সাক্ষাৎকারঃ মেজর এম, এস, এ ভূঁইয়া

<৯, ৪.৫, ২০৪-২০৬>

শত্রুর প্রচণ্ড চাপে মনতলার পতন

মেজর এম, এস, এ ভূঁইয়া

(‘মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস’ ১৯৭৪ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

 

মে মাসের শেষের দিক। তেলিয়াপাড়া পতনের পর ক্যাপ্টেন নাসিম (বর্তমানে মেজর) সিলেটের পাকিস্তানী এলাকা মনতলায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। মেজর মঈন প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন হরশপুর এবং মুকুন্দপুরে। ঐ দিক থেকে শত্রুর প্রবল হামলার আশংকা থাকায় আমাদের দুধারের পজিশন মধ্যবর্তী স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য পাঠানো হলো। আমার সাথে দেয়া হলো ৫০ জন জোয়ান। সঙ্গে অস্ত্র দেওয়া হলো একটি ভারী মেশিনগান, ৭টি হালকা মেশিনগান এবং বাকীগুলি রাইফেল। জায়গার তুলনায় আমাদের সাথে লোকসংখ্যা এবং অস্ত্রের পরিমাণ ছিল নগণ্য। এত অল্পসংখ্যক লোক দিয়ে আমাকে প্রায় আড়াই মাইল ফরোয়ার্ড লাইন কভার করতে হয়েছিল। আমাদের মিলিটারী ট্রেনিং অনুযায়ী এত বিরাট এলাকা কভার করা ছিল অকল্পনীয়।

 

যা হোক, এই অল্পসংখ্যক লোক নিয়েই আমি মনতলা থেকে গিলাতলী এবং তারপর ইখতেয়ারপুর গ্রাম পর্যন্ত কভার করলাম। অবশ্য আমার অসুবিধা টের পেয়ে আমাকে আরও ২০ জন লোক দেওয়া হয়। এই ২০ জনের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিমান বাহিনীর লোক। সুতরাং পদাতিক বাহিনীর ধ্যান -ধারনা সম্পর্কে তাদের ধারনা খুব স্পষ্ট ছিল না। আমি যাওয়ার আগেই শত্রুরা সেখানে আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু তাদের আক্রমণ কার্যকর হয়নি। প্রত্যেক বারই তাদের আক্রমণ ব্যাহত হতে লাগল। বাধ্য হয়ে শত্রুরা তাদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে ব্যাপৃত হল। শত্রুবাহিনী দিনের বেলা কয়েকবারই আমাদের উপর আক্রমণ চালালো। প্রথমে তারা আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের ডান দিয়ে আক্রমণ চালায়। আমি এবং মেজর নাসিম প্রতিরক্ষা ব্যুহের ডান দিকে দুটি ভারী মেশিনগান রেখেছিলাম। ফলে শত্রু পক্ষের আমাদের অবস্থান ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হল না। একদিন দিনের বেলা আক্রমণের সময় শত্রুবাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হলো। শত্রু অনেক মৃতদেহ পিছনে ফেলে রেখে হটে যেতে বাধ্য হলো।

 

আরেকদিন শত্রুবাহিনীর সাথে আমাদের লড়াই হলো মুখোমুখি। এ সময়ে শত্রুর সৈন্য সংখ্যা ছিল বিপুল। শত্রুবাহিনীর সংখ্যাধিক্যে আমাদের জোয়ানরা কিছুটা ভড়কে গিয়েছিল। তাদের কেউ কেউ আমাদের কোম্পানী তুলে নেওয়ার জন্যে পর্যন্ত পীড়াপীড়ি করেছিল। মনতলা পতনের শেষ দিন সন্ধ্যায় শত্রুবাহিনী এক বিগ্রেড এবং এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে মেজর নাসিম, লেফটেন্যান্ট মোরশেদ এবং এবং আমার পজিশনের উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালাল। আমি সে সময়ে ছিলাম আমার কোম্পানী হেডকোয়ার্টারে। আমি যাচ্ছিলাম মনতলা রেলওয়ে লাইনের ডান পার্শ্বে যে দুটো সেকশন ছিল সেগুলো চেক করার জন্যে। পথে জনৈক বে-সামরিক ব্যাক্তির কাছে জানতে পারলাম মনতলা রেলওয়ে ষ্টেশনে আমাদের কোন লোক নেই। তার কথা আমার বিশ্বাস হল না, বরং পাল্টা তার প্রতি আমার বিশেষ সন্দেহের উদ্রেক হল। আমি ঐ লোকটির সঙ্গে আমার দুজন দেহরক্ষীকে দিয়ে মনতলার পজিশন চেক করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। ওদিকে শত্রুবাহিনী ছয়টি কামানের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর অনবরত গোলাবর্ষণ শুরু করে দিয়েছে। আমার পাঠানো দেহরক্ষী দুজন ফিরে এসে জানালো, সত্যি সত্যিই ঐ পজিশনে আমাদের কোন লোক নেই। রাত তখন ৮টা বাজে।

 

সেদিনকার ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী দিচ্ছিঃ মেজর নাসিমের অবস্থানের উপর শত্রুবাহিনীর প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য আক্রমণ চালায়। এক ব্যাটালিয়নের সইন্যসংখ্যা প্রায় ৮০০ শত। এই বিপুল সৈন্যের আক্রমণের মুখে মেজর নাসিম ও তাঁর সৈন্যদের অবস্থানে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তিনি তাঁর কোম্পানী নিয়ে অবস্থান ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। মেজর নাসিম মেজর মঈনের কোম্পানীকে (পরে লেফটেন্যান্ট মোরশেদের দ্বারা পরিচালিত) ফরোয়ার্ড লাইনে টেলিফোনের মাধ্যমে এই সৈন্য উঠিয়ে নেওয়ার সংবাদ জানান। আমার সাথে মেজর নাসিম দুজন জওয়ান মারফত আমাকে এই সংবাদ পাঠান যে, শত্রুবাহিনীর আক্রমণ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। খবরে আরো বলেন যে, শত্রু ত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়েছে। মেজর নাসিম এবং লেফটেন্যান্ট মোরশেদের সৈন্যদের পজিশন ছিল আমার উভয় পার্শ্বে। তাদের পজিশনে শত্রু প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল। মেজর নাসিমের সৈন্যরা তুমুল লড়াই করে শত্রুর অগ্রগতিকে ব্যাহত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। অবশেষে মেজর নাসিম নিজের ট্রুপস এবং আমার কোম্পানীর ২১ জন লোক ও সুবেদার মান্নানকে নিয়ে পঞ্চবটীতে অর্থাৎ কয়েক মাইল পেছনে সরে গেলেন। ওদিকে লেফটেন্যান্ট মোরশেদও প্রাণপণ লড়াই করার পর তাঁর সৈন্যদের নিয়ে সরে পড়তে শুরু করেছেন। আমি এসবের কোন খবরই পাইনি। তদুপরি আমার প্রতিরক্ষা লাইন ছিল কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে আড়াই মাইল আগে।

 

আমার সে সময়কার মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আমি তখন বলতে গেলে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়েছি। রাত দশটার দিকে আমার হেডকোয়ার্টারের উপর প্রায় দশটা কামানের গোলা এসে পড়ল। আমাদের সংগ্রামী সৈনিকরা অনেকেই একেবারে নতুন। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্যে তারা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের অনেকেই জীবনে এই প্রথম কামানের গোলার আওয়াজ শুনলো। শত্রু ডান দিক দিয়ে আমাদের উপর প্রচণ্ড চাপ দিয়ে যাচ্ছে। অধিকন্তু ফরোয়ার্ড ডিফেন্স লাইনে যারা ছিল তাদের উপর প্রচণ্ড চাপ এল। আমি হেডকোয়ার্টারে থেকে কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। ফলে ফরোয়ার্ড ডিফেন্স লাইনে অর্থাৎ ইখতেয়ারপুর ও গিলাতলীতে যারা ছিল তাদের খবরও জানা সম্ভব হল না। কাসিমপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের ওখানে আমার একটি অবস্থান ছিল। সেখানকার জোয়ানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ জন। আমি তদের ওখানে দুজন রানার পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু শত্রুদের কামান থেকে তখন এমন অবিরামভাবে গোলা বর্ষিত হচ্ছিল যে কিছুদুর এগিয়ে যাওয়ার পর তারা থেমে যেতে বাধ্য হল।

 

রাত তখন দশটা বাজে। আমিও অবস্থান ত্যাগ করাই মনস্থ করলাম। সব জায়গায় লোক পাঠিয়ে তাদের জানিয়ে দিলাম, পরবর্তী অবস্থান এবং প্রতিরক্ষাব্যুহ রচিত হবে চৌমুহনীতে।

 

শত্রু তখন তিন দিক থেকে আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। আমি হেডকোয়ার্টার নিয়ে চৌমুহনীর দিকে রওনা হলাম। আমরা সবাই নিজ নিজ অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ সঙ্গে নিলাম। বাধ্য হয়ে আমরা সে সময়ে অনেক বেসামরিক লোককেও আমাদের অস্ত্রের বোঝা বহন করার জন্য সঙ্গে নিয়েছিলাম।

 

আমার বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার সময় অন্যান্য কয়েকটি দলও এসে আমার দলের সঙ্গে যোগ দিল। শত্রুর অগ্রগতিকে বিলম্বিত করার জন্য হালকা মেশিনগানের সাহায্যে আমরা গুলি করতে থাকলাম। রাত দুটোয় এসে আমরা পৌঁছলাম চৌমুহনীতে। আল্লাহর রহমতে আমরা সবাই সেখানে এসে একত্রিত হলাম। আমাদের কোম্পানীর সমস্ত সৈন্যই ছড়িয়ে পড়াতে আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। সত্যি বলতে কি- আমার অবস্থা ছিল ঝড়ের সমুদ্রের ছিন্নপাল নৌকার মাঝির মত। এখন সবাইকে এক স্থানে পেয়ে আমি খোদার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।

 

চৌমুহনীতে এসে আমি কোম্পানীর সবাইকে পেলাম সত্য, কিন্তু আবার নতুন বিপদের সম্মুখীন হলাম। মেশিনগান সজ্জিত আমার কয়েকটি সৈন্যদল গুলিবর্ষণ করে শত্রুসৈন্যদের অগ্রগতিকে বিলম্বিত করতে সক্ষম হলেও, শত্রুর পার্শ্ববর্তী অগ্রগতিকে বাধা দিতে সক্ষম হল না। আর শত্রুর সবদিকের অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখাও ছিল অসম্ভব- কারণ আমাদের সংখ্যাল্পতা। সংখ্যায় শত্রুসৈন্য ছিল আমাদের তুলনায় দশগুন। ভারতীয় সীমানা থেকে চৌমুহনীর দূরত্ব মাত্র দুই মাইল। কিন্তু এই দুই মাইল রাস্তা সেদিন রাতে কাছে অন্তহীন বলে মনে হয়েছিল।

 

রাতের শেষের দিক তখন। তখন ভোর চারটা। শত্রুরা শুধু গুলি করতেই এগিয়ে আসছিল না, তারা এগিয়ে আসছিল ঘরবাড়ি, গাছপালা জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে।

 

ভোর সাড়ে চারটার দিকে তারা ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। শত্রুবাহিনী তখন আমাদের পশ্চাদ্ভাগের ব্যুহ প্রায় ভেদ করে ফেলেছে। আমাদের বাহিনীর তিন দিক বেষ্টন করেছে তারা। সামনে, দক্ষিণে এবং বামে। তখন ঐ নিতান্ত ফাঁদে পড়া অবস্থার মধ্যেও আমরা মনোবল না হারিয়ে তিনদিকে হালকা মেশিনগানের সাহায্যে অবিরাম গুলি চালাতে লাগলাম। আমাদের প্রতিজ্ঞা; আমরা শত্রুদের কিছুতেই আমাদেরকে ঘেরাও করতে দেব না। আমাদের হাতে তখন ছিল মর্টার আর ৫৬টা গোলা। নিরুপায় হয়ে শত্রুসৈন্যর উপর আমি মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করলাম। গোলার সংখ্যা কম হওয়াতে প্রতি দু-তিন মিনিট অন্তর শত্রুর অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করছিলাম। সেদিন মর্টারটি আমাদের অবস্থান থেকে সরে আদতে বিধাতার আশীর্বাদের মত সাহায্য করছিল।

 

সূর্য ওঠার পর দেখতে পেলাম আমাদেরকে ঘিরে ফেলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। প্রায় ১৪ ঘণ্টা ধরে আমাদের সঙ্গে তাদের গোলাগুলি বিনিময় চলল। অবশেষে সকাল ৯টার দিকে আমরা সিদাই থানায় পৌঁছাতে সক্ষম হলাম।