স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েমের আহ্বান জানিয়ে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন

<2.145.618-620>

স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েমের আহবান জানিয়ে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন
তারিখ- ৮ জানুয়ারী ১৯৭১
সূত্র- পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন।

জাতিয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, একটি স্ফূলিঙ্গকে দাবানলে রূপ দিন, স্বাধীন গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ নিরপেক্ষ প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন।

৮ জানুয়ারী ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের তৃতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকৌ উপলক্ষে কমরেড সিরাজ সিকদার কর্তৃক পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল সমর্থক ও বিপ্লবী জনগণ এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত আহবান।

পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন মার্কসবাদ-লেলিনবাদ-মাওসেতুং চিন্তাধারায় সার্বজনীন সত্যকে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনে প্রয়োগের মূল্যবান অভিজ্ঞতা নিয়ে পূর্ব বাংলা ও বিশ্বের প্রতি দৃষ্টি প্রসারিত রেখে দৃঢ় পদক্ষেপে প্রতিষ্ঠার ৪র্থ বর্ষে পদার্পন করছে।

এই তিন বৎসর পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা আত্মবলিদান ও কঠোর সংগ্রাম দ্বারা আনন্দ ও বেদনার মহা উপাখ্যানের সৃষ্টি করেছে এবং পূর্ব বাংলার বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাসে মহান গৌরবময় অধ্যায়ের সংযোজন করেছে।

সভাপতি মাওয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণী ও বিপ্লবীদের সংশোধনবাদবিরোধী সংগ্রামের প্রভাবে পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত; এ পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অকৃত্রিম সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং পূর্ব বাংলার শ্রমিক শ্রেনীর সঠিক রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করে।

পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার মুহুর্তে থেকেই পার্টির অভ্যন্তরে ও বাইরে বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদ ও খুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও প্রকাশের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম পরিচালনা করেছে এবং বিপ্লবী অনুশীলনের প্রক্রিয়ার প্রণয়ন করেছে। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জাতিয় মুক্তির সঠিক রাজনৈতিক লাইন, দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের বর্তমান পর্যায়ে জাতিয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ সূচনার সঠিক সামরিক লাইন এবং গোপনভাবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ভিত্তিতে সংগঠন গড়ে তোলার সঠিক সাংগঠনিক লাইন।

পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা মার্কসবাদ-লেলিনবাদ-মাওসেতুং চিন্তাধারা অধ্যায়ন ও প্রয়োগ, কৃষক শ্রমিকের সাথে একীভূত হওয়া এবং বিপ্লবী ঝড় তরঙ্গে পোড় খেয়ে অধিকতর পরিপক্ক হয়েছেন এবং অধিকতর দক্ষতার সাথে বিপ্লবীকার্য পরিচালনা করেছেন।

পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিপ্লবী অনুশীলনের এই তিন বৎসর সশস্ত্র সংগ্রাম সূচনা ও পরিচালনা করার অাত্মগত প্রস্তুতির সৃষ্টি করেছেন। এর ফলশ্রুতি হিসেবে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের গেরিলারা সাফল্যজনকভাবে পাকিস্তান কাউন্সিল কেন্দ্র, অফিস ও মার্কিন তথ্য কেন্দ্রে কমান্ডো হামলা পরিচালনা করে এবং পূর্ব বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে সশস্ত্র প্রতিরোধের সূচনা করে।

পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সামরিক শাসকগোষ্ঠি ‘একটি পাতা নড়ার শব্দেই আৎকে উঠে’ এবং পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার জন্য পাগলা কুকুরের মতো হন্য হয়ে উঠে। তাদের এ জঘন্য প্রচেষ্টায় শামিল হয় পূর্ব বাংলার বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী দালালরা এবং পূর্ব বাংলার দক্ষিণপন্থী ও আকৃতিগতভাবে বামপন্থী কিন্তু স্বতস্ফূর্তভাবে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলরা।

পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠি পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনে কার্যরত পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তাদের অনেককে গ্রেফতার করেছে, আরো অনেকের বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছে গ্রেপ্তারী পুরুস্কার।

পূর্ব বাংলার জনগণের রক্তের রক্ত, মাংসের মাংস পূর্ব বাংলার এ সকল শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা আজ কারার অন্তরালে অশেষ নির্যাতন ও কষ্টে ভুগছেন। তাদের কথা মনে পড়ে আমাদের হৃদয় বেদনায় ভরে উঠে। চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে।

পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা বেদনাকে শত্রুর প্রতি তীব্র ঘৃণায় এবং অশ্রুকে শত্রু ধ্বংসের বজ্রকঠিন শপথে রুপান্তরিত করে নিজেদের শক্তিকে সুসংঘবদ্ধ ও পুনর্গঠিত করে বিপ্লবী কাজ দ্বিগুণভাবে জোরদার করে এবং সশস্ত্র সংগ্রামকে গ্রাম্য এলাকায় সম্প্রসারিত করে।

পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের গেরিলারা সাফল্যজনকভাবে পূর্ব বাংলার বুকে সর্বপ্রথম সূর্যসেনের দেশ চট্টলায় এবং সন্ন্যাস বিদ্রোহের দেশ ময়মনসিংহে জাতিয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধের সূচনা করেছে এবং বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে।

১৯৭০ সালে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন তার বিকাশের সশস্ত্র সংগ্রামের ঐতিহাসিক স্তরে প্রবেশ করেছে।

পাকিস্তানী অবাঙ্গালি শাসকগোষ্ঠির সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের দ্বন্দ প্রতিদিনই তীব্রতর হচ্ছে। স্মরণাতীতকালের প্রচন্ডতম ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসের তান্ডবলীলায় লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ বলিদান প্রমাণ করেছে পূর্ব বাংলার পরাধিনতার চরিত্রকে। পাকিস্তানের উপনিবেশিক সামরিক শাসকগোষ্ঠি পূর্ব বাংলার জনগণের জাতিয় স্বাধীনতা, মুক্তি ও বিচ্ছিন্নতার সংগ্রামকে নিয়মতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের কানাগলিপথে পরিচালনার ষড়যন্ত্র করছে এবং এই উদ্দেশ্যে সামরিক শাসনের ছত্রছায়ায় এবং আইনগত কাঠামোর আওতায় নির্বাচন করেছে।

আওয়ামী লীগ জনতাকে এর বিরুদ্ধে পরিচালিত না করে এই ষড়যন্ত্রে হাত মিলিয়েছে এবং পূর্ব বাংলার উপরস্থ শোষণ নিপীড়ন সমাধানের জন্য শান্তিপূর্ণ ও সংস্কারবাদী পথ এবং গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কথা বলছে।

পাকিস্তানের অবাঙ্গালি শাসকগোষ্ঠির ক্ষমতার প্রধান উপাদান হলো সামরিক বাহিনী। পূর্ব বাংলার জনগণের কোনো উপকারই করা সম্ভব নয় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার ভূমিকা গণবিরোধী এই সশস্ত্র বাহিনীকে পরাজিত ও ধ্বংস করা ব্যতিত। শান্তিপূর্ণ, নিয়মতান্ত্রিক, সংস্কারবাদী সকল প্রচেষ্টার পরিণতি হলো আপোষ ও আঁতাত এবং জনগণের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। কাজেই আওয়ামী লীগের সামনে সশস্ত্র সংগ্রাম ও আপোষের দুটি পথ খোলা রয়েছে। আওয়ামী লীগের শ্রেনীভিত্তি প্রমাণ করে শেষোক্ত পথ অনুসরণ করেছে যার পরিণতি হলো জনগনের স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।

আওয়ামী লীগ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়করণ করে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চায়। সর্বহারার রাজনৈতিক পার্টি ও তার মাধ্যমে পরিচালিত সর্বহারার একনায়কত্ব ব্যতিত অন্য সকল প্রকার সমাজতন্ত্রের সারবস্তু হলো রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। ইহা জনগণের পরিবর্তে দুর্নীতিপরায়ণ আমলা-ম্যানেজার প্রভৃতিদের স্বার্থ রক্ষা করে। এর পরিণতি হলো লোকসানের প্রতিষ্ঠান ইপিআরটিসি বা ইপিআইডিসি এবং অন্যান্য সহকারী সংস্থা।

তথাকথিত মুক্ত পৃথিবীর প্রধান মোড়ল মার্কিন সম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের কমিউনিজম প্রতিহত করার ইহা একটি নতুন কৌশল। বার্মার নে-উইন, সিঙ্গাপুরের লি-কান-উয়ে, ভারতের ইন্দিরা গান্ধি নিজস্ব পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র গঠনের মাধ্যমে পুরনো শোষণকে নতুন শোষণরূপে তীব্রতর করছে এবং কমিউনিস্ট ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কমিউনিজম প্রতিহত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম প্রচন্ড রোষে ফেটে পড়ছে।

শেখ মুজিব সমাজতন্ত্র ও শোষণের অবসানের কথা বলে মার্কিন সম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠি ও প্রতিক্রিয়াশীলদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে পূর্ব বাংলার কৃষক শ্রমিক জনতা ও তাদের নেতৃত্বকর “জ্যান্ত কবরস্থ” করা এবং পূর্ব বাংলার চিয়াংকাইশেক, নে-উইন, ইন্দিরা, লি-কান-উইয়ের ভূমিকা পালন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সামরিক শাসকগোষ্ঠি একারণেই তাদেরকে কিছুটা সুবিধা প্রধান করে পূর্ব বাংলার বিপ্লবীদের পরিচালিত পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙ্গালিদের দ্বারা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে।

ইতিহাস সকল ভীতি ভাঁড় ও ভাওতাবাজদের আগে হোক পরে হোক চুড়ান্তভাবে কবরস্থ করবেই। পূর্ব বাংলার বিপ্লবী জনতার পরিচালিত ইতিহাসের চাকা শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে উচ্চ শিখরে উত্তোলিত করেছে। ইহা নিজস্ব গতিপথে অনিবার্যভাবেই তাদেরকে গুঁড়িয়ে চূর্ণবিচূর্ণ করে চুড়ান্তভাবে কবরস্থ করবে।

আমরা অবশ্যই এই সত্য প্রতিনিয়ত জনতার সামনে তুলে ধরবো এবং বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে উঠতি বুর্জোয়াদের মোহগ্রস্থ জনগণকে আমাদের পিছনে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা জোরদার করবো। এ উদ্দেশ্যে আমরা গ্রাম্য এলাকায় কৃষকদের জাতিয় শত্রু খতম অভিযান জোরদার করবো। এভাবে পূর্ব বাংলাকে ৮০ ভাগ জনতার নেতৃত্ব অর্জনের মাধ্যমে শহরে বুদ্ধিজীবি, শ্রমিক ও জাতিয় বুর্জোয়াদের নেতৃত্ব অর্জন করতে আমরা সক্ষম হবো।

বর্তমান আন্তর্জাতিক অবস্থা বিপ্লবের পক্ষে খুবই সুবিধাজনক। মহান নেতা সভাপতি মাও যথাযথভাবে বর্তমান দুনিয়ার বিপ্লবী সংগ্রামের অভিজ্ঞতার সার সংকলন করেছেন। বিপ্লব হলো বর্তমান বিশ্বের প্রধান প্রবণতা। বিশ্বের বিপ্লবীরা দ্রুতগতিতে চুড়ান্ত বিজয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, বার্মা, ভারত, প্যালেস্টাইন এবং এশিয়া আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নিপীড়িত দেশ ও জাতিসমূহের মুক্তি সংগ্রাম দাউ দাউ করে জ্বলছে।

খোদ মার্কিন সম্রাজ্যবাদের মর্মস্থলে কালো অধিবাসীদের হিংসাত্মক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম জোরদার হচ্ছে।

সোভিয়েট সামাজিক সম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সংশোধনবাদী দেশসমূহে গণঅসন্তোস এবং নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তীব্রতর হচ্ছে। তারাও নিজেদের খতম হওয়ার দিন গুনছে।

পক্ষান্তরে, সভাপতি মাওয়ের নেতৃত্বে গণচীন বিরাটকায় দানবের মতো দাড়িয়ে আছে পূর্ব দিগন্তে।  ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক আলোকস্তম্ভ আলবেনিয়াতে উজ্জল কিরণ বিচ্ছুরিত করছে।

এ যুগ সম্পর্কে সভাপতি মাও দূরদর্শিতার সাথে যথার্থই উল্লেখ করেছেন। “আজ থেকে আগামী ৫০ থেকে ১০০ বৎসর অথবা তার পরের সময়টা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী সমাজ কাঠামো আমূল পরিবর্তনের মহান যুগ। পূর্ববর্তী যে কোনো ঐতিহাসিক পর্যায় নজীরবিহীন একটি বিশ্ব কাঁপানো যুগ।”

Scroll to Top