শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২। ৬ নং সেক্টরের যুদ্ধ সম্পর্কে অন্যান্যের প্রদত্ত বিবরণ ও তথ্যাদি | বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র | ১৯৭১ |
<১০, ১২.১, ৩০৩-৩০৯>
সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল দেলোয়ার হোসেন
১৬- ১০- ১৯৭৪
২২ শে আগস্ট আমাকে ৬ নং সেক্টরে (রংপুর- দিনাজপুর) ক্যাপ্টেন আজিজ পাশাকে ২ নং সেক্টরে এবং ক্যাপ্টেন শাহজাহানকে নয় নং সেক্টরে পোস্টিং দেয়া হয়। ২৩ শে আগস্ট রাতে আমি শিলিগুড়ি পৌছি এবং প্রথমে ৬ নং সেক্টরে কর্তব্যরত ক্যাপ্টেন নাজমুল হকের (বর্তমানে মেজর) সাথে দেখা করি।
বাংলাদেশের মুক্ত এলাকায় এসে নিজেকে গৌরবান্বিত করি। আমার এত আনন্দ হয়েছিল যা আজ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। শীঘ্রই আমি ৬ নং সেক্টরে কর্তব্যরত স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দিনের সাথে দেখা করি। এরপর আমি আমাদের সাহায্যে নিয়োজিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারদের সাথে সাক্ষাৎ করি। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম কবে আমি অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে যাব এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাব। যদিও আমার রংপুর ও দিনাজপুর এলাকা সম্বন্ধে ধারণা খুব কম ছিল তবুও দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। এই সময় আমি শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রথম অপারেশন শুরু করি। আমি শত্রুদের বিরুদ্ধে আক্রমন চালিয়ে তাদের ৫ জন কে নিহত ও ১২ জন কে আহত করি। আমার সাথে যারা ছিল তারা সবাই নতুন শিক্ষাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের ১ জন সামান্য আহত হয়। আমরা হালকা মেশিনগান এস এম জি ৩০৩ রাইফেল ও ২ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে শত্রুদের বিরুদ্ধে আক্রমন চালিয়েছিলাম। আমাদের ডিফেন্স পজিশন থেকে ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্য দেয়া হয়।
অমরখানা সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা আমি জীবনে ভুলতে পারব না। তার মত সাহসী যোদ্ধার কথা ইতিহাসে লেখা থাকবে বলে আমি মনে করি। ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার শত্রুদের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করেছিল। পাকসেনাদের কাছে সে ভীতির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাকে একটানা কয়েকদিন ও রাত না ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছি। ৬ নং সেক্টরের অফিসারদের তার মত এত কৃতিত্বের দাবীদার আর কেউ নয়। আমি ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার কে কোন সময়ে বিমর্ষ দেখিনি। দেশপ্রেমিক ও প্রকৃত যোদ্ধার মত তিনি শত্রুদের মোকাবিলা করেছিলেন।
৬ নং সেক্টরের উইং কমান্ডার মিঃ বাশারের (বর্তমান গ্রুপ ক্যাপ্টেন) সাথে আমার তখনো পরিচয় হয়নি। একদিন তিনি আমাকে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য বলে পাঠালেন। আমি তাঁর নির্দেশ মত দেখা করি। একজন এয়ার ফোর্সের অফিসার হউয়া সত্বেও তিনি ৬ নং সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন তা যেকন দক্ষ পদাতিক অফিসারের সাথে তুলনা করা চলে। তিনি নিপুণতার সাথে ৬ নং সেক্টর পরিচালনা করেন। দদীর্ঘ ৯ মাস তিনি সুদক্ষ ভাবে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন। ৬ নং সেক্টর রংপুর – দিনাজপুর জেলা নিয়ে গঠিত। অনেক সময় তিনি আমাকে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে অপারেশনে বহু সাহায্য করেছেন।
আমাদের সেক্টর ৬ এর সদর দফতর বুড়িমারিতে স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের অন্যান্য সেক্টরগুলির তুলনায় একমাত্র আমাদের সেক্টরেই বহু মুক্ত এলাকা ছিল। আমাদের সেক্টর সদর দপ্তর ও সাব সেক্টর দপ্তর বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই স্থাপন করা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের (বর্তমান মেজর) উপর ন্যস্ত ছিল সাহেবগঞ্জ সাব সেক্টর। তাঁর নিয়ন্ত্রণে কিছু নিয়মিত ও ই পি আর বাহিনীর সৈন্য ছিল। সাহেবগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ অনেক আগেই শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন। পাটগ্রাম সাব সেক্টর পরিচালনার ভার ছিল ক্যাপ্তেন মতিয়ুর রহমানের উপর। তিনি অনেক স্থান শত্রুমুক্ত করে রেখেছিলেন। দিনাজপুরের তেঁতুলিয়া সাব সেক্টর পরিচালনার ভার ছিল স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দিনের (বর্তমান উইং কমান্ডার) উপর। এখানেও অনেক এলাকা মুক্ত ছিল।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য সেক্টর ৬ এর বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করা হয়েছিল। ঠাকুরবাড়ি কোটগাছ হিমকুমারী শীতলকুচি গিতলদহ সোনাহাট প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। সেই সময়ে সামরিক অফিসারের অভাবে ঠাকুরবাড়ি এবং কোটগাছ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া যাচ্ছিল না। সেক্টর কমান্ডার বাশার আমাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঠাকুরবাড়ি ও কোটগাছ ক্যাম্প পরিচালনার ভার দেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ মত ঠাকুরবাড়ি ও কোটগাছ ক্যাম্প এ মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে থাকি। শত শত শিক্ষিত ও অশিক্ষিত যুবককে সামরিক ট্রেনিং দিতে থাকি। এরা প্রায় সকলেই সামরিক ট্রেনিং এ অনভিজ্ঞ ছিল। সহজেই বুঝতে পারা যায় যে অনভিজ্ঞ যুবকদের কত কষ্টে সামরিক শিক্ষা দিতে হয়েছে। কিন্তু আমার অধীনে শিক্ষা প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক ট্রেনিং ও জ্ঞান অর্জনে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। তারা কোন দিন কোন অসুবিধার কথা আমাকে জানায়নি। তাদের যাকে যা কাজ দেয়া হত তারা তা ভালভাবেই সম্পন্ন বা কর্তব্য পালন করবার চেষ্টা করত। মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেয়া হত। সেই জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানী প্লাটুন ও সেকশনে ভাগ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ভিতরে পাঠাবার পূর্বে সেই স্থান ভালভাবে রেকী করা হত এবং আমি নিজেই অনেক স্থান রেকি করে তাদের পাঠিয়েছি।
প্রথমে আমি যে সব এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ করাই সে এলাকাগুলো হল দিনাজপুর জেলার বালিয়াডাঙ্গি রুহিয়া লেহেরী ও আটাওয়ারী। এসব এলাকায় আমিই রেকী পরিচালনা করেছিলাম। রেকী করা কালে অনেক সময় ইপিকাফ রাজাকার এবং পাকিস্তানী রেঞ্জারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলাম। এই রকম একটি ঘটনা ঘটে ৫ ই সেপ্টেম্বরে। রেকী করার জন্য যাই। আমার সাথে ১২ / ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল, আর সঙ্গে ২ টা এল এম জি, একটি ২ ইঞ্চি মর্টার, স্টেনগান ও ৩০৩ রাইফেল ছিল। একটি স্কুলে পাকসেনাদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। সেখানে পাকসেনাদের ২ টা প্লাটুন ছাড়াও ইপিকাফ ও বিহারী রাজাকার ও ছিল। আমাদের রেকী করার খবর কিছু দালাল পাকসেনাদের জানায়। আমি সাধারণত গেরিলা যুদ্ধ চালাতাম। শত্রুদের অকস্মাৎ আক্রমন করে দ্রুত সরে পরাই আমাদের লক্ষ্য ছিল। শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমন শুরু করে দেয়। তিন ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলার পর আমি আমার দল নিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হই। এ যুদ্ধে আমার ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। এই ঘটনার পর আমি মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশের ভিতরে অনুপ্রবেশ করানোর জন্য সীমান্তের নিকটবর্তী কয়েক স্থানে বেইস স্থাপন করি। পরে এই স্থানগুলি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ করানো হয়। ৫০০ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রতিষ্ঠিত বেইস দিয়ে ঠাকুরগাঁও রানীসংকৈল বোদা পচাগর ইত্যাদি স্থানে পাঠান হয়। এইভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ভিতরে অনুপ্রবেশের ব্যবস্থা সম্পন্ন হলে সেক্টর কমান্দার উইং কমান্ডার বাশার আমাকে রংপুরের গীতলদহ ও শীতলকুচিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প পরিচালনার ভার নিতে নির্দেশ দেন। তখন পর্যন্ত এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ কোন কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। গীতলদহ ক্যাম্পে ২০০০ এবং শীতলকুচি ক্যাম্পে ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিচ্ছিল। আমার দায়িত্ব ছিল নিম্নরূপ –
(ক) ট্রেনিং থেকে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রহন করা।
(খ) মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশনে পাঠাবার ব্যবস্থা করা। তাদের এম্বুশ রেইড আক্রমণ রেল ও সড়ক সেতু (যেগুলো শত্রুদের যাতায়াতে সাহায্য করত) উড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশ প্রদান।
(গ) মুক্তিযোদ্ধাদের ঐ এলাকার রাস্তাঘাট ও অন্যান্য বিষয়ে জানানো।
(ঘ) মুক্তিযোদ্ধাদের ঐ এলাকার জনগনের সাথে মিশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্বন্ধে জানানোর ব্যবস্থা করা।
(ঙ) সর্বোপরি পাকসেনাদের অধিকৃত এলাকার ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশের ব্যবস্থা করা।
আমি এই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প পরিচালনার ভার নিয়ে প্রথমে তাদের পরীক্ষা করে দেখি। তাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যপারে কিছু জানা নাই এবং সামরিক কৌশল সম্বন্ধে ধারণা নাই। সামরিক অফিসারের অভাব থাকার জন্যই তাদের পক্ষে সামরিক কৌশল সম্বন্ধে জানা সম্ভব হয়নাই। সেই জন্য ক্যাম্প দুটির মুক্তিযোদ্ধাদের ঠিকমত পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। আমি তাদের সুস্পষ্টভাবে সামরিক কৌশল শিখিয়ে অপারেশনে পাঠানোর জন্য তৈরী করি। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কোম্পানী প্লাটুন সেকশনে বিভক্ত করি। তাদের সংগঠিত করে পাকসেনাদের উপর দিনে কমপক্ষে ৫ বার হামলা করতে থাকি। এর ফলে তারা এত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে যে পাকসেনারা দিনেও বাংকার থেকে বেরিয়ে আসতে সাহস করত না। আমি অনেক অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যেতাম এবং এই ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়ে তুলি। আমার ব্যক্তিগত অংশগ্রহণের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা আমার নির্দেশ মেনে চলার চেষটা চালায়। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের পাকসেনাদের এমবুশ ও রেইড করা এবং রেল ও সড়কসেতু ধ্বংস করে দেয়ার নির্দেশ দেই। তাদেরকে অধিকৃত অঞ্চলে বেইস করে গড়ে তোলার নির্দেশ দেই। অনেককে ভেতরে পাঠিয়ে দেই পাকসেনাদের এমবুশ ও রেইড করে পর্যুদস্ত করার জন্য্য।
যেসব মুক্তিযোদ্ধা নতুন ট্রেনিং নিয়ে আসত তাদেরকে প্রথমে শত্রুদের বিরুদ্ধে এমবুশ ও রেইড করার নির্দেশ দিতাম। রেল ও সড়কসেতু ধ্বংস করে পাকসেনাদের যাতায়াতে বাধা সৃষ্টি করার জন্য পাঠাতাম। ছোটখাটো অপারেশনের দায়িত্ব দিয়ে তাদেরকে যুদ্ধকৌশলে পারদর্শী করে তোলা হত ।
একটি অপারেশনের কথা আমার মনে পরছে। লালমনিরহাট থেকে মোগলহাটে অবস্থানরত পাকসেনাদের জন্য প্রতিদিন সকালে ট্রেনে করে রসদ ও সৈন্য আসত। এই সাব সেক্টরের দায়িত্ব ছিল অসমসাহসী যোদ্ধা ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের উপর। তিনি আমাকে এই অপারেশন পরিচালনা করার ব্যপারে যথেষ্ট সাহায্য করেন। তিনি পিছনে অবস্থানরত প্লাটুনের সাহায্যে শত্রুট্রেনের উপর মর্টার চালানোর নির্দেশ দেন। দিনটি ছিল যতদুর সম্ভব ৬ সেপ্টেম্বর। ভোর ৫ টার সময় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মোগলহাট রেললাইনের নিকট অবস্থান নেই। রেললাইনের উপর এন্টি ট্যাঙ্ক মাইন বসানো হয়। গ্যালাটিন ও পি ই কে ঠিকমত বসিয়ে দূরে সুইচ লাগিয়ে শত্রুট্রেন আসার অপেক্ষায় অবস্থা নিয়ে অপেক্কা করতে থাকি। ঠিক সময়মত ট্রেনটি সামনের কয়েকটি বগিতে বালি ও অন্যান্য জিনিসে ভর্তি করে পিছনের বগীগুলিতে আসে। আমাদের এন্টি ট্যাঙ্ক মাইনের আঘাতে ইঞ্জিনসহ সামনের কয়েকটি বগী বিধ্বস্ত হয়। পাক সেনারা সঙ্গে সঙ্গে তাদের অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে আমাদের গোলাগুলির জবাব দিতে শুরু করে। তারা ট্রেন থেকে নেমে তিনদিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তিযোধাদের আমি পেছনে সরে যেতে নির্দেশ দেই। আমার কাছে ১ টা হালকা মেশিনগান ছিল। সেই মারণাস্ত্র দিয়ে আমি শত্রুসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাই এবং এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে পিছনে সরে যেতে সক্ষম হয়। এই অপারেশনে ২ জন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও ৪ জন আহত হয়। আমিও বাঁ হাতে সামান্য আঘাত পাই। শত্রুদের ৫ জন নিহত ও অনেকে আহত হয়। এই অপারেশন পরিচালনার জন্য পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার আমাকে বীরপ্রতিক উপাধিতে ভূষিত করেন। এই অপারেশনের খবর টি স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয়। এ ছাড়া আমি যেসব অপারেশনে অংশগ্রহন করি সেগুলো হল মোগলহাট পাক অবস্থানের উপর অকস্মাৎ আক্রমন নাগেশ্বরী পাক কোম্পানী হেডকোয়ার্টার আক্রমন, কম্বলপুর ব্রীজ অপারেশন কূলাঘাট শত্রু অবস্থানের উপর হামলা দোরাকুটি পাক অবস্থানের উপর হামলা নুমেরি পাক অবস্থানে আক্রমন, পটেশ্বরী শত্রু গোলন্দাজ অবস্থানের উপর হামলা ভাতমারী শত্রু কোম্পানী অবস্থানের উপর হামলা, কালীগঞ্জ পাক অবস্থান আক্রমন, তুষভান্ডা শত্রু প্লাটুনের উপর অকস্মাৎ আক্রমণ, হাতিবান্ধা শত্রুকোম্পানীর উপর আক্রমণ ইত্যাদি।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সীমান্তবর্তী থানাগুলতে আক্রমন চালানোর জন্য আমি কয়েকটা বেইস গড়ে তুলি। ফুলবাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। লালমনিরহান থানার ইমানগঞ্জ হাট ও কর্নার হাট এলাকায় আমাদের ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। কালিগঞ্জ থানায় দাইখোয়া ও চালতায় বেইস গড়ে তোলা হয়। এসব স্থান থেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা বিভিন্ন পাক অবস্থানের উপর এমবুশ ও রেইড করত। তারা রেল ও সড়কসেতু উড়িয়ে দিয়ে পাকসেনাদের যাতায়াতে বাধার সৃষ্টি করত।
এসব সীমান্ত এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করার পর রংপুর জেলার ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের কিভাবে অনুপ্রবেশ করানো যায় সে চিন্তা করতে থাকি। সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা ইতিমধ্যে পাকসেনাদের উপর আক্রমন চালিয়ে ক্ষতিসাধন করতে থাকি। পাকসেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে এমনকি দিনের বেলাতেও পাকসেনারা বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আসার সাহস করত না। পাকসেনাদের গতিবিধি অনেক কমে যায়। আমাদের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাবার ফলে পাকসেনারা গ্রামে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এর পূর্বে পাকসেনারা গ্রামে গিয়ে লুটতরাজ, নারীধর্ষণ, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া ও গ্রামবাসিদের উপর অত্যাচার চালাত। আমাদের কার্যকলাপের ফলে গ্রামবাসীরা অনেক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারা আমাদের শত্রুপক্ষের অনেক গোপন তথ্য জানিয়ে সাহায্য করত। আমার পক্ষে সব বেইস এলাকায় থাকা সম্ভব ছিল না। তাই মাঝে মাঝে প্রায় সব কটি বেইস এলাকায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে শত্রুদের বিরুদ্ধে অনেক অপারেশনে অংশগ্রহন করতাম। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। আমি ভিতরে অনেক লোককে নিয়োগ করি শত্রুপক্ষের গোপন তথ্যাদি ও গতিবিধি সম্বন্ধে খবর দেবার জন্য। তারা আমাকে ঠিকমত খবর দিয়ে অপারেশনে সাহায্য করত।
মুক্তিযোদ্ধারা প্রতি রাতেই তাদের অবস্থান বদল করত। এক স্থানে অবস্থান নিয়ে বসে থাকত না। আমি নিম্নলিখিত এলাকায় বেইস তৈরী করি। এগুলো হলঃ লালমনিরহাট থানার কস্তুরীহাট, কাউনিয়া থানার তেপাহাটা, গংগাচরা থানার গংগাচরা, লালমনিরহাট থানার শিবরাম ও পাঁচগ্রাম কাউনিয়া থানার সারাই ও নাজিরদহ পীরগাছা থানার জিগাবাড়ি ও বাজে মশকুর কাউনিয়া থানার তেপামধুপুর, মিঠাপুকুর থানার রাজপুকুর, জলঢাকা থানার খৈলমারি ইত্যাদি।
এসব এলাকায় বেইস তৈরী করার পর আমি প্রতি এলাকার জন্য ১০ থেকে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার পার্টি নিয়োগ করি শত্রুদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালানর জন্য। তিনদিন অন্তর তাদের প্রত্যেক পার্টিকে ভাগাভাগি করে অপারেশনের দায়িত্ব দিতাম। সেপ্তেম্বর মাসের শেষের দিকে প্রায় সব কটি বেইস এলাকায় তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়। অক্টবর মাসের শেষ দিকে প্রায় প্রতি বেইসে ১৫০ জন প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়োগ করতে সক্ষম হই। ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৭০ মাইল ভিতরেও বেইস তৈরি করতে সক্ষম হই। এক বেইস এলাকার সাথে অন্য বেইস এলাকার যোগাযোগ রাখা হত। এইভাবে তারা একে অন্যের সাহায্য করে এবং আমার সাথে চেইন হিসাবে যোগাযগ রাখে। প্রতি বেইস এলাকা থেকেই তারা সিচুয়েশন রিপোর্ট পাঠাত। আমি কোম্পানি কমান্দারদের কাছে নির্দেশ পাঠাতাম এবং সপ্তাহ অন্তর কোম্পানী কমান্ডাররা তাদের রিপোর্ট পাঠাত। দূরবর্তী কোম্পানী কমান্ডারদের এক সপ্তাহের কাজ দিতাম। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল শত্রুদের সামনে থেকে আক্রমন না করে এমবুশ ও রেইড করে ব্যতিব্যস্ত রাখার জন্য এবং যোগাযোগ ও যাতায়াত বন্ধ করে দেয়ার জন্য সড়ক ও রেলসেতু ধ্বংস ও উড়িয়ে দেয়ার জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আরো নির্দেশ ছিল গ্রামবাসী ও এলাকাবাসির সাথে মিশে তাদের সাহায্য নিয়ে অপারেশন করার জন্য। কিন্তু আবার এই সময় রাজাকার আল বদর আল শামস মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর দালালরা ও বিহারীরা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যকলাপে বাধা সৃষ্টি করত। কিন্তু আবার অনেক রাজাকার এমনকি শান্তি কমিটির অনেক সদস্য গোপনে শত্রুদের অনেক খবর আমাদের দিত। লালমনিরহাট থানার বাবোবাড়ি ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সদস্য আবুল কাসেমের বাড়িতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত দেখতে পাওয়ায় পাকসেনারা নির্মমভাবে আবুল কাসেমকে হত্যা করে। আবুল কাসেমের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান কম নয়।
নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকসেনারা কোনঠাসা হয়ে পরে। প্রতি রাতেই তাদের উপর হামলা চালানো হত। রংপুরের সিনেমা হলে গ্রেনেড বিস্ফোরন ঘটানো হয়। ১০ জনের মুক্তিবাহিনীর একটি পার্টিকে এ কাজের জন্য পাঠান হয়েছিল। লালমনিরহাট, কালীগঞ্জ,ভোতমারী, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম,তিস্তাঘাট, কাউনিয়া, পীরগাছা,গঙ্গাচরা, মিঠাপুকুর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পাক অবস্থানে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এমনকি রংপুর শহরেও আমাদের কার্যকলাপ শুরু হয়ে যায়। এর মধ্যে আমাদের কার্যকলাপ গ্রাম ছাড়িয়ে শহর ও সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শুরু হয়। পাকসেনারা এরপর আরো কোনঠাসা হয়ে পরে। তারা প্রায় ই সবসময় বাঙ্কার ও ছাউনি ছেড়ে বাইরে যেত না। কোন অপারেশনে গেলে তারা রাজাকারদের সামনে এগিয়ে দিত এবং নিজেরা ডিফেন্স পজিশনে থাকত।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমরা অনেক এলাকা পাকসেনাদের হাত থেকে মুক্ত করে ফেলি। পীরগাছা, মিঠাপুকুর, গঙ্গাচরা ও কাউনিয়া থানা এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। ২ রা ডিসেম্বরে সেক্টর কমান্দার বাসার আমাকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ১ টা ব্যাটেলিয়ন তৈরী করে লালমনিরহাট ও তিস্তাঘাট হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ সহ আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে লালমিরহাটের দিকে অগ্রসর হই। পাটগ্রাম সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিয়ুর রহমান বারখাতা, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ হয়ে লালমনিরহাটের দিকে এগিয়ে আসেন। অন্যদিকে সাহেবগঞ্জ সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ ভুরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, পটেশ্বরী, কুড়িগ্রাম হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হন। নীলফামারী মুক্ত করে আমরা তিস্তা ঘাটে একত্রিত হয়ে রংপুর শহরের দিকে অগ্রসর হই। ১৫ ই ডিসেম্বর অনেক বাধাবিপত্তির পর রংপুর শহরে পৌছতে সক্ষম হই। আমরা তাদের উপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে শহর থেকে সরে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় যেতে বাধ্য করি। ১৬ ই ডিসেম্বর পাকসেনারা মিত্রবাহিনী ও আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা আমার কাছে প্রশিক্ষন নিয়ে অভ্যন্তরে চলে যায়। এসব মুক্তিযোদ্ধারা অসমসাহসী ছিল। তারা পাকসেনাদের বারবার আচমকা আক্রমণ চালিয়ে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল। আগস্টের শেষে প্রাক্তন এম সি এ কে বি এম আবু হেনা এদেরকে নিয়ে সিরাজগঞ্জে চলে যান। জনাব হেনা স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেকে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তার মত সাহসী এম সি এ ও মুক্তিযোদ্ধা আমি খুব কম ই দেখেছি। দেশ কে মুক্ত করার জন্য তিনি নিজের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। সিরাজগঞ্জের ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে আবু হেনাকে কোম্পানী কমান্ডার মিঃ সাইদুর রহমান কে সেকেন্ড ইন কমান্ড মিঃ আমির হোসেন, বেলায়েত হোসেন ও বজলুর রহমান কে প্লাটুন কমান্ডার করে আবু হেনার নেতৃত্বাধীনে সিরাজগঞ্জ এলাকায় পাঠিয়ে দেই।
মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ ও সুশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তাদের মধ্য থেকে কোম্পানী কমান্ডার, প্লাটুন কমান্ডার ও সেকশন কমান্ডার নিয়োগ করি। মুক্তিবাহিনীকে কোম্পানী, প্লাটুন ও সেকশনে ভাগ করি শ্ত্রুদের উপর সুষ্ঠুভাবে আক্রমন পরিচালনার জন্য। আমরা কয়েকজন সাহসী শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান মুক্তিযোদ্ধার নাম নিম্নে প্রদান করছিঃ
(১) বদরুজ্জামান কোম্পানী কমান্ডার (২) সিরাজুল ইসলাম,কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (৩) মজাহার আলী,প্লাটুন কমান্ডার সেকেন্ড ইন কমান্ড (৪) একরামুল হক প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৫) নুরুল আলম খোকন,,প্লাটুন কমান্ডার (৬) শহীদুর রহমান,প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৭) ওয়াদুর রহমান,প্লাটুন কমান্ডার (৮) আব্দুল করিম,প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৯) মোঃ তাজিব উদ্দীন,কোম্পানি কমান্দার (১০) গোলজার হোসেন,কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (১১) ইমান আলী,প্লাটুন কমান্ডার (১২) রবিউল আলম,প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (১৩) শফিকুল ইসলাম,প্লাটুন কমান্ডার (১৪) আব্দুস সালাম,প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (১৫) মোজাফফর হোসেন,প্লাটুন কমান্ডার (১৬) খোরশেদ আলম,প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (১৭) মাহতাব আলী সরকার,কোম্পানী কমান্ডার (১৮) নুরুল আজিজ, কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (১৯) শামসুল আলম, প্লাটুন কমান্ডার (২০) আদুর রশীদ, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (২১) আশরাফ আলী,প্লাটুন কমান্ডার (২২) জমির আলী আহমেদ,সেকেন্ড ইন কমান্ড (২৩) ওয়ারেশ আলী, প্লাটুন কমান্ডার (২৪) আতিয়ার রহমান, সেকেন্ড ইন কমান্ড (২৫) আব্দুর রউফ, কোম্পানী কমান্ডার (২৬) মোঃ ইলিয়াস, কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (২৭) জয়দেব রায়, প্লাটুন কমান্দার (২৮) দীনেশ রায়, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (২৯) নুরুদ্দীন, প্লাটুন কমান্ডার (৩০) যোগেশ সরকার, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৩১) মজিবর রহমান, প্লাটুন কমান্ডার (৩২) মোঃআজাদ, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৩৩) সিরাজুল হক, কোম্পানী কমান্ডার (৩৪) লুতফর রহমান, কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (৩৫) কলিমউদ্দিন, প্লাটুন কমান্ডার (৩৬) ওসমান গনি, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৩৭) মোস্তাফিজুর রহমান, প্লাটুন কমান্ডার (৩৮) খাইরুজ্জামান, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৩৯) ফরিদ হোসেন, প্লাটুন কমান্ডার (৪০) জুলহাস হোসেন, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৪১) মোখলেসুর রহমান, কোম্পানী কমান্ডার (৪২) কফিলউদ্দিন, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৪৩) আবুল হোসেন, প্লাটুন কমান্ডার (৪৪) মোহাম্মদ আলী, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৪৫) আব্দুস সামাদ, প্লাটুন কমান্ডার (৪৬) আব্দুস সামাদ, (২) প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৪৭) এ কে এম আব্দুর রশীদ, প্লাটুন কমান্ডার (৪৮) বেলাল হোসেন, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৪৯) মফিজুল হক, কোম্পানী কমান্ডার (৫০) সাবের আল, কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (৫১) আইয়ূব আলী, প্লাটুন কমান্ডার (৫২) মোঃ আবু সিদ্দিক, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৫৩) মজিবর রহমান, প্লাটুন কমান্ডার (৫৪) আজিজুল হক, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৫৫) জহুরুল হক, প্রধান প্লাটুন কমান্ডার (৫৬) আব্দুর রাজ্জাক, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৫৭) আজহারুল ইসলাম, কোম্পানী কমান্ডার (৫৮) বেলায়েত হোসেন, কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (৫৯) মোঃ শাজাহান, প্লাটুন কমান্ডার (৬০) আনিসুর রহমান, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৬১) মুসলিম উদ্দিন, প্লাটুন কমান্ডার (৬২) ওয়াজেদ আলী, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৬৩) সিরাজুল ইসলাম, প্লাটুন কমান্ডার (৬৪) দেলোয়ার হোসেন, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৬৫) খাইরুজ্জামান, কোম্পানী কমান্ডার (৬৬) মোঃ শামসুল আলম, কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (৬৭) এম আর প্রধান, প্লাটুন কমান্ডার (৬৮) রফিউল আলম, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৬৯) আকবর আলি, প্লাটুন কমান্ডার (৭০) খুরশিদ আলম, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৭১) মেসবাহউদ্দিন, প্লাটুন কমান্ডার (৭২) আতিয়ার রহমান, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড (৭৩) শমসের আলী, প্লাটুন কমান্ডার (৭৪) শামসুল হক, প্লাটুন সেকেন্ড ইন কমান্ড।
এ ছাড়া আমি কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করি। নীচে সেসব অপারেশনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হল –
প্রথম অপারেশনঃ লালমনিরহাট এবং মোগলহাটের মধ্যবর্তী রেললাইন ও ইঞ্জিনসহ উড়িয়ে দেয়া হয়। প্রকাশ যে, মোগলহাটে পাকবাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটিতে প্রত্যেক দিন সকাল সন্ধ্যা পাকসেনারা একদলকে রেখে ডিউটিরত দলকে অন্যত্র নিয়ে যেত। ১৫ ই সেপ্টেম্বর ভোর রাতে দুরাকুটি নামক জায়গাতে মাইন ও বিস্ফোরক পদার্থ সহযোগে পাক সেনাবাহিনীর রেলগাড়ি উড়িয়ে দেয়া হয়। এই অপারেশনে অন্ততপক্ষে ২৭ জন পাকসেনার মৃত্যু ঘটে এবং ১০/ ১২ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। এই অপারেশনের খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও প্রচার করা হয়। এই অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহন করে। এই অপারেশনে আমি নিজে আহত হই এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধা একজন শহিদ হন এবং ৪ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়।
দ্বিতীয় অপারেশনঃ রংপুরের ভূরুঙ্গামারি জয়মনিরহাট রায়গঞ্জ অপারেশন। যুদ্ধকালীন সময়ে যাতে করে পাকবাহিনী কুড়িগ্রাম থেকে ধবলানদী অতিক্রম করে রসদ গোলাবারুদ ও সৈন্য পাটেশ্বরী নাগেশ্বরী এবং ভুরুঙ্গামারীর দিকে সরবরাহ না করতে পারে সেজন্য এই অপারেশন চালানো হয়। এই অপারেশনে ভূরুঙ্গামারীতে মেজর নওয়াজেশ তার দল নিয়ে আক্রমণ করেন আর আমার দলের দুটো গ্রুপের একটা ছিল পাটেশ্বরী এবং অপরটি ছিল নাগেশ্বরীতে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঈদের রাতে এই অপারেশন চলে। এই অপারেশনে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ১০ / ১২ জন সদস্য শহিদ হন অপরদিকে পাকসেনাদের কমপক্ষে সোয়াশ নেতা নিহত হয়। এই অপারেশনেও আমরা সাফল্য অরজন করি। এই অপারেশনে ১ জন অফিসারসহ ১০ থেকে ১৫ জন পাকসেনা ধরা পরে এবং ২ জন অফিসার নিহত হয়।
৩য় অপারেশনঃ লালমনিরহাট এবং তিস্তাঘাটের মধ্যবর্তী বড়বাড়ি ইউনিয়নে বাকবাহিনীর আরেকটি ঘাঁটি ছিল। নভেম্বরের ১০ তারিখের সন্ধ্যায় এই ঘাঁটি আক্রমন করা হয়। আমার বাহিনীর মাত্র ৬০ জন সদস্য নিয়ে আমি নিজে এই ঘাঁটি আক্রমণ করি। আমাদের তীব্র আক্রমনের ফলে ৫ জন পাকসেনা নিহত এবং বাকীরা পালিয়ে যায়। আমরা ওদের রান্নার কজে সহযোগিতাসহ আমাদের খবর সরবরাহকারী তাদের পাচক এবং সেই ক্যাম্পে যে মহিলাকে নিয়ে পাকসেনারা রাত কাটাত তাকেও ধরে নিয়ে আসি। এই অপারেশনে আমাদের ৪/ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মকভাবে আহত হয়। পূর্বোল্লিখিত আমার বাহিনীর ২ এম দল তিস্তাঘাট এবং তার আশে পাশে ডিসেম্বরের প্রথম দিকেই পাক সেনাদের অবস্থানগুলোয় আক্রমণ চালায় এবং তাদের সফল আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী টিকতে না পেরে তারা রংপুর হেডকোয়ার্টারে কেন্দ্রীভূত হয়। এছাড়া ২ এম দলও পীরগাছা থানা এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থানগুলোর উপর চোরাগোপ্তা আক্রমন চালায়। তাদের সে আক্রমণের মুখে পাকবাহিনী কুলাতে না পেরে পীরগাছা ছেড়ে রংপুরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এইসব আক্রমণে প্রচুর পরিমান অস্ত্রশস্ত্র পাকবাহিনী এবং রাজাকারদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে আমরা সক্ষম হই। এসব আক্রমণে বিপুল সংখ্যক রাজাকারও নিহত হয়। প্রসংক্রমে আরো উল্লেখ্য যে, এরা ছিল পাকবাহিনি অধিকৃত বাংলাদেশের অভ্যন্তরস্থ এলাকার আক্রমনকারী।
সীমান্ত এলাকা থেকে দীর্ঘ ৬৫ মাইল ভিতরে আমার বাহিনীর ১ পি দল মিঠাপুকুর থানার রানীপুকুরে শত্রুবাহিনির উপর সফল আক্রমন পরিচালনা করে। তারাও ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই শত্রুবাহিনীকে সন্ত্রস্ত করে তলে এবং তাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র উদ্ধার করে। তাদের হাতেও অনেক রাজাকার নিহত হয় ও আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে ১০ ই ডিসেম্বরের মধ্যে এই সমস্ত এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। এরপরে ক্যাপ্টেন মতিয়ুর রহমান পাটগ্রাম থেকে রংপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন এবং নওয়াজেশ ভূরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হন এবং আমি আমার বাহিনী নিয়ে লালমনিরহাট হয়ে রংপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। ডিসেম্বরের ১১/১২ তারিখের দিকে আমরা তিনজন নিজ নিজ দলসহ লালমনিরহাট মিলিত হয়ে সম্মিলিতভাবে রংপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকি এবং ১৪ ই ডিসেম্বর রংপুর শহরে পৌঁছে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমনের প্রস্তুতি নিতে থাকি। বিকেলে মিত্রবাহিনীও রংপুর পৌঁছে এবং তারা আমাদের কে ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। তারা ইতিমধ্যে মেসেজ পেয়েছিলেন যে রংপুরস্থ পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে এবং সেজন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ সংবাদ পেয়ে আমরা তাদেরকে আক্রমন থেকে বিরত হই। আমাদের রংপুর পৌছার খবর পেয়ে সেখানকার জনগন ও আশেপাশের গ্রাম গ্রামান্তর থেকে আগত সাধারণ মানুষ আমাদেরকে এবং মিত্রবআহিনীকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেন। তাদের বিজোয়োল্লাস এবং আমাদের প্রতি তাদের অকৃত্রিম ও প্রাণবন্ত সংবর্ধনায় আমরা মুগ্ধ হয়ে পরি।
স্বাক্ষরঃ এম দেলয়ার হসেন
১৬-১০-৭৪
*১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন।