রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১৬৬,২৮১-১৮৩>
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী
তারিখঃ ৭ ডিসেম্বর,১৯৭১
রাজনৈতিক দিগন্তে
যাত্রিক
আজ মৃত্যুঞ্জয়ী ৭ই ডিসেম্বর। এক বৎসর আগে ঠিক এই দিনটিতেই অনুষ্ঠিত হইয়াছিল সেদিনের পাকিস্তানের ২৩ বছরের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। আর রাষ্ট্রীয় ভাগ্য নির্ধারণের প্রশ্নে নিজেদের অবাধ মতামত পেশের সেই প্রথম সুযোগেই শেখ মুজিবের বাংলার মানুষ দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে জানাইয়া দিয়াছিল চিরদিন কাহারো গোলাম হইয়া কলোনী হইয়া থাকার জন্য বাঙ্গালীর জন্ম হয় নাই। সেদিন বিশ্বের পার্লামেন্টারী রাজনীতির ইতিহাসে নজীর বিহীন নিঃশব্দ ব্যালটের বিপ্লবের মাধ্যমে শেখ মুজিবের বাংলাদেশ জানাইয়া দিয়াছিল বিদ্রোহী বঙ্গোপসাগরের প্রমত্ত হুঙ্কারে আমরাই আমাদের শাসন করিতে চাই- বাংলাকেই করিতে চাই বাংলার ভাগ্যবিধাতা। দ্ব্যর্থহীন ভাষায়, নিঃসঙ্কোচ আন্তরিকতায়, আর অন্তহীন ভালবাসা ও বিশ্বাসের সঙ্গে বাংলার মানুষ সেদিন নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার তুলিয়া দিয়াছিল বাংলার মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। এ রায় শুধুমাত্র একটি বিক্ষুব্ধ বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর রায় ছিলনা- এ রায় ছিল সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালীর বলিষ্ঠ রায়- সেদিনের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করিয়া সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্টারী দলের মর্যাদা এবং সমগ্র পাকিস্তান শাসনের অধিকার লাভ করে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে দুইটি সত্য দিবালোকের মত স্পষ্ট হইয়া যায়। প্রথমতঃ বাংলার মানুষ স্বাধিকার চায়- পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক দুঃশাসনের শৃঙ্খল চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য-নিয়ন্ত্রণ করিতে চায়। আর ৭ডিসেম্বর এই সত্যকেই সগৌরব মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করিয়া দেয় যে, একমাত্র শেখ মুজিবর রহমানেরই বাংলাদেশের এমনকি সমগ্র পাকিস্তানের পক্ষ হইয়া কথা বলার অধিকার রহিয়াছে।
২৪ বৎসর আগে পাকিস্তান নামক রাজনৈতিক জারজ সন্তানের সৃষ্টি হইবার পর একটি দিনের জন্যও সে দেশের মানুষ স্বাধীনতার আস্বাদ লাভ করিতে পারে নাই। দুই যুগ ধরিয়া পশ্চিম পাঞ্জাবী পুঁজিপতি, শিল্পপতি, কায়েমী স্বার্থবাদী ও শোষক ষড়যন্ত্রকারীদের অদৃশ্য সুতার টানে যারাই ক্ষমতার আসনে সমাসীন হইয়াছে আবার চিৎপটাং হইয়া পড়িয়াছে, তারা সকলেই ছিল এই উপনিবেশবাদী দুঃশাসনেরই নাট-বল্টু মাত্র। জনগণের সঙ্গে তাদের কোন যোগাযোগ ছিলনা- জনগণকে তারা না পারিয়াছে আপন করিতে, না পারিয়াছে জনমতের কাছে মাথা নত করিয়া তাদেরকেই সকল শক্তির উৎস ধরিয়া তাদের ইচ্ছানুসারে রাষ্ট্র শাসন করিতে। দুইযুগের ইতিহাস প্রমাণ করিয়াছে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট আমরা যা পাইয়াছিলাম তার নাম আর যাই হউক স্বাধীনতা নয়। বরং এই দিন স্বাধীনতার নামে শুধু গোলামীর জিঞ্জির বদল হইয়াছিল- ইংরেজদের বদলে আমরা আবদ্ধ হইয়াছিলাম পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদের নির্মম শাসন ও শোষনের নিষ্ঠুর শৃঙ্খলে। এই শৃঙ্খলে বিশেষতঃ বাঙ্গালী জাতির জন্য ছিল বৃটিশ পরাধীনতার চাইতে ভয়াবহ। শেখ মুজিবুর রহমানই একদিন বলিয়াছিলেন, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ২০০ বৎসরে বাংলাদেশকে যতটা শোষন করিয়াছে, পশ্চিম পাকিস্তানীরা ২৩ বৎসরে তার চাইতে অনেক বেশি শোষণ করিয়াছে। ২৩ বৎসর ধরিয়া পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক ও শোষকের দল শাসনের নামে, ব্যবসায়ের নামে, বাণিজ্যের নামে বাংলার শ্যামল মাটিকে ক্ষত-বিক্ষত করিয়াছে, কামড়াইয়া ছিঁড়িয়া খাবলাইয়া খাইয়াছে বাঙ্গালীর হাড়, মাংস, কলিজা। ২৩ বৎসরে নির্মম দস্যুর মত বল্গাহীন শোষন ও লুন্ঠনে সোনার বাংলাকে পরিণত করিয়াছে শ্মশানে, অন্তহীন দুঃখের ভাগাড়ে। বাঙ্গালী জাতির দুঃখ, বঞ্চনা ও দুর্ভোগ
যত বাড়িয়াছে ততই তীব্রতর হইয়াছে তার দূর্জয় জাতীয়তাবাদী চেতনা। বাঙ্গালী জাতির এই জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং নিজেই নিজের ভাগ্য নিয়ন্তা হওয়ার দূর্জয় বাসনা চরম রুপ লাভ করিয়াছে বিংশ শতাব্দীর অপরাজেয় জাতীয়তাবাদী গণশক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠার দুর্বার সংগ্রামের নির্ভীক সিপাহসালার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। ছয় দফা কর্মসূচীর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধিকার চাহিয়াছিলেন। কিন্তু এই আপাতঃ লক্ষ্য স্বাধিকারের দাবীর অন্তরালে যে চূড়ান্ত লক্ষ্য নিহিত ছিল সে সম্পর্কেও তিনি জনগণের কাছে আভাস দিতে ভুল করেন নাই। ১৯৭০ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারই প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে বাংলার ছাত্র, যুবক, শ্রমিক জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলিয়াছেন, “ছয় দফা যদি মানিয়া না নেওয়া হয় তবে কয় দফা দিতে হইবে আমার জানা আছে। যখন দরকার হইবে আমিই বিপ্লবের ডাক দিব, তোমরা প্রস্তুত থাকিও।” ষড়যন্ত্রকারী এবং শাসককুল যে সহজে জনগণকেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সকল শক্তির উৎস বলিয়া মানিয়া নিয়া তাদের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করিবেনা বঙ্গবন্ধু ইহা জানিতেন। আর জানিতেন বলিয়াই ভোট চাইতে গিয়াও তিনি জনগণের প্রতি সর্বাত্মক সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়াছেন। বাংলার মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি বলিয়াছেন, “আমি তোমাদের কাছে দুইটি জিনিস চাইঃ একটি তোমাদের ভোট, আর একটি যখন আন্দোলনের ডাক দিব তখন সর্বশক্তি লইয়া দুশমনের মোকাবিলা করিবার ওয়াদা।” প্রলয়-বিধ্বস্ত দুর্ভাগা বাংলার উপকুলীয় এলাকা পরিদর্শন শেষে ঢাকা ফিরিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৩শে নভেম্বর হোটেল শাহবাগে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। এই সম্মেলনে দেশ-বিদেশের দুইশোরও বেশী সাংবাদিক যোগদান করেন। এই সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথেই লক্ষ্যে পৌঁছিতে চাই। নির্বাচন যদি হয় ভাল। আর যদি নির্বাচন না হয় সংগ্রামের মাধ্যমেই আমরা অধিকার আদায় করিব। প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের যে দশ লক্ষ ভাইবোন প্রাণ হারাইয়াছে তাদের কাছে আমরা ঋণী। তাদের কাছে এই আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকারঃ প্রয়োজনবোধে আরো দশ লক্ষ বাঙ্গালী শহীদ হইব। তবু আমরাই আমাদের দেশ শাসন করিব-বাংলাকেই করিয়া তুলিব বাংলার ভাগ্যবিধাতা!”
এই পটভূমিতে গত বছর ৭ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানুষ ভোটকেন্দ্রে গমণ করে। তাদের এই দিনের রায়- নিজেরাই নিজেদের শাসক হইবার রায়- বাংলাকেই বাংলার ভাগ্য নিয়ন্তা করার রায়। আর এই রায় নিঃসন্দেহে দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক নব দিগন্তের সূচনা করিয়াছে। আজিকার মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা এবং বৈধতা সপ্রমাণেও তাই ৭ই ডিসেম্বরের রায়ের ভূমিকা অপরিসীম, অনস্বীকার্য। ৭ই ডিসেম্বরের সেই রায় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক-শোষকের দল মানিয়া নেয় নাই। কিন্তু বাংলার মানুষও শক্তির দাপটের কাছে মাথা নত করে নাই-নীরবে বরদাস্ত করে নাই বাঙ্গালী জাতির আশা-আকাঙ্খার উপর জল্লাদের হামলা।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম ২৬শে মার্চ। মাত্র আট মাস আগে বাঙ্গালী জাতি বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার পতাকা আর সমরাস্ত্র হাতে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্রের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে। এই আট মাসে ২৫শে মার্চের কালো রাত্রির হিংস্র জল্লাদী ছোবল, মানবেতিহাসের নজিরবিহীন বিভৎস নারকীয় গণহত্যাযজ্ঞ, হানাদার বর্বর ডালকুত্তা বাহিনীর পাশবিক নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ আর নির্যাতনের নীল সমুদ্র পাড়ি দিয়া, আকস্মিক আঘাতের প্রাথমিক বিপর্যয় কাটাইয়া, স্বাধীনতার দুর্গম বিসর্পিল পথের প্রান্তে প্রান্তে শাঠ্য ষড়যন্ত্র বাধাবিপত্তির মরণ ফাঁদ এড়াইয়া আপোষহীন সংকল্পে সামনে আগাইয়া পাল্টা আঘাত হানিতে অনেকটা সময় কাতিয়া গিয়াছে বাঙ্গালী জাতির। কিন্তু কর্তব্যে অবহেলা আর এতটুকু কালক্ষেপণও তারা করে নাই। হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও স্বাধীনতার স্বর্গতোরণের নির্দিষ্ট পথে আগাইয়া চলিয়াছে বাংলার মানুষ অপ্রতিহত বেগে। বুকে বুকে হানাদার দুশমনের উপর নির্মম প্রতিশোধ গ্রহণের লেলিহান চিতাগ্নি, অন্তরে অন্তরে স্বাধীনতার দুর্মর স্বপ্নের বন্যা, আর বাংলার মুক্তি সেনাদের চোখের সামনে উজ্জ্বল শিখায় জ্বলিয়াছে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রদীপ্ত আলোকমালা। সেই আলোতেই পথ দেখিয়া তারা অবিচল দৃঢ়তায় শত্রুবাহিনীকে কচুকাটা করিতে করিতে আজ আসিয়া দাঁড়াইয়াছে সুনিশ্চিত সোনালী সূর্যের আলোর রাজত্বে। এবার চরম আঘাত হানিবার পালা। বাংলাদেশের দিকে দিকে দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধারা এক যোগে দুশমনের উপর
প্রচণ্ড আঘাত হানিয়া চলিয়াছে- সর্বত্রই তাদের জয় জয় কার। বাংলার দশ-দিগন্তে আজ স্বাধীন বাংলার জয় জয়ন্তীর তূর্যনাদ। এই সাফল্যের তুলনা নাই। পৃথিবীর কোন দেশেই কোন কালে মাত্র আট মাসের মধ্যে একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধের এমন উল্লেখযোগ্য সাফল্যের আর কোন নজির নাই।
শুধু তাই নয়, নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে বাঙ্গালী জাতি। গত বছর ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে নিঃশব্দ ব্যালটের বিপ্লবের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতি সৃষ্টি করিয়াছিল বিশ্বের পার্লামেন্টারী রাজনীতির ইতিহাসে এক নজিরবিহীন রেকর্ড। কিন্তু সেদিনের পাকিস্তানের গণবিরোধী স্বৈরাচারী রাজশক্তি বাংলার মানুষের সেই নিরস্ত্র বিপ্লবের রায়কে সহজ ভাবে মানিয়া নেয় নাই। জঙ্গীচক্র যে বাঙ্গালীর আশা-আকাঙ্খার কাছে নতি স্বীকার করিবেনা, একথা অজানা ছিল না বাংলার নেতা ও জনতার কাছে, তাই নীরবে-নিভৃতে চলিয়াছে শক্তি দিয়া শক্তির মোকাবিলা করার প্রস্তুতি। যখন সময় আসিয়াছে সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালীর বিক্ষুব্ধ কন্ঠস্বরকে নিজের কন্ঠে তুলিয়া নিয়া প্রমত্ত হুঙ্কারে গর্জিয়া উঠিয়াছেন বাংলার মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ ‘বাংলাদেশ স্বাধীন। শত্রু আমাদের আক্রমণ করিয়াছে। সজোরে পাল্টা আঘাত হানো।’ বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠ নির্দেশ বাতাসে মিলাইয়া যাওয়ার আগেই হাতে অস্ত্র তুলিয়া নিয়াছে বাংলার মানুষ। প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণের প্রবল তরঙ্গাঘাতে ৭২ ঘন্টায় বাঙ্গালী জাতি নির্মূল করার জল্লাদী খোয়াব ভাঙ্গিয়া খান খান করিয়া দিয়া শেখ মুজিবের অনুসারীরা মুগ্ধবিস্মিত বিশ্ববাসীকে দেখাইয়া দিয়াছে শুধু ব্যালটেরই নয়-বাঙ্গালীর বুলেটেরও জোর কত বেশী। গত বছরের সাতই ডিসেম্বর আর এবারের সাতই ডিসেম্বর একই সগর্ব সগর্বে পতাকা উর্ধ্ব তুলিয়া ধরিয়াছে। একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির ইচ্ছাকে, আশা-আকাঙ্খাকে দাবাইয়া দেওয়ার শক্তি কাহারও নাই-কেহই পারেনা একটি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন বানচাল করিয়া দিতে। ৭ই ডিসেম্বর তাই মৃত্যুঞ্জয়ী।