<৯, ২.১, ২৮-৩২>
সেদিন চট্টগ্রামে যেমন করে
স্বাধীনতার লড়াই শুরু হয়েছিল
সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল জিয়াউর রহমান
(উনি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড হিসেবে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি লেঃ জেনারেল এবং রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। লেখাটি ২৬ শে মার্চ, ১৯৭২ সংখ্যার ‘দৈনিক বাংলা’ থেকে সংকলিত)
৩রা মার্চ, ১৯৭১ সাল। সময় সকাল সাড়ে নয় টা। এই প্রথম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সশস্ত্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার ব্যাপারে প্রথম প্রকাশ্য আলোচনা। এদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি ঘটছিল। সামরিক বাহিনীর অন্যান্য বাঙালি অফিসাররা অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের সবার মনেই একটি চিন্তাই পাক খেয়ে ফিরছিল- কি করা যায়? কি করব?
বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে তাঁরা বার-বার ছুটে আসছিলেন মেজর জিয়ার কাছে। মেজর জিয়া তখন ছিলেন ৮ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের বাঙালি অফিসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত।
এর পর এলো ৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন। বললেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।
৮ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের অফিসাররা একে অস্ত্র তুলে নেবার আহবান বলেই মনে করলেন।
পরদিন ৮ই মার্চ। আবার সেই সকাল। ওরা দু’জন সবার অলক্ষ্যে আবার উঠে এলেন ছাদে। মেজর জিয়াউর রহমান আর ক্যাপ্টেন অলি আহমদ। বিদ্রোহ ঘোষনা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে দু”জনে আলোচনা করলেন। ঠিক হলো বিদ্রোহ ঘোষনার জন্য উপযুক্ত মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু কখন আসবে সেই উপযুক্ত মুহূর্ত? কখন? কবে?
ওঁরা জানতেন এই বিশেষ মুহুর্ত টি আসবে তখনই যখন তাদের বিদ্রোহের সমর্থনে পূর্ণ আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবে জনসাধারণ। এই মুহুর্ত টি আসনে তখনই যখন শত্রুর বর্বরতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রমাণ সবার সামনে তুলে ধরা যাবে। এদিকে ইয়াহিয়া বসলো মুজিবের সঙ্গে আলোচনায়। ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসাররা রূদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলেন আলোচনার ফল কি হয়?…আলোচনার অন্তরালে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের এক জঘন্যতম চক্রান্ত। সে চক্রান্ত বাঙালিদের উপর হামলার। সে চক্রান্ত বাংলাদেশের উপর বর্বর অভিযানের।
আলোচনা চলছিল। আর এদিকে আসছিল জাহাজ বোঝাই সৈন্য। বিপুল পরিমান অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ। জাহাজ বোঝাই করে যে সব সৈন্য আসছিলো, তাদেরকে দ্রুত বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছিল।
এমন সময় ডাক এলো লেঃ কর্নেল এম, আর, চৌধুরীর কাছ থেকে। ১৭ইমার্চ রাত সাড়ে নয়টায় চট্টগ্রামে স্টেডিয়ামে সামরিক আইন সদর দপ্তরে তার ডাকে প্রথম গুপ্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হল- চারজন সামরিক বাহিনীর বাঙালি অফিসারের মধ্যে। এরা চারজন হচ্ছেন লেঃ কর্নেল এম, আর, চৌধুরী, মেজর জিয়াউর রহমান, নোয়াখালীর মেজর আমীন আহমদ চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন অলি আহমদ।
-কি মনে করছ? বৈঠকের শুরুতেই কর্নেল চৌধুরী পরিস্থিত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন মেজর জিয়াকে।
-ওদের ভাবগতি দেখে পরিস্কার মনে হচ্ছে ওরা হামলা চালাবে।
কর্নেল বললেন তাঁরও তাই ধারনা। কিন্তু কি করা যায়? সবারই মনে এই প্রশ্ন। এক- বিদ্রোহ। কর্নেল চৌধুরী সুস্পষ্ট ভাবে বললেন, সশস্ত্র অভ্যুত্থানই একমাত্র পথ। তিনি প্রথম বাঙালি সামরিক অফিসার যিনি সশস্ত্র অভ্যূত্থানের আহবান জানালেন।
সশস্ত্র অভ্যুত্থান। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম ‘সিপাহী বিদ্রোহের’ পর আর এক নতুনতর সিপাহী বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহ অবিশ্যম্ভাবী। সশস্ত্র অভ্যুত্থান ছাড়া বিকল্প আর কিছু নেই।
ওরা চারজন বাঙালি অফিসার বসলেন বিদ্রোহের পরিকল্পনা প্রণয়নে। ঠিক হলো ক্যান্টনমেন্টের স্টেশন কমান্ডার একমাত্র বাঙালি ব্রিগেডিয়ার এম, আর মজুমদারকে এ পরিকল্পনা থেকে বাইরে রাখতে হবে। ঠিক হলো লেঃ কর্নেল এম, আর, চৌধুরীর নেতৃত্বেই তারা বিদ্রোহের প্রস্তুতি চালিয়ে যাবেন।
এদিকে পাকিস্তানী হামলার প্রস্তুতি চলছিল পুরোদমে। বাঙালি অফিসারদের উপরে তাদের সজাগ দৃষ্টি হয়ে উঠেছিল আরো প্রখর। আর এরাও পাল্টা গোয়েন্দা বৃত্তি চালিয়ে সংগ্রহ করছিলেন পাক সেনাদের তৎপরতা। এরই মধ্যে কুমিল্লা থেকে বিস্তারিত খবর আসতে থাকল।
কমাণ্ড ব্যাটেলিয়নকে আনা হল চট্টগ্রামে। তাদেরকে রাখা হতে লাগল শহরের অবাঙালিদের বাড়ি বাড়ি। চট্টগ্রামের ২০ তম বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরাও প্রতি রাতে সাদা পোশাকে অসামরিক ট্রাকে করে বেরিয়ে যেত শহরে। তাদের কাজ ছিল অবাঙালিদের সাথে মিলে লুটপাট করা।
বাংলাদেশের উপর বর্বর হামলার প্রস্তুতি দেখতে এলেন পাক সেনাবাহিনীর জেনারেল হামিদ খান। ২১ শে মার্চ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে তাকে আপ্যায়িত করা হল মধ্যাহ্ন ভোজে। এই মধ্যাহ্ন ভোজেই পশ্চিমা সামরিক অফিসারদের কানাঘুষা আর জেনারেল হামিদের একটু ছোট্ট উক্তিতে বাঙালি অফিসাররা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন দিন ঘনিয়ে এসেছে। হামলা অত্যাসন্ন।
মধ্যাহ্ন ভোজে জেনারেল হামিদ বীর বাঙালি অফিসারদের যেন চিনতেই পারেন নি। তার যত কানাঘুষা আর কথাবার্তা চলছিল পশ্চিমা অফিসারদের সাথে।
কি এত কানাঘুষা? কিসের এত ফিসফাস? সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল্ল মেজর জিয়ার মন। কৌশলে একজনের সাথে কথা বলতে বলতে গিয়ে দাঁড়ালেন জেনারেল হামিদের ঠিক পেছনে। দাঁড়ালেন পেছন ফিরে। কথা বলতে লাগলেন সঙ্গীটির সাথে আর দু’কান সজাগ রাখলেন জেনারেল হামিদের কথার দিকে।
জেনারেল হামিদ তখন বলছিলেন ২০ তম বালুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল ফাতমীর সাথে। অনেক কথার মধ্যে অনেকটা যেন সামরিক নির্দেশের মতই কর্নেল ফাতমীকে বলে উঠলেন জেনারেল হামিদ- “দেখ ফাতমী, অভিযান (একশন) খুব দ্রুত ও কম সময়ের মধ্যে হতে হবে। আমাদের পক্ষের কেউ যেন হতাহত না হয়।”
আঁতকে উঠলেন মেজর জিয়া। একি? কি হতে যাচ্ছে? ঐ দিনই বিকেলে তিনি সস্ত্রীক এক সৌজন্য সাক্ষাতে গেলেন ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের বাসায়। কথায় কথায় তিনি জানতে চাইলেন জেনারেল হামিদের সফরের উদ্দেশ্য। কিন্তু ব্রিগেডিয়াম মজুমদারের সে তথ্য ছিল অজানা। তিনি শুধু বললেন, ওরা আমাকে বিশ্বাস করে না। তিনি জানালেন, জেনারেল হামিদ যখন অপারেশন রুমে ছিলেন তাঁকে সে ঘরে ঢুকতেই দেয়া হয় নি।
– কি বুঝলেন? জানতে চাইলেন মেজর জিয়া।
– মনে হচ্ছে সামথিং ফিশি।
জিয়া বললেন, ফিশি নয়- বিরাট কিছু। বিরাট এক চক্রান্তে মেতেছে ওরা। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার মেনে নিলেন সে কথা। পরদিন ২২শে মার্চ। রাত ১১ টায় চট্টগ্রাম ই-পি-আর সেক্টর দফতরের এডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিক এসে দেখা করলেন মেজর জিয়ার সাথে। তিনি সরাসরি বললেন, সময় খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমাদের বিদ্রোহ ঘোষনা করতেই হবে। আপনার প্রতি আমাদের আস্থা আছে। আপনি বিদ্রোহ ঘোষনা করুন। ই-পি-আর দের সাহায্য পাবেন। মেজর জিয়া তাঁকে তাঁদের পরিকল্পনার কথা জানান। ই-পি-আর এর সাহায্য সম্পর্কে আলোচনা করেন। ২৫শে মার্চে ব্যাপক রদবদল ঘটে গেল ক্যান্টনমেন্টের প্রশাসন ব্যবস্থায়।
ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে উড়ে এলেন জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা, জেনারেল আনসারি, মেজর জেনারেল মিঠা খান, লেঃ জেনারেল খোদাদাদ খান প্রমুখ। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে তারা জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন ঢাকায়। সেই সাথে নিয়ে গেলেন মেজর আমিন আহমদ চৌধুরীকেও। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের স্থানে আনসারী নিযুক্ত হলেন স্টেশন কমান্ডার। কর্নেল শিগারী দায়িত্ব নেন ই-পি-আর এর সেক্টর কমান্ডার হিসাবে।
এই রদবদলে আশংকিত হয়ে উঠেন বাঙালি সৈনিক ও অফিসারেরা। এই দিনই গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন লেঃ কর্নেল চৌধুরী।
এদিকে চট্টগ্রাম শহরের উত্তেজনা ক্রমেই বেড়ে চলছিল। অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াতের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হচ্ছিল প্রবল প্রতিরোধ। অস্ত্র খালাস করে যাতে পশ্চিমা সৈন্যদের হাতে পৌছাতে না পারে তার জন্য রাস্তায় রাস্তায় তৈরী করা হলো ব্যারিকেড। এই ব্যারিকেড সরিয়ে রাস্তা পরিস্কারের কাজে লাগানো হল বাঙালি সৈন্যদের। রাত ১০ টা পর্যন্ত চলল এই ব্যারিকেড সরানোর কাজ। রাত ১১ টার অফিসার কমান্ডিং জানজুয়া আকস্মিকভাবে মেজর জিয়ার কাছে নির্দেশ পাঠালেন এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে বন্দরে যাওয়ার জন্য। এই আকস্মিক ও রহস্যজনক নির্দেশের অর্থ তাঁর কাছে বোধগম্য হল না। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটায় জানজুয়া নিজে এসে তাকে নৌবাহিনীর একটা ট্রাকে তুলে ষোল শহর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বন্দরের দিকে রওনা করিয়ে দেন কিন্তু রাস্তায় ব্যারিকেড সরিয়ে সরিয়ে যেতে তার দেরী হচ্ছিল। আগ্রাবাদে যখন একটা বড় ব্যারিকেডের সামনে বাধা পেয়ে তার ট্রাক দাঁড়িয়ে পড়ে তখনই পিছন থেকে ছুটে আসে একটি ডজ গাড়ি। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান গাড়ী থেকে নেমেই আসেন মেজর জিয়ার কাছে। তাঁকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যান রাস্তার ধারে।
-পশ্চিমারা গোলাগুলি শুরু করেছে। শহরের বহু লোক হতাহত হয়েছে। খালেকুজ্জামানের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর থেকে কথা কয়টি ঝরে পরে। কি করবেন জিয়া ভাই এখন?
মাত্র আধ মিনিট। গভীর চিন্তায় তলিয়ে যান মেজর জিয়া। তারপর বজ্রনির্ঘোষে বলে উঠেন- উই রিভোল্ট!
সাথে সাথে তিনি খালেকুজ্জামান কে ফিরে যেতে বলেন। বললেন, ব্যাটালিয়নকে তৈরি করার জন্য অলি আহমেদকে নির্দেশ দিতে। আর সেই সাথে নির্দেশ পাঠান ব্যাটালিয়নের সমস্ত পশ্চিমা অফিসারকে গ্রেপ্তারের।
খালেকুজ্জামান দ্রুত ফিরে গেলেন ষোল শহরের দিকে। আর মেজর জিয়া ফিরে এলেন ট্রাকে। যে পশ্চিমা অফিসারকে তার সাথে দেয়া হয়েছিল, তাকে বললেন, হুকুম বদলে গেছে। বন্দরে যেতে হবে না। আমাদের এখন ফিরে যেতে হবে ক্যান্টনমেন্টে। বাঙালি সৈন্য যারা তার সাথে ছিলেন তাঁদেরকে ইশারায় বললেন রাইফেল লোড করে রাখতে, প্রয়োজন হতে পারে।
তাঁরা ফিরে আসেন ব্যাটালিয়নে। এসেই তিনি সাথের পশ্চিমা অফিসারকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি এখন আমাদের হাতে বন্দী। অফিসারটি আত্মসমর্পন করলে তিনি ট্রাক থেকে নেমে ট্রাকের পশ্চিমা নৌ-সেনাদের দিকে রাইফেল তাক করে তাদেরকেও অস্ত্র ছেড়ে আত্মমসমর্পন করতে বলেন। হতচকিত পশ্চিমা সেনারা সবাই আত্মসমর্পণ করে।
এরপর তিনি একাই গাড়ি নিয়ে ছুটে যান অফিসার কমান্ডিং জানজুয়ার বাড়ি। কলিং বেল টিপতেই ঘুম থেকে উঠে আসেন জানজুযা। আর সামনেই মেজর জিয়াকে দেখে ভূত দেখার মত করে চমকে উঠেন। তার ধারনা ছিল পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর জিয়া বন্দরে বন্দী রয়েছে। জানজুয়া কে গ্রেফতার করে নিয়ে ষোলশহরে ফিরে আসেন মেজর জিয়া। পথে অফিসার্স মেসে মেজর শওকত কে তিনি সব কথা বলতেই মেজর শওকত উৎফুল্ল হয়ে উঠেন এবং বিদ্রোহে তাঁর সাথে যোগ দেয়ার কথা ঘোষনা করে দ্রুত ব্যাটালিয়নে চলে আসেন।
এরপরই মেজর জিয়া স্থানীয় জননেতা ও বেসামরিক অফিসারদের সাথে যোগাযোগ চেষ্টা করেন, কিন্তু কাউকেই পান না। তখন টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অপারেটর কে জানালেন সবাইকে টেলিফোন করে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহের ঘোষনার কথা জানাতে। অপারেটর সানন্দে তাঁর এই নির্দেশ জানাতে রাজি হন।
তিনি লেঃ কর্নেল এম, আর , চৌধুরীকেও টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁকেও পাননি। পরে শুনেছিলেন পকিস্তানী সৈন্যরা এই রাতেই গুরুতর অসুস্থ এম, আর , চৌধুরীকে হত্যা করেছিল।
শুরু হয়ে গেল বিদ্রোহ। রাত তখন দুটো। ব্যাটালিয়নের আড়াইশোর মত সৈনিককে একত্রিত করে তাঁদেরকে সব কথা বলেন মেজর জিয়া। সবাই একবাক্যে এই বিদ্রোহের প্রতি তাঁদের পূর্ণ সমর্থনের কথা ঘোষনা করেন। তাঁরা জানান, দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁরা জান দিতেও প্রস্তুত। কিছু সৈন্য ষোলশহরে রেখে বাকিদের নিয়ে মেজর জিয়া বেরিয়ে পরেন কালুরঘাটের পথে। এদিকে ই-পি-আর এর জোয়ানেরাও লড়াই শুরু করেছিল। কালুরঘাটে পরেরদিন তাঁদের সাথে বেশ কিছু পুলিশ ও যোগ দেন।
২৬শে মার্চ সকাল। আগের রাতে ঢাকা শহরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে রাজধানীর উপরে পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল পাকিস্তানী বাহিনী। আর আনন্দে সকাল হতেই পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দফতরে চলছিল মিষ্টি বিতরণ আর অভিনন্দন বিনিময়ের পালা। কিন্তু কয়েক মূহুর্ত পরেই তাদের হাসি ম্লান হয়ে যায়। মিষ্টি হয়ে যায় বিস্বাদ। চট্টগ্রামের যুদ্ধের খবর যখন তাদের কাছে পৌছাল, তখন এক নিদারুন সন্ত্রস্তে আঁতকে উঠলেন তারা।
চট্টগ্রাম। পাকিস্তানীদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো চট্টগ্রাম। ২৭শে মার্চ সকালেই বিমান বোঝাই হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে গেল পুরো দ্বিতীয় কমাণ্ডো ব্যাটালিয়ন। চট্টগ্রাম যুদ্ধের পরিকল্পনা তৈরীর জন্য মিঠা খান কে হেলিকপ্টারে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে। বাঙালি সৈন্যরা গুলি করে সে হেলিকপ্টারটি ফুটো করে দেয়। একই সাথে বিমানে করে নামানো হতে লাগল দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ন কে। নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বাবর কে নিয়ে আসা হয় বন্দরে। এতে ছিল দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য। ডেস্ট্রয়ার, এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক ও লাগানো হয় এই যুদ্ধে। জাহাজের গান থেকেও গোলা নিক্ষেপ হতে থাকে শহরের দিকে।
এই বিরাট শক্তির মোকাবিলায় বেশিক্ষন টিকে থাকা সম্ভব হবে না এ কথা বাঙালি সৈন্যরা বুঝেছিলেন। তাই শহর ছেড়ে যাবার আগেই বিশ্ববাসীকে কথা জানিয়ে যাবার জন্য মেজর জিয়া ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যান। বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা মেজর জিয়া কে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠেন। কিন্তু কি বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লিখেন আবার ছিড়ে ফেলেন। কি জানাবেন তিনি বিশ্ববাসী এবং দেশবাসী কে বেতার মারফৎ? এদিকে বেতার কর্মীরা বারবার ঘোষণা করছিলেন- আর পনের মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়া ভাষণ দেবেন। কিন্তু পনের মিনিট পার হয়ে গেল। মেজর জিয়া মাত্র তিনলাইন লিখতে পেরেছেন। তখন তাঁর মানসিক অবস্থা বুঝাবার নয়। বিবৃতি লেখার ঝুঁকিও ছিল অনেক। ভাবতে হচ্ছিলো শব্দ চয়ন, বক্তব্য পেশ প্রভৃতি নিয়ে।
প্রায় দেড় ঘন্টা মোসাবিদার পরে তিনি তৈরী করেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটি। নিজেই সেটা বাংলা ও ইংরেজীতে পাঠ করেন।
১১ই এপ্রিল পর্যন্ত কালুরঘাটে থেকে তাঁরা চট্টগ্রামের যুদ্ধ চালিয়ে যান। তাঁদের যুদ্ধের সাথে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল ২০ তম বালুচ রেজিমেন্ট, কুমিল্লা থেকে নিয়ে যাওয়া ৫৩-ব্রিগেড। আর নিশ্চিহ্ন হয়েছিল কমান্ডো, যারা অবাঙালিদের ঘরে ঘরে ঘাঁটি গেড়েছিল।
এদেরকে ছাড়াও চট্টগ্রামের এই যুদ্ধে বাঙালিদের বিরুদ্ধে লাগানো হয়েছিল কোয়েটা থেকে নিয়ে আসা ১৬শ ডিভিশন ও প্রথম কমান্ডো ব্যাটালিয়নকে।
৩০শে মার্চ সকালে মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র) থেকে আর এক ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার ঘোষণা করেন।
এই দিনই দুটি পাকিস্তানী বিমান থেকে গোলাবর্ষন করে বেতার কেন্দ্রটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
১১ই এপ্রিল কালুরঘাট এলাকা থেকে অবস্থান সরিয়ে নেয়ার পর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায়। এ যুদ্ধ চলে রামগড়, রাঙ্গামাটি এলাকায়। যুদ্ধ চলে কক্সবাজারের পথে, শুভপুরে। যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই দলে দলে জনসাধারণ বিশেষ করে ছাত্ররা এসে যোগ দিয়েছে বাহিনীতে। অস্ত্র ধরেছে, ট্রেনিং নিয়েছে, বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে।
৩০শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যাবার পর ৩রা এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টায় পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন এক গোপন এলাকা থেকে চালু করা হয় আরেকটি বেতার কেন্দ্র। “আমার সোনার বাংলা” দিয়ে করা হয় এই কেন্দ্রের উদ্বোধন। এই গানটি গাইবার জন্য সেই রাতে সেখানে এসেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের তদানীন্তন পুলিশ সুপার জনাব রহমানের তিন মেয়ে।