পূজা পলি
<৬, ২৮৭, ৪৯২-৪৯৩>
শিরোনামঃ বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কিছু চিন্তা
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ, ভলিউম ১ নং. ৯
তারিখঃ ২৫ জুলাই, ১৯৭১
.
বাংলাদেশ নিয়ে কিছু ভাবনা
লিখেছেন- এ.এল. বাসাম
.
কলকাতা ভ্রমণের শুরুতে কিছু দুর্দশাগ্রস্ত,অসুখী মানুষদের দেখেছি।এরা পূর্ববাংলার অত্যাচারিত মানুষ।পশ্চিম পাকিস্তানের পশুতুল্য সেনাবাহিনী দ্বারা সংগঠিত নিষ্ঠুর অত্যাচারে বাধ্য হয়ে পালিয়ে আসা মানুষ এরা। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ,মানুষকে ঘৃণা করতে উৎসাহিত করা আমার কাজ নয়।অন্যথায় আমি ইতিহাসবিদও।সেক্ষেত্রে অতীতকে এড়িয়ে আমি তুলনা করতে পারিনা। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষ আর তিক্ততার ক্ষমতা কতটা প্রবল তার উদাহরণ স্বয়ং আমার নিজের জন্মভূমির ইতিহাস।
সেই সুপ্রাচীনকাল আর মধ্যযুগীয় সময়কালে কারও প্রকাশিত জাতিসত্তা দুর্বল হলে,সে জাতির উপর বিজয়ী হওয়া কিংবা নিজ জাতিকে অন্যকোন জাতির নিকট হস্তান্তর করা সম্ভবপর ছিল।বিখ্যাত নরম্যান অ্যাঞ্জেলো-সাক্সন সর্বপ্রথম একই ভাষাভাষি দুটি ভিন্নজাতিকে একটি জাতিতে পরিণত করেছিলেন।তার সামসময়িক এই ভিন্ন চিন্তাধারাকে সাধুবাদ।নরম্যান আয়ারল্যান্ডও জয় করেছিলেন।কিন্তু সেখানকার অধিবাসীদের উপর সেটা কার্যকর হয়নি।সেই ঘটনার চুড়ান্ত পরিণতি আসে সপ্তদশ শতাব্দীতে,যখন অলিভার ক্রোময়েল আয়ারল্যান্ডে শান্তি স্থাপন করেছিলেন।যারা কিনা গৃহযুদ্ধের সময় কিংসস্ পার্টির সমর্থক ছিল।আইরিশরা কখনো সেইসব সাংবিধানিক নরপশুগুলোকে ভুলতে পারবে না যারা সেইসময়টাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞ আর লুন্ঠন চালিয়েছিল।ঊনিশশতকে তারা পুরোপুরিভাবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করে।ব্রিটিশদের প্রতি আইরিশদের তীব্র অসন্তোষ-বিদ্বেষ থাকা সত্ত্বেও তারা শেষপর্যন্ত শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্র(republic of Eire) প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলন।
প্রায় তিনশ্ বছরের ক্রোমেলের নৃশংসতার ইতিহাস তারা ভুলে নি। ‘The Curse of Cromell on You’ একজন আইরিশের তিক্তস্বাদ অভিশাপের স্মরণ করিয়ে দেয়।
.
ব্রিটিশররা তাদের গোয়ার্তুমি আর পীড়াদায়ক শাসনতন্ত্রের কারণে আমেরিকান কলোনিগুলোতে পতন হতে শুরু করে।পরবর্তীতে অষ্ট্রেলিয়া এবং কানাডার (যেটা এখন আমার দেশ) রক্তপাতবিহীন স্বাধীনতা অর্জনে তারা আরও যথোপযুক্ত শিক্ষা পায়।কিন্তু ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে সেটা ভিন্ন।শিক্ষিত ভারতীয়রা কানাডা আর অষ্ট্রেলিয়ার বিষয়বস্তু দেখেন এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছিল।কিন্তু বেশিরভাগ ভারতীয় লোকজন পরিমাণে বেশি কিংবা কম নিরব ছিল এবং ব্রিটিশদের নীতিমালা ত্রহণ করেছিল।নিজেদের সরকার দ্বারা পরিচালিত কিছু সল্প পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করেছিল।সেসব পদক্ষেপগুলোই ভারতকে অষ্ট্রেলিয়া-কানাডার মত স্বাধীনতার পথে ধাবিত করে তবে তার জন্য দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয়।
হঠাৎ একদিন,ঊনিশো ঊনিশ সালে,পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে।একটি নামবিহীন রাজনৈতিক জমায়েত তৈরী হয়।জালিয়ানওয়ালাবাগ,অমৃতসরে আগুন জ্বলে উঠল।বহু নারী-পুরুষ নিহত হল।সারা ভারতবর্ষে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হল।ঠিক ঐ মুহূর্তে ভবিষ্যৎ ভারতের প্রতিমূর্তি প্রতীয়মান হয়।এরপরেই আসে ভারতের তুলনামূলক যৌথ স্বাধীনতা ঠিক ঐ মুহূর্তে ভবিষ্যৎ ভারতের প্রতিমূর্তি সৃষ্টি হয়।ভারতীয়দের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে তুলনামূলক কম রক্তপাতের বিনিময়ে এবং সেখানের জনগণ মানসিকভাবে ব্রিটিশদের কঠোর নিয়মকানুন মেনে নিতে পারছিলনা।
সেক্ষেত্রে, পূর্ববাংলা নিষ্ঠুরতা একমাসের মধ্যেই যে চরমতার রূপ নিয়েছে সেটা জালিয়ানওয়ালাবাগকের চেয়েও নৃশংস এবং যা পরিকল্পনা আর সাবধানতার সাথে ঘটছিল যেখানে জালিয়ানওয়ালাবাগের আতংক ছিল স্থানীয় সংগঠনের মধ্যে।নৃশংসতার মাত্রা অনুমোদিত হারে এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে বিগত তিনমাসে পূর্ববাংলায় দশলক্ষেরও বেশি প্রাণহানি ঘটে।চেঙ্গিস খানের সময়ের চেয়েও এই নৃশংসতা অদ্বিতীয়,তুলনাহীন এমনকি এটা আয়ারল্যান্ডের ক্রোময়েলের নৃশংসতারর সাথেও অসংগতিপূর্ণ। ভারতীয় সীমান্তে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের উপস্থিতি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আচরণ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।
.
হিথ্রো, অবশেষে আমি নিশ্চুপ ছিলাম। ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে অনেক বিষয়ে বিবাদ রয়েছে। আমি সমসাময়িক ইতিহাসে একজন বিশেষজ্ঞ এবং এ ঘটনাকে আমার সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনার প্রচারের অংশ হিসেবে দেখছি না আমি এবং আমি এটাকে সাধারণ ঘটনা হিসেবেও নিচ্ছি না। কিন্তু একজন ইতিহাসবিদ হয়ে আমি তা প্রকাশ করতে বাধ্য।এই প্রসঙ্গে ইতিহাস যা দেখায় সেটা হল পূর্ববাংলার জনগণ স্বেচ্ছায় কখনো পাকিস্তানেরর সাথে থাকবেনা।যদি পাকিস্তান পূর্ববাংলাকে সংযুক্তিতে রাখতে চায় সেটা হবে বল প্রয়োগ করে,সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মাধ্যমে দখল করে, এবং আধিপত্য বিস্তারে শিকার হওয়া জনগণের কাছে ঘৃণিত হয়ে।এ অবস্থা কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয়না।একটা প্রশ্নই সৃষ্টি হয়-কতদিন? পাকিস্তানিরা যদি এভাবে তাদের সংকল্পে স্থির থাকে এবংঅবিরামভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে তবে সেটা দুই দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিবে এবং অবিরামভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে তবে সেটা দুই দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিবে এবং জনজীবনের অপরিমেয় দুঃখ-দুর্দশার কারণ হবে।অন্তিমে বাঙলাদেশ স্বাধীন হবে।পাকিস্তানীদের কৃত নিষ্ঠুরতা তারা কখনো ভুলবেনা।আবার বাঙালিরা ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো তাদের শাসনব্যবস্থা মেনে নিবেনা।
.
পাকিস্তানী বিজ্ঞজনেরা অব্যশই সেটা এখন উপলব্ধি করতে পারছেন। জাতিসংঘ দুটি সরকারকেই আলাদাভাবে জনজীবন রক্ষার্থে- পাকিস্তান সরকারকে তার সেনাবাহিনীর প্রভাব বিস্তার না করে সেটা প্রত্যাহার এবং নতুন রাষ্ট্র গঠনের অনুমতি প্রদানের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।যদি পাকিস্তানের শরণার্থীরা সমগ্র বিশ্বের নিকট নিষ্ঠুররতার প্রতীক হয়ে উঠে, তবে ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস সাম্রাজ্যবাদের ঘএনা হিসেবে গণ্য হবে। বিগত ইতিহাসে দেখিয়েছে,এমন সাম্রাজ্যবাদ অনিশ্চিতভাবে ঠিকে থাকেনি।