শফিকুল ইসলাম
<৬,১৭৭,৩০৩-৩০৪>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
ইয়াহিয়ার যুদ্ধ চক্রান্ত ও তাহার দোসররা | নতুন বাংলা ১ম বর্ষঃ ১৩শ সংখ্যা |
১১ নভেম্বর, ১৯৭১ |
ইয়াহিয়ার যুদ্ধ চক্রান্ত ও তাহার দোসররা
(নিজস্ব ভাষ্যকার)
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম দমনে ব্যর্থ মনোরথ ইয়াহিয়া ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুংকার দিয়াছে। গত আগষ্ট মাসে ইয়াহিয়া সদম্ভে ঘোষনা করিয়াছিল প্রয়োজন হইলে ভাততের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিব। প্রথম হইতেই ইয়াহিয়া সাহেব বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদের ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী’ বলিয়া বিশ্ববাসীর চোখে ধোঁকা দিতে চাহিয়াছিল। ভারতে তাহার অত্যাচারে মুখে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের ভারত কর্তৃক সীমান্তে প্রেরিত ভারতীয় বেকার বলিয়া মিথ্যা অপপ্রচার চালাইয়াছে।
ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য ছিল তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্র হইতে অবাঞ্চিত ব্যক্তিদের ভারতে তাড়াইয়া দেওয়া, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ধ্বংস সাধন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে রক্তের বন্যায় ডুবাইয়া দিয়া স্বীয় অপকর্মের বোঝা ভারতের ঘাড়ে চাপানো, সেখানে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বাধাইয়া ভারতীয় মুসলিমদের জন্য মায়াকান্না এবং বিশ্বের দরবারে নিজেদের ২৪ বছরের সাম্প্রদায়িক শাসন-শোষণের পক্ষে সাফাই গাওয়া। কিন্তু জাগ্রত বাঙ্গালী হিন্দু মুসল্মান বৌদ্ধ খৃষ্টান নির্বিশেষে ইয়াহিয়ার এই শয়তানীর বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের দুই যুগব্যাপী মুখোশ ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছে। ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কবর রচনা করিতেছে।
স্বাভাবিক ভাবেই সাম্রাজ্যবাদী মহল বিশেষ ভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ইহাতে প্রমাদ গুনিয়াছে, তাহারা ইয়াহিয়ার মুখের বুলি লুফিয়া লইয়াছে। পাক-ভারত উত্তেজনার অজুহাত তুলিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বানচাল করিতে চাহিতেছে।
সাম্রাজ্যবাদীদের প্রত্যক্ষ উৎসাহে ইয়াহিয়া ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করিয়াছে। অন্ততঃ দুইবার সে স্পষ্টভাবেই ভারত আক্রমণ করিবে বলিয়া বড়াই করিয়াছে। সাম্রাজ্যবাদী সরকার উহার নিন্দা করা দূরে থাকুক একটু বিচলিত ভাব পর্যন্ত দেখায় নাই। এখন ভারত আত্মরক্ষার জন্য যেইমাত্র সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করিয়াছে অমনি তাহারা ভারতকে সংযম ধরিবার উপদেশ খয়রাতি শুরু করিয়াছে।
জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠাবার তাল মাঠে মারা যাওয়ার পর এবার সাম্রাজ্যবাদী মহল ভারত আক্রমনের জন্য পাকিস্তানকে উস্কানী দিতেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী সরকার ইয়াহিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করিতেছে। ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানীও অস্ত্র দিতেছে বলিয়া খবর পাওয়া গিয়াছে। অন্ততঃ ইয়াহিয়ার উক্তি হইতে এ রকম একটা আভাস পাওয়া যায়। চীনে একটি সামরিক প্রতিনিধি দল পাঠাইয়াছে, উদ্দেশ্য ভারত আক্রমন করিলে চীনের কাছ হইতে কী ধরণের সাহায্য ও সমর্থন পাইবে উহা যাচাই করা। পিকিং কর্তৃপক্ষের সুর হইতে মনে হয় তাহারা সরাসরি এ ব্যাপারে এখনে হয়ত আগাইয়া আসিবে না। তবে মার্কিন সরকারের সহিত একটা অন্ততঃ মিল পাওয়া যায় চীনা অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেং ফেইর মন্তব্যে। তিনি বাংলাদেশ প্রশ্নে ইহাহিয়ার কথিত সমাধানে বিশ্বাসী। তিনি পাকিস্তান ও ভারতকে বিরোধ মীমাংসার জন্য আহ্বান জানাইয়াছেন। এক কোটি শরণার্থী সম্পর্কে তিনি নীরব। কিন্তু পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষায় তাহার আগ্রহ হইতে বুঝা যায় তিনি বাংলাদেশে কী ধরণের সমাধান কামনা করেন। বলা বাহুল্য তাহার ধ্যান ধারনার সহিত বাস্তবতার কোন যোগ নাই।
সামরিক জোটের গাঁটছড়ায় আবদ্ধ পাকিস্তানের যুদ্ধদেহী মনোভাব চীনের চোখে পড়ে না। বারংবার পাকিস্তানকে আশ্বাস দিতেছে যে, বহিরাক্রমণের বিরুদ্ধে চীন তাহাকে সাহায্য করিবে ও সমর্থন জানাইবে। সাম্রাজ্যবাদীদের পান্ডা আমেরিকা পর্যন্ত এ কথা বিশ্বাস করে না যে, ভারত পাকিস্তান আক্রমন করিবে। অঠচ চীনের মত একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সরকারের আস্ফালনকে প্রশ্রয় দেয় ইহা দুঃখের বিষয়। চীনের সংগ্রামী ঐতিহ্যের ইহা বিরোধী।
পাক-ভারত সীমান্তে আজ যুদ্ধের ঘনঘটা। পাকিস্তান সমস্ত সীমান্ত রীতি লঙ্ঘন করিয়া সৈন্য সমাবেশ করিয়াছে। ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন এবং ভারতীয় এলাকায় গোলাবর্ষন করিয়া যুদ্ধের উস্কানী দিতেছে এবং এখনও মুক্তিসংগ্রামীদের “ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী” বলিয়া ভারতকে আক্রমণকারী হিসাবে চিহ্নিত করিয়া যুদ্ধ বাধাইবার ফিকির খুঁজিতেছে।
একথা স্পষ্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধে রূপ দিয়া আমাদের স্বাধীনতার প্রশ্নটি ধামাচাপা দেওয়া ও সংগ্রাম বাঞ্চাল করাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদদের আশু লক্ষ্য। ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহী উহা কার্যকরি করিতে ব্যগ্র।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র সফরে গিয়াছেন। তাঁহার উদ্দেশ্য শরণার্থী সমস্যার মূলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমন করার জন্য ইয়াহিয়ার বর্বরতা কাজ করিতেছে তৎসম্পর্কে রাষ্ট্রপ্রধানদের দৃষ্টি আকর্ষণ। ব্রিটিশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাহার কথায় কর্ণপাত করে নাই। তাহার ইতাকে পাকিস্তানে আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং পাক-ভারন উত্তেজনা হ্রাসের জন্য সীমান্ত হইতে উভয় পক্ষের সৈন্যাপসারণের ‘সদুপদেশ’ দিয়াছে। ইসলামী জাতীয়তাবাদের পক্ষে অবাঞ্চিত বাঙ্গালীদের নিধন ও বিতাড়নে ইয়াহিয়ার কলঙ্কিত হাতের সহিত বাঙ্গালীদের হাত মিলাইবার জন্য ইহারা উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে। আর এই মহৎ কাজের জন্য পাক-ভারত যুদ্ধকে অনিবার্য করিয়া তোলাই ইহাদের লক্ষ্য। নিক্সন সরকার ইন্দিরা গান্ধীকে তাহাদের এই পরিকল্পনায় সামিল করার জন্য চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু ইন্দিরাজীর দৃঢ়তার কাছে নিক্সনের চাল ব্যর্থ হইয়াছে। বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী হীথ সাহেবও সুবিধা করতে পারেন নাই। এই দুই দেশে সাংবাদিক সম্মেলনে ইন্দিরাজীর চোখা চোখা জবাবে ঝানু সাংবাদিকগণও সুবিধা করিতে পারে নাই। এই পর্যায়ে ইন্দিরা তাহাদের প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করেন উথান্ট অথবা অন্য কেহ কি শরণার্থীদের ভারতের ঘাড়ে চাপাইয়া দিয়া এখন ইয়াহিয়া সাহেব বলিতেছেন ভারত শরণার্থীদের ফিরিতে দিতেছে না, শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টির দায়িত্ব স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাহার সফরের ফলে বাংলাদেশের প্রকৃত সমস্যার চেহারাটা বিশ্বের চোখে আরও স্পষ্ট হইয়াছে।
কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা হাল ছাড়িবার পাত্র নয়। তাহারা ভারত উপমহাদেশে যুদ্ধ বাধাইবার চক্রান্ত হইতে সরিয়া দাঁড়ায় নাই। বিশেষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩৬ লক্ষ ডলার মূল্যের অস্ত্র সরবরাহের লাইসেন্স বাতিল করিয়া সম্প্রতি সাধু সাজার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু সিয়াটো এবং সেন্টোভুক্ত পাকিস্তানের দোস্ত রাষ্ট্রদের মাধ্যমে অস্ত্রশস্ত্র এমনকি বিমান সরবরাহ পুরাদমে চলিয়াছে।