২২০. ১১ ডিসেম্বর শত্রু পরিত্যাক্ত ভালুকা

সহুল আহমদ মুন্না

<৬,২২০,৩৭১-৩৭২>

শিরোনামঃ শত্রুপরিত্যাক্ত ভালুকা

সংবাপত্রঃ জাগ্রত বাংলা, ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা

তারিখঃ ১১ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

                                  শত্রুপরিত্যাক্ত ভালুকা

বাংকার, বাংকার, শুধু বাংকার। যেদিকে তাকানো যায়, চোখে একটা না একটা বাঙ্কার পড়বেই। ভালুকার কুলাঙ্গার চান মিয়ার বাড়ির উঠোনে তেমনি একটা বাংকার চোখে পড়লো। এতো চমৎকারভাবে তৈরী এ বাংকারটি যে, দিনের পর দিন এতে আশ্রয় নিয়ে থাকলেও বিপদের এতটুকু সম্ভাবনা নেই। বাড়ীটির পশ্চিমদিকেও চারখানা বড় বড় বাঙ্কার। এ সবের মধ্যে থাকা খাওয়া সবকিছুই চলতে পারে। এ থেকে বেরিয়ে নিরাপদে পালাবার পথও তৈরী রয়েছে। এক কথায় বাড়ীটি এতো সুরক্ষিত যে, একে একটা দূর্গ বলা চলে; ছাদের উপরও বাঙ্কারের অস্তিত্ব তারই প্রমাণ।

 

বাড়ীটি থেকে বেরুলেই সামনে নদী। খেয়াঘাটের উপর রাস্তার মুখে বাংকার। দূর থেকে বুঝা যায় না ওখানে কোন শত্রু ঘাটি আছে কিনা। এর একটু পেরিয়েই কিছু বেড়ার ঘর, সেখানে রাজাকাররা থাকতো তাদের পরিবার নিয়ে। পরিবার পরিকল্পনা দপ্তর, সাবরেজিস্ট্রার অফিস এ সমস্ত ঘরগুলোও একই কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে ওখানে পড়ে রয়েছে চাল, ডাল, মরিচ। কোন জায়গায় পড়ে আছে রান্না করা খাবার, খেয়ে নেবার সময়টুকুও পায়নি – পালাতে হয়েছে পাক সেনাদের পা চাটা পোষা কুকুরের মত।

 

বাজারের পশ্চিম অংশে বহু বাঙ্কার আর শেল্টার। দক্ষিণে ঈদগাহ মাঠটিও বিরাট বাংকারে পরিপূর্ণ। মসজিদের দক্ষিণ পাশে দু খানা বাঙ্কার জোড়া লাগানো; এক একটাতে গোটা পরিবার নিয়ে বাস করা যেতে পারে। বাজারের পর থানা। থানার পশ্চিম দিকে সুউচ্চ মাটির বাঁধ, বাঁধের আড়ালে বাঙ্কার। মাত্র কদিন পূর্বেই একটি দালান তৈরী হয়েছে দশ ইঞ্চি পুরু দেয়ালে; পশ্চিম দেয়ালটায় গুলি করার জন্যে ফোঁকরা রাখা হয়েছে। শুধু থানাটিকে ঘিরেই পশ্চিমে বড় বড় ১০ খানা, দক্ষিণে ৭ টা,  পূর্বেও ১০ খানা ও উত্তরে ৪ টি বাঙ্কার। থানা এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে মাটির নিচে একটি ঘর। ঘরটিতে চেয়ার, টেবিল, তক্তপোষ সবই পাতা রয়েছে। শোনা গেল পাক হানাদারেরা ওখান থেকে ওয়ারলেসে খবর পাঠাত। একটা ব্যাপার খুব অবাক হবার মত – পালিয়ে যাবার পূর্ব মুহূর্তে ওরা প্রতিটি অফিসের কাগজগুলো নষ্ট করে দিয়েছে। থানার অফিস কক্ষেও একই কান্ড, কাগজপত্র নষ্ট অবস্থায় ইতস্ততঃ ছড়ানো।

 

থানার পূর্ব পাশ দিয়ে হাইওয়ে। গোটা হাইওয়েটাই বাঙ্কার ও ট্রেন্সে একাকার। এসব দেখে স্বভাবতঃই মনে ভয় জাগে, নিরাপত্তার এতো সুন্দর বন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও শত্রুরা পালিয়ে গেলো কেন? মেজর আফসারের কাছে এ প্রশ্নের জবাব মিললো। তিনি বলেন,এক মাস যাবৎ আমরা তাদের এমনভাবে অবরোধ করেছিলাম যে, তাদের খাদ্য, পানীয় এবং সকল রকম সরবরাহের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার ওপর প্রচন্ড আক্রমনণ এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক – সামরিক পট পরিবর্তনের সামনে ওরা দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।

 

শত্রুর তৈরী একটা বাংকারে বসে বিষয়টি লেখা চলছিল। ভালুকা থানার রেভিনিউ সার্কেল অফিসার বললেন, পাক সেনারা ভালূকায় আসার দু দিন পর আমাকে জোর করে ধরে এখানে আনা হয়। এরপর এখানে যা দেখেছি তা প্রকাশ করতে সংকোচ করতে লাগে। চান মিয়ার সুযোগ্য পুত্র ধনু মিয়া এখানে না থাকলে এ – অঞ্চল এতোটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতো না। ধনু ও তার সঙ্গীরা একদিন ১৯ জন নারীর ওপর পাশবিক উৎপীড়ন চালায়।

 

চান মিয়া যাকে লোকে একসময় সমীহ করে কর্তা বলতো, পাক জঙ্গী চক্রের সেই বিশ্বস্ত কর্তা আজ নেই। তার বিশাল বাড়ী সমস্ত কুকীর্তির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক ঐশ্বর্য আর আসবাবপত্র গড়ে উঠেছিলো বাড়ীটিতে, যে ঐশ্বর্যের পরতে পরতে মানুষের রক্ত, ভারী ভারী গদিজোড়া আসন, যাতে গা রাখিলে আবেশে চোখ আপনি বুজে আসে – আলমারী ভর্তি পোষাক – অগণিত ট্রাঙ্ক, সুটকেস – প্রতিটি কক্ষের একই সাজ। সবগুলো টেবিলের ওপর বিদেশী ম্যাগাজিন, অবসর বিনোদনের জন্যে বই, যেন সবাই একটুখানি বাইরে গেছে এক্ষুণী এসে পড়বে।

 

কিন্তু তারা আর আসবে না। মুক্তিবাহিনীর ক’জন বীর জোয়ান সদর্পে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে বাড়ীটাতে।

 

কিছু রাত হতেই শোনা গেল দূর থেকে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান। একজন শাস্ত্রী মেজরের সামনে এসে স্যালুট জানিয়ে বলল, একদল রাজাকার এসেছে। জানা গেলো, ওরা ধীতপুরে সকালের দিকে আত্নসমর্পণ করেছে। মেজর তাদেরকে নিরস্ত্র করে আনতে বললেন। ৮০ টা রাইফেল, ১টা স্টেনগান, একখানা এল. এম. জি. সহ বিপুল পরিমাণ গোলারুবাদ পাওয়া গেলো ওদের কাছে। মেজর আফসারের কাছে অবশ্য এ ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। মাত্র ক’দিন আগে তিনি ‘জাগ্রত বাংলা’র প্রতিনিধির কাছে ব্যাক্ত করেছিলেন, আর তিন দিন পর আপনারা মুক্ত ভালুকায় বসে রিপোর্ট লিখবেন।

 

মেজর আফসারের এ – দূরদর্শিতাই তাঁর যথার্থ পরিচয়। তাঁর প্রতিটি কথার পিছনে থাকে অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতার পিছনে কর্মের একটা প্রয়াস। সামরিক পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ ভুলভ্রান্তি হয়তো তাঁর কখনও হয়েছে কিন্তু অদম্য নিষ্ঠা তাঁকে একের পর এক এনে দিয়েছে সাফল্যের বিজয় গৌরব। চারিত্রিক দৃঢ়তায় মেজর আফসারের প্রকৃত সৈনিকের ন্যায়ই অনাড়ম্বর। 

Scroll to Top