্ফোরণের সময় ইগ্নিশন ঠিকমত কাজ করেনা। ইত্যবসরে স্থানীয় ডালা চেয়ারম্যান এবং রাজাকার পাকবাহিনীদের খবর দেয়। পাকবাহিনী এবং রাজাকার অকস্মাৎ ভাষণের ডিমলিশন পার্টির উপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণে ভাষণের দলের ৩ জন গেরিলা গুরুতরভাবে আহত হয়। এই ৩ জনের মধ্যে একজন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক কোরাইশই ও ছিল। গেরিলা দলটি ইগ্নিশন কাজ না করার দরুন সেতু উড়িয়ে দিতে ব্যার্থ হয়ে পাকবাহিনীর আক্রমণের চাপে অবস্থান পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। যদিও আহত গেরিলাদের সঙ্গে আনতে সক্ষম হয় কিন্তু যেসব বিস্ফোরক সেতুটিতে লাগানো হয়েছিল সেগুলি উঠিয়ে আনা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এবং তারা ২৬০ পাউন্ড আই এন টি সেখানেই ফেলে রেখে হেড কোয়ার্টারে ফেরত আসে। এত বিরাট পরিমাণ আই এন টির শত্রুর হাতে পড়া ও নষ্ট হয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে একটা বিরাট ক্ষতির কারণ। ঐ সময়ে বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আমাদের খুব কম ছিল। অনেক চেষ্টার পর হয়তো কিছু কিছু আমরা যোগাড় করতে সক্ষম হতাম। ধাকা-কুমিল্লা রাস্তা বন্ধ কোরে দেয়া আমার লক্ষ ছিল। সেই লক্ষ এইভাবে ব্যার্থতায় পর্যবসিত হওয়ায় আমি যথেষ্ট চিন্তিত হয়ে পড়ি। এবং পড় পরই আবার বিস্ফোরক জোগাড়ের চিন্তায় থাকি। ২/৩ সপ্তাহ পরে অনেক কষ্টে আবার কিছু পরিমাণ আই এন টি সংগ্রহ করতে সক্ষম হই। আই এন টি জোগাড়ের পড় আমি মোঃ রফিকে ডেকে পাঠাই। শেষ পর্যন্ত আমরা বাউসিয়ার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সমর্থ হয়েছিলাম। লাটুমুরাতে লেঃ হুমায়ুনের নেতৃত্বে যে কোম্পানি অবস্থান নিয়েছিল সেই অবস্থানের উপর পাক বাহিনী তাদের চাপ অব্যাহত রাখে। লাটুমুরার অবস্থান থেকে আমাদের বিতাড়িত করার চেষ্টা করে। লেঃ হুমায়ুনের কোম্পানিটি পাক বাহিনীর প্রচণ্ড চাপের মুখেও তাদের অবস্থানটি সাহসের সঙ্গে ধরে রাখে। মুক্তিযোদ্ধারা এই অবস্থান থেকে প্রায়ই পাকসেনাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালাতে থাকে। ১৭ই জুলাই বিকেল ৪টায় আমাদের ও-পি দেখতে পায় যে লাটমুড়া থেকে একটি শত্রুদল চন্দ্রপুর শত্রুঅবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে। লেঃ হুমায়ুন কবির তৎক্ষণাৎ একটি প্লাটুন চন্দ্রপুরের রাস্তায় পাকসেনাদের এম্বুশ করার জন্য পাঠিয়ে দেয়। প্লাটুনটি চন্দ্রপুর থেকে একটু দূরে অবস্থান নিয়ে পাকসেনাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। পাকসেনারা যখনি সেই অবস্থানে পৌঁছে ঠিক তখনি তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালানো হয়। ফলে ৪জন পাকসেনা নিহত এবং আহত হয়। পাকসেনারা এম্বুশ থেকে বাঁচার জন্য লাটুমুড়ায় পলায়ন করে।
২০শে জুলাই সকাল ৯টার সময় একটি প্লাটুন পাকসেনাদের ইয়াকুবপুর , চন্দ্রপুর এবং বাগানবাড়ি অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ করার জন্য পাঠানো হয়। এই প্লাটুনটি গোপন পথে গ্রামের ভিতর দিতে পাকসেনাদের অবস্থানের অতি নিকটে যেতে সমর্থ হয়। রেকি করার পড় তারা দেখতে পায় যে, পাকসেনাদের কিছু লোক বিভিন্ন বাঙ্কারের উপর বসে চা পান করছে, এবং তাদের প্রহরার ব্যাবস্থা শিথিল। এছাড়াও আরও ৩/৪ টি দল বাঙ্কারের উপর দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের একজন ও-পি গাছের উপর বসা ছিল। আমাদের প্লাটুনটি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে তাদের বাঙ্কারগুলির উপর আক্রমণ চালায়। গোলগুলিতে যেসব পাকসেনা বাঙ্কারের উপর বসে চা পানে ব্যাস্ত ছিল এবং দাঁড়িয়েছিল তারা সঙ্গে সঙ্গে আহত ও নিহত হল। নিকতবর্তী একটি ঘর থেকে কিছু পাকসেনা বেরিয়ে আসে এবং বাঙ্কারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে তারাও আহত ও নিহত হয়। এরপর পাকসেনাদের প্রতি এক্রমন করারা আগেই আমাদের প্লাটুনটি অবস্থান ত্যাগ করে নিজেদের এলাকায় নিরাপদে ফিরে আসে। এই সঙ্ঘর্ষের ফলে ১৩ জন পাকসেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। আমাদের একজন গুরুতর ভাবে আহত হয়।
শালদা নদীতে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি এবং সি কোম্পানি তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। পাকসেনারা শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন থেকে নারায়নপুরের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করছিল। ১৭ই জুলাই তাদের একটি দল রেলওয়ে স্টেশনের প্রায় এক হাজার গজ দক্ষিণে মনোরা রেলওয়ে ব্রিজ পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ব্রিজের কাছে এসে পাকসেনাদের দলটি ব্রিজের চতুর্দিকে বাঙ্কার তৈরির প্রস্তুতি নেয়। বেলা সাড়ে ১২টার সময় এ কোম্পানির একটি প্লাটুন মর্টার সহ পাকসেনাদের এই দলটির উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের ফলে পাকসেনারা সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাদের বেশকিছু লোক আহত ও নিহত হয়। পাকসেনারা উপায়ান্তর না দেখে আবার শালদা নদীতে পিছু হটে যায়। পরদিন সকাল ৯টার সময় শালদা নদী থেকে পাকসেনারা আবার মনোরা ব্রিজের দিকে অগ্রসর হয়। সকাল ৯টায় আমাদের সৈনিকরা আবার তাদের বাঁধা দেয়। এবং পাকসেনাদের উপর মর্টার এবং কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। ফলে পাকসেনাদের ৪জন লোক নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। পাকসেনারা আর অগ্রসর না হয়ে পিছু হটে মনোরা ব্রিজের উত্তরে অবস্থা নেয়। ১৯শে জুলাই পাকসেনারা ব্রিজের দক্ষিণে আবার অবস্থান নেয় বাঙ্কার খোঁড়ার চেষ্টা করে। এবারো পাকিস্তানীরা আমাদের মর্টার , কামান এবং মেশিনগানের গোলাগুলিতে অনেক হতাহত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরে স্থানীয় লোকের কাছে জানা যায় যে, পাকসেনারা আহত ও নিহত সঙ্গীদের নৌকায় করে পিছনে নিয়ে যায়। এদের সঠিক সংখ্যা সম্বন্ধে তাৎক্ষনিকভাবে সংবাদ জানা না গেলেও পরে যানা যায় ৮ জন নিহত এবং ১৪ জন আহত হয়। ২১শে সন্ধ্যায় ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানির একটা প্লাটুন শালদা নদীর অবস্থানের ভিতর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে ৮জন পাকসেনা নিহত ও ৭ জন আহত হয়। দেড় ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের দলটি শত্রু অবস্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসে। এই আক্রমণের সাথে আমাদের ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্ট পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে বহু পাকসেনাকে হতাহত করে। জুলাই মাসে কুমিল্লায় পাকসেনারা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল এবং কিছুটা সফলও হয়েছিল। এ সময় কুমিল্লা শহরের ভিবিন্ন স্থানে পাকসেনারা তাদের ক্যাম্প গড়ে তুলেছিল। এসব ক্যাম্প থেকে তাড়া ঘন ঘন টহল চালাত। কুমিল্লায় পাকসেনাদের এই তৎপরতা খর্ব করার জন্য আমাদের গেরিলাদের ২০ জনের একটি দল একটি ৩ ইঞ্চি মর্টারসহ কুমিল্লার উত্তরে অনুপ্রবেশ করে। ২০শে জুলাই সকাল সাড়ে ১০টার সময় গেরিলাদের এই দলটি কুমিল্লা শহরে পাকসেনাদের বিভিন্ন অবস্থানের উপর মর্টারের সাহায্যে গোলা নিক্ষেপ করে। একটি গোলা আজাদ স্কুলে, একটি গোলা সাধনা ঔষধালয়ের নিকটে, একটি গোলা গোয়ালপত্রীতে, একটি গোলা কালীবাড়ির নিকটে এবং একটি গোলা এস ডি ওর অফিসের নিকটে বিস্ফোরিত হয়। গোলাগুলি বিস্ফোরণের ফলে পাকসেনাদের মনোবল ভেঙ্গে যায় এবং ভিতসন্ত্রত হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে ছোটাছুটি করতে থাকে। বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সদ্য আগত সেনারা মনোবল হারিয়ে ফেলে। অনেক পাকসেনা স্থানীয় লোকদের সেনানিবাসের রাস্তা জানতে চায়। আবার অনেকে ভয়ে ব্রিজের তলায় লুকিয়ে পরে। আবার কুমিল্লাতে যখন গেরিলারা তাদের তৎপরতা চালাচ্ছিল ঠিক সে সময়ে গেরিলাদের আর একটি দল চাঁদপুরেও তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। ১৭ই জুলাই রাত ১০টায় বাবুর হাটের পূর্বে কুমিল্লা-চাঁদপুর রাস্তায় আশিকাটি গ্রামের নিকট পাকসেনাদের একটি কনভয় যখন যাচ্ছিল তখন আমাদের গেরিলারা গাড়ীতে গ্রেনেড নিক্ষেপ করল। ফলে ৮ জন পাকসেনা নিহত ও আরও অনেকে আহত হয়। ১০শে জুলাই দুপুর ১টার সময় বাবুরহাটে পাকসেনাদের একটি গাড়ীর উপর গেরিলারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এর ফলে ৫ জন পাকসেনা নিহত ও ৭ জন আহত হয়।
১১ই জুলাই বিকেল সাড়ে ৬টায় ২ জন গেরিলা চাঁদপুর পাওয়ার স্টেশনের সামনে পাহারারত ২জন পাকসেনা ও ২ জন পাকিস্তানী পুলিশের উপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তাদের হত্যা করে।
চাঁদপুরে শান্তি কমিটির দালালদের একটি আলোচনা সভায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করার পর ৭ জন দালাল আহত হয়। এ ছাড়াও ইলিয়টগঞ্জে পাকসেনাদের স্থানীয় এক দালালের লঞ্চে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এ সমস্ত কার্যকলাপের ফলে স্থানীয় লোকদের মনোবল আরও বেড়ে যায়। তাদের মুক্তিবাহিনীর উপর আস্থা আবার ফিরে আসে।
কসবার উত্তরে কাশিমনগর রেলওয়ে সেতুর নিকট পাকিস্তানীদের ডুটি প্লাটুন অবস্থা নিয়ে সেতুটি প্রহরার কাজে নিযুক্ত ছিল। এই সেতুটিকে ধ্বংস করার জন্য আমি ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে নির্দেশ দেই। নির্দেশ পেয়ে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন সেতুটি রেকি করার জন্য ডিমলিশন এক্সপার্ট সহ একটি রেকি পাঠায়। এই রেকি পার্টি শত্রুঅবস্থান সম্বন্ধে এবং সেতুটি সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর দিয়ে আসে। এরপর ১৮ই জুলাই রাত ২টায় একটি রেইডিং প্লাটুন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে কাশিমপুর সেতুর উদ্যেশ্যে রওনা দেয়। রাত ৮টার সময় সেতুটির নিকতবর্তী পাক অবস্থানের উপর প্লাটুনটি আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে ১৭ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং যারা বেঁচে ছিল তাড়া অবস্থান ত্যাগ করে খাইরাতুল্লাতে পালিয়ে যায়। আমাদের রেইডিং পার্টি সেতুটিকে বিস্ফোরণ লাগিয়ে ধ্বংস করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের অবস্থান থেকে অনেক অস্ত্র উদ্ধার করে। আমি যখন কুমিল্লা ও নোয়াখালী এলাকায় যুদ্ধে ব্যাস্ত ছিলাম, সে সময় শত্রুদের খবরাখবর নেবার জন্য একটি ৬ ইন্টিলিজেন্স নেট স্থাপন করি। এদের দায়িত্ব ছিল শত্রুদের সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর আমাদের নিকট প্রেরণ করে। বিশেষ করে এইসব ইন্টিলিজেন্স এ এমন কতগুলো লোক কাজ করত যাদের সম্বন্ধে কিছু কোথা বলার দরকার। যেমন লাটু মিয়া। সে কুমিল্লা সেনানিবাস হাসপাতালে মালীর কাজ করত। সে আমাদের খবর পাঠায় সেনানিবাসে পাকসেনাদের ডুটি ব্রিগেড আছে এবং সেখানে একটি ডিপ হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ৫০০-৬০০ রাজাকার এবং রেঞ্জার মোতায়েন করা হয়েছে। সে আরও খবর পাঠায় কুমিল্লা সেনানিবাসের প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা খুবই উত্তম এবং মজবুত করা হয়েছে এবং এই প্রতিরক্ষাবুহ্য বাইরে উত্তরে গোরা কবরস্থান পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে।
কুমিল্লা বিমানবন্দরেও একটি ব্যাটালিয়ন শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করা হয়েছে।
কুমিল্লা এবং নোয়াখালী এলাকায় পাকসেনাদের শক্তি এক ডিভিশনেরও বেশী। কিন্তু পাকসেনাদের এত শক্তি থাকা সত্ত্বেও তাদের মনোবল বেশ কমে গেছে। সাধারণ সিপাইরা এই যুদ্ধের নইরাশ্যজনক ফলাফল সম্বন্ধে মন্তব্য করত। তাদেরকে জোর করে যুদ্ধে ব্যাবহার করা হচ্ছে। সে জন্য তাড়া যথেষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করত। তাদের মধ্যে পলায়নপর মনোভাব খুবই প্রবল। তাড়া যুদ্ধ এলাকা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে ইচ্ছুক। আমাদেরকে আরও খবর পাঠায় যে, পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা খুবই বেশী। শুধু সেনানিবাস হাসপাতালেই প্রায় ৫০০-৬০০ জন আহত সৈনিক চিকিৎসাধীন আছে। হাসপাতালে স্থানের অভাবে তাঁবুর ভিতরে অনেক আহত সৈনিককে রাখা হয়েছে এবং গুরুতর আহত সৈনিকদের পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আহতের সংখ্যা এত বেশী হওয়ার জন্য সাধারণ মনোবল ভেঙ্গে পড়েছিল। কুমিল্লা শহরে আমাদের এবং পাকিস্তানীদের তৎপরতার ফলে লোকজন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক শহরবাসী পরিচয়পত্র ছাড়া শহরে বেড় হটে পারছেনা। কুমিল্লার উত্তরে পাকসেনারা আমাদের কোটেশ্বর অবস্থান পুনর্দখলের জন্য চেষ্টা চালায়। ২৪শে জুলাই পাকসেনাদের একটি কোম্পানিগঞ্জ পার হয়ে কোটেশ্বরের দিকে অগ্রসর হটে থাকে। সকাল ১০টায় পাকসেনাদের কোম্পানিটি যখন আমাদের অগ্রসর অবস্থানের সামনে পৌঁছে যায়, তখন আমাদের মুক্তিবাহিনী সৈনিকরা তাদের উপর মর্টার এবং হাল্কা মেশিনগানের সাহায্যে তাদের অগ্রসরে বাঁধা দেয়। আমাদের গোলাগুলিতে পাকসেনারা প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবুও পাকসেনারা তাদের আক্রমণের চাপ অব্যাহত রাখে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাও সাহসের সাথে তাদের আক্রমণ পরিত্যাগ করে ২ ঘণ্টা পরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই সঙ্ঘর্ষের ফলে পাকসেনাদের ১৫জন হতাহত হয়। পাকসেনারা সমস্ত দিন আমাদের অবস্থানের উপর কামানের গোলা নিক্ষেপ করে।
ঐ দিনই কোটেশ্বর এবং কসবা অবস্থান থেকে দুই দল গেরিলা বুড়িচং থানার নিকট একটি সড়কসেতু, তিনটি বিদ্যুৎ পাইলন এবং কসবা এবং কসবার নিকট একটি রেলসেতু উড়িয়ে দেয়া হয়। বেলুনিয়াতে আমাদের সৈন্যরা যখন পাকিস্তানীদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে লিপ্ত এবং পাকিস্তানীরা ফেনীর দিক থেকে বেলুনিয়া ব্রিজে প্রবেশ করার চেষ্টা করছিল ঠিক সেই সময়ে পাকসেনারাও আমাদের পেছনে ধ্বংসাত্মক চেষ্টা চালায়। তারা কিছু সংখ্যক দালালকে এই কাজে নিয়োগ করে। এইসব দালালকে মাইনসহ আমাদের অবস্থানের পিছনে পাঠায়। দালালরা আমাদের লাইনের পিছনে রাস্তায় ৬টা এন্টিপার্সোনাল এবং ৯টা এন্টিট্যাঙ্ক মাইন লাগায়। কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণের সতর্কতার জন্যই এন্টিট্যাঙ্ক মাইনগুলিতে আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি। মাইন পোঁতার খবরটি একজন স্থানীয় লোক আমাদের বেলুনিয়া হেডকোয়ার্টারে পাঠায়। খবর পাওয়ামাত্র হেডকোয়ার্টার থেকে আমাদের ডিমলিশন বিশেষজ্ঞ দল গাইডের সঙ্গে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তৎক্ষণাৎ মাইনগুলি নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আমরা স্থানীয় লোকদের পাকিস্তানী ধ্বংসাত্মক তৎপরতা সম্বন্ধে সজাগ থাকতে বলি। এরপর যখনি পাকিস্তানী দালালরা এরকম ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য আমাদের অবস্থানের পিছনে আসার চেষ্টা করেছে স্থানীয় জনগণ তাদের প্রচেষ্টাকে ব্যার্থ করে দিয়েছে। জুলাই মাসের শেষের দিকে লেঃ মাহবুব মিয়াবাজার, চাঁদপুর, হাজীগঞ্জ ইত্যাদি এলাকাতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তৎপরতা জোরদার করে। পাকসেনারা মিয়াবাজারে যে ক্যাম্প করেছিল সেখান থেকে কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রাস্তা আবার খোলার চেষ্টা করে। লেঃ মাহবুব মিয়াবাজার শত্রুক্যাম্পটি রেইড করার জন্য পাঠিয়ে দেয়। এই দলটি সন্ধ্যায় মিয়াবাজারের নিকট পৌঁছে যায়। সেখান থেকে তাদের একটি ছোট রেকি দল পাকসেনাদের অবস্থান সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর সংগ্রহ করে। রাত ১২টায় কমান্ডো দলটি গোপন পথে অগ্রসর হয়ে শত্রু অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই অতর্কিত হামলার জন্য পাকিস্তানীরা মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা। তারা দিগ্বিদিকজ্ঞ্যানশুন্য হয়ে যায়। আমাদের কমান্ডো দলটি এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে পাকসেনাদের বেশ কয়েকটি বাঙ্কার গ্রেনেড ছুড়ে উড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা আক্রান্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে এবং আমাদের সৈনিকদের গুলিতে প্রায় ২০ জন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। এক ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর আমাদের কমান্ডো দলটি পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষতিসাধন করে। শত্রুসেনাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে চলে আসে। চাঁদপুরে পাকিস্তানীরা তাদের ঘাঁটি আরও শক্তিশালী করে তোলে। চাঁদপুরের এই ঘাঁটি থেকে তারা জায়গায় গাড়ীতে পেট্রলিং করত। এইসব পেট্রলিং এর জন্য ২-৩ টি ৩ টনের ট্রাক কনভয় এর আকারে ব্যাবহার করত। এইসব পেট্রলিং ভোরে, দুপুরে, সন্ধ্যায় এবং রাত ১২টার পর পাকসেনারা চালাত। এবং প্রত্যেক গাড়ির ব্যাবধান ৫০ থেকে ১০০ গজের মধ্যে। এই সংবাদ স্থানীয় গেরিলারা লেঃ মাহবুবের কাছে পৌঁছে দেয়। খবর পেয়ে লেঃ মাহবুব দুটি প্লাটুন ২০শে জুলাই চাঁদপুরের পূর্বে পাঠিয়ে দেয়। প্লাটুন দুটি চাঁদপুর থানার আশিকাটির নিকট এম্বুশ পাতে। পরদিন ভোর ৫টায় চাঁদপুর থেকে একটি পেট্রোল কনভয় আশিকাটির দিকে অগ্রসর হয়। কনভয়টি যখন এম্বুশ অবস্থানের মাঝে পৌঁছে যায় ঠিক তখনি আমাদের অ্যামবুশ পার্টি মেশিনগান এবং হাল্কা মেশিনগানের সাহায্যে গুলি চালায়। এর ফলে কনভয় এর প্রথম তিনটি জিপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রাস্তা থেকে পড়ে যায় এবং অবশিষ্ট গাড়ীগুলিরও যথেষ্ট ক্ষতিসাধন হয়। পাকসেনারা গাড়ি থেকে নেমে পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের এম্বুশ পার্টির গুলিতে তাদের অন্তত ১০ জন নিহত এবং ২৫ জন আহত হয়। পাকসেনারা গুলির মুখে টিকতে না পেরে পালিয়ে যায়। ঐ দিন আশিকাটির ৩ মাইল পশ্চিমে সন্ধ্যায় আমাদের আর একটি এম্বুশ পার্টি পাকসেনাদের আর একটি কনভয়কে অ্যামবুশ করে। ফলে পাকসেনাদের ৩ জন নিহত এবং ৫ জন আহত ও একটি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমাদের এম্বুশ পার্টির হস্তগত হয়। এছাড়া একটি মটর সাইকেলও দখলে নেয়। এম্বুশের খবর পেয়ে পাকসেনারা তাদের হাজীগঞ্জ ক্যাম্প থেকে আমটি শক্তিশালী কোম্পানি আমাদের এম্বুশ পার্টিকে আক্রমণ করার জন্য পাঠিয়ে দেয়। এই কোম্পানিটি ১ ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে আসে। ততক্ষণে আমাদের এম্বুশ পার্টি সংঘর্ষ শেষে মোটামুটি প্রস্তুত হয়েই অপেক্ষা করছিল। পাকসেনারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এম্বুশ পার্টি আবার তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এর ফলে পাকসেনাদের ১২ জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়। এরপর আমাদের দলটি অবস্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল হাজীগঞ্জের নিকট নরসিংপুরে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। এই ঘাঁটি থেকে পাকসেনারা ঐ এলাকার চতুর্দিকে ত্রাসের সৃষ্টি করে। এই ঘাঁটিকে আক্রমণ করার জন্য লেঃ মাহবুব নিয়মিত ও গণবাহিনীর একটি সম্মিলিত কোম্পানি পাঠিয়ে দেয়। এই কোম্পানিটি ১৭ই জুলাই তারিখ হাজীগঞ্জের দক্ষিণে তাদের অস্থায়ী গোপন অবস্থান তৈরি করে। এরপর পেট্রোল পাঠিয়ে পাকসেনাদের অবস্থান সম্বন্ধে তথ্য যোগাড় করে। ১৭ই জুলাই সন্ধ্যায় আমাদের কোম্পানিটি অতর্কিত পাকসেনাদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ করে। আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ১৩জন নিহত ও অনেক আহত হয়। এরপর আমাদের কোম্পানিটি অতর্কিত পাকসেনাদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ করে। আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ১৩ জন নিহত ও অনেক আহত হয়। এরপর আমাদের কোম্পানিটি নিরাপদে নিজ অবস্থানে ফিরে আসে।
ফরিদপুরে আমাদের গেরিলা দল তাদের কার্যকলাপ জুন মাস্যা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন বেসামরিক সাধন শাসন ব্যাবস্থা কে সম্পুর্ন অচল করে দেয়। এই প্ররিপ্রেক্ষিতে ১২জিন গেরিলারা চিকা নিদই এবং মুন্সেফ অফিস ধ্বংস করে সমস্ত অফিসিয়াল কাগজপত্র জ্বালিয়ে দেয়। ১৮ই জুলাই একটি দল গসাইরহাট থার দামুদিয়া পুলিশ ফাঁড়ির উপর আক্রমণ চালিয়ে ফাঁড়ি ধ্বংস করে দেয়। ফাঁড়ি থেকে ৫টি রাইফেল, প্রচুর গুলি এবং একটি ওয়ারলেস সেট দখল করে নেয়। গেরিলা দল দামুদিয়া তহশিল অফিস ও সার্কেল অফিস জ্বালিয়ে দেয়। এই ঘটনার দুদিন পর আরও একটি গেরিলা দল দামুদিয়া তহশিল অফিস ও সার্কেল অফিস জ্বালিয়ে দেয়। এই ঘটনার দুদিন পর আরও একটি গেরিলা দল ভেদরগঞ্জ থানা আক্রমণ করে দুজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশকে আহত করে এবং একটি ওয়ারলেস সেট হস্তগত করে। সঙ্গে সঙ্গে তহশিল অফিস ও পালং থানার আঙ্গালিয়া বাজারে জুট গোডাউন আগুন লাগিয়ে ২৫ হাজার মণ পাট জালিয়ে দেয়া হয়। গেরিলারা আঙ্গালিয়া তহশিল অফিসও জ্বালিয়ে দেয়। এসব কার্যকলাপের ফলে মাদারীপুরের শাসনব্যাবস্থা অচল হয়ে যায়।
শালদা নদীতে এবং মন্দভাগে ক্যাপ্টেন গাফফার এবং মেজর সালেক পাকবাহিনীকে বার বার আঘাত করতে থাকে। আমাদের রেকি পার্টি খবর নিয়ে আসে যে, ২৪ শে জুলাই বিকেল ৩টার সময় পাকসেনারা নওগাঁও স্কুলে স্থানীয় দালালদের নিয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এই সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন গাফফার একটি প্লাটুন মর্টার সহ নওগাঁর নিকট পাঠিয়ে দেয়। বিকেল ৫টায় পাকসেনাদের ৫০-৬০ জন লোক ও স্থানীয় দালালরা স্কুল প্রাণগণে সমবেত হয়ে তাদের আলোচনা সভা শুরু করে। সভা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমাদের প্লাটুনটি মর্তারের সাহায্যে পাকসেনাদের এই সমাবেশের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ফলে আলোচনা সভা বেঙে যায় এবং পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পাকসেনাদের ৩০জন লোক ৭ জন দালালসহ নিহত হয়। আমাদের প্লাটুনটি নিরাপদে ফিরে আসে। পাকসেনারা শালদা নদীর দক্ষিণে মনোরা ভাঙ্গা রেলওয়ে সেতুটি মেরামত করার জন্য আবার চেষ্টা চালায়। ২৬শে জুলাই সকাল ১০টায় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল তাদের শালদা নদী অবস্থান থেকে মনোরা সেতুর নিকট সমবেত হয়। এরপর সেতুর চতুর্দিকে তারা বাঙ্কার তৈরির প্রস্তুতি নেয়। সংবাদ পেয়ে মেজর সালেক মর্টারসহ একটি প্লাটুন পাকসেনাদের মনোরা সেতু থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে পাঠিয়ে দেয়। বিকেল ৪টায় আমদের দলটি আগরতলার নিকট অবস্থান নেয় এবং পাকসেনাদের উপর মর্টার এবং মেশিনগানের সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আমাদের গোলাগুলিতে পাকসেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে এবং তাদের অনেক হতাহত হয়। মনোরা সেতু থেকে তারা পালিয়ে যায়। পরে বিশ্বস্ত সূত্রে আমরা জানতে পারলাম যে পাকসেনাদের কমপক্ষে ৪ জন নিহত এবং অনেক আহত হয়।
২৬শে জুলাই ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন একটা এম্বুশ পার্টি নওগাঁ এবং আক্সিনার মাঝামাঝি রাস্তায় এম্বুশ পাতে। পাকসেনাদের একটি দল নওগাঁর পথে সেই এম্বুশে পরে যায়। ফলে ৭ জন পাকসেনা নিহত ও ৪ জন আহত হয়। আমাদের একজন গুরুতরভাবে আহত হয়। প্লাটুনটি ফেরার পথে কল্যাণসাগরে আবার একটি এম্বুশ পেতে বসে থাকে। পাকসেনাদের একটি কোম্পানি সাইদাবাদ থেকে কসবার পথে সেই এম্বুশে পড়ে যায়। ফলে ২১ জন পাকসেনা ও ১ জন দালাল নিহত হয় এবং ৯ জন আহত হয়। পাক পেট্রোল পার্টির একটি ট্রাক ও ধ্বংস হয়। ঐ দিন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের একটি কমান্ডো দল বগাবাড়িতে একটি রেলওয়ে ব্রিজ ও ২-৩ টি টেলিফোন পাইলন উড়িয়ে দেয়। আমরা যেসব গেরিলাদের ঢাকা এবং কুমিল্লার পশ্চিম ও ভৈরব বাজার এলাকায় পাঠাতাম, তারা কসবার উত্তর দিকে ছাতুরা ও নবীনগর হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় কার্যকলাপ সম্বন্ধে খবরাখবর নেয়ার জন্য পাকসেনারা দালালদের নিযুক্ত করে এবং আমাদের অনুপ্রবেশের রাস্তাকে বন্ধ করার জন্য রাজাকারদের রাস্তায় এবং নদীপথে পাহারায় মোতায়েন করে। এই সব দালাল এবং রাজাকাররা আমার অপারেশনের জন্য অসুবিধার সৃষ্টি করে। দালালদের ধরার জন্য এবং রাজাকারদের সমুচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন ও লেঃ হারুন কে আমি নির্দেশ দেই। নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন এবং লেঃ হারুন বিভিন্ন স্থানে তাদের লোকজনকে দালালদের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয় এবং এম্বুশ পেতে রাখে। ২৫শে জুলাই সন্ধ্যায় নরসিংহের নিকট লেঃ হারুনের লোক পাকসেনাদের ৬ জন দালালকে এম্বুশ করে বন্দি করে। এদের নিকট ১৪ পাউন্ড বিস্ফোরক, ৩টি গ্রেনেড পাওয়া যায়। এর পরদিন আরও ৭ জন দালাল আমাদের এম্বুশে ধরা পরে এবং তাদের কাছ থেকে দুটি রাইফেল, ৪টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১টি ওয়ারলেস সেট এবং ১২০ রাউন্ড গুলি পাওয়া যায়। এর পর থেকে আমাদের এলাকাতে আর সাহস পায়নি। বন্দি দালালদের কাছ থেকে যানা যায় যে তাদেরকে পাকিস্তানী অফিসাররা প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং সঙ্গে করে এনে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের নিকট ছেড়ে দেয়। তাদের উপর নির্দেশ ছিল মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অন্যথায় তাদের পরিবার বর্গের উপর কঠোর ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরপর রাজাকারদের শায়েস্তা করার জন্য ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন একটি কোম্পানি পাঠিয়ে দেয়। এই কমান্ডো কোম্পানিটি ছাতুরার নিকট রাজাকার ক্যাম্পের উপর ২৫শে জুলাই অতর্কিতে হামলা চালায়। হামলার ফলে ১৬ জন রাজাকার নিহত এবং ৫ জন আহত হয়। ঐ এলাকার রাজাকাররা ভিত হয়ে সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। তারা পরদিন তাদের নেতাকে আমাদের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয় এবং মুক্তিবাহিনীর সাথে সহায়তা করার অঙ্গীকার দেয়। এছাড়া অনেক রাজাকার মুক্তিবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এর পর থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই এলাকার রাজাকারদের সক্রিয় সহায়তা মুক্তিবাহিনী সব সময় পেয়েছে। অনেক সময় রাজাকাররাই আমাদের গেরিলাদেরকে নিরাপদ রাস্তায় তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছে। সি এন্ড বি রাস্তায় যে সেতুর নিচ দিয়ে আমাদের গেরিলারা নৌকায় যাতায়াত করত রাজাকাররা সেই সেতুর উপর পাকসেনাদের গতিবিধি সম্পর্কে সংকেত দিত। কোন সময় যদি পাকসেনারা ঐ জায়গায় টহলে আসতো তবে আগে থেকে হারিকেনের লাল আলো বা টর্চের সাহায্যে সংকেত দিয়ে আমাদের জানাত। আর ফলে এই রাস্তাটি আমাদের জন্য সম্পুর্ণ নিরাপদ হয়ে যায়।
মেজর সালেক একটি ডিমলিশন পার্টি ও একটি কমান্ডো প্লাটুনকে ২৮শে জুলাই রাত ২টার সময় হরিমঙ্গলে পাঠিয়ে দেয়। এই দলটি হরিমঙ্গলের নিকটে রেলওয়ে সেতুটির রেকি করে এবং সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ডিমলিশন বানিয়ে সেতুটিকে উড়িয়ে দেয়। বিস্ফোরণের ফলে সেতুটির মাঝখানে ৪০ ফুটের একটি গ্যাপ সৃষ্টি হয়। এছাড়া সেতুটি দখন পাশে ২৭০ ফুট রেলওয়ে লাইন বারুদ লাগিয়ে নষ্ট করে দেয়া হয়। এর পরদিন এই ডিমলিশন পার্টি বিজন্মা রেলওয়ে সেতুটি বারুদ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। ২৮শে জুলাই সকাল ৮তায় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল বিজন্মা ব্রিজের নিকট পরিদর্শনে আসে। ঠিক সেই সময় আমাদের কামান তাদের উপর গোলাগুলি করে। ফলে পাকসেনাদের ৩ জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়। পাকসেনারা সেই অবস্থান পরিত্যাগ করে কায়েক গ্রামের দিকে পলায়ন করে। এরপর পহেলা আগস্ট পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী কোম্পানি হরিমঙ্গল সেতুর নিকট অগ্রসর হয় এবং সেখানে তাদের ঘাঁটি গড়ার চেষ্টা করে। এবারো আমাদের সৈন্যরা তাদের অগ্রসরে বাঁধা দেয়। আমাদের সৈন্যদের গোলাগুলিতে পাকসেনাদের ৩০ জন হতাহত হয়। ফলে পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
কসবার টি আলির বাড়িতে পাকসেনাদের যে অবস্থান ছিল, সে অবস্থা থেকে পাকসেনারা চাল পর্যন্ত প্রায়ই যাতায়াত করত। এই সংবাদ লাটুমুরার নিকট লেঃ হুমায়ুন কবির সংগ্রহ করে। সে আরও জানতে পারে যে কাচা রাস্তায় পাকসেনাদের কমপক্ষে একটি কোম্পানি যাতায়াত করে। পাকসেনাদের এই দলকে আক্রমণ করার জন্য লেঃ কবির একটি প্লাটুন পাঠিয়ে দেয়। এই প্লাটুনটি এই প্লাটুনটি কল্যাণসাগরের নিকট ২৩শে জুলাই ভোর সোয়া ৪টায় এম্বুশ পড়ে যায়। আমাদের যোদ্ধাদের অতর্কিত গুলির আঘাতে পাকসেনাদের ২০জন নিহত ও ৮ জন আহত হয়। ১ জন স্থানীয় দালাল, যে পাকসেনাদের পথনির্দেশক ছিল, সেও মারা যায়। ২-৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পড় পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং আমাদের লোকেরা অবস্থান তুলে নিজ ঘাঁটিতে ফেরত আসে।
কসবার উত্তরে পাকসেনাদের গোসাই স্থানে একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটিতে অন্তত ৪০-৫০ জন পাকসেনা অবস্থান করছিল। আমাদের যেসব গেরিলা ঢাকার পথে যাতায়াত করত, এই অবস্থান থাকাতে তাদের যাতায়াতের গোপন পথে বিপজ্জনক হয়ে যায়। এই ঘাঁটিটি ধ্বংস করে দিয়ে যাতায়াতের গোপন পথে নিরাপদ করার জন্য আইনউদ্দিন ৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানিকে পাঠায়। ডি কোম্পানি ৩১শে জুলাই রাত ১০টার সময় দক্ষিণ থেকে অগ্রসর হয়ে গোসাই স্থান অবস্থানের নিকট পৌঁছে। এই অবস্থানটি রেকি পূর্বেই করা ছিল। পাকসেনাদের অবস্থানটির দক্ষিণ হতে ডি কোম্পানি অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে পাকসেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যায়। আক্রমণ ২-৩ ঘণ্টা চলে। ডি কোম্পানির সৈন্যরা বেশ কয়েকটি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেয় এবং অন্তত ২০ জন পাকসেনাকে হতাহত করে। আক্রমণের প্রবল চাপে টিকতে না পেরে পাকসেনারা গোসাই স্থান পরিত্যাগ করে পিছনে পলায়ন করে।
শালদা নদীতে আমাদের সঙ্গে পাকসেনাদের সঙ্ঘর্ষ পুরো জুলাই মাস চলতে থাকে। ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে শালদা নদীর শত্রু অবস্থানটির উত্তর দিকে ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানি মোটামুটি ঘিরে ফেলেছিল। এদিকে দক্ষিণ দিকে আগরতলা ও কাঁটামোড়ায় মেজর সালেক ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি দিয়ে পাকসেনাদের শালদা নদী অবস্থানের উপর চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। পাকসেনাদের পিছন থেকে সরবরাহের রাস্তা একমাত্র নদী ছাড়া সবই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিলো। নদীপথেই লুকিয়ে মাঝে মাঝে পাকসেনাদের অবস্থানে রসদপত্র সরবরাহ করা হত। এই সরবরাহ পথে পাকসেনাদের এম্বুশ পেতে বসে থাকে। রাত ১টার সময় ৭-৮ টি নৌকায় প্রায় ১৫০ জন সৈন্য ও অন্যন্য সরবরাহ সহ পাকসেনারা তাদের শালদা নদী অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। নৌকাগুলি যখন এম্বুশ অবস্থানের ভিতরে আসে আমাদের প্লাটুনটি মেশিনগানের সাহায্যে গুলি চালাতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে নৌকা ডুবে যায়। পাকসেনারাও পিছন হতে পাল্টা গোলাগুলি শুরু করে। সঙ্ঘর্ষ প্রায় অর্ধঘণ্টা স্থায়ী থাকে। এরপর পাকসেনাদের পিছনের নৌকাগুলি ফেরত চলে যায়। এই সঙ্ঘর্ষে পাকসেনাদের প্রায় ৬০-৭০ জন হতাহত হয় , ৪-৫ টি নৌকা ডুবে যায় এবং অনেক রসদ নষ্ট হয়। নৌকার আরোহী পাকসেনারা ডুবে যায়। পাকসেনাদের গুলিতে আমাদের ৪ জন নিহত ও একজন আহত হয়।
কুমিল্লার উত্তরে কালামছড়ি চা বাগানের নিকট পাকসেনাদের একটি ঘাঁটি ছিল। এখানে মাসাধিককাল ধরে পাকসেনা ও মুক্তি বাহিনীর মধ্যে সঙ্ঘর্ষ চলে আসছিল। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে অতিস্ট হয়ে পাকসেনারা কালামছড়ি চা বাগানে বাঙ্কার তৈরি করে। ২রা আগস্ট রাত ১২টার সময় লেঃ হারুনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র দল শত্রুঅবস্থানের উপর হামলা চালায়। পাকসেনাদের এক কোম্পানি সৈন্য কামান এবং মর্টারের সহায়তায় শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছিল। ২রা আগস্ট মুক্তিবাহিনীর অমর সাহসী ক্ষুদ্র দলটি হ্যান্ড গ্রেনেড ও ৩০৩ রাইফেলের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শত্রুদের ১০টি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেয়। পাকসেনারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ৫০ জন নিহত সঙ্গীকে ফেলে পিছনে গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। সেখানেও গ্রামের লোক দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অনেক পাকসেনা নিহত হয়। দুজন পাকসেনা আমাদের হাটে বন্দি হয়। এম জি আই এ ও মেশিনগান সহ অনেক অস্ত্রশস্ত্র এবং ২০-২৫ হাজার গুলি আমাদের হস্তগত হয়। এছাড়া অনেক খাদ্যসামগ্রী ও কাপড় আমাদের হস্তগত হয়। আমাদের পক্ষে দুজন মুক্তিসেনা নিহত হয়। জুলাই মাসে নোয়াখালীতে অপারেশনের জন্য ১৪ জন গণবাহিনীর গেরিলা গোপন পথে চৌদ্দগ্রামে আলোকরা বাজার হয়ে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছিল। রাত ১টার সময় বাজারের নিকটে শত্রুদের একটি দল অতর্কিতে গেরিলাদের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের গেরিলারা সাহসের সঙ্গে আক্রমণের মোকাবিলা করে, কিন্তু শত্রুদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। সঙ্ঘর্ষে আমাদের একজন গেরিলা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। এবং বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে তারা পালিয়ে আসে। হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে যে দলটি হোমনা থানায় অবস্থান করছিল সেই দলটি ২৮শে জুলাই রাতে হোমনা থানার সাঘুটিয়া (হোমনা, বাঞ্ছারামপুর, রামচন্দ্রপুরের সঙ্গমস্থল) লঞ্চঘাটে পাকবাহিনীর টহলদার একটি লঞ্চের উপর এম্বুশ ফাঁদে আটকা পড়ে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সুবেদার গিয়াসের দল আকস্মিকভাবে শত্রুদের উপর হামলা চালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রায় ২০-২৫ মিনিট পর্যন্ত পাকসেনারা কোন জবাব দেয়না। দুর্ভাগ্যবশত রকেট লাঞ্চার কাজ না করায় সুবেদার গিয়াসের দল লঞ্চটাকে ডুবাতে সক্ষম হয়নি। ১ ঘণ্টা ধরে উভয় পক্ষে প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলে। পাকসেনারা বিক্ষিপ্তভাবে মর্টারের গোলা ছুড়তে থাকে। সুবেদার গিয়াসের দলের এতে কোন ক্ষতি হয়নি। ১ঘন্টা সঙ্ঘর্ষের পর পাকসেনাদের লঞ্চটি পালিয়ে যায়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পিছে ধাওয়া করে। পাকসেনাদের হতাহতের সংবাদ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা না গেলেও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ ক্ষতবিক্ষত লঞ্চটি দেড় ঘণ্টা হোমনা থানার ঘাটে নোঙ্গর করে থাকে। সেখানে বেশ কিছু আহতকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয় এবং অবশেষ অনেক মৃতদেহ সহ লঞ্চটি ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে। জুলাই মাসে পাকসেনারা চট্টগ্রাম-কুমিল্লা রোড খুলতে চেষ্টা করে। এই সময় মাঝে মাঝে পাকসেনাদের শক্তিশালী দল এই রাস্তায় টহল দেয়ার জন্য আসত। চৌদ্দগ্রামের উত্তরে ও দক্ষিণে ইমামুজ্জামান এইসব পাকসেনাদের টহলদারি দলগুলোকে তাড়িয়ে দিত।
৩০ শে জুলাই সকাল ৭টায় ইমামুজ্জামানের একটা প্লাটুন চৌদ্দগ্রামের ৪ মাইল দক্ষিণে নানকরা নামক স্থানে এম্বুশ পাতে। এম্বুশ পার্টি সারাদিন অপেক্ষা করার পড় জানতে পারে যে জগন্নাথ দীঘির নিকট একটি জিপ টহলে বেরবার জন্য তৈরি হচ্ছে। এই জিপকে এম্বুশ করার জন্য অ্যামবুশ পার্টি তখনি তৈরি হয়ে যায়। সন্ধ্যাসাড়ে ৬টার সময় পাকবাহিনীর এই জীপটি চৌদ্দগ্রামের ডিকে অগ্রসর হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশ অবস্থানে পৌঁছে। পৌছার সঙ্গে সঙ্গে অ্যামবুশ পার্টি জিপটির উপর মেশিনগান এবং হাল্কা মেশিনগান থেকে গুলি চালায়। গুলিতে ড্রাইভার আহত হয়। ৬ জন পাকসেনা জিপ থেকে লাফিয়ে নিচে নামে, কিন্তু তারাও আমাদের এম্বুশ পার্টি গুলিতে নিহত হয়। পরে এম্বুশ পার্টি একটি মৃত পাক সেনার পকেটে একটি চিঠি পায়। তা থেকে জানা যায় এই পাকসেনারা ২৯ তম বেলুচ রেজিমেন্টের সি কোম্পানির লোক। নিহত পাকসেনাদের নিকট হতে রাইফেল এবং যথেষ্ট গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। একজন আহত পাকসেনা আমাদের হাটে বন্দি হয়। এই অ্যামবুশের পর পাকসেনারা কুমিল্লা থেকে আরও সৈন্য চৌদ্দগ্রামে নিয়ে আসে এবং সারারাত ধরে আমাদের অবস্থানের উপর মর্টার এবং কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। আমাদের লোকেরাও শত্রু অবস্থানের উপর মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করে। পরদিন ৩১শে জুলাই সকালে পাকিস্তানীদের একটি কোম্পানি চৌদ্দগ্রাম থেকে ও আর একটি কোম্পানি জগন্নাথ দীঘি থেকে ট্রাঙ্ক রোড হয়ে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকসেনারা যখন আমাদের অবস্থানের ২০০ গজের মধ্যে পৌঁছে তখনি আমাদের এম্বুশ অবস্থান থেকে তাদের উপর অতর্কিত গুলি চালানো হয়। গুলির আঘাতে ২০ জন পাকসেনা রাস্তার উত্তরে এবং ৬ জন দক্ষিণে আহত ও নিহত হয়। পাকসেনারা কামানের গোলার সহায়তায় পিছনে সরে যেতে থাকে। এই সময়েও আমাদের গুলির আঘাতে আরও কিছু সৈন্য হতাহত হয়। এরপর আমাদের এম্বুশ পার্টি সেই অবস্থান পরিত্যাগ করে হরিশ্বরদার হাটের নিকট নতুন অবস্থান নেয়। এর দুদিন পড় দোসরা আগস্ট সকাল ৭তায় পাকসেনাদের একটি ব্যাটালিয়ন উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম হতে হরিশ্বরদার হাটের দিকে অগ্রসর হয়। এই সময়ে আমাদের অবস্থানে লেঃ ইমামুজ্জামান আরও দুটি প্লাটুন পাঠিয়ে অবস্থানটি শক্তিশালী করে। পাকসেনারা হরিশ্বরদার হাটের নিকট অবস্থিত ৩টি ভাঙ্গা সে পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং সেখানে পিছন থেকে গোলাগুলি চালায়। আমাদের কোম্পানিটিও সাহসের সঙ্গে পাকসেনাদের আক্রমণকে প্রতহত করতে থাকে। সমস্ত দিনের যুদ্ধে পাকসেনাদের ২৫ জন হতাহত হয়। পাকসেনারা দোসরা আগস্ট রাতে প্রধান সড়কের উপর তাদের প্রতিরক্ষাবুহ্য তৈরি করে। এর পরদিন তাড়া ৩রা আগস্ট সমস্ত দিন ধরে পাকসেনাদের সাথে সঙ্ঘর্ষ চলে। ঐ দিন সন্ধ্যায় আমাদের কোম্পানিটি অবস্থা পরিত্যাগ করে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল নয়ানপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় সুদৃঢ় ঘাঁটি করে অবস্থান করছিল। অনেক সময় এই অবস্থানের সঙ্গে অতীতে আমাদের যথেষ্ট সঙ্ঘর্ষ হয়। পাকসেনারা এই ঘাঁটিতে আরও বাড়িয়ে শালদা নদীর অবস্থান পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করছিল। মেজর সালেক পাকসেনাদের নয়ানপুর ঘাঁটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ঘাঁটিতে পাকসেনাদের অন্তত এক কোম্পানির বেশী সৈন্য ছিল। পাকসেনারা স্টেশন ও নিকটবর্তী রেলওয়ে গুদাম এলাকায় তাদের সুদৃঢ় বাঙ্কার তৈরি করে। মেজর সালেক ভদের এই অবস্থানটি সম্বন্ধে বিস্তারিত খবরাখবর সংগ্রহ করে। এর পড় ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি এবং কিছু সংখ্যক গণবাহিনী নিয়ে রাত সাড়ে ১২টার সময় পাকসেনাদের অবস্থানের নিকট জমায়েত হতে থাকে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাত আড়াইটার সময় স্টেশনের ২০০ গজ উত্তরে রেললাইন পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে দখল করে নিতে সক্ষম হয়। এই সময়ে পাকসেনাদের গোলাগুলি ভীষণ তীব্র হতে শুরু করে এবং আমাদের সেনাদের আক্রমণ কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। মেজর সালেক অন্য প্লাটুন অর্থাৎ যারা স্টেশনের দিকে ছিল তাদের আক্রমণ আরও তীব্র করার নির্দেশ দেয়। এই প্লাটুনটি পাকসেনাদের প্রবল গুলিবৃষ্টির মধ্যে রেললাইনের পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে অগ্রসর হতে থাকে। এত প্লাটুনের লোকেরা রেলস্টেশনের ২৫ গজের মধ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। এবং পাকসেনাদের প্রায় ৬-৭টি বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়। এই সময়ে স্টেশনের নিকটস্থ গুদাম এলাকা থেকে আমাদের লোকদের উপর তীব্র আক্রমণ শুরু হয়। অতর্কিত এই আক্রমণে আমাদের অনেক লোক হতাহত হয়। অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। মেজর সালেকের পক্ষে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হয় না। নিরুপায় হয়ে মেজর সালেক তার আহত ও নিহত সৈনিকদের নিয়ে পশ্চাতে হতে আস্তে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে আমাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ কোম্পানির ৭ জন নিহত ও ৯ জন আহত হয়। এই যুদ্ধে সৈনিকদের মনোবল কিছুটা করে যায়। পাকসেনার তাদের অবস্থান অক্ষত রাখতে সক্ষম হয়। আমার সেক্টরে এটাই ছিল প্রথম এবং সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয় যাতে এতজন এক সাথে নিহত ও আহত হল।
ঢাকা এবং ঢাকার চারপাশে গেরিলারা তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল। ২৫শে জুলাই সকাল ৬টা পূবাইলের নিকট কালসজা স্থানে রেলওয়ে লাইনের ওপর বৈদ্যুতিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একটি ট্রেন উড়িয়ে দেয়া হয়। ইঞ্জিন্সহ তিনটি রেলওয়ে বগি লাইনচ্যুত হয় এবং ইঞ্জিনে আগুন লেগে বিধ্বস্ত হয়। ট্রেনের আরোহী ৩০-৩৫ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ সেই সাথে নিহত হয়। বগিগুলি লাইনচ্যুত হয়ে পানিতে পড়ে যায়। গেরিলাদের আরেকটি দল ৪ঠা আগস্ট আড়াইহাজার থানার নিকট পাঞ্চকাপি সড়কসেতু এবং দরগাও সড়কসেতু উড়িয়ে দেয়। এর ফলে নরসিংদী – ডেমরার মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এদিকে ২৭শে জুলাই ৪ জনের একটি গেরিলা দল মতিঝিলের (পীরজঙ্গি মজার) নিকট বিদ্যুৎ সরবরাহ সাবস্টেশনের উপর আক্রমণ চালায়। পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এই সাবস্টেশনটিকে পাহার দিচ্ছিল। গেরিলারা দুজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশকে নিহত এবং বাকিদের নিরস্ত্র করে। তাড়া তালা ভেঙ্গে সাবস্টেশনে প্রবেশ করে ও সাব স্টেশনটি এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে ধ্বংস করে দেয়। ফলে মতিঝিল, কমলাপুর স্টেশন, শাহজাহানপুর , গোপীবাগে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। গেরিলা দলটি এরপর ফেরার পথে শাহজাহানপুরে রাজাকারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়; কিন্তু সাহসের সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ৮-১০ জন রাজাকারকে নিহত করে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। জুলাই মাসে শেষ সপ্তাহে আরে একটি গেরিলাদল সিদ্ধিরগঞ্জ এবং খিলগাঁও ও কমলাপুরের মাঝে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের পাইলন উড়িয়ে দেয়। ফলে টঙ্গি, কালীগঞ্জ প্রভৃতি শিল্প এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ১৫ ই জুলাই পাগলা এলাকার গেরিলা দল ফতুল্লা এবং ঢাকার মাঝে একটি রেলওয়ে সেতু এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে ঢাকা- নারায়ণগঞ্জ রেল যোগাযোগ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ফার্মগেটের নিকট পাকিস্তানীদের একটি চেকপোস্ট আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কয়েকদিন গাড়িতে রেকি করার পড় তারা দেখতে পায় যে, পাহারারত মিলিটারি পুলিশ সব সময় মোটেই সতর্ক থাকে না। একদিন সন্ধ্যায় আলম, কাজি, গাজি এবং স্বপন নামের চার জন ঢাকার গেরিলা একটি গাড়ীতে ফার্মগেটে আসে। মিলিটারি চেক পোস্টের নিকটে পৌছার সময় তাদেরকে পাকসেনারা আস্তে নির্দেশ দেয়। তারা তাদের গাড়ীটি নির্দেশ অনুযায়ী দ্বিতীয় রাজধানীর দিকে মুখ করে রাস্তার পাশে দাড় করায়। চারজন পাকসেনা গাড়ীর দিকে চল্লাশির জন্য অগ্রসর হয়। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ী থেকে গেরিলারা তিনটি চায়নিজ স্টেনগান থেকে গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনাদের অন্যান্য লোকও গাড়ীর দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। গেরিলা দল তাদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়ে এবং তীব্র গতিতে গাড়ী চালিয়ে অবস্থান ত্যাগ করে। এ সঙ্ঘর্ষের ফলে পাকসেনাদের ৫ জন মিলিটারি পুলিশ আহত ও ৪ জন নিহত হয়। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ফার্মগেট এবং কাওরান বাজার এলাকায় আতংকের সৃষ্টি হয়। ২রা আগস্ট ঢাকার গেরিলাদের আরেকটি দল ‘গ্যানিস’ এবং ‘ভোগ’ নামক দুটি বড় দোকানে গ্রেনেড ছুড়ে দোকান দুটির ক্ষতিসাধন করে।
লেঃ ইমামুজ্জামানের রেকি পার্টি সংবাদ নিয়ে আসে যে, পাকসেনাদের দুটি জিপকে রেশন এবং গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য বালিয়াজুরি ভাঙ্গা ব্রিজের নিকট শত্রু অবস্থানের নিকট যেতে দেখা গেছে। লেঃ ইমামিজ্জামান তৎক্ষণাৎ একটি প্লাটুন জিপ দুটিকে এম্বুশ করার জন্য হরিসর্দার বালিয়াজুরি ব্রিজের নিকট পাঠিয়ে দেয়। লেঃ ইমামুজ্জামান প্লাটুনটি সঙ্গে সঙ্গে অবস্থান নিয়ে জিপের উপর রাইফেলের সাহায্যে গুলি চালাতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনাদের দুজন নিহত হয়। একটি জিপ মৃত সঙ্গীদের নিয়ে দ্রুত ঘুরে পালিয়ে যায়। অন্য জিপটির উপর প্লাটুনটি গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনাদের রাস্তার পশ্চিম পাশে অবস্থান নিয়ে আমাদের প্লাটুনটির উপর গুলি চালাতে থাকে। তাদের গুলি ফুরিয়ে এলে তারা গাড়ি থেকে গুলি নেবার চেষ্টা করে – কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যার্থ হয়। এ আক্রমণে তাদের ৬ জন মারা যায়। পরে পাকসেনারা আমাদের এম্বুশ অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গোলা ছুড়তে থাকে। বাধ্য হিতে আমাদের প্লাটুনটি অবস্থান পরিত্যাগ করে। শত্রুদের গাড়িটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এরপর পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল দুপুর দেড়টার দিকে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং আরও কয়েকজন আহত হয়। পাকসেনারা বাধ্য হয়ে তাদের আক্রমণ পরিত্যাগ করে ফেরত চলে যায়।
মেজর সালেক ১০ই আগস্ট একটি প্লাটুন নিয়ে শালদা নদীর পশ্চিমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কুমিল্লা সি এন্ড বি রাস্তার নিকট শিলদাই গ্রামে তার গোপন ঘাঁটি স্থাপন করে। পরদিন স্থানীয় লোকের নিকট খবর পায় যে সি এন্ড বি রাস্তার উপর দিয়ে প্রতিদিন কুমিল্লা থেকে উজানিরশার পাক অবস্থানে ৩-৪ টি জিপ যাতায়াত করে। এই সংবাদ পেয়ে মেজর সালেক পাকসেনাদের জন্য সিএন্ড বি রাস্তায় একটা এম্বুশ পাতে। সমস্ত দিন ও রাত অপেক্ষা করার পরেও পাকসেনারা সেদিন আর আসেনি। বোঝা গেল যে হয়তো বা তাদের কোন ডালা বা রাজাকার আগে থেকেই এম্বুশ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিল। অনেক অপেক্ষা করার পর রাস্তায় মাইন লাগিয়ে মেজর সালেকের দলটি তার ঘাঁটিতে রওনা হয়। পথে রসুল্গ্রামের নিকট একটি রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। আ