সাক্ষাৎকারঃ মেজর গফফার

<১০, ৪.৩, ১৫৩-১৭০>

সাক্ষাৎকারঃ মেজর গফফার

 

জুন মাসের শেষে শালদা এক রকম আমার নিয়ন্ত্রণেই ছিল আমি আমার নিজ সাবসেক্টর রেকি করে জানতে পারি, শালদা নদী গোডাউনে ৩০০০ মণের মত গম এবং চাল মজুদ আছে। খাদ্যসামগ্রীর প্রয়োজন আমাদের অতিরিক্ত ছিল। কেননা এতদিন পর্যন্ত স্থানীয় লোকের খাদ্যসামগ্রীর উপর নির্ভর করেই আমরা জীবনধারণ করছিলাম। তারা যা খেতে দিত তাই আমরা খেতাত জনসাধারণের এ সহযোগিতা না পেলে আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারতাম না। কিন্তু জনসাধারণের খাদ্য সাহায্য পর্যাপ্ত ছিল না। অনেক সময় আমাদের ফলমূল ও পানি খেয়েই জীবনধারণ করতে হয়েছিল।

শালদা নদী গোডাউনে খাদ্যসামগ্রীর কথা আমার সেক্টর কামান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফকে জানাই। তিনি আমাকে নির্দেশ দেন ৩০০০ মণ গম ও চাল যেন তাড়াতাড়ি সেক্টর হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।  আমি শালদা নদী গিয়ে ৩০টা নৌকা যোগাড় করে স্থানীয় এবং আমার সৈনিকদের সাহায্যে সমস্ত খাদ্যসামগ্রী নৌকাতে বোঝাই করি। কিন্তু স্থানীয় দালালরা আমাদের এ খাদ্যসামগ্রী সরানোর খবর কুটিতে অবস্থিত শক্রুসেনাদের জানায়। শক্রুরা কুটি থেকে গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্যে কামান থেকে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ গোলাগুলির মধ্যে আমরা সুন্দরভাবে আমাদের কাজ সম্পন্ন করি।

আমি কসবাতে দুটি কোম্পানী গঠন করি। একটি কোম্পানী ৪র্থ বেঙ্গল-এর ‘সি’ কোম্পানী নিয়ে গঠিত ছিল-অপর কোম্পানী ই-পি-আর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ এবং স্থানীয় লোকদের নিয়ে। আমি তাদের একমাস ধরে ট্রেনিং দেই এবং কোম্পানীতে অন্তর্ভুক্ত করি। তাদেরকে শক্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিভিন্ন অপারেশনে পাঠাতে শুরু করি। ঐ সমস্ত গ্রামের লোকেরা শক্রুদের গতিবিধির খবর দিয়ে, খাবার দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে, বস্ত্র দিয়ে আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।

আমি কসবার উপর আমার নিয়ন্ত্রন চালিয়ে যেতে থাকি। শক্রুরা যখনই প্রবেশের চেষ্টা করেছে তখনই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে তারা পশ্চাদপসরণ করেছে। আমি ঐ এলাকার রেললাইন তুলে ফেলে, রেললাইনের সেতু ও রাস্তার সেতু ভেঙ্গে দিয়ে শক্রুদের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেই। ইলেক্ট্রিক পাইলন, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনের থামও উড়িয়ে দেই। এ সমস্ত করার ফলে শক্রুরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হয়।

আমার কোন টেলিফোন সেট ছিল না। কিন্তু একমাসের মধ্যে শক্রুদের উপর হামলা চালিয়ে অনেক ক্যাবল ও টেলিফোন সেট দখল করি এবং তাঁর পরই আমি বিভিন্ন কোম্পানীর মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য টেলিফোন লাইন স্থাপন করি। এর ফলে আমার বাহিনীকে নেতৃত্ব ও নির্দেশ দেওয়া আমার পক্ষে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) আমাদের নির্দেশ দেন, শক্রুদের সাথে সামনাসামনি লড়াই না করে তাদের উপর আচমকা আক্রমণ চালাবার। তিনি এয়াম্বুশ, রেইড ও সেতু ধ্বংস, যাতায়াতের ক্ষতিসাধন ইত্যাদির উপর জোর দেওয়ার নির্দেশ দেন। এর ফলে শক্রুদের ক্ষতি হবে ব্যাপক এবং সে অনুপাতে আমাদের ক্ষতি হবে সামান্য। এ কৌশল খুবই উপযোগি হয়েছিল। এতে আমাদের সৈনিকদের মনোবল বেড়ে যায়। প্রতিদিন প্রতিরাতে শক্রুদের ওপর আচমকা আক্রমণ চালিয়ে তাদের অনেকেই নিহত বা আহত করছিলাম। শক্রুরা এক স্থান থেকে আরেক স্থান গেলে আমরা এয়ম্বুশ পেতে বসে থাকতাম এবং শক্রুরা এম্বুশের ফাঁদে পড়লে তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের ধ্বংস করতাম। আমি তাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাতাম প্রায় রাতেই। ফলে শক্রুরা রাত্রিবেলা বাঙ্কার থেকে বাইরে আসতো না। এমন কি দিনের বেলা এক প্লাটুন শক্তি ছাড়া তারা বের হতে চাইত না।               

একদিন পাকসেনারা আমার ডানপাশের সাবসেক্টর মনতলির সাবসেক্টর কামান্ডার আইনউদ্দিনের বাহিনী দ্বারা এয়াম্বুশ ফাঁদে পড়ে আক্রান্ত হয়। শক্রুদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। তারা আহত এবং নিহত সৈন্যদের ১টা রেলওয়ে ট্রলিতে ভর্তি করে রেললাইনের ধার দিয়ে পালাতে থাকে। আমি তালতলা আড়াইবাড়ীতে এয়াম্বুশ পেতে তাদের উপর আক্রমণ চলাই। আবার আক্রান্ত হবার ফলে তাদের আহত ও মৃত সাথীদের ফেলে পলায়ন করে। পরবর্তী সময়ে পাকসেনারা তাদের মৃত সাথীদের কবর দেয়ার জন্যে গঙ্গাসাগরের এক কবরস্থানে জড় হয়েছে। আমার কয়েকজন গুপচর এসে আমাকে এ খবর জানায়। আমরা সঙ্গে সঙ্গে অবস্থান নিয়ে দেখতে পাই সত্যিই শক্রুরা কবরস্থানে জড় হয়েছে তাদের সাথীদের কবর দেবার জন্য। আমি ৩” মর্টার এবং ভারী মেশিনগানের সাহায্যে শক্রুদের উপর আকস্মাত গোলাগুলি ছুড়তে থাকি। ফলে পাকসেনারা তাদের পুরাতন মৃত সাথিদের সঙ্গে আরো কয়েকজন নতুন সাথীকে কবর দেয়।     

পাকসেনারা তাদের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে কুটি সড়কের উপরে এবং মুল ঘাঁটি স্থাপন করে আড়াইবাড়িতে টি, আলীর বাড়িতে। সে সময়ে সমগ্র শালদা নদী এলাকা নয়নপুর রেলওয়ে ষ্টেশন পর্যন্ত আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল। তারা শলদা নদী পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে এবং সেজন্য এক কোম্পানী সৈন্যকে আড়াইবাড়ি থেকে জেলা বোর্ডের রাস্তা শালদা নদীর দিকে এগোতে থাকে। মনোলোবাগ রেলওয়ে ষ্টেশনের নিকট একটা প্লাটুন আগে থেকেই রেখেছিলাম। যখন শক্রুরা মনোলোবাগ রেলওয়ে ষ্টেশনের পাশের গ্রামে পৌছায় তখন তারা আমাদের এয়াম্বুশে পড়ে যায়। আমরা তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে একটি জীপ এম ৩৮ এআই, একটি ৩/৪ টনের ডজ ধ্বংস করে দেই। একজন অফিসারসহ ১৭জন নিহত হয় এবং ২০ জনের মত আহত হয়। আমরা গাড়ি নিয়ে আসতে পারিনি, কেননা শক্রুরা গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করছিল। ফলে গাড়িগুলি পুড়িয়ে দেয়া হয়। পরে আমরা অনেক অস্ত্রশস্ত্র, টেলিফোন সেট, টেলিফোন ক্যাবল, শক্রুদের শুকনা রেশন, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উদ্ধার করি। শক্রুদের বিচানাপত্র উড়িয়ে দেয়া হয়। আমরা একটা স্যুটকেস পাই গাড়ির ভিতর থেকে। স্যুটকেসটি টাকা ভর্তি ছিল কিন্তু তাকাগুলি গোলাগুলির ফলে পুড়ে গিয়েছিল। আমি সমস্ত কিছু আমার সেক্টর কামান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের হাতে তুলে দেই। ঐ টাকা ভর্তি স্যুটকেসটি দেখে আমাদের ধারনা হয় ঐ পাকিস্তানী অফিসারটি এসব টাকা ব্যাংক থেকে লুট করেছিল। পরে তারা বারবার চেষ্টা করেছিল শালদা নদীর অবস্থান দখল করার কিন্তু তারা বারবারই পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে যায়।         

সমগ্র কসবা ও শালদা নদী এলাকা জুলাই মাস পর্যন্ত আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল। লাটুমুড়া পাহাড়ী যায়গাটি আমার নিয়ন্ত্রণে রাখি। শক্রুর যদি লাটুমুড়া দখল করে নেয়, তবে ক্ষতি হবে। সেজন্য আমি একটি কোম্পানী তৈরী করে দুটি প্লাটুন সেখানে রাখি প্রতিরক্ষাব্যুহ শক্তিশালী করার জন্য। ফেনী মুন্সিরহাটে যাবার আগে কসবা সাব-সেক্টরের ভার ক্যাডেট হুমায়ুন কবিরের হাতে দিয়ে যাই।              

ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের (বর্তমান মেজর) অধিনায়কত্বে মুন্সিরহাট ফেনী সাবসেক্টর একটা গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তেজনাকর স্থান হয়ে দাঁড়ায়। ফেনী থেকে তিন মাইল দূরে চাগলনাইয়া, মুন্সিরহাট ও লক্ষীপুরে ১৭ মাইল লম্বা এবং ৮ মাইল প্রস্থ এই বিরাট অবস্থান জুড়ে বসে আছেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ও তাঁর বাহিনী। পাকসেনারা এ অবস্থানের উপর বিরাট শক্তি নিয়ে চাপ দিতে থাকে। ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তাঁর দু’জন অফিসার ও তিনটি কোম্পানি নিয়ে শক্রুদের কামান ও ট্যাঙ্কের সাথে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ২ নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের কাছে ফেনী মুন্সিরহাট অবস্থান রক্ষা করা এক চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ মুহূর্তে এখানে আরও শক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রাত দু’টার সময় মেজর খালেদ আমার ক্যাম্পে আসেন। আমি তখন ক্যাম্পে ছিলাম না, অপারেশনের জন্য বাইরে ছিলাম। যখন একশন করে ফিরে আসি তখন দেখি তিনি ফেনীর একটা ম্যাপ খুলে চিন্তিত মুখে বসে আছেন। তাঁকে খুব চিন্তিত এবং বিষন্ন দেখাচ্ছিল।

তিনি ধীরে এবং দ্রুত ফেনী অবস্থানের পরিস্থিতির কথা বলে গেলেন এবং কি করা যায় তার একটা পরামর্শ চাইলেন। একটা কোম্পানী ফেনীতে দ্রুত পাঠিয়ে দিতে তাঁকে অনুরোধ করলাম। মেজর খালেদ আমাকে একটা কোম্পানীসহ সেখানে যাবার জন্য বললেন। আমি এটা আগেই বুঝেছিলাম কিন্তু কসবার ভার কার হাতে দেয়া যায় এ নিয়ে একটু দ্বিধা ছিল। কেননা কোন নতুন অফিসারের পক্ষে কসবা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভবপর ছিল না। যা হোক ক্যাডেট হুমায়ুন কবিরের হাতে ( বর্তমানে ক্যাপ্টেন) আমার ১ নং কোম্পানী ও কসবা সাবসেক্টরের ভার দিয়ে আমি সকালে একটি কোম্পানী নিয়ে ফেনীর দিকে রওয়ানা হই। যাবার সময় আমার ২নং কোম্পানীকে সমস্ত পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলি। আমি ক্যাডেট হুমায়ুন কবিরকেও সমস্ত পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলি এবং লাটুমুড়া অবস্থানের গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁকে বলি। এ জায়গাটা ছিল পাহাড়ের উপর। এখান থেকে সমগ্র স্থান নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ ছিল। পাকসেনারা এ স্থান পুনরুদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালাবে। কেননা এর আগে তারা অনেক বার চেষ্টা চালিয়ে সফল হতে পারেনি। কিন্তু অত্যান্ত আশ্চর্যের ব্যাপার আমরা কসবা ছেড়ে যাবার পর এক সাপ্তাহের মধ্যে শক্রুরা লাটুমুড়া দখল করে নেয় এবং ১নং কোম্পানীর কয়েকজন সাহসী যোদ্ধা এতে মারা যায়। নভেম্বর মাস পর্যন্ত পাকসেনারা লাটুমুড়ার উপর কতৃত্ব রেখেছিল। ভারত এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ন শক্তি নিয়ে নভেম্বর মাসে শক্রুদের সরিয়ে দিতে পারা যায়। শক্রুদের সরাতে ৩ জন অফিসারসহ ৪০ জন সৈন্য মারা যায় এবং ৬০ জনের বেশি আহত হয়। লাটুমুড়া অবস্থানের গুরুত্ব এ হতাহতের থেকেই বুঝা যায়। শক্রুদের কতজন মারা গিয়েছিল তা আমার জানা নাই।

যাই হোক, পরের দিন সকালে ২ নং কোম্পানীকে সাথে নিয়ে ফেনীর পথে রওনা দির। ৬ই জুন সন্ধ্যা ৫টার সময় বেলুনিয়া পৌছি। তারপর  ১৪ মাইল কাদামাটির রাস্তা ভেঙ্গে আমি এবং আমার সৈন্যরা রাত ৮টার সময় মুন্সিরহাট নুতন বাজার পৌছি, যা জাফর ইমামের অবস্থান থেকে ৮০০ গজ দূরে ছিল। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমরা কোন বিশ্রাম নেইনি এবং পেটেও কিছু পড়েনি। আমার কোম্পানীকে আমি এখানে বিশ্রাম নিতে বলি। তারপর আমরা ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের সাথে দেখা করার জন্য তাঁর ক্যাম্পের দিকে রওনা হই। তাঁর সাথে দেখা করে অবস্থানটি দেখি। প্রতিরক্ষাব্যুহ দেখে আশ্চর্যবোধ করি। প্রতিরক্ষাব্যুহ খুব শক্তিশালী ছিল না। মুল অবস্থানের ডানদিকে একেবারে ফাঁকা এবং খোলা অবস্থায় ছিল। বাঁয়ে অবস্থানরত লেঃ ইমামুজ্জামানের বাহিনীর সাথে জাফর ইমামের বাহিনীর দুরত্ব অনেক ছিল। এত দুর্বল অবস্থানের জন্য ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে দোষ দিতে পারি না কেননা সৈন্যসংখ্যা ছিল সীমিত। যাহোক প্রতিরক্ষাব্যুহকে সুদৃঢ় করার জন্য আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে নিম্নোক্ত ব্যাবস্থা নিতে বলি।

(ক)  আমার কোম্পানী থাকবে অবস্থানের ডানদিকে। দুটি প্লাটুন উপরে এবং ১টি প্লাটুন ভিতরে।       

(খ) ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের বাহিনী তাঁর অবস্থানেই থাকবে কিন্তু সৈন্যদের আরো সংগঠিত করতে হবে। ডিফেন্স ভিতরেই নিতে হবে।

(গ) লেঃ ইমামুজ্জামান বাঁয়ে থাকবে কিন্তু দুরত্বটা কমিয়ে আনতে হবে। ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের বাহিনীর সাথে সংযোগ রাখতে হবে।

(ঘ) মুন্সিরহাটের নিকটে মূল অবস্থানের সাথে সংযোগ রেখে ক্যাপ্টেন শহীদের বাহিনী অবস্থান নেবে।

কিন্তু ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমার পরিকল্পনা মেনে নেয় না। আমি এরপর মেজর আমিনের কাছে যাই এ ব্যাপারে পরামর্শ নেবার জন্য। মেজর আমিন তখন ঐ অঞ্চলের কামান্ডার ছিলেন। মেজর আমিন ও ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম বুঝতে সক্ষম না হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। মেজর খালেদ তখন সেখানে ছিলেন না।

সময় খুব সঙ্কটজনক থাকায় দেরি না করে আমি আমার একটা প্লাটুনকে ডানদিকে একিনপুরে অবস্থান নিতে বলি। ১টা প্লাটুনকে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ও লেঃ ইমামের ফাঁকা স্থানে অবস্থান নিতে বলি এবং আরেকটা প্লাটুন মুন্সিরহাটে অবস্থান নেয়।   পাকসেনারা যেকোন মুহূর্তে আমাদের আক্রমণ করতে পারে। এই নতুন অবস্থানের পর মোটামুটি আশ্বস্ত হই কিন্তু পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। তার উপর আমাদের কোন ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল না, কেবলমাত্র ৩ইঞ্চি ৮১ এম-এম মর্টার ছাড়া। শক্রুরা প্রতিদিন আমাদের উপর ছোট ছোট আক্রমণ চালাতে থাকে এবং আমরাও এম্বুশ এবং আচমকা আক্রমণ চালিয়ে তাদের পর্যুদস্ত করতে থাকি। শক্রুরা গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্যে কামান দিয়ে আমাদের উপর গোলা ছুড়তে থাকে এবং প্রতিদিন আমাদের কিছু কিছু লোক আহত হয়। শক্রুদের হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রচুর। এ সময় মেজর খালেদ আমাদের অবস্থান দেখতে আসেন এবং আমি সমস্ত পরিস্থিতি তাঁকে খুলে বলি। আমি আমার পরিকল্পনার কথা তাঁকে বলি এবং তিনি আমার পরিকল্পনা মেনে নেন। কিন্তু এবারও ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম পরিকল্পনা মেনে নিতে রাজি হয় না। কিন্তু ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম স্থানীয় লোক হওয়ায় মেজর খালেদ তাঁকে আর চাপ দেয় না। যাই হোক, আমাকে আমার পুরাতন অবস্থানই রাখতে হলো। আমরা মেজর আমিনকে খাদ্য ও বস্ত্র সরবরাহের দিকে লক্ষ্য রাখতে বললাম। এ অবস্থানে আমরা কয়েকদিন অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। তখন ছিল বর্ষাকাল। রাস্তাঘাট কাদায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অস্ত্রশস্ত্র ১৪ মাইল দূরে বেলুনিয়া থেকে কাঁদা ভেঙ্গে আনতে হত। এ অসুবিধা সত্ত্বেও মেজর আমিন যতখানি পেরেছেন আমার জন্য করেছেন। তিনি কাঁদার রাস্তা ভেঙ্গে যত দ্রুত অস্ত্রশস্ত্র ও খাবার পৌছানো যায় তার ব্যবস্থা করেছেন। ভারতীয় বাহিনীর গলান্দাজ বাহিনীর যাতে সাহায্য পাওয়া যায় তার চেষ্টা আমরা করেছিলাম কিন্তু তা সফল হয়নি। গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্য না পেলেও মিত্র বাহিনীর  সেনারা মর্টারের সাহায্যে তাদের উপর গোলা ছুড়ছিল। এটা আমাদের মনোবল বাড়াতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। আমার সৈনিকরা এত উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল যে তারা বাঙ্কার ছেড়ে বেরিয়ে এসে বলতে থাকে, “স্যার ভারতী বাহিনী যদি আমাদের সাহায্য করে, তবে আমরা আজই ফেনী দখল করে নিতে পারব।” কিন্তু এটা যে সম্ভব নয় তা আমার সৈন্যদের বুঝানো মুশকিল হয়ে পড়েছিল।

আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিলো পুরান আমলের এবং অতি সামান্য। সে তুলনায় শক্রুদের শক্তি ছিলো একটা ব্রিগেড, এক রেজিমেন্ট আর্টিলারী ও ট্যাঙ্ক বাহিনী। এ ছাড়া ছ’টি হেলিকপ্টার ছিল শক্রুসেনাদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাবার জন্য। মর্টার ছাড়াও কিছু মেশিনগান ও হালকা মেশিনগান আমাদের সঙ্গে ছিল।

যাহোক, আমরা আচমকা আক্রমণ চালিয়ে শক্রুদের ব্যাতিব্যস্তরাখছিলাম। আমরা প্রতিদিন তাদের অনেককেই হতাহত করছিলাম। তাদের শক্তি অত্যাধিক হওয়ায় তারা হতাহতের স্থান পূরণ করতে পারছিল। আমাদের হতাহতের সংখ্যা সামান্য হলেও তা পূরণ করতে আমরা সমর্থ ছিলাম না। আমরা চিন্তা করছিলাম শক্রুরা যেকোন মুহূর্তে প্রবল শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ‘৭১ এর ১৭ই জুন সকালে শক্রুরা গোলান্দাজ বাহিনীর কামানের সাহায্য নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ শুরু করেছিল। কামান ছাড়াও শক্রুদের আর-আর, মর্টার,মেশিনগান, চাইনিজ রাইফেল তো ছিলোই। আমাদের অবস্থানের অবস্থা থেকে সহজেই বুঝা যায় এ এক অসম যুদ্ধ। পাকিস্তানী সৈন্যরা ৭ ঘন্টা ধরে স্রোতের মত এগোতে থাকে। সাত ঘন্টা পর আমাদের হাতে চরম মার খেয়ে তারা পিছু হটে যায়। এমনকি তারা তাদের অনেক মৃতদেহ ইলোনিয়া নদী ও অন্যান্য স্থানে ফেলে রেখে পালায়। মৃতদেহগুলি পড়ে শকুন ও কুকুরে খায়।

পাকিস্তন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান তখন ঢাকাতে ছিলেন। ফেনীর খবর শুনে তিনি নিজে এর গুরুত্ব বুঝাবার জন্য ফেনীতে আসেন। তিনি ফেনীতে এসে ধারণা করেন মুজিবনগর আশেপাশেই আছে। সেহেতু মুন্সিরহাট দখল করার জন্য তিনি নিজে এবং দু’জন ব্রিগেডিয়ারকে নিয়ে আমাদের তিনজন ক্যাপ্টেন ও একজন লেফটেন্যান্টের বিরুদ্ধে লড়াই করে বুঝিয়ে দেন যে বঙ্গশারদুলরা তাদের থেকেও কম নয়। এ যুদ্ধ আমাদের জন্য এক বিশাল গৌরব। এ যুদ্ধে পাকিস্তানের এক ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দেন ফ্রন্টিয়ার ফোরসের মেজর আশিফ, যার সাথে আমরা একসঙ্গে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম।

এসময় আমাদের সেক্টর-২ এর কামাণ্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ খবর পাঠান যে, ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের প্রধান জেনারেল আরোরা হেলিকপ্টার করে আমাদের অবস্থান দেখতে আসতে পারেন। তাঁর হেলিকপ্টারে গুলি না চালানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু আমার মনে হয় পাকসেনারা এ খবর পেয়ে গিয়েছিল, ফলে তিনি আর আসতে পারেননি।

তখন ছিল বর্ষাকাল। ২০শে জুন সারাদিন সারারাত ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল। ২১শে জুনের আকাশ ছিল মেঘলা এবং ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি সকাল থেকে অস্বস্তি বোধ করছিলাম। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে বিরাজ করছিল অস্বস্তি। আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কাছে যাই সমস্ত পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনার জন্য। বিকেল ৫টা সময় আমি আমার অবস্থানে ফিরে আসি। আমি আমার সমস্ত
কামান্ডারকে ডেকে পাঠাই। রাত্রে আমরা আমাদের অবস্থানে আলো জ্বালাতাম না, কেননা আলো শক্রুদের দৃষ্টিগোচর হবার সম্ভাবনা ছিল। তাই খাওয়াদাওয়া আলো শেষ হবার আগেই সেরে ফেলতে হত। আমার বাঙ্গারে যখন ২টা রুটি ডাল সহযোগে খেতে বসেছি তখন হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনতে পাই। আমার আরদালী দৌড়াতে দৌড়াতে এসে খবর দেয় দুটি হেলিকপ্টার আমার হেডকোয়ার্টারের পিছনে উড়ছে- যা পশ্চিম দিক অর্থাৎ ভারতের দিক থেকে আসছে। আমি ভাবলাম ২৪ ঘন্টা অতিরিক্ত বৃষ্টি হবার জন্য হয়ত জেনারেল আরোরা কাল আসতে পারেন নি, আজ আস্তে আস্তে বৃষ্টি হচ্ছে তাই এসেছেন। এ চিন্তা করে কিভাবে সম্বর্ধনা জানাবো ভেবে হেলিকপ্টারের দিকে দৃষ্টি রাখি। হেলিকপ্টার দুটি নিচু দিয়ে ১৮০ ডিগ্রি যাবার পর দুটি দুদিকে যায়। ১টি হেলিকপ্টার বাঁ অবস্থানে পূর্বদিকে এবং অন্যটি আমার হেডকোয়ার্টারের উপর দিয়ে উত্তর দিকে ১০০০ গজ পর্যন্ত যায়। সন্দেহ জাগে দুটি হেলিকপ্টার দু’জায়গায় নামছে কেন? হঠাত আমার মনে সন্দেহ জাগে এবং আমার বিশেষ প্লাটুনের কামান্ডার নায়েক সুবেদার শহীদকে ডেকে পাঠাই। ১৫ মিনিট অতিক্রান্ত হবার পর দেখি দুটি হেলিকপ্টারই ভারতীয় সীমান্তের দিকে যাচ্ছে। হঠাত বাঁ দিক ও পিছন দিক থেকে গুলি আসতে থাকে। তখন ছিল অন্ধকার। শক্রুরা গ্রেনেড, এম-জি ও হালকা মেশিনগানের সাহায্যে আমাদের উপর গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। আমি সহজেই বুঝতে পারি এটা পাকিস্তানী কমান্ডোদের কাজ। আমি বুঝতে পারি এটা জেনারেল আরোরার হেলিকপ্টার নয়, শক্রুরা হেলিকপ্টারের সাহায্যে পেছনে অবস্থান নিয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে নায়েক সুবেদার শহীদ এবং ই-পি-আর এর সুবেদার ফরিদ আহমেদকে নির্দেশ দেই সমস্ত সৈন্যদের অতিসত্বর আমার নিকট হাজির করার জন্য। তারা সমস্ত পরিস্থিতি বুঝতে পারে এবং ১০ মিনিটের মধ্যে এসে খবর দেয়। আমি দ্রুততার সঙ্গে নতুনভাবে আমার বাহিনীকে সজ্জিত করি। প্রধান রাস্তা এবং রেললাইনের উপর তাদের অবস্থান নিতে বলি এবং আরও বলি আমি গুলি চালালে তোমরা গুলি চালাবে। এ রাত ছিল খুবই অন্ধকার এবং কোন কিছু দেখা যাচ্ছিল না। আমি আমার বাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান (সেকেন্ড-ইন কামান্ড) সুবেদার খুরশিদ আলমকে উত্তর এবং পশ্চিম দিকের প্রতি নজর রাখতে বলি এবং আমি পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকে নজর রাখি। পাক কামান্ডোদের হামলার অপেক্ষা করতে লাগলাম। এ আমার জিবনে এক চরম পরীক্ষা ছিল। একটু ভুল করলে আমরা সবাই ধ্বংস হয়ে যাব। সে রাতের কথা মনে পড়লে আজও আমার শিরন জাগে। এ সময়ে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমার কাছে খবর পাঠান যে তিনি এফডিএল-এর (ফরোয়ার্ড ডিফেন্ডেড লোকালটি) পথ দিয়ে এগোচ্ছেন।
পাক গোলান্দাজ বাহিনী কামান, মর্টার, আর-আর-এর সাহায্যে আমাদের উপর অবিরাম বৃষ্টির মত গোলা ছুড়তে শুরু করে দিয়েছে। বৃষ্টির মত গুলাগুলি ২ ঘণ্টা ধরে চলে। কিন্তু আমরা তাদের সামনে অগ্রসরের চেষ্টা রুদ্ধ করে দেই। ইতিমধ্যে দ্বিতিয়বারের মত হেলিকপ্টারের সাহায্যে পাকবাহিনী পিছনে আবার তাদের কামান্ডোদের নামিয়েছে। রাত ৯টার সময় লেঃ ইমামুজ্জামানের কাছ থেকে খবর পাই তারা পাকসেনা কতৃক আক্রান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে মর্টার সেকসনের কামান্ডার সুবেদার জব্বার খবর পাঠায় যে, মর্টার সহযোগিতা করা আর সম্ভব নয়, কেননা ইতোমধ্যে সমস্ত মর্টার শেষ হয়ে গেছে। সাহায্য পাবার আশা না থাকায় আমি একিনপুর থেকে অবস্থান সরিয়ে নেই। লেঃ ইমাম আমাকে ফোনে খবর পাঠায় পাক কামান্ডোরা সামনে থেকে তাদের আক্রমণ চালিয়েছে এবং পাঠাননগরের দিকে এগোচ্ছে। তার কাছে আর গোলাবারুদ নেই। আমাকে সে অনুরোধ জানায় কিছু গোলাবারুদ যেন অতি সত্বর ইমামুজ্জামানের কাছে পাঠায়। লেঃ ইমাম আমাকে আরো জানায় ছাগলনাইয়া  থেকে মুহুরী নদীতে যে প্রতিরক্ষাব্যূহ ছিল তা সন্ধ্যায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে। যোগাযোগের অভাব হেতু সে এ খবর আগে পাঠাতে পারেনি। প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙ্গে যাওয়ায় সে ফুলগাজির দিকে চলে যাচ্ছে। আমি আমার ডাকপাশের বাহীনিকে অবস্থান তুলে নিয়ে মুহুরী নদী হয়ে ফুলগাজিতে অবস্থান নিতে বলি।

রাত ৯টার দিয়ে আমার হেডকোয়ার্টার কামাণ্ডোদের দ্বারা আক্রন্ত হয়ে। পাঠাননগর অগ্রসরমান শত্রুসেনারা বাঁ দিক এবং সামনের দিক দিয়ে আক্রমন চালায়। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমার কাছে খবর পাঠায় ২নং সেপ্টেম্বর কমাণ্ডার মেজর খালেদ আমাদের অবস্থান নিয়ে ফুলগাজির পেছনে চিতরিয়ায় অবস্থান নিতে বলেছে। ঠিক সময়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, অন্যথায় আমরা সবাই শত্রুদের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম।

 

পাক কামণ্ডো এবং অন্যান্য সৈন্যরা আস্তে আস্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন। আমি দেখতে পেলাম শত্রুরা দুটি গ্রুপে বিভিক্ত হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রত্যেক গ্রুপে ২০/৩৫ জন শত্রুসেনা ছিল বাঁ দিকের গ্র“পটি ২০/৩৫ গজ দূরে এবং অন্যাটি ৩০/৪০ গজ দূরে। আমি এবং আমার সৈন্যরা সবাই এক সাথে শত্রুদের উপর ঝঁপিয়ে পড়লাম। তারাও আমাদের উপর গুলি চালাতে লাগল। গোলাগুলি বিনিময় আটাঘণ্টা ধরে চলল এবং শত্রুরা ৮টা মৃতদেহ ফেলে রেখে পিছনে সরে যেতে লাগল।

 

ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম দু’জন গুরুতরভাবে আহত মুক্তিযোদ্ধাকে প্রথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য আমার নিকট পাঠিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আমাদের পার্শ্ববর্তী ঘাঁটি ফুলগাজীতে পৌঁছানোর কোন দ্রুত ব্যবস্থা ছিল না আমি তাদের আরও ১২ জন আহত মুক্তিযোদ্ধার সাথে পাকে ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে রেখে দেই। এরিয়া কামণ্ডার মেজর আমিন ফুলগাজী থেকে আমার হেডকোয়ার্টরে আসনে। আমি থাকে আমার অবস্থানের দ্রুতঅবনতির কথা জানাই। তিনি দ্রুত আহত সৈনিকদের পশ্চৎবর্তী ঘাঁটি ফুলগাজী-চিতলিয়াতে পৌঁছানো ব্যবস্থা করেন। আহত সৈনিকদের উপর যাতে হামলা না হয় তার জন্য তাদের সাথে একটা প্রহরা (এসকট) পার্টিও দেই।

 

তখন রাত সাড়ে দশটা। যুদ্ধ কিছু সময় হল থেমে আছে। যতদূর সম্ভব শত্রুরা সে সময় শক্তি সঞ্চয় ব্যস্ত ছিল। এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তাঁর ও তাঁর বাহিনীর অবস্থান তুলে নিয়ে আমার কাছে আসেন। আমার তাড়াতাড়ি দ্রুত পরিস্থিতি অবনতির কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিই আমি আমার অবস্থানে থাকব এবং ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম সৈন্যদের নিয়ে পার্শ্ববর্তী ঘাঁটি ফুলগাজীতে সরে যাবেন। সেই অনুযায়ী তিনি ফুলগাজীর দিকে রওনা দিলাম। ভোর ৪টা মধ্যে সমস্ত সৈন্য ফুলগাজীতে চলে যায়। এবং আমি ভোর সাড়ে ৫টার সময় আমি আমার অবস্থান পরিত্যাগ করে ফুলগাজীর দিকে রওনা দেই । আমাদের পার্শ্ববতী ঘাঁটিতে যাওয়াটা খুব সুন্দর ভাবে হয়েছিল সকালে ফুলগাজীতে মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে দেখা হয়। তিনি সেখানে অবস্থান করেছিলেন। ফুলগাজী অত্যধিক ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় এখান থেকে শত্রুদের মোকাবিলা করা অসম্ভব ছিল, ফলে আমরা চিতলিয়া যাবার সিদ্ধান্ত নেই। যাবার আগে ফুলগাজী ব্রীজ উড়িয়ে দিয়ে একটা ডিলেইং পার্টি এবং চিতলিয়া আসি এবং নতুন অবস্থান তৈরি করি। আমি আমার বাহিনী নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলাবোর্ড সড়র এবং রেললাইনের উপর অবস্থান নেই ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তার বাহিনী নিয়ে পরশুরাম এলাকায় অবস্থান নেন। বাঁ দিকে বাহিনী নিয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলেন। এভাবে আমার দ্রুত চিতলিয়াতে প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তুলি।

 

ইতিমধ্যে পাকসেনারা ফুলগাজী ব্রীজ পর্যন্ত এগিয়ে পূর্বেই উল্লেখ করেছি ফুলগাজী ব্রীজ শত্রুদের এগোতে বাধা দেয়ার জন্য ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। এ ব্রীজ এসে শত্রুরা বাধা পায় এবং ২৪ ঘণ্টারও বেশী সময় পর্যন্ত তারা আর এগোতে পারেনি ৪৮ ঘন্টা যাবৎ শত্রুদের বাধা দিতে থাকি, ফলে শত্রুরা অ্যাধিক গোলাবর্ষণ করতে থাকে। তাতেও ব্যর্থ হয়ে তারা হেলিকপ্টার ব্যবহার করে ব্রীজের এপারে আসে। চিতলিয়া যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে শত্রুরা হেলিকপ্টার সাহায্য মুহুরী নদী পার হয়ে আসে। এবং লেঃ ইমামুজ্জামানের বানিহীকে ঘিরে ফেলে। সে তাড়াতাড়ি তার বাহিনী পিছনে সরিয়ে নিয়ে যায়। যাবার আগে সে আমাকে জানাতে পারেনি। ডানদিকে আমার যে প্লাটুনটি ছিল, শত্রুদের গোলাগুলির মুখে তারা তাদের অবস্থান টিকে রাখতে পারে না। তারা অবস্থান ত্যাগ করে যায় এবং শত্রুরা সে অবস্থান দখল করে নেয়। ব্যাটলিয়ন হেডকোয়র্টার থেকে জানানো হয় অন্যান্যে প্রতিরক্ষাব্যূহতে সৈন্যরা ঠিকমতই অবস্থান নিয়ে আছে।

 

শত্রুরা ডাক এবং বাম দিক ও সম্মুখ থেকে আমার বাহিনীর উপর আক্রমন চালিয়ে যাচ্ছে। শত্রুর অবস্থান জানাবার জন্য নায়েক সুরেদার বেলায়েত হোসেনকে ডান দিকে পাঠাই এবং আমি নায়েক সুবেদার শহীদকে নিয়ে বাঁ দিকে যাই। আমি গিয়ে দেখতে পাই শত্রুরা মাত্র ৫০০ গজ দূরে এবং আমি সঙ্গে সঙ্গে মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসি এবং দেখতে পাই নায়ক সুবেদার বেলায়েত হোসেন আমার জন্য অপেক্ষ করে দাঁড়িয়ে আছেন। সে জানায় আমাদের আগের অবস্থান থেকে শত্রুরা আক্রমণ চালাচ্ছে। বিকেল ৫ টা দিকে শত্রুরা তিনদিক থেকে আক্রমণ শুরু করে দেয়। আমরা আক্রমণ প্রতিহত করতে শত্রুরা আমাদের সমস্ত যোগাযোগ পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু শত্রুসেনা ছাগলনাইয়া হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে এবং আমাদের একমাত্র যোগাযোগ পথ পরশুরামের রেলওয়ে ব্রীজ ও সড়কসেতু ঘিরে রাখে।

 

৩৬ ঘণ্টার মধ্যে আমার বাহিনী কারো মুখে খাদ্য জোটেনি। আমরা অভুক্ত ছিলাম এবং গোলাবারুদ নিঃশেষ হয়ে আসছিল । আমি সেক্টর- ২ এর হেডকোয়ার্টারে খবর পাঠাই সত্বর খবার এবং গোলাবারুদ পাঠানোর জন্য, কিন্তু হেডকোয়ার্টার খবর পাঠায় যে ভারতীয় বাহিনীর গোলাগুলি দেবার যে কথা ছিল তা এখনও এসে পৌঁছেনি- সেহেতু আমি আমার অবস্থান তুলে নিয়ে যেন পরশুরাম চেকপোষ্টের দিকে এগিয়ে যাই।

 

অবস্থান তুলে নেবার নির্দেশ পেলেও শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হবার ফলে আমি আমার বাহিনী তুলে নিতে পারছিলাম না। শত্রুরা ধীরে ধীরে আমাদের নিকটে চলে আসছিল। এ মুহুর্তে আমার বাহিনীকে জোগাড় করা মুস্কিল ছিল, কেননা শত্রুরা গোলান্দাজ বাহিনীর কামান বৃষ্টির মত আমাদের উপর গোলা ছুড়ছিল। আমার সে সময়ে গোলাবারুদ একরকম নিঃশেষ হয়ে এসেছিল। প্রতিটি রাইফেলের জন্য ১০ রাউন্ড এবং হালকা মেলিনগানের জন্য ৫০ রাউন্ডের বেশি গুলি ছিল না। আমি সব প্লাটুন কমাণ্ডারদের ডেকে পাঠাই এবং তাদেরকে রেললাইনের পূর্বদিকে সরে যাবার নির্দেশ দেই। যা হোক কোনক্রমে আমি আমার বাহিনীকে আমি নিরাপদে পরশুরামে নিয়ে আসতে সক্ষম হই। আমি সেখানে পৌঁছে দেখি হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন জাফর ইমামও তাঁর বাহিনী সরিয়ে নেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।

 

পরশুরামে থেকে অবস্থান তুলে নেবার কাজু দ্রুতগতিতে চলতে থাকে। কিন্তু শত্রুরা আমাদের অবস্থান পরিত্যাগের কথা জানতে পারে এবং আমাদের পিছু ধাওয়া করে। শত্রুরা বৃষ্টির মত আমাদের উপর গোলাগুলি চালাতে থাকে। আমরা দ্রুত খালে নেমে শত্রুরা গোলাগুলির হাত থেকে রক্ষা পাই। সকাল ৬টার মধ্যে আমরা নোয়াখালী হেডকোয়ার্টারে পৌছি।

 

নিদ্রহীন এবং অভুক্ত থাকার জন্য আমার বাহিনীর অর্ধেকের মত সৈন্য অসুস্থ হয়ে পড়ে। ২৬ শে জুনে সেক্টর- ২ এর কমাণ্ডার মেজর খালেদা নোয়াখালী হেডকোয়ার্টারে আসেন। তিনি এখানে সব কমাণ্ডারদের নিয়ে এক সভা করেন। তিনি আমাকে আমার বাহিনী নিয়ে ১২ ঘণ্টার মধ্যে শালদা নদীর কোনাবন এলাকায় যাবার নির্দেশ যেন। সে সময়ে পাকসেনারা এ এলাকায় খুব দিচ্ছিল। মেজর খালেদ এবং আমার বাহিনীর জন্য যাবনবাহনের ব্যবস্থা করে দেন।

 

২৭ শে জুন আমি আমার কসবা সাবক্টের হেডকোয়ার্টরে পৌঁছে। বসবাতে পৌছি। আমি আমার বাহিনী যেটা কসবায় রেখে গিয়েছিলাম, তাদের যোগাড় করতে থাকি। কসবায় এসে দেখি পানসেনারা গুরুত্বপূর্ণ লাটুমুড়া পাহাড়ী এলাকাটি সহ সমগ্র কসবা এলাকা দখল করে নিয়েছে। যহোক, আমি কোম্পানী যোগাড় করে শলদা নদী-নাবনের দিকে অগ্রসর হই। ক্যাপ্টনসা সালেক ছিলেন শালদা নদী সাবসেক্টরের কমাণ্ডার। মন্দভাগ- কোনাবনে আমাদের সৈন্যই ছিল না। শত্রুরা শালদা রেলওয়ে ষ্টেশন, ‘বায়েক’, মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশন দখল করে রেখেছিল। যাহোক আমি আমার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি। সে থেকে আমার সাবসেক্টর কোনবন সাবসেক্টর বলে পরিচিত ছিল। আমার সাবসেক্টর উত্তরে কসবা- জাদেশ্বর এবং দক্ষিণে ‘বায়েক’ নিয়ে বিস্তৃত ছিল। পূর্ব পশ্চিমে ছিল সি-এন্ড-বি সড়ক বারবার কোম্পানীগঞ্জ পর্যন্ত। আমি আমার সাবসেক্টর জুড়ে রেকি করি এবং কোম্পানী কমাণ্ডারদের নিয়ে কোম্পানীগুলিকে পুনর্গঠিত করে ফেলি। আমার প্রথম কর্তব্য হয়ে দাড়াঁল আমার বাহিনীকে নিয়ে একটা স্থাপন করা মনঃপূত মনে করিনি। তাই আমার হেডকোয়ার্টার কোনবনে স্থাপন করি।

 

৩০শে জুন সকাল শত্রুদের শক্তিশালী ঘাঁটি মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশন আক্রমন করি ৫ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর বেলা সাড়ে ১২ টা সময় শত্রুরা মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশন ছেড়ে চলে যায়। মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশন দখল করার পর ঐ দিনই আরও ৪/৫টা গ্রাম মুক্ত করে নেই । এভাবে আমি প্রতিরক্ষাব্যূহ ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা গড়ে তুলি। সন্ধ্যা পর্যন্ত দু’বার শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমণ চালায় কিন্তু তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর অনেক বার শত্রুরা চেষ্টা করেছিল এ এলাকা দখল করার জন্য কিন্তু পর করুণাময় আল্লাহর রহমতে তাদের প্রচেষ্টা দেশ মুক্তি হবার আগে পর্যন্ত সফল হয়নি। প্রায় ৪ লক্ষের মতো লোক পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নেয় । তাদের আত্মত্যাগের কথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্বর্ণক্ষরে লিখে রাখা দরকার। তারা আমাদের মনোবল অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা অনেক কাজ আমাদের সাহায্যও করতে। পাকসেনারা মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে বিতাড়িত হবার পর মন্দভাগ বাহিনী আশ্রয় নেয়। মন্দভাগ বাজার, আড়াইবাড়ি ও নয়নপুরে তারা সাঁজেয়া ও গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে আসে। আমার কোন অপরেশন করলেই গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য আমাদের এলাকায় কামানের গোলা ফেলত।

 

এরপর আমি মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশনের দক্ষিন ‘ বায়েক’ গ্রাম দখল করার পরিকল্পনা নেই। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমার যখন বাঙ্কার থেকে উঠে আসতাম তখন এ গ্রামে অবস্থানরত শত্রুসেনারা আমাদের উপর গুলি ও ৮২- এম-এম চাইনিজ মার্টারের সাহায্য গোলা চালাত। ঐ গ্রাম আমি দখল করে নেই এবং শত্রুদের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রকিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলি।

 

এই দুই আক্রমণে আমার আমার বাহিনীর বেশ হতাহত হবার ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম, এ,জি ওসমানী নির্দেশ পাঠান সামসাসামনি যুদ্ধ না করার শত্রুদের ক্ষতিসাধন করার জন্য তিনি এ্যামবুশ এবং হঠাৎ করে আক্রমণ করার নির্দেশ দেন।

 

কর্ণেল ওসমানীর নির্দেশ পাবার পর আম আচমকা আক্রমণের পথকেই বেছে নেই এবং এতে প্রভূত সাফল্য লাভ করি। এ পরিকল্পনার জন্য ‘সি’ কোম্পানীর ১টা প্লাটুনকে নিয়োগ করি এবং ১টা কোম্পানী সুবেদার গোলাম আম্বিয়া নেতৃত্বে ১টা কোম্পানী ২নং সেক্টরের কমাণ্ডার মেজর খালেদ আমার নিকট পাঠান। সুবেদার গোলাম আম্বিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল। পরে আমাকে ৪র্থ ইষ্ট বেঙ্গল- এর নেতৃত্ব দেয়া হয়। তখন আমি ১৫ আগস্টে ‘ডি’ কোম্পানী গঠন করি সুবেদার আম্বিয়ার কোম্পানীকে নিয়ে। এই দুই কোম্পানী স্বাধীনতার যুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল। এই দুই কোম্পানীকে নিয়ে। থেকে বায়েক পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল এবং ক্যাপ্টন খালেকের সৈন্যারা কাটামোড়া থেকে গৌরাঙ্গাতলা ও নয়নপুর রেলওয়ে ষ্টেশন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল।

 

পূর্বেই উল্লেখ করেছি গেরিলা তৎপরতার জন্য আমি ১টা প্লাটুনকে নিয়োজিত রেখেছিলাম। বাছাই করা লোকদের এ কাজ নিয়োগ করি। এ কাজ নিয়োগ করি। এ কাজে আমি একজন অতি সাহসী জুনিয়ার অফিসারকে পাই। সে হচ্ছে সুবেদার ওহাব। তার নাম স্বাধীনতা যুদ্ধের পর্থপ্রদর্শক হিসেবে লিখিত থাকা উচিত। সে নিজের জীবনের মায়া, ত্যাগ করে সত্যি প্রকৃত বাঘের মত শত্রুদের উপর ছাঁপিয়ে পড়ত। সে কোনদিন কোন অভিযোগ আমার কাছে করে নাই। এমনকি অনেকদিন অভূক্ত অবস্থায় দিন কাটিয়েছে। তাকে যে কাজের ভার দেয়া হয়, তা সাফল্যের সাথে করে। কোন অপারেশন সে কোনদিন বিফল হয়নি। এ প্রসঙ্গে আমি আরেক জনের নাম কবর। সে হচ্ছে মর্টার সেকশনে সামসুল হক। তার নিখঁত সাহসিকতার কাজের জন্য আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল পাকসেনাদের বিপর্যস্ত কার। তার কাজের জন্যই সাবসেক্টর শত্রুদের জন্য করবস্থানে’ পরিণত হয়েছিল। পূর্বেই উল্লেখ করেছি দেশ শত্রুমুক্ত হওয়া পর্যন্ত দীর্গ ৯ মাস মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশনে ও তার আশেপাশের এলাকা শত্রুমুক্ত রেখেছিলাম।

 

আমি মুক্ত এলাকাগুলি নিয়ে একটা সাব- ডিভিশন করি। সেখানে বাজার, স্কুল, থানা বেসামরিক প্রশাসন চালু রাখার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করি। মুক্ত এলাকা বাংলাদেশ পতাকা গৌরবের সাথে উড়তে থাকে। এ মুক্ত এলাকা দেখার জন্য দেশ-বিদেশে নাম করা সংবাদপত্র, টেলিভশন ও গন্যমাণ্যরা দেখতে আসতে থাকে। আমাদের পক্ষে সুবিধা হয়ে পরেছিল ঐ সমস্ত গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের সম্স্ত কিছু দেখাতে এবং বুঝাতে। এ আমি মুক্ত এলাকার লোকের কথা স্বরন না করে পারি না। এদের অনেক শত্রুদের গোলার আঘাতে মারা গেছে বা গুরুত্বরভাবে আহত হয়েছে। তবুও তাদেররও মনোবল একটুও ভাঙ্গেনি। তারা আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করে যেতে থাকে। তারা বাঙ্কারে গোলাবারুদ পৌছিয়ে দিত, মৃত শহীদের কবরের ব্যবস্থা করতো, আহত সৈনিকদের সেবা-শুশ্রƒষা করে খবরাখবর এনে দিত। এ খবরাখবর না পেলে শত্রুদের উপর ঠিকমক হামলা করতে পারতাম না। এদের সাহায্য নিয়েই আমি শত্রুসেনাদের উপরে আক্রমন চালিয়ে তাদের অনেক তাদের অফিসার ও সৈনিকদের শেষ করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

 

আমি শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন শত্রুদের যাওয়া- আসা এবং রসদ সরবারাহের প্রতি লক্ষ্য রাখতাম। ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্ট মন্দমেন্ট মন্দভাগ বাজারে ঘাটি গিরেছিল। কোম্পানীগঞ্জ থেকে স্পীডবোটের মাধ্যমে শালদা নদী হয়ে মন্দভাগ বাজার ও শালদা নদী ষ্টেশন অবস্থিক শত্রুদের ঘাঁটিতে তাদের রসদ আসতো সেদিনটি ছিল আমাদের জন্য খুব ভাল দিন। রাত দুটার সময় সুবেদার ওহার ও তার প্লাটুন নিয়ে বারদুরিয়াতে অবস্থিত শত্রুদের ঘাঁটি আক্রমণ করতে গিয়েছিলাম। এ্যাকশনে শেষ করে পরের দিন সকাল ৮ দিকে গুপ্তপথে আমাদেও অবস্থানে ফিরে আসছিলাম। সত্যিকথা বলতে কি আমার খুব ক্লান্ত ছিলাম সেজন্য একটি ঝোঁপের মধ্যে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে ৩টা স্পীডবোটের আওয়াজ শুনতে পাই যা কোম্পানীগঞ্জ থেকে আসছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই স্পীডবোটের আহত সৈনিকদের নিয়ে আবার কোম্পানীগঞ্জ ফিরে যাবে। আমি এ ব্যাপারে সাহসী যোদ্ধা সুবেদার ওহারের সাথে আলোচনা করি এবং দ্রুত শালদা নদীর একটা নির্বাচিত এলাকার ঝোঁপে গিয়ে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। নদীর অপর পর্শ্বে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে ওহারের অধীনে একটা সেকশন পাঠিয়ে দেই এ্যাম্বস পাতার জন্য এবং আমি নিজেই দুটো সেকশন নিয়ে নদীর পূর্বপাড়ে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে এ্যামবুশ পাতি। আধাঘণ্টার মাধ্যমে মন্দভাগ থেকে স্পীডবোট আসার আওয়াজ শুনতে পাই। দুটো স্পীডবোট আমাদের ফাঁদে পা দেবার জন্য এগিয়ে আসছিল। আমি আমার সৈনিকদের নির্দেশ দেই আমি গুলি না ছোড়া পর্যন্ত যেন তারা কেউ গুলি না চালায়। দুটো স্পীডবোট ১৫০ গজের ব্যবধানে এগিয়ে আসতে থাকে। স্পীডবোটগুলি ছিল খোলা এবং প্রথম স্পীডবোটে দেখি ২/৩টি ছাতার নিচে লোক বসে আছে এবং পিছনেরটিতে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে বোঝাই হয়ে আসছে। আমি নিশ্চিত হলাম প্রথম স্পীডবোটে ছাতার নিচে পাকসামরিক অফিসাররা বসে আছেন। নদী ছিল ৩০/৪০ গজ প্রশস্ত দুটি স্পীডবোটেই যখন আমার ফাঁদে পড়ে যায় তখন আমি শত্রুদের দিকে গুলি চালাই। সঙ্গে সঙ্গে আমার বাহিনীর লোকের শত্রুদের উপর এক সঙ্গে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এই গোলাবর্ষাণ চলে ৫ মিনিট ধরে এবং শত্রুরা এ আক্রমাণের কোন জবাব দেয়ার সময় পায়নি। শত্রুরা সবাই স্পীডবোট ছেড়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়। ১৪ জন শত্রুসেনার সবাই মারা যায়। আমি দেখি একজন শত্রুসেনা পানি থেকে আবার স্পীডবোটে ওঠার চেষ্টা করছে, সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে তার সে চেষ্টা ব্যার্থ করে দেয়া হলো। এটা এক সাফ্যজনক অপারেশন ছিল। আমরা দুটি এম-জি-আর -এ-৩, ১টা চাইনিজ রাইফেল, ২টা চাইনিজ ষ্টেনগান ১টা সামগ্র এলাকার আর্টিলারি ম্যাপ, ২টা পি-আর-সি, ১০টা অয়্যারলেস সেট আছে। আমার তার ব্যজটি ছিড়ে নেই আমরা দেখি একটা স্পীডবোট একজন মৃত পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন পড়ে আছে। আমরা তার ব্যাজটি ছিড়ে নেই, আমরা দ্রুত অবসাহন তুলে নিয়ে আমাদের ক্যাম্পে দুপুর তিনটার সময়। এ ঘটনার ম্যাসেজ ধরেন) স্পীডবোটগুলিতে ৩৩ বালুচর ৫ জন অফিসার এবং অন্যান্য র‌্যাঙ্কের ৯জন ছিল। এদের মধ্যে ১জন লেঃ কর্নেল, ১ জন মেজর ১জন ক্যাপ্টেন ডাক্তার, ১ জন আর্টিলারি ক্যাপ্টন, একজন লেফটেন্যান্ট ছিলেন। এরা সবাই কুমিল্লা টাউনে বাঙালিদের উপরে অত্যাটার চালিয়েছিল, মা- বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছিল এবং ধন- সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল। পরে স্থানীয় রাজাকার ও হেলিকাপ্টারের সাহায্য মৃতদেহগুলি নিয়ে শত্রুরা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টর সৈন্যদের কবরস্থানে দিয়েছিল। মধ্যে কুখ্যাত ক্যাপ্টেন বোখারিও ছিল।

 

 

মক্ত এলাকায় আমার যে অবস্থানগুলি ছিল সে গুলি বায়েক গ্রাম, মন্দভাগ বাজার, কামালপুর, মঈনপুর, গৌবিন্দপুর এবং উদিশ্বর। শত্রুদের ঘাঁটি ছিল আমার এলাকার বিপরীতে কসবা, চাঁদলা, বড়ধুসিয়া, শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টিশন ও নয়নপুর বাজারে। এসব এলাকা থেকে শত্রুরা আমাদের অবস্থানের উপর প্রায়ই গোলাগোলি চালাত। ছোট ছোট আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণ, এ্যামবুশ ও রেইড দৈনন্দিন ব্যাপার ছিল। এতে শত্রুদের যতেষ্ট হতাহত হয়।

 

শত্রুসেনারা রাজাকারের কোম্পানীগঞ্জ-কুটি প্রধান রাস্তায় পাহাড়ায় মোতায়েন রাখে। রাজাকারের একটি দল আমার সাথে গোপন যোগাযোগ করে। তারা জানায় তাদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হলে তারা আমার নিকট আত্মসমার্পন করবে এবং অনুমতি দিলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবে। কোম্পানীগঞ্জ- কুটি; সড়কের মধ্যে কালামোরায় ১০৩ ফুট লম্বা ১টা ব্রীজ ছিল। রাজাকাররা সে ব্রীজ পাহাড়া দিত। আমি আমার এক দূতের মাধ্যমে জানাই তাদেরকে হত্যা করা হবে না এবং প্রয়োজনে হলে মুক্তিবাহিনীতে নেয়া হবে। তাদের আরো জানাই কালামোরা ব্রীজ উড়ানোতে তাদের সাহায্যও প্রয়োজন হবে।

 

আগস্ট মাসের রাতে ব্রীজ ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রুদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে ব্যস্ত রাখার জন্য সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে ৫টি এ্যাম্বশ দল পাঁচ জায়গায় প্রেরণা করি। রাত ১২টা থেকে ভোর পর্যন্ত তারা শত্রুদের অবস্থানগুলি যথা সাহেবপারা, শালদা নদী গোডাউন, চাঁদলা প্রভৃতি জায়গায় আম্বিয়ার নেতৃত্বে একটি প্লটুন কালামোরা ব্রীজে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে রাত দু’টার সময় ব্রীজটি উড়িয়ে দেয়। এ কাজ এ কাজে রাজাকাররা আমাদের সাহায্য করে ৭ জন রাজাকার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয় এবং দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত তারা আমার সাথেই ছিল।

 

শত্রুরা রসদ সরবারাহ করার জন্য এ রাস্তা দিয়ে যাবে আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। সে জন্য এ কালামোরা। ব্রীজ থেকে ১০০ গজ দূরে কোম্পানীগঞ্জের দিকে এ্যামবুশ পেতে বসে বাকি। ভোরের দিকে শত্রুদের রসদ সরবারহকারী দুটো সৈন্যবোঝাই জীপ, দুটো ডজ, ৩ টা বেসরকারী গাড়ি, একটা বাস ও দুটা তিন টনের গাড়ি এ রাস্তা দিয়ে আসছিল। ব্রীজের কাছে এসে তা ভাঙ্গা দেখে তারা আবার ফিরে যাবার জন্য প্র¯ত্তত হবার আমরা আকস্মাৎ রকেট লাঞ্চনার , রাইফেল ও হালকা মেশিনগানের সাহায্যে শত্রুদের উপর আক্রমণ শুরু করি রকেট লাঞ্চারের সাহায্য শত্রুদের পাচঁটি গাড়ী ধ্বংস করে দেয়া হয়। ১৫ জন পাকসেনা নিহত এবং কতজন আহত হয়েছিল আমার জন্য নাই। ৩ জন জীবিত শত্রুসেনাকে আমরা ধরে ফেলি। এদের একজন হচ্ছে নায়েক সুবেদার বশির (সিন্ধি) আমরা কিছু গোলাগুলি, অস্ত্রশস্ত্র এবং জরুরী কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করি। শত্রুরা গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্যে গোলাবর্ষণ শুরু করলে আমরা অবস্থান পরিত্যাগ করি। জীবিত শত্রুসেনাদের আমি মেলা পাঠিয়ে দেই। এরা ধৃত হবার ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেরে যায়।

 

বাচ্চু নামে (ক্লাস নাইনে পড়ত তখন) অসীমসাহসী যুবক একটা হালকা মেশিনগান নিয়ে শালদা নদীর এক স্থানে এ্যামবুশ পেতে শত্রুদের একটা নৌকা উড়িয়ে দিয়। নৌকাতে অবস্থানরত পাকসেনা এতে মারা যায়।

 

শালদা নদীর পূর্বপারে মন্দভাগ গ্রামে আমদের দখলে ছিল। নদীর অপার পার আমাদের দখলে না থাকলেও শত্রুদের নিয়ন্ত্রণে ছিলোনা। নদীর ওপারে চাদলা গ্রামে শত্রুরা অবস্থান নিয়েছিল। শত্রুরা বার বার চাপ দিচ্ছিল মন্দভাগ দখল  করে নেবার জন্য। আমরা ছোট ছোট ওয়্যারলেসের মধ্য দিয়ে ধরতে পারি শত্রুরা যে কোন মুহুর্তে মন্দভাগ আক্রমণ করতে পারে। ২১শে সেপ্টেম্বর শত্রুরা চাঁদলা থেকে চারটা নৌকায় করে মন্দভাগ আসছিল। মেজর দূররানির নেতৃত্ব ৩৩ বেলুচের নেতৃত্ব ‘বি’ এবং ‘ডি’ কোম্পানী এই নৌকা গুলিতে ছিল। শত্রুরা আক্রমণ করতে পারে বলে আমি বাছাই করা একটা প্লাটুনকে সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে মন্দভাগ শালদা নদীর উপরে অবস্থান নিতে বলি। আর একটা সেকশনকে গ্রামের এক পাশে আমার ডানদিকে এবং আরেকটা সেকশনকে বাম পাশে অবস্থান নিতে বলি। আমি অবস্থান নেই মধ্যখানে। আমি আমার বাহিনীকে নির্দেশ দেই আমি গুলি না ছাড়া পর্যন্ত যেন কেউ গুলি না চালায়। রাত্রি একটার সময় শত্রুরা মেজর দুরবানির নেতৃত্বে আমার অবস্থানের দিকে খাল নৌকাযোগে এগুতে থাকে। আমি তখন মন্দভাগ গ্রামে অবস্থানরত ডানপাশের বাহিনীকে নির্দেশ দেই শত্রুদের প্রতি গুলি ছোঁড়ার জন্য। শত্রুরা তখন নৌকা থেকে নেমে দুই ভাগে ব্রাকেন লাইন হয়ে এগুতে থাকে। তারপর যখন তারা আমার প্রতিরক্ষাব্যূহের ২০/২৫ গজের মধ্যে এসে গেছে, তখন আমরা সবাই তাদের উপর গুলিবর্ষণ করতে থাকি। এ গুলিবর্ষণের ফলে প্রথম সারির সবাই আহত- নিহত পড়ে যায় এবং পিছনেরও অনেকে হতাহত হয়। শত্রুরা বেগতিক দেখে তাদের আহত সৈনিকদের ও গোলাগুলি ফেলে পালিয়ে যায়। পশ্চদপসরনরত সৈনিদের লক্ষ্য করে মর্টারের সাহায্য গোলাবর্ষণ করা হয়। ফলে শত্রুদের কিছু আহত হয়। এ যুদ্ধে শত্রুদের ৬ জন আহত সৈনিকদের ধরে ফেলি। ২৬ জন মৃত শত্রুসেনাকে নিয়ে আসতে সক্ষম হই। এদের মধ্যে একজন লেফটেন্যান্ট ছিল। আমরা ৬টা এমজিআই- এ-৩ ৩৭ /৩৮ টা জি-৩ রাইফেল, ৫টা পিস্তল, চাইনিজ স্টেনগান ৮টা, ৩.৫ ইঞ্চি রকেট লাঞ্চার , ১টা ক্যমেরা, ১টা বাইনোকুলার, ২টা ক্যাম্পাস, ম্যাপ ও ৫/৬ হাজার গোলাগুলি দখল করে নেই। এ যুদ্ধে আমাদের ৪জন আহত হয়। পাক গোলান্দাজ বাহিনী আমাদের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ যুদ্ধে পৌনে পাঁচটা থেকে ছ’টা পর্যন্ত চলে আমার ধৃত ও নিহত সৈন্যদের সেক্টর-২-এর হেডকোয়ার্টারের মেলাঘরে পাঠিয়ে দেই। শত্রুরা বিপর্যস্ত হবার পর পরই তাদের বিমান বাহিনীর পাঁচটা স্যাবর জেট এসে ৪৭ মিনিট ধরে আমার মুক্ত এলাকায় স্ট্র্যাপিং করতে থাকে। এতে একজন সামান্য আহত হয়।

 

জাদিশ্বরে আমি আমার একটা মর্টার সেকশন রাখি নায়েক সুবেদার মঈনের অধীনে। তখন ছিল রমজান মাস। আমি সুবেদার মঈনের নির্দেশ দেই জাদিশ্বর থেকে কোন এক স্থানে বেছে নিয়ে সাহেববাড়িতে অবিস্থিত শত্রুসেনাদের অবস্থানে খাওয়ার সময় যেন আচমকা মর্টারের সাহায্য হামলা চালায়। তাকে যেদিন এ কজি করতে বলা হয়, যেদিন সে ব্যার্থ হয়। পরের দিন ভোররাতে সেহরী খাওয়ার সময় জাদিশ্বর থেকে খাল পার হয়ে নায়েক সুবেদার মঈন তার ৮জন সঙ্গীকে নিয়ে যায় মার্টর হামলা করার জন্য কিন্তু শত্রুসেনারা কোন গুপ্তচারের মাধ্যমে খবর পেয়ে আগে থেকেই এ্যাম্বশ পেতে বসে ছিল। তারা নায়েক সুবেদার মঈন ও তাঁর বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এরা সুবেদার মঈন ও তার দুজন সঙ্গীকে ধরে ফেলে। দুজন গুলি করে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলে রেখে যায়। সুবেদার মঈনকে তারা নিয়ে যায় সুবেদার আম্বিয়া টেলিফোন যোগে এ বিপর্যয়ের বাংলাদেশ কথা জানায়। আমি তাকে সঙ্গে সঙ্গে তার প্লাটুন নিয়ে শত্রুদের ধাওয়ার জন্য। সে আমার কথামত তাঁর প্লাটুন নিয়ে শত্রুদের ধাওয়া করে। ফেলে শত্রুরা সেখানে নায়ের সুবেদার মঈনকে হাত পা বাধা অবস্থায় মেরে ফেলে পালিয়ে যায়। আমরা তাকে মুক্ত এলাকায় এনে সামরিক কায়দার সম্মান জানিয়ে সমাহিত করি।

 

নায়েব সুবেদার মঈন একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। তাকে কাজ দেয়া হত, সে কাজ দ্রুততার সাথে কাজ সম্পন্ন করতো। কোন নির্দেশ পাওয়ার পর, সে সেটা সম্পন্ন না করা পর্যন্ত শাস্তি পেতনা। অসমসাহসী এ যোদ্ধার কথা বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস স্বর্ণক্ষরে লিখে রাখা উচিত। তার জন্য বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে। মন্দভাগ গ্রাম ও রেলওয়ে ষ্টেশন আমাদের নিয়ন্ত্রনে আনেক আগে থেকেই ছিল। মন্দভাগের শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশনের গুরুত্ব ছিল অপারিসীম। এখান থেকেই কুমিল্লা-চট্টগ্রাম, কুমিল্লা-সিলেট ও কুমিল্লা- ঢাকা রেলপথে যেতে হয়। শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন ও বাজার ছিল একটা গুরুত্বপূর্ন বাণিজ্যিক এলাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়াম বুরিচ, কসরা এলাকায় শালদা নদী গ্রামের ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের কাঁচা রাস্তা দিয়ে যেতে হয়। ফলে শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন ও গ্রামের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সেক্টর- ২ এর কামণ্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফ সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমাকে শালদা নদী সাবসেক্টরর কমাণ্ডার মেজর সালেক চৌধুরী ক্যাপ্টন পাশা ও ক্যাপ্টন আশরাকে নিয়ে রেলওয়ে ষ্টেশনে আমার হেডকোয়ার্টারে এক আলোচনা সভা ডাকেন। তিনি আমাদের বলে, আমরা মন্দভাগ মুক্ত করেছি। শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন মুক্ত করতে পারলে আমাদের মুক্ত করতে পারলে আমাদের মুক্ত এলাকা বেড়ে যাবে এবং সামরিক ও অন্যান্য দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি মুক্ত করতে পারলে শত্রুদের মনোবল ভেঙ্গে যাবে। সে মতে তিনি আমাদের শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন মুক্ত করার জন্য শত্রুদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে হামলা চালাবার নির্দেশ দেন এবং তিনি নিজে এ আক্রমণ পরিচালনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি আমার একটা কোম্পানী নিয়ে শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশনের দিকে বায়েক গ্রামে অবস্থান নেই। ক্যাপ্টেন আশারাফ একটা কোম্পানী নিয়ে মন্দভাগ গ্রাম থেকে এগিয়ে শত্রুদের নয়নপুর ঘাঁটির দূরে অবস্থান নেন। মেজর সালেক সালেক খাল পার হয়ে শালদা নদী পার হয়ে একটা কোম্পানী নিয়ে শালদা নদী ষ্টেশন পশ্চিমে গোডাউনে অবস্থান নেন। ক্যাপ্টন নেন। আমাদের সাহায্য করার জন্য সুবেদার জববার তার মার্টন সেকসন নিয়ে আমার অবস্থানের পিছনে মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশনে অবস্থান নেয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী সকাল সাড়ে ৬টার সময় গোলান্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন পাশা অবস্থানের উপর গোলা ছুড়তে থাকে। মেজর সালেক, আশরাফ এবং আমি নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে শত্রুদের অবস্থানের উপর নির্দিষ্ট সময়ে হামলা চালাই। শত্রুরা তাদের গোলান্দাজ ঘাঁটি বুড়িচং, কসবা, কুটি, থেকে আমাদের উপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। ক্যাপ্টেন আশরাফের আক্রমণে নয়নপুর গ্রামে অবস্থানরত পাকসেনারা নয়নপুর গ্রাম ছেড়ে শালদা নদীদক্ষিণ পাড়ে চলে যায়। নয়নপুর গ্রাম আমাদের দখলে চলে আসে। আমি আমার বাহিনী নিয়ে নয়নপুর গ্রামের রেলব্রীজ পর্যন্ত এগিয়ে যাই। মেজর সালেক শালদা নদী বাজার এবং গোডাউন দখল করে নেয়। শালদা নদীর দক্ষিণ পার্শ্বের বিলে শত্রুদের দৃঢ় অবস্থানের জন্য মেজর সালেক নদী রেলওয়ে ষ্টেশন পর্যন্ত এগুতে পারেননি। এ যুদ্ধ চলে সকাল সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। শত্রুরা তাদের তিনটি গোলান্দাজ ঘাঁটি থেকে আমাদের অবস্থানে ও মুক্ত এলাকায় অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাবার ফলে মেজর সালেক তার অগ্রবর্তী অবস্থানে তুলে নিয়ে মন্দভাগে চজলে আসেন। ক্যাপ্টেন আশরাফ এবং আমার দখলকৃত জায়গা আমার দখলে রাখি। মেজর সালেক এবং ক্যাপ্টেন আশরাফ তাদের বাহিনী আমার অধীনে রেখে ২নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে চলে যায়। এই যুদ্ধ আমাদের নাম করা সাতারু সিরাজ সহ ৬জন সৈন্য পাকিস্তনী গোলাগুলি ফলে নিহত এবং আহত হয়। শত্রুদের হতাহতের সঠিক কোন পাওয়া গেলেও লোকমুখে আমার জানতে পেরেছি নয়নপুর রেলওয়ে ষ্টেশন হয়ে টেলিযোগে অনেক আহত এবং নিহত সৈনিকদের কুমিল্লা ক্যান্টলমেন্ট নিয়ে গেছে। এটাই ছিল প্রথম সামনাসামনি যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পর পর আমার শত্রুদের সাথে সামনসামনি যুদ্ধ করার পথ বেছে নেই। সৈন্য এবং গণবাহিনীর ছেলেদের মনোবল এ যুদ্ধের পর বেড়ে যায়। গণবাহিনীর ছেলেরা যদিও এই সামনাসামনি যুদ্ধে কিছুটা ভীত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু পরে তারা বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল। এ যুদ্ধের পরেই মেজর সালেক এবং ক্যাপ্টেন আশরাফের কাছ থেক শালদা নদী সাব-সেক্টরের ভার নিয়ে নেই। শেষ অবধি দেশ স্বাধীন হাওয়া দুই সাবসেক্টর আমার অধীনেই ছিল। মেজর সালেক ছিলেন এক অসমসাহসী যোদ্ধা।

 

মন্দভাগ ও শালদা নদী সাবসেক্টরের মধ্যে শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশনে শক্রদের একটা শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। আমি শালদা নদী সাব-সেক্টরের কামণ্ডার মেজর সালেক ও ক্যাপ্টেন আশরাফ সেক্টর-২ এর কমাণ্ডার কর্নেল খালেদ মোশারফের নির্দেশ যৌথভাবে শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশনে শত্রুদের ঘাঁটির উপর পূর্বেই একবার হামলা চালিয়েছিলাম। কিছুটা সাফল্য লাভ করলেও শত্রুদের শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে বিতারিত করা সম্ভব হয়নি। এরপর মেজর সালেক শালদা নদী সাব-সেক্টরের ভার আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যান। আমি চিন্তা করতে থাকি শত্রুদের কি করে শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে শত্রুদের শক্তিশালী ঘাঁটির অবস্থান পর্যবেক্ষন করার জন্য কালো শার্ট ও লুঙ্গি পড়ে কৃষকের বেশে শালদা নদীর রেলওয়ে ষ্টেশনের নদীর বিপরীত দিকে এক বিরাট বিরাট গাছের তলায় দাঁড়িয়ে শত্রুদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। সময় ছিল ঠিক সন্ধার আগে। শত্রুরা আমাকে দেখতে পায় এবং আমার উপর গোলাগুলি ছুড়াতে থাকে। নিম গাছের আরাল করে বসে থাকি। তাদের আমার পাশ দিয়ে চলে যেতে থাকে। সন্ধ্যার পর গোলাগুলি বন্ধ হলে আমি আমার ঘাঁটিতে ফিরে আসি।

 

শত্রুদের প্রতিরক্ষা অবস্থান পর্যবেক্ষণের পর বুঝাতে পারি শত্রুদের অবস্থান খুবই শক্তিশালী। নদীর তীর বারবার আমাদের অবস্থানের সামনে তারা চারটি বড় পরিখা খনন করছে। শালদা নদী গোডাউনের পাশ দিয়েও তারা এরকম শক্তিশালী পরীখা খনন করছে। এ অবস্থানে আমি আমি আমার শত্রুদের কাবু করার জন্য তিন দিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমনের পরিকল্পনা নেই এবং নায়েক সুবেদার সিরাজের নেতৃত্বে শালদা নদী রেলওয়ে ষ্টেশনের পূর্বে পাহাড়ী জায়গা প্লাটুন পাঠাই। সুবেদার মঙ্গল মিয়াকে আর একটা প্লাটুন নিয়ে শালদা নদী গোডাউনের নিকটে গিয়ে অবস্থান নিতে বলি। সুবেদার বেলায়েতকে নিয়ে আর একটা প্লাটুন নিয়ে শালদা নদীতে শত্রুদের ঘাঁটির নদীর বীপরিতে অবস্থান নিতে বলি আমাদের যাতে শত্রুরা পিছন থেকে আক্রমণ করতে না পরে তার জন্য সুবেদার ওহাবের একটা কোম্পানীকে সুবেদার মঙ্গল মিয়ার পিছনে অবস্থান নিতে বলি। সঙ্গে সঙ্গে চারটা রেইডিং পার্টিকে শত্রুদের অন্যান্য অবস্থান যথা বড়ধূসিয়া , চাঁদলা,  সাহেবেরবাড়ী গোবিন্দপুর ও কায়েমপুরের আগের ঘাঁটিতে রাতে হঠাৎ রেইড করার নির্দেশ দেই। হঠাৎ করে চারটা ঘাঁটিতে আক্রমনের পরিকল্পনা নিয়েছিলাম এ জন্য যে, এর ফলে শালদা রেলওয়ে ষ্টেশনে। অবস্থানরত শত্রুদের দৃষ্টি অন্যদিকে পড়বে। হঠাৎ করে চারটি ঘাঁটিতে আক্রমণ করলে তাদের ঐ চারটা অবস্থানকে রক্ষার জন্য তারা মর্র্টার ও কামানর গোলা আমাদের উপর নিক্ষেপ করবে। এভাবে তাদের মর্টার ও কামানের গোলা অনেক শেষ হয়ে যাবে। পরিকল্পনা মত ৭/৮ই অক্টোবর রাতে ৪টি রেইডিং পার্টি ক্রমান্বয়ে বড়ধূসিয়া, চাঁদলা কায়েমপুর ও সাহেববাড়ি গোবিন্দপুরে হামলা চালায়। এটা চলে সারারাত ধরে। শালদা রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে শত্রুরা আমাদের এ্যামবুশ পার্টিগুলির উপর মর্টার ও কামানের নিক্ষেপ করতে থাকে। ভোরের দিকে এ আক্রমণ বন্ধ হয়ে যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, শত্রুরা রাতে আমাদের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকত, কিন্তু দিনের বেলা তারা এতখানি প্রস্তুত থাকত না। দিনের বেলা ই-পি-সি-এ-এফ ও রাজাকারদের পাড়ারায় মোতায়েন করে তারা ঘুমাত, না হয় বিশ্রাম নিত।

৭/৮ই অক্টোবরের সকাল ৮টার সময় সম্মিলিতভাবে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। সুবেদার মঙ্গল মিয়া শালদা নদী গোডাউনের পরিখায় অবস্থানরত শত্রুদের উপর গোলাগুলি চালাতে থাকে। সুবেদার বেলায়েত নদীর পার থেকে ওপারে শত্রুদের পরিখার উপর ভীষণভাবে গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। নায়েক সুবেদার সিরাজ পাহাড়ী অবস্থান থেকে শত্রুদের উপর আক্রমণ চালাতে থাকে। উভয়পক্ষের মধ্যেই প্রচণ্ড বিনিময় গুলি বিনিময় হতে থাকে। আমি আগেই পরিকল্পনা নিয়েছিলাম নদীর ওপারে পরিখাগুলি নষ্ট করে দিতে পারলে শত্রুরা টিকতে পারবে না। সে মতে নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ হোসেন আর-আর- এর গোলা পরিখার উপর ফেলতে থাকে এবং এতে কাজ হয়। আর-আর এর দুটি গোলার আঘাতে নদীর পারে অবস্থিত চারটি পরিখার মধ্যে ২টি নষ্ট হয়ে যায় এবং শত্রুরা ঐ নষ্ট দুটি পরিখা ত্যাগ করে অন্য দুটিতে চলে যায়। সুবেদার বেলায়েত সঙ্গে সঙ্গে তার বাহিনীর কিছু লোক নিয়ে নদী সাঁতরিয়ে গিয়ে ভাঙ্গা পরিখায় অবস্থান নেয় এর ফলে শত্রুরা দুই ভপাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের অবস্থানরত শত্রুসেনাদের সাথে গোডাউনে অবস্থানরত শত্রুদের কোন সংযোগ থাকে না। শত্রুরা আমাদের উপর মার্টার ও কামানের গোলা ফেলতে পারছিল না। এতে তাদের অনেক ক্ষতি হত, কেননা আমাদের সৈন্যরা তাদের দুদলের মাঝে ঢুকে গেছে। শালদা নদী গোডাউনে অবস্থানরত বুঝতে পারে তাদের পক্ষে এঁটে ওঠা সম্ভব নয়। অন্য দিক থেকে সাহায্য না পাবার ফলে তারা গোডাউনের পার দিয়ে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনে তাদের অবস্থানে পালিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মিয়া শালদা নদী গোডাউনটি দখল করে নেয়। দুপুর ১১টার সময় শত্রুদের  একটি অয়ারলেস থেকে ম্যাসেজ আমি ধরি। তাতে তারা কতৃপক্ষকে জানায় মুক্তিবাহিনীর ১টা ব্যাটালিয়ান তাদের আক্রমণ করেছে। এ মুহূর্তে তাদের পক্ষে আর এ ঘাঁটিতে টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।

এ ম্যাসেজ ধরার পরে আমার মনোবল বেড়ে যায়। আমি আমার শত্রুদের আরও তীব্রভাবে তাদের উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দেই। আমি বুঝতে পারছিলাম তাদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। শত্রুরা এ ঘাঁটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে যদি আমরা আক্রমণ চালিয়ে যাই। কিছুক্ষণ লড়াই চলবার পর শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানরত শত্রুসেনারা ধীরে ধীরে রেললাইন বরাবর পরিখা দিয়ে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনে তাদের ঘাঁটিতে পালিয়ে যেতে থাকে। আমি এবং আমার বাহিনী পরিখাতে অবস্তান নিয়ে পলায়নপর শত্রুদের উপর গুলি চালাতে থাকি। একজন পাকসেনার কথা আমার মনে পড়ে। সে ধীরমন্থর গতিতে একটি পরিখা থেকে অন্য পরিখা যাচ্ছিল। আমি তার উপর গুলি চালাই। দেখি আবার কিছুক্ষণ পর উঠে ধীরমন্থর গতিতে আবার এগিয়ে যাচ্ছে, আবার গুলি চালাই। এভাবে ২/৩ টি পরিখা পার হবার পর সে আর যেতে পারেনি। আমার মনে হয় আমাদের আক্রমণের সময়ই সে গুরুতর ভাবে আহত হয়েছিল যার জন্য সে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে পারেনি।

 

এরপর আমরা সমগ্র শালদা নদী এলাকা দখল করে নিয়ে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে তুলতে থাকি যেন শত্রুরা আক্রমণ করে শালদা পুনর্দখল করে নিতে না পারে।

এরপর শত্রুরা নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘাঁটি মর্টার ও কামানের গোলা বৃষ্টির মত আমাদের অবস্থানে ফেলতে থাকে। ইতিমধ্যে ভারতীয় বাহিনীর লেঃ জেনারেল সগৎ সিং আমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য মন্দভাগে আসেন। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই।

এর মধ্যে শত্রুরা আমাদেরকে আক্রমণের জন্য শালদা নী গোডাউনের কাছে সমাবেশ হচ্ছে খবর পেয়ে সুবেদার বেলায়েত সে স্থানে যান। রেকি করার সময় একজন প্যারা-ট্রপস এর শত্রুদের একটি গাছের আরাল থেকে তাকে গুলি করে তাকে গুরুত্বর ভাবে আহত করে। জেনারেল সগৎ সিং- এর সাথে দেখা করে ফেলার পর আমি এ খবর পাই। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিকিৎসা করার জন্য সেক্টর-২ এর হাসপাতালে পাঠানো হয় কিন্তু পথিমধ্যে সে মারা যায়। তার মত বীর সৈনিকের মৃত্যুতে আমি মর্মাহত হয়ে পড়ি। তার মত বীরের মৃত্যুতে আমাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ একজন মহান বীরকে হারায়।

শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন দখল একটা সাহসী পরিকল্পনা ছিল। আমি অবশ্য আশান্বিত ছিলাম যদি তাদের ঠিকমত আঘাত করা যায় এবং মনোবল ভেঙ্গে দেয়া যায়, তবে নিশ্চয়ই জিতব। এটা অত্যন্ত শক্ত এবং দুঃসাহসী কাজ ছিল।

শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন দখল করার পর আমরা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ সেখানে পাই। ২১ টা ৩০৩ রাইফেল, ৫টা হালকা মেশিনগান, এম-জি-আই-৩ ৩টা, ম্যাগাজিন বক্স ২টা, হালকা মেশিনগান ম্যাগাজিন ৩১টা, বেটাগান ২টা, রকেট লাঞাচার ৪০-এম এম ১টা, অয়্যারলেস সেট পি-আর-সি-৬২ একটা, হারিকেন ৪টা, গোলাবারুদ ২০,২৫০ টা, ২ ইঞ্চি মর্টার বোমা ২০০টা, ৬০-এম-এম মর্টার বোমা ৭২টা, ৩০৩ বল ১০ হাজার, ২ ইঞ্চি মর্টার বোমা ধোঁয়া ৪টা, টেলিফোন সেট ৩টা, জেনারেটর ১টা, পি-আর-সি-১০ অয়্যারলেস সেট ব্যাটারিসহ ৫টা, ট্রাঞ্জিস্টর ৩ ব্যান্ড ১ টা এবং বিভিন্ন ধরনের খাদ্য রসদ ও অসংখ্য কাপড় চোপর। এছাড়াও ব্যারেল হোল্ডার ২ টা , এম-জি স্পেয়ার ব্যারেল ২টা, ম্যাপ এবং বিভিন্ন ধরনের নথিপত্র। এসব দলিলপত্র থেকে জানতে পারি যে ৩০ পাঞ্চাবের ‘বি’ এবং ‘ডি’ কোম্পানী এখানে মোতায়েন ছিল। এ লড়াই ভোর পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত চলে। প্রায় ১৬ ঘণ্টা ধরে দু’পক্ষের তুমুল লড়াই চলে। এ যুদ্ধে আমার বাহিনীর ২ জন নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। শত্রুদের প্রায় ১০০ জন যখন নিহত এবং ধৃত হয়। এর মধ্যে ১২ জনকে আমরা জীবিত অবস্থায় ধরে ফেলি। শত্রুদের কতজন আহত হয়েছিল তার সঠিক সংখ্যা না জানা গেলেও এটা নিশ্চিত যে তাদের অনেকেই আহত হয়েছিল।

শালদা রেলওয়ে স্টেশনে কৃতিত্বের সঙ্গে লড়াই করে শত্রুদের বিতাড়িত করার জন্য তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার সেনাবাহিনীর তরফ থেকে যুদ্ধকালীন সময়ে আমাকে বীরত্বসূচক হাই অর্ডার (গ্যালানট্রি এওয়ার্ড) সম্মানে সম্মানিত করে। স্বাধীন হবার পর এর নাম দেওয়া হয় বীরউত্তম। এ ছিল আমার সাবসেক্টরে কৃতিত্বপূর্ণ লড়াইয়ের একটি পুরস্কার।

মন্দভাগ শালদা নদী সাবসেক্টরে যেসব সেনা শত্রুদের সাথে লড়াইয়ে শহীদ হন, তাদের আমি কুলপাতড়া নামক স্থানে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করি। এদের স্মৃতিচিহ্ন এখনও কুলাপাতড়ায় বিরাজ করছে।

শালদী নদী থেকে শত্রুদের পরাস্ত এবং বিতাড়িত হবার পর তারা বুড়িচং এবং কুমিল্লার দিকে সড়ে যায়। শালদা নদী মুক্ত করার পর মুক্তবাহিনীর একটা কোম্পানী ফ্লাইং অফিসার কামালের অধীনে রাখা হয়। শালদা নদী মুক্ত করার পর মুক্তিবাহিনীর একটা কোম্পানী ফ্লাইং অফিসার কামালের অধীনে রাখা হয়। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম.এ.জি ওসমানী (বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) আমাকে ‘কে ফোর্সের ৪র্থ বেঙ্গলকে নিয়ে ফেনীর দিকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেন। সেই মত আমি আমার বাহিনী নিয়ে ফেনীর দিকে অগ্রসর হই। ফেনীতে অবস্থানরত শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য আমি আমার বাহিনীকে ছাগলানাইয়া থেকে শুভপুর ব্রীজ পর্যন্ত শত্রুদের প্রতিরক্ষাব্যূহ ঘিরে অবস্তান নেওয়ার নির্দেশ দেই। সেই মত তারা অবস্থান নেয়। ‘ফোর্সের ১০ম বেঙ্গলের অধীনায়ক ক্যাপ্টেন নেবার নির্দেশ দেই। সেই মত অবস্থান নেয়। ‘ ফোর্সের ১০ম বেঙ্গলের অধীনায়ক ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ছাগলনাইয়া থেকে লক্ষীপুর পর্যন্ত অবস্থান নেয়। ভারতীয় বাহিনীর দুটো ব্যাটালিয়ান আমাদের সাহায্য করার জন্য বিলোনিয়াতে অবস্থান নেয়। আমরা ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে অবস্থান শক্তিশালী উপর গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে গোলা চালাতে থাকি। শত্রুরা এতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। শত্রুদের মনোবল তখন একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। শত্রুরা আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণে ভীত হয়ে ৬ই ডিসেম্বর ফেনীতে তাদের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ফেলে শুভপুর ব্রীজ হয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। ৬ই ডিসেম্বর ফেনী শত্রুমুক্ত হয়। ফেনীতে আমরা অজস্র গোলাবারুদ হস্তগত করি। শত্রুরা শুভপুর হয়ে চট্টগ্রামে পালাবার সময় রেলব্রীজ ও শুভপুর সড়কের দুটোই ধ্বংস করে দিয়ে যায়। আমরা ফেনী দখল করার পর শত্রুদের পিছু ধাওয়া করি। কিন্তু শুভপুরের পারাপারে দুবার দুটো ব্রীজই ধব্বংস হবার ফলে আমাদের গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমরা শুভপুরে ব্রীজ মেরামতের জন্য দু’দিন অবস্থান করি। ভারতীয় বাহিনীর ইঞ্জিনিয়াররা দু’দিনে ব্রীজ পুন:নির্মাণ করে। তারপর আমরা নৌকা করে এবং ব্রীজের সাহায্যে শুভপুর পার হয়ে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হই। করেরহাটে রাত ৮টার সময় ‘কে’ ফোর্সের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আনন্দস্বরূপের সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ৪র্থ বেঙ্গল এবং মুজিব ব্যাটারীকে (বাংলাদেশের প্রথম গোলন্দাজ বাহিনী) নিয়ে আমি হিয়াকু, ফটিকছড়ি, নাজিরহাট হয়ে চট্টগ্রামের দিকে যাবে এবং ১০ম বেঙ্গল ও আরও দুটো ভারতীয় ব্যাটালিয়নকে নিয়ে বিগ্রেডিয়ার আনন্দস্বরূপ সীতাকুণ্ড হয়ে চট্টগ্রামে দিকে অগ্রসর হবেন। পরিকল্পনা নেয়া হয় চট্টগ্রামে একসঙ্গে মিলিত হয়ে আমরা একসঙ্গে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। পরিকল্পনা মত আমরা রাত ১২টার সময় রওনা দিলাম এবং সকাল সাড়ে ৬টায় হিয়াকু বাজের পৌঁছলাম। হিয়াকু বাজারে শত্রুদের একটা ডিলেয়িং প্লাটুন ছিল। তারা আমাদের বাধা দেয় কিন্তু আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাগুলির জন্য তারা অবস্থান তুলে নিয়ে ফটিকছড়িতে পালিয়ে যা। আমরা হিয়াকু সহজেই শত্রুমুক্ত করি। এরপরে রাস্তা ছিল খুবই বিপদসঙ্কুল। কোন কোন সময় আমাদের গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। অগ্রসর হবার পথে বিবিরহাটের এবং হিয়াকুর মধ্যে চৌরাস্তার সামনে এক পাঞ্চাবী সেনা হাত তুলে আমাদের আসতে বলে। আমি আমার গাড়ি শত্রুসেনাটির উপর দিয়ে চালিয়ে দিই। এতে সে গুরুত্বরভাবে আহত হয় এবং চিকিৎসা করার জন্য পাঠাবার সময় পথিমধ্যে সে মারা যায়। শত্রুসেনাটি পথ হারিয়ে ছিল বলে আমার মনে হয়। নারায়ণহাটে এক রাত থাকি এবং বাহিনীকে আরো সংগঠিত করে পরের দিন সকালে ফটিকছড়ির দিকে অগ্রসর হই। পথে কাজিরহাটে দেখি এবং কাঠের ব্রীজ শত্রুরা ভেঙ্গে দিয়েছে। ব্রীজ মেরামতের জন্য আমাদের ৫/৬ ঘণ্টা সময় লাগে। কাজিরহাটে শত্রুরা আমাদের অগ্রসরে বাধা দেবার জন্য পথে অনেক মাই বসিয়ে রেখে গিয়েছিল। এসময়ের মধ্যে আমরা মাইনও সড়িয়ে ফেলি এবং আমরা ফটিকছড়ির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করি।

ফটিকছড়িতে শত্রুদের এক কোম্পানী ই-পি-সি-এ-পি ও ২৪ তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কিছু সৈন্য মোতায়েন ছিল। কাজিরহাট থেকে কিছুদূর এগিয়ে আমি আমার বাহিনীকে তিনভাগে ভাগ করে শত্রুদের অবস্থানে আক্রমণের জন্য এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেই। একদল ফটিকছড়ির সন্নিকটে পাহাড়ের দিকের রাস্তায় অবস্থান নেয়। আর একদল মানিকছড়ি-রামগড় রাস্তার এক জায়গায় অবস্থান নেয। প্রধান দলটি ফটিকছড়ি কাজিরহাট রাস্তার শত্রুদের অবস্থানের নিকট অবস্থান নেয়। ১১ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটের সময় আমরা সম্মিলিতভাবে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। শত্রুরা আমাদের গোলাগুলির সামনে টিকতে না পেরে কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ বিছানাপত্র ফেলে পালিয়ে যায়। ফটিকছড়ি রক্ষার জন্য শুক্তিশালী অবস্থান নিতে বলি। সেই প্রধান চারটি সড়কের সামনে আমরা অবস্থান নেই। ফটিকছড়ির যুদ্ধে আমাদের দুইজন আহত হয়। পাকসেনাদের কতজন মারা গিয়েছিল তা জানা না গেলেও তাদের রক্ত মাখা জামা-কাপড় অনেক ফেলে রেখে গিয়েছিল। আমি মনে করি তাদের বেশ কিছু হতাহত হয়েছিল। এরপর শত্রুরা পিছু হটে নাজিরহাট থেকে আমাদের উপর মর্টারের সাহায্যে অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এর মধ্যে একজনের মারফত খবর পাই শত্রুরা রামগড়ে তাদের অবস্থান ছেড়ে দিয়ে মানিকছড়ি রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে। আমি আরো দুটো প্লাটুনকে মানিকছড়ি রাস্তায় আমাদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করার জন্য পাঠিয়ে দেই এবং মর্টারের সাহায্যে রামগড়ে শত্রুদের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকি। এতে তারা মানিকছড়ির দিকে না এগিয়ে অন্য পথে নাজিরহাটের দিকে পালিয়ে যায়।

এরপর আমি নাজিরহাটে শত্রুদের অবস্থান দেখার জন্য নাজিরহাটের দিকে যাই। নদীপারে এক দোতলা বাড়ি থেকে শত্রুদের অবস্থান রেকি করি এবং দেখি শত্রুরা নদীর ধার বরাবর শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে বসে আছে। মেজর আসিফের নেতৃত্বে ৩৪তম এফ-এম-রেজিমেন্টের ২টা কোম্পানী ও বেশ কিছু সংখ্যক ই-পি-সি-এ-পি নাজিরহাটে অবস্থান নিয়েছিল। ১৩ই ডিসেম্বর সন্ধ্যার সময় থেকে আমরা নদীর পার থেকে নাজিরহাটে শত্রুদের অবস্থানের উপর গোলাগুলি চালাতে থাকি। আমাদের লক্ষ্য ছিল এ আক্রমণে শত্রুরা যদি কিছুটা দুর্বল হয়ে পরে তাহলে আমরা সাঁতরিয়ে নদী পার হয়ে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। কিন্তু তাদের অবস্থান এত শক্তিশালী ছিল যে আমরা চারঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চালাবার পরও তারা আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে।

তখন বুঝতে পারি এভাবে আক্রমণ করে কোন লাভ হবে না। চারঘণ্টা আক্রমণ চালাবার পর আমি আমার বাহিনীকে উঠিয়ে দেই। এই সংঘর্ষ চলবার সময় আমরা একজন রাজাকারকে জীবিত অবস্থায় ধরে ফেলি। সে আমাকে জানায় উদালিয়া চা-বাগান থেকে শত্রুদের আক্রমণ করলে তারা এঁটে উঠতে পারবে না। সেই মত আমি উদালিয়া হয়ে শত্রুদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেই। আমি লে: শওকতকে গণবাহিনীর ১টা কোম্পানী নিয়ে নাজিরহাট ও চট্টগ্রামের মধ্যকার একস্থানে অবস্থান নিতে বলি। সে আমার কথামত অবস্থান নেয়। আর একটা কোম্পানীকে নজিরহাট-চট্টগ্রাম রেললাইনের মাঝে একস্থানে অবস্থান নিতে বলি। তারাও আমার নির্দেশ মত অবস্থান নেয়। বার ঘণ্টা যুদ্ধ চালাবার পর অবস্থান তুলে নিয়ে আমি আমার লোকদের খাইয়ে নিয়ে উদালিয়ার দিকে অগ্রসর হই। রাতের মধ্যে অবস্থান ঠিক করে নিয়ে ১৪ই ডিসেম্বর ভোরে নাজিরহাটে শত্রুঅবস্থানের উপর আক্রমণ করি। তারা এত হকচকিত হয়ে গিয়েছিল যে তারা আমাদের আক্রমণে বাধা পর্যন্ত দিতে পারেনি। তারা ভেবে ছিল অবস্থান তুলে নেবার পর পুনরায় শক্তি সঞ্চয়ের জন্য আমাদের কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগবে। আমরা ভোরে যখন আক্রমণ চালাই তখন অনেকেই ঘুমাচ্ছিল। শত্রুরা ঘুম থেকে উঠে যখন তাড়াতাড়ি অবস্থান তুলে নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল, তখন পলায়নপুর পাকসেনাদের উপর মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালানো হয়। এতে অনেক হতাহত হয়। ২৭জন পাকসেনা নিহত হয়। ৮ জন আহত সৈনিককে ধরা হয়। ৪৯ জন ই-পি-সি-এ-পি আমাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। প্রচুর গোলাবারুদ, জিনিসপত্র, ১টা বেডফোর্ড ট্রাক (রেশন বোঝাই) আমাদের হস্তগত হয়। পাকসেনারা যখন পালাচ্ছিল, তখন পথে পূর্ব থেকেই অবস্থানরত লে: শওকতের গণবাহিনীর কোম্পানী ও রেলসড়কের কোম্পানী শত্রুদের পলায়নে বাধা দেয়। কিন্তু পাকসেনারা রেললাইন ও সড়কের মধ্যে দিয়ে চট্টগ্রামে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ১৪ই ডিসেম্বর নাজিরহাট মুক্ত হয়। এতে আমাদের একজন শহীদ ও চারজন আহত হয়। নাজিরহাটের ব্রীজটি মেরামত না করা পর্যন্ত আমি মর্টার, ভারী কামান, অস্ত্রশস্ত্র ও গাড়ি পার করতে পারছিলাম না। নাজিরহাটের বেসামরিক লোকের সাহায্যে ব্রীজটি পুন:নির্মাণ করিয়ে মর্টার, গাড়ি পার করিয়ে দেই।

নাজিরহাট মুক্ত করার পর আমি বাহিনী পুনর্গঠিত করে হাটহাজারীর দিকে অগ্রসর হই। ১৫ই ডিসেম্বর সকালে হাটহাজারী পৌঁছে ওখানে মেজর জাফর ইমামের সাথে যোগাযোগ হয়। তিনি সিতাকুণ্ড হয়ে ব্যাটালিয়ন নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে আসছিলেন। তারপর সম্মিলিতভাবে অগ্রসর হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যায়। ১৬ই ডিসেম্বর সকালে রেকি করে শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হই। এমন সময় ‘কে’ ফোর্সের বিগ্রেডিয়ার আনন্দস্বরূপ ওয়ারলেসের মাধ্যমে নির্দেশ দেন পুনরায় নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আক্রমণ বন্ধ রাখতে। বিকেল ৪-৩০ মিনিটের সময় পাকসেনারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারা তাদের সমস্ত ব্যাজ, অস্ত্রশস্ত্র বিগ্রেডিয়ার আনন্দস্বরূপের নেতৃত্বে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পাকসেনাদের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট, নেভাল বেইস ও ট্রানজিট ক্যাম্পে বন্দী করে রাখা হয়। চট্টগ্রাম আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। জনগণ আমাদের বিজয়মাল্যে ভূষিত করে এবং জয়োল্লাসে শহর ভ্রমণ করতে থাকে।

সর্বশেষে বলতে চাই তাদের কথা-যারা আমাদের বিশেষভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। মন্দভাগ ও শালদা নদী সাবসেক্টরে আমাকে যারা সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন তারা হলেন, কর্নেল খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন মতিন, ক্যাপ্টেন মহসীনউদ্দিন আহমেদ, লে: এ কে ফজলুল কবির, ক্যাপ্টেন ডা: আক্তার হোসেন, লে: মোস্তফা কামাল, সুবেদার আ: ওহাব, নায়েব সুবেদার বেলায়েত (শহীদ), সুবেদার শহীদ, সুবেদার আম্বিয়া (বিডিয়ার), নায়েব সুবেদার আসদ্দর আলী (বিডিয়ার), সুবেদার আব্দুর রহমান, নায়েব সুবেদার মনির হোসেন, সুবেদার মেজর আ: জব্বার, সুবেদার মেজর মো: হেলাল উদ্দীন, নায়েব সুবেদার মো: হোসেন, নায়েব সুবেদার মঈনুল হোসেন, (শহীদ) নায়েব সুবেদার সিরাজ, সুবেদার ফরিদউদ্দিন (বিডিয়ার), পুলিশ ইন্সপেক্টর আব্দুর রাজ্জাক, মুক্তিযোদ্দা কাদের, মোজাম্মেল, ফিরোজ, মিজানুর, মোশাররফ, রবিউল ও আরো অনেকে। কর্নেল খালেদ মোশাররফ ছিলেন সেক্টর-২ এর অধিনায়ক। তিনি অনেক সময় আমাকে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনায় যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। সুবেদার বেলায়েত, সুবেদার মঈন বীরত্বের সাথে লড়াই করতে করতে শহীদ হন। তাদের কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। এ সমস্ত ব্যক্তির সাহায্য-সহযোগিতা না পেলে আমার পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব হত না মন্দভাগ ও শালদা নদীতে শত্রুদের পর্যুদস্ত ও পরাজিত করতে। মনে পড়ে আরেকজন স্থানীয় ডাক্তার জনাব জহুরুল হকের কথা- যিনি সব সময় আমার আহত সৈনিকদের চিকিৎসা করে ছিলেন। আরো মনে পড়ে শালদা নদী, মন্দভাগের জনগণের স্বত:স্ফূর্ত সাহায্য-সহযোগীতার কথা। তারা আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন, অনেক সময় খাদ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন, শত্রুদের অবস্থানের কথা জানিয়েছেন এবং গুলিরমুখে পড়েও তারা কোনদিন ভীত হননি। আমি এদের সবাইকে আমার কৃতিত্বপূর্ণ সংগ্রামের সাথী হিসেবে মনে করি। এদের সকলের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল শত্রুদের বিতাড়িত ও পর্যুদস্ত করা। আমি তাদের সবাইকে স্মরণ করি এবং কৃতিত্বপূর্ণ সংগ্রামের জন্য সালাম জানাই।

স্বাক্ষর: মেজর আবদুর গফফার

২১-০৮-১৯৭৩ ইং

 

* ১৯৭৩ সালে এ সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়। জনাব গাফফার একাত্তরের মার্চে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে এ্যডজুটেন্ট হিসাবে ক্যাপ্টেন পদে ছিলেন।

Scroll to Top