দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,২০০,৩৪৮-৩৪৯>
শিরোনামঃ সংগ্রামী বাংলার বসন্ত চলে যায়
সংবাদপত্রঃ সংগ্রামী বাংলা ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৭ নভেম্বর, ১৯৭১
সংগ্রামী বাংলার বসন্ত চলে যায়
পাকিস্তান ২২ বছর ধরে সংগ্রামী বাঙ্গালী জাতিকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে, উদ্যত সঙ্গীনের সামনে । তাই আজ শোষিত, অত্যাচারিত, জনগণের সংগ্রামী আদালত পাকিস্তান মৃত্যুদন্ডের রায়ে স্বাক্ষর করেছেন ।
পাকিস্তানের নামে নির্মম শাসন, ইসলামের নামে নির্লজ্জ শোষণ, মুসলিম ভ্রাতৃত্বের নামে অন্যায় অত্যাচার, অবিচারকে চিরতরে নির্মূল করে দেওয়ার জন্য বাংলার জনগণ আজ বদ্ধপরিকর । সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত । সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের শোষিত জনগণও পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির জন্য রণসাজে সজ্জিত । পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে স্বাধীনতার জন্য এই যে মহাজাগরণ, এই যে রক্তক্ষয়ি যুদ্ধ তা রোধ করার ক্ষমতা পাকিস্তানের জঙ্গী সরকারের নাই । পাকিস্তান নিজের হাতে নিজের কবর রচনা করেছে যে কবরে সমাহিত করতে চেয়েছিল বাংলা, সিন্ধু, বেলুচ ও পাখতুনদের ন্যায়সঙ্গত জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে ।
অন্তিম মুহূর্তে পাকিস্তান মৃত্যুর বিভীষিকাই চোখের সামনে দেখছে । পাকিস্তান আজ ঘাতকের বেশে দেশবাসীর সামনে দেখছে । পাকিস্তান আজ ঘাতকের বেশে দেশবাসীর সামনে উপস্থিত আর বাংলা, সীমান্ত, বেলুচিস্তান ও সিন্ধু তার বধ্যভূমিতে পরিণত । পাকিস্তান আজ স্বাধীনতাকামী জনগণের সামনে ভীতি ও অভিশাপস্বরূপ । এখন আমরা ইতিহাসের এক চরম বৈপ্লবিক অধ্যায়ের দ্বারদেশে উপনীত । বাঙালীরা স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকবে কি না । যদিও কোন কোন বাঙালী চিরদিন শাসক-শোষকদের গোলামী করেছে । ভাই হয়ে ভাইয়ের বুকে ছুরি বসিয়েছে । দেশের স্বার্থ কেউ কেউ বিদেশীদের কাছে বিক্রিও করেছে । এই বাংলায় মীরজাফরের আবির্ভাব ঘটেছে আবার সিরাজ, মোহনলালেরও জন্ম হয়েছে । কুচক্রীও আছে, আবার মহানুভবতাও আছে এ বঙ্গভূমিতে । ভীরু হৃদয়ও যেমন আছে তেমনি সিংহ হৃদয়, মহৎ হৃদয়েরও অনেক লোক আছেন । এই বাংলায় সুবিধাবাদীও আছে আবার পরম বিশ্বাসী দেশপ্রেমিকের অভাবে নাই । এই বাংলাদেশ বহু আন্দোলন, বিদ্রোহ ও বৈপ্লবের জন্ম দিয়েছে আবার অনেক গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থও হয়েছে । অনেক ত্যাগ, অনেক সাধনা, অনেক প্রতিভা, অনেক জীবন সংগ্রাম, অনেক রক্তদান বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে । তা সত্ত্বেও সংগ্রামের মহামন্ত্রে দীক্ষাগ্রহণকারীরা চিরদিন বলেছেন oh motherland with all thy faults we love still thee অতীতের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সামনে রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। রুশ বিপ্লব, চীন স্পেনের গৃহযুদ্ধ নাইজেরিয়া, বায়াফ্রা, কঙ্গো-কাতাঙ্গার মর্মান্তিক কাহিনী । রাজনৈতিক বিভেদ, হিংসাদ্বেষ দলমত নির্বিশেষে সমস্ত মুক্তিকামী জনগণ আজ একান্ত-অভিন্ন । সংগ্রামী জনসাধারণ সবাই সমান । সকলের ত্যাগের ও সংগ্রামের মর্যাদা অনস্বীকার্য । love begets love ’ ভ্রাতৃত্ব, প্রীতি ও ভালবাসার বন্ধনে আজ আবদ্ধ সমস্ত স্বাধীনতাকামী জনগণ । অসংগঠিত মুক্তিযুদ্ধ- নির্মম গৃহযুদ্ধে রূপ নেয় কোন কোন সময় । কেননা মুক্তিযুদ্ধ মূলতঃ রাজনৈতিক যুদ্ধ, রাজনৈতিক কর্তব্য নিষ্ঠা, চরম ত্যাগ, অসংখ্য রক্তদানের বিনিময়েই স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় সম্ভব । বিদেশী হানাদারদের চিরদিনের জন্য বাংলার বুক থেকে নির্মূল আমাদের করতেই হবে ও আমাদের জাতীয় আদর্শের ডাক- প্রানপ্রিয় জন্মভূমির জ্বালাময়ী আহবান, সন্তানহারা মায়ের অশ্রুজল মিনতি, মাতৃহারা শিশুদের প্রতিহিংসান্মোত্ত আহবান, স্বামীহারা লাঞ্চিতা নারীর করুণ আবেদন, ভূমিহারা বঞ্চিত লুণ্ঠিত কৃষকের উদাত্ত আহবান, সর্বহারা শ্রমিকের বজ্রকঠোর শপথ, সংগ্রামী ছাত্র যুবকের পবিত্র সংকল্প সমস্ত মুক্তিকামী রাজনীতিকদের ঐক্যবদ্ধ ঘোষণা, “ কে আছ বাংলার বীর সন্তান রক্ত নিতে হবে, রক্ত দিতে হবে, এগিয়ে যাও” অস্ত্র নাও “ বাংলার বুক থেকে বিদেশী অত্যাচারী জালেমশাহী হটাও । বাঙ্গালীরা, কৃষক শ্রমিক ছাত্র যুবক জনগণ মুক্তির আদর্শে উদ্বুদ্ধ সদা জাগ্রত সৈনিক । নিষ্ঠুর মৃত্যুর সংগে লড়াই করছে দিনের পর দিন রাতের পর রাত । “ দানবের সাথে সংগ্রামের তরে সবাই প্রস্তুত ঘরে ঘরে” তবে নাগ নাগিরা চারিদিকে ফেলছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস সংগ্রামী গণঐক্যে ফাটল সৃষ্টি যেন না হয় । লক্ষ লক্ষ নরনারী পশুর মত জীবন বিসর্জন দিয়েছে কোটি কোটি লোক গৃহহারা, সম্পদহারা পথের কাঙ্গাল হয়েছে । অসংখ্য নারী তার সতীত্বের মর্যাদা হারিয়েছে, বাংলার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি বিনষ্ট হয়েছে । লক্ষ লক্ষ বাড়ি ঘর ভস্মীভূত হয়েছে সেই মহাশ্মাশানের বুকে দাঁড়িয়ে সংগ্রামী বাংলার নতুন ইতিহাস সৃষ্টির দায়িত্ব আমাদের উপর । পুরাতনের ধ্বংসস্তূপের উপর গড়ে তুলতে হবে আমাদের নতুন স্বাধীন দেশ, স্বাধীন জাতি, সার্বভৌম রাষ্ট্র দানবের নির্মমতা, কুচক্রীর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে স্বাধীনতার অগ্নি পরীক্ষায় আমাদের উত্তীর্ণ হতে হবে । স্বাধীনতা, দুঃখ, কষ্ট, ত্যাগ সাধন , সংগ্রাম, আর রক্ত সব এক মিছিলে একাকার হয়ে এগিয়ে চলেছে ভাবী কালের দিকে । ভাবী বংশদধরদের জন্য একটি নতুন ইতিহাস নতুন দেশ উপহার দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে- আর দেরী নয় । সংগ্রামী বাংলার বসন্ত চলে যায় । গণবিপ্লবের সময় বহিয়া যায় ।