বোর্ড অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন নিযুক্ত ষ্টাডি গ্রুপ কর্তৃক পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ২য় খণ্ডের ০৪-১২ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ০৪ নং দলিল থেকে বলছি…

শিরোনাম সূত্র তারিখ
বোর্ড অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন নিযুক্ত ষ্টাডি গ্রুপ কর্তৃক পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি সরকারী ৩ ডিসেম্বর, ১৯৫৮

 

গোপনীয়

বোর্ড অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন কর্তৃক নিযুক্ত ষ্টাডি গ্রুপের রিপোর্ট

*             *             *             *             *             *             *     

৩। ডি.আই.বি কর্তৃক প্রণীত বিস্তারিত নোটের আলোকে স্টাডি গ্রুপটি দেশের পরিস্থিতির সার্বিক বিশ্লেষণ করে। তারা দ্রুতই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কারণে জনগণের কল্যাণ বিঘ্নিত হচ্ছে যেগুলো স্বীকার করে নিয়ে মোকাবেলা না করে শুধু প্রচার-প্রচারণা দিয়ে মতামত গ্রহণের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরী হবে না। প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে শুধু সরকারের কার্যক্রম ও সদিচ্ছা সম্পর্কে অবহিত করা যাবে, কিন্তু তা আদতে সাফল্য বয়ে আনবে না। স্টাডি গ্রুপটি আরো মতামত দেয় যে, বিপ্লব বলতে যদি কিছু বুঝায়, সেখানে এমন কিছু একটাই কাম্য ছিল যেখানে ন্যাশনাল গাইডেন্সের জন্য ‘লক্ষ্য’ নির্ধারণ ছাড়াও ন্যাশনাল রিকন্সট্রাকশানের প্রধান প্রধান ‘করণীয়’ নির্ণয়ের পাশাপাশি সেগুলো রক্ষার ‘কর্মপন্থা’ নির্ধারণ করা, যাতে লক্ষ্য সুনির্ধারিত রেখে তা অর্জনের জন্য দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টা চালিয়ে নেওয়া যায়।

 

স্টাডি গ্রুপটি তাদের প্রথম তিনটি বৈঠকে শুধু এসব লক্ষ্য, করণীয় এবং কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা করে এবং জাতীয় পুর্নগঠন বোর্ডের সাথে আলোচনার পর তারা নিন্মোক্ত প্রস্তাবনাসমূহ প্রদান করে:

 

ন্যাশনাল গাইডেন্সের প্রধান লক্ষ্য:

 

৪. নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ ন্যাশনাল গাইডেন্সের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ:

 

ক) জাতি হিসেবে পাকিস্তানের একতার-বুনন শক্ত করা এবং জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করা।

খ) পাকিস্তানের জনগণকে আলোকিত এবং বাস্তবিক চিন্তা-চেতনায় বিকশিত করা এবং তাদের নৈতিক ও নাগরিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ করা।

গ) জনগণকে বিপ্লবের সংজ্ঞা, এর আদর্শ ও অর্জনের ব্যাপারে অবহিত করা এবং বৃহত্তর গঠনমূলক কাজে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করা।

ঘ) আকাশ-কুসুম কল্পনা না করে বাস্তবভিত্তিক প্রত্যাশা এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে যতটুকু পাওয়া যায়, তা গ্রহণের জনমত তৈরি করা।

ঙ) সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া এবং ট্যাটু প্রদর্শনের মত পদক্ষেপ নিয়ে জনমনকে সুস্থ এবং গঠনমূলক খাতে পরিচালিত করা।

চ) অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিকভাবে আগত শত্রুতামূলক কার্যকলাপ, মিথ্যা প্রোপাগান্ডা এবং ক্ষতিকর প্রভাবকে কার্যকরভাবে প্রতিহত করা।

 

জাতীয় পুনর্গঠনের জন্য মুখ্য পদক্ষেপসমূহ

৫। জাতীয় পুর্নগঠনের জন্য মুখ্য করণীয় কার্যসমূহ নিম্নরূপ:

(১) একটি সৎ ও দক্ষ প্রশাসনের জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র ঢেলে সাজানো।

(২) নোংরামিমুক্ত, যৌক্তিক এবং সৎ ব্যবসা পদ্ধতি নিশ্চিত করা।

(৩) স্থিতিশীল এবং শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা।

(৪) সরল ও পরিমিত ব্যয়ের জীবনযাত্রা গড়ে তোলা।

(৫) জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য তাঁদের সুপ্রস্তাবসমূহ পর্যালোচনা এবং প্রচলিত কৌশলসমূহ পুনঃমূল্যায়ন।

(৬) পূর্ব পাকিস্তানের বিশেষ সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা এবং দুই অংশের মধ্যে সমঝোতাকে পৃষ্ঠপোষকতা করা।

(৭) জাতীয় সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের জন্য দেশের বিভিন্ন অংশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষকতা এবং জাতীয় সংস্কৃতি উন্নয়নে সহায়তা করা।

(৮) বিরাজমান বাধাসমূহ অতিক্রম করে জাতীয় জীবনে পাকিস্তানী নারীদের যথাযথ ভূমিকা পালনে সক্ষম করা।

(৯) পাকিস্তানে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাসমূহ সমাধান করা।

(১০) বৈদেশিক উৎস বিশেষ করে ভারত, আফগানিস্তান, ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক, ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক প্রভৃতি দ্বারা দেশের মধ্যে সংঘটিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার ব্যাপারে একটি উপযুক্ত নীতিমালা প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরু করা।

(১১) একটি সুস্থ জাতীয়তাবোধ এবং পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যপূর্ণ জাতি গঠনের জন্য প্রদেশগত বিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা ও আঞ্চলিকতার মূলোৎপাটন।

(১২) উদ্বাস্তু সমস্যার আশু, ন্যায্য এবং চূড়ান্ত সমাধান করা।

(১৩) উপযুক্ত শ্রমনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।

(১৪) কাশ্মীর ও খালের পানি বণ্টন নিয়ে বিরোধের ন্যায্য সমাধান।

(১৫) একীভূত পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য জনসমর্থনপুষ্ট পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্ব অনুধাবন এবং প্রচার করা।

 

৬। উপর্যুক্ত কার্য সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ নিম্নরূপ:

 

(১) ভূমি সংস্কার।

(২) গ্রামীণ জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির পুনর্বাসন।

(৩) উৎপাদক এবং ভোক্তা হিসেবে একজন সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রবিধান নিশ্চিত করা। একদিকে যেমন অবকাঠামো ও অন্যান্য প্রয়োজন, অন্যদিকে তেমনি খাদ্য, বাসস্থান ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন।

(৪) দেশের চাহিদা মোতাবেক শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন।

(৫) বিচার ব্যবস্থার সংস্কার।

(৬) দেশের প্রচার সম্পদের পুনর্গঠন ও শক্তিশালীকরণ।

(৭) পরিবহন ও জন-উপযোগমূলক সেবাসমূহ যৌক্তিকীকরণ এবং জাতীয়করণ।

(৮) নির্বাচিত পণ্যে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য।

(৯) খাদ্যে স্বয়সম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কৃষিখাতে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।

(১০) পরিবর্তিত অবস্থা ও অর্থনীতির কার্যকারিতার জন্য কমিশন নিয়োগ, পুনর্গঠন ও চাকুরির প্রবাহ নিশ্চিতকরণ।

(১১) করাচি হতে অন্য কোন উপযুক্ত স্থানে রাজধানী স্থানান্তর।

(১২) জনবিষ্ফোরণ থামাতে পরিবার পরিকল্পনা প্রণয়ন।

(১৩) ন্যাশনাল গাইডেন্স ও রিকনস্ট্রাকশনের উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্য কৃত কর্মকাণ্ডের সমন্বয়ের জন্য একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠা।

 

উপর্যুক্ত তালিকাভূক্ত বেশিরভাগ প্রস্তাবনাই স্ব-ব্যাখ্যাকৃত এবং তা দীর্ঘায়িত না করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। তালিকার মধ্যে অল্প কিছু প্রস্তাবনা ন্যাশনাল গাইডেন্স এর সাথে সম্পর্কিত যা দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করা হবে।

 

জাতীয় সংহতি

ন্যাশনাল গাইডেন্সের সবচেয়ে জরুরী উদ্দেশ্য হল ‘পাকিস্তানকে সুসংঘবদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করা’। এটাই দেশের জন্য সব চেয়ে বড় সমস্যা। স্টাডি গ্রুপ এসব সমস্যার পিছে অনেক সময় ব্যয় করে নিম্নোক্ত উপসংহারে উপনীত হয়েছেঃ

 

(ক) জাতীয় সংহতি সম্পর্কিত সমস্যা শুধু পাকিস্তানের একার নয়। বেশিরভাগ দেশই তার স্বাভাবিক ইতিহাসের কোন না কোন পর্যায়ে এর সম্মুখীন হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে বেশ কিছু সুসংঘবদ্ধ রাষ্ট্র (যেমন কানাডা) একে একটা শৃঙ্খলার ভিতরে নিয়ে এসেছে। এই ব্যাপারে পাকিস্তানের কিছু বিশেষ সমস্যা রয়েছে। যেমন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগলিক অবস্থান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী বিশাল জনগোষ্ঠী। তবে এর কিছু নির্দিষ্ট ইতিবাচক দিকও আছে এবং গত ১১ বছরে বেশ কয়েকটি বিষয়ে উন্নতি সাধিত হয়েছে।

 

বর্তমান অবস্থা ভালো থেকে অনেক দূরে এবং সংবিধান ও অন্যান্য বিতর্কিত বিষয় সংক্রান্ত প্রশ্নাবলী আবার চালু হবার পরে এগুলো অত্যন্ত দক্ষ হাতে পরিচালিত না হলে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে। পাকিস্তানকে একটি সুসংঘবদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বড় ধরণের উদ্যোগ নিতে হবে। বিষয়গুলো আংশিকভাবে রাজনৈতিক তবে ‘গ্রুপের’ মতে সমস্যা মোকাবিলা করার সুচিন্তিত ও সমন্বিত পদক্ষেপ না নেয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কিছুটা সাফল্য অর্জিত হয়েছে। সমস্যা মোকাবিলা ও সমাধানের সুপরিকল্পিত ও টেকসই কোন পন্থা বের করা ছাড়া অনেক ফাঁকা বুলি আওড়ানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এই ‘গ্রুপ’ পাকিস্তান সরকারের অধীন এমন কোন সংস্থার সাথে পরিচিত নয় যারা এই বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে এবং প্রত্যেকটা পদক্ষেপ হিসেব করে নেয় যেটা অন্যান্য দেশ যেমন ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা, ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক এবং সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়ামের মতো দ্বিভাষিক বা ত্রিভাষিক রাষ্ট্রে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নানা উপাদানকে একত্রিত করে সমন্বয়পূর্ণ সমষ্টিতে রূপান্তর করতে ব্যবহৃত হয়েছিল।

 

খ) গ্রুপটি মনে করে পাকিস্তানকে সুসংঘবদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে সরকারের সকল স্তরে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকা দরকার। কেন্দ্রিয় সরকারের তিনটি মন্ত্রণালয় যথা স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা এবং তথ্য ও সম্প্রচারের প্রধান দায়িত্বগুলোর একটি হিসেবে এটি থাকা উচিৎ এবং এটি অর্জনের জন্য তাঁদের সুবিন্যস্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

 

গ) গ্রুপটি আরও সুপারিশ করেছে যে, অনতিবিলম্বে কানাডিয় নাগরিকত্ব বিভাগের মতো একটি সংস্থা তৈরি করতে যাদের কাজ ছিল “কানাডার জাতিগত, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগতভাবে পৃথক গোষ্ঠীসমূহকে একত্র করে একটি সংহতিপূর্ণ কানাডা রাষ্ট্র তৈরি করা।” এই সংস্থা মনস্তাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও অন্যান্য সমস্যাগুলো নিয়ে গবেষণা করবে যেগুলো পাকিস্তানে সংহতি আনয়নে সাহায্য করবে। এটি অঞ্চলভিত্তিক সংস্কৃতি এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গোষ্ঠীসমূহের আচার-ব্যবহার এবং আন্তঃগোষ্ঠী ও এলাকাভিত্তিক সমস্যা ও সমাধানের উপায় নিয়ে কাজ করবে। এই সংস্থাকে মনোবিজ্ঞানসহ অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই অত্যন্ত সাবধানতার সাথে বিশেষজ্ঞ নির্বাচন করতে হবে এবং তাঁদের সিদ্ধান্তই পরবর্তী সময়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কাজের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হবে। ‘গ্রুপটি’ মনে করে নব্য-সংঘটিত পুনর্গঠন ব্যুরো কাজের ব্যাপারে বিশ্বস্ত হবে এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল বাস্তবায়নের কাজে বিদ্যমান সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করবে।

 

ঘ) জাতীয় সংহতি চারিত্রিকভাবে আংশিক মনস্তাত্ত্বিক ও আবেগতাড়িত। তবে এটা আন্তঃনির্ভরশীলতা ও পরিপূরক অর্থনীতির অনুভূতি উন্নতকরণের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যবহৃত হবে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ এর জন্য যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারে।

 

সাংস্কৃতিক বিষয়াদি

সাংস্কৃতিক বিষয়াদির সাথে জাতীয় সংহতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জড়িত। এটি একটি সূক্ষ্ম ও জটিল বিষয় যা নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতা, উদার মানসিকতা এবং বিচারবুদ্ধি সহকারে আগানো উচিত। একটা বিষয় হলো, আমাদের সমাজে এরকম গোঁড়া ও ধর্মান্ধ মানুষের অভাব নেই যারা কোন না কোন অজুহাতে সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেই বাঁধা দিতে চায়। আবার জাতীয় সংস্কৃতিক বিবর্তনের নামে স্থানীয় সংস্কৃতিকে নিরুৎসাহিত করা ও জনগণের নিজস্ব মত প্রকাশের প্রচলিত ধারাকে এড়িয়ে যাওয়াও হতে পারে। এই দুই ধরণের প্রলোভনকেই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যেতে হবে। মুক্তির মানে হওয়া উচিত আত্মার সন্তুষ্টি; হতাশা নয়। এছাড়া পাকিস্তান এমন কিছু এলাকা নিয়ে গঠিত যাদের সাথে দেশ ভাগের সময় শুধু যে বস্তুগত  অমিল ছিল তা নয়, বরং তারা ছিল অপেক্ষাকৃত অপরিচিত এবং তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির ব্যাপারে তেমন কোন অনুসন্ধান করা হয় নি। অতএব, যদি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও ইতিহাস সংক্রান্ত অনুসন্ধানকে যদি উৎসাহিত না করা হয়, তাহলে ঐসকল অঞ্চলের মানবিক দিকগুলো অজানাই থেকে যাবে। প্রত্যেক গোষ্ঠী সম্পর্কে অনুসন্ধান এবং ধারণা না থাকলে জাতীয় ঐক্য সম্ভব নয়। সুতরাং বিভিন্ন অঞ্চলের চিরাচরিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এবং উদার মানসিকতা, শ্রদ্ধা ও বিচারবুদ্ধির সাথে অঞ্চলভিত্তিক অমিলগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।

 

অন্যদিকে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে জাতীয় সংস্কৃতির উন্নয়নে সহায়তার দায়িত্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এড়িয়ে যেতে পারবে না। এই দায়িত্ব এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা আঞ্চলিক সংস্কৃতির অতীতের অনুসন্ধানসমূহ বেশিরভাগ সময়েই অমুসলিমদের দ্বারা করানো হয়েছিল, যাঁরা দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে একসূত্রে সম্মিলনকারী ইসলামী এবং অন্যান্য সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোকে নির্ণয় এবং মূল্যায়ন করার জন্য খুব একটা প্রস্তুত ছিলেন না। এমনকি এ ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে উদার মানসিকতা থাকার পরেও। এ সমস্যা আরও বেড়ে যাচ্ছে। কেননা কিছু কিছু এলাকায় বৈদেশিক সরকার এবং সংস্থা, যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের পশতুভাষী অঞ্চলে আফগানিস্তান রাষ্ট্র এবং পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলে কলকাতার সংস্থাসমূহ নানাভাবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে, যা জাতির জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবেই।

 

এমতাবস্থায়, সীমান্তের বাইরে থেকে উস্কানি ও সহায়তা পেয়ে অথবা না পেয়ে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিনষ্ট করতে উদ্যত শক্তিসমূহকে প্রতিহত না করাটা হবে পাকিস্তান সরকারের দায়িত্বে চরম ব্যর্থতা। সরকার যেসব ব্যাপারে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে সেগুলো আগেই বলা হয়েছে। শিক্ষা, তথ্য ও সম্প্রপ্রচার মন্ত্রণালয়কে তাদের দায়িত্ব স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে হবে এবং প্রতিটা পদক্ষেপে সফল হবার জন্য সতর্কভাবে এগুতে হবে। তাদের উচিত পাকিস্তানের সকল অঞ্চলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করা এবং ঐতিহ্যগত ও আঞ্চলিক সংস্কৃতির প্রসারে কাজ করা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক প্রবণতা নিয়ে অনুসন্ধান এবং সেই প্রবণতাগুলোকে আবিস্কার ও প্রতিপালন করার ব্যাপারে তাদেরকে দায়বদ্ধ করতে হবে যা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় সংস্কৃতি গঠনে অবদান রাখবে।

এজন্য যা যা দরকার-

১। জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস নতুন করে সাজানো

২। দেশীয় সাহিত্য ও লোকগীতি সংগ্রহ

৩। স্থানীয় হস্ত ও কারুশিল্পকে উৎসাহ প্রদান

৪। জাতীয় মতাদর্শ অনুযায়ী নাচ, গান ও নাটক প্রচার

 

গ্রুপটি খেয়াল করেছে যে, দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে হিন্দু ও ভারতীয়দের দ্বারা শক্তভাবে প্রভাবিত নাচ পরিবেশিত হয়। এছাড়া অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনে ভারতীয় কূটনৈতিক ও তাঁদের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী লোকজনের গমনাগমন ঘটার পাশাপাশি নানা ধরণের সাহায্যও আসে। বৈদেশিক মিশনের এসব কাজ সামষ্টিকভাবে আলাদা ব্যাপার হলেও যেহেতু তা সাংস্কৃতিক আদর্শের সাথে জড়িত, তাই এর যথাযথ সমাধান শুধু পাকিস্তানি স্কুল অব ড্যান্সিং স্থাপনের মাধ্যমেই করা সম্ভব। প্রয়াত বুলবুল চৌধুরি এটা নিয়ে কাজ করছিলেন, কিন্তু তার নামধারী একাডেমিও এই কাজের ধারা অব্যাহত রাখে নি। পাকিস্তানি নাচের বিবর্তনমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রতি দ্রুত ও যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

*                  *                  *                  *                  *                  *                  *

পূর্ব পাকিস্তান

পূর্ব পাকিস্তানের বিশেষ সমস্যাসমূহ আমলে নিয়ে সমাধানের জন্য সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলো নিয়ে গ্রুপটি সন্তুষ্ট নয়। কর্মবণ্টনের মাধ্যমে এর সমাধান না করলে পাকিস্তানের ঐক্য হুমকির মুখে পড়বে। সমস্যাগুলো নিয়ে গবেষণার জন্য গ্রুপটি অনেক সময় ব্যয় করেছে এবং ঢাকা সফর করে বেশ কয়েকজন প্রতিনিধিত্বশীল ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী ও বেশ কিছু কর্মকর্তাসহ সাধারণ জনগণের মধ্যে ধারণা রয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রিয় সরকারের নিকট হতে ন্যায্য অধিকার পাচ্ছে না। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ও তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও তাঁদের ভুল ধারণা রয়েছে। যদিও অতীতে কিছু ভুল হয়েছে এবং এখনও অনেক কিছুই করা বাকি, তারপরেও দলটি মনে করে যে কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী (প্রধানত রাজনীতিবিদ, সরকারী কর্মচারি এবং ব্যবসায়ী) এই অবস্থাকে উসকে দিয়েছে। সকল ব্যর্থতার জন্য কেন্দ্রিয় সরকারকে অভিযুক্ত করা এখন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতাসীনসহ অন্যান্য রাজনীতিবিদরা এই অবস্থার জন্য দায়ী। অনেক সময় পেড়িয়ে গেলেও সুপরিকল্পিত ও টেকসই উপায়ে এখনও সমাধান সম্ভব। কিন্তু ঢিমেতালে আগালে পারিস্থিতি আরও খারাপ হবে এবং তখন সমাধান খুঁজে পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

 

২। পূর্ব পাকিস্তানে মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকসহ অনেক সমস্যা থাকলেও ‘গ্রুপটির মতে’ প্রধান দু’টি সমস্যা হল মনস্তাত্বিক ও অর্থনৈতিক। কমপক্ষে দুই শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলটি এতটাই নিগৃহীত হয়েছে যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় এর সাধারণ উন্নয়ন খুবই সীমিত। এছাড়া এখানে জীবনযাত্রার মান খুবই অনুন্নত যা জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। বেকারত্বের হার খুবই বেশী, বিশেষ করে শিক্ষিতদের মধ্যে। এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কম খরচে শিক্ষার তুলনায় শিল্পোন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির অভাবে এই অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। এই অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য বড় ধরণের পদক্ষেপ নিতে হবে বলে গ্রুপটির শক্তভাবে সুপারিশ করছে। অর্থনৈতিক খাতে পূর্ব পাকিস্তানের সকল বাস্তব দুর্দশা প্রশমিত করতে হবে। সাধারণ জনগণের উন্নতি এবং তাঁরা যে হতাশাজনক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তা অনুসন্ধান ও প্রশমনের জন্য সকল ধরণের কৌশল যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে। এই কাজে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে যাতে কয়েক মাসের মধ্যেই জনগণ নতুন সরকারের কর্মোদীপ্তি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারে। নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা সুপারিশ করা এই ‘গ্রুপের’ কাজ নয়। এটি যা সুপারিশ করতে পারে তা হল, এমন সব পরিকল্পনাকেই গুরুত্ব দেয়া উচিৎ যেগুলো সাধারণ জনগণের অধিকাংশের উপকারে আসার নিশ্চয়তা দেবে এবং কম সময়ে ও কম কারিগরি জ্ঞানের সাহায্যেও বাস্তবায়নযোগ্য হবে। এমন অনেক অভিনব পন্থার কথা আমরা শুনেছি যার পিছনে অতীতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে এবং বিশেষজ্ঞদের মতে লাভ এসেছে খুবই সামান্য। অন্যদিকে, জনসাধারণের আশু পর্যাপ্ত ঋণসুবিধা প্রয়োজন, যা তাঁদেরকে কার্যকরী পুঁজির যোগান দেবে; দরকার কৃষি এবং কুটিরশিল্পের উন্নয়নের পদক্ষেপ, যা তাঁদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয়। এগুলোর অনেক সুযোগ রয়েছে অথচ এগুলোর প্রতি যথেষ্ট দৃষ্টি দেয়া হয় নি। এসব ক্ষেত্রের জন্য উপযোগী কর্মপরিকল্পনাগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া উচিৎ।

 

‘গ্রুপটি’ অর্থনৈতিক সমস্যার দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়ার কথা বললেও, একই সাথে এটাও অনুভব করে যে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক। একারণে প্রতিটি সমস্যার অর্থনৈতিক দিকগুলি মোকাবিলা করার সাথে সাথে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলির প্রতিও যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। জনপ্রচারণার প্রচেষ্টা আরও বাড়াতে হবে। সরকারের কর্মসূচি, সফলতাসমূহ এবং সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবন্ধকতাসমূহ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি গোপন উদ্দেশ্যে গোলমাল সৃষ্টিকারী এবং ঘৃণামূলক উস্কানিদাতা ব্যক্তিদের মুখোশ উন্মোচন করে কঠোরভাবে দমন করতে হবে।…

 

অন্যদিকে প্রশাসনে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিতে হবে যা তাকে দক্ষ করে তুলবে। দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত এবং নিজ কর্তব্যে সচেতন সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ অনেক বড় কিছু করতে সক্ষম। পাল্টাপাল্টি অভিযোগ বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি তো করেই না, বরং আরও কঠিন করে তোলে। প্রাদেশিক উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত এবং আগেই তালিকাভুক্ত বিষয়গুলো মধ্যে অনেকগুলোই কেন্দ্রিয় সরকারের সহায়তা ছাড়াই প্রাদেশিক সরকার নিজ উদ্যোগে উন্নত বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় বাস্তবায়ন করতে পারতো।

 

পুরাতন সংবিধানের অনুবিধি অনুযায়ী জাতীয় সংসদের কমপক্ষে দুইটি অধিবেশন পূর্ব পাকিস্তানে হবার ব্যবস্থা ছিল। রাষ্ট্রপতির মন্ত্রিসভা অন্তত ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে পূর্বপাকিস্তানে বৈঠক করলে তা জনগণের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে ও কুচক্রী মহলকে নিষ্ক্রিয় করতে অনেক সাহায্য করবে। এছাড়া জনমনে এমন একটা ধারণা রয়েছে, যেসব মন্ত্রীদের নিবাস পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁরা তাদের নিজ নিজ প্রদেশের ভেতরেই যাতায়াত সীমিত রাখেন। একই কথা বলা যায় কেন্দ্রিয় সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও। রাষ্ট্রের দুই অংশের দিকেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে।

 

মূখ্য সচিবের মতে, পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের মতো একইভাবে পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসকেও কেন্দ্রিভূত করা উচিৎ। এটি প্রশাসনিক কার্যাবলীর প্রমিতকরণে ও পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। কিছু প্রায়োগিক সমস্যা থাকলেও এই প্রস্তাব কতটা প্রয়োগ করা যাবে, তা নিয়ে পরীক্ষা করা উচিৎ। জুতসইভাবে এর প্রয়োগ জাতীয় সংশক্তি বাড়াবে এবং ‘গ্রুপটি’ অতিসত্ত্বর উপযুক্ত উপায়ে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের পক্ষে জোর দিচ্ছে।

 

সিএসপি অফিসারদের আন্তঃঅঞ্চল বদলির পদক্ষেপটা নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনা মতো কাজ করে নি। যদি চাকুরিকালের শর্তাবলি আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হতো এবং বাসস্থান, আসবাব প্রভৃতির যথাযথ সহায়তা প্রদান করা হতো, তাহলে বাঁধাটা অনেকাংশেই কমে যেত। উদাহরণস্বরূপ সামরিক বাহিনীর দিকে দেখা যেতে পারে।

 

পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব ও জনপ্রশাসন বিভাগের পরিচালকের সাথে ‘গ্রুপটির’ একটি ফলপ্রসু আলোচনা হয়েছে। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটি জানতে পেরেছে, পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক শিক্ষার উপরে অনেক গুরুত্ব দেয়া হলেও মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যপারে সেরকম কিছু করা হয় নি। প্রায় ১৪০০ উচ্চ বিদ্যালয়ের মধ্যে সরকার মাত্র ৩৭টি পরিচালনা করে এবং অন্যান্যগুলোকে সহায়তার জন্য খুবই কম ব্যয় করে। আমাদের মতে গুরুত্ব দেয়ার এই নীতি পুরোটাই ভুল। প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যাটি এতোই বড় যে বিশাল অংকের আর্থিক বিনিয়োগ ছাড়া কেন্দ্রিয় বা প্রাদেশিক সরকার, কারো পক্ষেই এর সমাধান করা সম্ভব না এবং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসু কাজের দিকে মনোযোগ দেয়াই বেশী প্রয়োজন। ‘গ্রুপটি’ মনে করে প্রদেশে শিক্ষা, প্রশাসন ও ব্যবসার মান তখনই বাড়বে, যখন মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে ব্যবসা, শিল্প, জীবিকা, সরকারী চাকুরি প্রভৃতি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব সৃষ্টি করা যাবে। ‘গ্রুপটি’ পর্যাপ্ত সরকারী বিদ্যালয় চালু করার সুপারিশ করছে। একই সময়ে প্রাদেশিক সদর দপ্তর ঢাকা ও ব্যস্ত শহরজীবন থেকে দূরে মানানসই কোথাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাবটিকে পুনরায় সক্রিয় ও যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা দরকার।

 

‘গ্রুপটিকে’ জানানো হয়েছিল যে, ভারতীয় এবং অন্যান্য যারা কাগজপত্রে পাকিস্তানের অধিবাসী হলেও মন ও পরিবারের সবকিছুই পশ্চিম বাংলায়, তাদের একটা বড় অংশ এখন আর বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর নীতি নির্ধারণের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করছে না। কিন্তু এটা এখনও একটা চিন্তার বিষয় এবং ধ্বংসের কারণ হতে পারে। ডিপিআই কর্মচারি ছাঁটাই এর ইঙ্গিত করেছিল। এটা একটি ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব কিন্তু সেরকম কিছু হবে না,কারণ যে প্রতিষ্ঠান যুবকদের গড়ে তুলছে, জনগণের মতের উপরে প্রভাব ফেলছে এবং যেটা কোন না কোন ভাবে সরকার থেকে সাহায্য পাচ্ছে, সেখানে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যে গাফেল এরকম কাউকে কোন গুরুত্বপুর্ন পদে থাকতে দেয়া হবে না। এটা শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এমন না, যেকোনো সরকারী সংস্থা বা সাংস্কৃতিক দলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

 

বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের হতাশার অন্যতম কারণ হচ্ছে, তাঁদের কর্মকাণ্ড প্রকাশ করার কোন ধরণের সুযোগ সুবিধা নেই এবং তাঁরা রাষ্ট্রের নিকট হতে কোন ধরণের সাহায্য পাচ্ছেন না। সত্যিকার অর্থে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রকাশনা ব্যবস্থা এতটাই অপর্যাপ্ত যে এখনও পশ্চিম বাংলার বইগুলো বাজারে আধিপত্য ধরে রেখেছে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং গ্রন্থ প্রকাশনাসহ বিবিধ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বড় ধরণের প্রণোদনা প্রদান করা জরুরি।

 

পূর্ব পাকিস্তানে প্রচার ব্যবস্থা জোরদার করা এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দ্বারা ঐক্য তহবিল পরিচালিত হওয়া উচিৎ।

 

জাতীয় নির্দেশনা ও পুনর্গঠনের মাধ্যম

জাতীয় নির্দেশনা ও পুনর্গঠনের জন্য অনেকগুলো প্রচারমাধ্যম আছে। কিন্তু জনমত প্রভাবিত করতে যেসব সংস্থা কাজ করে থাকে তাদের মধ্যে শিক্ষা এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় প্রধান।

       সর্বশেষ বিশ্লেষণ অনুযায়ী, নীতি নির্দেশনা রাষ্ট্রপতির নিকট হতেই আসবে। তবে তাঁর সার্বিক বিবেচনায়, জাতীয় নির্দেশনা ও পুনর্গঠনের নীতি এবং কৌশল গ্রহণের দায়িত্ব জাতীয় পুনর্গঠন বোর্ডের উপরে ন্যস্ত। শুধু কিছু বিশেষ উপাদানের জন্যেই নয়, বরং বোর্ডের সামনে সামগ্রিক অবস্থা ও প্রস্তাব পরিবেশনের জন্যেও নব্য প্রতিষ্ঠিত পুনর্গঠন ব্যুরো একটি প্রয়োজনীয় সংস্থা বটে।

        এই ব্যবস্থাগুলো সার্বিক দিক নির্দেশনা ও গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বলে মনে হলেও জাতীয় পুনর্গঠন বোর্ডের নীতি বাস্তবায়নের জন্য কৌশলগত দিকসমূহকেও শক্তিশালীকরণ করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যেসব দিকগুলো জোরদার করতে হবে, সেগুলো এই রিপোর্টে নির্দেশ করা হয়েছে। দেশে প্রচার জোরদারের লক্ষ্যে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ও বিস্তারিত প্রস্তাবনা তৈরি করেছে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামনে তা তুলে ধরছে।
        

          ১৯৫৮ সালের ৩ ডিসেম্বর গ্রুপটির সভার মাধ্যমে এই রিপোর্টটি অনুমোদিত হয়।

Scroll to Top