অনুবাদঃ তুষার শুভ্র
<৬, ৭৮, ৭২০-৭২১>
শিরোনামঃ বাংলাদেশে জাতিসংঘ ত্রাণ সাহায্য
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ, ভলিউম ১ নং ৩
তারিখঃ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবিক সাহায্য
এর আসল অর্থ কি
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে
বাংলাদেশে জাতিসংঘ মিশনের প্রাথমিক পর্যায় হিসেবে ৩৮ জন বিশেষজ্ঞের একটি দল পাঠানো হয়েছে। বাইরে থেকে দেখে জাতিসংঘের এই ভূমিকাটি বর্তমানে পৃথিবীর ঐতিহ্যের যোগ্য মনে হতে পারে। কিন্তু এর মনুষ্যত্বের মুখোশসের পেছনে ওতপেতে আছে বিপদ।
জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল যোগাযোগ ব্যাবস্থার পূনর্বাসন এবং সড়ক ও নদীপথ পুনরায় চলাচলের উপযোগী করা। সেটি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে অবদান রাখবে। আমাদেরকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে যে, যদি এই শর্ত পূরণ না হয় তাহলে দাতা দেশ গুলোর সহানুভূতির সাথে দেওয়া সাহায্য সেই ব্যাক্তিদের কাছে পৌঁছাবে না যাদের এটির প্রয়োজন এবং মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে না খেয়ে থাকতে হবে। এটি ধরে নেওয়া যায় যে, সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্বাবধান না থাকলে দাতা দেশগুল বাংলাদেশে সাহায্য পাঠাতে উৎসাহিত হবে না।
বাংলাদেশে দুর্গত মানুষের জন্য দাতা দেশগুলোর এই উদ্বেগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষই বাংলাদেশে মানুষের হাতে সাহায্য পৌঁছে দেয়ার একমাত্র বাহন- দাতা দেশগুলোর এই বিশ্বাসটার সাথে একমত হতে আমরা ব্যার্থ। গত বছরের ঘুর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট যে মিলিটারিদের ত্রাণ সরবারহের কার্যকলাপের উপর বিশ্বাস রাখা ভিত্তিহীন। এটি একটি সাধারণ জ্ঞান যে, মিলিটারিরা এই ত্রাণ তাদের নিজেদের প্রয়োজনে অপব্যাবহার করেছে এবং ব্যাক্তি ও বিভিন্ন ত্রাণ বিতরণকারী সংস্থার দেওয়া মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের কোন উপযুক্ত হিসাব পাকিস্তান এমব্যাসি দিতে ব্যার্থ হয়েছিল।
পাকিস্তানিরা ত্রাণ কার্যের উদ্দেশ্যে সরবরাহকৃত হেলিকাপ্টার ও বোটগুলো যে ২৫শে মার্চ ও তাঁর পরে ব্যাবহার করেছে তারও প্রমাণ আছে।
ইউনিসেফের যানবাহন
মিলিটারিরা জাতিসংঘের যে সব সম্পত্তি গুলো জোরদখল করে রেখেছে সেগুলো অব্যাহতি দেয়নি। ইউনিসেফের জীপগুলো মিলিটারিরা তাদের সামরিক প্রয়োজনে উনমুক্তভাবে বাংলাদেশে ব্যাবহার করেছে। ৩১শে আগস্ট লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা অনুসারে, মুষ্টিমেয় কিছু জীপ তার মালিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় প্রমাণ আছে যে এফ.এ. ও এর গাড়ি ও বোটগুলো বাংলাদেশীদের গ্রাপ্তার ও অত্যাচারের জন্য ব্যাবহার করা হয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল, এই সম্পত্তি দখলের কথা অস্বীকার করার সাহস দেখাতে পারেননি। এমনকি এ ধরণের ঘটনা যে আর ঘটবে না সে আশ্বাস ও দিতে পারেননি।
যদি এই হয় বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবিক সাহায্য দেওয়ার নমুনা তাহলে সাহায্যের জন্য দেয়া সুক্ষ যন্ত্রপাতিগুলো যে বাংলাদেশীদের অত্যাচারের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যাবহার করবে না তাঁর নিশ্চয়তা কি?
সেক্রেটারি জেনারেল
যতদিন পাকিস্তান সরকার আছে ততদিন সেক্রেটারি জেনারেল ‘হিয়ার নো ইভিল, স্পিক নো ইভিল, সি নো ইভিল’ নীতি অনুসরণ করছেন। তিনি নিউ ইয়র্কে টাইমসে প্রকাশিত মিস এলিস থর্নায়ের প্রকাশিত একটি চিঠির বক্তব্য অস্বীকার করেছেন। এটি স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে যে মিস থর্নার জাতিসংঘের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে বাংলাদেশে জাতিসংঘের সাহায্য সামরিকভাবে পাকিস্তানের অস্তিত্বকে শক্তিশালী করবে এবং বাংলাদেশের জনগণের দুঃখ আরও বাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশের জনগণ নিজেই নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্তা এবং তারা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাত থেকে নিজেদের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে বদ্ধ পরিকর।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ জোড় দিয়ে বলেছেন, বিশ্ববাসীকে এটি খেয়াল রাখতে হবে যে, ‘বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের সরকারকে বিপথে নেওয়ার চেষ্টা করা বিপদজনক হবে’।
এটি এখন আমাদের দৃঢ় আশা যে সেক্রেটারি জেনারেল এই ডাক শুনবেন এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি আর্মিদের দখলদারিত্বের দীর্ঘ সূত্রিতা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া থেকে কারও প্রভাবে বিচ্যুত হবে না।
বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সদস্যকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত যে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলবে এতে কোন সন্দেহ নেই।