সাক্ষাৎকারঃ স. ম. বাবর আলী

<১০, ১৮.৭, ৪৪৩-৪৪৪>

সাক্ষাৎকারঃ স, ম, বাবর আলী

২৪-৬-১৯৭৩

১৫ই মে খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার ভোমরা বর্ডারে কাষ্টমস হাউসে আমরা বাঙালী ই-পি আর ও পুলিশদের নিয়ে একটি শিবির খুলি।

মে মাসের প্রথম দিকে পাক-মিলিটারী অতর্কিতে বেলা ১০ টার দিকে এই শিবির আক্রমণ করে। কিন্তু পাক-মিলিটারী ১ ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর পিছু হটতে বাধ্য হয়।

তারপরের দিন পাক-মিলিটারী পনরায় উক্ত ঘাঁটি আক্রমণ করে। ঐ আক্রমণ অত্যন্ত প্রবল হওয়ার আমরা উক্ত শিবির পরিত্যাগ করে ভারতে ইটিন্ডিয়া নামক স্থানে এস উঠি এবং একটা শিবির স্তাপন করি। এই যুদ্ধে আমাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিছুদিন পরে পাক-মিলিটারী ভোমরা ক্যাম্প পরিত্যাগ করায় আমরা পুনরায় ভোমরা ক্যাম্পে আসি।

১৯৭১-এর ১৮ ই মে পাক-সেনারা বিপুল বিক্রমে আমাদের ভোমরা শিবির দখল করার জন্য আসে। গভীর রাত্রে তারা আমাদের শিবির আক্রমণ করে। বৈকাল ৫ টার সময় মিলিটারীর হটে যাওয়ার পর এই যুদ্ধ শেষ হয়। এই যুদ্ধে পাক-মিলিটারীর বহু অফিসার ও সৈন্য নিহত হয়। আমরা পাকসেনা ২ জন ক্যাপ্টেন ও একজন সৈনিকের লাশ আনতে সক্ষম হই। আমাদের পক্ষেও ২ জন শহীদ হন।

১৯৭১- এর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ১১ জনের একটা দল নিয়ে মাত্র ৪ টি রাইফেল, ১১ টা গ্রেনেড ও কয়েকটি বেয়োনেট নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তর ঢুকি। জুনের ১০ তারিখে টাকী ক্যাম্পে ফিরে যাই।

১৯৭১-এর ১২ই জুন গভীর রাতে ইছামতী নদী পার হয়ে দেবহাটা থানার টাউন শ্রীপুর গ্রামের মিলিটারী ঘাঁটি আক্রমণ করতে যাই, কিন্তু গিয়ে দেখি ঐ ঘাঁটিতে কোন মিলিটারী নেই। রাত্রে আমরা ঐ গ্রামেই অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু শান্তি কমিটির লোকেরা খবর পেয়ে ভোর না হতেই আমাদেরকে ঘেরাও করে ফেলে। মৃত্যু ছাড়া কোন গতি না দেখে মিলিটারী সাথে গুলি বিনিময় শুরু করি। প্রায় ৫ ঘন্টাকাল যুদ্ধ চলার পর ১৯ জন মিলিটারীরর লাশ ফেলে রেখে মিলিটারীরা পিছু হটে যায়। আমাদের পক্ষে কাজল, নাজমুল ও নারায়ণসহ ৭ জন নিহত নিহত ও ১০/১৫ জন আহত হয়। ইছামতী নদী সাঁতরিয়ে আমরা টাকীতে ফিরে আসি। এ যুদ্ধ হয় ১৩ ই জুন।

এর কয়েকদিন পর প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে ঢুকি এবং আশাশুনি থানার বড়দল নামক স্থানে শহীদ কাজলের নামনুসারে কাজলনগর শিবির খুলি।

বড়দলের এই শিবির পাকসেনারা সন্ধান পেয়ে আক্রমণ করে। পাকসেনারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত থাকায় এবং আমাদের কাছে আক্রমণ প্রতিহত করার মত অস্ত্র না থাকায় পালিয়ে যাই।

জুলাই মাসে গড়ুইখালীতে রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করি এবং প্রচুর ৩০৩ রাইফেল ও গুলি উদ্ধার করি। এই মাসের শেষের দিকে পাইকগাছা থানা আক্রমণ করি। পুলিশ বিনাশর্তে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং আমরা তাদের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র দখল করি।

আশাশুনি থানার কেয়ারগাতি নামক স্থানে আমরা আর একটা নতুন শিবির স্থাপন করি। শিবির স্থাপনের কয়েকদিন পরেই গানবোটসহ পাকসেনারা শিবির দখল করার চেষ্টা করলে সেখানে বিপুল সংঘর্ষ হয়। অবশেষে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। পাকসেনারা ও রাজাকাররা কেয়ারগাতি, জামালনগর, গোয়ালডাঙ্গা, ফকরাবাদ এই কয়টি গ্রাম সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে গেয়। ইতিমধ্যে বিশ্বকবি শিবির, বঙ্গবন্ধু শিবির, শহীদ নারায়ণ শিবির, কবি নজরুল শিবির, শেরেবাংলা শিবির, সোহরাওয়ার্দী শিবির, শহীদ নাজমুল শিবির প্রভৃতি শিবির স্থাপন করি এবং এ সকল শিবিরে ছেলেদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে থাকি। এই সময় মুজিব বাহিনীর হাই কমান্ডের নির্দেশে ভারতের দেরাদুনে মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। তারপর প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নয়ে বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করি।

১৯৭১- এর আগষ্ট মাস থেকে আমরা চালনা ও মংলা বন্দরে বিদেশী শিপ, গানবোট ও খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের লালশিয়া জাহাজসহ কয়েকটা বার্জ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হই।

১৫ই সেপ্টেম্বর পাইকগাছা থানার রাডুলী ইউনিয়নের বাঁকা গ্রামে পাকসেনা ও রাজাকাররা মিলিতভাবে কয়েকটি গানবোটসহ আমাদের শিবির আক্রমণ করে। তারা অতি সন্তপর্ণে এই আক্রমণ চালায়। দুই ঘন্টা গুলিবিনিময়ের পর আমরা পিছু হটি। এই যুদ্ধে কামরুল (খোকন), মালেক, এনায়েত আইনুদ্দীন, শঙ্কর শহীদ হয়। অপর পক্ষে পাকসেনা ও রাজাকারদের বহু সৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়।

১৭ই সেপ্টেম্বর আশাশুনি থানার গোয়ালডাঙ্গা নামক স্থানে রাজাকার ও প্যারামিলিশিয়া রাহিনীর সাথে এক সম্মুখ সমর হয়। এই যুদ্ধে প্রায় ৪০/৫০ জন রাজাকার ও প্যারামিলিশিয়া নিহত হয় এবং আমরা ৭০/৭৫টি রাইফেল উদ্ধার করি। আমাদের পক্ষে এই যুদ্ধে মনোঞ্জন শহীদ হয়।

খুলনা জেলার আশাশুনি থানার চাপড়ায় রাজাকারদের একটা শক্তিশালী ঘাটি ছিল। প্রত্যেক সপ্তাহে ১/২ বার আমরা এই ঘাটিতে আক্রমণ চালাতাম ও অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করতাম।

১৯৭১- এর অক্টোবরের মাঝামাঝিতে খুলনা জেলার তালা থানার মাগুরাতে একটা শিবির স্থাপন করি। ঐ মাসের শেষদিকে সূর্যাস্তের একটু আগে কয়েক গাড়ী মিলিটারী অতি সন্তর্পণে এসে আমাদের শিবির ঘেরাও করে। আমরা মিলিটারীর আক্রমণ প্রহিত করার চেষ্টা করলে তা ব্যাহত হয়। ফলে আমরা পিছু হটি। এই যুদ্ধে সুশীল, আকবর, বক্কার শহীদ হয়। পাকসেনারা চলে গেলে মাগুরায় এক কবরে এক কবরে ৩টি লাশ সমহিত করা হয়।

খুলনা জেলার পাইকগাছা থানার কপিলমুনিতে রাজাকার ও প্যারামিলিশিয়াদের একটা মজবুত ঘাটি ছিল। ইতিপূর্বে আমরা এই ঘাঁটি আক্রমণ করে ব্যর্থ হই। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে ঐ ঘাঁটি আক্রমণ করি। ৭২ ঘন্টা দিবারাত্রি সমানে যুদ্ধ চলার উক্ত ঘাঁটির পতন হয়। এই যুদ্ধে মোট ১৫২ জন প্যারামিলিশিয়া, রাজাকার ও খানসেনা নিহত হয়। আমাদের পক্ষে গাজী, আনোয়ার (আনু) শহীদ হয় এবং খালেক, তোরাবসহ কয়েকজন আহত হয়।

ডিসেম্বরের ১২ তারিখে আমরা খুলনা শহরের ১০ মাইলের ভিতরে পৌঁছাই এবং ২/১ জন করে শহরের ভিতরে খোঁজখবরের জন্য ঢুকিয়ে দেই। ১৪ই ডিসেম্বর তারিখে খুলনা বেতারের মিলিটারী ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালাই। ইতিমধ্যে যশোর ক্যান্টমেন্টের পতন হয় এবং সেখানকার যাবতীয় মিলিটারী খুলনায় এসে আশ্রয় নেয়। ইতিমধ্যে আমরা বেশ কয়েকবার খুলনা ঢুকতে গিয়ে ব্যর্থ হই।

১৬ই ডিসেম্বর সারারাত যুদ্ধ করার পর ১৭ই ডিসেম্বর সকাল নয়টায় আমরা খুলনা শহরে প্রবেশ করতে সক্ষম হই এবং খুলনা শহীদ হাদিস পার্কে অনুষ্ঠানিকভাবে আমি প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে মুক্তিবাহিনীর অভিবাদন গ্রহন করি।

স্বাক্ষরঃ স, ম, বাবর আলী

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্য

২৪-৬-৭৩

Scroll to Top