সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার চিত্তরঞ্জন দত্ত

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭। ৪ নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধের বিবরণ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র মে-ডিসেম্বর’ ১৯৭১

<১০, , ২৩৫২৪৪>

সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার চিত্তরঞ্জন দত্ত*

মে ১৯৭১ সন।ভারতীয় বিভিন্ন এলাকায় খোলা হল নানা ট্রেনিং ক্যাম্প।পুরো সিলেট সেক্টরের ভার আমার উপর দেয়া হল।মোট দুটি সাব-সেক্টর খোলা হল।আমার সৈন্যদের মনোবল ভাঙ্গল না।বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে তারা কাজ করতে আরম্ভ করল।সিলেটের সব থানা থেকে লোক ভর্তি করা শুরু হলো এবং প্রশিক্ষনের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলে।বি ডি আর, আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশকে নিয়ে গড়ে উঠল ‘সেক্টর ট্রুপস’ আর স্কুল কলেজের ছাত্রদের নিয়ে গড়ে উঠল ‘গণবাহিনী’।সিলেটে মোট ৬টি সাব-সেক্টর ছিল।

১।জামালপুর সাব-সেক্টরঃ গণবাহিনীর মাহমুদূর রব সাদী এই সাব-সেক্টর কমান্ড করতো।অল্পবয়স্ক সুন্দর ছেলেটি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য যে স্পৃহা নিয়ে কাজ করত,তা দেখলে সত্যি আশ্চর্য লাগত।যেখানেই তাকে পাঠানো হয়েছিল,প্রত্যেকটি অপারেশনে সে কৃতকার্য হয়েছে। এই সাব-সেক্টর থেকে অপারেশন চালানো হয়েছে আটগ্রাম,জাকীগঞ্জ,লুবাছড়া ও কানাইঘাটি এলাকায়।নভেম্বরের শেষের দিকে সাদীকে সিলেটের ভিতরে নবীগঞ্জ এলাকায় প্রায় ৫০জন বিশ্বস্ত গণবাহিনী ছেলে দিয়ে নবীগঞ্জ এলাকা মুক্ত করতে পাঠানো হয়েছিল।

২।বারোপুঞ্জী সাব-সেক্টরঃএটা কমান্ড করত ক্যাপ্টেন রব।সাপ্লাই কোরের অফিসার হয়ে পদাতিক সৈন্য পরিচালনায় সে অশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে এবং সাব-সেক্টর লাটু,বিয়ানিবাজার,শারোপার,বারোগ্রাম,জাকীগঞ্জ,আটগ্রাম,কানাইঘাট,চিকনাগুল এলাকায় অসীম সাহসের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে।

৩।আমলসিদ সাব-সেক্টরঃবাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেঃজহীর এই সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিল।এই তরুণ অফিসারটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে খুবই সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে।কানাইঘাট অপারেশনে তার দক্ষতার প্রশংসা না করে পারা যায়না, ডিসেম্বর এর প্রথম সপ্তাহে এই সাব-সেক্টরটি ‘জেড ফোর্সের প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করেছে।

৪।কুকিতল সাব-সেক্টরঃএটার কমান্ডার ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যন্ট কাদের। বিমানবাহিনীর অফিসার হয়ে এত সুষ্ঠভাবে পদাতিক বাহিনী পরিচালনা করায় তাকে প্রশংসা না করে পারা যায়না। মাঝে মাঝে সে প্রায়ই বলত, স্যার আমাকে একটা জঙ্গিবিমান এনে দেন,আমি পাকিস্তানীদের খতম করব।আপনাদের যুদ্ধ খুব মন্থর গতিতে চলছে,আমি চাই তাড়াতাড়ি পাকিস্তানীদের শেষ করে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে।আমি তাকে স্বান্তনা দিতাম ‘স্লো এন্ড স্টীডি ইউনস দি রেস’ । এই সাব-সেক্টর দিলখুশ চাবাগান,কুলাউড়া, জুবী চা বাগান এলাকায় অপারেশন চালিয়ে শত্রুকে নাস্তানাবুদ করেছে।পরে এই সাব-সেক্টরে ক্যাপ্টেন শরিফুল হক যোগ দিয়েছিল।এই নির্ভীক যুবক পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ করে।এর কৃতিত্বের কথা পরে আসবে।

৫।কৈলাশশহর সাব-সেক্টরঃলেঃ ওয়াকিউজ্জামান এই সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিল।নয় মৌজায় বাংলাদেশ পতাকা উত্তোলন ও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এত বড় এলাকাকে মুক্ত রাখার জন্যএই তরুণ অফিসারকে প্রশংসা না করে পারা যায় না।এই সাব-সেক্টর ডিসেম্বরের দিকে ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত করে সিলেটের দিকে গিয়েছিল।এবং ভারত যখন যুদ্ধ ঘোষনা করল তখন এই সাব-সেক্টর ভারতের ৫৯ ভারতীয় ব্রিগেডের সঙ্গে সিলেটে প্রবেশ করেছিল।

৬।কমলাপুর সাব-সেক্টরঃএটার কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন এনাম।এই তরুণ অফিসার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়।এবং এই সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার হয়ে অনেক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। ধলাই চা বাগান এবং পার্শ্ববর্তী চা বাগানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য এই সাব-সেক্টরকে কৃতিত্ব দেয়া যায়।ভারত যুদ্ধ ঘোষণার পর এই সাব-সেক্টর ৮১ ভারতীয় ব্রিগেডের সঙ্গে মিলিত হয়ে মৌলভীবাজারে প্রবেশ করেছিল।

লোহারবন্দ নামে এক জায়গায় সমস্ত ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেয়া হত।রিলিফ ক্যাম্প,শরনার্থী শিবির এবং নানা জায়গা থেকে স্কুল কলেজের ছেলেদের এবং বাংলাদেশের কর্মক্ষম নাগরিকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হত।প্রশিক্ষণ দেবার পর ছেলেদের পাঠিয়ে দেয়া হত বিভিন্ন সাব-সেক্টরে।এই কাজের জন্য সিলেটের ফরিদ গাজী,নুরুল ইসলাম,আজিজ,তোয়াবুর রহীম, ডক্টর আলী,হাবিব রহমান, ডক্টর মালেক,লতিফ প্রমুখ লোকের নাম না করলে তাঁদের প্রতি অবিচার করা হবে।রাত দিন কাজ করে নানা জায়গা থেকে লোক সংগ্রহ করে তাঁরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিতেন। আমার সৈন্যদের সাব-সেক্টর খাওয়া -দাওয়া এবং থাকার ব্যবস্থা করতেন,তার জন্য আমি তাঁদেরকে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।

সেক্টর ট্রুপস এর কাজ শত্রুদের ধ্বংস করা,এ্যামবুশ করা এবং গণবাহিনীর কাজ ছিল পুল ধ্বংস করা, বিদ্যুৎ সরবরাহ বিপর্যস্ত করা,মাইন পোঁতা ও ছোটখাটো শত্রুঘাঁটি ধ্বংস করা।বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক থেকে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল যত চা বাগান আমার এলাকায় আছে তাদের অকেজো করে দেয়া।কাজ পুরোদমে চলতে লাগল। এদিকে একদিন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, বিধু দাশগুপ্ত আমার কাছে এসে বলল যে,শিলং দিয়ে সুনামগঞ্জ এলাকায় অপারেশন করা উচিত। আমি তাদেরকে সব সাহায্য দিলাম।পরে এই দুই নির্ভীক যুবক তাদের নিজ নিজ এলাকার ভিতর ঢুকে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিপুল ক্ষতি সাধন করেছে। সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের দিরাই অপারেশন এবং বিধু দাশগুপ্তের মাঘালকান্দী এবং আজমিরীগঞ্জ অপারেশন এলাকার সকলেরই সুবিদিত।এরা সত্যই প্রশংসার যোগ্য।

মে-জুন সেক্টর ট্রুপস এবং গণবাহিনী তাদের নিজ নিজ কাজ পুরোদমে চালিয়ে যেত থাকে।শেওলা, সাদা খাল,বারইগ্রাম রবং কাংলী ফেরীর উপর এরা আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানীদের বিপর্যস্ত করতে লাগল।অনেক দালালকে মেরে ফেলা হল।ছোট ছোট দলে সেক্টর ট্রুপস ও বাহিনীকে পাঠানো হত ফেরীগুলোকে নষ্ট করতে।এক একটা নৌকাকে নষ্ট করতে বেশ সময় এবং পরিশ্রমের দরকার। এখন মনে পড়ে নায়েব কুতুবের কথা।আজ সে আমাদের মাঝে নেই। সাদা খাল ফেরী নষ্ট করতে হবে।সংগে আরো দুজন সিপাহী ও দুজন ছাত্র।সাদা খাল তখন পানিতে ভর্তি। বেশ স্রোত কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছিল এখানে ওখানে,খেয়া ছিল নদীর ওপারে, যেদিকে শত্রু ছিল।সবাই ওরা নদীতে নেমেছে খেয়াগুলিকে নষ্ট করতে। নদীর মাঝখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃস্টিরমত গুলি আসতে শুরু করল।নায়েক কুতুব ডুব দিয়ে প্রায় নৌকার কাছে চলে এসেছিল, সামনে ছিল কচুরিপানা। ওগুলো মাথায় দিয়ে স্রোতের দিকে ভেসে গেল।দুদিন পর এসে আমার পায়ে প্রণাম করে বলল, বড় বেঁচে গেছি স্যার।আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।চোখ দিয়ে আনন্দে জল গড়িয়ে পড়ল।কেবল বললাম,বেঁচে থাক ‘জয় বাংলা, চারজন ফিরে এসে যখন অবস্থার বর্ণনা দিয়েছিল তখন ভেবেছিলাম ওকে বোধ হয় আর ফিরে পাব না।যাই হোক ওকে আমার কাছে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

পুরো জুন-জুলাই আমাদের কাজ অব্যহত থাকে।হিট এন্ড রান কায়দায় শত্রুদের বিপর্যস্ত করাই আমাদের মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল।শত্রুদের ঘাঁটি লাটু, বড়লেখা, ফুলতলা, আটগ্রামের উপর হানা দিলাম। চা-বাগানগুলো অকেজো করতে আরম্ভ করলাম।রাজকী, ফুলতলা, শেওলা, পৃথিমপাশা,সমনভাগ,সোনারুপা,হাসনাবাদ,চূড়ামণি, গাহেরা,সাগরনাল চা বাগানগুলো অকেজো করা হল।বিস্ফোরক দ্রব্য বেশী ছিল না।তবুও তাই দিয়ে চা বাগানের বড় বড় মেশিনের যন্ত্রপাতি অকেজো করা হল।

জুনের প্রথম সপ্তাহে লাঠিটিলা চা বাগানের উপর মস্তবড় হামলা চালানো হল।জানতে পারলাম লাঠিটিলাতে শত্রুদের এক প্লাটুন সৈন্য পরিখা খনন করে আছে।

এই আক্রমণে আমাকে ভারতীয় গোলান্দাজ এবং মেশিনগানের সাহায্য নিতে হয়েছিল। শত্রুদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল আমাদের কাছে যে সেন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র ছিল তা দিয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করা সম্ভব ছিল না বলে আমাকে ভারতীয়দদের সাহায্য নিতে হয়েছিল। এই আক্রমণ ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে হয়েছিল। খুব ভোরে চারটা থেকে ভারতীয় গোলান্দাজ বাহিনী গোলাগুলি শুরু করলো এবং মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করল।আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সৈন্যরা শত্রুর দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করল।বেলা প্রায় ১১টার সময় শত্রুরা আমাদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটে যায়।আমার সৈন্যরা তার উপর হামলা করে,অনেক গোলাবারুদ এবং অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল। দুটো পাকিস্তানি সৈনিক আহত অবস্থায় ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল। একদিন পর আরেকজন পাঞ্জাবী ল্যান্স নায়েককে পাতনি চা বাগানে পাওয়া গিয়েছিল।

এই যুদ্ধে নায়েক শফিকউদ্দিন আহমেদকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। নায়েক শফিকই হাতাহাতি যুদ্ধে নিজের জীবন বিপন্ন করে গ্রেনেড ছুড়ে আহত সিপাহীটিকে ধরে আনতে সক্ষম হয়েছিল। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘হীট এন্ড রান কৌশল অব্যাহত থাকে।বেশীরভাগ চা- বাগানগুলো অকেজো করে দেয়া হল।এবং স্থির হলো যে গণবাহিনীর ছেলেদের সিলেটের ভেতরে ঢুকানো হবে। এদেরকে বলা হল,সিলেটের ভিতরে গিয়ে ডাকঘর,পুলিশ স্টেশন, বাণিজ্য কেন্দ্রে ইত্যাদিতে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত করতে হবে।এদিকে ক্যাপ্টেন শরিফুল হক জুলাই মাসের মাঝামাঝি দিলখুশ ও জুবিতে অনেক অপারেশন করলো এবং খবর পাওয়া গেল দিলখুশ চা বাগানে পাকিস্তানীরা পরিখা খনন করেছে এবং আমাদের জুবী যাবার রাস্তা বন্ধ করে দেবার চেষ্টা করছে।ক্যাপ্টেন শরিফুল হককে বলা হল দিলখুশে পাকিস্তানী ঘাঁটি ধ্বংস করতে।এই ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য আমাকে ভারতীয় গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্য নিতে হয়েছিল।ক্যাপ্টেন হক একজন আর্টিলারি অফিসার।টার্গেট নির্দেশ করার প্রশিক্ষণ তার ছিল,দিলখুশ আক্রমণের জন্য কি কি কাজ করতে হবে তা সৈন্যদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হল।দিলখুশ থেকে প্রায় এক মাইল দূরের একটা উঁচু লম্বা গাছ থেকে পুরো দিলখুশ এলাকাটা দেখা যায়।আক্রমণ শুরু হল।ক্যাপ্টেন হক গাছে চড়ে অয়ারলেসের সাহায্য টার্গেট সঠিকভাবে নির্দেশ করতে আরম্ভ করলেন।আমাদের গোলাগুলি পাকিস্তানীদের উপর পড়তে লাগল।তারা দৌড়াদৌড়ি আরম্ভ করল,বুঝা গেল তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে।যুদ্ধ যখন শেষ অবস্থায় এসে পৌঁছল তখন শত্রুদের একটা ৩”মর্টরের গুলি এসে হক যে গাছে ছিল তার নিচে এসে পড়ল এবং হক আহত হয়ে পড়ে গেল।আমাদের পক্ষের গোলাগুলি এরপর থেকে ঠিক লক্ষ্য স্থানে পড়ছিল না-এমনি আমাদের উপরেই পড়তে আরম্ভ করল।আমাদের সৈন্যরা তখন পিছু হটতে বাধ্য হল।হককে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হল।যদিও এ আক্রমণ সফল হয়নি,তবুও পাকিস্তানীদের মনোবল অনেক ভেঙ্গে গিয়েছিল এবং বেশকিছু হতাহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এই এ্যাকশন এর পর পাকিস্তানীরা দিলখুশে আর তাদের ঘাঁটি বানায়নি।এই যুদ্ধের জন্য ক্যাপ্টেন হককে বীর উত্তম উপাধির সুপারিশ করা হয়েছিল।আগষ্ট মাসে লুবাছড়া,কাড়াবালা,মুখাটিলা,আমলসিদ,ন মৌজা আমাদের মুক্ত এলাকা বলে ঘোষিত হল।পাকিস্তানীরা এই মুক্ত এলাকা দখল করার জন্য বার বার আক্রমণ চালিয়েছে কিন্তু সফল হতে পারেনি।

খবর পাওয়া গেল লাটুতে শত্রুসৈন্য (প্রায় এক কোম্পানি) পরিখা খনন করেছে এবং বড়লেখা পর্যন্ত তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।লাটু এমন একটি জায়গা যেটা দখল করা আমাদের পক্ষে খুবই দরকার ছিল।কারণ লাটু দখল করলে শত্রুদের কুলাউড়া -শ্রীহট্ট রাস্তায় চলাচলে অনেক অসুবিধা হবে।মেজর রবের অধীনে প্রায় ৩০০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে লাটু দখলের পরিকল্পনা নিলাম।আমার পরিকল্পনা ছিল লাটু রেলওয়ে ষ্টেশনে কিছুসংখ্যক সৈন্য দিয়ে আক্রমণ চালানো আর বাকি সৈন্য দ্বারা লাটুর বাঁয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে লাটুর উপর পুরোপুরি আক্রমণ চালিয়ে দখল করা।লাটু-বড়লেখা রাস্তায় মাইন পুঁতে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল,যাতে পাকসেনারা বড়লেখা থেকে অগ্রসর হতে না পারে এবং বাধাপ্রাপ্ত হয়।আমাদের কাছে কোন অয়ারলেস সাজসরঞ্জাম ছিল না।তাই একদলের সাথে অন্যদের যোগাযোগ ছিল না।আগষ্টের শেষের দিকে ভোর চারটায় আক্রমণ শুরু হল।বেলা সাড়ে এগারটায় লাটু -বড়লেখা রাস্তায় মাইন পোঁতার জন্য যাদেরকে পাঠানো হয়েছিল টার সাড়ে এগারটায় ফিরে আসে।দুইজন গুরুত্বরভাবে আহত হয়েছিল মাইন পোঁতার সময়।তাদের সবাইকে মেজর রবের কাছে পাঠিয়ে দিলাম।পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চলতে থাকে।বেলা প্রায় দুটোর সময় দেখা গেল যে পাকসেনারা বাংকার ছেড়ে পেছনে চলে যাচ্ছে,পরক্ষণেই আরম্ভ হল শত্রুসৈন্যর লাটুর উপর গোলাগুলি নিক্ষেপ।বোঝা গেল বড়লেখা থেকে শত্রুসৈন্য লাটুতে এসে যোগ দিয়েছে।শত্রুদের কাছ থেকে ৩ ইঞ্চি এমজির গোলাগুলি আসতে লাগল।বেলা প্রায় সাড়ে পাঁচটা।শত্রুদের প্রচন্ড আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছনে চলে আসতে শুরু করে।মনটা খারাপ হয়ে গেল।এই যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিল।

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আবার আক্রমণ চালানো হল।সারোপার এবং লাটু এই দুটো জায়গা আবার দখল করার প্রচেষ্টা চালানো হয়।তুমুল যুদ্ধের পর সারোপার আমাদের হস্তগত হয়।সারোপার দখলে একটা সুবিধা হল যে শত্রুসৈন্যর এখন কুলাউড়া থেকে সিলেটে সরাসরি আসা বন্ধ হয়ে গেল।পুরো সেপ্টেম্বর মাসটা লাটু,বড়লেখা এমনি ফেঞ্চুগঞ্জ পর্যন্ত আমাদের আক্রমণ চলতে লাগল।ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সাদী তার সৈন্যদের নিয়ে চা বাগানে আক্রমণ চালায় এবং দুদিন তুমুল যুদ্ধের পর পুরো লুবাছড়া -কাড়াবালা আমাদের হস্তগত হয়।লুবাছড়া মুক্ত হবার পর পাকিস্তানীরা বারবার চেষ্টা চালিয়েছে লুবাছড়া দখল করার জন্য।কিন্তু লুবাছড়া পুনরায় দখল করতে তারা সমর্থ হয়নি।লুবাছড়া স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত মুক্ত ছিল।আমাদের আক্রমণের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী লুবাছড়া থেকে নির্ধারিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে খাজা নিজাম উদ্দীনসহ নিম্নলিখিত মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হয়েছিল এবং তাদের বীরত্বের জন্য লুবাছড়া আমাদের হস্তগত হয়েছিল।তাদেরকে এওয়ার্ড দেয়ার জন্য আমি সি-এন-সি’র কাছে অনুরোধ করেছিলাম।

নিহতরা হলোঃ১।খাজা নিজামুদ্দীন বীরশ্রেষ্ঠ। ২।রফিক উদ্দিন বীরোত্তম।৩।মোহাম্মদ বশির আহম্মদ বীরপ্রতীক, ৪।মোহাম্মদ মইজুল ইসলাম বীরপ্রতীক, ৫।মোহাম্মদ শাহাবউদ্দীন বীরশ্রেষ্ঠ, ৬।মোহাম্মদ হোসেন,৭।আতিকুল ইসলাম বীরপ্রতীক,৮।আশরাফুল হক বীরোত্তম, ৯।মাহমুদূর রব বীরোত্তম।

নয়টা গ্রাম নিয়ে গঠিত একটি মৌজা -নাম ন’মৌজা।এটি ভারতের কৈলাশশহের বিপরীতে অবস্থিত ছিল।লেঃ ওয়াকিউজ্জামানের নেতৃত্বে ন’মৌজায় পাকিস্তানী ঘাঁটির উপর আঘাত হানা হল এবং ন’মৌজাকে শত্রুমুক্ত করা হল।এমনিভাবে লুবাছড়া,কাড়াবালা,মোকামটিলা,আমলসিদ,ন’মৌজা আমাদের দখলে আসে।এবং পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানীদের উপর আঘাত হানা হল এই সমস্ত ঘাঁটি হতে।

অক্টোবরের মাঝামাঝি মেজর জিয়া (বর্তমানে মেজর জেনারেল) ১ম এবং ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে আমার সেক্টরে যোগ দেন।তাতে আমার শক্তি অনেক বেড়ে যায়।১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে এবং ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর আমিনের নেতৃত্বে (বর্তমানে দুইজনই লেফটেন্যন্ট কর্ণেল) সিলেটের চা বাগানগুলোর উপর আক্রমণ চালানো হয়।পরিকল্পনা ছিল চা বাগানগুলো শত্রুমুক্ত করে আমরা সবাই মিলে সিলেটের দিকে অগ্রসর হবো।১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রথম আঘাত হানল কেজুরীছড়া চা বাগানের উপর,সঙ্গে সঙ্গে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট আঘাত হানল ফুলতলা-সাগরনাথ চা বাগানের উপর।এমনিভাবে সেক্টর ট্রুপস এবং জেড ফোর্স পুরো সিলেট জেলার উপর একটার পর একটা আঘাত হানতে শুরু করল,এবং পাকিস্তানীদের পর্যুদস্ত করতে শুরু করল।৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট দক্ষিণগুলো চা বাগানের উপর আক্রমণ চালালো।শত্রুদের ২২ বেলুচ রেজিমেন্ট ওখানে ছিল।পাকিস্তানীরা অনেকবার দক্ষিণগুলের উপর আক্রমণ চালিয়েছে,কিন্তু ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট দক্ষিণগুল হাতছাড়া করেনি।আমার মনে হয়,বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম দক্ষিণগুলে ১০৫ মিলিমিটার আর্টিলারি দক্ষতার সাথে এবং কার্যকরীভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে,ব্যবহার করা হয়েছিল।দক্ষিণগুল জয়ের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে ১০৫ আর্টিলারির সাফল্যজনক ব্যবহার অনেকাংশে সাহায্য করেছিল।১০৫ মিলিমিটার আর্টিলারি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ সিলেট সেক্টর আমারই তত্ত্বাবধানে ক্যাপ্টেন রশীদের পরিচালনায় সর্বপ্রথম হয়েছিল।আমার যতদূর মনে হয়,১০৫ মি.মি.আর্টিলারিকে পরবর্তীকালে মুজিব ব্যাটারি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আটগ্রাম -জাকীগঞ্জ দখল করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল।কারণ জাকীগঞ্জ সিলেটের এক কোণে অবস্থিত।ভারতের করিমগঞ্জ শহরটি ঘেঁষে জাকীগঞ্জের অবস্থিতি।মাঝখানে ছোট্ট একটা নদীর ব্যবধান,জাকীগঞ্জ থেকে পাকিস্তানীরা শিলচর-করিমগঞ্জ রেলওয়ে লাইনের উপর রাতের অন্ধকারে মাইন পুঁতে রাখত।তার ফলে দু’দুবার মালবাহী ট্রেন দূর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল। এতে আমরা অত্যন্ত লজ্জাবোধ করতাম,কারণ বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানীরা এসে বন্ধুরাষ্ট্রের ক্ষতিসাধন করছে।তাই জাকীগঞ্জ দখল করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল।সেক্টর ট্রুপস এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে হামলা চালানো হল।জাকীগঞ্জের এই যুদ্ধে ভারতের সাহায্য সহযোগীতা কোনদিন ভুলিবার নয়। তাদের সাহায্য না পেলে হয়ত জাকীগঞ্জ -আটগ্রাম শত্রুমুক্ত করা সহজ বা সম্ভব হত না।প্রচন্ড যুদ্ধের পর জাকীগঞ্জ আটগ্রাম আমাদের দখলে আসে।দখলের পর ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট আটগ্রামে অবস্থান করেছিল।ভারতের ৯৯তম মাউন্টেন রেজিমেন্টকে জানাই আমার সালাম।

খবর আসতে লাগল শত্রুসৈন্য সমস্ত সিলেট জেলায় আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে বিপর্যস্ত হয়ে পিছু হঠতে শুরু করেছে,তারা রাতে ভয়ে কোথাও বের হত না।পাকিস্তানীদের একা একা কোথাও দেখা যেত না।গেরিলা অপারেশন অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছিল।পাকিস্তান সেনাবাহিনী গেরিলা অপারেশনের সফলতায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তারা তাদের ঘাঁটি থেকে বের হতে সাহস করত না।তাদের চলাফেরা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল।

সিলেট জয় করতে হলে কানাইঘাট দখল করা সর্বপ্রথম প্রয়োজন।আমি সেক্টর ট্রুপস নিয়ে কানাইঘাট জয়ের জন্য লুবাছড়ার দিকে অগ্রসর হয়ে ওদিক থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা নিলাম।আমার সঙ্গে ছিল বাংলাদেশ রাইফেলের ছেলেরা,আনসার,মোজাহিদ পুলিশ ও স্কুল কলেজের ছাত্ররা, সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০ জন।লুবাছড়া পৌঁছতে বিকেল হয়ে আসল।চিন্তা করতে লাগলাম কিভাবে কানাইঘাট দখল করা যায়।আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছিল যেভাবে হোক কানাইঘাট দখল করতে হবে।

সিলেট সেক্টর ট্রুপস কানাইঘাটের যুদ্ধ একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা, ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর সেক্টর ট্রুপস অগ্রসর হল।সৈন্যসংখ্যা চারশো জনকে নিয়ে চারটি কোম্পানি গঠন করা হল।একটি কোম্পানিকে লেফটেন্যন্ট গিয়াসের নেতৃত্বে দরবস্ত -কানাইঘাট রাস্তার মধ্যে ‘কাট অফ কোম্পানি’ হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হল।ওর কাজ ছিল শত্রুসৈন্য দরবস্ত হতে কানাইঘাট যুদ্ধে যেন কোন সাহায্য করতে না পারে। লেফটেন্যন্ট জহীরকে আর একটা কোম্পানির দায়িত্ব হতে কানাইঘাট -চোরঘাই রাস্তায় ‘কাট অফ কোম্পানি হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হল।ওকে এই দায়িত্ব দেওয়ার কারণ হলো চোরঘাই থেকে যেন শত্রুসৈন্য কানাইঘাটে সাহায্য এগিয়ে আসতে না পারে।এবং কানাইঘাট থেকে শত্রুসৈন্য পালিয়ে চোরঘাইর দিকে না যেতে পারে।আর দুটি কোম্পানি মেজর রব ( বর্তমানে লেফটেন্যন্ট কর্ণেল) এর অধিনায়কত্বে নদীর পাড় ও মধ্যে দিয়ে শত্রুর উপর হামলা চালিয়ে কানাইঘাট দখলের দায়িত্ব দেয়া হল।রাতের অন্ধকারে কানাইঘাট যুদ্ধ জয়ের অভিযান শুরু হল।রাত দেড়টায় গোলাগুলির আওয়াজ শুনা যায়।লেফটেন্যন্ট গিয়াসের সঙ্গে শত্রুসৈন্যর গুলি বিনিময় হচ্ছে। লেফটেন্যন্ট গিয়াসের কোম্পানি জায়গায় পৌঁছাতে পারছে না।ইতিমধ্যে তার একজন সৈন্য আহত হয়।আমি তাকে বললাম যেভাবে হোক তোমার গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হবে।লেফটেন্যন্ট জহীরের কাছ থেকে খবর আসল সে বিনা-বাধায় কানাইঘাট -দরবস্ত রাস্তা পার হয়ে গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাত যত বাড়তে লাগল ততই গোলাগুলির আওয়াজ বাড়তে লাগল।রাত প্রায় দুটোর সময় লেফটেন্যন্ট গিয়াসের কাছ থেকে খবর পেলাম ওরা শত্রুসৈন্যকে ঘিরে ফেলেছে। তবে তার একটি ছেলে শহীদ হয়েছে এবং সে শত্রুদের উপর শেষ হামলা চালাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।এদিকে জহীরের কাছ থেকে খবর পেলাম তার গন্তব্যস্থল প্রায় ৭০০/৮০০ গজ দূরে,তার উপর ভীষণভাবে মর্টারের গোলাবর্ষণ হচ্ছে এবং সে এগুতে পারছে না, মেজর রবের কাছ থেকে খবর পেলাম তার দুটো কোম্পানি ধীরগতিতে গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।তবে সে এখনও মুখোমুখি সংঘর্ষের সম্মুখীন হয়নি।লেফটেন্যন্ট গিয়াসের কাছ থেকে ৪ ঠা ডিসেম্বর রাত তিনটার সময় খবর আসল শত্রুদের একটি পুলের চারকোণায় চারটি বাংকার।এবং তার ভেতর থেকে প্রচন্ড গোলাগুলি আসছে। লেফটেন্যন্ট গিয়াসের সৈন্যরা বাংকারের উপর গ্রেনেডের সাহায্য শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।ভেতর থেকে বাংলায় চিৎকার করে বলল,’আমরা বাঙ্গালী,আমাদের মারবে না।দুটো পশ্চিম পাকিস্তানী রাস্তার উপর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।আমরা আপনাদের সাহায্য করব”।রাত প্রায় সাড়ে তিনটে-চারটে হবে।লেফটেন্যন্ট গিয়াসের কাছে খবর পেলাম ওরা ওদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে।বাংকারের ভেতরে ওরা যেতে পারেনি।কারণ বাংকারে অনেক মৃতদেহ পড়ে আছে,এবং ৭ জন রাজাকার বাইরে চলে এসে আত্মসমর্পণ করেছে,নয়জন পশ্চিম পাকিস্তানী গ্রেনেড ছোড়ার ফলে মারা যায়।দু’জন পশ্চিম পাকিস্তানী পালাবার সময় মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলে।৭ জন বাঙ্গালী রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।লেফটেন্যন্ট গিয়াসকে পুরো এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলো,যাতে দরবস্ত থেকে শত্রুরা কানাইঘাটের দিকে আসতে না পারে।রাত বাড়তে লাগল,লেফটেন্যন্ট জহীরের কাছ থেকে খবর পেলাম সে এগুতে পারছে না।এদিকে মেজর রব শত্রুসৈন্যর মুখোমুখি প্রায় এসে পড়েছে।তার উপর প্রচন্ড গোলাবর্ষণ হচ্ছে।বেলা বাড়তে লাগল,মেজর রব শত্রুসৈন্যকে নদীর তীর দিয়ে প্রায় ঘিরে ফেলেছে।সে ওদের কাছ থেকে দুশো গজ দূরে আছে।তার দুটো ছেলে গুরুত্বরভাবে আহত হয়েছে।তার গোলাবারুদ দরকার বলে সে জানাল।৪ ঠা ডিসেম্বর সকাল ৬টায় জহীরের কাছ থেকে খবর পেলাম এম-জি এবং মর্টারের গোলাগুলিতে সে এগুতে পারছে না।তিনজন গুরুত্বরভাবে আহত হয়েছে। আরও সৈন্য এবং গোলাবারুদ চেয়ে সে অনুরোধ জানাল।আমি বললাম সৈন্য আর পাঠাতে পারব না,তবে গোলাবারুদ পাঠিয়ে দিচ্ছি।সকাল ৭টায় মেজর রবের কাছ থেকে খবর পেলাম নদীর ওপার থেকে ওদের উপর গোলাগুলি আসছে,আমি জানতাম আটগ্রামে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট আছে এবং এটাও জানতাম নদীর ওপারে শত্রুসৈন্য আছে।১ম বেঙ্গলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নদীর ওপার থেকে শত্রুসৈন্যদের সরিয়ে দিতে।আমার সঙ্গে ১ম বেঙ্গল রেজিঃ এবং জেড ফোর্স এর বেতার যোগাযোগ ছিল না।মেজর রবের উপর নদীর ওপার থেকে থেকে গোলাগুলি আসতে লাগল।মেজর রবকে বললাম ভারতের সাথ বেতার যোগাযোগ করে ভারতীয় গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্য আমি নিচ্ছি।তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করে যাও।ভারতের সাথে যোগাযোগ করি এবং গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্য পাবো বলে আশ্বাস দেয়।এদিকে যেহেতু মেজর রবের আরো সৈন্যর দরকার ছিল সেইহেতু জহীরকে মেজর রবের সাহায্য পাঠানো হল।লেফটেন্যন্ট গিয়াসের কাছ থেকে খবর পেলাম দরবস্ত থেকে পাকিস্তানীদের কানাইঘাটের দিকে আসার কোন পরিকল্পনা আছে বলে তার মনে হচ্ছে না।গিয়াসকে লেফটেন্যন্ট জহীরকে সাহায্যের জন্য পাঠানো হল।মেজর রব এবং লেফটেন্যন্ট জহীরের দলের উপর শত্রুর ভীষণ গুলাগুলি হচ্ছিল।আস্তে আস্তে ওরা এগুতে লাগল।বেলা প্রায় দশটায় খবর পেলাম নদীর ওপার থেকে পাকিস্তানীরা পেছনে পালাচ্ছে।এদিকে কানাইঘাট থেকেও পাকিস্তানীরা বাংকার থেকে উঠে পড়েছে।কানাইঘাটে শত্রুদের উপর মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়ল।বেলা প্রায় সাড়ে দশটায় মেজর রব,লেফটেন্যন্ট গিয়াস ও লেফটেন্যন্ট জহীরের সৈন্যরা সম্মিলিতভাবে কানাইঘাটে শত্রুসৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।এবং হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।পাকিস্তানীরা রাস্তা না পেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতে আরম্ভ করল এবং নিজেদের পোঁতা মাইন বিস্ফোরণে নিজেরাই মরতে আরম্ভ করল।যারা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল ওরাও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রাণ হারায়।নদীর পানি লাল হয়ে গিয়েছিল।অনেকে পানিতে ডুবেও মারা যায়।ভীষণ শব্দে মাইনগুলো ফাটছিল।যারা চুরবাইর দিকে পালাতে চেষ্টা করেছিল তারও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রাণ হারায়।বেলা প্রায় ১১ টায় এগারটায় কানাইঘাট আমাদের দখলে আসল। কানাইঘাটে শত্রুসৈন্য ও অনেক লাশ ছিল।লাশগুলো সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।চারধারে জয় বাংলা ধ্বনি,ছেলেদের মুখে হাসি। মনটা গর্বে ভরে উঠল।কানাইঘাট জয়ের কথা জানানো হল।নানা জায়গা থেকে আমাদেরকে অভিনন্দন জানানো হল।জেনারেল উসমানীর কাছ থেকেও অভিনন্দন বার্তা পেলাম।কানাইঘাট যুদ্ধে পাকিস্তানীদের মৃতের সংখ্যা ছিল ৫০ জন,আহত ছিল ২০ জন।বাঙ্গালী রাজাকার ছিল ২০ জন তারা পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়াতে ওদেরকে মুটে-মজুরের কাজ দেয়া হয়েছিল।এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষে শহীদ হয়েছে ১১ জন,এবং আহত হয়েছিল ১৫ জন।আমার ডাক্তার ছিল সিলেট মেডিক্যাল কলেজের, ছাত্র নজরুল,যেভাবে সে আহতদের চিকিৎসা করেছে তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না।অবাক হয়ে চেয়ে থাকতাম কখনো ব্লেড গরম করে,কখনো বেয়নেট গরম করে কাটাছেঁড়া করছে।অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে সে।

এতবড় দায়িত্ব সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি বলে যারা ভাল কাজ করেছে তাদেরকে উপাধিতে ভূষিত করার জন্য সর্বাধিনায়কের কাছে নাম পাঠিয়েছিলাম।তারা হলঃ ১।মেজর রব বীরোত্তম,২।লেফটেন্যন্ট জহীরুল হক বীরপ্রতিক,৩।সুবেদার মতিন বীরোত্তম,৪।সুবেদার বাছর আলী বীরোত্তম,৫।নায়েক সুবেদার শামসুল হক বীরোত্তম,৬।হাবিলদার মোহাম্মদ শাহ আলম (শহীদ) বীরশ্রেষ্ঠ।৭।হাবিলদার আবদুল জব্বার বীরপ্রতীক, ৮।সিপাহী কামাল উদ্দিন বীরপ্রতীক, ৯।নায়েক আলী আকবর বীরপ্রতীক, ১০।এফ,এফ,নূরউদ্দিন আহমেদ বীরোত্তম, ১১।এফ,এফ,নীলমণি সরকার।

কানাইঘাট জয়ের পর খবর আসল আমাকে দরবস্ত হয়ে সিলেট যেতে হবে।দরবস্ত জায়গাটা হল তামাবিল এবং সিলেটের মধ্যে।খবর পেলাম দরবস্তে এক কোম্পানি পাকিস্তানী সৈন্য আছে।যদি দরবস্ত শত্রুমুক্ত করা না যায় তাহলে সিলেটে আমাদের যাওয়া যাবেনা, এবং তামাবিল ও গোয়াইনঘাট হতে আমাদের যে সৈন্য আসছে ওরাও সিলেট যেতে পারবে না,তাই যেভাবেই হোক দরবস্ত শত্রুমুক্ত করতে হবে।আমার এই অভিযান শুরু করার কিছুক্ষণ আগে সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে খবর পেলাম জেড ফোর্সকে আমার এক কোম্পানি দিতে হবে।কারণ ওর সৈন্য সংখ্যা কম।লেফটেন্যন্ট জহীরকে জেড ফোর্সের ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সাহায্য করার জন্য দিলাম।যতটুকু আমি জানি মেজর জিয়া ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে এবং সেক্টর ট্রুপস এর একটা কোম্পানি নিয়ে শালুটিকার বিমান ঘাঁটির দিকে যাবেন।ওদিকে ভারতের একটা ব্যাটালিয়ন সিলেটের দক্ষিণদিকে হেলিকপ্টারে ছত্রীসেনা নামিয়ে দেবে।ভারতের ছত্রীসেনার সংগে মিলিত হয়ে মেজর জিয়া তার সৈন্য নিয়ে সিলেট আক্রমণ করবে।আমার সৈন্য দরবস্ত জয় করে খাদিমনগর হয়ে সিলেটের উপর আক্রমণ করবে।মেজর শওকত (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) এর সৈন্যদল ও ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট গোয়াইনঘাট-ছাতক হয়ে সিলেটের পেছন দিক থেকে আক্রমণ করবে।আর একটা বাহিনী ভারতের সাহায্য মেজর এনামের দায়িত্বে মৌলভীবাজার হয়ে সিলেট আক্রমণ করবে।আর একটা বাহিনী ভারতের সাহায্যে লেফটেন্যন্ট ওয়াকিউজ্জামান এবং ফ্লাইট লেফটেন্যন্ট কাদেরের সেক্টর ট্রুপস নিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে সিলেট আক্রমণ করবে।এই ছিল সিলেট যুদ্ধের পরিকল্পনা,যতটুকু আমি জানতে পেরেছিলাম।

শুরু হল দরবস্তের পথে যাত্রা।প্রায় ১৫ মাইল হাঁটতে হয়েছিল।এফ,এফ রবকে দিয়ে একটা কোম্পানি তৈরী করলাম এবং অগ্রবাহিনী হিসেবে কাজ করার নির্দেশ দিলাম।এফ,এফ শুকুরের কোম্পানি রইল তার পিছনে।আমার পিছনে রইল মেজর রব ও সুবেদার ফজলুল হকের কোম্পানি।পেছনে ধরা পড়া রাজাকাররা আনল গোলাবারুদ ও খাদ্য সরঞ্জাম।

৬ ডিসেম্বর বিকেল প্রায় পাঁচটা।সবাইকে এক জায়গায় জড় করলাম,বললাম যেভাবে হোক দরবস্ত দখলে আনতে হবে।দরবস্তে পাকিস্তানীদের একটা কোম্পানি আছে।দরবস্ত দখল না করলে সিলেট জয় করা খুবই মুশকিল হবে।কারণ ভারত থেকে ইতিমধ্যে গুর্খা ব্যাটালিয়ন এবং এফ,এফ,দের একটা কোম্পানি নিয়ে তামাবিল দখল করে দরবস্তে আমাদের সংগে মিলে সিলেটে একসঙ্গে যাব।যদি দরবস্ত দখল করতে না পারি তাহলে তাদের পক্ষে সিলেট থাকা মুশকিল হবে।তাই আজ রাতের মধ্যেই দরবস্ত দখল করতে হবে।শুরু হল আমাদের অভিযান।গ্রামের নামটা মনে নেই, প্রায় দেড় মাইল দূরে এসেছি।বাঁয়ে সদ্য ফেলা মাটির একটা উঁচু টিলা।মনটা ভাল লাগল না।পাশেই বেশ কয়েকটি বাড়ি ছিল,একজন বুড়ো ভদ্রলোককে ডাকলাম।সে আমাকে দেখে কেঁদে উঠল, কিছুদিন আগের একটা ঘটনা,৭/৮ টা পাকিস্তানী এসেছিল ওদের গ্রামে,সঙ্গে ছিল বাঙ্গালী রাজাকার।সমস্ত গ্রামটা তছনছ করে দিয়েছিল।ওদেরকে খাবার দিতে হবে,যা অল্পবিস্তর খাবার ছিল দেয়া হল।হালের গরুটাকেও ওরা ছাড়েনি।ওদেরই বাড়িতে রান্নাবান্না হল।খাওয়া শেষ হল,রাত ঘনিয়ে আসতে লাগল।চারদিকে অন্ধকার।ঘরে ভেতরে মেয়েছেলেরা ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত।হঠাৎ ২/৩ টা সৈন্য ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করল।ওরা সবাই নিষেধ করল।শুরু হল অমানুষিক মারধর।এমনিভাবে চার-পাঁচটা বাড়িতে হামলা করল।মেয়েদের উপর অকথ্য নির্যাতন করল।চারপাশের বেশ কয়েকজন জোয়ান ছেলেকে উঁচু জায়গায় নিয়ে গেল।ওদেরকে দিয়ে মাটি কাটানো হল।তারপর শোনা গেল বেশ কয়েকটা গুলির আওয়াজ এবং সাথে সাথে আর্তনাদ।সবশেষে ডাকা হল বাকি যারা ছিল ওদেরকে মাটি দিয়ে গর্ত ভরতে।যারা বূড়ো ছিল চোখের পানিতে নিজের ছেলের কবর দিতে লাগল।এই হল রাস্তার পাশে ছোটটিলার ইতিহাস।চোখ ভরে পানি এল।প্রতিহিংসার তীব্র জ্বালা মনে এল।প্রতিশোধ নিতেই হবে।

দরবস্ত এখনো অনেক দূরে।দূরে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম।বুঝতে পারলাম না এই গোলাগুলির আওয়াজ কিসের।আন্দাজ করলাম ভারতীয় সৈন্যদের সাথে পাকিস্তানীদের কাছাকাছি কোথাও যুদ্ধ চলছে।দেরী করলে চলবে না।আজকে রাতের মধ্যেই আমাকে দরবস্ত দখল করতে হবে।রাত প্রায় বারটা হবে।এফ,এফ রবের কাছ থেকে খবর পেলাম ওদের উপর গোলাগুলি আসছে।রবের সৈন্যদের দরবস্তকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলতে এবং এফ,এফ শুকুরকে দরবস্তের বাঁ দিকে ঘিরে ফেলতে নির্দেশ দেয়া হল।মেজর রবের কোম্পানি রাস্তার ঠিক বাঁয়ে এবং সুবেদার ফজলুল হকের কোম্পানি রাস্তার ডানদিক দিয়ে সোজা দরবস্তের উপর আক্রমণ করবে।দরবস্ত তখন প্রায় তিন মাইল দূরে।বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেল।রব এবং শুকুরের সাথে আমার বেতার যোগাযোগ ছিল না।মেজর রব এবং ফজলুল হকের কাছ থেকে খবর পেলাম যে রব এবং শুকুরের সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই,তবে তারা দরবস্তের কাছে পৌঁছে গেছে।

৭ই ডিসেম্বর সকাল চারটা।মেজর রব এবং ফজলুল হক খবর দিল যে দরবস্ত দখল হয়ে গেছে।মেজর রব এবং সুবেদার ফজলুল হকের সৈন্যদের বিশ্রাম নিতে বললাম।যখন একটু বেলা হয়ে যাবে তখন যেন ওরা এক-একটা করে প্লাটুন পাঠিয়ে দেয় রব এবং শুকুরের সৈন্যদের খুঁজে বের করতে।সকাল প্রায় ৭টা।দেখছি দু,ধার থেকে এফ,এফ,রব এবং এফ,এফ শুকুরের সৈন্যরা এসে আমাদের সাথে একত্রিত হচ্ছে।এফ,এফ রবের কাছ থেকে জানলাম ওরা যখন পাকিস্তানীদের পেছনে ধাওয়া করছিল তখন ওরা দিক হারিয়ে অনেক ডানে চলে গিয়েছিল,এবং পরে একটা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল তবে কোন পাকিস্তানীকে পায়নি।এফ,এফ শুকুরের খবরে জানলাম পাকিস্তানীরা রাতের অন্ধকারে হরিপুরের দিকে দৌড়ে পালাচ্ছিল।ওদেরকে পিছু ধাওয়া করতেই ওরা অন্যপথে চলে গিয়েছিল।তারাও একটা গ্রামে আস্তানা গেড়েছিল।ওখানেও গ্রামের বাড়িতে একটা পাকিস্তানী সৈন্য লুকিয়েছিল,তাকেও শেষ করা হয়েছে।ইতিমধ্যে ভারতের গুর্খা সৈন্যরা ৫নং সেক্টরের একটা কোম্পানি নিয়ে দরবস্ত পৌঁছেছে।

৮ই ডিসেম্বর,বেলা প্রায় দশটা হবে।একদিনের জন্য দরবস্তে,আমার আস্তানা গেড়েছি।ব্রিগেডিয়ার ওয়াছকে এবং ব্রিগেডিয়ার বার্নে এসে দরবস্ত পৌঁছলেন।ঠিক হল গুর্খা রেজিমেন্ট রাস্তার ডান পাশ হয়ে দরবস্ত -সিলেট যাবে এবং আমার সৈন্যরা রাস্তার বাঁদিক দিয়ে খাদেমনগর হয়ে সিলেট যাবে।

১০ই ডিসেম্বর পৌঁছালাম লামা নামক একটা গ্রামে।ব্রিগেডিয়ার ওয়াছকের সঙ্গে দেখা হল।উনি বললেন,হিমু চা বাগানের কাছে পাকিস্তানীরা শক্ত ব্যূহ রচনা করেছে।একটা পুল আছে হিমুর কাছে।তার নিচ দিয়ে একটি নদী চলে গেছে।এবং হিমুর আগে বেশকিছু উঁচু জায়গা আছে।আমাদের পক্ষে এগুনো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাছাড়া হিমু যাবার পুলটা পাকিস্তানীরা উড়িয়ে দিয়েছে।আমাকে বলা হল হিমুর পেছন দিক থেকে শত্রুসৈন্যকে আক্রমণ করতে এবং যেভাবে হোক হিমু শত্রুমুক্ত করে হরিপুরের উপর আক্রমণ চালাতে।

খাওয়া-দাওয়া করে গ্রাম থেকে দুজন গাইড নিয়ে চললাম হিমুর উদ্দেশ্য।সারারাত নদী-খাল-বিল পার হয়ে পৌঁছালাম আটগ্রাম বলে একটি গ্রামে।সেখান থেকে হিমুর দুরত্ব প্রায় দু’মাইল।আটগ্রাম পৌঁছলাম ভোত চারটায়।গ্রামের পাশে নদী পার হতে হবে অনেক কষ্টে।দুটো নৌকা যোগাড় করা গেল।ওপারে সবাই পৌঁছলাম।ওপারে প্রায় ৭০০/৮০০ গজ দূরে খোলা মাঠ,তার উপরে অনেকগুলো উঁচু টিলা,যা পুরো আটগ্রাম গ্রামকে ঘিরে রেখেছে।সকাল হতে চলেছে।দেখলাম হিমু পর্যন্ত পুরো খোলা মাঠ।চিন্তা করলাম দিনের বেলা এই খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে যাওয়া সমীচীন হবে না।তাই সবাইকে বললাম আজকের দিনটা আটগ্রামে কাটিয়ে দিই।সন্ধ্যার সময় হিমুর পথে যাত্রা করা যাবে।ভারতীয় গুর্খা সৈন্যদের সংগে বেতার যোগাযোগ করতে পারলাম না।যাই হোক আবার সবাই মিলে নদী পার হয়ে আটগ্রামে ফিরে আসলাম।আমার সৈন্যদের কে কোথায় জায়গা নেবে পুরো হুকুম দেবার সময় পেলাম না।বেলা প্রায় আটটা হবে।পাকিস্তানীদের দিক থেকে শুরু হল আমাদের উপর ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলাবর্ষণ।সঙ্গে আরম্ভ হল আমাদের উপর মেশিনগান এবং এল-এম-জির গোলাবর্ষণ।সৈন্যরা নিজের নিজের জায়গায় অবস্থান নিল।কিছুই করার নেই একেবারে শত্রুর মুখে পড়ে গেছে।কিন্তু বুঝলাম একেবারে আচানক শত্রুর গোলাগুলিতে আমার সৈন্যরা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে।

আটগ্রাম ছোট গ্রাম।বৃস্টির মত গোলাগুলি হচ্ছিল।আমাদের এমন কিছুই করবার নেই,চিন্তা করলাম যদি আটগ্রাম থাকি তাহলে আমরা সবাই মারা যাব।কারণ পাকিস্তানীরা আমাদের জায়গা জেনে ফেলেছে।তাই সবাইকে বললাম যে যেভাবে পারে পেছনে দু,তিন মাইল দূরে অন্য এক গ্রামে চলে যেতে।যাবার সময় আহতদের নিয়ে যাবার জন্য বলা হল।ডাক্তার নজরুলকে বললাম যারা শহীদ হয়েছে তাদের কবরের ব্যবস্থা করার জন্য।আমরা সবাই চললাম গ্রামের দিকে,সৃষ্টিকর্তার অশেষ দয়া ছিল।যখন আমরা আটগ্রাম ছেড়ে পেছনের গ্রামে যাচ্ছিলাম তখন আমাদের কেউ শহীদ বা আহত হয়নি।যদিও আমাদের উপর গোলাগুলি হচ্ছিল,একটি গুলিও আমাদের উপর লাগেনি।যখন সবাই এসে পৌঁছলাম তখন দেখলাম আমার ১১ জন ছেলে শহীদ হয়েছে এবং পাঁচজন গুরুত্বরভাবে আহত হয়েছে।সবার সাথে আলাপ করে বুঝলাম সবাই ঘাবড়ে গেছে।ভাবলাম একটা দিন পুরো বিশ্রাম নেয়া উচিৎ।গ্রামের লোকেরা আমাদের যথেষ্ট খাতির করেছে।

১২ই ডিসেম্বর বিকেলবেলা হিমু থেকে খবর পেলাম পাকিস্তানীরা চলে গেছে চিকনাগুল চা বাগানের দিকে।সোজা চিকনাগুল চা বাগানের দিকে যাবার পরিকল্পনা নেয়া হল।চারধার থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আসতে লাগল।বিনা বাধায় চিকনাগুলে পৌঁছলাম।ভারতের গুর্খা ব্যাটালিয়নের সঙ্গে তখন পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ সম্ভব হয়ে উঠেনি।পরেরদিন রাস্তায় দেখ হল গুর্খা ব্যাটালিয়নের সি-ওর সঙ্গে,ঠিক হল রাস্তার ডানদিক দিয়ে খাদেমনগরের উপর আক্রমণ চালাবে গুর্খা ব্যাটালিয়ন,বাঁয়ে আক্রমণ চালাবে আমাদের সৈন্যরা।খাদেমনগর পাকিস্তানীদের বিরাট এবং শেষ ঘাঁটি।

১৫ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সন।চারধারে পাকিস্তানীরা মজবুত ব্যূহ রচনা করেছে,যতবড় ব্যূহই রচনা করুক বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।সিলেট আর বেশী দূরে নয়।তারা এগিয়ে যাবেই।পেছনে যাবার কোন প্রশ্নই উঠে না।ভারতের গুর্খা ব্যাটালিয়ন রাস্তার ডানে এবং আমাদের সৈন্যরা রাস্তার বাঁয়ে এগিয়ে চলেছে,খাদেমনগর দখলের চেষ্টা,কিছুদূর এগিয়েছি।সামনে ঈদগা এবং উঁচু টিলা থেকে মর্টার ও মেশিনগানের গোলাগুলি আসতে লাগল।কিছুক্ষণ বিরতির পর আবার শুরু হয় গোলাগুলির আওয়াজ।বেলা বাড়তে লাগল।রাস্তার ডানে এবং বাঁয়ে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল।ইতিমধ্যে আমার এক কোম্পানি ঈদগার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।একেবারে খোলা জায়গা,তবে দু-একটা টিলা ছিল।বেলা প্রায় পাঁচটা। হাবিলদার গোলাম রসূল ছেলেটি বেশ নির্ভীক।ঈদগার উপর একা আক্রমণ করতে গিয়ে শহীদ হল।বৃস্টির মত গোলাগুলি চলছিল।তবু সে এগিয়ে গিয়েছিল,রাত হয় হয়।ঈদগা আমাদের দখলে আসল।ই পি আর এর এই নির্ভীক ছেলেটি ঈদগার দখল দেখে যেতে পারল না।তারই বীরত্বে ঈদগা দখল সম্ভব হয়েছিল।তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেয়ার জন্য আমাদের সর্বাধিনায়কের কাছে নাম পাঠিয়েছি।সেদিন রাতে চিকনাগুলের কাছে তাকে কবর দেয়া হয়।এই যুদ্ধে একজন শহীদ ও তিনজন গুরুত্বররুপে আহত হয়েছিল।

পরদিন খাদেমনগরের কাছে এসে পৌঁছলাম এবং খাদেমনগর আক্রমণ করার পরিকল্পনা নিলাম।আমাদের উপর ভীষণভাবে গোলাগুলি আসছিল।আমাদের পক্ষ থেকেও ভীষণ গোলাগুলি খাদেমনগরের উপর পড়ছিল।গ্রামের লোকেরা খুব সাহায্য করেছে।১৬ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সন।সবাইর মনে আনন্দ।যারা আনন্দের দিনে আমাদের সঙ্গে নেই,যাদের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীনতা পেলাম, পরমেশ্বরের কাছে হাতজোড় করে জানালাম অজস্র প্রণাম।তাদের আত্মার সদগতি হোক।জয় বাংলা।

সিলেটের স্বাধীনতা এসেছিল ১৭ ই ডিসেম্বর।

স্বাক্ষরঃচিত্তরঞ্জন দত্ত,

ব্রিগেডিয়ার

২৪-৩-৭৪

**১৯৭১ সালের মার্চে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। বর্ত্মানে মেজর-জেনারেল। সাক্ষাৎকারটি ২৪-৩-১৯৭৪ তারিখে গৃহীত হয়।

 

Scroll to Top