৪৮। অমানুষিক নির্যাতনেও তাঁর মনের বলিষ্ঠতা কমেনি (৪৪৩)
সূত্র – দৈনিক বাংলা, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
অমানুষিক নির্যাতনেও তাঁর মনের বলিষ্ঠতা কমেনি
।। স্টাফ রিপোর্টার ।।
আমার আব্বাকে কি মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনা যেত না? সাক্ষাৎকারের শুরুতেই প্রশ্নটি করেছিলেন বাবুল। বাবুল আওয়ামী লীগ নেতা এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য, যশোরের গৌরব, মরহুম মশিহুর রহমানের বড় ছেলে। তাঁর আম্মা এবং অন্য তিন ভাইবোন সহ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছেন? স্বাধীন বাংলার অঙ্গনে দাঁড়িয়ে আজ বাবুল অসংখ্য প্রশ্নের আঘাতে প্রতিনিয়ত বিধ্বস্ত হচ্ছেন। বোনের বাসা ধানমণ্ডিতেই তিনি উঠেছেন।
আলাপের প্রথম দিকে স্তব্ধভাবে পাথরের মূর্তির মত বসেছিলেন তিনি। হয়ত শুনেছিলেন তাঁর আত্মজের কণ্ঠের অশ্রান্ত আর্তনাদ, এত লোক থাকতে কেন আমার আব্বা বাঁচলো না? কেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোন আবেদন পৌঁছালো না আব্বার অমূল্য জীবনের জন্য।
একান্ত ধীরস্থির কণ্ঠে বেগম রহমান বললেন তাঁর মহান স্বামী মরহুম মশিহুর রহমানের সাথে তার সেই অবিস্মরণীয় দিনগুলোর কথা।
তিনি বলেছিলেন কিভাবে ২৫শে মার্চের কালো রাতটাকে স্ত্রী পুত্র এবং বন্ধু বান্ধবের অসংখ্য অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি পালিয়ে যাননি। সকলের অনুরোধের উত্তরে একবার শুধু তিনি বলেছিলেন- নির্দয় এই সেনাবাহিনীর হাটে এ দেশের সরল জনগনকে ছেড়ে দিয়ে কি ভাবে আমি শুধু নিজের জীবন রক্ষা করবো। আপন আদর্শে বিশ্বাসী জনাব মশিহুর রহমান নিজস্ব নীতি থেকে কখনো বিচ্যুত হননি।
ভীষণ যন্ত্রনা দিয়ে পাকহানাদার বাহিনী তিল তিল করে তাঁকে সংহার করেছে। বিশ্বস্ত সুত্রে জেনেছি এই ঘৃণিত পশুর দল প্রথমে তাঁকে নীতিচ্যুত করার জন্য নানা ধরণের অত্যাচার চালায়। শরীরের নানা স্থানে আগুনে পোড়ানো, দেহকে বেত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে তাতে লবণ মাখানো থেকে আরম্ভ করে ইলেকট্রিক শক পর্যন্ত লাগানো হয়েছে। অত্যাচার যখন তার বলিষ্ঠ দেহটা ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল তখনও তার মনের বলিষ্ঠতা একটুও কমেনি। সব সময় তিনি একই কথা বলেছেন, আমি আমার জনগণের বিরদ্ধে কিছু বলতে বা লিখতে পারবো না।
সত্যিই তিনি তা পারেননি। হানাদার বাহিনী যখন তার বাম হাত কেটে ফেলে ডান হাতে লেখার জন্য হুকুম চালায় তখন যন্ত্রনায় শুধু কেঁপেছেন তিনি। কিন্তু তার বলিষ্ঠ ঠোট দুটো একটুও কাঁপেনি। প্রতি দিনে একে একে হানাদার পশুরা তাঁর দুই পা, দুই হাত কেটে বিকলাঙ্গ দেহের ‘পরে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে তখনও একটু কেঁপে ওঠেনি তাঁর দৃঢ়ভাবে বন্ধ ঠোঁট দুটো।
বেগম রহমান জানেন তাঁর স্বামীর সেই নৃশংস মৃত্যুর কথা। তিনি সহ্য করতে পারেন না নিষ্ঠুর সেই ঘটনার কোন বর্ণনা। তবুও মাঝে মাঝে তাঁর অবুঝ মন জানতে চায় কিভাবে স্বাধীন বাংলার মাটি গ্রহণ করবে তাঁর স্বামীর মত মহান প্রেমিকের বিদেহী আত্মাকে।