কম্পাইলারঃ আহসান উল্লাহ
<৬,২৫,৫০-৫১>
.
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়, বন্যা ও মুক্তিযুদ্ধ।
সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা, ১ম বর্ষঃ ১৬শ সংখ্যা ।
তারিখঃ ২৭ আগস্ট, ১৯৭১।
.
সম্পাদকীয়ঃ বন্যা ও মুক্তিযুদ্ধ
.
বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। হানাদার বাহিনীর দখলীকৃত এক বিস্তীর্ণ এলাকা এখন পানির নিচে। বাংলাদেশের এটা সাম্বৎসরিক বন্যা। ১৯৫৫ সালে প্রথম প্রথম এই সর্বগ্রাসী বন্যার প্লাবন দেখা দেয় বাংলাদেশে। এখন এটা নিয়মিত মৌসুমি ব্যাপার। প্রথম প্রথম এক বছর বা দু বছর অন্তর এই বন্যা দেখা দিত। তারপর প্রতি বছর এমনকি বছরে একাধিকবার এই প্লাবনে বাংলাদেশের মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। বন্যায় প্রতিবছর বাংলাদেশের ফসলের যে ক্ষতি হয় তার পরিমাণ দুশো কোটি টাকা। গবাদিপশু ও ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এর মাঝে ধরা হয়নি। অবশ্য এই দুশো কোটি টাকাও ইসলামাবাদের মিথ্যাবাদী রাখাল বালকদের হিসাব। বন্যায় প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এখন পর্যন্ত জানা যায়নি বা জানানোর চেষ্টা হয়নি। ইসলামাবাদের উপনিবেশিক শাসকেরা সবসময় এই খতির হিসাব চেপে রাখার চেষ্টা করেছেন।
.
বন্যায় বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি শুধু ফসল, গবাদিপশু বা ঘরবাড়ি সম্পত্তি ধ্বংস হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই ক্ষতির ধাক্কা যেমন পৌনঃপুনিক তেমন সুদূরপ্রসারী । এক বছরে একাধিকবার সর্বপ্লাবি বন্যা হওয়ার ফলে বাংলাদেশে খাদ্যঘাটতি একটা সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।দুর্ভিক্ষাবস্থা বাংলাদেশে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। বন্যার দরুন কৃষি সংস্কার ও অধিক খাদ্য ফলাও আন্দোলন কিছু মাত্র সফল হয়নি। ইসলামাবাদের শোষকচক্র বাংলাদেশকে হরিলুটের বাতাসার মত কেবল চোষণ করেছে, কিন্তু বন্যার প্রতিকার বা খাদ্য ঘাটতি দূর করার জন্য সবুজ বিপ্লব অনুষ্ঠানের কোন ব্যবস্থা করেননি। জাতিসংঘের পিয়ারসন কমিটির রিপোর্টেও অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় এই ব্যাপারে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে ভূমির উপর অত্যধিক চাপ হ্রাসের জন্য শক্তি চালিত পাম্প ও গভীর নলকূপের সাহায্যে সেচ ব্যবস্থা প্রবর্তন দ্বারা বহু আগেই বাংলাদেশে সবুজ বিপ্লব বা কৃষি উন্নয়নের ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করা উচিৎ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে যা করা হয়নি তা করা হয়েছে পাকিস্তানের মরুভূমিতে। সেখানে গভীর নলকূপের সাহায্যে সেচ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে গত চব্বিশ বছরে একটি খাদ্য ঘাটতি এলাকাকে খাদ্য উদ্বৃত্ত এলাকায় পরিণত করা হয়েছে। অন্যদিকে সেখানকার শিল্পোন্নতি তো রয়েছেই। বাংলাদেশে না হয়েছে শিল্পোন্নতি না হয়েছে সবুজ বিপ্লব। ফলে খাদ্যঘাটতি দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের করালগ্রাসে বাংলাদেশ আজ সর্বনাশের শেষ প্রান্তে উপনীত। তারপর গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত জুটেছে প্রতি বছরের বন্যা।
.
পিয়ারসন কমিটির এই রিপোর্টের বিবরণ প্রকাশিত হলে বাংলাদেশে রীতিমত চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। আজ ঢাকা শহরের যে দুটি বা তিনটি পত্রিকা হানাদার বাহিনীর পা চাটা দালালের ভূমিকা গ্রহণ করেছে মাত্র এক বছর আগে অর্থাৎ গত বছরের এই সময়ই তারাই পিয়ারসন কমিটির রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশকে বঞ্চনা ও বাঙ্গালিদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতার বিবরণ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছে এবং ইসলামাবাদ বাংলাদেশে উপনিবেশিক শাসন ও শোষণ চালাচ্ছে বলে অভিমত ও প্রকাশ করেছে।
.
বন্যা বাংলাদেশ ও বাঙ্গালির জীবন মরণ সমস্যা । বন্যা সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও সামাজিক ধ্বংস রোধ করার দ্বিতীয় কোন উপায় নেই। কিন্তু গত ষোল বছর যাবৎ প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার শস্য নষ্ট, জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতি হওয়ার পরও এই সমস্যার যে সমাধান হয়নি তার কারণ বাংলাদেশের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি জঙ্গি চক্রের উপনিবেশিক শাসন । বাংলাদেশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শকুনি চরিত্রের একদল মানবতাদ্রোহি শাসকের ও শোষণের লীলাক্ষেত্র । পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশনের প্রাক্তন কর্তা এবং এখন যিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সেই পাঞ্জাবি আমলা এম এম আহমদ এ যুগের শ্রেষ্ঠ প্রতারক ও জালিয়াত আখ্যালাভের যোগ্য। বাংলাদেশের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় পশ্চিম পাকিস্তানের তারবেলা, মংলা বাধ পরিকল্পনা কার্যকরী হয়েছে পরিকল্পনা বহির্ভূত টাকায় জমির লবনাক্ততার সমস্যা মোচন করা সম্ভব হয়েছে, এমনকি বিনা প্রয়োজনে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পাঞ্জাবের মরুভূমিতে ইসলামাবাদ নাম দিয়ে একটি নতুন রাজধানী তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। কেবল সম্ভব হয়নি ১৯৫৫ সালের পর বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পাঁচশো কোটি টাকার একটি প্রাথমিক পরিকল্পনা অর্থসংস্থান করা, বাংলাদেশের প্রস্তাবিত একমাত্র আণবিক চুল্লি রুপপুর কেন্দ্রের জন্য বৈদেশিক সাহায্য সংগ্রহ করা।
.
বছরের পর বছর যে মর্মজ্বালা বাঙ্গালিরা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছে তারই বহিঃপ্রকাশ আজকের মুক্তি সংগ্রাম। এবারেও বাংলাদেশেও দখলীকৃত বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যার ঢল নেমেছে এবং বিভিন্ন নদীতে পানির উচ্চতা বিপদসীমার দিকে দ্রুত এগিয়ে গেছে। কিন্তু এবারের বন্যা বাঙ্গালিদের জন্য যতই দুঃখ কষ্টের হোক, তারমধ্যে আশীর্বাদের অংশও কম নয়। বন্যার ফলে হানাদার বাহিনীর চলাচল এখন রুদ্ধ। তাদের ট্যাঙ্ক ও বিমান অকেজো হয়ে পরেছে । দখলীকৃত এলাকায় বাঙালি মুক্তিবাহিনী এই সুযোগে আগের চাইতেও তৎপর হয়েছেন। এই তৎপরতা আরও বাড়ানো হবে। শত্রুর উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার সন্ধিক্ষণ দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের বন্যা সমস্যার সমাধান বাংলাদেশের মানুষের সকল দুঃখকষ্টের অবসানের একমাত্র উপায় হল তার স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করাই আমাদের আজিকার একমাত্র কর্তব্য।