দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,৯৩,১৪৮-১৪৯>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়
শুভ সূচনা |
স্বাধীন বাংলা
১ম বর্ষঃ ১১শ সংখ্যা |
১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
শুভ সূচনা
গত সপ্তাহে পাঁচটি সংগ্রামী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি সমবায়ে মন্ত্রিসভার পরামর্শদাতা কমিটি গঠন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে নব অধ্যায়ের সূচনা করিয়াছে । পরামর্শদাতা কমিটিতে বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামীলীগের দুই জন করিয়া এবং কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ( সভাপতি অধ্যাপক মোজফফর আহমদ) জাতীয় কংগ্রেস ও ভাসানী ন্যাপের একজন করিয়া প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হইয়াছেন । এই কমিটি গঠনের ফলে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে নিয়োজিত সকল সংগ্রামী দল ও শক্তির সমান অংশীদারিত্বেও মনোভাব নিশ্চিত হইবে এবং বিভিন্ন দল ও শক্তির কার্যকলাপের মধ্যে সমন্বয় বিধানের মাধ্যমে মুক্তিসংগ্রামের আরও সুষ্ঠু পরিচালনা সম্ভব হইবে । সর্বোপরি, সংযুক্ত কমিটি হইল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের জঙ্গী একতার প্রতীক । আমরা এই কমিটি গঠনকে মুক্তি সংগ্রামের দ্রুত ও নিশ্চিত বিজয়ের পথে একটি সঠিক পদক্ষেপ বলিয়া মনে করি এবং ইহাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছি ।
.
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সকল সংগ্রামী দল ও শক্তির মধ্যে একতা গড়িয়া তোলার প্রয়োজনীয়তা অধিক বলার অপেক্ষা রাখে না । কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রথমাবধি সকল সংগ্রামী দল ও শক্তির সমবায় ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আহবান জানাইয়া আসিয়াছে । কমিউনিস্ট পার্টি বর্তমান অবস্থার পরিপেক্ষিতে প্রস্তাবিত মুক্তিফ্রন্টের উপযোগী একটি খসড়া নিম্নতম কর্মসূচীও হাজির করিয়াছে । কিন্তু কোন কোন দলের সঙ্কীর্ণতাবাদী মনোভাবে ও বৃহৎ দলসুলভ অহমিকার দরুন মুক্তিসংগ্রামের বিজয়ের অত্যাবশ্যকীয় শর্তস্বরূপ এই একতা গড়িয়া তোলার কাজ এতদিন অগ্রসর হইতে পারে নাই । এখন জনমতের চাপ ও মুক্তি সংগ্রামের বাস্তব অভিজ্ঞতা হইতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলি ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিয়াছেন । আলোচ্য পরামর্শদাতা কমিটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের সমর্থক বা সমপর্যায়ের না হইলেও ইহা নিঃসন্দেহে সঠিক পথে এক ধাপ অগ্রগতি এই কমিটি গঠনের ফলে একতার প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হওয়ার সাথে সাথে উহার একটা প্রাথমিক ভিত্তিও স্থাপিত হইয়াছে । ইহাকে দিন দিন আরও প্রসারিত ও আরও উন্নত করিয়া নিতে হইবে এবং উহার সম্ভাবনাও রহিয়াছে ।
.
সর্বদলীয় ভিত্তিতে মন্ত্রিসভার পরামর্শদাতা কমিটি গঠিত হওয়ার ফলে দেশবাসীর সংগ্রামী উদ্দীপনা আরও বৃদ্ধি পাইবে এবং মুক্তিবাহিনী ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও বাহুবল বহুগুণে বাড়িয়া যাইবে । বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার বেসামরিক গভর্নর নিয়োগ সাধারণ “ক্ষমা” ঘোষণা প্রভৃতি দ্বারা দেশের ও বিদেশের জনগণকে দুর্বল ও বিভ্রান্ত করার যে সুচতুর কৌশল জল্লাদ ইয়াহিয়া- চক্র অবলম্বন করিয়াছে, উহাকে নস্যাৎ করার ব্যাপারে সংযুক্ত কমিটি বিশেষ কার্যকর হইব । আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মিত্রবর্গ বিশেষ সমাজতান্ত্রিক শিবির এবং সম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রগতিশীল রাষ্ট্রবর্গ ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের অধিকতর সাহায্য সমর্থন লাভেও ইহা খুবই সহায়ক হইবে । এ সব দিক দিয়া এই সংযুক্ত কমিটি গঠনে তাৎপর্য সুদুর প্রসারী বলিয়া আমরা মনে করি ।
.
দেশবাসী একান্তভাবে আশা করেন যে, এই কমিটি নিছক কাগজে-পত্রে সীমাবদ্ধ না থাকিয়া সংগ্রামী শক্তিগুলির ঐক্য ও সমন্বয়ের কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত হউক । এতদিন সংগ্রামের ক্ষেত্রে যে সকল অসুবিধা বিরাজ করিতেছিল ( যা মুক্তিবাহিনীকে লোক সংগ্রহের ব্যাপারে দলীয় বাছবিচার, সামরিক অপারেশনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শক্তির কার্যক্রমের ব্যাপারে সমন্বয়ের অভাব প্রভৃতি ) সংযুক্ত কমিটি গঠনের ফলে এখন সেগুলি দূরীভুত হইবে বলিয়া দেশবাসী প্রত্যাশা করেন । উচ্চ পর্যায়ের মত স্থানীয় কার্যকলাপের সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে নিচের স্তরের সর্বদলীয় কমিটি গঠন করা দরকার । এবং সর্বোপরী যাহা দরকার তাহা হইল, প্রত্যেকেরই দলীয় সঙ্কীর্ণতা ত্যাগ করিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের সার্থকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া এবং সংগ্রামী শক্তিগুলির পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা ও সহযোগিতার মনোভাব গড়িয়া তোলা এখানে আমরা দেশবাসী সংগ্রামী শক্তিগুলির উদ্দেশ্য একটি সতর্কবাণী উচ্চারিত করিতে চাই । সংযুক্ত কমিটি গঠনের ফলেই সংগ্রামী ঐক্যের সমস্যা দূরীভুত হইয়া গিয়াছে কিম্বা দলীয় সঙ্কীর্ণতা বা বিভেদ পন্থার শক্তি সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হইয়াছে একথা মনে করা ভুল হইবে । বিভেদে ও শক্তি সম্পর্কে দেশবাসী ও সকল সংগ্রামী শক্তিকে সজাগ থাকিতে হইবে এবং ইহার বিরুদ্ধে লড়াই করিয়া ঐক্যের ভিত্তিকে মজবুত করিতে হইবে ।
.
গত ৮ই সেপ্টেম্বর সরবদলীয় বৈঠকে যেসব প্রস্তাব গ্রহণ করা হইয়াছে সেগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং উহাদের তাৎপর্যও সুদরপ্রসারী । এই বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দলমত নির্বিশেষে সমগ্র জনগণের পূর্ণ আস্থার কথা পুনরায় ঘোষনা করা হইয়াছে । ইহাহিয়া-চক্রের রুট চক্রান্ত ও বিভেদমূলক নীতির পরিপেক্ষিতে বাংলাদেশের সকল দলের এই সম্মিলিত ঘোষণা দেশে ও বিদেশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করিবে । অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে জিম্মি রাখিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা যেভাবে স্বাধীনতার দাবি ছাড়িয়া দিয়া আপোষ মীমাংসার জন্য চাপ সৃষ্টি করিতেছে উহার পটভূমিতে সর্বদলীয় বৈঠকের স্বাধীনতার স্বীকৃতি ব্যতীত অন্য কোন ভিত্তিতে রাজনৈতিক মীমাংসা গ্রহণযোগ্য নয়” বলিয়া সুস্পষ্ট প্রস্তাবও তাৎপর্যপূর্ণ । শেখ মুজিবকে আটক রাখিয়া ব্লাকমেলিং এর কোন প্রচেষ্টা বাংলাদেশের জনগণ বরদাস্ত করিবেন না, এই প্রস্তাবের উহাই দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ পাইয়াছে শেখ মুজিবের গ্রেফতার ও বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ধ্বনিত হইয়াছে সর্বদলীয় বৈঠকে । বাংলাদেশের সংগ্রাম যে “পশ্চিম পাকিস্তানীদের” বিরুদ্ধে নয়, সেখানকার একচেটিয়া ধনিক ও বৃহৎ সামন্ত ভূস্বামী-শ্রেণী এবং ইহাদের স্বার্থরক্ষক ইয়াহিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে এই সঠিক উপলব্ধির অভিব্যক্তিও দেখা গিয়াছে সর্বদলীয় বৈঠকের প্রস্তাবে ।