সাময়িকী

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত বাংলা কথিতমালা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এর দলিলপত্র মে-ডিসেম্বর, ১৯৭১

সাময়িকী

২৮ মে, ১৯৭১

স্বাধীন বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের নিধনযজ্ঞে নেমে পাকিস্তানের সামরিকশাহী অকল্পনীয় আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি ও সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। লণ্ডনের যুদ্ধ বিশেষজ্ঞদের মতে, দেড় হাজার মাইল দূর থেকে এসে বাংলাদেশে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর দৈনিক এককোটিরও বেশি টাকা খরচ হচ্ছে- এ হিসেবে যুদ্ধের প্রথম পঞ্চান্ন দিনে পাকিস্তানের আড়াইশ’ কোটি টাকা খরচ ও ঘাটতি হয়েছে। মার্চ মাসের শুরু থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে কোন মাল রপ্তানি না হওয়ায় পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ নেমে কমেছে ১৫ কোটি ডলারে। বাণিজ্য খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা।

ফ্রান্স-এর পত্রিকা ‘লা ফিগারোর মতে যুদ্ধের প্রথম মাসে অর্থাৎ প্রথম ত্রিশ দিনে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানী-বাণিজ্যের ক্ষেত্রের পশ্চিম পাকিস্তান একশ’ কোটি টাকা হারিয়েছে।

এ বছরের জানুয়ারি মাসের শেষে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা জমা ছিল ১২৭ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৯০ কোটি টাকা। যুদ্ধের দরুন এপ্রিলের শেষে সেই অংক কমে ৮২ মিলিয়ন ডলারে, অর্থাৎ প্রায় ষাট কোটি টাকায়। এবং বর্তমানে সেটা এসে ঠেকেছে ২০ কোটি টাকার কাছে।

পাশ্চাত্যের অর্থ-বিশেষজ্ঞদের মতে, কোন দেশের সংরক্ষিত তহবিলে বিশ কোটি ডলার অর্থাৎ এক শ’ কোটি টাকা জমা থাকা উচিত। এর কম হলে সে দেশকে অর্থনৈতিক দেউলিয়া দেশ বলা হয়। পাকিস্তানের সংরক্ষিত তহবিলে এখন জমা আছে মাত্র ২০ কোটি টাকা। এদিক থেকে পাকিস্তান এখন সত্যসত্যই দেউলিয়া দেশ।

ফলে পাকিস্তানী টাকার মূল্যমান কমানো অনিবার্য হইয়ে পড়েছে । পাকিস্তান সরকার পাকিস্তানী মুদ্রার মূল্যমান কমাতে সম্মতও হয়েছে। কারণ এখন আর উপায় নেই।

ফ্রান্সের “লা ফিগারো পত্রিকার এক খবরে বলা হয়েছে যে, মার্কিন সরকার পাকিস্তানের সামরিকশাহীকে এ বছর ষাট কোটি টাকার সাহায্য দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু এখন আর তা দেয়া হচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২৫ শে মার্চ অর্থাৎ বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনানায়করা যুদ্ধ শুরু করার দিন থেকে পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়া স্থগিত রেখেছে। বৃটিশ সরকারের প্রতিশ্রুত সাড়ে একত্রিশ কোটি টাকার সাহায্য বন্ধ রয়েছে।

এদিকে বিশ্বব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট উপদেষ্টা মি.এম,এম আহমদকে বাংলাদেশে যুদ্ধ বন্ধ না করা পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনো ঋণ দেবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে।

জার্মান পত্রিকা ‘আলগেমাইনে জাইটুং-এ এই মর্মে সংবাদ ছাপা হয়েছে যে, বাংলাদেশের যুদ্ধ চালাতে গিয়ে পাকিস্তানের রফতানী এখন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ এবং যুদ্ধ খাতে প্রচুর ব্যয়ের জন্য পাকিস্তান এখন আর্থিক দেউলিয়া দেশে পরিণত হয়েছে।

ইয়াহিয়া খানের অর্থ-উপদেষ্টা মি. এম,এম আহমদ ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলেছেন, পাকিস্তানের মাত্র তিন-চার মাসের খাদ্যশস্য মজুদ আছে। সেখানে তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করতে গিয়ে পাক-সেনারা বাংলাদেশের শতকরা ৫০ ভাগ রেলপথ ধ্বংস করে দিয়েছে এবং বর্তমান শতকরা ৮০ ভাগ রেলপথই অকেজো। ফলে বাংলাদেশে সরবরাহ ব্যবস্থা বিলকুল বন্ধ- মানে প্রায় তিনমাস ধরে বন্ধ। তাছাড়া প্রায় তিনমাস ধরে চট্টগ্রাম ও চালন বন্দর সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। বাংলাদেশের কল-কারখানা বন্ধ-ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় নেমে এসেছে রীতিমতো আকাল।

অপরপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদিত কোনো জিনিসপত্র গত তিনমাস ধরে বাংলাদেশে আমদানী কলা সম্ভব হয়নি। অথচ এই বাংলাদেশেই গত ২৩ বৎসর ধরে পশ্চিমা ব্যবসায়ীদের কাজ-কারবারের বাজার ছিল। যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার এই অচলাবস্থার দরুন বাংলাদেশে থেকে যেমন চা, পাট, পান, সুপারি পশ্চিম পাকিস্তানের নেয়া সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও কোন মালামাল এখান আমদানী করা সম্ভবপর হয়নি। এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপাদনকারীরা অতুলনীয় ব্যবসায়ীক সংকটে পড়েছেন। এদিকে বাংলাদেশে পাক-সেনারা জানমালের যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে এবং এখনো করছে তার দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে বিরল।

এ অবস্থায় পাকিস্তানকে বিভক্ত করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ইয়াহিয়া খানকে দায়ী করেছেন। ১৪ বৎসর ধরে পাকিস্তানে সামরিক শাসন কায়েম থাকায় এবং এবার জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে বরং বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা, নারী-নির্যাতন ও লুটতরাজসহ যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের মতো লাভজনক বাজার হারাতে বসায় পঃ পাকিস্তানের সর্বত্র খান-সরকারের অপরিণামদর্শিতার বিরুদ্ধে দারুণ বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশে থেকে ইয়াহিয়াশাহী অবিলম্বে সেনাবাহিনী গুটিয়ে না নিলে আর্থিক ও জানমালের ক্ষতি যে কি পর্যায়ে পৌছে তা বলা দুষ্কর- তাই জঙ্গীশাহীর অর্থর-বিশেষজ্ঞরা আজ আতঙ্কিত হয়ে কি ভাবছেন না যে, ছেড়ে দে মা কেদে বাঁচি?

(আবুল কাসেম সন্দ্বীপ রচিত)

Scroll to Top