<৯, ১১.৪, ৩৩২-৩৩৪>
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহীর সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকার- হাবিলদার মোহাম্মদ ফসিউদ্দিন
০২-০৫-১৯৭৪
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ইপিআর-এর ৬নং উইং ছিল। ২৪শে মার্চ থেকে আমাদের কিছু লোককে বাইরে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ডিউটির জন্য পাঠানো হয়। এবং উইং এর কমান্ডার, সহকারী উইং কমান্ডার, ক্যাপ্টেন সিদ্দিক ও আর একজন ক্যাপ্টেন মেস কমান্ডার থেকে সুবেদার মেজর সবাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী। বাঙালিদের বদলী করে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়োগ করা হয়। ২৫শে মার্চ থেকে বাঙালি ইপিয়ার’দের কাছে থেকে অস্ত্র কেড়ে নেবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাঙালিদের সন্দেহ জাগায় অস্ত্র জমা দিতে তারা অস্বীকার করে। জনসাধারণ আমাদের উপর হামলা চালাবে এই অজুহাতে আমরা অস্ত্র জমা দেই নাই।
২৫শে মার্চ বিকেলে সেক্টর হেডকোয়ার্টার রাজশাহী থেকে ১৫/১৬ জন বাঙালি ইপিআর একজন সিকিউরিটিসহ নবাবগঞ্জে আসে। মাঝে মাঝে তারা গোপন বৈঠক করতে থাকে। ২৫শে মার্চ রাতে তিনজন ক্যাপ্টেনসহ আনুমানিক ২৫/৩০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআর রাত প্রায় দেড় ঘটিকার সময় রহনপুর প্লাটুন হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। রহনপুর ক্যাম্পের বাঙালি ইপিআররা তাদের জীবন রক্ষার্থে ওদের উপর পাল্টা আক্রমন চালায়। ওদের তিনজন আহত হয়। ২৬শে মার্চ পাকিস্তানীরা রহনপুর বাজারে কিছু নিঃসহায় লোককে গুলী করে হত্যা করে। ২৬শে মার্চ দিনে নবাবগঞ্জ ক্যাম্পের সমস্ত বাঙালিকে নিরস্ত্র অবস্থায় তিন চারবার ফলইন করা হয়। কিন্তু কিছু সংখ্যক বাঙালি অস্ত্রসহ বাইরে গণ্ডগোলের অজুহাতে ক্যাম্পের আশেপাশে থাকে। আমাদের ফল-ইন করিয়ে উইং কমাণ্ডার বলেন যে, আমরা যদি বাইরের জনসাধারণের সাথে সহযোগিতা করি তাহলে আমাদের কঠিন সাজা দেওয়া হবে এবং গুলি করে হত্যা করা হবে। কথা প্রসংগে পশ্চিমা সুবেদার মেজর দাদু খান বলে যে তোমাদেরকে ট্যাঙ্কের সাহায্যে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হবে।
২৬শে মার্চ দিনের বেলা আমরা চট্রগ্রাম কেন্দ্র থেকে ইপিআর অয়ারলেন্সে খবর পাই যে ঢাকাতে বাঙালি ইপিআরদেরকে খতম করা হয়েছে। বাইরে যারা আছে তাদেরকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়।
২৬শে মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় আমরা কয়েকজন বাঙালি এসসিও হাবিলদার মোস্তফা কামাল, হাবিলদার জমজম আলী হাবিলদার সিদ্দিকুর রহমান, হাবিলদার সৈয়দ আলী তালুকদার এবং কিছুসংখ্যক নায়েক সিপাহী পশ্চিম পাকিস্তানী কয়েকজন এনসিও-র সাথে আলাপ করেছিলাম। হঠাৎ ব্যাটালিয়ন হাবিলদার মেজর গুলজার খান পশ্চিম পাকিস্তানীদের চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে আসেন। তাদের এহেন আচরনে আমরা সন্দিগ্ধ হলাম। আমরা আরো সতর্ক হই। কিছুক্ষন পর রাজশাহী সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে একটি মেসেজ আসে। সেটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী সমস্ত অফিসার এবং জোয়ান্দের পরিবারকে রাজশাহীতে সরিয়ে ফেলার জন্য এবং বাঙালিদের খতম করে রাজশাহীর দিকে যাবার জন্য। আমাদের বাঙালি অপারেটর এই মেসেজ সমস্ত বাঙালিদের জানিয়ে দেয়। এই মেসেজ অফিসারদের হাতে পড়ার সাথে সাথে আমাদের উপর হামলা শুরু হয়। গোলাগুলির মধ্যেই তিনজন অফিসার পরিবারসহ পালিয়ে রাজশাহীর দিকে চলে যায়। প্রায় দুই ঘন্টা গোলাগুলীর পর পরিস্থিতি বাঙালিদের আয়ত্তে আসে এবং অস্ত্রসহ পশ্চিম পাকিস্তানী জেসিওকে বন্দী করা হয়। গোলাগুলিতে তাদের কিছু লোক মারা যায়, কিছু আহত হয়। আমাদের একজন সামান্য আহত হয়।
ক্যাম্পকে সম্পূর্ণরুপে নিজ দায়িত্বে আনার পর বাইরে জনসাধারণ কে খবর দেয়া হয়। ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে ২/৩ হাজার লোক ক্যাম্পে আসে আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য। সারা রাত ক্যাম্পের বাইরে এবং ভিতরে চতুর্দিকে ডিফেন্স করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানীদের আক্রমন থেকে রক্ষা পাবার জন্য। তখন রাজশাহীতে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ছিল। আমরা সীমান্তের সমস্ত বিওপিতে অবাঙালিদের গ্রেফতার করে কিছু লোক বিওপিতে থাকি; বাকি সবাই উইং হেডকোয়ার্টারে সমবেত হবার জন্য অগ্রসর হই। ২৭ মার্চ বিকালে ৫ ঘটিকায় আমরা রাজশাহীর বাঙালির ইপিআর এবং বাঙালি পুলিশদের জীবন রক্ষার্থে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হই। রাজশাহীর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে পাকিস্তানীরা সমস্ত গোলাবারুদ এবং বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্র জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেয়। সেক্টর হেডকোয়ার্টার পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন ইসহাক সমস্ত বাঙালি ইপিআরকে সতর্ক করে দেন এবং বলেন যে; তোমাদের সাথে আমি অনেক দিন যাবৎ আছি এখানে অনেক কিছু খেয়েছি। তিনি সবাইকে আত্মরক্ষার জন্য দুই মিনিটের মধ্যে চলে যেতে বলেন। ঠিক ঐ সময়ের মধ্যে পাকিস্তানীরা গোলাগুলি এবং আগুন জ্বালানো শুরু করে দেয়।
নবাবগঞ্জ থেকে ১৮ মাইল দূরে গোদাগাড়ীতে কিছুসংখ্যক লোক ডিফেন্স তৈরি করে। রাত্রে পাকিস্তানীরা আমাদের উপর আক্রমন চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে। আমরা আস্তে আস্তে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হতে থাকি গোলাগুলী চলতেই থাকে। রাজশাহীর কাছিয়াডাঙ্গাতে ক্যাপ্টেন গিয়াস নওগাঁ থেকে এসে আমাদের সাথে মিলিত হন। সেই সময় আমাদের কোন অফিসার না থাকায় তিনি নেতৃত্ব দেন । রাজশাহী কোর্ট স্টেশনের নিকট ডিফেন্স থাকাকালীন আমাদের একজন নায়েক আব্দুল মালেক শহীদ হন। ক্যাপ্টেন গিয়াস সাহেবের নেতৃত্বে আমরা রাজশাহী শহর দখল করে নেই। এরপর রাজশাহী সেনানিবাস দখলের জন্য সাঁড়াশী অভিযান শুরু হয়। প্রায়ই আমাদের উপর বিমান হামলা হত-দিনে ৩/৪বার করে। ১৩ই এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত আমরা সেনানিবাসের কিছু জায়গা দখল করে নেই। এই অভিযানে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিকাংশই নিহত হয়।
রাজশাহী দখলের পরই খবর আসে যে ঢাকা থেকে বিপুল সৈন্য আরিচাঘাট- নগরবাড়ি হয়ে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের পথে বাধা দেয়ার জন্যে আমাদের কিছু লোক-আনসার, মোজাহিদ, পুলিশ ঐদিকে এগিয়ে যায়। নগরবাড়িতে আমাদের লোকের সাথে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। আমাদের লোক পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানীদের রাজশাহী পৌছা পর্যন্ত রাস্তার কয়েক জায়গায় আমাদের লোকের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। সংখ্যায় তারা অধিক থাকায় বহু হতাহতের পরও তারা রাজশাহী পৌছে যায়- বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের সুশিক্ষিত গোলন্দাজ বাহিনী তাদের অনেক গারী ধ্বংস করে/ তাদেরও অনেক হতাহত হয়। ১৩ই এপ্রিল শেষ রাতে পাকিস্তানীরা আমাদের উপর মরণপণ আক্রমন চালায়। আর্টিলারী, পদাতিক এবং বিমান হামলা চলে সম্মিলিতভাবে। তাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা আত্মরক্ষার জন্য পিছু হটতে বাধ্য হই।
পুনরায় আমরা সমবেত হই-চাঁপাইনবাবগঞ্জে। গোদাগাড়ীতে পুনরায় ডিফেন্স নিই। ২২শে এপ্রিল ভোর বেলায় পাকিস্তানীরা আমাদের উপর হামলা চালায়। এখানে পাকিস্তানীদের প্রায় ১৫০টি কনভয় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমন চালায়। পরপর কয়েকবার আমাদের উপর পালটা আক্রমন হয়। আমাদের বহু লোক এখানে শহীদ হয়।
২৩শে এপ্রিল ভোরে আমরা পদ্মা নদী পার হয়ে হাকিমপুর, পোলাডাঙ্গা এবং সাহেবনগর চরে গিয়ে সমবেত হই। ক্যাপ্টেন গিয়াসের নির্দেশে সমস্ত লোক পোলাডাঙ্গা ক্যাম্পে একত্রিত হয়।