স্বীকারোক্তি
৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
ছাপাখানাটা শহরের মাঝখানে এবং আবাসিক এলাকায়। এ অঞ্চলে আর কোন ছাপাখানা ছিল না। পরে যখন আরো দুটো ছাপাখানা বসে শহীদ সাহেব চিন্তিত হয়, অবশ্য সেটা সাময়িক। ছাপাখানার কাজে কোন ভাটা পড়েনি, যেমন আজ আসত তেমনি আসতে লাগল।
একতলা বাড়ীর উঠোনের একপাশে বাঁশের চালায় দুটি যন্ত্র নিয়ে ছাপাখানা। একটা ট্রেডল, একটা ফ্ল্যাটবেড। একপাশে শহীদ সাহেবের বসার ঘর, যেটা অফিস বলে বিবেচিত। শহীদ সাহেব প্রায় পঁয়ত্রিশ বয়স, মাথার একপাশের চুল অর্ধেক সাদা-কালো। ইংরেজী সাহিত্যে এমএ, কিন্তু বরাবর ছিল ব্যবসার দিকে ঝোঁক, তাই চাকরি না নিয়ে অল্প মূলধন জোগাড় করে ধরেছে এই ব্যবসা।
ব্যবসায় প্রথম দিকে তেমন সুবিধা হচ্ছিল না। তাই কমার্সের সব বই নিয়ে বসে যায়, বিশেষ করে ছোট ব্যবসা কেমন করে চালাতে হয় এ ব্যাপারে পড়াশোনা করে একেবারে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে এবং এখন তার কাছে
এম-কম পাস করা লোকেও অনেক কিছু শিখতে পারে। লেখাপড়ার ফল হিসেবে ছাপাখানার এখন বাড়বাড়ন্ত অবস্থা। পাঁচজন লোক নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল, এখন পয়ত্রিশজন খাটছে।
পত্রিকা বের করার ইচ্ছা ছিল, তাই মাসিক বেরিয়েছে- এবার বাসনা দৈনিকের। বন্ধুবান্ধবের ধারণা শহীদ তা পারবে।
শহীদ সাহেব ভীষণ নিয়ম মেনে চলার পক্ষপাতী। সময়মত পাওনা দিয়ে দেওয়া এবং সময়মত কাজ আদায় করতেও ছাড়ে না। তার সঙ্গে ব্যবসা করতে এসে সবাই খুশী। শ্রমিকরাও। বড় ঝড় বড় গাছের উপর দিয়েই যায় প্রবলভাবে, কিন্তু মাঝে মাঝে এমন এক-একটা ঝড় আসে যা ঘাসকেও রেহাই দেয় না। মার্চ মাসে বাংলাদেশে সে ঝড় এসে গেল। দোসরা মার্চ থেকে সব কিছু বন্ধের সাথে শহীদ সাহেবের ছাপাখানাও গেল আচল হয়ে। সাত তারিখ থেকে শেখ সাহেবের ডাকে আন্দোলন শুরু হয়ে গেল কর্মীরা মাঝে মাঝে এসে ঘুরে যেতে লাগল, বেশীর ভাগই বাড়ি চলে যাবে ঠিক করে।
দশ তারিখে শহীদ সাহেব সব কর্মীদের নিয়ে মিটিং-এ বসে যায়।
বলে, আমরা এখানে কেন জমায়েত হয়েছি আপনারা জানেন।
জানে, সবাই জানে, তাই সবাই চুপ৷
শহীদ সাহেব বলে চলে, দেখুন আমরা রাজনীতি করতে চাই বা না চাই, রাজনীতি আমাদের ছেড়ে কথা কইবে না। আজ দেশ যে পর্যায়ে গেছে সেখান থেকে আমাদের আর ফেরার উপায় নেই। এ ব্যাপারে আমাদেরও ত্যাগ স্বীকার করেত হবে। দেখুন, কাজ হোক আর না হোক মাইনে আমাকে গুণতেই হবে। তবে আপনারা আমাকে একটু সাহায্য করুন, এ মাসের পনের দিনের টাকা নিয়ে দেশে চলে যান, পরে আমি চিঠি দিয়ে ডেকে আনব, আর বাকী টাকা দু’মাসের মধ্যে কিস্তিতে শোধ করে দেব। প্রেসের আয় কত তাতো আপনারা সবাই জানেন।
শ্রমিকরা প্রতিবাদ না করে এই ব্যবস্থা মেনে নেয়।
ভরা বসন্ত তখন বাংলাদেশে। চৈত্র পবনে বাতাস উতলা। ঝুমকো লতার চাওয়ায় মনের বেদনা উদাস হয়ে দেখা দেয়। মুকুলগুলি ঝরে ঝরে পড়ে। এমন এক বসন্ত-রাতে অকস্মাৎ সেই ঝড়টা চূড়ান্ত রূপে এসে গেল। পঁচিশে মার্চের রাতে।
ঘুমন্ত দশ লক্ষ লোক খুন করে বিশ্বের দরবারে সাহসিকতার চরম দেখানোর ইয়াহিয়ার নেকড়েগুলো ছাড়েনি।
এক মাস কেটে গেছে ছাপাখানার কোন কর্মীর দেখা নেই। শহীদ সাহেব আর তালা খোলেন না। কি হবে খুলে? ব্যবসা, টাকা-পয়সার কথা চিন্তা হলেই বুকের কাছটা কেমন করে ওঠে তার, মাথা ঘুরে যায়।
কয়েকদিন পর শহীদ সাহেব ছাপাখানা খোলেন, সরকারী চিঠি এসেছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব খুলে রাখার হুকুম।
ধুলো ঝেড়ে চেয়ারে বসে কি যেন ভাবছেন এমন সময় প্রতিবেশী রসুল সাহেব উঁকি দেন।
বলেন, কি ভাই, অফিস খুলেছেন, বহুত আচ্ছা।
ভদ্রলোক অবাঙালী।
খাতির করে ডেকে বসান শহীদ সাহেব।
দু’চারটে কথা বলে রসুল সাহেব বেশ হৃষ্ট মনে চলে যান। আর শহীদ সাহেব গালে হাত দিয়ে ভাবেন এক মাস আগেও এই রসুল সাহেব যেতে-আসতে সালাম দিয়ে যেতেন, গায়ে পড়ে করতেন আলাপ, আর আজ? এই রসুল সাহেবের দয়ার উপরেই নির্ভর করছে এ পাড়ার লোকগুলোর জীবন-মরণ।
প্রায় তিন মাস কেটে গেছে। ছাপাখানা তেমনি অচল। তবে প্রতিরোধের কাজ দিন দিন জোরদার হচ্ছে। শুধু বোমা নয়, ঢাকা শহরে রীতিমত সামনাসামনিও লড়াই হচ্ছে। চোরাগুপ্তি সংগঠনের সাথে সাইক্লোস্টাইলে ছাপা দুটো পত্রিকা চলছে, গোপনে একজনের হাত থেকে আর একজনের হাতে চলে যায়- লিফলেট- হ্যাণ্ডবিলও বিলি চলছে।
দু’দিন গভীর রাতে রসুল সাহেব লক্ষ্য করেন শহীদ সাহেবের ছাপাখানায় আলো- আর ট্রেডল মেশিনটাও চলছে। ভাবেন, এত রাতে কি কাজ। বলেন ত কোন কাজও নেই।
রোজকার মত শহীদ সাহেব অফিস খুলে বসেন, ঝিরঝিরিয়ে নেমেছে বৃষ্টি, ভিজে বাতাসে ঘুম ঘুম ভাব। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে কখন চোখের পাতা তার জড়িয়ে গেছে। এক সময় দেখতে পান তার অফিসটা কখন তিনতলা বাড়ি হয়ে গেছে, নীচতলায় চলতে অফসেট মেশিন, লাইনোটাইপে কম্পোজ হচ্ছে। তার দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক বাংলাদেশ’, কাগজের শেষ পাতায় নীচের দিকে কোণায় তার নাম লেখা, সম্পাদকঃ শহীদ আহমদ।
এই সময় ভীষণ ঘরঘর শব্দে তার তন্দ্রা ভেঙ্গে যায়। দেখে একটা মিলিটারী জিপ সাঁ করে বেরিয়ে গেল। ঘাড় কাৎ করে শহীদ সাহেব দেখেন জিপটা রসুল সাহেবের বাসার সামনে থেমে গেল। জিপ থেকে নামেন রসুল সাহেব, কি যেন বলেন, তারপর আঙ্গুল বাড়িয়ে এদিকেই কি দেখান।
জিপটা মুখ না ফিরিয়ে ব্যাক করে ছাপাখানার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। লাফ দিয়ে নামে সশস্ত্র দু’জন পশ্চিমা সেনা।
একজন সেনা পরিষ্কার বাংলায় বলে, শহীদ আহমদ কার নাম?
আমার নাম। কি দরকার বলুন। ভাবেন রসুল সাহেব হয়ত কোন সরকারী কাজ জোগাড় করে দিয়েছেন।
কোন জবাব না দিয়ে সৈনিক বুক পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে শহীদ সাহেবের মুখের সামনে তুলে ধরে।
একটা হ্যান্ডবিল বড় বড় হরফে লেখা- মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করুন। কিন্তু অত বড় অক্ষরগুলো কেমন চিনে উঠতে পারেন না শহীদ সাহেব, সব কেমন গুলিয়ে যেতে থাকে। তা অবশ্য মুহুর্তের জন্যে।
পর মুহুর্তের শহীদ সাহেব সহজ গলায় বলেনঃ ও হ্যান্ডবিলটা তো, ওটা আমার প্রেসেই ছাপা হয়েছে।
(বুলবন ওসমান রচিত গল্প)