সহুল আহমেদ মুন্না
<৬,১৫৩,২৫১-২৫২>
শিরোনামঃ সশস্ত্র যুদ্ধে বাঙ্গালীদের পাশে আসিয়া দাড়াইতে হইবে – আঁদ্রে মালরো
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী, মুজিবনগরঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
রাসেলের শূণ্য স্থানে আঁদ্রে মালরো
সশস্ত্র যুদ্ধে বাঙ্গালীদের পাশে আসিয়া দাড়াইতে হইবে
(নিজস্ব নিবন্ধকার)
বিশ্ব বিবেকের কণ্ঠস্বর বার্ট্রান্ড রাসেল আজ আর নাই। কিউবা সঙ্কট, ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রভৃতি ঘটনার সময় এই মহামনীষী বিশ্ববিবেকের পক্ষ হইতে প্রতিবাদ জানাইয়াছিলেন। তিনি সেদিন নামিয়াছিলেন পথে। উচ্চকন্ঠে ঘোষণা করিয়া বলিয়াছিলেন, মানুষের ভবিষৎ বলিয়া যদি কিছু থাকে, তবে বিশ্বের দেশে দেশে মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য অপরাধ অনুষ্টিত হইতেছে তাহা বন্ধ করিতে হইবে, অপরাধীকে সমুচিত শাস্তি প্রদান করিতে হইবে।
.
কিন্তু আজিও পৃথিবীতে শান্তি স্থাপিত হয় নাই। অত্যাচারী হানাদার হিংস্র হায়েনারা আজো পৃথিবীর দেশে দেশে মানবতার বিরুদ্ধে নৃশংসতম ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে লিপ্ত রহিয়াছে। প্রতি মুহুর্তে, প্রতি ঘটনায় মানবতার চরম অপমান ঘটিতেছে। আজিকার দিনে আবার বিশ্ববাসীর সামনে একটি প্রশ্ন সবচেয়ে বড় হইয়া দেখা দিয়াছে। এই প্রশ্ন, মানবজাতির ভবিষ্যৎ কি? পৃথিবীতে কি চিরকাল সাম্রাজ্যবাদী জুলুমবাজরাই রাজত্ব করিয়া যাইবে?
.
ইহার একটি উত্তর হইল, না। বিশ্বের স্বাধীনতাকামী শান্তিকামী জনতা বজ্রকঠোর স্বরে ঘোষনা করিতেছে, না, ইহা হইতে পারে না।
.
আজ তাই বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের পাশে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন ফ্রান্সের বিখ্যাত লেখক মিঃ আঁদ্রে মালরো। ফ্রান্সের পৃথিবী বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জাঁ পল সার্ত্রে মানবতার এই দুঃসহ অপমানের দিনে আগাইয়া আসেন নাই, আগাইয়া আসিয়াছেন ফরাসী প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা মঁশিয়ে আঁদ্রে মালরো। আগাইয়া আসিয়াছেন বিশ্বের বহু দেশের অসংখ্য সচেতন মানুষ।
.
বাংলাদেশের জনগনের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম আজ চরম অবস্থায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, বাংলার মানুষের অপূর্ব আত্নদান আজ সমগ্র পৃথিবীতে তুলিয়াছে অভূতপূর্ব সাড়া। ফ্রান্সের প্রাক্তন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী মিঃ আঁদ্রে মালরো বাংলাদেশের জনগনের পাশে দাড়াইয়া যুদ্ধ করিবার সংকল্প প্রকাশ করিয়াছেন। আঁদ্রে মালরো এই ঐতিহাসিক ঘোষণা পৃথিবীর মানুষকে অবাক করিয়া দিয়াছে। আঁদ্রে মালরো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর ফ্রান্সের অবিসংবাদিত গণনায়ক জেনারেল দ্য গলের মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ছিলেন।
.
মঁশিয়ে মালরো ফ্রান্সের একজন বিখ্যাত লেখক। আর সম্ভবতঃ ফ্রান্সই একমাত্র দেশ যেখানে এখনো বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক ও কবিরা চিত্রতারকাদের চাইতে অনেক অনেক বেশী জনপ্রিয়। ৬৯ বৎসর বয়স্ক ফরাসী লেখক মালরোর ঘোষনা তাই সমগ্র ফরাসী দেশে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছে। কূটনৈতিক মহল এই ঘটনার উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন। আঁদ্রে মালরো জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহন করিয়াছেন। স্পেনে স্বৈরাচারী জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে তিনি আন্তর্জাতিক বাহিনীতে যোগদান করিয়াছিলেন , চীনের গৃহযুদ্ধেও তিনি যুদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্তু আঁদ্রে মালরোর কৃতিত্ব তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফ্যাসিস্ট জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে ফরাসী প্রতিরোধ বাহিনীর অন্যতম সংগঠক। মালরো তাঁহার জীবনের এই সব সংগ্রামী ঘটনার পটভূমিতে রচনা করিয়াছেন অসাধারণ উপন্যাস। তিনি ১৯৬৯ সালে জেনারেল দ্য গলের পরাজয়ের পর সক্রিয় রাজনীতি হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু দ্য গল পন্থীদের মাঝে তাঁহার প্রভাব অত্যন্ত বেশী। মাঁশিয়ে মালরো ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক জগতের অন্যতম প্রতিভাবান প্রভাবশালী ব্যাক্তিত্ব। সম্প্রতি নয়া দিল্লীতে অনুষ্টিত বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা সর্বোদয় নেতা শ্রী জয় প্রকাশ নারায়নের কাছে এক চিঠিতে তিনি লিখিয়াছেন- –“ পাকিস্তানী জঙ্গীচক্র যে সময়ে ট্যাঙ্ক ও সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে বাংলাদেশের জনগনের উপর পশুসুলভ বর্বর আচরণ অব্যাহত রাখিয়াছে – তখন আবেদন – নিবেদন কিংবা সম্মেলন করিয়া কোন ফল হইবে না”।
.
‘লা ফিগারো’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের উপর জোর দিয়া মঁশিয়ে মালরো লিখিয়াছেন- আবেদন- নিবেদনের দিন শেষ হইয়াছে। আজ ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীর বর্বরতার একমাত্র জবাব সশস্ত্র সংগ্রাম। বাংলার জনগণকে যদি কেউ সত্যিই সাহায্য করিতে চান – তবে তাঁহাকে সশস্ত্র যুদ্ধে বাঙ্গালীর পাশে আসিয়া দাঁড়াইতে হবে”।
.
আঁদ্রে মালরোর এই প্রত্যয় ঘোষণা ফ্রান্সের রাজনৈতিক মহল বিশেষ গুরুত্ব লাভ করিয়াছে। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় একই সাথে ইহা দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করিয়াছেন।
.
আঁদ্রে মালরো ইতিমধ্যে জানাইয়াছেন – তিনি তাঁহার ঘোষণা সম্পর্কে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামী জনগণের সাহায্যে তাঁহার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা তিনি এই বিবৃতিতে উল্লেখ করিবেন বলিয়া আশা করা যাইতাছে।
.
সম্প্রতি মঁশিয়ে মালরো সহিত যাঁহার সাক্ষাৎ করিয়াছেন তাঁহারে বলেন, প্যারিসের বাইরে তাঁর নিজের বাড়িতে তিনি এখন অবসর জীবন যাপন করিতেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে সর্বশেষ সংবাদটিও তাঁহার জানা এবং মঁশিয়ে মালরোর দৃঢ় ধারণা, বিশ শতকের সত্তর দশকে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নির্যাতিত, নিপীড়িত জনতার এই নব- উত্থান পৃথিবীর ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা।
.
সত্তর বছরের বৃদ্ধ এই মানুষটি তাই বলিয়াছেন- আমি বাংলাদেশের যুদ্ধ অংশগ্রহণ করিতে চাই। মানবতার সপক্ষে নিপীড়িত জনতার এই সংগ্রাম একটি মহান সংগ্রাম। তিনি বলেন, “আমি বৃদ্ধ, হয়তো পদাতিক হিসাবে যুদ্ধ করার সামর্থ্য আমার হইবে না। তবে ট্যাঙ্ক চড়িয়া আমি পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার পশুদের মোকাবিলা করিবার শক্তি রাখি”।
.
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক দুনিয়ার ঘটনাবলীর পটভূমিতে বিচার করিলে বুঝা যায় – তৎকালীন সময়ে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ সম্ভব পর হইয়াছিল। কিন্তু আজ সেই সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত”। আমাদের চোখের সামনে রহিয়াছে ভিয়েতনামের দৃষ্টান্ত।
.
বাংলাদেশের মানুষকে আজ উপলধ্বি করিতে হইবে- যে জঘন্য পশু শক্তির বিরুদ্ধে বাঙ্গালীরা রুখিয়া দাড়াইয়াছেন, সেই পশু শক্তি ইতিহাসের ঘৃণ্যতম নরপশু। বাঙ্গালীকে আজ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই মুক্তি সংগ্রামকে চূড়ান্ত সফলতার দিকে নিয়া যাইতে হইবে।
.
বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের সামনে আজ আর অন্য কোন পথ নাই।