১৪৭. ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় কি দেখলাম

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<৬,১৪৭,২৩৯-২৪০>  

সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী মুজিব নগরঃ ৪র্থ সংখ্যা

তারিখঃ ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

.

                     বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায়

                                  কি দেখিলাম-

       অতি সম্প্রতি ‘বাংলার বাণী’র একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা সফর করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন । সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধি যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তাহারই শেষ অংশ এখানে ছাপা হইল ।

       অধিকৃত এলাকায় পাক সেনার যথেচ্ছভাবে স্থানীয় অবাঙ্গালী কুলি-কামিন এবং চোর-ডাকাত গুণ্ডা-বদমায়েশদের লইয়া বদর, রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনী গঠন করিয়া চলিয়াছে । তাহাদের সহিত কিছু মুসলিম লীগ ও জামাতের গুণ্ডা-পাণ্ডাও জুটিয়াছে । তাহারা পাক বাহিনীর ছত্রছায়ায় থাকিয়া যে ঘৃণ্য কেলেঙ্কারীর ইতিহাস সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে তাহা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না । পাক বাহিনী নিজেরা যে কোন সম্মুখসমরে গা বাঁচাইয়া চলিয়া প্রাঃয়শই ইহাদিগকে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলিয়া দেয় । রাত্রিকালে পাক বাহিনী যেখানে শিবিরের বাহিরে আসিবার কল্পনাও করিতে পারে না সেখানে রাজাকার বা মুজাহিদ বাহিনীর লোকদের দিয়া শিবিরসমূহে নৈশকালীন পাহারা দিবার ব্যবস্থা করা হইয়াছে । সামান্য কয়েকদিন অনুশীলনীর পরই তাহাদিগকে ফ্রন্টে পাঠাইয়া দিয়া খান সেনারা নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে গা বাঁচাইয়া অবস্থান করে । সে জন্য প্রতি ক্ষেত্রেই স্বল্প ট্রেইংপ্রাপ্ত এইসব বালখিলারা হয় পালাইয়া প্রাণ বাঁচায়, না হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিত নিশানায় পরিণত হয় ।

                                         হাট-বাজার

       অধিকৃত এলাকার হাট-বাজার প্রায় সবই কোনমতে চলিতেছে । এবং জিনিসপত্রের দাম আগুন হইয়া উঠিয়াছে । অতি সম্প্রতি সেখানে লবণ প্রতি সের দুই টাকা হিসাবে এবং কিছুদিন আগে কেরোসিন তেল প্রতি টিন ৪৫ টাকা হইতে ৫২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হইয়াছে, ইদানিং তাহা কমিয়া ২৮ টাকা হইতে ৩২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হইতেছে । চাউল আটা প্রায়ই হঠাৎ করিয়া বাজার হইতে উধাও হইয়া যায় । সাধারণ চাউলের দর এ সময় সাধারনতঃ মণপ্রতি ৪২ টাকা হইতে ৪৮ টাকা পর্যন্ত হইয়া থাকে, বর্তমানে উহা ৬০ টাকার উপরে । গ্রামাঞ্চলে তাহাও পাওয়া দুষ্কর । এইসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং  খাদ্যশস্যের এরূপ ঊর্ধ্বগতির কারণ কি এই সম্পর্কে জনৈক ব্যবসায়ীকে প্রশ্ন করা হইলে তিনি জানান যে, প্রতিটি নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য শহর হইতে খরিদ করিয়া অবাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রয় করিয়া দিতেছে । এবং সেইগুলি সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, শন্তাহার, ঈশ্বরদী, খালিশপুর ইত্যাদি বিশেষ এলাকায় জমা করা হইয়াছে । তাহাদের উদ্দেশ্য কি জানা ভার । ব্যবসায়ীটি আরো জানান, স্থানীয় হাট-বাজারগুলির আড়তগুলিতে প্রথমদিকে যে লুটের তাণ্ডব চলিয়াছিল সে তাণ্ডবে কোন বাঙ্গালী আড়তই রক্ষা পায় নাই ।

       বর্বরা হয় লুটপাট করিয়া মালামাল লইয়া গিয়াছে, না হয় আড়ত অগ্নিদগ্ধ করিয়াছে । কাজেই ব্যবসায়ীরা রাতারাতি পথের ভিখারী হইয়া ব্যবসা গুটাইতে বাধ্য হইয়াছেন ।

 

জনৈক গ্রামবাসীকে স্থানীয় হাটের ভয়াবহ অবস্থার কথা প্রশ্ন করিলে তিনি জানান, প্রায়ই কিছু না কিছু রাজাকার ও পাকবাহিনী আসিয়া জোরপূর্বক দোকানদারের নিকট হইতে সাধ্যাতিরিক্ত অর্থ চাহিয়া বসে এবং অর্থদানে বিলম্ব ঘটিলে মারধর, খুন-জখম করিতেও দ্বিধাবোধ করে না । তাহারা সবকিছু লুটপাট করিয়া লইয়া যায় । ইহার ফলে কোন ব্যবসায়ীই আর নতুন জিনিস না কিনিয়া দোকান আপাততঃ বন্ধ করিয়া দিতে বাধ্য হইয়াছেন ।

                                         স্কুল-কলেজ

      অধিকৃত এলাকায় স্কুল-কলেজগুলির অবস্থা চরম নৈরাশ্যজনক । স্কুলগুলিতে ৫০০-৬০০ ছাত্রের মধ্যে ২-১ জন ছাত্র মাঝেমধ্যে বেড়াইতে আসে । পড়াশোনার প্রশ্নই উঠে না । বোর্ডের ফাইনাল পরীক্ষায় হলগুলিতে ছাত্রদের অনেক ভয়ভীতি প্রদর্শন করাইয়াও মুষ্টিমেয় সংখ্যক ছাড়া কাহাকেও উপস্থিত করাইতে পাকবাহিনী ব্যর্থ হইয়াছে । যাহারা পরীক্ষায় উপস্থিত হয় নাই, তাহাদের পিতামাতার নিকট কারণ দর্শাইবার নোটিশ যাইতেছে বলিয়া প্রকাশ । কলেজগুলিতে কিছু কিছু অবাঙ্গালী ছাত্র হাজিরা দেয় এবং এইসব অবাঙ্গালী ছাত্ররা প্রায়ই ক্লাসের দিকে না যাইয়া ক্যান্টিন ও কমনরুমের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করিয়া কালক্ষেপণ করে ।

                                         শহরের পথ-ঘাট

       শহরের পথচারী প্রতিটি মানুষের মুখে আতঙ্কের ভাব পরিস্ফুট । পথচারী সকলেই প্রায় নিরাপত্তার ভয়ে সর্বদা সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কিত । শহরবাসীরা একান্ত বাধ্য না হইলে ঘর হইতে বাহির হইবার চেষ্টা করেন না ।

       শহরের প্রায় বড় বড় দোকানগুলি তালাবন্ধ হইয়াছে । দোকানগুলির সাইনবোর্ড ও বিজ্ঞাপনে নতুন উর্দু অক্ষর বসিয়াছে । বাঙ্গালী পথচারীকে ব্যঙ্গ করিতেছে । রাতারাতি শহরের সকল সাইনবোর্ড ও মোটর গাড়ি, রিকশার নম্বর-প্লেট বাংলা হইতে উর্দুতে লিখিতে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে । আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ীঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও দোকানগুলি ইতিমধ্যে অবাঙ্গালী ও জামাত মুসলিম লীগ সমর্থকদের মধ্যে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করা হইয়াছে ।