কম্পাইলারঃ স্নেহাশিস পানু
<৬,৩৪,৬৮-৬৯>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বিশ্ব মানবতা
জল্লাদ ইয়াহিয়ার বিচার চায় |
জয় বাংলা
১ম বর্ষ, ২০শ সংখ্যা |
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
বিশ্ব মানবতা জল্লাদ ইয়াহিয়ার বিচার চায়
জাতিসংঘ কি করতে পারবে?
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
গত ২১শে সেপ্টেম্বর থেকে বহু বিঘোষিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়েছে। বিশ্বের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিগণ প্রতিবারের মতই এবারও বিশ্ব সম্মেলনে যোগদান করেছেন। কিন্তু এবারে জাতিসংঘ সম্মেলনে আরো একটি নতুন স্বাধীন দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিতে গিয়েছেন। এ দেশটি হল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। যদিও জাতিসংঘের সদস্যপদ তার অর্জিত হয়নি পৃথিবীর কোন দেশের কাছ থেকে এখনো রাজনৈতিক স্বীকৃতি পায়নি, তবুও বিশ্বপ্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশ তার নিজস্ব গণতান্ত্রিক অধিকারেই হাজির হয়েছে।
.
জাতিসংঘের অধিবেশনে পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের অধিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রন, ব্যাক্তিস্বাধীনতা ও মানবিক অধিকারগত সমস্যার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। গনহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বর্ণ বৈষম্য, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা, নারী নির্যাতন, কোন অঞ্চলে উত্তেজনা ও যুদ্ধের আশংকা প্রভৃতি বিষয়ে বহু জটিল প্রশ্ন নিয়ে প্রায় বৃহত্তর বিতর্কের সুত্রপাত ঘটে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ও নিষ্ঠুর সত্য এই যে, এই সব সমস্যা সমাধানে প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জাতিসংঘের ভূমিকা খুব উজ্জল নয়। বরং বিশ্বরাজনীতির দাবা খেলায় বহু মানবিক প্রশ্নই নানাভাবে উপেক্ষিত হতে দেখা গেছে। একদা লীগ অব নেশন্সের ব্যার্থতা মানব জাতির ভাগ্যে যে মর্মান্তিক পরিণতি নিয়ে এসেছিল, আজকের জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের সে ব্যর্থতার নজির থেকেই শিক্ষা গ্রহন করতে হবে; সম্ভবত তাহলেই কেবল জাতিসংঘ ইতিহাসের সেই নিষ্ঠুরতম পুনরাবৃত্তিকে ঠেকাতে সক্ষম হবে।
.
বাংলাদেশে গত ছয় মাসে পৃথিবীর বৃহত্তর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এ শতাব্দীর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ড, নারী নির্যাতন, লুন্ঠন ও বর্বরোচিত ধ্বংসলীলায় যে নারকীয় ইতিহাস রচিত হয়েছে, যার কাছে চেঙ্গিস হালাকু কিংবা হিটলারের নৃশংসতাও ম্লান হয়ে যায়, মানব ইতিহাসের এমন নারকীয় এমন বীভৎস দৃশ্য দেখেও জাতিসংঘের মতো বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের কন্ঠ তীব্রতর প্রতিরোধের ভাষায় সোচ্চার হয়ে উঠেনি, সক্রিয় হস্তক্ষেপ মানবতার এই অপমান রোধে অগ্রসর হয়নি এবং প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের মতো পশ্চিম পাকিস্তান ঘেষা পুঁজিপতিকে মামুলি সফরে পাঠিয়ে জাতিসংঘ মোটামুটিভাবে তার দায়িত্ব শেষ করেছেন এমন বললে বোধ করি বাড়িয়ে বলা হবেনা।
.
বাংলাদেশের এই মর্মান্তিক ঘটনাকে জাতিসংঘের সেক্রেটারী মিঃ উথান্ট কেবল ‘মানব সভ্যতার দূরপনেয় কলঙ্ক’ বলেই খালাস হলে চলবেনা; মানব সভ্যতার এই দূরপনেয় কলঙ্কের যে হোতা, যে স্বনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ষড়যন্ত্র ও ক্রুর ইচ্ছায় এ শতাব্দীর এতো বড় একটা ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হচ্ছে, দশ লক্ষ নর-নারী পশুর মত প্রাণ দিয়েছেন, পঁচিশ লক্ষ লোক ঘরবড়ী স্বর্বস্ব হারিয়ে অন্যপদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, আরো লক্ষ লক্ষ মানুষ যেখানে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখোমুখি বসবাস করছে, যার উম্মাদ খোলায় মানব সভ্যতার এমন দূরপনেয় কলঙ্ক সূচিত হতে পারলো, বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘেরই দায়িত্ব সেই একরোখা ক্রুর দানবের শাস্তি বিধান করা।
.
কেননা ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেই গণহত্যা বন্ধ ও তার শাস্তি বিধানের সনদ গৃহীত হয়েছে।
.
জাতিসংঘের এই সনদ অনুযায়ী গণহত্যা কিংবা অনুরূপ কোন অপরাধের জন্যে দায়ী ব্যক্তি অবশ্যই শাস্তি পাবে, সে শাসনতান্ত্রিকভাবে কোন দেশের শাসনকর্তাই হোক, কোন সরকারী কর্মচারীই হোক কিংবা বেসরকারী লোকই হোক। এ সঙ্গে আরো বলা হয়েছে যে, গণহত্যা কিংবা অনুরূপ কোন অপরাধে দায়ী ব্যক্তির বিচার সে দেশেরই ক্ষমতা সম্পন্ন আদালতে নিস্পন্ন হবে কিংবা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে তার বিচার করতে হবে।