<১০, ৪.৪, ১৭০-১৭১>
সাক্ষাৎকারঃ মেজর ইমামুজ্জামান
জুন মাসের ৭ তারিখে পাকিস্তানীরা প্রথমবারের মত ফেনী থেকে পরশুরামের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে তাদের অগ্রগতি প্রতিহত করা হয়। প্রায় ৩০০ জনের মত নিহত হয়। লাশগুলো এ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাবার সময় আমরা দেখতে পাই।
জুন মাসের ২১ তারিখের মধ্যে ওরা ১৭ বার আমাদের আক্রমণ চালায়। কিন্তু প্রতিবারই ওরে আক্রমণকে প্রতিহত করা হয়। ওদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। জুন মাসের ২১ তারিখে ৭টা হেলিকাপ্টার (সৈন্য বোঝাই) আমাদের পিছনে নামানো হয়। ভোর তিনটা/চারটার দিকে পেছনের এক ব্যাটালিয়ন কমান্ডো সৈন্য এবং সামনে থেকে পাক ব্রিগেডেরও অধিক সৈন্য ট্যাংক এবং গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতায় আমাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আমাদের বহু লোক হতাহত হয়। উপায়ন্তর না দেখে মুহুরী নদীর পার ঘেঁষে ঘেঁষে ওদের প্রতিরক্ষাবূহ্য ভেতর দিয়ে বহু কষ্টে বের হয়ে আসলাম, আমাদের অনেকে হতাহত হয়েছিল। বেলুনিয়া পর্যন্ত ওরা আমাদের পিছু ধাওয়া করে। আমরা বেলুনিয়া চলে যেতে বাধ্য হই।
চৌদ্দগ্রামের সীমান্তে ক্যাম্প খুললাম। সেখান থেকে গেরিলা অপারেশন শুরু করা হয়। লাকসাম থেকে ফেনী রেলওয়ে লাইন এবং লাকসাম-চাঁদপুর রেলওয়ে এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য রাস্তার উপর মাইন পুঁতে রাখি। এসময় ডিনামাইট দিয়ে অনেক গাড়ি উড়িয়ে দেয়া হয়। সৈন্য বোঝাই অনেক ট্রেনের ক্ষতি সাধন করা হয়। জগন্নাথদিঘী, চিওড়া, চৌদ্দগ্রাম হরিসর্দার বাজারে পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাঁটিগুলোতে রেইড করা হয়।
অক্টোবর মাসে আমার কোম্পানী এবং মেজর জাফর ইমামের কোম্পানী নিয়ে দ্বাদশ বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হয়। নভেম্বর মাসের ২ তারিখে দ্বাদশ বেঙ্গল রেজিমেন্ট পেছন থেকে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতায় পরশুরামের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। সকালের মধ্যেই ৪ বর্গমাইল এলাকা আমরা মুক্ত করতে সক্ষম হই। ৪৪ জন সৈন্য একজন ক্যাপ্টেনসহ আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
পশুরামে আমরা ঘাঁটি স্থাপন করি। নভেম্বরের ১৯ ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মুন্সিহাট-পাঠানগর অঞ্চলে আক্রমণ চালানো হয় এবং মুক্ত করা হয়। অনেক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। অধিকাংশই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ভারতীয় বাহিনী ঐ এলাকায় ৪টা ট্যাংক নিয়ে ঢুকেছিল।
ডিসেম্বর মাসের তিন তারিখে ফেনির উপরে আক্রমণ চালানো হয়। সকালের মধ্যে সমস্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ফেনী ছেড়ে চলে যায়। ফেনী থেকে আমরা চৌমুহনীর দিকে রওয়ানা হলাম। সেখানে অনেক পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকার ছিল। দু’দিন তুমুল যুদ্ধ চলে। পরে চৌহমুহনী মুক্ত হয়। প্রায় একহাজার রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। অনেক পাকিস্তানী সৈন্যও আত্মসমর্পণ করে।
৭ই ডিসেম্বর আমরা মাইজদীতে গেলাম। সেখানেও পাকিস্তানীরা বাধা দেয়। অনেক রাজাকার এবং পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। এই সমস্ত এলাকার দায়িত্ব মুক্তিবাহিনীর কাছে অর্পণ করে আমরা চট্টগ্রামের দিকে রওয়ানা হলাম।
ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পৌঁছাই। ১৪ই ডিসেম্বর হাটহাজারী থানা দখল করা হয়। ডিসেম্বর ১৬ তারিখে খবর পাওয়া গেলো পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডোর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানীরা চট্টগ্রামেও আত্মসমর্পণ করলো। মুক্তিবাহিনীতে অধিকাংশ স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যোগ দিয়েছিল। তাছাড়া গরীব এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির যুবকরা নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধ করেছিল।
স্বাক্ষর: মেজর ইমামুজ্জামান
১০-০১-১৯৭৪ ইং
* লেঃ কর্নেল ইমামুজ্জামান ১৯৭১ সালের মার্চে লেফত্যানেন্ট হিসাবে কুমিল্লা সেনানিবাসে ছিলেন, ইমামুজ্জামানের এ সাক্ষাৎকারটি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়।