২৪৬. ১৬ ডিসেম্বর সাম্প্রদায়িক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত

কম্পাইলারঃ লাল কমল

<৬,২৪৬,৪১৬-৪১৭>

শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
সাম্প্রদায়িক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত দেশ বাংলা

১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

 

বাংলাদেশের সুস্থ রাজনীতির উৎজ্জ্বল সম্ভাবনা

সাম্প্রদায়িক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত

(দেশবাংলা রিপোর্ট)

 

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ ঘোষনা করেছন, বাংলাদেশে অতঃপর কোন সাম্প্রদায়িক দল থাকবে না। জামাতে ইসলামী, তিন মুসলিম লীগ, পিডিপি ও নেজামে ইসলাম দলকে বেআইনী ঘোষণা করে জনাব তাজউদ্দিন যশোরে স্বাধীন বাংলার মাটিতে প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, এখন থেকে আর ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।

 

বলা বাহুল্য প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষনা সর্বত্র অভিনন্দিত হয়েছে। বিগত বছর যাবৎ বাংলাদেশকে পদদলিত করে রাখার ব্যাপারে পশ্চিমা চক্র ধর্মের লেবাসধারী এই দলগুলিকে সর্বপ্রকারে মদত দিয়েছে এবং বাংলাদেশে একটি  প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থ-স্বর্বস্ব দালাল শ্রেনী সৃষ্টি করার কাজে এই দলগুলিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে। গনতন্ত্রের টুটি টিপে ধরে, সর্বপ্রকারের প্রগতির পথ আগলে দাঁড়াবার ব্যাপারে এই সব রাজনৈতিক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলি যথেষ্ট ‘সংগ্রাম’ও করেছে।

 

২৫শে মার্চ বাংলাদেশের উপর নারকীয় দুর্যোগ নেমে আসার পর এই দলগুলির গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল নেতৃবৃন্দ নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ‘শান্তি(?)কমিটি’ গঠনের জন্য টিক্কা খাঁর কাছে ধর্ণা দেয়। তারপর থেকে এই সব শান্তি সৈনিকেরা ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্রের কামানের খোরাক এবং কামনার শিকার সন্ধানের জন্য শিকারী কুকুরের ভূমিকা পালন করে এসেছে। তারই ইনাম হিসাবে তাদের ভাগ্যে জুটেছিল ‘উপনির্বাচন’। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ হাতের গ্রাস হাতেই থেকেছে, মুখে পৌছাবার আগেই কম্ম-কাবার হয়ে গেছে।

 

অতীতে দক্ষিণপন্থী ধ্যান ধারনা পোষণ এবং সাম্প্রদায়িক চেতনাভিত্তিক রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের পিছনে অন্ততঃ এইটুকু যুক্তি ছিল যে জনগণকেই ভালোমন্দ বিচার করতে দেওয়া হোক। গণতন্ত্রে কোন মতকে জোর করে শুদ্ধ করে দেওয়া চলে না। কিন্তু গত আট মাসে এই তথাকথিত দলগুলি দেশ ও জাতির সাথে যেভাবে বিস্বাসঘাতকতা করেছে এবং দেশের মাটি রক্তে রঞ্জিত করার কাজে শত্রুকে সর্বপ্রকারের সহায়তা করেছে, তার প্রেক্ষিতে আজ সে ব্যপারে কোন শৈথিল্য প্রদর্শনের সুযোগ নাই। পঞ্চমবাহিনীকে দেশের বুকে রাজনীতি করতে দেওয়া যাবে না, এ সিদ্ধান্ত পরিপূর্ণভাবেই গণতান্ত্রিক।

 

এই দলগুলি বেআইনী ঘোষিত হবার পর বাংলাদেশের ছোট-বড় মিলিয়ে যে সব দল-উপদল জীবিত থাকবে বলে মনে হয়; যেগুলি কম-বেশী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশীদার থেকেছে, সেগুলিকে এভাবে সাজানো যেতে পারে

 

(১) আওয়ামী লীগঃ বৃহত্তম এবং বলতে গেলে বর্তমান পর্যায়ে একক রাজনৈতিক দল। সহযোগী ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, শ্রমিক সংগঠন, জাতীয় শ্রমিক লীগ।

 

(২) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর পন্থী) ও বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট পার্টি। সহযোগী ছাত্র সংগঠ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড-ইউনিয়ন সেন্টার। সংগঠনগত ও জনসমর্থনের দিক

 

থেকে বর্তমানে এই দল্টির স্থান দ্বিতীয়। ন্যাপ ও কম্যুনিষ্ট পার্টি দু’নামে সংগঠন টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হবে বলে মনে হয়, তেমন অবস্থায় কোনটি রেখে কোনটি ভেঙ্গে দেওয়া হবে, তা সম্ভবতঃ পরিস্থির উপর নির্ভর করবে।

 

(৩) বাংলা জাতীয় লীগ (সভাপতি, আতাউর রহমান খান) সহযগী ছাত্র সংগঠন, বাংলা ছাত্রলীগ। সংগঠনগত ও জনসমর্থনের দিক থেকে এই দলের স্থান হবে তৃতীয়; আতাউর রহমান খান সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন, পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয় কিন্তু তিনি ঢাকাতেই থেকে যান। তাঁর দলের কর্মী মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন।

(৪) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী পন্থী)। বেহুধা বিভক্তির পর এবং চরম বামপন্থী উপদলগুলির পৃথক পৃথক সংগঠন গড়ে তোলার ফলে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন এক কালের বিরাট সংগঠনটি এখন পূর্ব জৌলুষ হারিয়ে ফেললেও, মওলানার ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রিয়তা এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরাট প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। মওলানার পরবর্তী কার্যক্রমের উপর এর ভবিষ্যত নির্ভর করবে।

(৫) বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস। পূর্ব পাকিস্তানের এককালীন অর্থমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর এবং প্রবীন কংগ্রেস নেতা ভবেশ নন্দীর নেতৃত্বাধীন এই দলটি এযাবৎকাল ‘সংখ্যালঘু’দের দল হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসলেও, বর্ত্মান সংগ্রাম ও মনোরঞ্জন বাবুর বাংলাদেশ সরকারের কন্সালট্রেটিভ কমিটির সদস্য হওয়ার প্রেক্ষিতে এই দলটি এখন গুরুত্ব অর্জন করেছে। দলের ভবিষ্যত কার্যক্রম বিশেষভাবে লক্ষোণীয়।

(৬) বামপন্থী কম্যুনিষ্ট উপদলসমূহ। বামপন্থী কম্যুনিষ্ট উপদলগুলির একাংশ মুক্তি সংগ্রামের অনুকুলে বক্তব্য পেশ করেছে, অপর অংশ বিরোধিতা করেছে। এই সব সংগঠনের অনেকগুলি হয়তো ভবিষ্যতেও ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ সংগঠন হিসাবেই কাজ চালাবে। আইনসিদ্ধ প্রকাশ্য কম্যুনিষ্ট পার্টি করারও চেষ্টা হতে পারে। এ সম্বদ্ধে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়। পিকিং-এর সাম্প্রতিক ভূমিকা এঁদের পক্ষে খুবই অসুবিধাজনক হয়েছে।

(৭) এ ছাড়াও শ্রমিক কৃষক-সমাজবাদী দল এবং অলি আহাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় লীগের উপদলটিও পৃথক দলীয় অস্তিত্ব বজায় রাখবে বলে মনে হয়। উভয় দলেরই কয়েকটি শ্রমিক এলাকায় প্রভাব রয়েছে।

 

তাহলে দেখা যাচ্ছে, আগামী দিনের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছাড়াও আরো কয়েকটি দল মাঠে থাকছে। তন্মধ্যে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর পন্থী) ছাড়া অন্য দলগুলির সাংগঠনিক অবস্থা ভালো নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে নাম-সর্বস্ব। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশ বিশ্চিতভাবেই পার্লামেন্টারী রাজনীতি চালু হতে যাচ্ছে এবং যেহেতু স্বাধীনতার প্রশ্নে এসব দলেরও কমবেশী অবদান রয়েছে, সেহেতু আগামীতে এরাই হবে বিরোধী দল। পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে বিরধীদলের ভূমিকা থাকে মুখ্য। কাজেই কালক্রমে এইসব দলও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।

 

তবে আওয়ামী লীগের বিরাট শক্তির মোকাবিলায় ক্ষুদ্র দলের কাজের সুযোগ যে খুবই সীমিত তা এ সব দলের কর্মকর্তাদের না বোঝার কথা নয়। এমতাবস্থায় ক্ষুদ্রতর দলগুলির কয়েকটি একত্রিত হয়ে শক্তিশালী দলে রুপান্তরিত হবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

Scroll to Top