সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল মতিউর রহমান
আমরা দিল্লী থেকে কলকাতাতে ফ্লাই করি মে মাসে। তারপর আমরা বাংলাদেশের ফোর্সেস হেডকোয়ার্টারে আসি। সেখানে নূরকে নিযুক্ত করা হল এডিসি টু সি-ইন-সি। আমি এবং ডালিম- দুজনকেই সি ইন সির গেরিলা এডভাইজার হিসাবে এপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়। আমি ছিলাম ৬ নং সেক্টরের জন্য ডালিম ছিল যশোর এরিয়ার অর্থাৎ ৮ নং সেক্টরের জন্য। আমরা জেনারেল ওসমানির সাথে দিল্লী থেকে কলকাতা এলাম। যদিও আমি আমার ইউনিটে অর্থাৎ ৩ য় ইস্ট বেঙ্গলে যোগদান করতে চেয়েছিলাম কিন্তু জেনারেল ওসমানি তাতে মত দিলেন না। তিনি আমাকে নিয়ে এলেন ৬ নং সেক্টর এলাকায়। তখনো ৬ নং সেক্টর হয়নি। ওখানে তখন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ ছিলেন। তাঁর কাছে আমাকে রেখে দেন। আমাকে ইন্সট্রাকশন দেয়া হয় আমি যেন বাংলাদেশের ভেতরে না ঢুকি। কেন আমাকে এই ইন্সট্রাকশন দেয়া হল আমি বুঝতে পারিনি। ইন্ডিয়ানদেরকেও বলে দেয়া হয় আমাকে যেন বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকার অনুমতি না দেয়া হয়। আমি কর্নেল নওয়াজেশের সাথে থাকতে থাকতে বোর ফিল করি। কোন কাজ নেই একমাত্র এসেসমেন্ট ছাড়া। আমি আস্তে আস্তে বি ডি আর ট্রুপ্স নিয়ে ছোটখাট রেইড ও এমবুশ করতে থাকি। কর্নেল নওয়াজেশ ভুরুঙ্গামারি এলাকায় থাকতেন।
<১০, ১২.৬, ৩২১-৩২৬>
একবার মনে আছে ইন্ডিয়ানরা খবর দেয় যে, ভুরুঙ্গামারিতে ৩০/৩৫ জন পাকসেনা আছে। ৩৫ জন লোক খুব কমই। তখন আমি একটা প্লাটুন এবং কর্নেল নওয়াজেশ একটা প্লাটুন নিয়ে ভুরুঙ্গামারী রেইড করতে যাই। ম্যাপ অনযায়ী আমাকে শুধু একটা নদী পার হতে হবে। আমার কাছে পাকিস্তানী সৈন্যের বুলেটকে যত না ভয় ছিল তার থেকে পানি পার হওয়া বেশি ভয়ের ব্যপার ছিল। যাই হোক তারা আমাকে দুটো কলাগাছ একসাথে করে ভেলা বানিয়ে তার উপর শুইয়ে শুইয়ে টেনে টেনে পার করা হয়। এই নদীই রাতে আমাকে চার পাঁচবার পার হতে হয়েছে। আমাকে ফাঁকি দেয়ার জন্য তারা একবার এপারে আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওপাড়ে এভাবে চারবার পার করিয়েছে। সে সময়ের মধ্যে আমাদের ভুরুঙ্গামারী যাবার কথা সেই সময় পার হয়ে যায়। ম্যাপ অনুযায়ী আমি বুঝতে পারছিলাম না কোথায় যাচ্ছি, কেননা পানিতে আমি পুরোপুরি অন্য লোকের উপর নির্ভর করতাম। যখন ভোর হয়ে আসে তখন আমি ওদের চালাকি বুঝতে পারি। আমরা ফেরত আসি। তখন ইন্ডিয়ান যে ব্রিগেডিয়ার ছিলেন তিনি খুব তাচ্ছিল্যের সাথে আমাকে বলেছিলেন যে আমার জন্যই রেইডটা সফল হয়নি আমার সাহস নেই এইসব। এতে আমার খুব রাগ ধরে। ব্রিগেডিয়ার সাহেবকে দেখাবার জন্যে সম্ভবতঃ জুলাই মাস হবে পরের রাতে আমিও আমার ব্যাটম্যান এবং আরেকটা লোক আমরা তিনজনে ভুরুঙ্গামারি যাই। সেখানে আসলে একটা কম্পানী ছিল। এই কোম্পানীর ৪ মাইল দূরে আরেকটা প্লাটুন ছিল। কোম্পানী কমান্ডার সন্ধ্যার সময় প্রায়ই বলতে গেলে রোজই ঐ প্লাটুন থেকে মূল কোম্পানিতে চলে যেত। আমরা প্ল্যান করি পথের মধ্যে ঐ কোম্পানী কমান্ডারকে এম্বুশ করব। আমরা দুপুরে খাওয়ার পরে রওনা হলাম। আমরা বর্ডার ক্রস করে ভিতরে ঢুকি। জায়গায় পৌঁছে রাস্তা থেকে ৩০০/৪০০ গজ দূরে থাকতে কোম্পানী কমান্ডারের জীপ আমাদেরকে ক্রস করে চলে যায়। ফলে তাকে এমবুশ করা সেদিনের মত হয়নি। কিন্তু তাকে ধরবার জন্য খোলা মাঠের উপর দিয়ে আমরা পিছনে পিছনে দৌড়ে যাই হঠাত দেখি সামনে সাদা বিল্ডিং। আমি শুনেছিলাম যে, ভুরুঙ্গামারি কলেজে পাকিস্তান আর্মি থাকে। ভুরুঙ্গামারির একমাত্র সাদা বিল্ডিং হচ্ছে ঐ ভুরুঙ্গামারি কলেজ। আমরা দৌড়াতে দৌড়তে সাদা বিল্ডিং এর প্রায় ৩০ গজ দূরে চলে গিয়েছিলাম। যখন বাঁশঝাড় থেকে বের হই তখনই দেখি সদা বিল্ডিং এর সঙ্গে সঙ্গে আমরা থেমে যাই। আবার বাঁশ ঝারের ভিতর চলে যাই। কেননা, এখানেই পাকিস্তান আর্মি থাকে। আমরা তখন ওদের কথাবার্তা শুনছি। বাঁশঝাড় থেকে কলেজ খুব বেশি হলে ৫০ গজ। সামনে ছোট ছোট পাটগাছ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চাঁদ ছিল তাই পরিস্কার সব কিছু দেখা যায়। কলেজের পাশ দিয়ে পাকিস্তানী সেন্ট্রিগুলো হাঁটছে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ইন্ডিয়ান ব্রিগেডিয়ার যে কমেন্ট করেছিল সেটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমার মাথায় চিন্তা ছিল কিছু একটা করতে হবে। সেজন্য আমি অপেক্ষা করতে থাকি। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যেন বৃষ্টি আসে। অন্ততঃ মেঘ আসুক যাতে চাঁদ না থাকে অন্ধকার হয়ে যায়। এ রকম অপেক্ষা করতে করতে রাত যখন দেড়টা দুইটা তখন ঠিকই মেঘ আসল এবং ঝির ঝির করে বৃষ্টি পরতে শুরু করল। রাত সাড়ে ১০ টার দিকে পাকিস্তানী আর্মি দিনের ডিউটি শেষ করে ঘুমাতে যায় সেন্ট্রি বাদে। সেন্ট্রীদের দেখতে পাচ্ছিলাম। হাঁটাচলা করছে। আমি এবং আমার ব্যাটম্যানের হাতে দুটা করে গ্রেনেড। আমাদের সাথে যে আরেকটি লোক ছিল ও হাতে এল এম জি ছিল। তাকে আমরা পাশে রেখেছিলাম। তাকে অর্ডার দিয়েছিলাম যে গ্রেনেডের চারটা এক্সপ্লোশন হওয়ার পরে সে ফায়ার করতে থাকবে যেন আমরা উইথড্র করতে পারি। বৃষ্টির ভিতর আমরা পাটক্ষেতের মধ্য দিয়ে ক্রস করতে করতে বিল্ডিং এর কাছে পৌছাই এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি বিল্ডিং এর বারান্দায় চৌকির উপর পাকিস্তানী আর্মিরা শুয়ে আছে। পাকিস্তানী সেন্ট্রিটা যখন হেঁটে আমাদের ক্রস করে চলে যায় তখন আমরা দুজন দৌড়ে আমাদের গ্রেনেড ফেলে দিয়ে ফেরত আসি। তখনো আমরা জানতাম না পাকিস্তানীদের কি ক্ষয়ক্ষতি হল।আমরা দৌড়ে ফেরত আসছি ততক্ষনে পাকিস্তানিরা গুলি করতে শুরু করেছে। হঠাত আমি আছাড় খেয়ে পরে যাই। মনে হল আমার পায়ে কিছু একটা লেগেছে। পরে দেখি আমার দান পাটা অবশ হয়ে গেছে আমি আর উঠতে পারছি না। আমার ব্যাটম্যান এবং আমার সাথের লোকটি দুজনে ধরে আমাকে উঠায়। তখন দেখি আমার পায়ে একটা গুলি লেগেছে। গুলিটা বেশি ভেদ করে যেতে পারেনি কেননা আমরা বেশ দূরে ছিলাম ওরা তাড়াতাড়ি ঘাড়ে করে আমাকে নিয়ে আসে। এবং আমরা আবার ইন্ডিয়াতে ফেরত আসি। সেখানে আমাদের ডাক্তার ছিল, সে গুলি বের করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। আমি সাতদিন পরেই ঠিক হয়ে যাই। পরে আমরা জানতে পারি যে, সেদিনের গ্রেনেড বিস্ফোরনের ফলে ৭ জন পাক আর্মি নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছে।
কয়েকদিন পর ভুরুঙ্গামারীতে দুই কোম্পানী নিয়ে আক্রমন করার প্ল্যান করা হয়। খুব সম্ভব জুলাই/আগস্টের দিকে। সেখানে পাকিস্তানীদের এক কোম্পানী ছিল। ঐ জায়গাটা দখল করার জন্য আক্রমনের প্ল্যান করা হয়। ইন্ডিয়ানরা আমাদের আর্টিলারি সাপোর্ট দিবে। আমরা দুই কোম্পানী সারারাত হাঁটার পরে ভোরবেলা ঐ কলেজের কাছে পৌছাই। ভোর হচ্ছে হচ্ছে এমন সময় জয় বাংলা বলে আক্রমন করি। মোট দুটি কম্পানী ছিল। দুটির ই ফিল্ড কমান্ডার আমি ছিলাম। কর্নেল নওয়াজেশ অবশ্য কোম্পানী কমান্দারের কাজ করেন নি তিনি ব্যাটেলিয়ন কমান্ডারের কাজ করেছেন। তিনি যুদ্ধকে ডাইরেক্ট করেছিলেন পেছন থেকে। এছাড়াও আরও ৮০ জন গিয়েছিল সেটা লেঃ ফারুকের অধীনে ছিল। তাদের কাজ ছিল নাগেশ্বরী থেকে যে রোড এসেছে ভুরুঙ্গামারীতে সেই রোডের উপর এমবুশ করা যাতে পাকিস্তানীরা রিইনফোর্সমেন্ট না আনতে পারে। এজন্য সে প্রায় সাড়ে ৩ মাইল দূরে জয়মনিরহাট রেলওয়ে স্টেশনের কাছে এমবুশ পাতে ও আমরা ৫০ গজ দূর থেকে জয়বাংলা বলে আক্রমন শুরু করি। পাকিস্তানিরা প্রথমেই গুলি করে। তাদের সম্মুখে যে বাঙ্কারগুলি ছিল সেগুলো থেকে উইথড্র করে তারা পিছনে সরে যায়। আমাদের লোকেরা সবাই পাকিস্তানিদের গুলি আসার সাথে সাথে মাটিতে শুয়ে পরে। আমি অনেক চেষ্টা করেও তাদের মাটি থেকে উঠাতে পারিনি। তবে আমি কিছু লোক নিয়ে কলেজ বিল্ডিং এর দিকে এগিয়ে যাই। ইতিমধ্যে ইন্ডিয়ানরা যে আমাদের আর্টিলারি সাপোর্ট দিচ্ছিল সেটা ভুল হউয়াতে আমাদের গোলাই আমাদের উপরে এসে পরতে শুরু করে যার ফলে আমাদের ৪/৫ জন মারা যায়। আমরা দেখছিলাম যে, পাকিস্তানীরা পালিয়ে যাচ্ছিলো। আমরা তাদের উপর গুলি করছিলাম। এবং কলেজ বিল্ডিং এ তাদের যা কিছু ছিল তাতে আমরা আগেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম। এভাবে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে যায়। ইতিমধ্যে পেছন দিক থেকে লেঃ ফারুক যে রোডের উপর এমবুশ করছিল শত্রুরা সেই এমবুশের উপর দিয়ে তাদেরকে ক্রস করে আমাদের পিছন দিকে চলে আসে। সুতরাং আমাদের সামনেও পাকিস্তানীরা ছিল পিছন দিকেও পাকিস্তানীরা ছিল। যদিও কর্নেল নওয়াজেশ আমাকে আক্রমন চালিয়ে যাবার জন্য উৎসাহ দিচ্ছিলেন কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে আক্রমন চালিয়ে যাওয়া মানে আমার দলের অনেক লোক হতাহত হওয়া। কারন আমাদের দলের লোকদের ভাল ট্রেনিং নেই। পাকিস্তানীরা মর্টার ছোড়া শুরু করেছিল। ওখানে থাকা মানে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হওয়া। এইজন্য আমি ওখান থেকে আমার লোকজন নিয়ে উইথড্র করে আবার ইন্ডিয়াতে ফেরত চলে আসি। এই ব্যপারটা নিয়ে কর্নেল নওয়াজেশের সাথে আমার বেশ গন্ডগোল হয়, যার ফলে তখন আমাদের সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছিলেন এম কে বাশার। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে আমাকে একটা আলাদা সাব সেক্টর দেওয়া হবে। সেটা হচ্ছে পাটগ্রাম। পাকিস্তান আর্মি তখনো পাটগ্রামে আসেনি।
পাটগ্রাম এমন এক জায়গা যেটা লম্বায় প্রায় ২২ মাইল, চওড়ায় দুপাশে ইন্ডিয়া অনেকটা লাউ এর মত।লাউ এর গলাটা আড়াই মাইল। আড়াই মাইল জমি বাংলাদেশের, মধ্যিখানে ইন্ডিয়া। মধ্যখান দিয়ে একটা রেলওয়ে লাইন চলে গেছে। এজন্যই হয়ত সেই এলাকায় পাকিস্তান আর্মি আসেনি বা আসতে সাহস করেনি। আমাকে বিডি আর মুক্তিফৌজের একটি কোম্পানী দিয়ে বলা হল যে, পাটগ্রাম এলাকাকে যে কোন ভাবে মুক্ত রাখতে হবে। আমি ঐ এক কোম্পানী নিয়ে সোজা চলে যাই পাটগ্রাম এলাকাতে। এবং লাউ এর গলার মাঝখানটা অর্থাৎ যেখান টায় সবচেয়ে কম জায়গা সেখানে একটা ডিফেন্স নেই এবং এক কোম্পানি দিয়ে পাটগ্রামের ডিফেন্সের আয়োজন করি। এটা খুব সম্ভব আগস্টের শেষের দিকে হবে। অরে অবশ্য আমাকে পাটগ্রাম ডিফেন্সের জন্য ৫ টা কোম্পানী দেয়া হয় ৫ টা মুক্তিফৌজ কোম্পানী। বাওরা বলে একটা জায়গা আছে সেখানে আমরা ডিফেন্স নেই। ইতিমধ্যে, খুব মজার ব্যপার পাকিস্তানিরা হাতিবান্ধায় চলে এসেছে। হাতিবান্ধা ও বাওড়ার মধ্যে পার্থক্য তিন থেকে সাড়ে তিন মাইল। পাকিস্তানীরা হাতিবান্ধায় এসে ডিফেন্স নিয়েছে আর আমি বাওড়ায় একটা ডিফেন্স খুলেছি। তখন বর্ষাকাল ছিল বলে রেললাইনের উপর ছাড়া কোন যানবাহন চলতে পারত না। আমি চিন্তা করলাম রেলকাইনটা যদি কাট করা যায় তাহলে পাকিস্তানীরা আর আসতে পারবে না। আমার সাথে ৯০ জন লোক হাতে কোন মেশিনগান ছিল না। কিন্তু আমি তখনকার ইপিআরদের দেখে বুঝতে পারছিলাম যে, তাদের পক্ষে পাকিস্তানীদের আক্রমনের মুখে সবসময় এক জায়গা দরে রাখা সম্ভব নয়। সেজন্য আমি রেলওয়ে লাইনের আশেপাশে যে সকল গ্রাম ছিল প্রত্যেক গ্রামে ডিফেন্স করে রেখেছিলাম। আমি ভাবছিলাম যদি পাকিস্তানিরা একটা গ্রামে আক্রমন চালায় তাহলে তারা যেন সেই জায়গা ছেড়ে পরবর্তী গ্রামে গিয়ে বসতে পারে।পাকিস্তানীরা সাধারনতঃ এক এক রাতে এক এক গ্রামে আক্রমন চালাত। আমাদের লোকেরা পরবর্তী গ্রামে গিয়ে ডিফেন্স নিত। ডিফেন্স খোলা ছিল। পাকিস্তানীরা আমাদের জায়গায় এসে কিছুক্ষন থাকার পরেই ভোর হবার আগেই তাদের মেইন ডিফেন্স হাতিবান্ধায় চলে যেত। আমরা আবার সকালবেলায় আমাদের পুরোনো জায়গায় গিয়ে বসতাম। এ রকম খেলা চলতে লাগল প্রায় এক মাসের মত। পাকিস্তানীদের এক কোম্পানী ছিল হাতিবান্ধায়। এভাবে আগস্ট মাস পার হয়ে যায়। এর মধ্যে আমি আরেকটা কোম্পানী পাই। তখন রেললানের উপাশে দুটা কোম্পানী লাগিয়ে একটা পার্মানেন্ট ডিফেন্স নিযুক্ত করি। পাকিস্তানীদের ও তখন শক্তি বেড়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমার ৫ টা কম্পানী গড়ে ওঠে। আমাদের উপর বারবার আক্রমন হবার ফলে আমাদের বেশ ক্যাজুয়ালটি হত। ফলে আমাদের সেক্টর কমান্ডার মনে করলেন যে জায়গাটা ধরে রাখতে হবে জায়গাটা গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য তিনি আমাকে আরো ৫ তা কোম্পানী পরে দেন। আমার পিছনে বি এস এফ এর একটা ব্যাটেলিয়ন ছিল, তারপরে ইন্ডিয়ান আর্মির একটা ব্যাটেলিয়ন ছিল। আমাদের সাপোর্টে তিনটা ট্যাঙ্ক ছিল এবং ইন্ডিয়ান আর্টিলারির ব্যাটারি ছিল। আমাদের ডিফেন্স খুব শক্তিসম্পন্ন হয়ে গেছে। পাকিস্তানীদেরও আর্টিলারি ব্যাটারি ছিল। মোট কথা, ডিফেন্সিভ যুদ্ধ দুই পাশ থেকেই চলতে থাকে। কিন্তু আমাদের ইচ্ছা ছিল আমরা ক্রমাগত আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে যাবো। কেননা আমাদের সামনের গ্রামে যদি আর্মিরা না থাকত তখন আমরা ঐ গ্রামে গিয়ে বসে থাকতাম। এভাবে এগোতে এগোতে আমরা সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানীদের থেকে ৪০০ গজ দূরে এসে ডিফেন্স নিলাম। মধ্যখানে ধানক্ষেত। এপাশে আমরা অপাশে ওরা। সে সময় আমাদের মরাল খুব ই ডাউন ছিল। কেননা এ পর্যন্ত আমরা কোন কিছুতেই তেমন সফলকাম হতে পারিনি। পাকিস্তানী ডিফেন্সের বিপরীতেও আমরা আক্রমন চালাই কিন্তু তাদের ডিফেন্স এত শক্ত ছিল যে আমার লোকজনের তেমন ভাল ট্রেনিং না থাকায় অনেক সময় আমরা তাদের বাঙ্কারের উপর বসে থাকতাম। তারা বাঙ্কারের ভিতরে কিন্তু আমরা তাদের মারতে পারতাম না। ফলে আমরা হতাহত হয়ে পিছনে হটতাম। এবং তারা যে মাইন বসাতো তাতে আমাদের অনেক লোক হতাহত হত। সুতরাং আমি দেখলাম যে এভাবে আমাদের কোন সাকসেস হবেনা অন্যভাবে হয়ত হবে। আমার ডানপাশে ছিল তিস্তা নদী। তিস্তা নদীর ওপাশে পাকিস্তানীদের অবাধ গতি। রৌমারী থানার অন্তর্গত সুঠিবাড়ি এলাকা বলে একটা জায়গা ছিল। আমরা খবর পেতাম সেখানে পাকিস্তানীদের একটা প্লাটুন আছে এবং সাথে ইপিকাফের আরো একটি প্লাটুন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানী নিয়ে ঐ জায়গাটি রেইড করব। আমার বিশ্বাস ছিল সাফল্য আমাদের আসবে। এবং এ সাফল্যে আমার ট্রুপ্স এর মনোবোল বেড়ে যাবে।
আমি এক কোম্পানি নিয়ে বাওড়া থেকে দুটি নৌকাযোগে তিস্তা পার হই। সেই রাতে প্রচুর ঝড়বৃষ্টি হছিল। নদীর মাঝখানে পৌছে মনে হয়েছিল আমার নৌকা বুঝি ডুবে যাবে এবং আমরা সবাই ডুবে মারা যাব কারন নদীতে ছিল প্রচন্ড স্রোত। নদী পার হয়ে গাইডের সাহায্যে আমরা সুঠিবাড়ি – যেখানে একটা বিল্ডিং ছিল সম্ভবতঃ কৃষি দফতরের ভবন -প্রায় পৌছে যাই। বিল্ডিং এর সামনে প্রায় ৫০ গজ চওড়া একটা ছোট ক্যানেল ছিল। আমাদের আক্রমন করতে হলে ক্যানেলটি পার হতে হবে। তখন প্রায় ভোর হয় হয়। আমি আমার কোম্পানীকে দু ভাগে ভাগ করলাম। একটি দল ইতিমধ্যে ক্যানেল ক্রস করে রৌমারীর দিকে যে রাস্তা সেই রাস্তায় এমবুশ করে বসেছে। প্ল্যান ছিল আমি আক্রমন চালালে পাক ফৌজ পালিয়ে যেন রৌমারীর পথে যেতে না পারে। অপরদিকে রৌমারী থেকেও যেন পাকসেনারা সাহায্যে এখানে আসতে না পারে। আমি ক্যানেলটির পার থেকে পাকসেনাদের মুভমেন্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি নিজে ক্যানেল ক্রস করতে পারছিলাম না। দ্রুত সময় পার হচ্ছিল। ক্রমশ আমার মনে দ্বিধা জন্মাচ্ছিল আক্রমন করব কিনা। সিদ্ধান্ত নিলাম আক্রমন করবই। আমি আমার মর্টার দিয়ে প্রথম ফায়ার ওপেন করলাম। পাকসেনারা কিছুক্ষন বিচলিত হয়ে পরক্ষনেই পাল্টা আক্রমন চালায়। আমি এক সময় নদীতে ঝাঁপিয়ে পরি।আমার কোমরে দড়ি বাঁধা থাকত। আমার ঝাঁপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যাটম্যানও নদীতে ঝাঁপ দেয়। দড়ির বাকী অংশ তার হাতেই ছিল। ব্যাটম্যান টেনে আমাকে ক্যানেলের অপর পাড়ে নিয়ে যায়। আমার সঙ্গের সবাই ক্যানেল পার হয়ে বিল্ডিং এর উপর চড়াও হয়। পাকিস্তানিরা তখন পালাবার চেষ্টা করতে থাকে। এই আক্রমনে ১৫জন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। ১৫ জনের ৭ জন ছিল পাক সেনাবাহিনীর এবং ৮ ছিল ই পি কাফ। আহত হয় প্রচুর। ঐ সংঘর্ষ আগস্টের শেষের দিকে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘতে। ঠিক তারিখ আজ আর মনে নাই। ভারতীয়রা বলত প্রমান স্বরূপ যুদ্ধে নিহত পাকসেনাদের মাথা কেটে নিয়ে আসতে হবে। আমরা ১৫ টি মাথা কেটে এবং তাদের ইউনিফর্ম নিয়ে আমাদের গন্তব্যে রওয়ানা হই। এই সংঘর্ষে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং তিনজন গুরুতররূপে আহত হন। এই আক্রমনের জন্যেই পরবর্তীতে আমাকে বীরবিক্রম উপাধি দেয়া হয়। সংঘর্ষে আমাদের ছেলেদের মনোবল সাংঘাতিক ভাবে বেড়ে যায়। পাকসেনারা যখন অস্ত্র ফেলে পালাচ্ছিল তখন আমার ছেলেরা পিছু ধাওয়া করে তাদের হত্যা করছিল। আমার ছেলেদের সাহসিকতা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম আমি সেদিন। এই অপারেশনে আমার সাব সেক্টরে ভীষন মরাল ইফেক্ট হয়েছিল- যার ফলে আমার রেইডিং পার্টি পরবর্তীতে সৈয়দপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে রেইড করত। এবং প্রতিটি রেইড ই সাকসেসফুল হয়েছে।
বয়রাতে আমাদের ডিফেন্স ছিল। আমরা লম্বালম্বি নিয়েছিলাম আমাদের সামনে ৪০০/৫০০ গজ দূরে পাকসেনারা ডিফেন্সে ছিল। পাকিস্তানীরা প্রায়ি আমাদের উপর আক্রমন চালিয়ে আমাদের ডিফেন্স দখল করার চেষ্টা করত কিন্তু আমাদের ডিফেন্স এত মজবুত ছিল যে তারা বারবারই পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। আমরাও চেষ্টা করতাম তাকে পিছু হটাতে।
একটি অপারেশনের কথা আমার মনে আছে। পাকিস্তানীদের ডিফেন্সের সামনে মাইনফিল্ড ছিল। আমাদের এটাকিং ফোর্স লেঃ ফারুকের কমান্ডে মাইন ফিল্ড অতিক্রম করে পাকসেনাদের বাঙ্কারের উপর চলে গিয়েছিল কিন্তু আমাদের ছেলেরা যুদ্ধের সকল বিষয় অয়াকিবহাল না হওয়ায় যথাযথ আক্রমনে ব্যর্থ হয় এবং মাইনে আমাদের বেশ হতাহত হয়।
পাটগ্রাম থানা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশেই চলত আমাদের প্রশাসন ছিল এবং আমরা উরো থানা নিয়ন্ত্রন করতাম। পাটগ্রামের পেছনে বুড়িগ্রামে আমাদের সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল। হেডকোয়ার্টারে আমাদের সেক্টর কমান্ডার এম কে বাশার থাকতেন। তিনি দিনাজপুর থেকে রংপুর পর্যন্ত কমান্দ করতেন। তাঁর সম্পর্কে দু একটি কথা বলতে হয়। যদিও তিনি বিমান বাহিনীর অফিসার ছিলেন তথাপি তিনি অতি সাফল্যের সঙ্গে আমাদের প্রায় ৩০০ মাইল সেক্টর এরিয়া দেখতেন।তাকে কোন সময় রাতে বিছানায় শুতে দেখিনি। জীপে জীপেই একটু আধটু ঘুমাতেন। কারন সারারাতই তাঁকে এক সাব সেক্টর থেকে অন্য সাব সেক্টরে ঘুরতে হত। তার প্রেরনা ছিল অফুরন্ত- আমাদের পাথেয়।
আমাদের হাতীবান্ধা অপারেশন ছিল ভয়াবহ। হাতীবান্ধাতে পাকিস্তানিদের একটি কোম্পানী ছিল। আমি ইতিপূর্বে কয়েকবার চেষ্টা করেছি- হাতীবান্ধা দখল করতে ব্যর্থ হয়েছি। নভেম্বর ২০/২১ হবে। ঈদের দিন ছিল। আমরা ঈদের সুযোগ নিয়ে ঠিক সকাল ৮ টায় হাতীবান্ধা আক্রমন করি যদিও দিনের আলোতে ঐ সময় আক্রমনের উপযোগী ছিলনা। আমরা অবশ্য ভেবেছিলাম ঈদের দিন পাকসেনারা হয়ত একটু রিলাক্স করবে এবং ঐ সময় অন্যান্য কাজে বস্ত থাকবে। আমরা চারটি কোম্পানী নিয়ে দুদিক থেকে আক্রমন করি। আমাদের সৌভাগ্য ছিল বলতে হবে। কারন পাকসেনাদের একটি কোম্পানী বদলী হচ্ছিল এবং নতুন দল সে স্থান দখল করছিল কিছু সৈন্য রওয়ানা হয়েছে কিছু হচ্ছে কিছু নতুন সৈন্য পজিশনে গেছে ঠিক এমনি সময়ে আমরা আক্রমন করে বসি। আমাদের প্রথম আক্রমনেই পাক অফিসার কোম্পানী কমান্ডার নিহত হয়। কমান্ডার নিহত হওয়ায় পাকসেনারা পিছু পালাতে থাকে। তারা প্রায় ১০০০ গজের মত পিছু হটে একটি গ্রামে পৌছে ডিফেন্স নেয়। সেখানে তাদের আর্টিলারি পজিশন ছিল। আমরা সামনে অগ্রসর হয়ে ডিফেন্স নেই। এই আক্রমনে ভারতীয় আর্টিলারি অবশ্য খুব সাহায্য করে। পরবর্তীতে সকল আক্রমনেই ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারি প্রভুত সাহায্য করে। আমরা ক্রমশঃ আঘাত হেনে পাকিস্তানীদের পিছু হটিয়ে অগ্রসর হতে থাকি। আমার সাব সেক্টর ট্রুপ্স নিয়ে ১০ ই ডিসেম্বর লাঙ্গলহাটে পৌছাই। ইতিপূর্বে হাতীবান্ধা ছাড়া এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ যুধ আর হয়নি। পাকসেনারা লাঙ্গলহাটি ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে তিস্তার অপর পারে চলে যায়। আমরা ১৩ ই ডিসেম্বর হারাগাছা এলাকা দিয়ে তিস্তা নদী অতিক্রম করি। সেখানে কোন পাকসেনা ছিলনা। হারাগাছার এই স্থান থেকে রংপুরের দুরত্ব ৮ মাইল হওয়া সত্বেও রংপুর পৌছতে আমাদের সময় লাগে তিন দিন। কারন পথে অনেক জায়গায়ি পাকসেনা ছিল। রংপুর এলাকাতে পৌছাই ১৫ ডিসেম্বর। ১৬ ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করলেও রংপুরে পাকসেনারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। হিলির দিক থেকে আগত ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ইতিমধ্যে কর্নেল নওয়াজেশের সাব সেক্টর ট্রুপস ও চলে যায়। আমাদের দুই সাব সেক্টর ট্রুপস এক হয়ে গেছিল। আমরা আমাদের ট্রুপস নিয়ে রংপরে থকি। ভারতীয় সেনাবাহিনী রংপুর সেনানিবাসে অবস্থান নেয়।
প্রশ্নঃ সমগ্র যুদ্ধকালীন সময়রে আপনার এমন একজন সহকর্মীর কথা বলুন যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতা দেখিয়েছেন।
উত্তরঃ আমি ফারুকের কথা বলব। ফারুককে লেফটেন্যান্ট বলা হলেও এ কোন কারনেই হোক পাকিস্তানে সে কমিশন পয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য সে আমার সাব সেক্টরে যোগদান করে। সে সময় আমার সাব সেক্টরে আমিই একমাত্র অফিসার ছিলাম। আর একজন অফিসারের অভাব আমি বিশেষভাবে উপলব্ধি করছিলাম। ফারুককে পেয়ে আমি ভীষন ভাবে খুশি হই। বস্তুতঃ তাঁর মত সাহসী ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। হাতিবান্ধা আক্রমনের পর আমি একটি বি ও পি থেকে ওয়ারলেসযোগে পাকিস্তানীদের উপর আঘাত হানার জন্যে আরটিলারি ডাইরেক্ট করছিলাম। সেক্টর কমান্ডার বাশার আমার প্রায় ৬০০ গজ পিছনে ছিলেন। আমি আর ফারুক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। পাকিস্তানীরা আমাদের উপর আর্টিলারির গোলা ছুঁড়ছিল। গোলা যখন পরে তখন লক্ষ্যবস্তুর আশেপাশে পরার পরই লক্ষ্যবস্তুর উপরে ফেলা হয়। আমাদের আশেপাশে গোলা পরছিল এবং বুঝতে পারছিলাম এখনি আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে পরবে। ফারুককে বললাম কভার নিতে কিন্তু সে কভার না নিয়ে আমার কাছে সরে আসে। পাকিস্তানী কামানের গোলা তখন ১৫/১৬ গজ দূর এসে পরে। সৌভাগ্যই বলতে হবে ডিপ্রেশন থাকায় গোলা তেমন কাজে আসে না। আমি গ্রাউন্ডে গেলাম। আমি উঠেই তার খোঁজ করলাম দেখি সে হাসছে। আমি বললাম চলো কভারে যাই। সে বলল স্যার এখানে আর শেল পরবে না। আমরা দুজন যেখানে গোলা পরেছিল সেই গর্তে গিয়ে দাঁড়া্লাম। তেমনি ছোট ছোট অনেল ঘটনার মধ্য দিয়েই লেঃ ফারুকের সাহসিকতার পরিচয় পেয়েছি।
আমি সেক্টর কমান্ডারের কথা বলব। তার সকল অপারেশনে যাওয়ার কথা নয় কিন্তু তিনি মেজর অপারেশনের প্রতিটিতেই স্বয়ং থাকতেন তদারক করতেন। এতে ট্রুপস এর মনোবল বৃদ্ধি পেত।
আর একজন বিডিআর হাবিলদার রাঙ্গু মিয়ার কথা বলব। তার চেহারা দেখতে মনে হত সে একটা ডাকাত। হাতীবান্ধা অপারেশনে রাঙ্গু মিয়া (শহীদ) বীরবিক্রম এবং নায়েব সুবেদার সম্ভবতঃ লুতফর (শহীদ) বীরবিক্রমের কথা না বললেই নয়। তখন বেলা সাড়ে আটটা। পাকিস্তানীদের ডানদিকের পজিশন ফল করছে। কিন্তু বামদিকের পজিশন ছিল একটি বিওপিতে। বেশ উঁচুতে। আমাদের উচিত ছিল আগে বামদিকের পজিশন দখল করা। পরে ডানদিকের পজিশনে আঘাত হানা। আমরা প্ল্যানিং এ ভুল হওয়ায় আমি প্রথমে ডান ও পরে বামদিকে আক্রমন চালাই। কিন্তু ডানদিকে আক্রমন চালিয়েই আমি আমার ভুল বুঝতে পারি এবং বামদিকে দখল না করতে পারলে যে আমরা এখানে থাকতে পারব না তাও বুঝতে পারলাম। দুটি কোম্পানীর একটি কমান্ডার ছিলেন বিডিআর নায়েক সুবেদার লুতফর আর তাঁরাই সঙ্গে ছিল হাবিলদার রাঙ্গু মিয়া। আমরা এটাকিং পজিশন থেকে ৩০০/৪০০ গজ দূরে একটা বাঁশঝাড় থেকে এগুচ্ছি বামদিকে। সময় তখন বেলা সারে ১০ টা। আমরা অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে পাক আর্টিলারি গোলা এসে পড়তে লাগল। এই গোলা শূন্যেই ফাটে এবং এত ক্ষয়ক্ষতি হয় বেশী। এরই মধ্য দিয়ে এই দুজন বিডিআর সৈনিক নির্ভয়ে পাকিস্তানীদের বাঙ্কার চার্জ করে এবং দখল করে। এদের সাহস ও আত্মত্যাগ তুলনাহিন। জাতির দুর্ভাগ্য দুজনই সংঘর্ষে পাকিস্তানী বাঙ্কার চার্জ করতে গিয়ে শহিদ হন।
প্রায় ২২ মাইল লম্বা এবং চওড়া ন্যুনতম ৩ মাইল, কোথাও ১৮ মাইল আমার সাব সেক্টর মুক্ত ছিল। বলতে গেলে পুরো পাটগ্রাম থানাটাই আমরা মুক্ত রেখেছিলাম আমার সাব সেক্টরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ একবার আসেন। স্থানীয় এম পি মতিয়ুর রহমান মাঝে মাঝে আসতেন অন্য আর কেউ তেমন আসতেন না। সি ইন সি কোনদিন আসেননি। বিদেশী সাংবাদিক আসেননি তবে ভারতীয় সাংবাদিকরা আসতেন।