<১০, ২০.৫, ৪৬৭-৪৭২>
সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল এম,এ,মান্নান*
১১-১২-৭৯ *
আমি (৩০-৩১ জুলাই জেড ফোর্সের কামালপুর সংঘর্ষে) আহত হওয়ার পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় পুনা।সেখানে একদিন চিকৎসা নেওয়ার পর হেলিকপ্টারে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ১৫১ বেইস হাসপাতাল গৌহাটিতে।সেই হাসপাতালে আমি এক মাসাধিকাল চিকিৎসাধীন ছিলাম।আগষ্ট মাসের শেষের দিকে জেঃ জিয়া আমাকে দেখতে সেখানে যান।ক্রমে আমি কিছুটা আরোগ্য লাভ করি।আমি খবর পাই যে,আমার পেরেন্টস কলকাতার দিকে গেছেন।তখন আমি জেঃ জিয়ার কাছে কয়েকদিনের ছুটি প্রার্থনা করি।তিনি আমার ছুটি মঞ্জুর করেন।আমি কলকাতা চলে যায়।সেখানে ৪/৫ দিন থাকার পর জেনারেল ইসলামের কাছে খবর পাই যে,সমস্ত সেক্টর কমান্ডার ৮ থিয়েটার রোডে কনফারেন্স ডাকা হয়েছে এবং জেনারেল জিয়াও কনফারেন্সে আসবেন।ঐ কনফারেন্সে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরসমূহের রুপরেখা ও নানাবিধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।এরপর আমি আমার ১ নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটে ফিরে আসি।তারপর শুনতে পাই যে ১১ নং সেক্টর নামে একটি নতুন সেক্টর গঠিত হয়েছে যার হেডকোয়ার্টার মহেন্দ্রগঞ্জে।কর্নেল তাহের সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব নেন।আমি যেহেতু অসুস্থ ছিলাম তাই আমাকে দুই নং সাবসেক্টরে দেওয়া হয়।সেক্টর এক্সিকিউটিভ হিসাবে আমি দায়িত্বভার গ্রহণ করি।
এই সেক্টরে আমার যোগদান করা থেকে শুরু করে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ছোট বড় উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোই আমি বলবো।
কামালপুরে পাকিস্তানী আর্মির যে ঘাঁটি ছিল তা অত্যন্ত সুদূঢ় ছিল।ঐ ঘাঁটির সমস্ত বাংকারগুলো ছিল সিমেন্টের আর-সি-সি বাংকার।কমিউনিকেশন ট্রেঞ্চ দিয়ে সেগুলো কানেক্টেড ছিল।কামালপুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল।তাই তারা এটাকে খুব শক্ত করেছিল,কারণ কামালপুরে যোগাযোগ বিস্তৃত ছিল বক্সিগঞ্জ,শেরপুর,জামালপুর,মধুপুর,হয়ে ঢাকা পর্যন্ত।তাই এই সেক্টর পাকিস্তানীদের কাছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল তেমনি আমাদের দিক থেকেও ছিল গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।পাকিস্তানীরা জানতো এই সেক্টরে তাদের পতন হলে ঢাকা পৌঁছা তাদের পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়বে।আমি আমার সহকর্মীদের বলেছিলাম,কামালপুরের পতন হলে সাতদিনের ভিতর ঢাকারও পতন ঘটবে।মূলতঃ কামালপুরের পতন হলো ৪ তারিখ বিকেলে এবং এর কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকারও পতন হলো।এই বাহিনীর ঢাকা পৌঁছাতে সময় লাগলো ৭/৮ দিনের মতো।উল্লেখ্য,কামালপুরে যে ট্রুপস ঢুকেছিল তারাই প্রথম ঢাকা পৌঁছেছিল।কামালপুরে যুদ্ধে পাকিস্তানীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।অবশ্য তারা যুদ্ধের ব্যাপারে প্রচুর মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছিল।তাদের প্রচারণার এক-দশমাংশ সম্ভবত সত্য।
আমি এই সেক্টরে যোগদানের পর আরও অনেক ঘটনা বা যুদ্ধ হয়,যেমন ধানুয়া-কামালপুরের যুদ্ধ।ধানুয়াকামালপুর কামালপুরের পরেই একটি গ্রাম।এই গ্রামটির কন্টিনিউয়েশন ভারত সীমান্তের ওপারের গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত।সীমিত হাতিয়ার নিয়ে যেহেতু আমরা পাকিস্তানীদের সুগঠিত ক্যাম্প থেকে উৎখাত করতে পারছিলাম না তাই বিকল্পপন্থায় ধানুয়াকামালপুর থেকে থেকে এমবুশ করার চেষ্টা করছিলাম একটা ডিফেন্স নিয়ে।এই ধানুয়াকামালপুর একটা কন্টিনিউয়েশান ছিল ফিরোজপুর হয়ে বক্সিগঞ্জের দিকে।এই পথে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমি ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে ৬/৭ খানা পাকিস্তানী আর্মির গাড়ি মাইনের সাহায্য ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিলাম।বক্সিগঞ্জ থেকে কামালপুরের দূরত্ব ৭ মাইল।পরবর্তী পর্যায়ে তারা কোনো গাড়ি নিয়ে কখনো মাইনের ভয়ে এই দূরুত্ব অতিক্রম করতে পারেনি।অতিক্রম করতে চাইলেও গরু কিংবা মহিষের গাড়ী দিয়ে আগে পথ পরিক্ষা করে নিত।তারপরও পরীক্ষিত পথে তারা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল।আমার মনে আছে,একদিন আমরা ছোট একটি দল নিয়ে কামালপুর এবং বক্সিগঞ্জের মাঝখানে এমবুশ লাগিয়ে পাকিস্তানীদের অপেক্ষায় বসে ছিলাম।কামালপুরের পাকিস্তানীদের জন্য খাবার-দাবার সরবরাহ হতো বক্সিগঞ্জ থেকে।এ পথে সন্দেহজনক এক লোক যাওয়ার সময় আমরা তাকে ধরি এবং এক অফিসারের জন্য প্রেরিত খাবার-দাবার এবং পাকিস্তানীদের কিছু চিঠিপত্র হস্তগত করি।উর্দু- ইংরেজিতে লেখা ঐসব চিঠির পাঠ উদ্ধার করে আমরা জানতে পারি দিন আর বেশী নয়।তারা হ্যান্ডস আপ করবে।
আরও একটি ঘটনা -তারিখ ঠিক মনে পড়ছে না।সেদিন আমরা ৬০/৭০ জনকে নিয়ে আখক্ষেতের ভিতর ডিফেন্স নিয়েছি।পাকিস্তানীরা বেরিয়ে আসে।তাদের সাথে প্রচন্ড গোলাগুলি হয়।এতে পাকিস্তানীদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়।আমার দুই জনের একটি ছোট্ট দল ছিল।তাদের নাম মনে পড়ছে না।১১ নং সেক্টরের ১১৩ জনের যে লিস্ট আছে তাদের কেউ হবেন।তারা ট্রেন্সের পিছনে বসা ছিল।সেখান থেকে তারা পাকিস্তানীদেরকে আক্রমণে ব্যস্ত ও মরিয়া হয়ে উঠেছিল।এক পর্যায়ে বুলেট শেষ হয়ে গেলে এরা পাকিস্তানীদের হাতে মারা যায়।দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানীদের মতো লাস্ট বুলেট এরা লড়াই করেছিল।এদেরকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে সামরিক মর্যাদায় দাফন করি।এদের স্মৃতিফলক বর্তমান।
ধানুয়াকামালপুরে আমরা যে ডিফেন্স নিয়েছিলাম তার একটি ঐতিহাসিক ঘটনা সেপ্টেম্বর মাসের কোন সময়ে ঘটেছিল।সেটা পরিচালনা করেছিলেন প্রথম বেঙ্গলের একটি কোম্পানি।অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন।তার সাথে অফিসার ছিল বর্তমান কর্ণেল পাটোয়ারী।তারা ধানুয়াকামালপুর ডিফেন্স নিলেন।পাকিস্তানীরা এসে আক্রমণ করে,ফলে প্রচন্ড সংঘর্ষ বাধে।পাকিস্তানীদের প্রায় ৩০/৪০ জন মারা যায়,আমাদের পক্ষে মাত্র একজন আহত হয়।পাকিস্তানীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।সেই অপারেশনে আমরা পাঞ্জাবীদের একটা মৃতদেহ নিয়ে আসতে সক্ষম হই।মৃত দেহের কপালে গুলি লাগে।এই মৃত দেহ আমাদের সকল সৈন্যদের দেখনো হয়।ফলে তাদের মনোবল বেড়ে যায়।অবশ্য পরে মুসলমান হিসাবে কবর দেওয়া হয়।পরে আমরা যখন ফিরে যাই তখন শুনতাম পাকিস্তানীরা কার নাম ধরে ডাকছে।সম্ভবতঃ মৃত লোকটিরই।
এছাড়াও কামালপুরে এমন কোন দিন ছিল না যে পাকিস্তানীরা শান্তিতে বসবাস করতে পারতো।কামালপুর-বক্সিগঞ্জে পাকিস্তানীদের যে টেলিফোন যোগাযোগ ছিল তা আমরা কেটে দিতাম।এক পর্যায়ে ১০/১২ জনের একটা ছোট দলকে এ ধরনের অপারেশনে পাঠাই।তারা প্রথমে টেলিফোনের তার কেটে দিয়ে ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে।পরে যখন পাকিস্তানীদের তার ঠিক করার পার্টি আসে তখন তাদের উপর আক্রমণ করে বসে।গোলাগুলি করে।পাকিস্তানীদের ক্ষতিসাধন করে ফিরে আসে।আমাদের কোন ক্ষতিই হয়নি।
আরও একটি ঘটনা।অক্টোবর মাসের কোন এক সময় ইন্ডিয়ান আর্মির একটি ব্যাটালিয়ন দিয়ে পাকিস্তানীদের উপর আক্রমণ চালানো হল।সেই আক্রমণে ইন্ডিয়ার একটি কোম্পানি কামালপুরের একটু পিছনে এমবুশ করে।যখন তাদের উপর আক্রমণ চলছিল তখন মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কোম্পানীও তাদের সাথে ছিল।কামালপুরের ফোর্সকে সহায়তা করার জন্য বক্সিগঞ্জ থেকে মর্টার নিয়ে তিনটি পাকিস্তানী গাড়ী আসছিল।তখন রাস্তায় এমবুশ করে গাড়ী সমেত পাকিস্তানীদের খতম করা হয়।
তারপর সম্ভবতঃ নভেম্বর মাস হবে।ইন্ডিয়ান আর্মির মাউন্টেন বিগ্রেডের একটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে কামালপুর আক্রমণ করানো হয় এবং একটি ব্যাটালিয়ন দিয়ে কামালপুর-বক্সিগঞ্জের মধ্যে এমবুশ লাগানো হয়।আমাদের দুটি কোম্পানী।একটির কমান্ডার আমি নিজে,সেটা নিয়ে আমি একটা ব্লকিং পজিশন তৈরী করি।সেটা কামালপুর মেইন পজিশন থেকে প্রায় ১৫০ গজ দুরে।আমার বিপরীতে ছিলেন বর্তমান মেজর মিজান।তার কোম্পানী সমেত তাঁকে নিয়ে একটি ব্লকিং পজিশন তৈরী করা হয়।আমাদের উপর নির্দেশ ছিল আমরা আখ ক্ষেতের ভিতর ট্রেঞ্চ খুঁড়ে পজিশন নিয়ে বসে থাকবো,যেন পাকিস্তানীরা এই দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে।যখন আমরা এই পজিশনে পৌঁছালাম তখন রাত প্রায় সাড়ে তিনটা।আমাদের সাপোর্টে ছিল ইন্ডিয়ান একটি আর্টিলারী রেজিমেন্ট এবং একটি মর্টার বাহিনী।তারা কামালপুরের উপর শেলিং করছিল।সকালের দিকে যোগাযোগের জন্য আমাদের কাছে ছোটছোট অয়্যারলেস সেট দেয়া হয়।কর্ণেল তাহের থাকলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের সঙ্গে যিনি মাউন্টেন ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন।ওখানে তিনি তাদের সাথে এই অপারেশনটা কো-অর্ডিনেশন করছিলেন।আমি যখন আমার পজিশনে পৌঁছে গেলাম তখন ছিল সকাল সাড়ে চারটা।তখন ইন্ডিয়ান আর্টিলারী ফায়ার করছিল।বেশ কতগুলো আর্টিলারী শেল আমাদের পজিশনের উপর এসে পড়লো।আমার এই কোম্পানীতে মোট ১০৯ জন ছেলে ছিল।তার মধ্যে ৯ জন আমার অত্যন্ত বিশস্ত ছিল।এরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এলোপাতারি দৌড়াদৌড়ি করে পালিয়ে যেতে লাগলো।মাত্র ক’ জন ছেলে নিয়ে আমি সেই পজিশনে পৌঁছালাম।তারপর অয়্যারলেস সেটে কর্ণেল তাহেরের সাথে যোগাযোগ করি এবং আমাদের পজিশনের উপর শেলিংয়ের বিস্তারিত ব্যাপার তাকে জানাই এবং ফায়ারিং বন্ধ করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করলাম।আমি বুঝে উঠতে পারলাম না ফায়ারিং কোন পক্ষের,কারণ এই পজিশনের ওপর ফায়ার করার কোন কথা ছিল না।তিনি ফায়ার বন্ধ করলেন।সম্ভবতঃ রেঞ্জিংয়ে কোন ডিফিকাল্টি ছিল,যার জন্য এটা হয়েছিল।পরে তাঁকে আমি ফায়ারিং কারেকশন জানাই।তখন সকাল হয়ে আসছে। কর্ণেল তাহের এক পর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন লেঃ মিজানের সাথে আমার কোন যোগাযোগ আছে কিনা।আমি বললাম এখন নেই।তিনি বললেন তাকে কল দাও,আমিও তার খোঁজ নিচ্ছি।তিনি ৫/৬ জনকে নিয়ে মিজানের পজিশনের দিকে গেলেন।প্রায় ৪৫ মিনিট থেকে ঘন্টাখানেক পর আমি সেটে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম।কান্না বিজরিত কন্ঠে বেলাল বলতে লাগলো শেলিং -এ তাহের ভাইয়ের পা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।মিজানের পজিশনের কাছে পাকিস্তানীরা তাকে দেখতে পেয়ে ৬০ এম-এম মর্টার থেকে শেলিং করে।তার একটি পা নষ্ট হয়ে যায়।৩০/৪৫ মিনিট পর একটি হেলিকপ্টারএসে কর্ণেল তাহেরকে নিয়ে যায়।১০-১১ টা পর্যন্ত সেই পজিশনে থাকলাম।পরে আমার কাছে এক মেসেঞ্জার একটা কাগজ নিয়ে আসেন,কর্ণেল তাহেরের লেখা,তাতে লেখা ছিল আমাকে এই সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।লেখাটুকু পুরোপুরি স্মরণ নাই।সম্ভবতঃ এ ধরনের ” Clear the road from here to Dacca.Look after my bodys.I leave everything to you and God bless you.” আরও অনেক কিছু ছিল।আমি অত্যন্ত মর্মাহত হলাম।কারণ আজ এই সেক্টরের দায়িত্ব আমার উপর দেয়া হয়েছে।আমি জানি না এই দায়িত্ব আমি সুষ্ঠভাবে পালন করতে পারবো কিনা।আমার মনে হচ্ছিল আকাশটা আমার আমার মাথায় ভেঙ্গে পড়েছে।যা হোক,সে অবরুদ্ধ অবস্থায় আমরা বিকেল পর্যন্ত সেখানে থাকলাম।স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহকে এই দায়িত্ব না দিয়ে আমার উপর তিনি এই দায়িত্ব দেন।অবশ্য পরে হামিদুল্লাহ আসার পর তিনি নামে মাত্র কমান্ডার রইলেন।অপারেশনের দায়িত্ব আমার উপর দেন,কারণ তিনি বিমানবাহিনীর লোক।অপারেশনর এইসব ব্যাপারে তিনি ততো অভিজ্ঞ নন।কর্ণেল তাহের আহত হওয়ায় আমরা সবাই মর্মাহত হই।একটা বিরাট শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল।অনেকটা গোটা পরিবার আকস্মিক পিতৃহীন হয়ে পড়ার মত।যাহোক অনেক কষ্টে আমি এই পরিস্থিতি সামলে নিয়েছিলাম।কর্ণেল তাহের গৌহাটিতে চিকিৎসাধীন থাকাকালে আমি সেখানে গিয়ে তার সাথে দেখা করে যুদ্ধ বিষয়ক পরামর্শ করি এবং সেক্টরে ফিরে আসি।
ডিসেম্বর এর তিন তারিখ ভারত আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষনা করে।১ তারিখ থেকে আমরা কামালপুর অবরুদ্ধ করে রাখি।আমাদের সাথে ছিল এক ইন্ডিয়ান রেগুলার ব্যাটালিয়ন,মুক্তিযোদ্ধা তিন কোম্পানী।আর ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের দুইটি ব্যাটালিয়ন কামালপুর বাইপাস করে কামালপুর পতনের আগেই বক্সিগঞ্জের দিকে চলে যায়।তখন পাকবাহিনী বক্সিগঞ্জ থেকে পিছু হটে যাচ্ছে।৪ তারিখ সকালে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের দুটি বিমান কামালপুরের উপর স্ট্রাফিং শুরু করে।দ্বিতীয়বার আক্রমণ হয় ১২ টা কি ২ টায় তৃতীয়বার আক্রমণ করার কথা ছিল বিকাল চারটায়।ইতিমধ্যে পাকিস্তানী বাহিনী যথেস্ট হেস্তনেস্ত হয়েছে।আমরা অয়্যারলেস সেটে ইন্ডিয়ানদের কনগ্র্যাচুলেশন শুনছিলাম।এক পর্যায়ে কামালপুরে তাদের যে ফোর্স ছিল তারা কন্টাক্ট করে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের সাথে এবং সাহায্য চেয়ে পাঠায় ফোর্সের জন্য।তারা জানালো তাদের কিছু করণীয় নাই।এটা বুঝে তখন জেনারেল হিরা,ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ও আমি তিনজনে বসে বুঝাপড়া করে একটা সারেন্ডার নোট তৈয়ার করি।একজন ফ্রিডম ফাইটারকে একটি সাদা ফ্লাগ হাতে দিয়ে তা কামালপুর ঘাঁটি ভিতর পাঠাই।প্রায় ঘন্টাখানেক পর সে যখন ফেরে নাই,তখন আমি অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লাম।দ্বিতীয়বার আর একটি ছেলেকে অয়ারলেস সেট সাথে দিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ রেখে কামালপুর ঘাঁটিতে পাঠাই।সে ওখানে যাওয়ার পর পাকসেনারা দ্বিতীয় ছেলেটিকে রেখে প্রথম ছেলেটিকে পাঠিয়ে দেয়।তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করি।সে জানালো,আমাকে তারা শেলিং হচ্ছে বলে নীচে বাংকারে নিয়ে যায় রুটিটুটি খেতে দেয়।তারা আমার সাথে ভাল ব্যবহার করে।যা হোক দ্বিতীয় ছেলেটির সাথে কয়েকবার সেটে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম।পারলাম না।সে তখন তাদের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত ছিল।তাছাড়া তারা তাকে সেটে কথা বলতে দিতে এলাউ করেনি।কিছুক্ষন পর সে যখন সেটে আসলো তখন যোগাযোগ হলো।ছেলেটি জানালো তারা সারেন্ডার করতে প্রস্তুত আছে।তখন আমি তাকে বললাম যে,আমি আর একজনকে পাঠাচ্ছি,তাদের জে-সি-ও বা অফিসার লেবেলের কাউকে তার সাথে আসতে বলো।সে গেল।যাওয়ার পর পাকিস্তান আর্মির একজন জে-সি-ও,মিলিশিয়া কাপড় পরা,সম্ভবতঃমিলিশিয়াই হবে,ছেলেটির সাথে এসে আমাদের সাথে যোগাযোগ করে এবং সারেন্ডারের কথা ব্যক্ত করে।তখন আমরা তাদেরকে সারেন্ডারের পদ্ধতি বলে দিই।সে ফিরে যায় এবং হাতিয়ার মাঠিতে রেখে সবাইকে সারেন্ডার করায়।আমরা তাদের সব হাতিয়ার এবং সকলকে আমাদের পজিশনে নিয়ে আসি।এদের মধ্যে একজন অফিসার,ইনি সম্ভবত ক্যাপ্টেন হাসান কোরেশী,একজন জে-সি-ও,এবং ১০০ জনের মত সিপাই,৩০ জনের মত রেঞ্জার এবং কিছুসংখ্যক রাজাকার ও ছিল।এদেরকে আনা হল।সমস্ত হাতিয়ার আনা হলো।আমরা যে হাতিয়ার পেলাম তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল এম-জি ৩৬ টি এবং আরও ছোটখাটো হাতিয়ার।যারা সারেন্ডার করে তাদেরকে রাখার ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো।তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।আমি অবরুদ্ধ ২৪ ঘন্টা ব্যস্ত ছিলাম।খাওয়া-দাওয়া ছিল না।তাই বিশ্রামে চলে যাই।Next day morning about 8- o clock I came back to the same place and there I found one Indian Capt.and one Indian Major.They were talking to Capt.Quoreishi etc.
যুদ্ধবন্দী আচরণ সংক্রান্ত কথাবার্তা হলো।তারপর দিন আমরা বক্সিগঞ্জ পৌঁছালাম।ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার সেখানে একটি রেস্ট হাউজে ছিলেন।আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন এবং কনগ্র্যাচুলেশন জানালেন।বললেন Mannan,our country recognize your country as a sovereign state.Now your morale should be high.we are going to fight a real battle to the pakistanis.
বক্সিগঞ্জে তখন কোন পাকিস্তানী ছিল না।তারা জামালপুরের দিকে চলে গেল।আমি আমার মুক্তিবাহিনী নিয়ে জামালপুরের দিকে অগ্রসর হলাম।আমি আগেই বলেছিলাম তাদের দুটি ফোর্স কামালপুর বাইপাস করে চলে গিয়েছিল।এই ফোর্সগুলো যখন টাঙ্গাইলের দিকে যাচ্ছিল তখন ইন্ডিয়ান ফোর্স তাদেরকে বাধা দেয়,যেন তারা টাঙ্গাইল যেতে না পারে।তারা যখন বাধা পেল তখন এক ব্যাটালিয়ন নান্দাইল হয়ে ময়মনসিংহের দিকে যে রাস্তা ছিল সেদিকে যেতে চেস্টা করে।তারাও বাধাপপ্রাপ্ত হলো।আমি আমার ফ্রিডম ফাইটারদের নিয়ে শেরপুর হয়ে জামালপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম।তখন আমি প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।তখন আমি নদী পার হতে পারিনি,কারণ নদীতে কোন ফেরীর বন্দোবস্ত ছল না।আর আমি দেখতে পাচ্ছিলাম দুটি ইন্ডিয়ান এয়ারক্রাফট জামালপুরের উপর ভীষণভাবে গুলিবর্ষণ করে চলেছে।আর তুমুল “গুলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম।প্রায় ঘন্টাদুয়েক সংঘর্ষের পর সব শান্ত হলো।ইন দি মি টাইম আমি ব্রক্ষ্মপুত্র নদ ক্রস করে জামালপুর সাইডে পৌঁছে গেলাম এবং অগ্রসর হতে লাগলাম।খবর পেলাম,পাকসেনাদের পুরো কনভয় ডেস্ট্রয় করা হয়েছে এবং প্রায় ৬ জন অফিসারসহ ৩৬০ জন পাকসেনাকে সেখানে বন্দী করা হয়েছে।তাদেরকে ইন্ডিয়ান আর্মি ঘেরাও করে জামালপুর পি-টি-আই তে রাখে।তখন আমি সেখানে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করি।বন্দি ছয়জন অফিসারের মধ্যে একজন মেডিক্যাল কোরের সদস্য ছলেন।আর একজন সিনিয়র মেজর ছিলেন,যিনি এই ব্যাটালিয়নের ও-সি ছিলেন। তার নাম মনে নেই,তিনি পাঠান এং কর্ণেল তাহেরের কোর্স মেট।তার সাথে কর্ণেল তাহের সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল।আলাপ-আলোচনার মধ্যে একজন ইন্ডিয়ান গার্ড রেজিমেন্টের সি-ও এসে যোগ দেন।পাক সিনিয়র মেজর আমাকে প্রশ্ন করেন, Manna, we fighting among us,আমি জবাব দেই,স্যার আপনারা পহেলা মার্চ থেকে থেকে ২৫ শে মার্চ যে হত্যাকান্ড করেছেন তার রিআ্যকশন স্বরুপ এছাড়া আমাদের কিছু করণীয় ছিল না।তারপর আমি তাকে আরও ঘটানার কথা বললাম।তিনি বললেন,Happy news that you are independent but I wish you are not like bhutan. আমি প্রত্যুত্তরে বলি,Sir, if we can get rid of you, we can get rid of anyone. we will never replace one master by another.
যাহোক, জামালপুর থেকে আমরা ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম আর ইন্ডিয়ান আর্মির যে দুটি ব্যাটালিয়ন ছিল তারা টাংগাইলের দিকে অগ্রসর হলো।আমি সেদিকে যেতে চেয়েছিলাম।কিন্তু জেনারেল নাগরা,যিনি এই ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন,তিনি আমাকে সেদিকে যেতে বারণ করেন।তিনি বললেন, তোমার সেদিকে যাওয়া প্রয়োজন হবে না।তুমি বরং এখানে লোকাল এডমিনিস্ট্রেশন এবং অন্যান্য সবকিছু তদারক কর।যা হোক আমি লোকাল এডমিনিস্ট্রেশন এবং সবকিছু যা যা অর্গানাইজ করার দরকার ছিল সবকিছু অর্গানাইজ করার চেষ্টা করলাম।আমি আমাদের ছেলেদের জামালপুর হাই স্কুলে ক্যাম্প করে তাদেরকে সেখানে থাকতে দিলাম।ইতিমধ্যে আমি সংবাদ পেলাম যে,জামালপুর থেকে মাইল দেড়েক দূরে পাক রাজাকার থেকে উদ্ধারকৃত ৩০০ টির মতো হাতিয়ার জড়ো করেছে এবং কোথাও সেগুলো সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে।আমি সেখানে গেলাম এবং তাদের সাথে কথা বললাম।তার জানালো এই সমস্ত হাতিয়ার পাবনা যাবে।পরে আমি সেগুলো সীজ করলাম।হাতিয়ার গুলো নিয়ে তারপরের দিন ময়মনসিংহে আসি।এসে দেখি ময়মনসিংহ ও মুক্ত।এটা আনুমানিক ১০ ই ডিসেম্বর।আমার হেড কোয়ার্টার টাউন হলে খুলি এবং আমার ফৌজ অর্গানাইজ করি।তারপর সিভিল এডমিনিস্ট্রেশন চালানোর জন্য আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিই।
*(১৯৭১ সালে লেফটেন্যন্ট হিসাবে কর্মরত ছিলেন।পরবর্তীতে লেঃ কর্ণেল পদে উন্নীত হন।বিবরণটি প্রকল্প কর্তৃক ১১-১২-৭৯ তারিখে গৃহীত সাক্ষাৎকার থেকে সংকলিত)