কম্পাইলারঃ জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,৪৮,৯০-৯১>
শিরোনামঃ বিচ্ছিন্নতার পথে বাংলাদেশ
সংবাদপত্রঃ স্বদেশ
১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ১ জুলাই, ১৯৭১
বিচ্ছিন্নতার পথে বাংলাদেশ
[আমেরিকার নিউজউইক সংবাদ সাপ্তাহিকের (১৫ই মার্চ সংখ্যায়) পাকিস্তানের তদানীন্তন রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে পাকিস্তান বিচ্ছিন্নতার পথে শীর্ষক এক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। ভাষান্তরিত নিবন্ধনটি প্রকাশ করা হল। ]
চূড়ান্ত হতাশা বাঙালীদের আজ বিচ্ছিন্নতার পথে পরিচালিত করেছে অধিকাংশ লোক তাতে বিচলিত হয়ে পড়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসাররা স্বীকার করেন যে, পশ্চিমাঞ্চলে পাঁচ কোটি মানুষের তুলনায় পূর্বাঞ্চলের সাত কোটি জনসাধারণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিতান্ত সামান্য ই হয়েছে। যেমন বিগত তেইশ বছর ধরে কেন্দ্রীয় বাজেটের পাঁচ ভাগের চার ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়েছে। পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের প্রায় ৮৫ ভাগ এবং সেনাবাহিনীর অফিসারদের প্রায় ৯০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানী এবং বিগত কয়েক বছরে পশ্চিমাঞ্চলে মাথা পিছু আয় বেড়েছে শতকরা ৪২ ভাগ, আর পূর্বাঞ্চলে মাত্র শতকরা ১৭ ভাগ। পূর্ব পাকিস্তানীরা দীর্ঘ বার বছর সামরিক একনায়কত্বের পর গত বছরের শেষভাগে দেশের প্রথম স্বাধীন সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে (নিউজউইক ডিসেম্বর ২১) তাদের পুঞ্জীভূত রোষের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী জাতীয়তাবাদী অগ্নিপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ দল আশ্চর্যজনকভাবে শতকরা ৯৮ ভাগ ভোট লাভ করেন। শেখ মুজিবুর তাঁর অনুরক্তদের মধ্যে ‘মুজিব’ নামে পরিচিত। মুজিব তাঁর ছয় দফা কর্মসূচীর জোরেই নির্বাচনে জয়লাভ করেন। এই ছয় দফা কর্মসূচী মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রকে একটি শিথিল কনফেডারেশনে পরিণত করবে। এতে প্রদেশগুলোকে সত্যিকারের স্বায়ত্তশাসন দিয়ে কেন্দ্রের জন্যে নিতান্ত সামান্য ক্ষমতাই অবশিষ্ট রাখা হয়েছে। কেন্দ্রের হাতে শুধু বৈদেশিক নীতি এবং জাতীয় প্রতিরক্ষার বিষয় ছাড়া আর কিছুই দেয়া হয়নি। আর নতুন জাতীয় পরিষদে নিশ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে মুজিব তথা পূর্ব পাকিস্তান তাদের রাষ্ট্রের ইতিহাসে, সর্বপ্রথম মুক্তির পথ করে নেয়ার মত রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করেছে। এই সমস্ত ঘটনা পশ্চিম পাকিস্তানে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রভাবশালী বামপন্থী নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে শীর্ষস্থান অধিকার করেছেন। কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগের হাতে সংসদীয় পরাজয় মেনে নিতে রাজি হলেন না। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ১৬৭টি ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি পেয়েছে ৮২টি আসন। জুলফিকার আলী ভুট্টো কেবল যে সংসদীয় পরাজয় পরাজয় মেনে নিতে রাজি হলেন না তা নয় তাঁর দলের পরিষদ সদস্যদের বলে দিলেন কেউ যেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করে। এর ফলে বৃটেনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত অন্তঃসারশূন্য সৈনিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পড়লেন দুজন আপোষ বিমুখ রাজনীতিবিদের পাল্লায়। শেখ মুজিবর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো দুজনেই রাজনৈতিক মঞ্চের কুশলী নট।
.
অবশেষে ইয়াহিয়া খান ভাবলেন যে, তাঁকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যেতে হবে। এ উদ্দেশ্যে জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন বাতিল করে তিনি চলতি সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের একটি সম্মেলন আহবান করেছেন। এই সম্মেলন ই হয়তো অচলাবস্থার নিরসন ঘটানোর একটি শেষ ও দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা। কিন্তু ইয়াহিয়ার এই আমন্ত্রণ শেখ মুজিব প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সপ্তাহ শেষের ঘটনাবলী দেখে মনে হয় তিনি অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। এই ঘটনার পর ইয়াহিয়া এক ঘোষণার মারফত এ মাসের শেষের দিকে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন উদ্বোধনের ব্যাপারে তাঁর মতামত দেশবাসীকে জানিয়ে দিলেন এবং সেই সাথে এক হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বললেন যে, ‘পাকিস্তানের সংহতি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্যে সেনাবাহিনী এগিয়ে আসতে পারে। দেশকে রাজনৈতিক ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষার জন্যে ইয়াহিয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন যে, অবস্থা এখন পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আয়ত্তের বাইরে। হয়তো সীমাবদ্ধ অনুভূতিই ভবিষ্যৎ ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রিত করবে। নিউজউইকের ঢাকায় অবস্থানরত লোরেন জেন কিনসকে পাশ্চাত্যের জনৈক কূটনীতিক বলেছেন, “পাকিস্তানের দুই অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে কি পড়বে না এটা এমন কোন প্রশ্ন নয়। এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে স্বাধীনতা কবে হবে। কি আগামী সপ্তাহে, না কি আগামী মাসে অথবা এর জন্যে আরো বছর খানেক কি বছর দুয়েক সময় লাগবে। দুর্ভাগ্যবশত মনে হয় পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান খুব তাড়াতাড়িই বিচ্ছিন্ন হবে; খুব বেশী দেরী হবে না।”