ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরের কিছু কথা
সাক্ষাৎকারঃ এয়ার কমোডোর এম, কে, বাশার
২৫শে মার্চ বিকাল চারটার সময় বিশেষ বোয়িং তার নিরাপত্তা প্রহরী নিয়ে বিমান বন্দরে অবতরণ করে। বিমান বাহিনীর দুজন অফিসার (তন্মধ্যে একজন আমি ও ছিলাম) এবং একজন টেকনিশিয়ানকে বোয়েংটির কাছে যেতে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সেনানিবাস থেকে টেলিফোনে নির্দেশ দেওয়া হয় বোয়িং ষ্টার্ট করার জন্য। রাত আটটায় একটা প্রাইভেট গাড়ীতে করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান(এর গাড়ীর ড্রাইভার ছিলো একজন কর্ণেল) ঢাকা সেনানিবাস থেকে সোজা একটা বোয়িং- এ উঠে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে বিমান চলে যায়। ঐ বিমানে প্রেসিডেন্ট একা ছিলেন। প্রেসিডেন্টের এভাবে চলে যাওয়াতে আমার ধারণা হলো যে, হয়তো জেনারেল হামিদ খান ক্ষমতা দখল করেছেন এবং ইয়াহিয়া খানকে বোয়িং-এ করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, জেনারেল হামিদ তখন ঢাকায় ছিলেন।
২৫ শে মার্চ রাতে আমি বনানীতে আমার বাসায় ছিলাম। রাত বারোটার পর ভীষণ গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভোর রাত থেকে জনগণ বনানীর ওই পথ দিয়ে গ্রামের দিকে পালাচ্ছে।
২৭ শে মার্চ আমি অফিসে আসি। সেই সময়কার বেস কমান্ডার ছিলেন এয়ার কমোডোর জাফর মাসুদ, যিনি মিঠঠি মাসুদ হিসাবে বিমান বাহিনীতে পরিচিত ছিলেন। আমরা বাঙালি অফিসাররা তাঁর সাথে দেখা করলাম এবংদেশের এই পরিস্থিতিতে আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তার সাথে আলাপ করলাম। তিনি বললেন, নো ওয়ান উইল টাচ মাই মেন অর অফিসার বিফোর দে কিল মি’। আমরা তাকে অনুরোধ করলাম তিনি যেন সবাইকে ডেকে সান্তনা দেন। এর মধ্য ২৯ শে মার্চ সেনাবাহিনী বিমান বাহিনীর কাছে বিমান সাহায্য চেয়ে পাঠায়। তিনি সে সাহায্য দিতে অস্বীকার করেন।
৩০ শে মার্চ তিনি বেসের সবাইকে ডেকে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, “তোমরা সবাই জান যে, সেনাবাহিনী তৎপরতা চালাচ্ছে। আমি বিমান সাহায্য দিতে অস্বীকার করেছি। কিন্তু আমি কতদিন এটা ঠেকিয়ে রাখতে পারব বলতে পারছি না। সমস্ত বাঙালি পাইলট দেরকে এই সব মিশনে যাওয়া থেকে অব্যাহতি দিচ্ছি এবং যে সমস্ত বাঙালি টেকনিশিয়ানরা এই সমস্ত বিমানে কাজ করতে চায়না তারা অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটিতে যেতে পারে।”
এপ্রিল মাসের ৩/৪ তারিখে প্রথম বিমান হামলা চালানো হয় পাবনার আশেপাশে। এয়ার কমোডোরের নির্দেশ ছিলো যদি কোথাও লোক জমায়েত দেখা যায় প্রথমে যেন ওয়ার্নিং শর্ট করা হয় যাতে করে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অপরদিকে সেনাবাহিনীর নির্দেশ ছিলো ম্যাসাকার করার জন্য। এই জন্য এয়ার কমোডোর জাফর মাসুদকে বদলি করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং চাকরী থেকে বরখাস্ত করা হয়।
এর মধ্য সমস্ত বাঙালি অফিসারকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করা হয়। আমরা ছুটি নিলাম। আমরা কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। জিয়াউর রহমানের ভাষণ আমরা শুনেছিলাম। লোকমুখে শুনলাম যে, ময়মনসিংহ এলাকায় প্রতিরোধ চলছে। তখন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মীর্জাকে খবর আনার জন্য পাঠানো হয়। সেও ঠিকমতো কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি-তবে একটা থমথমে পরিবেশ সে লক্ষ্য করেছিল। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাদেরকে আগরতলাতে পাঠানো হয়। সে ভারতে গিয়েছিলো এবং খালেদ মোশাররফের বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হযেছিল।যখন সে ফিরে কুমিল্লা আসে তখন পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
১২ ই মে আমরা ঢাকা ত্যাগ করলাম।নরসিংদী হয়ে লঞ্চে রওনা হলাম। লঞ্চ থেকে আমরা দেখলাম যে, পাক বাহিনী একটা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের সাথে আমাদের দেখা হয়। সে তার বাড়ীতে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল।