কম্পাইলারঃ রবিউল হাসান সিফাত
<৬,৩৯,৭৮-৭৯>
শিরোনামঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও জাতীয় পুনর্গঠন
সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষঃ ১৬শ সংখ্যা
তারিখঃ ১২ নভেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও জাতীয় পুনর্গঠন
!! অর্থনৈতিক ভাষ্যকার !!
পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে বাংলাদেশের অবশিষ্ঠ দখলীকৃত এলাকার মুক্তির কাল আসন্ন বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনের খবর থেকে এমন একটি প্রত্যাশা সকলের মনেই জেগেছে।
*
দেশপ্রেম, আত্নবিশ্বাস, ও উন্নততর রণকৌশল এবং দেশের মাটির সঙ্গে নাড়ীর সংযোগই মুক্তিবাহিনীকে চূড়ান্ত বিজয়ের তোরণদ্বারে পৌছে দিতে পেরেছে।
*
তবে রণাঙ্গনের খবর নয়, বর্তমান নিবন্ধে আমাদের আলোচ্য বিষয় স্বতন্ত্র। মাতৃভুমির আসন্ন মুক্তি সম্ভাবনাকে সামনে রেখে যে প্রশ্নটি ইতিমধ্যেই অনেকের মনে জাগছে তা হচ্ছে হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ ও যুদ্ধ্ববিধ্বস্ত বাংলাদেশকে কত দ্রুত পুনর্গঠন করা যাবে এবং পুনর্গঠনের জন্য আমাদের কোন বস্তুটির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী। একটি মাত্র বাক্যে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায়। জনগণের দেশপ্রেম ও সর্বস্তরে পূর্ণ ঐক্যই দ্রুত পুনর্গঠনের প্রাথমিক শর্ত।
*
মুক্তি সংগ্রামকে চূড়ান্ত বিজয়ের পথে নিয়ে যাবার জন্যে উপরোক্ত দুটি উপাদানের যেমন প্রয়োজন হয়েছিল, জাতীয় পুনর্গঠন ও দেশকে দ্রুত সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্যো ওই দুটি উপাদানের প্রয়োজন তার চেয়ে কিছু কম নয়। ওট মুক্তি সংগ্রামের সফল পরিসমাপ্তিরই যুক্তিসঙ্গত পরবর্তী ধাপ।
*
জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম দেশের মানুষকে যেমন উদ্ধুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে তেমনি অর্থনৈতিক ন্যায়নীতি ও সম্পদের সুষম বন্টন দেশের মানুষের জাতীয় পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক প্রেরণায় উদ্ধুদ্ধ করতে সমর্থ হবে। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো ও খসড়া কর্মসূচীতে তার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কাজেই জাতীয় পূর্ণগঠনের জন্যে যে মানবিক উপাদানগুলোর প্রয়োজন সেই উপাদানের কোন অভাব যে হবেনা সে সম্পর্কে আমরা স্থির নিশ্চিত। কিন্তু মানবিক উপাদান ছাড়াও যে অর্থনৈতিক সম্পদ ও সংঙ্গতির প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী অধ্যায়ে জাতীয় পুণর্গঠনের ব্যাপারে সে সম্পর্কেও বিশদ্ভাবে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে।
*
এ প্রসঙ্গটির সার্থক আলোচনার পূর্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রথমে আলোচনা করে নেবার প্রয়োজন রয়েছে। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বেও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু আলোচনা যে হয়েছে তা নয়, তবু জাতীয় পুণর্গঠনের প্রশ্নকে সামনে রেখে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আরও কিছু আলোচনার অবকাশ আছে।
*
কিছু কিছু মানুষ এখনও আছেন যারা অনেক সময় প্রশ্ন করেন যে, আমাদের এই রাষ্ট্রের ছোট্ট পরিসরে অগুন্তি মুখের খাদ্যের জোগান দিতে হবে। কাজেই এই দেশের পক্ষে অর্থনৈতিক দিক থেকে টিকে থাকা ও এগিয়ে যাওয়া কি সম্ভব হবে? এ প্রশ্ন যারা করেন তারা হয় অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ইতিহাস জানেন না, নয়তো মানসিক দিক থেকে পুরোপুরি সংশয়বাদী। তাঁরা পাকিস্তানের বিলুপ্তির পূর্বেকার অর্থনৈতিক বিন্যাসকে সাধারণ দৃষ্টিতে দেখেছেন কিন্তু তার কার্যকারণ এবং তাৎপর্য অনুধাবন করার চেষ্টা করেননি। তা করলে বুঝতে পারতেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গোড়াতে এই কার্যকারণই প্রচন্ডভাবে কাজ করেছে, নিছক ভাবাবেগ দ্বারা তাঁরা পরিচালিত হয়নি।
*
বিলুপ্তির পূর্বেকার পাকিস্তানের যে পশ্চিম পাকিস্তানী অর্থনৈতিক অক্টোপাসের শুঁড় দেখেয়ামাদের অনেকের মনে উপরোক্ত সংশয় জাগে সেই অক্টোপাসটি আসলে বেড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সম্পদ গ্রাস করে। এক কথায় বলতে গেলে পশ্চিম পকিস্তান বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করেনি। বরং বাংলাদেশই নিজেকে রিক্ত করে পশ্চিম পকিস্তানেরে এই বিপুল অর্থ ও শিল্প সম্পদকে গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে নিজের রক্ত দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছে রাজনৈতিক পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ থাকায়। কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানের বোঝা বহনের দায় থেকে মুক্ত, দেশপ্রেম উদ্ধুদ্ধ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অনেক সহজে এবং আরও ভালভাবে নিজেকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
*
যারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ আপাতদৃষ্টিতে তাঁরা প্রধানত দুটো লক্ষণ দেখে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। সেই কারণের একটা হল বাংলাদেশের ঘনবসতি। মাত্র ৫৫ হাজার ১২৬ বর্গমাইল এলাকায় সাড়ে সাত কোটি লোকের বাস। সম্ভবতঃ বাংলাদেশই পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি এলাকা। এই ছোট্ট পরিসরে অগুনতি মানুষ যেন ক্রমে হামাগুড়ি দিয়ে চলছে। তার ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপৌনিক আঘাত। দ্বিতীয় কারণ হলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা। এই অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতাকেই তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা বলে ভুল করছেন। কিন্তু এ কথাটা মনে রাখার প্রয়োজন রয়েছে যে গত ২৩ বছরে বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানের সমৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ভাবে কমপক্ষে ছয় হাজার কোটি টাকার যোগান দিতে বাধ্য হয়েছে।