স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সম্পর্কিত কয়েকটি প্রতিবেদন

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৫। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত কয়েকটি প্রতিবেদন —————— …… ১৯৭১

১. মুক্তিকামী বাঙালীর প্রেরণার উৎস

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

আতিকুর রহমান

ইথারে ভেসে আসা শব্দ যে বুলেটের চেয়েও প্রচণ্ডতম শক্তি নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হানতে পারে তার প্রমাণ হচ্ছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্ৰ। ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে টিক্কা-নিয়াজী-ফরমান আলীর বীর পশুরা সেদিন বুলেট-বেয়োনেট দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হাতিয়ারের চেয়ে শক্তিশালী আঘাত হেনেছে নরপশুদের বিরুদ্ধে।

 ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানী বাহিনী মরণ ছোবল হেনেছিল। শহর-বন্দরগ্রামকে রক্তে রঞ্জিত করেছিল। সেই আঘাতে হকচকিত বাংলার মানুষ পরদিন ২৬শে মার্চ বেতারে শ্রুত একটি বাণীতে খুঁজে পেয়েছিলেন আশার বাণী। সে বাণী ছিল স্বাধীনতার, হানাদারদের কবল থেকে মুক্তির। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে এই বেতার বাঙ্গালীদের যুগিয়েছে উৎসাহ-উদ্দীপনা, দেশকে মুক্ত করার প্রেরণা।

বিপ্লবী বীর সূর্যসেনের স্মৃতিতে উজ্জ্বল চট্টলার বুক থেকেই সেদিন বেতারে হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা। আর কালুরঘাটস্থ পাকিস্তানী বেতারের ট্রান্সমিশন কেন্দ্র থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে পৌছানো হয়েছিল স্বাধীনতার সে বাণী। ২৬শে মার্চ জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

২৫শে মার্চ রাতে হানাদার হায়েনার দল হত্যাযজ্ঞ শুরু করার পর ২৬শে মার্চ সকাল থেকে চট্টগ্রাম বেতারের সকল কর্মচারী কাজ বন্ধ করে নিয়েছিলেন। ব্রডকাষ্টিং যন্ত্রপাতি সরিয়ে রেখেছিলেন যাতে হানাদার বাহিনী প্রয়োজনবশত অবিলম্বে বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার শুরু করতে না পারে। ঢাকা বেতারও সেদিন নীরব ছিল।

চট্টগ্রামের কিছু সংখ্যক দেশপ্রেমিক সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু চালু করেছিলেন তাঁরা সকল প্রকার ঝুকিঁ নিয়ে।

২৬শে মার্চ দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য একবার চট্টগ্রাম বেতার থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে হানাদার বাহিনীকে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান প্রচারিত হয়েছিল।

সংগঠিতভাবে না হলেও সেদিনই সন্ধ্যায় আরেকদল কর্মী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ বলে পরিচয় দিয়ে প্রচার শুরু করেছিলেন। ২৭শে মার্চ এই কেন্দ্র থেকে মেজর (বর্তমান লেঃ কর্নেল) জিয়াউর রহমান জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।

এই কেন্দ্র থেকেই ২৮শে মার্চ মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত হামলা চালিয়ে ঢাকায় টিক্কা খানকে হত্যা করেছে বলে প্রচার করা হয়। সত্য না হলেও জনগণের হৃদয়ে আশা ও উদ্দীপনা সঞ্চারের জন্য বেতার কর্মীরা সুপরিকল্পিতভাবে এ কাজ সেদিন করেছিলেন।

দুই ভাগে বিচ্ছিন্নভাবে এজন্য প্রচেষ্টা চলেছিল। প্রথম দিনে দুপুরে সামান্যক্ষণ অনুষ্ঠান প্রচারকালে গণপরিষদ সদস্য জনাব এম, এ, হান্নান হানাদারদের রুখে দাঁড়াবার আহবান জানিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন। আর এই অনুষ্ঠান প্রচারে সহযোগিতা করেছে চট্টগ্রাম বেতারের ইঞ্জিনিয়ার মীর্জা নাসির, জনাব আবদুস সোবহান, চট্টগ্রাম কাষ্টম বিভাগের জনাব আবদুল হালিম, একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জনাব এম, এ, মাসেম প্রমুখ।

সেদিন সন্ধ্যায় দ্বিতীয় অনুষ্ঠান প্রচারের সাথে জড়িত বেতার কর্মিগণ ৩০শে মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে এই প্রচার চালু রেখেছিলেন। সেসব বেতার কর্মীর অনেকেই শেষ পর্যন্ত মুজিবনগর থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করেছেন।

আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকার ডাঃ সৈয়দ আনোয়ার আলীর বাসভবনে জমায়েত হয়েছিলেন দেশপ্রেমিক কয়েকজন ব্যক্তি। নেপথ্যে শুরু হয়েছিল অপর প্রচেষ্টা। ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার জনাব আসিকুল ইসলামের গাড়ীতে (চট্টগ্রাম ট-৯৬১৫) সেদিন ডাঃ আনোয়ার আলী, জনাব ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার দিলীপ চন্দ্র দাস, চট্টগ্রাম বেতারের ঘোষিকা কাজী হোসনে আরা সবাই ছুটে গিয়েছিলেন আগ্রাবাদস্থ ব্রডকাষ্টিং হাউসে। আরেকদিক থেকে চট্টগ্রাম বেতারের কমী জনাব বেলাল মোহাম্মদ, জনাব আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, জনাব মাহবুব হাসান একই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রডকাস্টিং হাউসে পৌছেন। সমবেত প্রচেষ্টার ফল ফলে সেদিন সন্ধ্যায়।

সেই কর্মীদের দল আবার একত্রে কালুরঘাট পৌঁছেন। খবর পেয়ে কাজে যোগ দিয়েছিলেন টেকনিশিয়ান ও প্রোগ্রাম প্রডিউসার কয়েকজন।

রাত সাড়ে সাতটার দিকে ট্রান্সমিশন কেন্দ্রের একটি কক্ষকে ষ্টুডিও হিসাবে ব্যবহার করে জনাব আবুল কাসেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় মুক্তির নবতম হাতিয়ারের ব্যবহার।

প্রথমেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা করে টেলিগ্রামের বাংলা ও ইংরেজী তর্জমা প্রচার করা হয়েছিল। ইংরেজী থেকে তর্জমা করেছিলেন ডঃ মঞ্জলা আনোয়ার। ইংরেজীতে ঘোষণাটি পড়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার জনাব আশিকুল ইসলাম। এই ঘোষণায় বাঙালী জাতি উদ্বুদ্ধ হয়নি শুধু- বাঙ্গালী জাতি যে স্বাধীন হবেই সে আশায় উদ্দীপ্ত হয়েছিল।

আধ ঘণ্টার মত প্রচারকালে আওয়ামী লীগ নেতা জনাব হান্নান ও বয়োবৃদ্ধ কবি আবদুস সালাম কথিকা পাঠ করেছেন। সেদিনের ঘোষণায় কণ্ঠ দিয়েছেন কাজী হোসনে আরা।

৩০শে মার্চ পর্যন্ত বেতার কর্মীরা অনিয়মিত হলেও অনুষ্ঠান প্রচার করেছেন। ৩০শে মার্চ হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে প্রথম বিমান হামলা চালায়। আর তা ছিল কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে। স্যাবর বিমান থেকে রকেট নিক্ষেপ করে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল ইথারের ভাষা।

পরে বেতার কর্মীরা স্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। ধীরে ধীরে তখন মুজিবনগরে গড়ে উঠেছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চট্টগ্রামের বীর সন্তানদের পথ ধরেই। সেদিনের অনেক কর্মী পরে সেখানে যোগ দেন।

চট্টগ্রামের বিদ্রোহী বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় পঞ্চাশজন যোদ্ধা বেতার কেন্দ্র রক্ষার দায়িত্বে থেকে সেই কয়দিন অক্নান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন অনুষ্ঠান চালু রাখার।

‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তখনকার অনুষ্ঠান প্রচারে জড়িত ছিলেন এ ছাড়াও প্রোগ্রাম শাকের, টেকনিক্যাল এসিসট্যান্ট জনাব রশিদুল হাসান ও জনাব আমিনুর রহমান, টেকনিক্যাল অপারেটর জনাব রেজাউল করিম চৌধুরী, জনাব শরফুজ্জামান ও কাজী হাবিবউদ্দিন আহমদ।

সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছেন জনাব এ, কে খানের দুই ভাইপো সেকান্দর ও হারুন।

অন্যান্য ভূমিকা পালন করেছেন। মেকানিক শফুর। প্রথমে ড্রাইভার হিসেবে চাকুরী নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরে অভিজ্ঞতার জন্য মেকানিক হিসেবে নিয়োজিত হয়েছিলেন। শত অনভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তার অদম্য প্রেরণা ও প্রচেষ্টায় একদিন অনুষ্ঠান প্রচার সম্ভব হয়েছিল।

-দৈনিক ‘পূর্বদেশ, ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭২

২, বেতার-মুক্তি সংগ্রামে*

বেলাল মোহাম্মদ

এই তথ্য-নিবন্ধ নির্মাণোদ্যত হয়ে প্রথমেই যে বিবেচনা বোধ করছি, তা হচ্ছে, ইতিহাস দুই কারণে বিকৃত হতে পারে। এক, প্রণেতার স্মৃতি বিপত্তি, যার কারণ কালবিলম্ব না করে লিপিবদ্ধকরণের পরিবেশের অপ্রতুলতা। দুই, অবস্থা গতিকে না ব্যক্তিগত দলগত স্বার্থে কোনো কোনো তথ্য গোপন বা অব্যক্ত আবশ্যকতা। এই শেষোক্ত কারণে অনেক সময় কোন বক্তব্য বিষয়কে বিকৃত না করলেও সীমাবদ্ধতা দিয়ে ক্ষুন্ন করতে পারে বেশ খানিকটা, অনেক কথাই স্মৃতিতে অম্লান হওয়া সত্ত্বেও সর্বমুহুর্তে প্রকাশ করা যায় না।

গোড়াতেই সবিনয়ে একটি কতা বলে রাখতে চাই, যে বিষয়ের আমি প্রত্যক্ষ কর্মবিবরণ লিপিবদ্ধ করতে বসেছি, আমার সহকর্মীরা অনেকেই বর্তমান আছেন যারা এটি পাঠ করবেন এবং আমার ভ্রমের জন্য বা দৃষ্টি বৈচিত্র্য ও উপলব্ধির বিভ্রমের জন্য তাদের কারো কাছে এখানে বর্ণিত কোনো তথ্যকে অস্বস্তিকর আপত্তিকর বিবেচিত হলে তা যেন ব্যক্তিগত ভুল বোঝাবুঝির বা অসন্তুষ্টির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে একজন সাংবাদিক যখন কোন সংবাদ সরঞ্জাম প্রত্যক্ষদশী হিসেবে সংগ্রহ করেন, তখন তিনি ঘটনা পরম্পরার সঙ্গে স্বয়ং জড়িত না হয়ে তৃতীয় ব্যক্তিত্বের ভূমিকা গ্রহণ করেন। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পটভূমিকা লিখতে গিয়ে আমরা স্বকীয় নগণ্য প্রয়াসকে ও সামগ্রিক সংগ্রামসূচী ও সংগ্রামী কার্যক্রমের সংগে সংযুক্ত করতে বিশেষভাবে প্রলুব্ধ হই। এটি একটি সংগ্রামী জাতির অস্তিত্বের সংগে একটি ব্যক্তিজীবনের কর্মময়।


*একই শিরোনামে ১৯৭৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে বেতার বাংলা’র বিজয় দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত বেলাল মোহাম্মদ-এর প্রতিবেদন দ্রষ্টব্য।

.

সময়ে সঙ্গত কারণেই আমরা সবাই অসম্ভব রকম জাতীয় সঙ্কীর্ণতায় আক্রান্ত বলেই নিবন্ধের গৌরচন্দ্রিকা আকারে এতো কথা বলতে হলো।

এবার আরম্ভেরও প্রারম্ভিক হিসেবে বলতে হচ্ছে, একটা বিষয় রহস্যাবৃত থাকা পর্যন্ত তাই নিয়ে বিচিত্র বিক্ষিপ্ত জল্পনা-কল্পনারও যেমন অবকাশ আছে, তেমন অবকাশ আছে নানা রকম রটনার এবং নানা জনের ব্যক্তিগত কৃতিত্ব প্রকাশের সুযোগ-সুবিধার।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ইতিমধ্যেই একটি বহুবিতর্কিত জটিল প্রসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে একজন নগণ্য বেতার কর্মী হিসেবে আমার সর্বসময়ের বক্তব্য হচ্ছে, স্বধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার একক কৃতিত্ব কারুরই নেই। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে পারেন। তবে একথা নিদ্বিধায় বলা যায় বেতার বিভাগীয় কর্মীরাই আলোচ্য কেন্দ্রটি চালু করেছেন-সেটা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই হোক কিংবা হোক রাজনৈতিক কর্মীদের প্রভাবে বা সহযোগিতায়। কেননা, বেতার মাইকের সামনে শব্দনিক্ষেপণ এবং শব্দকে ইথারে উৎক্ষেপন এই দুই কর্মই বেতারের অনুষ্ঠান ও প্রকৌশল বিভাগীয় কর্মীগণ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়া ২৫শে মার্চ, ৭১- এর পূর্বহ্নে বঙ্গবন্ধু আহুত অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে আমাদের বেতার কেন্দ্রগুলো দখলদার সরকারের সঙ্গে সত্যিকার অসহযোগিতা প্রদর্শনে উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল- তারই নিদর্শন হচ্ছে ‘রেডিও পাকিস্তান’ – নাম ঘোষণাটি সম্পূর্ণ বর্জন করে প্রত্যেক আঞ্চলিক কেন্দ্র নিজ নিজ আঞ্চলিক নাম ঘোষণা শুরু করেছিল, যেমন, ঢাকা বেতার কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র ইত্যাদি। প্রত্যেক বেতার কেন্দ্রেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছিল বাঙালী কর্মীদের সমন্বয় সংগ্রাম কমিটি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের ভাষণটি চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকেই প্রথম ৭ই মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় প্রচার করা হয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ১৫ই মার্চ, ৭১ স্থানীয় লালদীঘির ময়দানে অভিনীত গণনাটক মমতাজউদ্দীনের রচিত ‘এবারের সংগ্রাম”- এর রেকর্ড ১৭ই মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে বাজানো হয়েছিল। বেতার তথা সরকারী কর্মচারীদের কানে নিত্যই বাজাতো একটি বজ্ৰকণ্ঠের বাণীঃ বাঙালীর স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ তোমাদের করতে বলা হলে তোমরা অফিস বন্ধ করে দেবে।

ঠিক তা-ই করেছিলাম ২৬শে মার্চ, ৭১ সকালবেলা চট্টগ্রাম বেতারের কর্মীরা। প্রথম অধিবেশনের শেষাংশে যে মুহুর্তে বেতারের তখনকার প্রাদেশিক অনুষ্ঠানের সামরিক প্রশাসক প্রবর্তিত বিধানের প্রারম্ভিক ঘোষণা প্রচার করা হয়েছিল সেই মুহুর্তে উপস্থিত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছিল। আমাদের কর্মীরা বেতার ভবন ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন।

তার পরের ঘটনাগুলো অসম্ভব রকম স্বতঃস্ফূর্ত, অসম্ভব রকম বিচিত্র-বিক্ষিপ্ত। বিচিত্র কি, তখন আমাদের অনুষ্ঠানের শ্রোতারাও এরকম কিছু একটা ভাবতে পারেন, এখন যদি বেতারের বাঙালিদের সংগ্রামের সপক্ষে কিছু প্রচার করা যেতো।

বস্তুতঃ অনুরূপ চিন্তা-ভাবনা থেকেই চট্টগ্রাম বেতারের ট্রান্সমিটারে বিভিন্ন পর্যায়ে একই দিনে ২৬শে মার্চ, ৭১ তিনবার স্বল্পকাল স্থায়ী তিনটি অধিবেশন প্রচারিত হয়। একবার বেলা ২ টা বেজে ৭ মিনিট আর একবার সন্ধ্যা ৭ টা বেজে ৩৫ মিনিটে এবং আর একবার রাত ১০ টায়। বস্তুতঃ এই তিনটি ঘটনাই অসম্ভব রকম বিক্ষিপ্ত এবং এগুলোর উদ্যোগ-আয়োজনও ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত- দেশে দখলদার সামরিক বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণাত্মক তৎপরতার বিরুদ্ধে যেমন সেদিন সর্বত্র গড়ে উঠেছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ, এগুলোও ঠিক তেমনি।

দ্বিপ্রহরের অধিবেশনটির আমি প্রত্যক্ষদশী বা শ্রোতা নই। কিন্তু পরবর্তীকালে জেনেছিলাম, সেটির উদ্যোক্তা ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জনাব এম এ হান্নান। তিনি ও তার দলের সহকর্মীরা আমাদের কয়েকজন প্রকৌশলীকে নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে ট্রান্সমিটার ভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং ট্রান্সমিটার চালু করিয়েছিলেন। অধিবেশনটিতে ঘোষণা হিসেবে জনাব হান্নানের নাম ও বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল এবং জনাব হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে পাঁচ মিনিট ভাষণ প্রচার করেছিলেন। অধিবেশনের স্থিতিকালও ছিল ছয় থেকে সাত মিনিট।

জনাব হান্নানের প্রভাবে যেসব বেতারকর্মী/প্রকৌশলী ট্রান্সমিটার চালু করেছিলেন, তাঁর পরে আর এমুখো হননি-অধিকন্তু পরবর্তীকালে পাকিস্তান বেতারে কাজ করেছিলাম।

সন্ধ্যা৭টা বেজে ৩৫ মিনিটে যে অধিবেশন প্রচার করা হয় সেটার উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলাম আমি। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র নামটি আমিই অন্যতম সহকারী আবুল কাসেম সন্দ্বীপের সঙ্গে আলোচনাক্রমে স্থির এবং অনুমোদন করেছিলাম।

২৬ শে মার্চ, ৭১ সকালবেলা সহসা যখন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র নীরব হয়ে গিয়েছিল, তখন আমি ছিলাম এনায়েত বাজারে দন্তচিকিৎসক মোহাম্মদ শফীর বাড়িতে। তখনই আমার মনে এসেছিল, এখন যদি কিছু একটা করা যেতো! যেটা একজন অসহযোগকারী বাঙালীর জন্যে অত্যান্ত স্বাভাবিক, আগেই বলেছি। মনের কথাটা সে মুহুর্তে আমি শুধু বেগম মুশতার শফীকে বলেছিলাম- তিনি উৎসাহ দিয়েছিলেন।

প্রথমেই আমি গিয়েছিলাম ষ্টেশন রোডের রেষ্ট হাউসে আওয়ামী লীগ অফিসে- নেতৃবৃন্দের অনুমোদন নিয়ে যদি পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত করা যায়। পরিচিত কারো সঙ্গেই সেখানে আমার দেখা হয়নি। আমি শুধু নিজের নাম-পরিচয় দিয়ে সেখানে অন্যভাবে অসম্ভব রকম কর্মব্যস্ত দু’একজন কর্মীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়াস করেছিলাম। তখন সেখানে অস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছিল। সেখানেই দেখা হয়েছিল অধ্যাপক মমতাজউদ্দীনের সঙ্গে। মমতাজ আমার প্রস্তাব/ পরিকল্পনা শুনেই নিদ্বিধায় সহযোগী হয়েছিলেন এবং নিজের প্রভাবে আওয়ামী লীগ কর্মী এডভোকেট রফিকের কাছ থেকে একখানা জীপ চেয়ে নিয়েছিলেন। আমাদের প্রাথমিক প্রস্তুতি প্রসঙ্গটি ছিল আগ্রাবাদ বেতার ভবন এবং কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবন এ দুটি এলাকাকে পর্যপ্ত সংখ্যক সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বা বাঙালী সৈন্য সমাবেশে সংরক্ষিত করা। আমরা দুজন জীপে করে রেলওয়ে বিল্ডিং- এর পাহাড়ে ইপিআর হেড কোয়ার্টার্সে কমাণ্ডার রফিকের কাছে গিয়েছিলাম। তখন বেলা ২ টা কমাণ্ডার আধ ঘণ্টার মধ্যে বেতার ভবনে ২০ জন এবং ট্রান্সমিটারে ১৫ জন ইপিআর পাঠিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আশ্বস্ত হয়ে আমরা রাবেয়া খাতুন লেনে মাহবুব হাসানের বাড়ীতে গিয়েছিলাম। মাহবুব হাসান বেতার নাটকের শিল্পী- প্রযোজক হিসেবে চট্টগ্রাম বেতারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট, আমাদের প্রকৌশলীদের অনেকের সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব। তার সহায়তায় প্রকৌশলিক প্রস্তুতি সম্পাদন আমার উদ্দেশ্য ছিল।

এবার আমরা তিনজন জীপে করে চকবাজার এলাকার বাসিন্দা আমাদের বেতারের দুজন প্রকৌশলীর কাছে গিয়েছিলাম। তারা শর্ত আরোপ করেছিলেনঃ তারা কাজ করবেন, তবে এক, আঞ্চলিক প্রকৌশলীর লিখিত অনুমতি নিতে হবে অথবা দুই, এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেন তারা বাধ্য হয়ে প্রস্তাবিত কাজটি করেছিলেন- অনিশ্চিত ভবিষ্যতে যেন তাদের বিপদ না হয়। বেশ তো! দ্বিতীয় শর্তে আমরা মেনে নিয়েছিলাম। কেননা তখন যে কোন মুহুর্তে কমাণ্ডার রফিকের বাহিনী এসে পড়বে বলে আমরা আশা করেছিলাম। করেছিলাম।

প্রকৌশলী দুজনকে ট্রান্সমিটার ভবনে নামিয়ে দিয়ে আমরা তিনজন বেতার ভবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম। পথে কলেজ রোডে পৌঁছে মমতাজউদ্দীন বললেনঃ আচ্ছা, ভালো কথা, আমরা কিন্তু কি প্রচার

করবো সেটা একটুও চিন্তাভাবনা করছি না। এক কাজ করা যাক আমি এখানেই নেমে পড়ি এক্সটেম্পোর (তাৎক্ষণিক) কিছু বলতে পারবেন এরকম দু-একজনকে সঙ্গে নিয়ে শিগগিরিই আগ্রাবাদ গিয়ে আপনাদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছি।

সেদিন মমতাজউদ্দীন আর আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেননি। এখন আমি আর মাহবুব হাসান- আমরা আগ্রাবাদ রোডে জেকস এর সামনে এসে জীপ ছেড়ে দিয়েছিলাম- গাড়ী আর যাবে না, এখানে ছিল ব্যারিকেড। হেঁটে জনশূন্য বেতার ভবনে পৌঁছেই মাহবুব হাসান কন্ট্রোল রুমের সূইচ অন করেছিলেন। এমন সময় টেলিফোন ট্রান্সমিটার থেকে প্রকৌশলী বন্ধুরা মাহবুব হাসানকে জানিয়েছিলেন তারা অনুষ্ঠান এয়ার’-এ দিতে পারবেন না। কেননা ইতিমধ্যেই তারা আঞ্চলিক প্রকৌশলির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি সম্মতি দেননি- কাজেই তারা ট্রান্সমিটার ভবন ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আমি টেলিফোন ধরলাম। বলেছিলাম আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, আপনাদের দুই শর্তের একটি কর্যকারী হবে।

মাহাবুব হাসান আঞ্চলিক প্রকৌশলীর বাসার নম্বরে ডায়াল করে রিসিভার আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আঞ্চলিক প্রকৌশলী ঠিক এ কথাটি বলেছিলেন। বেলাল সাহেব আমাকে কেন জড়াচ্ছেন। বেতার কেন্দ্রে আমি তো দু’নম্বর। আপনি বরং নাজমুল আলম সাহেবের পারমিশন নিন। দুপুর বেলা হান্নান সাহেব জোর করে নিয়ে গিয়ে আমাদের হাতে কাজ করালেন, তার জন্য কি যে বিপদ আসে, আমি সত্যি ভয় পাচ্ছি।

আমি বলছিলাম- আর ডি সাহেবের বাসায় তো টেলিফোন নেই, ওর সঙ্গে কি করে যোগাযোগ করবো। তিনি বললেনঃ আলম সাহেব এখন আর ডি কাহহার সাহেবের বাসায়। ওখানে টেলিফোন করুন।

ঠিক সে সময় আমার খোঁজে এনায়েতবাজার থেকে আবুল কাসেম সন্দ্বীপ ও আবদুল্লাহ আল ফারুক বেতার ভবনে এসে পৌছেছিলেন। জনাব কাহহারের বাসায় টেলিফোন করে আমি কাসেমকে কথা বলতে দিয়েছিলাম। নাজমুল আলম সাহেব ওখানে আছেন কিনা এটাই জেনে নিতে বলেছিলাম। ওদিক থেকে এই অনুসন্ধানের কারণ জানতে চাওয়া হলে কাসেম আমার কথা বলেছিলেন। স্বাভিকভাবেই রিসিভার আমার হাতে এসে গিয়েছিল।

নাজমুল আলমের সঙ্গে আলোচনা করে আবদুল কাহহার আমাকে যা বলেছিলেন, তা সংক্ষেপে, বেতার ভবন বন্দরে নোঙ্গর করা পাকিস্তনী যুদ্ধজাহাজ বাবর’ সোয়াত-এর শেলিং এর আওতায় যে কোন মুহুর্তে শত্রুকবলিত হতে পারে। উত্তম হবে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারের ক্ষুদে ষ্টুডিওটি ব্যবহার করা- সেটি শহর থেকে বেশ দূরে- সে এলাকার পতন শীঘ্র হবার কারণ নেই। এ ছাড়া একযোগে দুটি ঘর রক্ষা করার জন্যে বাড়তি প্রস্তুতি অবশ্যক। ট্রন্সমিটার ভবনটি ব্রডকাষ্টিং পারপাস-এ স্বয়ংসম্পূর্ণ।

এবারে মাহবুব হাসান, আবুল কাসেম স্বন্দ্বীপ, আবদুল্লাহ আল ফারুক আর আমি কন্ট্রোল রুম থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম। গাড়ি বারান্দায় আমাদের একজন মহিলা ঘোষিকা- তিনি একজন ভদ্রলোককে দেখিযে বলেছিলেনঃ বেলাল ভাই, ইনি আমার চাচা ডাক্তার আনোয়ার- আওয়ামী লীগের একজন কর্মী।

ডাক্তার আনোয়ার বলেছিলেনঃ আচ্ছা আপনারা বেতার চালু কার কি প্রচার করবেন, ঠিক করেছেন?

আমি বলেছিলামঃ আগে চালু করার ব্যবস্থা করি, তারপর যা মুখে আসে বলবো। কথা তো সেই একটা, আমরা স্বধীন।

তিনি সাইক্লোষ্টাইল করা একটি ক্ষুদ্রকার ঘোষণাপত্র আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেনঃ এটা দেখুন তো দুই বা তিন বাক্যবিশিষ্ট বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। পড়েই আমি উল্লসিত হয়েছিলাম। বলেছিলামঃ ভালোই হলো এটা দিয়েই অধিবেশন শুরু করা হবে, আর এরই ভিত্তিতে প্রচার করা হবে সকল বক্তব্য।

আমি টুকরো কাগজখানা পকেটে নিয়েছিলাম। তারপরই বেরিয়ে এসেছিলাম ডাক্তার আনোয়ারকে বিন্দুমাত্র সৌজন্য প্রদর্শন না করে।

জেকস-এর সামনে এসেই খেয়াল হয়েছিল আমাদের গাড়ী নেই। এখন উপায়! উদ্ধার করেছিলেন ডাক্তার আনোয়ার- তিনিও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এসে গিয়েছিলেন, সঙ্গে ঘোষিকা হোসনে আরা। ডাক্তার আনোয়ার বলেছিলেনঃ কালুরঘাট যাবেন তো আসুন আমার গাড়ীতে।

মাহবুব হাসানের মাথায় তখন অন্য চিন্তা।

ট্রান্সমিটার ভবনে অবস্থানরত প্রকৌশলী বন্ধুরা তো তাদের শর্ত পূরণ ছাড়া সহযোগিতা দেবেন না। দেখা যাক আঞ্চলিক প্রকৌশলীকে বাধ্য করে এখান থেকে একটা টেলিফোন করিয়ে দেয়া যায় কিনা। আমরা আগ্রাবাদ কলোনীতে আঞ্চলিক প্রকৌশলীর বাসায় গিয়েছিলাম- তিনি প্রথমে ক্ষমা চেয়ে পরে চাপে পড়ে বলেছিলেনঃ আচ্ছা, আমি টেলিফোনে বলে দিচ্ছি, আপনারা যান।

রাস্তায় ইতিমধ্যে কবি আবদুস সালাম আমাদের গাড়ীতে এসে উঠেছিলেন। বললেনঃ নাতী বেলাল, আমাকে তোদের সঙ্গে নিয়ে যা। আমি-এই-দেখ-একটা কথিকা লিখছি-দু’পাতা লেখা হয়ে গেছে, এটা প্রচার করবো। তুই দেখে দিস।

মাহবুব হাসান বলেছিলেনঃ দেখুন, আর-ই সাহেব আসলে, ট্রান্সমিটারে আদৌ ফোন করবেন না। এদিকে বিনা পারমিশনে ওঁরা দুজন কাজ করবেন না। আমি বরং এক কাজ করি- আমি স্টেশন রোডে আওয়ামী লীগ অফিসে যাই। কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক নিয়েই এসে পড়বো। আপনারা এ গাড়ীতে যান।

মাহবুব হাসান আর আমাদের সংগে যোগদান করতে পারেননি- শুধু দু’দিন পরে একবার টেলিফোনে যোগাযোগ করেছিলেন।

কালুরঘাটগামী মোটর গাড়ীতে আমরা তখন ছ’জন- হোসনে আরা, ডাক্তার আনোয়ার, কবি আবদুস সালাম, কাসেম, ফারুক ও আমি ট্রান্সমিটার ভবনের গেটের কাছেই আমি একরকম লাফ দিয়ে গাড়ী থেকে নেমে পরেছিলাম। কেননা, দেখতে পেয়েছিলাম, প্রকৌশলী বন্ধু দু’জন ততোক্ষণে বেরিয়ে এসে রিকশায় উঠেছেন। রিকশা আগলে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম-বলেছিলামঃ আর-ই সাহেব পারমিশন দিয়েছেন (?) এবং স্বেচ্ছাসেবকরাও এসে পড়বেন মাহবুব হাসানের সংগে। আপনারা দয়া করে চলে যাবেন না।

ওরা বলেছিলেনঃ আর-ই সাহেবের সংগে আমাদের টেলিফোনে আলাপ হয়েছে, তিনি বলেছেন কিছু করলে নিজের দায়িত্বে করবেন। দেখুন, আমাদের চাকরি থাকবে না।

ডাক্তার আনোয়ার সমস্যাটি উপলব্ধি করেছিলেন এবং দ্বিতীয় ও শেষবাবের মতো পরম আনুকূল্য দিয়েছিলেন। তিনি কাছাকাছি কোনো গ্রামীণ অস্থায়ী ছাউনী থেকে কয়েকজন সশস্ত্র জোয়ানকে নিয়ে এসে সাময়িকভাবে ট্রান্সমিটারে মোতায়েন করার উপস্থিত ব্যবস্থা করেছিলেন- বাধ্যবাধকতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। প্রকৌশলী বন্ধুদের দেয়া একটি শর্ত পূরণ করা গিয়েছিল।

কেন্দ্রের নাম ও প্রথম ঘোষণাপত্রটি আমি লিখেছিলাম ট্রান্সমিটার ভবনের অফিসকক্ষে বসে। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠেছিল। আমি ‘হ্যালো’ বলতেই ওদিক থেকে দ্রুত এবং চাপা কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিলঃ বেলাল সাহেব, দেরী করছেন কেন? এখন তো প্রায় সাড়ে সাতটা-যা পারেন প্রচার শুরু করুন। লোক এখন

রেডিওর কাটা ঘোরাচ্ছে- আটটা বাজলেই কিন্তু আকাশবাণীর খবর শুনবে সবাই। আপনাদেরটা আর কেউ শুনবে না।

আমাদের বার্তা সম্পাদক সুলতানা আলী। করেছিলাম তিনি হয়তো ইতিমধ্যে আবদুল কাহহারের কাছ থেকে আমরা কথা জেনেছিলেন। সুলতানা আলী আমাকে প্রচারযোগ্য দুএকটি খবরও বলে দিয়েছিলেন।

হোসেন আরাকে আমি কণ্ঠ দিতে দিইনি- কেননা একটি গুপ্ত বেতার কেন্দ্রে আমাদের শ্রোতা সাধারণের জন্যে একটি মহিলাকষ্ঠের ঘোষণা বেমানান ঠেকাতে পারে বলে আমাদের ধারণা হয়েছিল। সেদিন অন্য একজন ঘোষক সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং কণ্ঠ দিয়েছিলেন- সুলতানুল আলম। তবে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র নাম ঘোষণটি সর্বপ্রথম আমার নির্বাচনক্রমে আবুল কাসেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল। আবদুল্লাহ-আল-ফারুক বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেছিলেন। কবি আবদুস সালাম কথিকা প্রচার করেছিলেন।

অধিবেশন চলাকালেই এসে উপস্থিত হয়েছিলেন জনাব এম, এ হান্নান। তিনি তাঁর ভাষণের পূর্বাহ্নে নাম ঘোষণা করতে বলেছিলাম। আমি বলেছিলামঃ নাম ঘোষণা না করলেই ভালো হতো, কেননা আমরা শত্রু  শ্রোতাদের কাছে যতটা সম্ভব নিজেদের অবস্থানকে দুর্জ্ঞেয় রাখতে চাই- সহজে যেন ওদের বোমাবর্ষণের টার্গেট নির্ণয় করতে না পারে। রাডারের সাহায্যে ওরা ঠিকই ধরে নেবে- তবে এক-দু’দিন অন্ততঃ তা বিলম্বিত হবে।

জনাব হান্নান দ্বিপ্রহরে স্বনামে ব্রডকাস্ট করার কথা বললে আমি বলেছিলামঃ তখন কেন্দ্রের নামকরণ হয়নি এবং অনুষ্ঠান প্রচারের ধারবাহিকতা পরিকল্পনা ছিল না।

আমার উদ্দেশ্য তিনি অনুধাবন করেছিলেন এবং নাম ঘোষণা ছাড়াই তার মূল্যবান ও সময়োপযোগী ভাষণ প্রচার করেছিলেন।

বেতার ভবন থেকে আমার একটি টেপ হাতে করে নিয়ে এসেছিলাম। তাতে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে রেকর্ডকৃত ও প্রচলিত গণসঙ্গীত এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে গীটার বাদ্য ছিল- সেই টেপটিও এই অধিবেশনে বাজানো হয়েছিল।

আনুমানিক আধঘণ্টা স্থায়ী অধিবেশন শেষে বাইরে এসে আমরা ডাক্তার আনোয়ার ও তাঁর সৌজন্যে মোতায়েনকৃত জোয়ানদের কাউকে আর দেখতে পাইনি। জনাব হান্নানও তার ভাষণ প্রচারের পর চলে গিয়েছিলেন। প্রসঙ্গতঃ ডাক্তার আনোয়ারকে এরপর আর কোন দিনই বেতারকেন্দ্রে দেখতে পাইনি এবং হোসনে আরা পরবর্তীকালে পাকিস্তান বেতারে কাজ করেছিলেন।

আমি, কাসেম ও ফারুক পায়ে হেঁটে রাত সাড়ে দশটায় এনায়েতবাজারে ফিরে এসেছিলাম পথটি ছিল ৭/৮ মাইল। (অংশ)

-দৈনিক আজাদী, ২৬ মার্চ, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭

৩. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্মকথা

মেসবাহ আহমেদ

        ——- বাংলাদেশে ২৬শে মার্চের সূর্যোদয় হল রক্তস্নানের মধ্য দিয়ে। ইথারে ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র”। ঐ সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনে মনে হয়েছিল এ একটি অল্প বিদ্যুৎ শক্তি সম্পন্ন কেন্দ্র। তখনো জানা যায়নি কে বা কারা এই অসমসাহসী যোদ্ধা যাদের উদ্যোগে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাংক্ষা ও সুখ-দুঃখ-কান্নার কথা প্রথম বাতাসে ধ্বনিত হল। অবশ্য পরে আমরা এদের সন্ধান পেয়েছি।

শত্রুসৈন্য চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র দখল করাবার পর এই বেতার কেন্দ্রের অন্যতম বেলাল মোহাম্মদের পরিচালনায় দশজনের একটি দল চট্টগ্রাম থেকে সরে গিয়ে কালুরঘাট এক কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটার প্রথম স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার করে। এই দলে ছিলেন রেডিও ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সাকের, রাশেদুল হাসান, আমিনুর রহমান, রেজাউল করিম, শরফুজ্জামান, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, আবদুল্লা-আল-ফারুক, সুব্রত বড়ুয়া ও কাজী হাবিবউদ্দীন। কালুরঘাট পাকিস্তানী সৈন্যদের কবলে এলে পরে তাঁরা বাংলাদেশকে অন্য এক মুক্তাঞ্চল থেকে কিছুদিন অনুষ্ঠান প্রচার করেন।

২৫শে মার্চ রাজশাহী বেতার কেন্দ্রেও কয়েকজন বাঙালী কর্মী আটকা পড়েছিলেন। ২৮শে মার্চ রাজশাহী পুলিশ লাইনে পুলিশ বাহিনী ও ই-পি-আর বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে পাক ফৌজ রাজশাহী বেতার কেন্দ্রে পিছু হটতে বাধ্য হয়। একদিন একরাত পর্যন্ত কয়েকজন বেতারকর্মীকে একটি ষ্টুডিও মধ্যে আটকে রাখা হয়।

মুক্তাঞ্চল থেকে স্বাধীনতার অনুষ্ঠান প্রচারের উদ্দেশ্যে রাজশাহী বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন নির্ভীক কর্মী জীবন বিপন্ন করে বেরিয়ে পড়েন বেতার ভবন থেকে। এই দলে ছিলেন অনুষ্ঠান সংগঠক মেসবাহ আহমেদ, অনুষ্ঠান সংগঠক আতাউর রহমান, অনুষ্ঠান প্রযোজক অনু ইসলাম, অনুষ্ঠান প্রযোজক শাহজালাল ফারুক এবং বার্তা সম্পাদক মোহাম্মদ মামুন।

রাজশাহী বেতারের এই কর্মীদল ২রা মে মুজিবনগরে পৌছান। দু’চারদিন পরের কথা। তখন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে। ইতিমধ্যে রাজশাহী বেতারের অনুষ্ঠান সংগঠক শামছুল হুদা চৌধুরী এসে গেছেন। তাঁকে আমাদের মধ্যে পেয়ে আমরা আরো উৎসাহ পেলাম।

ঢাকা টেলিভিশনের মোস্তফা মনোয়ার এবং জামিল চৌধুরী, প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, বিশিষ্ট সাংবাদিক এম, আর, আখতার এবং চিত্রাভিনেতা হাসান ইমাম ও তখন মুজিবনগনে। বিশিষ্ট ছাত্রনেতা এবং শেখ সাহেবের প্রেস সেক্রেটারী আমিনুল হক বাদশার সংগেও দেখা হল।

আমরা সকলে মান্নান সাহবের সংগে দেখা করলাম

পর পর কয়েকদিন আলোচনা হল। মান্নান সাহেবের পরিচালনায় উচ্চ বিদ্যুৎ শক্তি সম্পন্ন ট্রান্সমিটারযোগে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান প্রচারের কয়েকটি খসড়া পরিকল্পনা প্রণীত হয়।

ইতিমধ্যে ট্রান্সমিটার সংগ্রহের কাজও শুরু হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কেনার জন্য ১৪ই মে মান্নান সাহেব আমাদের শ দুই টাকা দিয়েছিলেন।

আমি, শামসুল হুদা চৌধুরী এবং ঢাকার পাইওনিয়ার প্রেসের মালিক এম, এ মোহাইমেন এম-পি-এ ঐদিনই প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ক্রয় করি।

দু-তিনদিন ধরে আমরা প্রপোজল রেজিষ্টার, কন্ট্রাক্ট রেজিষ্টার, কন্ট্রাক্ট ফরম, আর্টিষ্ট রেজিষ্টার ইত্যাদি তৈরি করি। এবস কাজে অনু ইসলাম আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেণ, যদিও তিনি তখন ‘জয়বাংলা’ পত্রিকায় কাজ করতেন।

এগিয়ে এল চরম মুহুর্ত। মান্নান সাহেবের প্রচেষ্টায় পঞ্চাশ কিলোয়াট শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটার পাওয়া গেল। ঠিক ঐ মুহুর্তে ঢাকা বেতারের সেই নির্ভীক তিন কর্মী আশফাকুর রহমান, তাহের সুলতান এবং টি, এইচ শিকদার মুজিবনগরে এসে পৌছেন। তারা এসেই এম-এন-এ তাহের উদ্দীন ঠাকুর এবং আমিনুল হক বাদশার সংগে দেখা করেন। তাদের সংগে ঢাকা থেকে আনীত কিছু মূল্যবান গানের টেপও ছিল।

২৫শে মে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবনে বিশেষ করে বাংলাদেশের বেতারকর্মীদের জবিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ঐদিনই বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাংক্ষা ও দুঃখ-কান্নার শব্দ ধ্বনিত হয় বাতাসে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে বাংলাদেশের প্রথম আনুষ্ঠানিক বেতার প্রচারে শুরু হল।

কয়েকদিন আবাসিক বাড়ীর সীমাবদ্ধ পরিবেশে ছোট একটি ঘরকে ষ্টুডিও করে প্রথম অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। প্রথম কিছুদিন প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার নিদারুণ অসুবিধার মধ্যেও অনুষ্ঠান প্রচার করতে হয়েছে। পরবর্তীকালে আমরা সে সমস্ত অসুবিধা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছিলাম। ষ্টুডিও অভাব, পর্যাপ্ত রেকর্ডিং সুবিধার অভাব এবং শিল্পী-সাহিত্যেকের ও কথকের অভাবের মধ্যে প্রথম দু’তিন মাস যে কি কষ্টে আমরা অনুষ্ঠান চালিয়েছি তা আজ লিখে শেষ করা যাবে না। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বেতারের সেই দশজনের দলটিও এসে কাজে যোগ দিয়েছেন।

প্রথম দিকের ঝক্কি খানিকটা কাটিয়ে ওঠার পর অনুষ্ঠান সম্পর্কে সংহত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সমগ্র দায়িত্ব ছিল তথ্য ও বেতার দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত এম-এন-এ আবদুল মান্নানের উপর ন্যস্ত।

কিছুদিনের জন্য সেক্রেটারী পর্যায়ে প্রতিরক্ষা দপ্তরের সচিব আবদুস সামাদও অনুষ্ঠান সম্পর্কে আমাদেরকে পরামর্শ দিতেন।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভেতর অনুষ্ঠান সংগঠন এবং কেন্দ্রের প্রশাসনিক পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন আমাদের সিনিয়র পোগ্রাম অর্গানাইজার শামসুল হুদা চৌধুরী।

সমগ্র অনুষ্ঠানের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছেন আশফাকুর রহমান।

পরবর্তীকালে তথ্য ও বেতার সচিব হিসেবে আনোয়ারুল হক খান আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেছেন।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান বিভাগে নিয়মিত কর্মী হিসাবে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরা হলেনঃ শামসুল হুদা চৌধুরী, আশফাকুর রহমান, মেসবাহ আহমেদ, বেলাল মোহাম্মদ, তাহের সুলতানা, টি এইচ শামসুদ্দিন আহমেদ, মঞ্জুর কাদের (বাবুল আখতার), আবু ইউনুস প্রমুখ কর্মী।

ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কাজ করেছেন আবদুস সাকের, রাশেদুল হাসান, আমিনুর রহমান, রেজাউল করিম, মইনুল হক, প্রণব রায়, মোহাম্মদ মহসিন ও শরফুজ্জামান।

যাদের নিরলস প্রচেষ্টায় সংবাদ বিভাগ সমৃদ্ধ হয়েছে তারা হচ্ছেন কামাল লোহানী, মোহাম্মদ মামুন, সুব্রত বড়ুয়া, মৃণালকৃষ্ণ রায়, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, নূরুল ইসলাম সরকার, আলী রেজা চৌধুরী, পারভীন হোসেন, জাহেদ সিদ্দিকী, শহীদুল হক ও জারিন আহমেদ।

ড্রামা প্রডিউসার ছিলেন রণেন কুশারী ও হাসান ইমাম। ইংরেজী অনুষ্ঠান প্রচারে ছিলেন আলমগীর কবীর ও আলী যাকের।

যেসব শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী অনুষ্ঠান সমৃদ্ধির জন্য সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করেছেন, তাদের মধ্যে ডক্টর এ, আর, মল্লিক, সৈয়দ আলী আহসান, ডক্টর মাযহারুল ইসলাম, ডক্টর আনিসুজ্জামান, শওকত ওসমান, গাজীউল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, রণেশ দাশগুপ্ত, সিকান্দার আবু জাফর, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, কল্যাণ মিত্র, নারায়ণ ঘোষ, সুভাষ দত্ত, জহির রায়হান, সুমিতা দেবী, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, বুলবন ওসমান, আসাদ চৌধুরী, আনু ইসলাম, প্রণব চৌধুরী, রাজু আহমেদ, নুরন্নাহার মযহার, আইভি ঘোষ, আপেল মাহমুদ, স্বপ্না রায়, অনুপ কুমার ভট্টাচার্য, রফিকুল আলম প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মী বলে নয়, একজন সাধারণ শ্রোতা হিসেবে বলতে পারি, এই কেন্দ্র থেকে গত নয় মাসে প্রচারিত প্রায় সব অনুষ্ঠানই উন্নতমানের হয়েছে। বিশেষ করে চরমপত্র’, ‘অগ্নিশিখা, “জল্লাদের দরবার’, ‘পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে’, ‘পুতুলনাচের খেল অনুষ্ঠানসমূহ সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে বলে আমার বিশ্বাস। বিশিষ্ট সাংবাদিক এম আর আখাতার চরমপত্র অনুষ্ঠানের লেখক ও প্রচারক। “জল্লাদের দরবার লিখতেন প্রখ্যাত নাট্যকার কল্যাণ মিত্র। জল্লাদ, দুর্মুখ, নবাবজাদা, টিটিয়া খান, পিয়জী খান, গর্ভণর এবং বেগমের ভূমিকায় অভিনয় করতেন যথাক্রমে চিত্রাভিনেতা রাজু আহমেদ, চিত্র পরিচালক নারায়ণ ঘোষ, প্রসেনজিৎ আজমল হুদা মিঠু, ফিরোজ ইফতিখার, জহিরুল হক ও বুলবুল মহলানবীশ। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন আশরাফুল আলম। ইসলামের দৃষ্টিতে অনুষ্ঠান প্রচার করে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যক সৈয়দ আলী আহসান আমাদের অনুষ্ঠানে শ্রীবৃদ্ধি করেছেন।

পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে এবং ‘পুতুলনাচের খেল’ লিখতেন যথাক্রমে ফয়েজ আহমদ ও আবদুল গাফফার চৌধুরী।

গণসঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গানের সুর সংযোজনা এবং কণ্ঠদানে কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে স্মরণ করেত হয়। তাঁরা হচ্ছেন- তাহের সুলতান, সমর দাশ, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, মান্না হক, কল্যাণী ঘোষ, সুজেয় শ্যাম, অজিত রায়, রফিকুল আলম, অনুপ ভূট্টাচার্য, হরলাল রায়, রথীন রায়, প্রমুখ শিল্পী।

(অংশ)

-‘জয়বাংলা/বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়া যাবে শামসুল হুদা চৌধুরীর একাত্তরের রণাঙ্গন গ্রন্থে।

Scroll to Top