হতবুদ্ধি ইয়াহিয়া

হতবুদ্ধি ইয়াহিয়া

 

অক্টোবর থেকে গেরিলাদের তৎপরতা সম্পর্কে উৎসাহব্যঞ্জক খবর পেতে থাকি। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে পণ্যসামগ্রী বাইরে প্রেরণ এবং বাইরে থেকে সামরিক সরঞ্জাম ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে আসা অব্যাহত গতিতেই চলতে থাকে।বাইরের যেসব মালামাল আসতো সেগুলো আবার যথারীতি দেশের ভেতর বিভিন্ন গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাচ্ছিলো। নৌবাহিনীর ডুবুরীদের সাফল্যজনক তৎপরতা সত্ত্বেও নৌ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে আমরা বিশেষ সফলতা লাভ করতে পারিনি। বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় বেশ কতগুলো কারণে দেখা যায় পাকিস্তান সরকার তার নৌযোগাযোগ মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে  চালু রাখতে সমর্থ হয়েছিলো।

 

(ক) বিদেশী শিপিং কোম্পানীগুলিকে পাকিস্তান সরকার যেকোনো সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় ক্ষতিপূরণ দানের প্রস্তাব করেছিলো।

(খ) অভ্যন্তরীণ নদীপথগুলোকে মোটামুটি ব্যাপকভাবে সশস্ত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা সহ নৌযানগুলোর চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।

(গ) উপকূল এলাকা এবং সামুদ্রিক বন্দরগুলোতে গানবোটের তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়।

(ঘ) শত্রুরা নৌ কমান্ডোদের কার্যপদ্ধতি জেনে যাওয়ায় তারা পর্যাপ্ত রক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করে।

 

পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আমরা বেশি করে নৌকমান্ডো নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেই। আমরা আরও যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করি সেগুলো ছিলঃ

 

(ক) আই ডব্লিও টি এ জাহাজগুলোতে ক্রু হিসেবে নৌকমান্ডো নিয়োগ করা।

(খ) নদীর তীর এবং সাগরের উপকূল থেকে সুবিধাজনক দূরপাল্লার হাতিয়ারের সাহায্যে নৌযানগুলোর উপর সরাসরি আক্রমণ চালানো এবং

(গ) এতদঞ্চলের আবহাওয়াগত কারণে সকাল সন্ধায় সৃষ্ট মৌসুমি কুয়াশার সুযোগ নিয়ে লিমপেট মাইন দ্বারা পাকিস্তানী জাহাজগুলোকে ধ্বংস করা।

 

১২ই অক্টোবর ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণ দেন। তিনি তার ভাষায় ‘ জাতীয় জীবনের এই ভয়াবহ মুহূর্তে আল্লাহও ইসলামের নামে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার পিছনে ঐক্যবদ্ধ হতে বললেন। বিরস, গম্ভীর, মাদালস কণ্ঠে তিনি বললেনঃ-

 

(ক) পাকিস্তানের সমগ্র সীমান্ত বরাবর ভারত ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করেছে।

(খ) ট্যাংক, গোলন্দাজ ইউনিট এবং বিমানবাহিনীকে পাক সীমান্তের কাছে এনে জড়ো করা হয়েছে(তার জিজ্ঞাসা ‘এসবের অর্থ কি?’) এবং

(গ) চট্টগ্রামও মংলা বন্দরে নৌবাহিনীর ডুবুরীদের হামলা হয়েছে। সড়ক, রেলপথও সেতু ধ্বংস করা হচ্ছে এবং বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে।

 

ইয়াহিয়ার এই বিশেষ বক্তৃতায় বিশেষ কয়েকটি দিক লক্ষণীয়। সবকিছুর জন্য তিনি ভারতকেই দোষারোপ করেছেন এবং সচেতনভাবে মুক্তিবাহিনীর কথা এড়িয়ে গেছেন।

 

এতে পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, তিনি যুদ্ধ করার একটি অজুহাত খুঁজছেন। এক বদ্ধ উন্মাদ যে মুক্তিবাহিনীর আঘাতে ক্ষত বিক্ষত, ক্রোধোন্মত্ত তার কথায় সেটাই প্রমাণিত হল। ততদিনে তাকে আমরা আরও নির্মম আঘাত হানার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি।

 

জুলাই মাস থেকে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার তেল ।সংরক্ষণাগারে একটা আক্রমণ চালানোর জন্য আমরা পরিকল্পনা করছিলাম। একাজের জন্য বিশেষভাবে বাছাই করা ছেলেকে আলাদাভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয়। কিন্ত উপরোক্ত হাতিয়ার না পাওয়ায় অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়। পাকিস্তান বিমানের জন্য উচ্চদাহ্য শক্তি সম্পন্ন জ্বালানি ভর্তি ট্যাংকগুলো ছিল প্রধান আকর্ষণ। ১৬ই অক্টোবর ট্রেনিংপ্রাপ্ত গণপরিষদ সদস্য মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে বিশেষ দলকে উক্ত তেল সংরক্ষণাগারে আক্রমণের জন্য পাঠানো হয়। আক্রমণের আগের রাতে শত্রুরা কিভাবে যেন শহরে গেরিলা দলের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়।চট্টগ্রামে তারা যেখানে উঠেছিলো পাকিস্তানীরা সে এলাকা ঘিরে ফেলে। সৌভাগ্যক্রমে একটি ড্রেনের ভেতর দিয়ে আমাদের পুরো দলটি আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়। কিন্ত তাদের অস্ত্রশস্ত্র খোয়া যায়। ফলে পরিকল্পনা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।

 

ওদিকে ইয়াহিয়া খান ভারত আক্রমণের একটি যথাযথ অজুহাত খুঁজছিলেন।তিনি ভেবেছিলেন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধিয়ে একটি মারাত্মক আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি করে বাংলাদেশের সমস্যা থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো যাবে। তার সমর অধিনায়করাও সে ধরনের একটি যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সৈয়দপুরে এক জনসমাবেশে পাকিস্তানী ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেঃ জেনারেল নিয়াজী ঘোষণা করলেন, উভয় ফ্রন্টের পরবর্তী যুদ্ধ ভারতের মাটিতে হবে।নিয়াজীর মুখ থেকে কথাটা বোধহয় বেফাঁস বেরিয়ে পড়েছিলো- কারণ ইয়াহিয়া খান তখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে যুদ্ধের কথা বলেননি। কিন্ত না বললে কি হবে ২০ এবং ২২শে অক্টোবর পাকিস্তানীরা সীমান্ত থেকে ভারতের অভ্যন্তরে কমলপুর গ্রামের উপর গোলাবর্ষণ করলো। যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানী উস্কানিমূলক তৎপরতায় বহুসংখ্যক বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং আহত হল। একদিন পর ২৩ অক্টোবর পাকবাহিনী পশ্চিম ফ্রন্টের সম্ভাব্য রণাঙ্গনগুলোতে সৈন্য সমাবেশ শুরু করে।

Scroll to Top