জেসিকা গুলশান তোড়া
<৬,৮৬,১৩৬>
সংবাদপত্রঃ স্বাধীন বাংলা ১ম বর্ষঃ ৭ম সংখ্যা
তারিখঃ ১২ জুলাই, ১৯৭১
.
[ছবি। ক্যাপশনে লিখা রয়েছে- ৯ জন পাক পশু সেনার ধর্ষনে মৃত রমণী। তার হাতের চুড়িগুলো এখনো বলছে ‘আমি ঘরের বৌ ছিলাম’। ]
বিশ্বের নারী সমাজের প্রতি অন্তিম আবেদন
বাংলার নারীদের বাঁচান
[এম.এ জলিল (বার্তা সম্পাদক) পরিবেশিত]
.
যশোহর ১০ই জুলাইঃ-
বাংলাদেশে পাক সেনার অধিকৃত অঞ্চলসমূহে প্রতিদিন কামান্ধ তথাকথিত ইসলামভক্ত পাকিস্তানী হানাদাররা অবলা নিস্কলঙ্কিনী মা-বোনদের উপর সীমাহীন পাশবিক আচরণ ও অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তারই একটি উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করছে এই বধুটি। একমাত্র সন্তানের জননী এই বধু। (নগ্নাবস্থার জন্য তার পরিচয় দেয়া হল না। ) ঘর-বাড়ী তাদের বহু পূর্বেই পাক সদস্যরা ধ্বংস করে দেয়ায় গ্রামের অন্যান্যদের সাথে তার পরিবারও আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি স্কুলগৃহে। খাবার সংস্থানও নেই। সারাদিন অনাহারে থেকে বহু কষ্টে ৬ মাসের শিশুর জন্য একটু দুধ সংগ্রহ করে খড়কুটো দিয়ে গরম করেছিলেন তিনি। ক্ষিধেয় কাতর তার একমাত্র নয়নমনি আকাশফাটা চিৎকার করছিল। তাড়াতাড়ি দুধটুকু গরম করতে তিনি ব্যস্ত। হঠাৎ কান্না-কাটির শোরগোলে তার সংগৃহীত দুধটুকু ছলকে পড়ে যায়। দু’গাড়ী পাক পশু ঢুকে পড়ে ঘরে। যুবতী মেয়েদের রেখে বাকীগুলোকে ঘর থেকে বের করে দেয় তারা। তারপর শুরু করে অকথ্য অত্যাচার। বর্বরেরা বলপূর্বক টেনে হিচড়ে তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ছুড়ে ফেলে দেয় ঘরের বাইরে। চীৎকার করে কেঁদে উঠতেই বেয়নেটের এক খোচায় চির নিদ্রায় ঘুম পাড়িয়ে দিল অবোধ শিশুকে। উন্মাদিনী মাতা সন্তানের কাছে ছুটে যেতে বাধা পেলেন। তিনি তখন এক পশুর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ। ইজ্জত বাঁচানোর তাগিদে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলেন তিনি তার সুতীক্ষন দন্তরাশি। কামড়ে ধরলেন পশুটির একটি হাত। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে হাত সরিয়ে নিল বর্বরটি। এই সুযোগে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলেন তিনি। শিকার পালিয়ে যাওয়ায় যন্ত্রণার কথা ভুলে গিয়ে কামোন্মাদ পশু ঝাপিয়ে পড়ল শিকার ধরতে। সহকর্মীর শিকার ধরতে এগিয়ে এল আরও ৮ জন পাক দস্যু। ব্যর্থ হল নিষ্পাপ রমনীর ইজ্জত বাঁচানো। পশু শক্তির কাছে হেরে গেলেন তিনি। শুরু হল অকথ্য অত্যাচার ও ধর্ষণ। ৯ জন পশুর অত্যাচারে শোণিত ধারা বয়ে চললো-জ্ঞান হারালেন তিনি।
.
ঘন্টা দুয়েক পর বর্বরেরা চলে গেলে লুক্কায়িত দুজন ব্যক্তি ছুটে এল সেখানে। একজন ডাক্তারের আপ্রাণ চেষ্টাতে তার জ্ঞান ফিরে এলো ক্ষণিকের জন্য। নির্দোষ খোকনের কথা স্মরণ করে হত্যাকারীদের বিচার প্রার্থনা করে আই. এ. পাশ এই বধু তথা নারীকল্যান সমিতির সম্পাদিকা বিশ্বের নারী সমাজের কাছে রেখে গেলেন তার জীবনের শেষ আকুল আবেদন- ‘হে বাংলার নারী তোমরা বিশ্ব বিবেক জাগ্রত কর, বর্বর পাক-দস্যুদের হাত থেকে লক্ষ লক্ষ মা-বোনদের প্রাণ ও ইজ্জত রক্ষা কর আমার-তোমার দেশমাতৃকাকে। চোখ মুদে এল তার। নিমিষে সব কিছু শেষ হয়ে গেল। সমস্ত গ্রাম জুড়ে নেমে এল শোকের ছায়া। বর্বরদের ভয়ে জনশূন্য হয়ে গেল গ্রামটি। সৎকারের অভাবে তার দেহ হয়তো এখন শৃগাল কুকুরের উদর পূর্তিতে পরিণত হয়েছে।