শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৬। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত একটি রূপক অনুষ্ঠান- জল্লাদের দরবার (অংশ) | স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র | …১৯৭১ |
জল্লাদের দরবার
১১ জুলাই, ১৯৭১
নকীবঃ (চিৎকার করে হকিছে) জনাব সদরে-মূলুক, খানা-এ-তালুক, প্যায়ারে মোহাম্মদ কেল্লা ফতে খান বাহাদুর-
ফতেঃ সিপাহসালার টিটিয়া খান, যুদ্ধের খবর কি?
সিপাহঃ যুদ্ধ শেষ। আমাদের সেনারা এখন ক্যাম্পে বসে তুন্দুরী রুটি খাচ্ছে। আর ঘুমুচ্ছে।
দুর্মুখ খানঃ জনাব সদরে মুলুক, গোস্তাকি মাপ। আমি দুর্মুখ খান। মাঝে মাঝে অতিব সত্য কথা না বললে কেমন যেন অম্বলের মতো বুক জ্বলে যায়।
ফতেঃ তোমার কি বক্তব্য, বলে ফেল দুর্মুখ খান।
দুর্মুখঃ আমাদের সিপাহসালার বুড়ো হলেও মনটা জোয়ানই আছে। উনি এই মাত্র বললেন আমাদের সেনারা নাকি যুদ্ধ শেষ করে এখন ক্যান্টনমেন্টে বসে তুন্দুরী রুটি খাচ্ছে আর ঘুমুচ্ছে।
ফতেঃ তুমি কি বলতে চাও?
দুর্মুখঃ হুজুরে আলা, আপনি তো তিন মাস হ’ল হার্ট আর মাথা ঘুরানি ব্যামোতে আপনার ‘মসরকী বাঙ্গালে’ পা রাখতে পারেননি। যদি মেহেরবানী করে একবার “বাংলাদেশে” যান তাহলে দেখতে পাবেন, ওইসব দুষ্টু বিচ্ছিন্নতাবাদী মানে মুক্তিবাহিনী প্রতিদিন আপনার প্যায়ারে সেনাদলকে এ্যায়সান ধোপা পাটকান পাটকাচ্ছে যে, সেইসব আমাদের সেনারা তুন্দুর রুটি খাবার বদলে হাসপাতালের বেড়ে খাবি খাচ্ছে। ওরা ঘুমুচ্ছে ঠিকই- তবে সে ঘুম সহজে ভাঙবার নয়। উঃ কি মার হুজুর- একেবারে বদন বিগড়ে দিয়েছে।
ফতেঃ খামোশ নালায়েক! মুক্তিবাহিনী-মুক্তিবাহিনী-মুক্তিবাহিনী আমাকে পাগল না বানিয়ে ছাড়বে না দেখছি।
দুর্মুখঃ গোস্তাফি মাফ জনাব। ভুলে গিয়েছিলাম, ওদের মুক্তিবাহিনী বলা চলবে না। মানে ঐসব দুষ্ট্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা।
ফতেঃ দুমুখ খানের একথা কি সত্য টিটিয়া খান?
সিপাহঃ জনাব, মারতে গেলে মার খেতে হয়- এইটাই আমাদের যুদ্ধকৌশল।
ফতেঃ তাহলে ওইসব দেশদ্রোহীদের হাতে আমার সাধের সেনাদল এখনও মার খাচ্ছে।
দুমুর্খঃ খাচ্ছে মানে? এ মার এমন মার যে হজম করা মুস্কিল। মেরে একে বারে তক্তা করে দিচ্ছে। আহা!
ফতেঃ দুর্মুখ খান, তোমার এই কথা শুনে আমার মাথাটা আবার ঘুরে উঠল। পানি।
সিপাহঃ জনাব, আপনি বিচলিত হবেন না। আমাদের বীর সেনাবাহিনী জান দিয়েও দেশ রক্ষা করবে।
দুমুর্খঃ দেশ রক্ষা নয়- বলুন তারা এখন পেট রক্ষায় ব্যস্ত।
ফতেঃ তার মানে? বেশ খোলাসা করে বলো দুর্মুখ খান।
দুমুর্খঃ তার মানে বুঝলেন না জনাব? আপনার সেনাদল বাংলাদেশের বুকে অভিযান চালাবার নামে নিরীহ মানুষ গুলোকে হত্যা করেছে, তাদের যথাসর্বস্ব লুটতরাজ করেছে, ব্যাঙ্ক লুটেছে। এইসব লুটের টাকায় আপনার এক-একজন গরীব সেনা রাতারাতি ক্রোড়পতি বন গিয়া।
ফতেঃ এ তো আনন্দের বিষয়। খোশ খবর।
দুমুর্খঃ কিন্তু নিরানন্দে আপনি তাদের ভাসালেন জনাব। আচমকা একশো আর পাঁচশো টাকার নোটগুলোকে কাগজ করে দিয়ে আপনার ওইসব ক্রোড়পতি সেনাদের আপনি একেবারে পথে বসালেন। তারা বলছে, কেল্লা ফতে খান আমাদের পথে বসালেন।
ফতেঃ সিপাহসালার, এ কথা কি সত্য? এই দেখো মাথাটা আবার-
সিপাহঃ আংশিক সত্য জনাব। লুটের টাকা নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে কিনা জানি না। তবে তারা পুরো মাইনে না পাওয়াতে মানে ডিফেন্স সারটিফিকেটে মাইনে দেওয়াতে দিলে বড়ই দুঃখ পেয়েছে।
ফতেঃ কি আর করা যাবে সিপাহসালার। যুদ্ধের ব্যয়, খয়রাতি সাহায্য বন্ধ, ব্যবসা অচল। এই সব মিলে কোষাগার প্রায় শূন্য। উঃ মাথাটা কেমন যেন-
সিপাহঃ ভাববেন না জনাব। আমাদের সেনারা মাইনে না পেলেও বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
দুর্মুখঃ হ্যাঁ-হ্যাঁ, কুছ পরওয়া নাহি হ্যায়। পয়ষট্টি সালের যুদ্ধের সময় আমাদের স্বনামধন্য লালকানার নবাব নন্দন বলেছিলেন, যদি আমাদের ঘাস খেয়ে বাচতে হয় তবু হাজার বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। ভাগ্যিস সতেরো দিনে যুদ্ধ থেমেছিলো।
সিপাহঃ তুমি পরিহাস করছো দুর্মুখ খান!
দুর্মুখঃ এ পরিহাস নয় সিপাহসালার। বাস্তব আর মুখের বজঠাণ্ডা। বুলি এক নয়। এর মধ্যেই শোনা যাচ্ছে, আমাদের কিছু সেনা নাকি আর বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ খুন করতে রাজী নয়।
ফতেঃ ওফ! মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল!
সিপাহঃ বিচলিত হবেন না জনাব। এ নিতান্ত কিছু সেনার মুখের কথা- মনের কথা নয়।
দুর্মুখঃ আমাদের বৃধ সিপাহসালার আজকাল কি তাঁর প্রতিটি অন্তরের গভীরতর তদেশ অন্বশ্ন করে এ খথা বলছেন? আপনার বীর বেলুচ সেনারা যে ধীরে ধীরে বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। তারা নাকি এখন বলছে, কাফের হত্যার নির্দেশ আমাদের দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখছি, আমরা যাদের খুন করছি তারা নিরিহ মানুষ, তারা মুসলমান, তারা আমার ভাই।
ফতেঃ ওফ-মাথাটা আবার
সিপাহঃ জনাব, আপনার মাথাটাকে অতো ঘোরাবেন না। আপনার প্রেসার আবার বেড়ে যাবে। আমার ওপর বিশ্বাস আর আস্থা রাখুন। সব ঠিক করে দেবো।
ফতেঃ কি করে আস্থা রাখি টিটিয়া খান! ইতিপূর্বে আপনি আমাকে বলেছিলেন সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আমিও বিশ্বকে বুক ঠুকে বলেছিলাম, দেখে যান বিশ্ববাসী, আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সব স্বাভাবিক করে ফেলেছি। কিন্তু কতোকগুলো বিদেশী মানুষ এদেশে এসে আপনার জারিজুরি সব ফাঁস করে দিল। আমার মুখ হাসালেন।
দুর্মুখঃ শুধু মুখ হাসালেন না, চোখের জলে লোমশ বুক ভাসালেন। আচ্ছা জনাব, যুদ্ধটা বন্ধ করে দিলে হয় না?
ফতেঃ কি বললে?
দুর্মুখঃ একটু ভেবে দেখুন, আপনার জন্মদাতাও অবশেষে যুদ্ধে ক্ষ্যান্ত দিয়ে নিরালায় বসে আত্মজীবনী লিখছেন আর দিলখুশবাগে পায়চারী করছেন। আপনিও না হয় সব কিছুতে ইস্তফা দিয়ে সাকী আর সুরা নিয়ে খোশমহলায় বাকি জীবনটা আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দেবেন। কি দরকার এসব বুট ঝামেলা!
ফতেঃ দুর্মুখ খান, তোমার এই ঔদ্ধত্য স্পর্ধা দেখে আমি বিস্মিত হচ্ছি। রসনা সংযত করো। এই মুহুর্তে আমি তোমাকে বহিষ্কার করতে পারি।
দুর্মুখঃ পারেন না জনাব। কারণ আমি আপনার হৃদয়ের গভীরে বাস করি। সেখান থেকে আমাকে বিতাড়িত করবেন কি করে।
সিপাহঃ জনাব আমি তাহলে এখন চলি।
ফতেঃ আসুন। তবে হ্যাঁ, স্মরণ রাখবেন সাড়ে সাত কোটি মানুষকে চরমভাবে শায়েস্তা না করা পর্যন্ত বিশ্রাম আমাদের হারাম।
সিপাহঃ আমি আবার বলছি। আপনি নিশ্চিত থাকুন। আর ক’দিন পর ওদের আমরা ফুয়ে উড়িয়ে দেবো
দুর্মুখঃ (হেসে) দেখবেন, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মিলিত নিঃশ্বাসে আপনারা শেষে উড়ে না যান! জনাব। নিজেদের গোড়া শক্ত করে রাখবেন।
সিপাহঃ এ ব্যাপারে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে। আমি চললাম জনাব। খোদা হাফেজ।
ফতেঃ খোদা হাফেজ।
দুর্মুখঃ জনাব, আমাদের সিপাহসালারের ভীমরতি ধরেছে। ওকে অবসর দিন।
ফতেঃ আমিও তাই ভাবছি।
নকিবঃ জনাবে আলা, লারকানার নবাবজাদা আপনার দর্শনপ্রার্থী।
ফতেঃ উঃ লোকটা আবার ঝামেলা করতে আসছে।
দুর্মুখঃ সে কি জনাব, বাদশাজাদা আপনার প্যায়ারের দোস্ত। সেই দোস্তকে এখন বরদাস্ত না করার কারণ?
ফতেঃ যখন প্রয়োজন ছিল দোস্তি করেছি।
দুর্মুখঃ আর এখন প্রয়োজন শেষে ছোববার মতো রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন এইতো!
ফতেঃ এইটাই আমাদের নীতি। যাও, নবাবজাদাকে পাঠিয়ে দাও।
নকীবঃ জো হুকুম জনাব।
দুর্মুখঃ আমি কি চলে যাবো জনাব?
ফতেঃ না-না-থাক বুঝলে দুর্মুখ খাঁ, এক এক সময় তোমাকে সহ্য করতে পারি না সত্য, আবার তোমার অস্তিত্বকে অস্বীকারও করতে পারি না। আসুন, নবাবজাদা, আসন গ্রহণ করুন। তারপর কি সংবাদ?
নবাবঃ আমাদের পক্ষে আর প্রকাশ্যে চলাফেরা দুঃসাধ্য খাঁ সাহেব। কোন রকেম ছাতা দিয়ে মাথা বাঁচিয়ে চলছি।
ফতেঃ কেন?
নবাবঃ আমার দলের সদস্যরা আজকাল কাবলে তাগাদা শুরু করেছে। তারা বলছে, আমরা এতো তকলীফ করে সদস্য হলাম, আর এখন পর্যন্ত ক্ষুদে উজির হওয়া তো দূরের কথা, মাইনেটা পর্যন্ত পেলাম না।
ফতেঃ (হেসে) নবাবজাদা বর্তমান পরিস্থিতি বড়ই ঘোলাটে।
দুর্মুখঃ নবাবজাদা সেটা জানেন হুজুর, কারণ ওঁর হাত দিয়েই তো ঘোল ঢালিয়েছেন।
ফতেঃ দুর্মুখ খান!
দুর্মুখঃ গোস্তাফি মাফ করবেন।
নবাবঃ খাঁ সাহেব, আপনি আমার কাছে ওয়াদা করেছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঠাণ্ডা করেই ক্ষমতা আমার হাতে অর্পণ করবেন।
দুর্মুখঃ লাগ ভেল্কি লাগ, চোখে মুখে লাগ।
ফতেঃ নবাবজাদা, আমার ওয়াদার পূর্বে আপনি আপনার দেশবাসীর কাছে ওয়াদা করেছিলেন যে, আপনার কতো একর জমি যেন গরীবদের মধ্যে দান করবেন। আপনি ওয়াদা রক্ষা করেছেন?
নবাবঃ সেটা নিতান্ত আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ফতেঃ আর এটাও আমার কিছুটা ব্যক্তিগত ব্যাপার বৈ কি! কারণ
দুর্মুখঃ কারণ, এই দেশ হুজুরের বাপ-দাদার খাশ তালুক না হলেও গোটা মালুকের একছত্ৰ মালিক উনি।
ফতেঃ স্তব্ধ হও দুর্মুখ খান।
নবাবঃ আমি এসেছি এই জন্যে যে, আর আপনার কাছ থেকে নতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে যাবো খাঁ সাহেব।
ফতেঃ প্রতীক্ষায় থাকু-ব্যবস্থা হবে।
নবাবঃ তাতো বুঝলাম। কিন্তু কবে!
দুর্মুখঃ ঠিকই তো। এ কথা তো ছিল না!
ফতেঃ দুর্মুখ খান
দুর্মুখঃ গোস্তাফি মাপ করা হোক জনাব।
ফতেঃ আর চার মাস অপেক্ষা করুন নবাবজাদা। যদি দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারি, যদি পৃথিবীর মানচিত্রে এ রাজ্যের অস্তিত্ব থাকে- তাহলে আমি অবশ্যই আপনাদের সম্পূর্ণ বিমুখ করবো না।
দুর্মুখঃ হুজুর পাঠানের বাচ্চা- এক কথার লোক। পাঠান জীবন থাকতে ওয়াদা খেলাপ করে না।
ফতেঃ নিশ্চয়ই।
দুমুখঃ অবশ্য নেহাৎ বেকায়দায় পড়ে দু’চারবার বাধ্য হয়ে জনাবকে কথার বরখেলাপ করতে হয়েছে তবে পৃথিবীর গ্রেটম্যানরা ওসব করেই থাকেন।
ফতেঃ দুর্মুখ, তোমাকে আমি কোতল করবো। তুমি গাধার বাচ্চা
দুর্মুখঃ হুজুর আমার মা-বাপ। যা বলবেন তাই সত্যি।
নবাবঃ আমি চলি। আবার আসবো। খোদাহাফেজ।
দুর্মুখঃ লারকানার নবাব নন্দন একটু চটে গেছেন।
ফতেঃ কুছ পরওয়া নাহি। এই দেখো, আবার মাথাটা ঘুরে উঠল। বাতাস দাও-পানি খাওয়াও।
১৬ জুলাই, ১৯৭১
সিপাহঃ কি ব্যাপার দুর্মুখ খান? তুমি একাকী দরবারে বসে যে?
দুর্মুখঃ এসেছি একা, যাইবো একা। দোসর নাহিকো আর
সিপাহঃ কাব্য করতেও জানো নাকি?
দুর্মুখঃ বাংলায় কিছুদিন ছিলাম। তাই শ্যামল মাঠভরা ধানের বাতাসে হৃদয়ে একটু কাব্য সঞ্চার হয়েছিল সিপাহসালার ।
সিপাহঃ বাংলাকে তুমি ভালোবাসো?
দুর্মুখঃ অমন সোনার বাংলাকে কে না ভালোবাসে জনাব। বাংলার মাটি, বাংলার আকাশ, সোনাঝরা রোদুর প্রাণে নতুন স্পন্দন জাগায়।
সিপাহঃ কই আমার মনে তো কোন স্পন্দন জাগে না!
দুর্মুখঃ সিপাহসালার, জীবনে আপনি কোনদিন হেসেছেন?
সিপাহঃ না।
দুর্মুখঃ কোনদিন কেদেছেন?
সিপাহঃ না।
দুর্মুখঃ তবে কি করে আপনার হৃদয়ে স্পন্দন জাগবে? আপনি যে মৃত নক্ষত্রের মতো। হৃদয়টাকে হত্যা করেছেন আপনি।
সিপাহঃ না। আমি উল্কার মতো আকাশের বুকে অশুভের বার্তা নিয়ে দেখা দিই। তাইতো আমার ছায়া দেখলে লোকে শিউরে ওঠে।
দুর্মুখঃ আমার মনে হয় সিপাহসালার, শৈশবে, কৈশোরে আপনি কারও স্নেহ-ভালোবাসা পাননি। তাই আপনার হৃদয় থেকে স্নেহ, ভালোবাসা শুকিয়ে গেছে। অন্তর বিদ্রোহ করেছে। আচ্ছা সিপাহসালার, আপনার সন্তানদের প্রতি আপনার এতোটুকু স্নেহ-ভালোবাসা নেই?
সিপাহঃ প্রয়োজন মনে করি না।
দুর্মুখঃ নিজের স্ত্রীকেও কি কোনদিন একটু ভালোবেসে
সিপাহঃ দুর্মুখ খান! বেয়াদপি আমি পছন্দ করি না। ভালোবাসা স্নেহ! মমতা ওসব হচ্ছে ন্যাকামি, ভাঁড়ামি। আমি ঘৃণা করি ওসবকে। ওই মোহে যারা আচ্ছন্ন তারা বেয়াকুব।
দুর্মুখঃ আচ্ছা আপনি তাহলে কি ভালোবাসেন, সিপাহসালা?
সিপাহঃ মানুষ খুন করতে আমি ভালোবাসি। রক্ত মুঠো-মুঠো রক্ত হাতে নিলে আমি আনন্দ পাই আমার বুকজোড়া তৃষ্ণা নিবারণ হয়- হৃদয়ে রোমাঞ্চ জাগে- স্পন্দন, শিহরণ জাগে।
দুর্মুখঃ (হেসে) ইতিহাসের এক নতুন চরিত্র। বিশ্বের বিস্ময়!
সিপাহঃ জানো দুর্মুখ, যুদ্ধে মানুষ খুন করলে কোন গুণাহ হয় না। তবে জানি না আমার কিসমৎ আমাকে কোথায় নয়ে চলেছে।
দুর্মুখঃ জাহান্নামে জনাব।
সিপাহঃ কি বললে দুর্মুখ খান?
দুর্মুখঃ না, মানে ইয়ে বলছিলাম কি, জনাবের বয়স অনেক হয়েছে, তাই জাহান্নামে যাবার পাসপোর্ট পেতে দেরী নয়। তবে হুজুর, বেহেস্তে যাবেন না। ওখানে আপনি শান্তি পাবেন না। কারণ সেখানে যতসব মহাত্ম ব্যক্তিরা খোদার ধ্যানে মগ্ন। ওসব ন্যাকামিপনা দেখলে আপনার গা খিসমিস করবে- হাত চুলকাবে। তার চাইতে আপনি দোজখবাসী হবেন। সেখানে আপনার
অনেক বাপ, দাদা, চাচা, মামুর সাক্ষাৎ পাবেন। আপনি সেখানে গেলে একেবারে দোজখ গুলজার হবে। কবে যাবেন জাহাপনা? আগে থেকে জনাবের যাতে ঢাকেশ্বরী মিলের ফাইন কাফনের কাপড় আপনার হাতে দিতে পারি। আমাদেরও তো একটু কর্তব্য আছে।
সিপাহঃ খামোশ কমবকত!
দুমুখঃ এইতো আবার চটে যাচ্ছেন। যতো বুড়ো হচ্ছেন ততই মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে। শিশুহত্যা নারী হত্যা করে আপনি যেরকম না করেছেন- তাতে মেজাজের মুখে লাগাম না দিলে বুড়ো বয়সে অপঘাতে মরবেন।
সিপাহঃ আমাকে মারবার সাধ্য কারও নেই।
দুমুখঃ আছে জনাব-আছে- ওই মাথার ওপর যিনি বসে আছেন তার মার আপনি রকেট-বোমা দিয়েও ঠেকাতে পারবেন না। সেই মার দুনিয়ার বার।
সিপাহঃ আমি কাউকে পরোয়া করি না দুর্মুখ।
দুর্মুখঃ আপনি খোদাকে মানেন?
সিপাহঃ যাকে দেখি না তাকে মানি না।
দুমুখঃ তাহলে ইসলাম রক্ষার জন্য বাংলার বুকে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিলেন কেন?
সিপাহঃ মসনদ ক্ষমতা রক্ষাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ।
দুমুখঃ ও! “ইসলাম বিপন্ন- ইসলাম রক্ষা সাচ্চা মুসলমানের ফরজ” ইত্যাদি বজ্ৰ বুলি তাহলে বাষ্প? আসলে-চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।
সিপাহঃ বাঁচতে পারছি কই?
দুমুখঃ কি বললেন!
সিপাহঃ না-কই কিছু না! যাক, ওসব রাজনীতি নিয়ে তুমি মাথা ঘামিও না। ওসব তুমি বুঝবে না।
দুমুখঃ ২৩ বছর পর এবার বুঝেছি। চোখ খুলে গেছে। সূর্যের আলোর মতো সব ঘোর কেটে গেছে।
সিপাহঃ তুমি বড় চালাক দুর্মুখ খান। তোমার বুদ্ধির প্রখরতায় এক এক সময়- যাক, চলো জাঁহাপনার মন্ত্রণা কক্ষে যাওয়া যাক।
দুমুখঃ সে কি জনাব, আমাকে আপনি সহ্য করতে পারেন না অথচ আমাকে ল্যাজে বেঁধে নিয়ে জাহাপনার সামনে হাজির হতে চান? ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না তো সিপাহসালার!
সিপাহঃ না মানে, তুমি দরবারে না থাকলে দরবার কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
দুর্মুখঃ যাক, তাহলে এতদিন পরে আমার অস্তিত্বটুকুকে স্বীকার করলেন। সত্যিই আমি যে কি আনন্দিত সিপাহসালার যে, এই মুহুর্তে আপনার মৃত্যু হলে এতো আনন্দিত হয়তো হতে পারতাম না।
সিপাহঃ দুর্মুখ খান! বেয়াদপ- বেতমিজ-
দুর্মুখঃ ক্ষ্যাপা কুকুরটা বিদায় হলো তাহলে। খোদা, তোমার দুনিয়া থেকে এই আবর্জনাগুলোকে সরিয়ে নাও। নইলে লাঞ্ছিত, নিপীড়িত মানুষ তোমাকে অভিশাপ দেবে। তোমার আরশ কেঁপে উঠবে। এ্যায় পরওয়ারদিগার, তুমি রহমানুর রাহিম। রহম করো-নিরীহ, নিষ্পাপ বঙ্গসন্তানদের প্রতি তুমি রহম করো। ওরা সত্য, ন্যায়ের পূজারী। ওরাই তোমার সৃষ্টির গর্ব। সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তরাত্মা যেখানে অত্যাচারিত নির্যাতিত, সেখানে কেন তুমি নিশ্চুপ!
নবাবঃ দুর্মুখ খান-
দুমুখঃ এই যে আসুন নবাবজাদা।
নবাবঃ জাহাপনা কোথায়?
দুর্মুখঃ মন্ত্রণা কক্ষে।
নবাবঃ কেউ কি মন্ত্রণা কক্ষে গেছে?
দুর্মুখঃ জী হ্যাঁ। ত্রিরত্বের এক রতু এইমাত্র অন্দরে গেলেন, এবার আপনি গেলেই ত্র্যহস্পর্শ।
নবাবঃ কোন গোপন সলাপরামর্শ হচ্ছে নাকি?
দুর্মুখঃ (হেসে) আজ তেইশ বছর ধরেই তো এই দরবারের মন্ত্রণা কক্ষে কতো চক্রান্তের জাল জন্ম নিল- আবার ভাঙলো- আবার গড়লো। মাকড়শার মতো এই দরবার জালে ছেয়ে গেছে। তাইতো নিজেদের জালে নিজেরা ফেসে গিয়ে এখন আর পালাবার পথ পাচ্ছে না।
নবাবঃ তুমি বড় বাজে বলো।
দুর্মুখঃ মাঝে মাঝে একটু চরম সত্যি কথা না বললে মুখটা কেমন যেন তেতো তেতো লাগে।
নবাবঃ আমার হাতে ক্ষমতা আসলে আমি তোমাকে একটা মন্ত্রিতু দেবো। দু পয়সা পাবার লাইন ধরিয়ে দেবো।
দুর্মুখঃ সাবাস নবাবজাদা- সাবাস! গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। আগে নিজের পেট বাঁচান নবাজাদা।
নবাবঃ আমি অন্য ধাতু দিয়ে তৈরী দুর্মুখ খান।
দুর্মুখঃ ওসব ধাতু ছাতু হয়ে যাবে নবাজাদা। সত্যিই, আপনার অবস্থার কথা চিন্তা করলে আমার মরা কান্না কাঁদতে ইচ্ছে করে।
নবাবঃ কেন? কেন? কাঁদার কি আছে!
দুর্মুখঃ কাঁদবো না! জাঁহাপনা আপনার গলার দড়ি ধরে ডুগডুগি বাজালেন। দর্শকের সামনে আপনি দর্শকের পায়ে হাত দিয়ে পয়সা নিয়ে জাহাপনাকে দিলেন। জাহাপনা মুচকি হেসে পকেটে সব পয়সা পুরলেন- আর আপনি বসে বসে এখন উকুন বাছছেন- আর এক টুকরো কলার জন্যে জাহাপনার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছেন। এদিকে লোকে আপনার পেছনে কাঠির খোঁচা দিয়ে মজা লুটছে- আর আপনি দাঁত খিচুচ্ছেন। এইতো পরিণাম!
নবাবঃ খামোশ বেয়াদপ। তোমাকে- তোমাকে আমি –
দুর্মুখঃ আহা- আপনার এ্যালকোহলী চেহারা লাল হয়ে গেল। রাগ করবেন না নবাবজাদা। একটু ঠাট্টা করলাম মাত্র।
নবাবঃ তুমিই কি এই মন্ত্রণা কক্ষের দ্বাররক্ষী?
দুর্মুখঃ না জনাব, হৃদয়ের দ্বাররক্ষী ! হৃদয়ের
নবাবঃ উন্মাদ। যতোসব উন্মাদ
দুর্মুখঃ নবাবজাদাও মন্ত্রণা কক্ষে চলে গেলেন। আমি উন্মাদ! কিন্তু তোরা- তোরা কি? তোরা জল্লাদ। তাই এই জল্লাদের দরবার ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। (Change over)
।। মন্ত্রণা কক্ষ।।
ফতেঃ শুনুন সিপাহসালার টিটিয়া খান, শুনুন লারকানার নবাবজাদা, পিণ্ডির মসনদ আজ ধীরে ধীরে অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে চলেছে। বাংলাদেশের বিদ্রোহীরা আমাদের লক্ষ্য করে একের পর এক তীর ছড়ছে। বাংলাদেশের বিদ্রোহের ফলে দারুণ অর্থসংকট দেখা দিয়েছে আমার রাজ্যে। শুধু অস্ত্র কোষাগারে। আপনারাই বলুন, এ ক্ষেত্রে করণীয় কি?
দুর্মুখঃ (স্বাগত) আহত মৃতপ্রায় ব্যাঘ্ৰ শেয়াল আর বেড়ালের কাছে মুক্তি চাইছে। হাসি পায়।
সিপাহঃ আমাদের আহাম্মুখ খান, চিটজাদা কি উপদেশ দিচ্ছেন?
ফতেঃ ও ব্যাটাদের মাথায় কিছু আছে নাকি! বাঁদরের বাচ্চারা আমার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেয়ে এখন জিব চাটছে।
দুর্মুখঃ না জনাব। ওদের গোঁফ-দাড়িতে এখন কাঁঠালের আঠা জড়িয়ে গেছে। তাই এখন ঘরের কোণে বসে কাঁঠালের আঠা ছাড়াচ্ছে।
নবাবঃ অনেকটা সত্য। ওদেরই জন্যে রাজ্যের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে ভেঙ্গে পড়েছে।
ফতেঃ সিপাহসালার, বাংলাদেশে খাজনা-কর আদায় কেমন হচ্ছে?
সিপাহঃ আমি যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছি জনাব।
দুর্মুখঃ কিন্তু কোনই ফয়দা হচ্ছে না। কারণ বাংলার দামাল ছেলেরা সব তহসীল-অফিস বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে।কার বাপের সাধ্য যে বোমা খাবার জন্যে খাজনা আদায় করতে যাবে!
সিপাহঃ দুর্মুখ খান, অবান্তর কথা বলে জাঁহাপনাকে অসুস্থ করে তুলো না।
দুর্মুখঃ কবে কখন জাঁহাপনা সুস্থ, প্রকৃতিস্থ থাকেন সিপাহসালার।
ফতেঃ খামোশ দুর্মুখ খান।
দুর্মুখঃ এটা মন্ত্রণা কক্ষ। এই মন্ত্রণা নিয়েই তো আপনার যতো যন্ত্রণা। সিপাহসালার,
ফতেঃ মসরের্কী বাঙ্গাল থেকে পাট বিক্রয়ের কি ব্যবস্থা করলেন?
দুর্মুখঃ পাট সব লোপাট জনাব।
ফতেঃ তার মানে?
দুর্মুখঃ জনাব, বাংলার ওই বিদ্রোহী নেকড়েগুলো আপনার পাটের গুদামগুলি পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছেকারণ, আপনারা যাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে অস্ত্র কিনতে না পারেন। তা ছাড়া বাংলার মুক্ত অঞ্চলের যাবতীয় পাট বাংলাদেশ সরকার ক্রয় করে বিদেশে রপ্তানী করছেন। ওই পাট দিয়েই আপনাদের সাট করার ব্যবস্থা হচ্ছে।
ফতেঃ দুর্মুখ খান! উঃ মাথাটা আবার ঘুরে উঠল।
সিপাহঃ দুর্মুখের কথায় অসুস্থ হয়ে পড়বেন না-জনাব। এবার মাশরেকী বাঙ্গালে পাট খুব কম পয়দা হয়েছে।
ফতেঃ নসীব- সবই বদনসীব সিপাহসালার। বিপদ যখন আসে তখন চারিদিক দিয়ে আসে।
দুর্মুখঃ আলবৎ খোদা যখন দেন তখন একেবারে ছাপ্পর ফারকে দেন। আর যখন মারেন, তখন পানি খাবারও সময় দেন না।
ফতেঃ উঃ পাঁচ ডিভিশন সৈন্য দিয়েও আপনি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিশ্চিহ্ন করতে পারলেন না। সিপাহসালার! অথচ বোমাবাজ টিটিয়া খানের ওপর আমার যথেষ্ট আস্থা ছিল।
দুর্মুখঃ বোমাবাজ, ধরিবাজ যাকেই পাঠান- বাংলা মুলুকে গিয়ে সবাই ডিগবাজী খাবেন। কারণ আল্লাহ খোদ মদত করছেন বাঙালীদের। তাইতো বীর প্রসবিনী বাংলা আজ ধন্যা।
ফতেঃ ওফ- বাংলা-বাংলা-বাংলা। সিপাহসালার বাংলাকে আপনি পোড়ামাটি করে দিন। মৃতদেহের ভাগাড়ে পরিণত করুন মাশরেকী বাংলাকে। কুকুর-শেয়ালের সামনে বাঙালীদের লাশগুলো ছুড়ে ফেলে দিন।
দুর্মুখঃ চমৎকার।
সিপাহঃ অবশেষে তাই করবো আলমপনা। আমি টিটিয়া খান- আমার রোষানলে সব ভস্মীভূত হবে।পুড়িয়ে দেবো বাংলার মাটি, জ্বালিয়ে দেবো ক্ষেত খামার। বাংলার মাটিকে আমি বন্ধ্যা করে দেবো।
দুর্মুখঃ আপনার মাথার ওপর শকুন উড়ছে সিপাহসালার
সিপাহঃ দুর্মুখ খান!
নবাবঃ দুর্মুখ ঠিকই বলেছে সিপাহসালার। বিদ্রোহ শুধু বাংলার মানুষের মধ্যে নয়- বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে আমাদের সৈন্যদের মধ্যে।
ফতেঃ আপনি আমার সৈন্যদের ভেতরের খবরও রাখেন নাকি নবাবজাদা।
নবাবঃ নিশ্চয়ই। চোখ-কান আমার সদা সজাগ। খাঁ সাহেব হয়তো জানেন না যে, ইতিমধ্যে আমাদের ম্যাসাকার বাহিনী বিশ্বাসঘাতকতা করছে। ওরা মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে পালাচ্ছে- আত্মসমর্পণ করছে- আমাদের গোপন তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে।
ফতেঃ তারপর- তারপর নবাবজাদা?
নবাবঃ শুধু তাই নয়, আমাদের বেলুচ সৈন্যদের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। এমন কি আমাদের সৈন্যদলের কিছু অধিনায়ক তলে তলে আমাদের বিরুদ্ধে হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই তারা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তখন কি অবস্থা দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখেছেন খাঁ সাহেব।
দুর্মুখঃ তখন আমরা নিজেদের মধ্যে কিত কিত খেলা শুরু করবো। আগেই বলেছি কাকের মাংস কাকে খায়। তাইতো বলছি আলমপনা, আপনাদের মাথার ওপর শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে। মাথা সাবধান!
ফতেঃ এদিকে ভারত আমাদের সামনে বিরাট মহীরুহ। যুদ্ধের হুমকি দিয়েও ফয়দা হ’ল না। এই জাতশত্রুকে খতম করতে না পারলে-
দুর্মুখঃ ভারত অস্ত্র শাণিয়ে আপনাদের স্বাগত জানাবার জন্যে বসে আছে। মার আমরা খাবো ঠিকই তবে তারা মলম লাগিয়ে দেবে বলেছে।
ফতেঃ অসহ্য- অসহ্য! সিপাহসালার, অবিলম্বে ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করুন। যুদ্ধের দামামা বাজান। যুদ্ধ-যুদ্ধ চাই। হয় উত্থান- না হয় পতন হয় ইতিহাসের মানচিত্রে আমরা টিকে থাকবো- না হয় মুছে যাবো। এ ছাড়া অন্য উপায় নেই।
সিপাহঃ কিন্তু জাঁহাপনা –
ফতেঃ এর মধ্যে কোন কিন্তু নেই। বাঁচা কিম্বা মরা, দুটোর একটা বেছে নিন। মাশরেকী বাঙ্গালকে কবজায় আনতে হলে, ভারত আক্রমণ ছাড়া অন্য উপায় আর নেই সিপাহসালার। এ কি আপনার মুখটা অমন ছাইয়ের মতো, আমন শুকনো-শুকনো দেখাচ্ছে কেন! যান, মুখে পানির ছিটে দিয়ে বিছমিল্লাহ বলে অগ্রসর হোন। আর নবাবজাদা, আপনিও বিদায় গ্রহণ করুন।
সিপাহঃ খোদা হাফেজ।
ফতেঃ খোদা হাফেজ।
দুর্মুখঃ উফ! দুই রাহু বিদায় হল। আলমপনা, আপনি একটা অষ্টধাতুর মাদুলী গলায় বাঁধুন। যেভাবে শনির দল আপনাকে ঘিরে ধেরেছে-
ফতেঃ দুর্মুখ! তোমার ওসব ন্যাকামি আমার ভালো লাগছে না। যক্ষ্মার বীজাণুর মতো কে যেন সর্বদা আমার বুকেরভেতরটা কুরে কুরে খাচ্ছে। সাড়া শরীরে যেন শক্তি পাচ্ছি না। একটা দাহ, বুঝলে দুর্মুখ, কিসের যেন একটা দাহ সর্বদা পুড়িয়ে মারছে। জ্বলে যায়- আমার সর্বশরীর জ্বলে যায়।
দুর্মুখঃ কিসের দাহ জানেন না? শিশুহত্যা, নারীহত্যার গুণাহ। ওদের অভিশাপের দাহ আপনাকে দগ্ধ করছে। এর কোন দাওয়াই নেই জনাব। এর হাত থেকে রেহাই নেই।
ফতেঃ শিশুহত্যা-নারীহত্যা হ্যাঁ- মানুষের বাচ্চাগুলোকে আমি খুন করেছি- নারীর ইজ্জত লুটেছি- হত্যা করেছি। আমি খুনি-আমি জল্লাদ- আমি বেঈমান। দেখেও নাও- দেখে যাও বিশ্বাবাসী। আমি নিরীহ বাঙ্গালীর লহুতে রক্তস্নান করেছি- বাঙালীদের লাখো লাশের ওপর বসে আমি মসনদী করছি। আমি বিশ্বের বিস্মরণ- আমি মহাত্রাস- আমি জল্লাদ। হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জল্লাদ
আমি খুনী- আমি কশাই। হা-হা-হা-আরও রক্ত চাই- আরও রক্ত চাই- আমি রক্তবীজ- আমি রাক্ষস-হা-হা হা-
দুর্মুখঃ …. নাটক জমে উঠেছে। যবনিকার আর দেরী নেই। তারপর নতুন পালা শুরু।
১ আগষ্ট, ১৯৭১
বাদশা কেল্লা ফতে খান হাসছেন।
দুমুখঃ আলমপনা, সকাল থেকে আপনি শুধু হাসছেন। এ এক আশ্চর্য পরিবর্তন
ফতেঃ কেন হাসছি বল তো দুর্মুখ খান?
দুর্মুখঃ অনেক রকম হাসি আছে জনাব। আনন্দের হাসি, দুঃখের হাসি, শয়তানের হাসিআমার হাসি শুনে কি মনে হচ্ছে তোমার? ইথারের বুকে কান পাতলে এমনি অনেক অট্টহাস্য শুনতে পাই। সুলতান মামুদ, নাদির শা, চেঙ্গিস, হিটলার সকলে বোধ করি এভাবেই হাসতেন।
ফতেঃ রাজা-বাদশারা এভাবেই হাসে মূখ।
দুর্মুখঃ কিন্তু জাঁহাপনা, কোনদিন কি মায়ের হাসি দেখেছেন? যখন মায়ের কোলে শিশুর মধুর হাসি মুখ দেখে বুক ভরিয়ে যায়? কোনদিন কি রাস্তার ওই উলঙ্গ ছেলেটার মুখের স্নিগ্ধ হাসি দেখেছেন? দেখেছেন কি গ্রাম-বাংলার কৃষকের প্রাণের খোলা হাসি? না, দেখেননি। কারণ সেইসব হাসি আপনি কেড়ে নিয়েছেন।
ফতেঃ বাংলা-মাশরেকী বাঙ্গালা। শোন দুর্মুখ খান, বাংলার মানুষের মুখের হাসির চাইতে সেখানকারজমিন আমার কাছে-
দুর্মুখঃ জানি জনাব, বাংলাদেশটা আপনাদের কাছে সোনার থালা, আর বাঙালীদের কাছে বাংলা ওদের মা। সেই মাকে কোনদিন কি আপনি ওদের কাছে থেকে কেড়ে নিতে পারবেন?
ফতেঃ দুর্মুখ, বাদশা কেল্লা ফতে খান যেখানে থাবা চালায় সেখান থেকে খালি মুঠি কোনদিন ফিরিয়ে আনেন না।আর খোদা না খাস্তা যদি বাংলাদেশ আমার হাত থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে গোটা বাংলাদেশটাকে আমি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্মস্তুপে পরিণত করবো । এই আমার কসম ।
দুর্মুখঃ জনাব, শুনি নাকি ধ্বংসস্তুপের মধ্যেই নতুনের ভিত্তি রচিত হয়। আশ্চর্য সাহস ওই বাংলার দামাল ছেলেগুলোর-এখনও হিংসের নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
ফতেঃ ওই বিদ্রোহীরা আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আমার নীদ হারাম করেছে। কিন্তু কমবকতরা বরঞ্চ দু’পায়ে দলে গেছে। দুর্মুখঃ জনাব, শুনি নাকি বাংলাদেশের পথে কাঁটার চাইতে কাদা বেশী। সেই হাতী এবার কাদায় পড়েছে জাঁহাপনা।
ফতেঃ তার অর্থ?
দুর্মুখঃ আলমপনা, দীর্ঘ চাত মাস অতিবাহিত হতে চললো, আপনার জবরদস্ত বীর জোয়ানরা স্বাধীনতাকামী ছেলেগুলোঠাণ্ডা করতে পারল না। এদিকে ওই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আরও শক্তিশালী, দুর্ধর্ষ হচ্ছে। আমাদের সৈনিকরা বুকে থাবা মেলে এগিয়ে যাচ্ছেথ- কিন্তু পরক্ষণে মাজা ভেঙ্গে ছাউনীতে ফিরছে। কেউ আর নাড়িভুড়ি এলিয়ে চিতোচ্ছে। আহা রে, আমাদের সোনার চাঁদ সেপাহীদের রক্তাক্ত দেহ দেখে- (কান্নার সুর কণ্ঠে)
ফতেঃ কেদো না-কেদো না দুর্মুখ খান। আমার মাথা ঘুরছে। এ্যাই- দাওয়াই কা বেতল লে আও।
দুর্মুখঃ অতো দাওয়াই খাবেন না জনাব। এমনিতেই ভুল বকছেন- আবার ঘন ঘন দাওয়াই পেটে পড়লে, একেবারে ক্ষেপে যাবেন জনাব।
ফতেঃ খামোশ কমবকত। তমিজ-সে বাত করো!
দুর্মুখঃ বড় দুঃখে বলি জনাব। আমার বুকটা দুঃখে জার জার।
ফতেঃ বেচেখান হয়ো না দুর্মুখ খান। যুদ্ধের সাফল্যের ওপর আমি নির্ভরশীল নই। আমার ক্রুর রাজনীতি আমার হাতিয়ার।
দুর্মুখঃ মেহেরবানী করে বান্দাকে যদি একটু খুলে বলতেন
ফতেঃ শোন দুর্মুখ- গোলা, বারুদ, সুরা, নারী আমার জীবনের সবচে’ পেয়ারা চীজ। মাগার পিণ্ডির এই তক্তে তাউস আমাকে ছাড়ল না। উনোসত্তরের বাংলা আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ল। সেই বাংলার জনতার জ্বলন্ত লাভা আছড়ে পড়ল পিণ্ডির মসনদে। কারাগার ভেঙ্গে বেরিয়ে এলেন বাঙ্গালীদের বঙ্গবন্ধু।
দুর্মুখঃ জানি জনাব। এবং সঙ্গে সঙ্গে মসনদচ্যুত হলেন আপনার ধর্ম-আব্বা হুজুর জনাব খানে খান বেকুব খান।
ফতেঃ উত্তাল তরঙ্গে তখন হাবুডুবু খাচ্ছে এই তক্তে তাউস। আমি হাল ধরলাম। ছলনা আর মিষ্টি কথার অস্ত্র প্রয়োগকরে অগ্ন্যুৎপাত বন্ধ করলাম। কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি যে, ওই বঙ্গবন্ধু মানুষটার মধ্যে এতো আগুন আছে। আগে যদি জানতাম, তাহলে নির্বাচনের প্রহসন করতে গিয়ে-
দুর্মুখঃ সং সেজে বুক চাপড়াতে হতো না।
ফতেঃ তবু আমি বঙ্গবন্ধুকে প্রলোভন দেখালাম- ছলে বলে বশ করার চেষ্টা করলাম; কিন্তু ব্যর্থ হলাম। চালালাম কিন্তু
দুর্মুখঃ কিন্তু সেই জুতো যে ফিরে এসে আপনার মুখে পড়বে তা কি আর ভেবেছিলাম জনাব।
ফতেঃ দুর্মুখ খান।
দুর্মুখঃ গোস্তাফি মাফ করবেন জনাব ! আচ্ছা আলমপনা, এখন আপনার এই খাশ তালুক রক্ষার কি ব্যবস্থা করছেন?
ফতেঃ শোন, আমি নিজেই একটা আইন তৈরী করছি। আর সেই আইন মোতাবেক আমিই হবো এই তক্তে তাউসের একচ্ছত্র অধিপতি।
দুর্মুখঃ একেই বলে রাজরাজড়ার মাথা!
ফতেঃ আরও শোন, আমার ওইসব পোষা কুকুর যারা এইটুকরো মাংসের জন্য জগতের শ্রেষ্ঠ সর্দার, গণপ্রতিনিধিরাই রাজ্যভার গ্রহণ করেছে।
দুর্মুখঃ মারহাব্বা- মারহাব্বা, জনাব! আপনাকে যে মা গর্ভে ধারণ করেছিলেন, তিনি সত্যিই বিশ্বের বিস্ময়!
ফতেঃ কেমন লাগলো পরিকলপনা?
দুর্মুখঃ অদ্ভুত। জনাব- অদ্ভুত। আমি শুধু ভাবছি, এতো বুদ্ধি নিয়ে আজও আপনি বেঁচে আছেন কি করে।
ফতেঃ (হেসে) সত্যিই তুমি রসিক পুরুষ দুর্মুখ খান।
দুর্মুখঃ একটা ছোট্ট গল্প বলি জনাব। বিয়ে-পাগল এক মূখ ব্যক্তি স্থির করল সে এক ধনীর একমাত্র কন্যাকে বিয়ে করে, শ্বশুর-শাশুড়িকে হত্যা করে তাড়াতাড়ি বড়লোক হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই মুর্খকে কোন মেয়েই পছন্দ করল না। অবশেষে এই মূর্খ রাগে-দুঃখে তার বুড়ি মাকে বললো মাগো, আমার বিয়া আমি আর দেইখ্যা যাইতে পারুম না।
ফতেঃ (উচ্চৈঃস্বরে হাসলেন) হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ- [ আচমকা হাসি বন্ধ করে ক্রোধে এ্যাঁ। কি বললে, দুর্মুখ খান! বেহুদা বততামিজ, কমিনে- নিকাল যাও-[ গর্জে উঠলেন? উঃ মাথাটা আবার-
।। দরবার কক্ষ।।
নবাবঃ বন্দেগী খাঁ সাহেব।
ফতেঃ আসুন লারকানা নবাবজাদা। কি সংবাদ?
নবাবঃ আমার কিছু বক্তব্য আছে খাঁ সাহেব।
ফতেঃ আমিও কিছু বলতে চাই নবাবজাদা। শুনছি, ইদানীং আপনি নাকি আমার কার্যের সমালোচনা করছেন?
নবাবঃ আমার দলের স্বার্থে
ফতেঃ উফ – স্বার্থ-স্বার্থ ! শুনুন নবাবজাদা, আমি এসব পছন্দ করি না।
নবাবঃ খাঁ সাহেব কি আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন?
ফতেঃ না নবাবজাদা। কার ওপর ক্ষুব্ধ হবো? আপনারা যে আমার ভাই- অতি আপনার জন। আমার সততা সারল্যকে-
দুর্মুখঃ নবাবজাদা জনাবকে ভালোভাবেই চেনেন। আমাদের আলমপনা সারল্যে শিশু, মহসীনের ন্যায় দয়ার সাগর-সততায় ইয়ের মতো আর কি।
ফতেঃ নবাবজাদা- এই মসনদ, এই গুরুভার আমি বইতে পারছি না। আপনাদের বৃহত্তর স্বার্থে এই রাজদণ্ড আমি হাতে তুলে নিয়েছিলাম। সময় আসলে এই মসনদের সব আপনাদের হাতে অর্পণ করে-
দুর্মুখঃ জনাব আবার রংমহলায় ফিরে যাবেন।
ফতেঃ না, আমি মক্কা শরীফে যাবো।
দুর্মুখঃ (স্বগত) এই বারেই কানা মরেছে।
নবাবঃ কিন্তু আমার দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আর ধৈর্য রাখতে পারছে না খাঁ সাহেব।
ফতেঃ তাঁদের ইচ্ছার ওপর আমার রাজকার্য নির্ভর করে না।
নবাবঃ যদি তাঁরা বিদ্রোহ করে?
ফতেঃ তাহলে বাংলার মানুষের মতো তাদের কলিজাগুলো ছিড়ে আনা হবে।
দুর্মুখঃ (স্বগত) একেই বলে কাকের মাংস কাকেই খায়।
নবাবঃ জাহাপনা, শক্তির আতিশয্যে আপনি ভুল পথে চলছেন।
ফতেঃ (হেসে) জীবনের পাশাখেলায় আমি কোনদিন হারিনি নবাবনন্দন। পশ্চিম খণ্ডে যদি বিদ্রোহ হয় তাহলে আপনি- না-না- আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। আপনার প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা, ভরসা আছে নবাবজাদা। কারণ-
দুর্মুখঃ কারণ কাকের বাসাতেই কোকিলের বাচ্চা মানুষ হয়ে কু-কু করে ডাকে।
নবাবঃ জাঁহাপনা, আমি একা কি করবো? বাংলার মাটিতে আগুনের লেলিহান শিখা, সিন্ধুর আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা, পাঞ্জাবের বাতাসে পুঞ্জীভূত অস্ফুট প্রতিবাদ ধ্বনি- দারুণ অর্থসংকট, ব্যবসা, বাণিজ্য, কল-কারখানা সব বন্ধ। এতগুলো সমস্যা
ফতেঃ উঃ সমস্যা- সমস্যা-সমস্যা। এতোগুলো সমস্যা সমাধান আমার এক চরম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুর্মুখঃ ভাববেন না জনাব। মাথার ওপর আমাদের মামারা আছেন, দুর্যোগে কেটে যাবে। নাকের বদলে নড়ন পাবো- সেই ভাল । নবাবজাদা তো এখন থেকেই “চীন-মার্কিন” ভাই ভাই বলে চেচাচ্ছেন।
ফতেঃ কি লাভ। আমি এতো করে আমার মার্কিন বন্ধুকে দিয়ে পূর্ব বাংলার সীমান্তে রাষ্ট্রসংঘের সৈন্য মোতায়েন করার প্রস্তাব করলাম, কিন্তু আমাদের শত্রু ভারত-সম্রাজ্ঞী আমনি কঠোরভাবে তার বিরোধিতা করল।
দুর্মুখঃ জনাব, আমি বলি কি, এতোসব ফন্দিফিকির না করে একেবারে চোখ-কান বুজে বিসমিল্লাহ বলে ভারতআক্রমণ করে ফেলুন।
নবাবঃ আমি তোমার সঙ্গে একমত দুর্মুখ খান।
সিপাহঃ বন্দেগী জাহাপনা। আমিও একমত এদের সঙ্গে।
ফতেঃ কিন্তু সিপাহসালার কোথায় দাঁড়িয়ে, কিসের ভরসায়, কি নিয়ে যুদ্ধ করবেন ? বাংলার জমিন, বাংলার মানুষ ওই হাজার হাজার বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আমাদের শত্রু। এদিকে কোষাগার শূন্য, চার মাসের যুদ্ধে প্রচুর অস্ত্র, সৈন্য আমরা হারিয়েছে। তাই ভেবে দেখুন, ঘরের শত্রুর পাশে দাঁড়িয়ে, ভুখা শরীরে, খালি হাতে ভারতের ন্যায় শক্তিশালী দেশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া বাতুলতা ।
দুর্মুখঃ যথার্থ বলেছেন জনাব। দীর্ঘ চার মাস ধরে আমাদের বীর সেনানীরা কতকগুলো ডানপিটে ছেলের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাংলার রাজধানী ঠেকাতে পারছে না। আর-
সিপাহঃ তাহলে জাঁহাপনা, আপনি আপাতত ভারতকে একটা কড়া হুমকি দিন। তাতে দুটো সুফল হবে। এক. যদি বিদ্রোহীরা ভবিষ্যতে বাংলার কিছু জমি দখল করে, তাহলে আমরা বিশ্বকে জানাবো ভারত আমাদের ভূখণ্ড জোর করে দখল করেছে। আর দ্বিতীয়তঃ ভারত-সম্রাজী নারী। আপনার ন্যায় সিংহপুরুষের হুঙ্কারে অবশ্যই ভীত হবে।
দুর্মুখঃ (হেসে) ভারত-সম্রাজী জানেন যে, ফাঁকা কলসীর আওয়াজ বেশী।
ফতেঃ খামোশ বেয়াদপ। ঠিক আছে টিটিয়া খান, আপনার যুক্তি মতোই ভারতকে একটা হুমকি দিন। সেই সঙ্গে এটা নিয়ে দিন, এবারের যুদ্ধে আমরা একা নই। হুশিয়ার।
দুর্মুখঃ আপনার হুংকারে ভারত-সম্রাজ্ঞী একটু মুচকি হাসবে জনাব। বিশ্ব জানে আপনার ভীমরতি ধরেছে।
ফতেঃ দুর্মুখ খান! সিপাহসালার যুদ্ধের খবর বলুন।
সিপাহঃ আমাদের বীর সৈন্যরা বিদ্রোহীদের ভেঙ্গে দিয়েছে জনাবে আলা।
দুর্মুখঃ তা-ঠিক। তবে মাঝে মাঝে কমবকত বাঙালী ছেলে-ছোকরারা ঢাকার বুকে বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, গ্যাসঘাঁটি উড়িয়ে দিচ্ছে। শহর-গ্রামে রেললাইন সেতু, রাস্তাঘাট, সামরিক ছাউনী গুডুম-ফটাস হয়ে যাচ্ছে। জনাবের ভূড়িয়াল সৈন্যরা, পোষ্যপুত্রেরা মাঝে মাঝে জিব বার করছে। সে এমন কিছুই নয়। সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
ফতেঃ উফ। মাথাটা আবার ঘুরছে।
দুর্মুখঃ ঘাবড়াবেন না জাঁহাপনা। আপনার নতুন চালানের সামান্য কিছু সৈনিক বিদ্রোহ করলেও- সব ঠাণ্ডা, সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে জনাব।
ফতেঃ সত্যই কি সব স্বাভাবিক টিটিয়া খান?
সিপাহঃ আমার প্রতি বিশ্বাস রাখুন আলমপনা। ব্যবসা বানিজ্য চালু করতে পারলেই- ফতেঃ কেন? ওদেশের ব্যবসাদাররা দোকান খুলছে না?
দুর্মুখঃ সব ভাগল-বা জনাব।
সিপাহঃ তবে আমি নয়া এলান জারি করেছি জনাব। এক সপ্তাহের মধ্যে কেউ যদি তার দোকান না খোলে তাহলে সেই দোকানে আমরা নিজেদের লোক বসাবো।
নবাবঃ নিজেদের লোক মানে?
দুর্মুখঃ মানে জনাবের ওইসব জারজ সন্তানদের- মানে আর কি জনাবের খাস তালুকের খাস আদমীদের বসানো হবে।
নবাবঃ সে কি ভালো হবে টিটিয়া খান সাহেব?
সিপাহঃ ভালো-মন্দের বিচার এখন রাখুন। বাঁচার কথা ভাবুন নবাব সাহেব। ওই বিদ্রোহীদের শায়েস্তা না করা পর্যন্ত
ফতেঃ হ্যাঁ, বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করতেই হবে। ভেবেছিলাম বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করলে বিদ্রোহের আগুন নিভে যায়। কিন্তু আগুন আরও জ্বললো। এবাব বাঙ্গালীর দরদী বন্দুকে খতম করতে হবে। জীবন দিতে হবে।
দুর্মুখঃ জনাব, গোস্তাফি মাফ করবেন। বঙ্গবন্ধুকে খতম করলে বীর প্রসবিনী বাংলা বীরশন্য হবে না। আজ বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষ বঙ্গবন্ধু- প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা এক- একজন সিপাহসালার। কটা বঙ্গবন্ধুরে খতম করবেন জনাব? একটি মশাল থেকে আর একটি মশাল জ্বলে উঠেছে। হাজারো হাতের উদ্যত শাণিত তরবারী পিণ্ডির মসনদ লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। কি দিয়ে তাদের রুদ্ধ করবেন?
ফতেঃ স্তব্ধ হও- স্তব্ধ হও দুর্মুখ খান। এ কি! দরবার এতো অন্ধকার কেন? কিসের যেন আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি। কারা যেন এদিকে এগিয়ে আসছে। ঐ, ঐ- জনতার স্রোত, গলিত লাভা এদিকে ছুটে আসছে। আগুন, আগুন বন্ধ করো- সিংহদ্বার বন্ধ করো। আলো, আলো- আরও আরো জ্বেলে দাও। উঃ-
নবাবঃ জাহাপনা মূৰ্ছা গেছেন। পিণ্ডির মসনদ, তুমিও একদিন মুক্তিকামী জনতার পায়ের তলায় গুড়া হয়ে যাবে। মহাকাল, ইতিহাস- শুধু তোমরা সাক্ষী থেকো ।
১৪ নভেম্বর, ১৯৭১
নবাবঃ পিণ্ডির মসনদ, অপেক্ষা করো- আমি আসছি। তোমার কলঙ্কিত জীবনের হবে অবসান। আমার এতোদিন প্রতীক্ষার সেই শুভদিন সমাগত। অনাগত দিনে তুমি আমাকে পেয়ে প্রাণ পাবে- ধন্য হবে। যে করে যেমনভাবে হোক তোমাকে হোক তোমাকে আমার চাই।
ঈমানঃ (ইকো) হা-হা-হা- হা-হা-হা
নবাবঃ কে? কে?
ঈমানঃ সিন্ধুর কুলাঙ্গার-পাকজাঁহার বেঈমান লারকানার নবাবজাদা, সিংহাসনের পানে একদৃষ্টে চেয়ে কিসের সুখস্বপ্ন দেখছো?
নবাবঃ কে! কে তুমি অদৃশ্য পুরুষ?
ঈমানঃ (ইকো) আমি ঈমান। তুমি আমাকে চেনো না। কারণ বেঈমান, শয়তান তোমার দোস্ত। আমি ন্যায়, আমি সত্য, সুন্দর। আমি নিয়ম – আমি বিবেক- আমি মানবতা ! কোনদিন আমাকে চিনবার চেষ্টা করেছো কি?
নবাবঃ না। ওসব নিয়ে নির্লিপ্ত থাকার সময় আমার নেই। আমি আমার দেশের কথা ছাড়া-
ঈমানঃ (ইকো) দেশ! হা-হা-হা- সুন্দর শয়তান, মানুষ তোমাকে কতো রূপেই না দেখলো। দেশ! দেশের জন্য কি করেছো আর করছে তা একবার ভেবে দেখেছো কি! স্বার্থের নামী জুয়াড়ী তুমি। দেশকে জুয়ার বাজিতে এনেছো। দেশের মানুষকে ধোঁকা দিয়েছো। আসলে তুমি, পাকিস্তান সামরিক জুন্তার এর উগ্রদলের হাতের পুতুল। মিলিটারী ব্যুরোক্র্যাটদের রাজনৈতিক ভাড়াটে কণ্ঠ তুমি।
নবাবঃ না। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী- আমি গণতন্ত্র চাই।
ঈমানঃ (ইকো) মিথ্যা কথা। তুমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নও। ওটা তোমার পোশাকী কথা। তুমিই বলেছো, পাকিস্তানের হৃদপিণ্ড হচ্ছে পাঞ্জাব ও সিন্ধু। মানে পাঞ্জাবের সামরিক গোষ্ঠী। তুমি যদি সত্যই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হতে- তাহলে বলতে পাকিস্তানের প্রাণ তার জনগণ। আর সেই জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বাস বাংলায়। অতএব বাংলাদেশেই হচ্ছে পাকিস্তানের হৃদপিণ্ড।
নবাবঃ আমি স্বীকার করি না।
ঈমানঃ (ইকো) তা জানি। স্বীকার করার সৎসাহস তোমার নেই। কার এক অশুভ লগ্নে, রাজনীতিতে তোমার হাতেখড়ি। আর সে থেকেই তোমার পিপলস পার্টি জন্ম থেকেই সামরিক জুন্তার শক্তিশালী অংশের তাঁবেদার। আর আজ যে পিণ্ডির বাদশার মুখের পানে চেয়ে আছো- সেই বাদশাও সামরিক জুন্তার ভৃত্য মাত্র। আমি জানি, এই সামরিক গোষ্ঠীর অস্ত্র হিসাবে তুমি বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে ঝড় ডেকে আনলে- বাঙ্গালীর রক্ত নেবার জন্য পিণ্ডির বাদশাকে সহযোগিতা করলে।
নবাবঃ না-না- এসব মিথ্যা! আমি কারো খেলার পুতুল নই। আমি যা কিছু করছি- আমার দেশের স্বার্থের জন্য। বাংলার মানুষের ঔদ্ধতা আমি বরদাস্ত করিনি কোনদিন- করবোও না।
ঈমানঃ (ইকো) ক্ষমতালিঙ্গসু, অন্ধ তুমি। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হল, ক্ষমতার স্বাদ কেমন তা বুঝতে পারলে না। কতো রঙ্গই না দেখাচ্ছো। তুমি কি ভেবেছো, পিণ্ডির এই মসনদ কেল্লা ফতে খান সাগ্রহে তোমার হাতে তুলে দেবেন?
নবাবঃ শাহানশা ওয়াদা করেছেন।
ঈমানঃ (ইকো) ওয়াদা। বিশ্বের সেরা নরঘাতী দানবের ওয়াদা! চমৎকার। তাই বুঝি পিণ্ডির বাদশার পেয়াদা হয়ে পিকিং দৌড়েছিলেন ?
নবাবঃ অনেকটা তাই। কারণ বিশ্বের কোন বৃহৎশক্তির সমর্থন না পেলে মসনদ বিপদমুক্ত হবে না।
ঈমানঃ কিন্তু কি পেলে? চীনের নীতির পটপরিবর্তন দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছো নিশ্চয়ই? দেখলে তা চীন সরকার শুধুমাত্র তোমাদের দু’চারটি উপদেশ দিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন। তুমি ব্যর্থ হলে। এবার কি পিণ্ডির বাদশা তোমার প্রতি খুশী হয়ে মসনদের ভাগ দেবেন? তুমি ইনাম পাবে না।
নবাবঃ তোমরা সবাই অনাগত দিনের দিকে চেয়ে থাকো। এই মসনদ আমার হাতে আসবে। আমিই হবো এদেশের ভাবী প্রধান উজির।
ঈমানঃ অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে আছো লারকানার নবাবজাদা। সত্যিই তুমি যদি জননায়ক বলে দাবী করো, তাহলে কি ভেবেছো সৈরাচারী সামরিক গোষ্ঠী জননায়ককে পেয়ার করে? অসম্ভব। তুমি কি ভেবেছো, যে কেল্লা ফতে খান সামরিক গোষ্ঠীর প্রতীত সে মুখের কথায় মসনদ ত্যাগ করবে?
নবাবঃ যদি স্ব-ইচ্ছায় ওয়াদামতো কেল্লা ফতে খান মসনদ ত্যাগ না করে তাহলে আমি প্রতিহিংসার আগুনে গোটা পাক জাহান পুড়িয়ে দেবো।
ঈমানঃ জ্বলাময়ী ভাষা প্রয়োগ করতে ওস্তাদ লোক তুমি। কিছুদিন আগেই তো বাদশার সঙ্গে তোমার তীব্র মতপার্থক্য শুরু হল। তুমি প্রকাশ্যে অভিযোগ করলে- ‘জনগণের পরিষদ’ আহবান করবে বলে বাদশাকে হুশিয়ার করে দিলে- আবার সেই তুমি পোষা কুত্তার মতো পিকিং দৌড়ালে।
নবাবঃ এর পশ্চাতে রহস্য আছে।
ঈমানঃ বিচিত্র- বিশ্বের বিস্ময়। তোমাদের ২৩ বছরের রাজনীতির ইতিহাসের পৃষ্ঠগুলি রক্তে ভেজা। বিষাক্ত নিঃশ্বাসে ভরপুর তোমাদের অন্তর। তাই পাকিস্তানের রাজনীতির মঞ্চে তোমার প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে, এদেশের রাজনীতি চরম সঙ্কটের সম্মুখীন- এদেশের রাজনীতি পথভ্রষ্ট। তাই কোন বাদশা, কোন প্রজা তোমাকে সহ্য করতে পারে না। তুমি যেন ধূমকেতু। তুমি এক অশুভ ব্যক্তি।
নবাবঃ খামোশ! আমাকে তোমরা সবাই মিলে অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে চাইছো। কিন্তু না- পারবে না। আমার এতোদিনের আশা-পরিকল্পনাকে তোমরা ভেঙ্গে দিতে পারবে না।’
ঈমানঃ (ইকো) পঙ্গু-পরাজিত নায়ক, তুমি এখন মাঝ-দরিয়ার পাঁকে পড়েছো। তুমি তলিয়ে যাবে। যদি বাঁচতে চাও- তাহলে সাচ্চাইয়ের হাত ধরো।
নবাবঃ আমাকে প্রলোভন দেখিও না।
ঈমানঃ (ইকো) বেয়কুব, প্রলোভনের জন্যেই তো বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধিকার, গণতন্ত্রকে কামানের মুখে উড়িয়ে দিয়েছো- বাংলার রক্তগঙ্গা বইয়েছো- তোমার দেশের মানুষের জীবনকে নিয়ে স্বার্থের জুয়াখেলা শুরু করেছো। গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচার, ধোঁকাবাজি তোমার দেশের জনগণও আর সহ্য করবে না। সেখানেও বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠবে। সব স্বার্থ ভস্মীভূত হবে।
নবাবঃ আমাকে সুনির্দিষ্ট পথের সন্ধান তুমি দিতে পারো?
ঈমানঃ (ইকো) একটিই পথ। সেটা হচ্ছে সত্য-সুন্দরের পথ। শান্তি-সংহতি-সৌভ্রাতৃত্বের পথে অগ্রসর — হয়ে মানুষের অন্তরের গভীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো। গোটা বিশ্বের মানবকল্যাণে নিজেকে-
উৎসর্গ করো। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের হাত ধরে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে এসো। সাচ্চা দেশপ্রেমিক বলে নিজেকে চিহ্নিত করতে পারবে। গন্ডিমুক্ত হও- একলা চলো।
নবাবঃ কিন্তু কি করে সর্ব বাঁধনমুক্ত হবো আমি! আমি যে আমার গোটা সত্তাটাকে বন্ধক দিয়েছি। আমি মুক্ত হতে চাইলেও- সামরিক জুন্তা আমাকে মুক্তি দেবে না।
দুর্মুখঃ আরে নবাবজাদা, মসনদের সামনে বসে কি ভাবছেন? ও– নবাবজাদা
নবাবঃ কে! ও দুর্মুখ খান!
দুর্মুখঃ হা- খোদা! আজকাল থেকে থেকে অন্য জগতে চলে যাচ্ছেন নাকি!
নবাবঃ আচ্ছা দুর্মুখ খান, তুমি তো বিচক্ষণ ব্যক্তি। আচ্ছা বল তো দুর্মুখ খান, আমি যা কিছু করেছি ও করছি সবই কি স্বীয় স্বার্থের জন্যে?
দুর্মুখঃ দুষ্ট লোকে অবশ্য তাই বলে। ওরা বলে আপনিই নাকি স্বচ্ছ পানি ঘোলা করেছেন। আবার অনেকে বলে- আপনি নাকি মুশকিল আসান। ভেবে দেখুন, ভেঙ্গে-পড়া গদীহারা পিণ্ডির বাদশা বেকুব খান আপনাকে মুশকিল আসান হিসেবে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। পিকিং-এর সঙ্গে পাকিস্তানের দোস্তীয় বন্ধনে আপনি বেঁধে দিয়েছেন। আবার বাংলাকে কোতল করবার পরামর্শ দিয়ে মিলিটারী জুন্তার মুশকিল পথ বাতলে দিলেন। কিন্তু আমি ভাবছি নবাবজাদা, আপনি তো সকলের মুশকিল আসান- কিন্তু আপনার মুশকিল আসান কে করবে?
নবাবঃ তুমিও কি আমাকে বিদ্রুপ করছো দুর্মুখ খান?
দুর্মুখঃ তোবা-তোবা! আপনাকে নিয়ে বিদ্রুপ-এও কি সম্ভব! নবাবঃ ধিক্কার-বিদ্রুপ আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। যে পথটিকেও বেছে নিচ্ছি সে পথই আমাকে ধিক্কার দিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে। জানি না, অনাগত দিন আমাকে প্রতিষ্ঠিত করবে, না আমাকে
দুর্মুখঃ ইতিহাসের আবর্জনার স্তুপে নিক্ষেপ করবে। গোস্তাফি মাপ করবেন, শেষের টুকু আমিই বলে দিলাম। এ কি, কোথায় চললেন নবাবজাদা?
নবাবঃ এখানে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। একটু বাইরে থেকে আসি।
(Change over-Music)
।।দরবার।।
ফতেঃ একে একে সবাই আমাকে পরিত্যাগ করছে। সবাই আমাকে হুশিয়ার করে দিচ্ছে। সর্বশক্তিমান যে আগুন আমি জেলেছি মাশরেকী বাঙ্গালে, সেই আগুনের তাপ যেন পিণ্ডির দরবারে বসে পাচ্ছি। কিন্তু কি করবো আমি? অদৃশ্য হস্তের ইংগিতে আমাকে পৃথিবীর মানচিত্রের এক অংশে সুপরিকল্পিত উপায়ে আগুন জ্বালাতে হয়েছে। আমি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছি। উঃ ভাবতে পারছি না আর এই-কোই হ্যায়?
দুর্মুখঃ বান্দা হাজির জনাবে আলা। ফরমাইয়ে-
ফতেঃ দুর্মুখ খান! তুমি!
দুর্মুখঃ আমিই হাজির হলাম জনাব। আপনার হুকুম তামিল করার জন্যে কাউকে দেখলাম না।
ফতেঃ কমবকতদের আমি বিতাড়িত করবো।
দুর্মুখঃ এখন কে কার হুকুম তামিল করে জনাব। দরবার, হারেমের সকলের চোখেমুখে কেমন যেন হতাশা-কেমন যেন একটা প্রচ্ছন্ন আতঙ্ক-
ফতেঃ আতঙ্ক হতাশা! এই সব আতঙ্ক-হতাশাকে আমি গলা টিপে হত্যা করবো। যার কণ্ঠে শুনবো আমি হতাশার বাণী, তার জিবটা আমি ছিঁড়ে নেবো।
দুর্মুখঃ আপনার অন্তরের গোপনেও কি হতাশা নেই জনাব? ফতেঃ না নেই। আমি পাঠান কা বাচ্চা।
দুর্মুখঃ এই হুঙ্কার আপনার মুখের-মনের নয়। পাশ্চাত্য দেশগুলির সমর্থন হারানোর জ্বালা আপনার হৃদয়কে দগ্ধ করছে। আমেরিকা কর্তৃক অস্ত্র সাহায্য বন্ধ, চীনের পাল্টা সুর, মশরেকী বাঙ্গালের সেনাবাহিনীর হত মনোবল, মুক্তিবাহিনীর বিক্রম আপনাকে, ধীরে ধীরে হতাশা-নৈরাশ্যের অন্ধকারে নিক্ষেপ করছে।
ফতেঃ বন্ধুহীনতায় আমি কিছুটা দুর্বল হয়েছি সত্যি-নানারকম চাপ, হুমকির সম্মুখীন হয়ে আমি বিচলিত হয়েছি সত্য- আমার অগণিত সৈন্যদের মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করেছে সত্য-কিন্তু তাই বলে মাথা নীচু করে বিশ্বের দরবারে বিচারাধীন হতে আমি রাজী নই। এ পরাজয় আমার আত্মহত্যার শামিল।
দুর্মুখঃ কিন্তু জনাব, এখনও কি ভেবেছেন বাংলা মুলুকে আপনার রাজ কায়েম রাখতে পারবেন?
ফতেঃ হ্যাঁ পারবো। প্রয়োজন হলে বাংলার প্রতিটি ঘরকে আমি ভস্মস্তুপে পরিণত করবো- বাংলার মানুষের লাশে ওদের নদীর বুক ভরে যাবে। তবু —তবু বাংলার জমিন আমি ছাড়বো না।
দুর্মুখঃ হাসালেন-নিতান্তই হাসালেন। আপনি কি আর ছাড়বেন- ওরা ছাড়িয়ে নেবে।
ফতেঃ দুর্মুখ খান।
দুর্মুখঃ হ্যাঁ জনাব। পিণ্ডিতে বসে বাংলার খবর কতোটুকু একবার যান না বাংলায়! আপনার সৈন্যদের মাঝে গিয়ে একবার দাঁড়ান। তাদের আশা দিন, ভরসা দিন।
ফতেঃ বাংলায় যাবার আমি প্রয়োজন মনে করি না।
দুর্মুখঃ বলুন বাংলায় যাবার সৌভাগ্য আর হবে না। ২৫শে মার্চে নিশ্চয় “হে বাংলা বিদায়-চিরবিদায়” বলে সেলাম জানিয়ে চলে এসেছেন?
ফতেঃ দুর্মুখ খান! তমিজ-সে বাত করো। বাংলায় যাবার সময় হলেই যাবো।
দুর্মুখঃ সেই ভালো। কারণ খতরনাক স্থানে বুঝে-সুঝে সাবধানে যাওয়াই মঙ্গল। কোথায় মাইন পাতা আছে, ঘুপ-ঘাপ কোথায় বোমা পড়ছে বলা যায় না। এই দেখুন- খবরে প্রকাশ, আপনার ভাবী পুতুল সরকারের একটা পুতুলকে মুক্তিবাহিনী বোমের ঘায়ে খতম করেছে। অশান্তি কমিটির
কয়েকজন চামুণ্ডাও আচমকা মারে পটল তুলেছে। ত্রিপুরা- নোয়াখালীতে আপনার জেট বিমান দিয়েও বিদ্রোহীদের কাত
করা যাচ্ছে না।
ফতেঃ মরুক-মরতে দাও ওদের। ওদের স্থানে আর একটি পুতুল খরিদ করতে আমার বেশী কষ্ট হবে না।
দুর্মুখঃ আরও খবর আছে। চাঁদপুরে অস্ত্র বোঝাই একটা মার্কিন জাহাজ বাংলার নৌ-কমাণ্ডোরা ডুবিয়ে দিয়েছে। গোদের উপর বিষফোঁড়া।
ফতেঃ তোমার এই কথাগুলো যেন মনে হচ্ছে আমার কানে গলিত সীসা ঢেলে দিচ্ছে। কতোগুলো অপদার্থের ওপর বাঙ্গাল মুলুকের দায়িত্ব দিয়েছি।
দুর্মুখঃ সৈন্যদের আর অপরাধ কি? তারা লড়ছে-মরছে। আর আহত সৈনিকরা চিকিৎসার অভাবে প্রাণ দিচ্ছে। এই ধরুন না, মেহেরপুরে আমাদের সৈন্যদের উপর বিদ্রোহীরা তিন দিক থেকে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করল। আরও চমকপ্রদ খবর আছে জনাব। আপনার পোষ্যপুত্র নবাবজাদা একটুর জন্যে রক্ষা পেয়েছেন।
নবাবঃ বন্দেগী খাঁ সাহেব।
দুর্মুখঃ আসুন নবাবজাদা, জাঁহাপনাকে একটু সান্তুনা দিন।
নবাবঃ আমি আর কি সান্তনা দেবো- কি ভরসা দেবো দুর্মুখ? একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অন্ধকারে আমরা নিমজ্জিত। মার্কিনীরা অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করল। ফ্রান্স, যুগোশ্লাভিয়া, কানাডা সকলেই বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান দাবী করছে।
ফতেঃ দাবী! কিসের দাবী! কারও কোন দাবী-কোন আব্দার আমি বরদাস্ত করবো না। আমি জানি আমি বন্ধুহীন-আমি নিঃসঙ্গ। কিন্তু এর শেষ আমি দেখতে চাই। নবাবঃ তবে খাঁ সাহেব, আমাদের চীনা বন্ধুরা-
ফতেঃ থামুন থামুন। চীনা বন্ধু! কি আশ্বাস নিয়ে এলেন আপনি চীনা দোস্তদের কাছ থেকে? নৈরাজ্য কিছু উপদেশ আর কিছু সান্তনা ছাড়া চীনা দোস্তরা কি দিয়েছে আপনাকে?
দুর্মুখঃ চীন বলেছে বাংলাদেশের সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান করে নিতে। আরে বাবা, নবাবজাদা কতো কাঠখড়ি, পুড়িয়ে, পাক-জাহার ভাবী পেরধান মন্ত্রী হবার আশ্বাস নিয়ে চীনে গেলেন অস্ত্র আর মদত আনতে। চীনা সাহেবদের হৃদয়ে কি নবাবজাদার জন্য এতটুকু করুণা-
ফতেঃ স্তব্ধ হও দুর্মুখ খান। খাঁ-সাহেব, চীন যে এভাবে আমাদের নিরাশ করবে তা ভাবতে পারিনি।
দুর্মুখঃ কপালে যখন আগুন লাগে-তখন তুষের আগুনের মতোই জ্বলতে থাকে।
ফতেঃ হ্যাঁ ঠিকই বলেছো দুর্মুখ খান! অথচ ক্ষমতা নেবার জন্য সকলের লোলুপ জিহবা মসনদটাকে গ্রাস করার জন্য ব্যস্ত।
নবাবঃ আপনার এই উক্তি কার প্রতি খাঁ-সাহেব?
ফতেঃ আপনাদের প্রতি নবাবজাদা। মসনদের ভাগ নেবার জন্য একদিকে শক্তিশালী সামরিক জুন্তা, অন্যদিকে আপনি, আপনি, নুরুল আমিন, দৌলতানা, কায়ুম প্রভৃতি।
নবাবঃ চীন সফরের পূর্বে আপনি আমার নিকট কি ওয়াদা করেছেন আশা করি ভুলে যান নি।
ফতেঃ না-না-ভুলে যাইনি-যাবো না। আমি বিদায় নেবার পূর্বে মসনদটাকে টুকরো করে আপনাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়ে যাবো। আমি ষোল আনা বুঝে দিয়ে যাবো।
দুর্মুখঃ কবে সেই দুদিন আসবে জনাব?
ফতেঃ জানি না। বুঝলেন নবাবজাদা, বড় আশা করেছিলাম আপনাদের নিয়ে-তাই আজ আমার এই পরিণতি। বড় আশা করেছিলাম টিটিয়া, পিয়াজী, দান্দাল গভর্নরকে নিয়ে-বড় আশা করেছিলাম আমাদের দুদিনে একমাত্র দোস্ত চীন অন্তত নিঃসন্দেহে আমাদের সক্রিয় সমর্থন জানাবে। ব্যর্থআপনি ব্যর্থ নবাবজাদা!
নবাবঃ এখন থেকে আমাদের অন্য কারও ওপর ভরসা না করা বাঞ্ছনীয়!
ফতেঃ চীনের প্রতি আমার দৃড়বিশ্বাস ছিল বলেই আমি বড় মুখ করে বলেছিলাম –
দুর্মুখঃ সে মুখ এভাবে ভোঁতা হবে তা কি জানতেন? চীনে নবাবজাদার প্রতি চীনা ছাত্রদের বিক্ষোভ রীতিমত অপমানকর। যে দেশে বিক্ষোভ, প্রদর্শনী, মিছিলের জন্য সরকারী অনুমতি লাগে, সে দেশে এই বিক্ষোভ প্রদর্শন সরকারের সমর্থন ও অনুমতিতেই হয়েছে।
ফতেঃ চীনও শেষে কি দোস্তের প্রতি অবিচার করবে?
নবাবঃ খাঁ সাহেব, এখন থেকে বিদেশী রাষ্ট্রগুলো সম্বন্ধে সংযত উক্তি করাই বাঞ্ছনীয়। মনে রাখবেন আমরা ধীরে ধীরে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছি-নিন্দিত হচ্ছি ।
ফতেঃ তবু আমি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে চাই। বন্ধুহীন, অসহায়, রিক্ত আমি। তবু আমি মরণ ছোবল দেবো। এ ছাড়া কোন উপায়, কোন পথ নেই নবাবজাদা। চরম অবস্থার সম্মুখীন আমি।
দুর্মুখঃ সামনে অন্ধকার-পেছনে অতল গহবর। ইতিহাস তুমি লিখে যাও-মহাকাল তুমি দেখে যাও-বন্য পশু কিভাবে মরণ গহবরে তলিয়ে যায়। বিশ্ববাসী তোমরা প্রত্যক্ষ করো, কেমনভাবে সত্যের অগ্নিতে মিথ্যার মৃত্যু ঘটে।
।।জয় বাংলা।।
(রচনাঃ কল্যাণ মিত্র। অংশগ্রহণেঃ রাজু আহমেদ, নারায়ণ ঘোষ (মিতা), নাজমুল হুদা মিঠু, প্রসেনজিং বোস, অমিতাভ বোস, জহুরুল হক, ইফতেখারুল আলম, বুলবুল মহলানবীশ, করুণা রায় প্রমুখ।)