শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭৬। সোনার বাংলা ধ্বংস অভিযান | ইমস ম্যাগাজিন | ২ অগাস্ট, ১৯৭১। |
<১৪, ৭৬, ১৮২-১৯১>
সোনার বাংলা ধ্বংস অভিযান
সুত্রঃ টাইমস ম্যাগাজিন
তারিখঃ ২ অগাস্ট, ১৯৭১।
নদী, সড়ক অথবা বন্যপথ ধরে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগন ভারতের দিকে ধাবিত হয়েই যাচ্ছে। হাতে কিছু টিনের বাসন কোসন, কার্ডবোর্ডের বাক্স; মাথার উপর কাপরের বেধে রাখা বান্ডিল, কোলে অসুস্থ শিশু বা বৃদ্ধ আত্মীয়দের বহন করে চলা এই মানুষের স্রোতধারার যেন কোন শেষ নেই। তারা এগিয়ে চলে কর্দমাক্ত খালি পায়ে। এই মিছিলের অনেকেই অসুস্থ, সারা শরীরে ঘা হয়েছে কারো কারো। কেউ কেউ কলেরায় আক্রান্ত হয়েছেন। চলতে চলতেই কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পরলে তাদের দেহ সৎকার করারও কেউ নেই। হিন্দুরা, যদি সম্ভব হয় তাদের মৃত আত্মীয়ের মুখাগ্নি করেন, অথবা পুড়িয়ে দেন। বাকী দেহাবশেষগুলো পড়ে থাকে কাক, শকুন অথবা কুকুরের খাদ্য হয়ে। পচাগলা মৃতদেহদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শরণার্থীরা কেউ কেউ নাকে কাপড় চাপা দেন, তবুও এই মিছিল, এই চলমান জনতার সারি চলতেই থাকে, দিবারাত্রি, কোন বিরাম নেই।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকালীন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল চারমাস আগে, শরণার্থীর মিছিল সেই থেকে এখনও পর্যন্ত চলছে। তাদের সংখ্যা ঠিক কত, তা সঠিক কেউ জানেনা, যদিও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ শরণার্থী শিবিরে প্রতিদিন রেজিস্টার করার হার দেখে বলছেন প্রতিদিন ৫০,০০০ শরণার্থী ভারত সীমান্তে প্রবেশ করে। গত সপ্তাহে ানুমানিক সাড়ে সাত লক্ষ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। মনে হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের যা অবস্থা, তাতে খুব দ্রুতই দুর্ভিক্ষ শুরু হবে। ভারত আশংকা করছে যে এই মিছিল শেষ হতে হতে শরণার্থীদের সংখ্যা বর্তমানের দ্বিগুণ হবে।
শত শত, হাজার হাজার মানুষ এখনও উদ্বাস্তু হয়ে দেশটির গ্রামাঞ্চলগুলোতে ঘুরছেন, তাদের কোন আশ্রয় নেই, নেই কোন খাবার। সীমান্তের কাছাকাছি স্কুলগুলোতে কেউ কেউ রাত্রিযাপন করেন, কেউ গ্রামবাসীদের বাড়িতে আশ্রয় নেন, কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে মাঠে কিংবা কোন গাছতলায়ই ঘুমিয়ে পড়েন। বেশিরভাগ শরণার্থীকেই শরণার্থী শিবিরগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়, খাবারের জন্য রেশন কার্ড আর মাথা গোজার জন্য ছাউনি, যার চারপাশে বাঁশের চাটাই এর বেড়া আর মাথার উপরে প্লাস্টিকশিট কিংবা চটের ছালা। শিবিরগুলোতে মানুষ অনাহারে না থাকলেও, খাবার বেশ অপর্যাপ্তই বলা যায়, বিশেষ করে গুড়ো দুধ এবং শিশুখাদ্য।
ফুরিয়ে গেছে চোখের পানিও
বর্ষার বৃষ্টিতে অনেক শিবিরই ছোটখাট জলাশয়ে পরিনত শরণার্থীদের জীবন আরো বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে। কলকাতার বাইরে অবস্থিত একটি ক্যাম্পে কাজ করছেন, জার্মান চিকিৎসক ডঃ মেথিস ব্রম্বারগার। তার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বৃষ্টির মধ্যে হাজার হাজার মানুষকে বাইরে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের নিচে ভিজতে হয়। তাদের মধ্যে ছোট ছোট শিশু এবং তাদের মায়েরাও আছেন। তারা ছাউনিতে ঘুমাতে পারছেন না, কেননা সেখানে হাটুসমান পানি জমে আছে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা যায়নি। ফলে, রোজ সকালেই অনেক শরণার্থী অসুস্থ হয়ে পরছেন কিংবা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে। কোন গুরুতর কলেরা রোগিকেই হাস্পাতালে নেয়া সম্ভব হয়নি। এবং মৃতদেহগুলো নিয়ে যাওয়ারও কেউ নেই। সেগুলো ওখানেই খোলা মাটিতে বা পানিতে পড়ে আছে। ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রতিষেধক দিয়ে কলেরার মাত্রা অনেকাংশেই কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও, ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী এপর্যন্ত ৫০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে এবং প্রায় ৩৫,০০০ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমাগত বমি ও ডায়রিয়ার সাথে লড়াই করে যাচ্ছেন। কর্তৃপক্ষ আশংকা করছেন যে, নতুন করে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শরণার্থীদের মাঝে নিউমোনিয়া, ডিপথেরিয়া ও যক্ষা ছড়িয়ে পোরতে পারে। একজন ডাক্তার বললেন- “মানুষ এখন আর কাঁদছেও না।” খুব সম্ভবত এর চেয়েও ভিতীকর অবস্থা থেকে তারা পালিয়ে এসেছে। প্রত্যেকের মনেই পাকবাহিনীর চালানো ধর্ষণ, খুন বা অন্যান্য অরাজকতার আতংক অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বর্তমান। বাঙ্গালীর স্বাধীনতা আন্দোলনকে থামিয়ে দিতেই হানাদার বাহিনী এ অত্যাচার চালাচ্ছে। একজন দম্পত্তি আমাদের বলছিলেন যে কিভাবে পাকবাহিনী তাদের তরুন দুই ছেলেকে বাড়ির বাইরে বের করে নিয়ে পেটে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে আঘাত করেছে, আহত ছেলেদের কাছে কাউকে যেতে দেয়নি, কিভাবে প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে রক্তক্ষরণ হয়ে তারা মৃত্যুবরন করে। আরেকজন নারী বললেন, সেনারা তার বাড়িতে এলে তিনি তার ছেলেমেয়েদের খাটের নিচে লুকিয়ে রাখেন, কিন্তু কম্বলের নিচে দিয়ে তাদের দেখতে পেয়ে সেনারা গুলি চালিয়ে তার দুই সন্তানকে হত্যা করে ও অন্যজনকে আহত করে। ভারতের প্রেস ট্রাস্ট রিপোর্ট (পিটিআই) এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সম্প্রতি একদল শরণার্থী পাকিস্তানী আর্মি পেট্রলের ধাওয়া খেয়ে ভারত সীমান্তের কাছেই একটি পাটক্ষেতে লুকিয়ে ছিলেন। পিটিআই প্রতিবেদনে বলছে- “এসময় হঠাত একটি ছয় মাস বয়সী শিশু মায়ের কোলে কেদে ওঠে, মা’টি অনেক চেষ্টা করেও শিশুটিকে থামাতে ব্যর্থ হয়। পাকসেনারা কান্না শুনে ফেললে বাকী শরণার্থীরাও আক্রান্ত হতে পারে সেই আশংকায় মা নিজেই শিশুটিকে গলা টিপে মেরে ফেলে।
আগুনের বেষ্টনীঃ
গোটা পূর্ব পাকিস্তান যেন আজ রক্তস্নাত, আর তার চিনহ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। শহরগুলোর সর্বত্র শেল আর বিমান হামলার ধংসযজ্ঞ। খুলনার উত্তরে খালিশপুর নামক আবাসিক এলাকায় এখন আর কোন বাসভবন নেই, শুধু বোমার আঘাতে গুড়িয়ে যাওয়া ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষগুলো পরিষ্কার করতে দেখা যায় কিছু জীর্ণশীর্ণ নারী ও নগ্ন শিশুদের যারা একসময় এই ঘরগুলির বাসিন্দা ছিলেন। চট্টগ্রাম এর হিজরি লেন ও মৌলানা শওকত আলি রোডের সব চিনহ সমুলে মুছে গিয়েছে। যশোরের কেন্দ্রীয় বাজার বলতে এখন কিছু দুমড়ানো মুচড়ানো টিন আর ভাঙ্গা দেয়াল। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক এর একটি টিম এর মন্তব্য অনুযায়ী কুষ্টিয়া শহরটিকে দেখলে একটি পারমানবিক বোমা আঘাত হানার পরের সকালটির কথা মনে পরে যায়।
ঢাকা শহরের পুরানো ঢাকা পরিচিত নামের অঞ্চলটিকে সেনারা বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে প্রথমে অগ্নি সংযোগ করে এবং তারপর আগুন থেকে পালতে চাওয়া বাংগালীদের উপর গুলি চালায়। প্রায় ২৫ টি গলিতে বুল্ডোজার চালিয়ে সেখানকার সব স্থাপনা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। চারদিকের গায়ে গায়ে লাগানো বস্তির ঘরগুলোর সাথে ওই ফাকা জায়গাগুলো একদমি বেমানান ও প্রকট হয়ে উঠছে। বিদেশী দরশনারথীদের জন্য পাকা সেনারা ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের দেয়ালে তৈরি হওয়া অনেক শেলের গরত বুজিয়ে ফেললেও, সেখানে আজো শত শত শিক্ষার্থীকে হত্যা করার চিনহ রয়ে গেছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, যেখানে প্রায় ১০০০ পুলিশ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুদ্ধ করে গেছেন, সেস্থানে বিস্ফোরিত হওয়া একটি ট্যাঙ্ক আজো সে অবস্থায় রয়ে গেছে।
লক্ষ লক্ষ একর জমি পতিত হয়ে পড়ে আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শস্য পাট আবাদের পর এখন মাঠে পড়ে আছে, পচন ধরছে, কেবল মাত্র সামান্য কিছু পাটই মিল অব্দি পৌছাতে পেরেছে। এবছর চাও সামান্যই উৎপাদিত হয়েছে। প্রায় ৩০০,০০০ টন আমদানি করা শস্য এখনও পরে আছে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে। ঢাকা এবং অন্যান্য শহরগুলোতে কাচা বাজার এখনও বসে, কিন্তু গত ৪ মাসে চালের দাম প্রায় ২০% বেড়ে গেছে।
বাঙ্গালিদের সবার মধ্যেই এখন ভয় এবং প্রচন্ড ঘৃণা বিরাজ করছে। সামনাসামনি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলবে, এমন লোক খুব কমই আছে, কিন্তু ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল এর মেইল বক্সে রোজই অসংখ্য চিঠি আসে অরাজকতা ও নতুন নতুন গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার খবর নিয়ে। বাঙালি একজন আমলা, তার গৃহে দেয়া এক গোপন সাক্ষাতকারে বলেন, অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবে, দীরঘ সময় ধরে এ সংগ্রাম চলবে, হয়ত ভিয়েতনামের চেয়েও খারাপ অবস্থা হতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয় আমাদেরই হবে।
আর্মিদের এই হামলায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে নানান রকম ধারনা আছে, দুই লক্ষ থেকে শুরু করে দশ লক্ষ পর্যন্ত। কম সংখ্যক ধারনাটাই আমাদের কাছে বেশি গ্রহনযোগ্য, কিন্তু সঠিক সংখ্যাটি জানা সম্ভব নয়। এর কারন, অসংখ্য লাশ নদীতে, কুয়ায় অথবা গনকবরে ফেলে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানিদের কাছে থেকে পাওয়া সংখ্যার উৎসকেই এক্ষেত্রে সবচেয়ে অনির্ভর যোগ্য বলে ধরা হচ্ছে। এমনটি হওাটাই স্বাভাবিক ছিল, কেননা শরণার্থীরা আসা শুরু করার আগে আয়তনে ফ্লোরিডা রাজ্যের সমান এ অঞ্চলে প্রায় ৭৮০ লক্ষ মানুষ ছিল, যাদের ৮০ ভাগই নিরক্ষর।
নির্মম প্রতিহিংসা
মুসলিম সেনাবাহিনীর তীব্র আক্রোশ হিন্দু বাঙ্গালীদের উপর, আর সেকারনেই নিহত বা শরণার্থীদের তিন- চতুর্থাংশই এ সম্প্রদায়ের। এখনও রাস্তায় রাস্তায় সেনাবাহিনী চেকপোস্টে বাঙ্গালীদের লুঙ্গি ছিনিয়ে নিয়ে খতিয়ে দেখা হয় যে তাদের খৎনা হয়েছে কিনা, মুসলিম পুরুষদের জন্য যা বাধ্যতামুলক। খৎনা ছাড়া কাউকে পাওয়া মানেই মৃত্যুদণ্ড। সারি বেধে দাড় করিয়ে বাকিদেরও গুলি করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের একজন উচ্চ পরযায়ের কর্মকর্তা গত সপ্তাহে মন্তব্য করেন- পোল্যান্ডে নাজিদের হত্যাযজ্ঞের পর এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ সুনিপুন পরিকল্পিত হত্যাকান্ড।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিরোধ ও গড়ে তোলা হচ্ছে ধীরে ধীরে। আর্মি ও তাদের সহযোগীদের হামলার জবাবে প্রথমে গেরিলা হিট এন্ড রান পদ্ধতি, নাশকতা এবং গুপ্তহত্যার মতন আক্রমন চালানো শুরু হয়েছিল, কিন্তু এখন বাঙালি মুক্তি বাহিনীর যোদ্ধারা শত শত ব্রিজ ও কাল্ভারট উরিয়ে দিচ্ছে, রেললাইন ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এই গেরিলাদের মুল অংশ ভারতীয় সীমান্তের ওপার থেকেই আসছে, যেখানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার একটি বৃহদাকার যুদ্ধ প্রশিক্ষন ও মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগ এর কার্যক্রম চালাচ্ছে। পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ও প্রধানমন্ত্রী ইয়াহিয়া খান গত মাসে দাবী করেন যে ভারতে এধরনের প্রায় ২৪টি ক্যাম্প রয়েছে। ভারতও এখন আর অস্বীকার করার প্রয়োজন মনে করছে না যে স্থানীয় ভারতীয়রা এবং ভারতীয় সীমান্তে নিয়োজিত কিছু সেনাবাহিনীর ইউনিটও এই ক্যাম্পগুলোতে বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই মুক্তি বাহিনীর অর্ধাংশ প্রায় ৫০,০০০ যোদ্ধা এসেছেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পার্লামেন্টারি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী থেকে। তরুন যোদ্ধারা, যাদের অনেকেই ছাত্র এখনও, তাদেরকেও ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে যেন তারা সাধারন জনগনের সাথে মিশে যেতে পারে। সাধারন জনগণই তাদের খাবার দাবারের ভার নিচ্ছে, তাদের জন্য খবরাখবর আনা নেয়া, রাস্তা চেনানো বা নাশকতায় হিট এন্ড রান হামলা করতে সাহায্য করছে. গেরিলারা ঢাকার বিদ্যুৎ সংযোগ দুইবার বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, এবং সপ্তাহখানেক ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েটিকেও অকেজো করে রেখেছে। যেখানেই পারছে তারা লাল-সবুজ আর সোনালী রঙের বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করছে। তারা দাবী করছে যে তারা এপর্যন্ত ২৫,০০০ পাকিস্তানী সেনা হত্যা করেছে, যদিও সংখ্যাটি ২৫,০০ এর বেশি হবেনা এবং আরো ১০,০০০ সেনা আহত হয়েছে (নিরভরযোগ্য পশ্চিমা সুত্র থেকে)। প্রতিরোধকারী বাহিনী ইতিমধ্যে রাতের বেলা শহরের বাইরের এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রন করছে, এবং দিনের বেশির ভাগ সময়টিতেও। কেবল্মাত্র সময় আর এই অগ্নি পরীক্ষাই বলে দিবে যে এই গেরিলাদেরকে মুক্তিবাহিনীর নেতারা একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ শক্তিতে পরিনত করতে পারবে কিনা। বর্তমানে এই বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হচ্ছে একজন অবসর প্রাপ্ত কর্নেল এ। জি। ওসমানী, যিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের একজন সদস্য। কিন্তু অনেকেরই ধারনা যে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পুরবেই এই অপেক্ষাকৃত পরিমার্জিত নেতৃত্ব চলে যাবে আরো বেশি মৌলবাদীদের হাতে। এখন পর্যন্ত যুদ্ধের কোন মতাদর্শগত ভিত্তি নেই, কিন্তু তা পরিবর্তিত হয়ে যেতেও পারে। একজন বাংলাদেশী কর্মকর্তা বলেন- “যদি গনতান্ত্রিক দেশগুলো দ্রুত এ সমস্যা নিরসনের জন্য পাকিস্তানকে চাপ না দেয়, তবে তার পরিনতি কি হতে পারে, ভাবতেও ভয় হচ্ছে। যদি এই সবাধীনতার সংগ্রাম অনেক দীরঘায়িত হয় তবে গনতন্ত্রের বিষয়গুলো বিযুক্ত হয়ে যাবে, কেবল সমাজতান্ত্রিকদের কথাই মুল হয়ে দাঁড়াবে। এখনও পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিকরা কোন শক্ত ভিত্তির উপরে দাড়াতে পারেনি। কিন্তু আমরা যদি জনতার পাশে প্রয়োজনের সময় না দাড়াতে পারে, তবে তারা দল পরিবর্তন করবে।
তবে এ প্রতিশোধের পুরোটাই পাক সেনাবাহিনীর উপর দিয়ে গেছে তা নয়, প্রায় ৫০০ বাঙ্গালীকেও পাকিস্তানীদের সহযোগী সন্দেহে হত্যা করেছে মুক্তিবাহিনী, যেমন ডানপন্থী ধর্মভিত্তিক দল জামাতে ইস্লামি ও অন্যান্য ছোটখাট পারটিসমুহের সদস্যদের। বিহারি, অবাঙ্গালি মুসলিম, যারা ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর এদেশেই রয়ে গিয়েছিল, তারাই ছিল মুল টার্গেট এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্দোষ টার্গেট। সহযোগী রাজাকার বলে যাদের সন্দেহ করা হচ্ছিল, গেরিলারা তাদের বাড়িতে হানা দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থাতেই তাদের হত্যা করেছে, কিংবা জবাই করেছে যেন অন্যান্য গ্রামবাসীরাও সতর্ক হয়ে যায়। আরো আশংকাজনক হচ্ছে যে ১৩০০ মাইল সীমানা জুড়ে দিন দিন সংঘর্ষ বেড়েই যাচ্ছে যেখানে প্রায় ৭০,০০০ পাকিস্তানী সেনা ভারত থেকে আসা বিদ্রোহীদের আক্রমন ঠেকানোর চেষ্টা করছে। আরেকদিকে তারা ভারতীয় জওয়ানদেরও মুখোমুখি হচ্ছে। একটি বিক্ষিপ্ত গুলিও ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের কারন হয়ে যেতে পারে এবং তার ফলাফল ১৯৬৫ সালে কাশ্মিরে যে ১৭ দিনের যুদ্ধ হয়েছিল তারচেয়ে বিধ্বংসী হয়ে পরবে।
একটি অনিয়ন্ত্রিত গেরিলা যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পরে, সংঘর্ষ যতবেশি ছরিয়ে পরছে পাকিস্তানিরা ততবেশি মনোবল হারাচ্ছে। দুই জাতি স্বেচ্ছায় আবার কখনও এক হবে তার কোন সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু, ইয়াহিয়া খান এবং অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী জাঁদরেল নেতাগন, যারা এই মুহূর্তে পুরব-পসচিম মিলিয়ে বিশ্বের পঞ্চম বৃহদাকার রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের কাছে বিভক্ত হওয়ার প্রস্তাব সম্পূর্ণ অবাস্তব। পাকিস্তানকে অবিভক্ত রাখার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খান গত মাসে জাতির উদ্দ্যেশ্যে ভাষণে বলেছেন- “এর চেয়ে মহৎ কোন ত্যাগ হতে পারেনা”। যে একতার সবপ্ন তিনি দেখছেন, তা কেবল মাত্র পূর্ব পাকিস্তানকে একটি অনুগত অঙ্গরাজ্যই বানিয়ে রাখতে পারবে। বাঙালি সংস্কৃতিকে মুছে ফেলতে এমনকি রাস্তার নামগুলো পর্যন্ত বদলে ফেলা হচ্ছে। ঢাকার শাখারি বাজার রোডের বর্তমান নাম টিক্কা খান রোড, এই নামকরন করা হয়েছে এমন একজনের নামে যিনি বর্তমানে মার্শাল ল এর অধীনে পুরব পাকিস্তানে শাসন করছেন এবং যাকে অত্যন্ত কঠিন একজন কমাণ্ডার বলে ধরে নেয়া হয়।
মধুর হাসি
গর্বিত বাঙালি জাতি সহজে হাল ছারেনা। একটি আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ কিন্তু পরিবরতনশীল জাতি, যাদের দুটি প্রধান আগ্রহের জায়গা হচ্ছে রাজনিতী ও কবিতা, যার একটি নিজস্ব সংস্কৃতি তারা তৈরি করে নিয়েছে। আড্ডা হচ্ছে তাদের অবসর কাটানোর সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম, এবং ঘন্টার পর ঘন্টা গ্রামের বটতলায় বা ঢাকার কফিহাউসগুলোতে বাঙ্গালিদের আড্ডা দিতে দেখা যায়।
স্বভাবতই বাঙালি তার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে কোন বিপ্লবী সঙ্গীত না বরং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাঙ্গালী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সোনার বাংলা” কবিতাকে বেছে নিয়েছে।
…ও মা,
ফাগুনে তোর আমের বনে
ঘ্রাণে পাগল করে–
মরি হায়, হায় রে
ও মা,
অঘ্রানে তোর ভরা খেতে,
আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।।
যে ভয়াবহ পরিনতি এদেশের মানুষকে মেনে নিতে হয়েছে, তা স্বত্বেও এই দেশ বিস্ময়কর সৌন্দর্যমন্ডিত, যত দূর চোখ যায় শুধু ধান আর পাট খেত দিগন্তজুড়ে, গঙ্গার মোহনাতে মিশে গিয়েছে। মাটি এতই উর্বর যে বীজ ফেল্লেই যেকোন শস্য ফলে, যদিও তা বাঙ্গালীকে দারিদ্র্যের আঘাত থেকে বাচাতে পারেনি। প্রক্রিতি যেমন দিয়েছে, তেমনি ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাস ও বন্যায় সব ভাসিয়েও নেয়। বন্যায় গঙ্গা বা ব্রক্ষ্মপুত্র নদী থেকে ভেসে আসা পলিমাটিতেই বাংলার মাটি এত উর্বর।
অসঙ্গত পরিণয়
এই যুদ্ধের আগেও, দেখা যাচ্ছিল যে পাকিস্তানের এই দুই ব্যাতিক্রম এবং দূরবর্তী অংশের মুসলিম জাতির মাঝে ইসলামিক ধর্ম বিশ্বাস ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স ছাড়া আর কোন বন্ধন ছিল না। না তাদের সীমান্ত এক না সংস্কৃতি, আর মাঝখানে ১১০০ মাইল জুড়ে ভারত। পাকিস্তান যেন দক্ষিণপূর্ব এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যের এক অসংগত পরিণয়। খ্রিষ্টাব্দের দ্বিতীয় সহস্রাব্দে আরযরা এই উপমহাদেশে প্রথম আসে, যাদেরি বংশধর এই দীরঘাঙ্গী, গৌরবর্ণ পাঞ্জাবি, পাঠান, বেলুচ ও সিন্ধি পশ্চিম পাকিস্তানিগন। কালো রঙের বাঙ্গালীরা বেশিরভাগই ছিল দ্রাভিদ জাতির যারা আরযদের দ্বারা শোষিত হয়েছিল। এই পশ্চিমারা গম ও মাংস খায়, কথা বলে উর্দুতে যা আরবিতে লেখা হলেও উৎপত্তি পার্সি ও হিন্দি ভাষা থেকে। অন্যদিকে পূর্ব অংশের এই জাতি খায় ভাত আর মাছ, কথা বলে বাংলায় যা ইন্দো-আরয ভাষার একটি অংশ।
পুবাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাও অত্যন্ত বেশি পশ্চিমের তুলনায়। ৭৮০ লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রায় ১০০ লক্ষ হিন্দু আর অইদিকে ৫৮০ লক্ষ জনতার মধ্যে মাত্র ৮ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ বাস করে পশ্চিম অংশে। ব্রিটিশ আমলে, পশ্চিম পাকিস্তানীরাই ছিল সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর মুল অংশ আর শক্তিশালী পাঞ্জাবী আর পাঠানদের ব্রিটিশরা প্রশিক্ষন দিয়ে দক্ষ শ্রমিকে পরিনত করেছিল। ‘লুঙ্গি’- একটি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ান ধাচের ঝুলওয়ালা পোশাক যা মুলত বাংগালীরা পরিধান করে, পশ্চিমাদের কাছে একটি অবজ্ঞার পোশাক, তারা বলে যে “সেখানে পুরুষরা সায়া পরিধান করে আর মেয়েরা প্যান্ট। পশ্চিমে এমন না, বরং সেভাবেই সবকিছু থাকে যেভাবে করা উচিত’।
বিশটি পরিবার
দেশ চালানোর প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সবসময়ি মুল চালিকাশক্তি নিজেদের হাতে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। একসময় বাঙ্গালীরা নিজেদের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত বলে গর্ববোধ করত, উর্দুতে যেই দেশের নাম “পবিত্রদের ভুমি”। পশ্চিমের মুসলিম জনগনের মতই তারা দেশবিভাগের পূর্বে ভারতীয় হিন্দুদের আধিপত্যে অতিষ্ঠ ছিল। ১৯৪০ সালে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা পিতা, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, একটি আলাদা ইসলামিক রাষ্ট্রের দাবী করেন। ভারত এই বিভক্তি রুখে দেবে বলে আশা করেছিল, কিন্তু ১৯৪৭ সালে পশ্চিম বংগসহ পাঁচটি মুসলিম রাষ্ট্র বিভক্ত হওয়ার পক্ষে ভোট দেয়। এর ফলাফল ভৌগলিকভাবে কৌতুহল জাগানো এক দেশের উদ্ভব, যা পরবর্তীতে সম্পূর্ণভাবে একটি রাজনৈতিকভাবে অর্থহীন রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে।
এই বিভক্তি শান্তি, প্রগতি আর স্বাধীনতা আসবে বলে ধরে নেয়া হয়েছিল, কিন্তু তা শুধুই ধ্বংস বয়ে এনেছে, যেখানে হিন্দু মুসলিম হত্যা করেছে, আর মুসলিমরা হত্যা করেছে হিন্দুদের। মহাত্মা গান্ধীজিকে হত্যা করার কিছুদিন আগেই তিনি এই রক্তপাত বন্ধের জন্য শেষ অনশনটি করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘হিন্দু মুসলিমের সকল সঙ্ঘাতের উৎপত্তি তখনি হয়েছে যখন একজন আরেকজনের উপরে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দিতে চেয়েছে”।
প্রথম থেকেই পূর্বাঞ্চল পাকিস্তান এর কাছ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল। যদিও দেশের ভুভাগের মাত্র ছয় ভাগের এক ভাগ এই অঞ্চল, এর জনসংখ্যা মুল জনসংখ্যার (১৩৬ মিলিয়ন) অর্ধেকের চাইতেও বেশি। প্রথমদিকে দেশটির বৈদেশিক আয়ের ৭০% এরো বেশি আসত পূর্বাঞ্চল থেকে। কিন্তু পাঞ্জাবি আর পাঠানদের আধিপত্যে পশ্চিম পাকিস্তান একাই দুই দশক ধরে এই বৈদেশিক সাহায্যের চার ভাগের তিন ভাগ ও রপ্তানি আয়ের ৬০% ভোগ করে। পূর্ব পাকিস্তানকে একটি বঞ্চিত অবরুদ্ধ চাষের জমির মত ফেলে রাখা হয়। এই গৃহযুদ্ধের পূর্বে পাকিস্তানের সরকারী চাকরির মাত্র ১৫ ভাগ আসনে ছিল বাঙ্গালীরা আর ২৭৫,০০০ সেনা সম্বলিত সেনাবাহিনীতে তাদের সংখ্যা মাত্র ৫%। মাত্র বিশটি মাল্টি মিলিয়নিয়ার পরিবার, যাদের প্রায় সবাইই পশ্চিম পাকিস্তানের, এখনও পাকিস্তানের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্থের সবচাইতে বড় অংশটি (দেশের মোট ইন্ডাস্ট্রির দুই-ত্রিতিয়াংশ ও পাচ ভাগের চার ভাগ ব্যাঙ্কিং ও ইন্সুরেন্স জাতীয় সম্পদ) নিয়ন্ত্রন করে (সুত্রঃ একটি অফিসিয়াল স্টাডি)। সম্পূর্ণ পাকিস্তানে জনপ্রতি আয় অত্যন্ত কম, অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রতি আয় (৳৪৮) পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রতি আয়ের প্রায় দ্বিগুণ (৳৩০)। এই আক্রোশকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে গত নভেম্বরে বঙ্গোপসাগরে হয়ে যাওয়া এক ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস, যা প্রায় ৫০,০০০ মানুষের প্রানহানি ঘটায়। এর আগে পুরবাংশের প্রতি পসচিমের অবজ্ঞা এত প্রকট হয়ে ধরা দেয়নি। ঘটনার প্রায় ১৩ দিন পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দুর্গত অঞ্চল পরিদরশন করেন, যেখানে কিছু পরিদর্শক বলছেন যে আক্রান্ত অঞ্চল্গুলোকে দ্বিতীয় হিরোশিমার মত মনে হয়েছে। পাকিস্তানি নেভি দুর্গত মানুষদের উদ্ধারে একদমি মাথা ঘামায়নি। সবকিছু থাকা স্বত্বেও ত্রাণ বিতরন ব্যবস্থা অবসন্ন ছিল, কেননা বিপুল আকারে খাদ্য ওয়ারহাউসে সংরক্ষিত থাকলেও পাকিস্তানি আর্মি হেলিকপ্টারগুলো হেলিপ্যাডে অলস বসে ছিল।
আত্মত্যাগ
এর তিন সপ্তাহ পর, একটি দেশে পরিনত হবার ২৩ বছর অতিক্রান্ত হবার পরে পাকিস্তানে প্রথম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর লক্ষ্য ছিল একটি সংবিধান অনুসারে সংসদ গঠন করা যারা দেশের জন্য নতুন করে দিকনির্দেশনা দিবে। কিন্তু নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের আধিপত্য জিতে যায়, তারা শেখ মুজিবর রহমানকে ৫১ শতাংস ভোটে নির্বাচনে জয়ী করে, যিনি আওয়ামীলীগ দলের নেতা ও পূর্বাঞ্চলের স্বায়ত্বশাসন এর দাবীর আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন বহুদিন ধরে। বাঙ্গালীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে প্রায় ১০ বছরের ও বেশি জেল খেটেছেন এই মহান নেতা। জাতীয় এসেম্বলির ৩১৩ টি আসনের ১৬৯ টি পূর্ব পাকিস্তানে আর তার মধ্যে ১৬৭টিতেই শেখ মুজিব জয়লাভ করেছেন, যা স্পষ্টতই বিশাল ম্যান্ডেট নিয়ে জয়লাভ। এই জয়লাভের অর্থ এই ছিল যে শেখ মুজিবই হবেন অখন্ড পাকিস্তানের পরবরতী প্রধানমন্ত্রী।
এই জয় কোনভাবেই ইয়াহিয়ার কাম্য ছিলনা। তিনি এবং তার জেনারেলরা অনুমান করেছিলেন শেখ মুজিব কোনভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের ৬০ ভাগের বেশি সিট পাবে না এবং তারপর ক্ষুদ্র পার্টিগুলো একটি জোট গঠন করবে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে, ফলে ক্ষমতা ইসলামাবাদের হাতেই থাকবে। মুজিব কিছুটা বিশ্বাসঘাতকতার আশংকা করেছিলেন। ফলে এক ঘোশনায় তিনি বলেন যে, যদি নির্বাচনে তিনি পরাজিত যা পরবরতীতে মানুষকে প্রচন্ড নাড়া দেয়, পূর্ব পাকিস্তানের জনগন ৭০ এর জলোচ্ছাসে জীবন দেয়া লক্ষ মানুষের দায় বহন করছে যেন তাদের এই দেশের প্রতিটি মানুষকে স্বাধীন নাগরিকে পরিনত করার আত্মত্যাগে পরিনত হয়।
মার্চে সংসদীয় অধিবেশন ও সরকার গঠনের একটি সময় বেধে দিয়ে ইয়াহিয়া গোপনে সেনাবাহিনীর দল পূর্বাঞ্চলে সংগঠিত করতে থাকেন, প্রতিরাতে তারা সাধারন মানুষের বেশে আকাশপথে পূর্বাঞ্চলে এসে সেনাবিহিনির শক্তি বৃদ্ধি করছিল। এরপর উনি অধিবেশন আরো পিছিয়ে দিলেন, কারন হিসেবে বললেন যে মুজিব পুরবাংশে ঠিক কতখানি ক্ষমতা ও স্বায়ত্বশাসন চাচ্ছেন তা নির্ধারিত হবার পূর্বে অধিবেশন সম্ভব নয়। মুজিব যদিও পূর্ণ স্বাধীনতা চাননি, কিন্তু দুইটি স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যের দাবী জানিয়েছেন, যারা রাজ্য সরকারের কাছে কর প্রদান করবে, এবং তাদের বানিজ্য ও বিদেশী মুদ্রা স্থানীয় সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। ইয়াহিয়া এবং তার জেনারেলদের কাছে এটা প্রায় অসম্ভব। ২৫ শে মার্চ ইয়াহিয়া মিটিং ভেস্তে দেন এবং ইসলামাবাদে চলে যান। তার ৫ ঘন্টা পরে সৈন্যরা কামান, ট্যাংক আর রকেট লঞ্চার নিয়ে ঢাকার এক ডজনেরো বেশি অঞ্চলে সাধারন মানুষের উপর ঝাপিয়ে পরে। এর ফলে যুদ্ধ শুরু হয়। ইয়াহিয়া আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করে ও সৈন্যদের নির্দেশ দেন তাদের ‘দায়িত্ব’ পালন করতে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিকদের গ্রেফতার করা হয়, শেখ মুজিবসহ, যিনি এই মুহূর্তে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ থেকে ১২৫ মাইল দক্ষিন-পশ্চিমাংসে অবস্থিত প্রত্যন্ত অঞ্চল সাহিওয়ালে বন্দিদশা ভোগ করছেন বিচারের অপেক্ষায়। এই বিচার অগাস্টে শুরু হতে পারে, এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দাওয়া হতে পারে।
নাগালের বাইরে
যুদ্ধ শুরু হয়েছে অনেক মাস হয়ে গেল, এখনও ইয়াহিয়া বিন্দুমাত্র নমনীয়তা প্রদর্শন করছেন না। বরং, এই প্রলম্বিত যুদ্ধ, যার ফলে ভারতের সাথে যুদ্ধ বেধে যাবার সমুহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, এবং প্রচুর মানুষের জীবনে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে, সে বিষয়ে যেকোন প্রশ্নে তিনি বলিষ্ঠ কন্ঠে কথা বলছেন। ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা বন্ধ করবে কিনা সে বিষয়ে তিনি গত সপ্তাহে হুমকি দিয়ে বলেন- “আমি হয়ত একটি যুদ্ধ ঘোষণা দিতে পারি, এবং আমি সারা পৃথিবীকেই সে বিষয়ে সাবধান করে দিচ্ছি। তিনি আরো হুমকি দিয়ে বলেন, যেসব দেশ প্রতি বছর প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য পাকিস্তানকে দিয়াসছে, তাদের চাপও এক্ষেত্রে কোন কাজে আসবে না। প্রয়োজনে তিনি সাহায্য ছাড়াই এগিয়ে যাবেন। এরি মধ্যে তিনি কিছু সাহায্য খুইয়েছেন। গত মাসে পূর্ব পাকিস্তান পরিদরশনের পর ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক মিশন এর এগার দেশীয় জোটকে সুপারিশ করে যেন তারা একটি রাজনৈতিক সমাধানে পাকিস্তান না আসা পর্যন্ত আর কোন সাহায্য দেশটিকে না দেয়ার জন্য। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা এই রিপোর্টকে সরবসমক্ষে প্রকাশ করছেন না, এই আশংকায় যে তা বিদ্যমান পরিস্থিতিকে আরো বিগ্রে দিতে পারে। রিপোর্টে সাধারন জনগনের নিকট পাকিস্তানি সেনাদের ভিতী আর ধবংসযজ্ঞ, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে সে বিষয়ে বিশদ বর্ণনা দিয়েছে। এতে কুষ্টিয়ার অবস্থা বর্ণিত হয়েছে, যার ৯০% ই ধ্বংস হয়ে গেছে, রিপোর্টে বলা হয়েছে মনে হচ্ছে পাকিস্তানি আরমিরা এখানে ভিয়েত্নামের “মাই লায়” এর মতন ধংশযজ্ঞ চালিয়েছে। একজন মধ্যপদস্থ ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা এ রিপোর্টের কিছু অংশ প্রকাশ করে দেয়, যার কারনে ম্যাকনামারা ইয়হিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তার চিঠিতে তিনি বলেন যে তার মনে হয়েছে প্রতিবেদনটি পক্ষপাতিত্বযুক্ত এবং উত্তেজক।” যদিও একজন ওয়ার্ল্ড ব্যাক কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলছেন যে প্রতিবেদনটিকেই পুনরসংশোধন করা এবং পরিবর্তন করার পরো এর সংবেদনশীলতা কমে যায়নি। তিনি বলেন- “আমাদেরকে শুধু একটু সহমর্মিতা কমিয়ে দিতে হয়েছে, কিন্তু এর প্রভাব একি রকম রয়েছে”।
এবিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বেশ অস্পষ্ট, বলা যায়। নিক্সনের প্রসাশন পাকিস্তানকে সব্রকম সাহায্য বন্ধ করতে নারাজ। ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে হোয়াইট হাউস পাকিস্তানকে ১১৮ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে কংগ্রেসকে, যা বলা হচ্ছে যে মুলতবি করে রাখা হবে। নিজের করমস্থল ও কংগ্রেস থেকে যথেষ্ট চাপ আসা স্বত্বেও নিক্সন বলে যাচ্ছেন যে, সকল সাহায্য বন্ধ করে দেয়া হলে পাকিস্তান চায়নার বেশি বন্ধুবৎসল হয়ে যাবে, যেদেশ তাদের ১৯৬৫ থেকে সামরিক সাহায্যের প্রধান উতস হয়ে যোগান দিয়ে যাচ্ছে এবং এই অবস্থাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দ্যেশ্য সাধনের সকল পথ বন্ধ ধ্বংস করে আসছে। যাই হোক, চায়নাতে কিসিঞ্জারের সফরের বরাত দিয়ে বলা যায়, প্রশাসনের এই নমনীয়তার অন্যকোন কারন ও থাকতে পারে, পাকিস্তান ই হচ্ছে সেই গোপন পথ যার মাধ্যমে কিসিঞ্জার চায়নায় পা রাখবেন।
যাই হোক, সমালোচনা বেরেই যাচ্ছে, বিশেষ করে সিনেট অধিবেশনে। ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট সমর্থকরাও দিন দিন পক্ষ ত্যাগ করছেন। সিনেটর এডওয়ার্ড, এম কেনেডি অভিযোগ করছেন যে স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর সারভে ও ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক রিপোর্ট দুটিই একটি ভয়াবহ অনুপাতে দুর্ভিক্ষের আশংকা করছে, এসময় এধরনের নমনীয়তা যেন রাষ্ট্রীয় নিতীমালার উপহাস করছে। আরো দুই সপ্তাহ আগে, ফরেন এফেয়ারস কমিটি পাকিস্তানের জন্য সকল রকম সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করে। বিলটি একনো হাউস এবং সিনেটে পাশ হয়নি, কিন্তু পাশ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ১৯৫২ সাল থেকে এই বিশালাকার সাহায্য প্রদান চলে আসছে, যার ফলে এখন পর্যন্ত পাকিস্তান প্রায় ৪.৩ বিলিয়ন ডলার অর্থসাহায্য পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। তার উপরে, ১৯৬৫ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সাহায্য ও পরিচালনের ভারও যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে আসছে। তারপর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যবর্তী যুদ্ধের কারনে অস্ত্র বিক্রয় বন্ধ হয়ে যায়। গত অক্টবরে তা আবার চালু হয় এককালীন সাহায্যের ভিত্তিতে। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার পর বলা হয়েছিল যে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা হবে। কিন্তু যখন দেখা গেল অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে তিনটি যুক্তরাষ্ট্রীয় জাহাজ পাকিস্তানের দিকে রওনা হয়েছে, স্টেট ডিপার্টমেন্ট যুক্তি দিল যে সেগুলো যাচ্ছে, কেননা সেগুলোর লাইসেন্স ইতিমধ্যে পাশ হয়ে গিয়েছে এবং চুক্তি ঠিক রাখতেই তারা এ অস্ত্র পাঠাচ্ছে। এত বছরে, বলা যায় প্রায় ১ বিল্লিওন ডলার সাহায্য পাকিস্তান পেয়েছে মিলিটারি খাতে। যুক্তরাষ্ট্রকে হয়ত পাকিস্তান এর বিষয়ে পলিসি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। সম্প্রতি একটি সাক্ষাতকারে প্রাক্তন ফ্রেঞ্চ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আন্দ্রে মালরো সাবধানবানী দেন, তিনি বলেন- যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিনের মধ্যেই একটা বড় সমস্যার সম্মুখীন হবে, আর তার নাম বাংলাদেশ। এটি ভিয়েতনামের মত একটি সমস্যাই হয়ে দাঁড়াবে, ব্যাতিক্রম শুধু এই যে এখানে প্রায় ৭৮০ লক্ষ বাঙ্গালী আছে (পাকিস্তানে)। বাঙ্গালীরা জাতীয়তাবাদী্, মাওবাদী না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে তার শান্তিপূর্ণ আচরনে পরিবর্তন আনতে হবে।
উপেক্ষিত গনহত্যা
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পলিসিকে কেন্দ্র করে ভারত বেশ ক্রোধান্বিত এবং তাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এ মাসে হেন্রি কিসিঞ্জার নিউ দিল্লী সফরকালে জোর গলায় যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করার প্রতিবাদ করেন। তাদের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী শরন সিং গত সপ্তাহেই অভিযোগ করে বলেন যে- “ যেকোন দেশই যদি এখন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে, তার মানে তারা প্রকাশ্যে একটি গনহত্যাকে উপেক্ষা করছে”। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির জন্য একদিকে কঠোরভাবে সেনাবাহিনী দিয়ে আক্রমন চালানোর চাপ, আর অন্যদিকে অর্থনৈতিক চাপ যা তার দেশকে বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে দিতে পারে। হতে পারে যে প্রতিটি রিফিউজির জন্য ভারত প্রতিদিন খরচ করছে ১.১০ রুপি, কিন্তু সেটাই একসাথে যোগ করলে দেখা যায় ভারত একদিনে রিফিউজিদের খাবারের জন্য খরচ করছে প্রায় ১০ লক্ষ ডলার। ভারতীয় কর্মকর্তাদের বার্তা অনুযায়ী, শুধু প্রথম ৬ মাসেই খরচ হয়েছে ৪০০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে একতৃতীয়াংশ খরচ এসেছে বাইরের দেশের সাহায্য থেকে ( যুক্তরাষ্ট্র ৭৩ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে), যদিও বেশির ভাগ সাহায্য এখনও পাঠানো হয়নি। তবুও যেভাবে কিছু অভিজাত ভারতীয় প্রকাশ্যে যুদ্ধের উপদেশ দিচ্ছেন, সেরকম একটি যুদ্ধ এরচাইতে কম ব্যায়বহুল হবে না। ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করার সাথে সাথে পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক আর বাহিনী ভারতের পশ্চিম সীমানার দিকে জড় হবে। তার উপর, এই যুদ্ধ গোটা উপমহাদেশেই ছড়িয়ে পরতে পারে। ভারতীয়দের এই অবস্থানে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তার বক্তব্যে বলেন- ভারত যতই আন্তরিক থাকুক বাংলাদেশ, তার গনতন্ত্র ও তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি, নিউ দিল্লী কোনভাবেই পশ্চিম বঙ্গের আর্থিক খতির ভার নেবেনা। নিউ দিল্লী মনে করছে, এ সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে একটি রাজনৈতিক সমাধান যার ফলে শরণার্থীরা তাদের দেশে ফিরে যেতে পারবে। সবিষয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ পশ্চিম পাকিস্তানকেই দেখাতে হবে। এটি এখনও অনিশ্চিত যে তারা আসলেই এত দূর থেকে একটি প্রলম্বিত যুদ্ধ চালাতে চায় কিনা। এখন পর্যন্ত, পশ্চিমের লোকদের কাছে এ যুদ্ধকে ভুল্ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, বলা হয়েছে এগুলো কেবল কিছু দুস্ক্রিতিকারীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান। কঠোর প্রহরার কারনে কোন বৈদেশিক সংবাদ মাধ্যম সেখানে পৌছুতে পারেনি যুদ্ধের খবর নিয়ে। অবশ্য, যেহারে আহত সৈন্যদের অঙ্গহানি ঘটার পর দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তরুন সৈন্যরা কফিনে বাড়ি ফেরত আসছেন (তালিকাভুক্তদের পুরবেই দাফন করা হয়), তাতে বিরোধীদল প্রতিভাদী জোট বাধতে পারে। অর্থনৈতিক চাপ ইতিমধ্যেই প্রভাব ফেলছে। শিল্পকারাখানাগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ শ্রমিক ছাটাই হচ্ছে, কেননা তারা বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে কাচামাল আমদানী করতে পারছেনা। ইতিমধ্যে, পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যমজুদ আরো কমে যাচ্ছে, অবস্থার কোন উন্নতি ও নেই যাতে বলা যাবে যে শিঘ্রই চাষাবাদ বা আমদানি
শুরু হবে এই গন অনাহারের পরিমাণ কমিয়ে আনতে। সাধারনত অগাস্টে সবচেয়ে বেশি ফসল ঘরে তোলা হয়, কিন্ত এপ্রিলে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একরের পর একর জমিতে কোন আবাদ হয়নি। এখন বৃষ্টিস্নাত রাস্তার পাশে শুধু ক্রিষকের ক্রিশ মুখ আর তাদের শুন্য দৃষ্টি দ্রিশ্যমান। ক্রিশকায় তাদের হাত পা, অপুষ্টিতে আক্রান্ত। লক্ষ লক্ষ বাঙালি গ্রামগুলোতে খাবারের সন্ধানে ঘুরছে। কিছু আক্রান্ত এলাকায় স্তানীয় লোকজনদের খাদ্যের অভাবে গাছের শিকড় বা কুকুরের মাংস খেতে দেখা গেছে। এই অনাহারের হুমকি আরো অনেক মানুষকেই ভারতে যেতে বাধ্য করবে। আগামী কয়েক মাসে অসংখ্য ও লক্ষ লক্ষ লোক অনাহারেই মৃত্যুবরণ করবে, যদি একটি বিশালাকার ত্রাণ কর্মসূচি অবিলম্বে চালু না হয়। তবে এই উদ্যোগ ইয়াহিয়ার সরকারের অরথায়নে করবে না। গত সপ্তাহে তার সরকার যে বাজেট প্রনয়ন করেছে, তাতে প্রতি ১০ ডলারের মধ্যে ৬ ডলার পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। গত ৫ বছরে বাঙ্গালীদের জন্য এটাই সবচাইতে কম বাজেট। ইয়াহিয়া পিকিং এর সাথে বন্ধুত্ব করায় যুক্তরাষ্ট্র কিঞ্চিত রাগান্বিত অবস্থায় আছে, এমতাবস্থায় মনে হয়না তারা এধরনের কোন প্রোগ্রামকে সমর্থন করেছে। এক সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন- “মানুষের দেহ এত ক্ষুদ্র, অথচ তা কত কষ্ট সহ্য করতে পারে”। কিন্তু, সোনার বাংলায় মানুষের এই ক্ষুদ্র দেহ চূর্ণ- বিচূর্ণ করতে কত শক্তি সংগ্রহ করতে হবে?
ইয়াহিয়া খান- একজন আদর্শ সৈনিক
পাকিস্তানের জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান রাওাল্পিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট এর পদ পাওার এক বছর পর বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে প্রেস সম্মেলন করতে সম্মত হন। তিনি যখন লোকে লোকারন্য সেই বসার ঘরটিতে প্রবেশ করেন ১৪ মাস আগে, সাথে সাথেই উচ্চ তাপ বিশিষ্ট টিভি লাইটগুলোর প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেন। একজন টেকনিশিয়ান কাঁপতে কাঁপতে সামনে এসে সেগুলো বন্ধ করে দেয়। তারপর তিনি সাংবাদিকদের ধমকানো শুরু করেন। তার স্বভাবজনিত বিষাদময় চেহারা নিয়ে রাগের সাথে তিনি টেবিল চাপড়ে তাদের বলেন- আমার সাথে রাজনীতির খেলা খেলতে এসনা, কেননা আমি তোমাদের সাথে রাজনীতি নিয়ে খেলব”।
৫৪ বছরের ইয়াহিয়া তার দেশও কম বেশি একি ভাবে চালাচ্ছেন, সেই অধৈর্য, ছলনা, বেসামরিক মানুষের দক্ষতার প্রতি অবমাননা, এবং তারচেও বেশিএই রাজনীতি ক্ষেত্রে তাকে সংযুক্ত করার ক্ষোভ নিয়ে। যখন আইয়ুব খান তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন দুই বছর আগে, শুধুমাত্র তখনি ইয়াহিয়া খাকি পোশাক বাদ দিয়ে কালো রঙের বিজনেস স্যুট পরিধান শুরু করেন, এবং এখনও তিনি তা পরে আছেন অস্বস্তি নিয়ে। সৈনিক ব্যারাকের জীবনের প্রতি তার আসক্তি জানাতে তিনি এখনও সৈন্যদের লাঠি হাতে বহন করেন এবং একজন সাধারন সোজা কথা সৈনিকের ভুমিকা পালন করার কোন সু্যোগ হারিয়ে যেতে দেন না। গত শীতে যখন পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ পৌছাতে বিলম্ব হল, তিনি বললেন- “আমার সরকার ফেরেশতা দিয়ে তৈরি নয়’। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়ে তিনি বলেন- “আমি উত্তরাধিকার সুত্রে অর্থনৈতিক মন্দা পেয়েছি এবং আমি এটাকে কাটিয়ে উঠব’। পূর্ব পাকিস্তানের এই মিশন সম্পর্কে তিনি বলেন- ‘পাকিস্তান বিভক্ত হলে আমি শেষ হয়ে যাব’। জনতার প্রতি দায়িত্ব বিষয়ে বলেন- মানুষ আমাকে ক্ষমতায় বসায়নি, এখানে আমি নিজ যোগ্যতায় বসেছি।”
দুই বছর আগে যখন ইয়াহিয়া খানকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে চিন্তা করা হয়, তখন কেবল কিছু মানুষই তাকে চিনত। এই মোটা ভুরুর পাঠান জওয়ান ১৯৬৬ সাল থেকে আর্মি চিফ অফ স্টাফ পদে আছেন। অন্তত অর্ধ-ডজন উচ্চপদস্থ জেনারেল অস্বস্তি বোধ করেছিলেন যখন আইয়ুব খান পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার কথা বলছিলেন, যেখানে তিনি নিজেই বলেছিলেন যে রাজনীতিবিদদের অবস্থা দেখলে মনে হয় পাচটি বিড়াল একসাথে লেজ বেধে দেয়া হয়েছে। ১৯৬৯ সালে বেতন বৃদ্ধি, শিক্ষা সংস্কার এবং অন্যান্য কারনে ছাত্র আন্দোলন, সংগ্রামের মুখে আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে সরে দাড়াতে বাধ্য হন, সেদিন সেই জেনারেলরা দ্রুত আবারো মার্শাল ল ফিরিয়ে নিয়েসেছিল। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম বক্তব্যে ইয়াহিয়া বলেন যে তিনি আনন্দিত যে দেশ রসাতলে যাওয়ার আগেই তার জওয়ান ভাইয়েরা সামরিক শাসন ফিরিয়ে এনেছে, আসলে জেনারেলদের মুল উৎকণ্ঠা ছিল যে দেশ হয়ত পুরোপুরি সাধারন মানুষের ক্ষমতায় চলে যাবে, যা সেনাদের খমতার জন্য সমুহ বিপদ ডেকে আনবে।
এক মাসের মধ্যে ইয়াহিয়া শিল্প কারখানার বেতন ৩০-২৬% বৃদ্ধি করলেন, যেখানে সেনারা দায়িত্ব ভালভাবে পালন করছিলেন না, সেখানে বেসামরিক মন্ত্রীদের বসালেন, এবং সরকারী দুরনিতী কমানোর উদ্যোগ নিলেন। তার কোনভাবেই আবার বেসামরিক শাসনে ফেরত যাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না, এমনকি তিনি ক্ষমতালিপ্সু ও নন- যদিও পাকিস্তানিদের ভাষায় যে সেনা যত জোরে ঘোড়া দৌড়ায় সে তত ধীরে অবতরন করে। ধিরে ধিরে তিনি একটি নতুন সংবিধান ও নতুন করে ইলেকশন দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করলেন। যদিও, পরে তিনিই বলেছেন যে আমার দেশের কিছু মানুষের এই পরিকল্পনাটা ভাল লাগবেনা, তারা বলবে এসব কি হচ্ছে, এসব করে আরো ঝামেলা হবে।
কিন্তু যাই হোক না কেন, ইয়াহিয়া রাজনীতির হাওয়ার দিক বুঝতে ভুল করেছিলেন। ডিসেম্বরের ইলেকশনে যখন পূর্ব পাকিস্তানের জাদুকরী নেতা শেখ মুজিবর রহমান প্রচুর ব্যবধানে নির্বাচনে বিজয়ী হলেন, তখনি ইয়াহিয়ার উপরে চাপ প্রয়োগ শুরু হল যে তারা আগেই ভেবেছিলেন যে এমনটি হবে। ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, বর্তমান চিফ অফ স্টাফ সহ আরো ছয়জন শীর্ষস্থানীয় জেনারেল এবং টিক্কা খান, একজন অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার খুনি হিসেবে পরিচিত কমান্ডার পূর্বাংশের এই বিশ্বাসঘাতকতা কঠোরভাবে দমন করতে ইয়াহিয়াকে সাহায্য করেছেন। ইয়াহিয়া নিজেকে একজন যোদ্ধা বংশের উত্তরাধিকার হিসেবে দাবী করেন যারা নাদির শাহ এর বিশেষ বাহিনীর অংশ হয়ে যুদ্ধ করেছিল এবং যাদের মাধ্যমে পারসিয়ানরা ১৬শ শতকে প্রথম দিল্লী দখল করে। ইংল্যান্ডে বড় না হলেও, ইয়াহিয়া দেহ্রাদুনে একটি ব্রিটিশদের পরিচালিত মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষিত হয়েছেন আর তাই চালচলনেও তিনি পাক্কা সাহেব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির হয়ে তিনি নর্থ আফ্রিকা ও ইতালিতে যুদ্ধ করেন। দেশ ভাগের পর, উপমহাদেশের অন্যান্য সেরা সৈনিকদের মতই তিনি পাকিস্তানে চলে আসেন (বলা হয়ে থাকে যে ভারত বেশিরভাগ আমাদেরই পেয়েছিল)। শুরু থেকেই আইয়ুব খান ছিলেন তার গুরু, এবং খুব দ্রুতই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। মুসলিম ধর্মের অনুসারী ইয়াহিয়া তার স্ত্রী ফাখ্রা এবং দুই বিবাহিত সন্তানদের সর্বসমক্ষের আড়ালেই রাখেন। সেনাজীবনের বাইরে তার একমাত্র শখ সকল প্রজাতির পাখি নিয়ে। প্রেসিডেন্ট হাউসে তিনি অস্ট্রেলিয়ান তোতা পোষেন, এবং একটি বিশেষভাবে নির্মিত পুলে প্রচুর সারস ও রাজহাঁস বাস করে। তার ঢেউ খেলানো কাচা পাকা ঘন চুল নিয়ে তিনি অত্যন্ত ব্যাতিব্যাস্ত হন, এবং বলেন যে স্যামসনের মত আমারো সকল শক্তি লুকিয়ে আছে আমার চুলে।
পশ্চিমারা যারা ইয়াহিয়াকে চিনেন, তারা প্রত্যেকেই বলেছেন ইয়াহিয়া একজন যুক্তি দ্বারা পরিচালিত মানুষ, কিন্তু অসম্ভব জেদি, গর্বিত এবং নিয়মতান্ত্রিক। দুর্নীতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ হিসেবে তিনি গত বছর সকল জ্যেষ্ঠ্যপদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তাদের তলব করেন এবং সবার সাম্নে তাদের চোরের দল বলে অভিহিত করেন। আমলারা দ্রুতই আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়, যার ফলে ইয়াহিয়া তার অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু বাংগালিদের ক্ষেত্রে তার নমনীয় হওয়ার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছেনা, যাদের তিনি উর্দুতে “মচ্ছর”-মশা বলে সম্বোধন করেন।
একজন পরিচিত আমেরিকান আমাদের বলেন- ইয়াহিয়া কোন নিষ্ঠুর ব্যক্তি নন। তিনি একজন ভালো সৈনিক। কিন্তু তিনি জাতীয়তাবাদের ঘোরে আক্রান্ত এবং প্রায় অন্ধ। তিনি বিশ্বাস করেন যে তার দেশের নিরাপত্তা ও সম্মানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। তিনি লিঙ্কনের মতই পাকিস্তানকে অবিভক্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যদিও তার কোন পদ্ধতির ধার ধারছেন না। পূর্ব বাংলার নীতিসম্মত সায়তবসাশনের দাবী যদি তিনি মেনে নিতেন, তবে হয়ত তিনি সফল হতেন, কিন্তু তার এই কঠোর আক্রমন এটাই নিশ্চিত করছে যে এই দেশ দুইভাগে ভাগ হবেই, যাদের মধ্যে খুব সামান্যই মিল আছে, এবং তা আর কখনই জোড়া লাগবে না।