৭.২১৭.৫৯৯ ৬০৩
শিরোনামঃ ২১৭। আত্মসমর্পণের আগে দখলদার বাহিনীর বেসামরিক সরকারের পদত্যাগ ও সে সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক কর্মকর্তা জন কেলীর একটি প্রতিবেদন।
সূত্রঃ এডভোকেট আমিনুল হক
তারিখঃ ৮ মার্চ, ১৯৭২
.
১৯৭১সালের ঢাকায় তিনদিন
জন আর কেলি
.
এটি ১৪,১৫,১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ ঢাকায় ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার ব্যক্তিগত হিসাব। এটি সহজভাবে লেখা বাংলাদেশ জন্মের পার্শ্ববর্তী কিছু ঘটনার নিজস্ব চিন্তন এবং এর সাথে আমি যে সংগঠনের সদস্য তা কোনোভাবেই জড়িত নয়। আমি এই ঘটনার তখন সম্পৃক্ত হই আগষ্টে যখন আমি জাতিসংঘের মহাসচিব এর দ্বারা শরনার্থীদের জন্য বরাদ্ধ হই, শরনার্থীদের যেকোনো সমস্যা মোকাবিলার জন্য এখানে বরাদ্ধ হয় প্রিন্স সাদরুদ্দিন আগা খান। যেহেতু এটি কঠোরভাবে একটি অরাজনৈতিক, মানবিক কাজ এবং এটি একটি অ-হিসাব, আমি এই দৃষ্টিভঙ্গির উপর কোনো মন্তব্য আরোপ করিনি এবং বলবোও না। তবুও আমি একজন আইরিশ এবং আমি বাঙালিদের জন্য অনেক সহানুভূতি অনুভব করেছি, আমি তাদের শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ভবিষ্যত কামনা করেছি।
ডিসেম্বরের শুরুর দিকে যুদ্ধ যখন তুঙ্গে বোঝা যাচ্ছিল যে শরণার্থী সমস্যার একটা সমাধান হবার পথে । পাওলো তখন ইউএন এর রিলিফ ফান্ডের সেক্রেটারী জেনারেল ছিলেন । তিনি এই যুদ্ধের শুরুর দিকে একটা সংক্ষিপ্ত সফরে এসে ঢাকা আটকা পড়েন । এই ফ্রেনচ মানুষটা আমাদের অনুপ্রেরণ হয়ে থাকবেন । যাহোক স্বভাবতই তিনি পুরো ইউএন দলের তত্বাবধায়ক রূপেই আবির্ভূত হন এবং আমাকে বিভিন্ন সামরিক ও সরকারী লিঁয়াজো করতে বলেন । আমি জোর দিয়েই বলব এগুলো সবই জনকল্যানমূলক ছিল । যাহোক এই ল্যাখাটি মুক্তিযুদ্ধের শেষ তিন দিনের কথা ।
মঙ্গলবার,১৪ ডিসেম্বর
১৪ ডিসেম্বর সকালে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর ডা. এ. এম. মালেক হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে আমাকে ফোন করেছিলেন, সেখানে আমি ছিলাম এবং জাতিসংঘের মি. পিটার উইলার কে বাইরে যাবার জন্য বলছিলাম এবং গর্ভনর হাউসে তার অবস্থা দেখার জন্য। ডা. মালেকের সাথে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে, ঢাকাতে ইউএনএইচসিয়ার এর প্রতিনিধি হিসাবে এবং যুদ্ধকালিন সময়ে যখন আমি সামরিক ও সরকারি যোগাযোগ করছিলাম।
এই সময়ের মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যই সুস্পষ্ট ছিল। সামনে ক্ষয় ছিলো এবং ঢাকাকে ১৯৪৫ সালের সামনের দিকের বার্লিনের মত লাগছিলো। যখন আমি এবং মিঃ পিটার হুইলার ডা. মালেকের সাথে গভর্ণর হাউজে দেখা করতে গেলাম তখন তিনি মন্ত্রীসভার বৈঠকে ছিলেন তবু তিনি বেরিয়ে আসেন এবং তার নেতৃত্বে আমাদের তার এডিসি’র অফিসে নিয়ে যান সে তার নিজের অবস্থার জন্য আমাদের নিজস্ব পরামর্শ জানতে চান।
আমি তাকে বলেছিলাম ‘আমি মনে করছি সে এবং তার মন্ত্রীসভা আসন্ন বিপদে মারা পড়তেন এবং যদি না সে ওই রাতে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে নিরপেক্ষ আশ্রয় না নিতো তবে সেই রাতে সে বাঁচতে পারে না। যাইহোক নিরপেক্ষ জোনে আশ্রয় নিতে হলে তাদেরকে তাদের অফিসের সমস্ত কার্যক্রম থেকে অবসর নিতে হতো। সে বলেন তার মন্ত্রীসভা যখন এটা বিবেচনা করার সময়ে ছিলো অথবা পদত্যাগ না করতে কিন্তু তারা এটা করতে অনিচ্ছুক ছিল।সে নিজে অনুভব করছিলো তার পদত্যাগ করা উচিত নয়, তার ওই সময় পদত্যাগ ইতিহাসের চোখে ছলনার ন্যায় দেখাবে। এরপর সে বললো যদি সে তার স্ত্রী-সন্তানদের নিরপেক্ষ জোনে পাঠাতে পারতো। আমি তখন উত্তর দিয়েছিলাম, যদিও সে নিরপেক্ষ জোন হোটেল কন্টিনেন্টালে তা স্ত্রী ও সন্তানদের ভর্তি করতে পারবে তাতে তার উদ্দেশ্য অর্জন হবে না। হোটেলটি পুরোপুরি সাংবাদিকে পরিপূর্ণ এবং তারা বলবে ডা. মালেক তার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে তাই তার পরিবারকে নিরাপদ অঞ্চলে পাঠিয়ে দিয়েছে এবং তারা প্রশ্ন করবে সে নিজে কখন এখানে আসবে ।
ঠিক সেই সময় গভর্মেন্ট হাউস বিভিন্ন ভারী বিস্ফোরনে কেঁপে উঠলো। এটা স্পষ্ট ছিলো ভবনটি সরাসরি ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমনের অধীনে চলে এসেছিলো এবং পিটার হুইলার এবং আমি রেলিং এর উপর দিয়ে দ্রুতভাবে চলে এসেছিলাম এবং আমি ৫ গজ দূরে একটি জীপে আশ্রয় নিয়ে ছিলাম। সেখানে ৬ টি ভারতীয় প্লেন ছিলো যা ভবন দুটিতে যা পরপর রকেট ও কামানের আঘাত হানছিলো।আক্রমণের প্রথম সময় মোজাফফর হোসেন তারপর মুখ্য সচিবকে খুব ফ্যাঁকাশে দেখাচ্ছিল এবং আমরা অভিবাদন বিনিময় করছিলাম। গভর্ণর হাউসে যেমন আক্রমন চলছিলো, তখন আমি ২০ গজ দূরে একটি পরিখায় দৌড়ে গেলাম যা আগে থেকেই সৈন্যে পরিপূর্ণ ছিলো এবং তাদের উপর ঢাকা দিলাম। এইসব সময়ের মধ্যে আমি জাতিসংঘের পল মার্ক হেনরির সাথে আমার হাত রেডিও ( ওয়াকি টকি) উপর ধারাভাষ্য চালু রেখেছিলাম। জেনারেল ফরমান আলি আগেই আশ্রয়ের জন্য আগেই চলে গিয়েছেন, এবং আমাকে বললেন তিনি পরোলোকগমন করেছেন। “কেন ভারতীয়রা আমাদের সাথে এমন করছে”? এমতাবস্থায় ভারতীয় বিমান ২০ গজ দূরে সেই ভবনে রকেট ও কামানের আক্রমণ অব্যাহত রেখেছিলো। আক্রমনের শব্দ কানে তুলা লাগাচ্ছিলো কিন্তু এক পর্্যায়ে তা থামলো এবং আমি গাড়িতে গেলাম , পিটার হুইলারকে তুলে নিলাম। এবং জাতিসংঘ এর কার্যালয়ে ফিরে গেলাম।
জাতিসংঘের কার্যালয়ে পৌছে আমি পল মার্ক হেনরিকে সব বললাম এবং সেখানে “অবজার্ভার এর জনাম গেভিং ইয়ং এর সাথে দেখা করলাম। জনাব গেভিং ইয়ং আস্থার সাথে আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, যে এটা এক ঘন্টা হবে এরপ ভারতীয় বিমানকে ফিরে যেতে হবে জ্বালানি ভরে নেয়া এবং পুনরায় লোড করার জন্য, যা পরবর্তীতে ভুল পরিণিত হয়েছিলো। সে আমাদের পরামর্শ করেছিলো গভর্ণর হাউসে ফিরে গিয়ে দেখতে সেখানে কি হয়েছিলো। আমি গেভিন ইয়ং এর সাথে এক মত হয়ে তাকে আমার গাড়িতে নিয়ে পুনরায় গভর্নর হাউসে গেলাম এবং সেখানে আমরা রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের সাক্ষাৎ পেলাম এবং তিনি আমাদের জানালেন যে ডাঃ মালেক এবং তার মন্ত্রীসভা গভর্নর হাউসের বাম দিকে রাখা একটি বাংকারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি আমাদের সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এবং আমরা ডাঃ মালেক এবং তার মন্ত্রীসভাকে খুব বিস্ফোরিত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো কিন্তু তখনো তারা দ্বিধান্বিত ছিলেন তারা পদত্যাগ করবে কি না ।
আমি তাকে বললাম, আমি ভেবেছিলাম তারা শুধু অনিয়মিতদের দ্বারা খুন এর বিপদের মধ্যে ছিলো না, কিন্তু ভারতীয় বিমান বাহিনী তাদের সরাসরি আক্রমন করছিলো।
সেই সময় ভারতীয় বিমান বাহিনী গভর্ণর হাউসের উপর দ্বিতীয়বার বিধ্বংসী হামলা চালালো। গ্যাভিন ইয়াং তাদের ফিরে আসার সময়ের অনুমানের ব্যাপারে দূর্ভাগ্যজনকভাবে ভুল ছিল। বাংকারটি খুব নিরাপদ বাংকার ছিলো না এবং এটি মাটির উপরে ছিলো এবং আমরা জানিনা ভারতীয় বিমান বাহিনী এটি সম্পর্কে জানে কি জানে না। অবশ্যই একটি সরাসরি আঘাত অপনেদিত যেতো। বিমানটি বোমাবর্ষণ অব্যাহত রাখলো। এটি মন্ত্রীদের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার কাছে পদত্যাগ পত্র লেখালো যা ডাঃ মালেক এবং উপস্থিত সকল মন্ত্রীদের সাক্ষর করা ছিল।
ডাঃ মালেক তারপর বাংকারে চলে গেলেন যেখানে তার স্ত্রী ও কণ্যারা অপেক্ষা করছিলো, তিনি নিজেকে পরিষ্কার করে নিলেন এবং নতজানু হয়ে নিজের প্রার্থনা করেছিলেন। সাবেক গভর্ণর ও সাবেক মন্ত্রীরা তার কিছুটা পরে নিরাপদ জোন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে সরে গিয়েছিলেন।
বুধবার, ১৫ই ডিসেম্বর
১৫ ডিসেম্বর বুধবার সকালে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে ডাঃ মালেক আমার কাছে আসলেন এটা বলতে যে, গভর্ণর হিসাবে তার পদত্যাগের সময় এবং ১৪ই ডিসেম্বর গভর্ণর হাউস থেকে তার প্রস্থানের সময় সে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে একটি টেলিগ্রাম পেয়েছিলেন। যতদূর আমি জানি, এটিই প্রথম রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া অনুমোদিত একটি যুদ্ধবিরতি।
ডাঃ মালেক বলেছিলেন সে জেনারেল নিয়াজির সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার দেয়া নির্দেশনা “ আপনার এখন যুদ্ধবন্ধের প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নিতে হবে” এর বিষয়ে এবং তিনি আমার কাছে সহায়তা চাইলেন। জীব এর আরো ক্ষয় এর বাঁচানোর জন্য এবং ব্যক্তিগত ক্ষমতার জন্য আমি রাজি হলাম। আমি তারপর নিরাপদ জোনের কর্ণেল গাফফার, পাকিস্তান সেনা লিয়াজোঁ অফিসার (বেসামরিক পোষাকের) এর সাথে যোগাযোগ করলাম, এবং তারপর আমরা তিনজন আমার রুমে গিয়েছিলাম যেখান থেকে আমরা জেনারেল নিঁয়াজিকে টেলিফোন করেছিলাম।
ডাঃ মালেক জেনারেল নিঁয়াজিকে প্রশ্ন করেছিলেন রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা অউসারে তিনি কি ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং জেনারেল নিঁয়াজি উত্তর করেছিলেন তিনি এটি ডাঃ মালেক এর সাথে আলোচনা করতে চান এনং তাকে হোটেল ছেড়ে ক্যান্টমেন্টে যেতে আমন্ত্রণ জানালেন এই বিষয়টি আলোচনা করতে।
আমি ডাঃ মালেককে পরামর্শ করলাম যদি সে নিরাপদ জোন ত্যাগ করে তবে বেশিক্ষণ তার সুরক্ষা থাকবে না এবং আগেরদিন তার পদত্যাগের সময় যা হয়েছিলো এরকম পরিস্থিতি হতে পারে, এবং তা করলে তার জন্য বিপদজনক। আমি তাকে পরামর্শ দিলাম তিনি নিজে না গিয়ে জেনারেল নিয়াজিকে হোটেলে আমন্ত্রন জানাতে।কিন্তু তিনি বললেন তিনি জেনারেল ফারমানকে পাঠাবেন এই মিটিং এ তার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য।
জেনারেল ফারমান যথাযত হোটেলের কাছাকাছি এসেছিলেন। একজন বিদেশী এবং আমি একান্ত ভাবে কাজ করছিলাম, এবং কোনোভাবেই মধ্যস্ততায় থাকা যাচ্ছিলো না, আমি তাদের আভ্যন্তরীন প্রকৃতির আলোচনা থেকে উঠে এলাম এবং ডাঃ মালেক, কর্ণেল গাফফার এবং জেনারেল ফারমান একসাথে রইলেন। পরবর্তীকালে তারা আমাকে আবার ডাকলো এবং তাদের বানানো নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলো দেখালো যা জেনারেল ফারমান অনুমোদনের জন্য জেনারেল নিঁয়াজির কাছে নিয়ে যাবে এবং রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার নিকট প্রেরণ করবে।
“আরও অধিক মানুষের জীবন হারানো এবং ধ্বংসের সমাপ্তি আনার জন্য আমরা সম্মানজনক শর্তে ইচ্ছুক”
a.অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্হানে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করা।
b.জাতি সংঘের আয়োজনে শান্তিপূর্ণভাবে পূর্ব পাকিস্হানের প্রশাসন ব্যবস্হা হস্তান্তর।
c.জাতিসংঘের নিশ্চিত করা উচিত:
১)পশ্চিম পাকিস্হান প্রত্যাগমনে অপেক্ষমান সামরিক এবং আধাসামরিক উভয় পাকিস্হানি বাহিনীর নিরাপত্তা।
২) পশ্চিম পাকিস্হান প্রত্যাগমনে অপেক্ষমান সকল বেসামরিক লোক,কর্মচারী এবং আমলাদের নিরাপত্তা।
৩)১৯৪৭ পূর্ববর্তী স্হায়ীভাবে বসবাসরত সকল বহিরাগত/ অস্হানীয়দের নিরাপত।
৪) মার্চ ১৯৭১ হতে যারা পাকিস্হানের জন্য সরকারকে সাহায্য এবং নিবেদিত হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার প্রতিশোধ না নেওয়ার নিশ্চয়তা।
পরে সেদিন জেনারেল ফরমান নিরাপদ অঞ্চলে যান এবং আমাদের তাদের প্রস্তাবে জেনারেল নিয়াজি এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতিক্রিয়া জানান।জেনারেল ফরমান রাত ৯ টার দিকে ফিরে এসেছিলেন এবং আমাদের জানান যে, যদিও জেনারেল নিয়াজি সেই প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করেছিনেন কিন্ত ইসলামাবাদ আইটেম (b) এর পুর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এভাবেই যুদ্ধ থামাবার আরেকটি চেষ্টার সমাপ্তি ঘটেছিলো।
বৃহস্পতিবার, ১৬ই ডিসেম্বর
১৬ই ডিসেম্বর ভোরে আমরা চরমপত্র সম্পর্কে জেনেছিলাম কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্হানী সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্হানে ঐদিন ঢাকার সময় ০৯.৩০ এর আত্নসমর্পন করার সময় বেঁধে দেয়।কর্ণেল গাফ্ফার, ডাঃ মালেক,রেড ক্রস সোসাইটি সংঘের মিঃ সেভেন লামপেল এবং আমি হোটেল থেকে মরিয়া হয়ে টেলিফোনে পাকিস্তান আর্মি হেডকোর্য়ারটারে যোগাযোগের চেষ্টা করি কিন্তু আমরা যোগাযোগে অসমর্থ হয়েছিলাম।২য় বিশ্বযুদ্ধে উত্তর আফ্রিকা এবং ইউরোপে ব্রিটিশ আর্মির একজন ইনফেনট্রি অফিসার হিসেবে অংশগ্রহনের সুবাদে আমিই শুধুমাত্র সচেতন ছিলাম প্রান হারানো এবং ধ্বংসের, যেটা ঢাকার উপর একটা সর্বাত্নক আক্রমনের ফলস্বরুপ হতে পারে।কর্ণেল গাফ্ফার আমাদের বলেন যে তিনি জানতেন পাকিস্হান আর্মির যোগাযোগ কেন্দ্রস্হল আগের দিন ভারতীয় বিমান হামলায় ধ্বংস হয়েছে,এবং প্রথমত তিনি নিশ্চিত ছিলেন না জেনারেল নিয়াজী আলটিমেটাম গ্রহন /স্বীকার করেছেন কিনা এবং দ্বিতীয়ত পাকিস্হান আর্মি বেঁধে দেয়া সময় গ্রহন করেছে বা করেনি সেটা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অবহিত করতে সক্ষম হয়েছে কিনা।
ইতিমধ্যে ঢাকার ওপর ভারতীয় বাহিনী চক্কর দিয়ে যাচ্ছিলো, সম্ভবত আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো এবং আমরা জানতাম ভারতীয় সেনাবাহিনী শফরতলিতে শক্তি জমায়েত করছিলো , সম্ভবত আরো অপ্রতিরোধ্য পদাতিক কামান হামলা আরম্ভ করতে চেয়েছিল। আমার অবশ্যই যোগ করা উচিত যে পরবর্তীকালে ভারতীয় অফিসারেরা বলেছিলো যে যখন তারা ঢাকায় প্রবেশ করেছিল তখন তারা ব্যবসা বুঝিয়েছিল, যদি চরমপত্র স্বীকার করা না হয় তবে তারা অবশ্যই ঢাকা প্রধ্বংসী হামলা চালাত। এটি নিদারুনভাবে জরুরি ছিল এই শহরকে বাঁচানো এবং সকাল ৮ টা ৩০ এর সময় আমি, কর্ণেল গাফফার আর জনাব লেমপেল নিরাপদ অঞ্চল ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেই এবং ক্যান্টনমেন্টের দিকে গাড়ি চালাই জেনারেল নিয়াজির থেকে এটা জানার জন্য যে কি হচ্ছিলো এবং তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন কিনা।
ক্যানটনমেন্ট যাওয়ার সময় আমি জাতিসংঘ কার্যালয়ে জনাব পল মার্ক হেনরিকে অবগত করেছিলাম যে আমরা কি করতে যাচ্ছি।
কিছু বিলম্বের পর আমরা কমান্ড বাংকারের সামনে গিয়েছিলাম কিন্তু জেনারেল নিয়াজিকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। যাই হোক আমরা বাংকারে জেনারেল ফারমানকে খুঁজে পেয়েছিলাম মূল উদ্দেশ্য নিয়ে কালো মুখ করা এবং পুরোপুরি হতাশাগ্রস্থ। দেখা হওয়ার পর তিনি সব কিছু শেষ হওয়ার ইপপ্রেশন দিয়েছিলেন।সে আমাকে জানালেন তিনি সম্পূর্ণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে কথা বলার জন্য অনুমোদিত হয়েছে এবং তারা চরমপত্র গ্রহণ করতে রাজি হয়েছেন।সে আমাকে আরো নিশ্চিত করলো যে তাদের কমিউনিকেশন সেন্টার ধ্বংস হওয়ার ফলে চরমপত্র গ্রহণ করার ব্যাপারে তারা ভারতীয় আর্মিকে জানাতে পারছিলেন না। আমি একটি বিশুদ্ধ যোগাযোগের চ্যানেল কিনা জেনারেল ফারমানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে আমাকে দিয়ে জাতিসংঘের রেডিও নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভারতীয় আর্মির চরমপত্র গ্রহন বহন করাতে পারেন। সে হ্যাঁবোধক ভাবে জবাব দিলেন, তাই আমি তাকে বাংকারের বাইরে নিয়ে আসলাম আমার ওয়াকিটকিটি চালু করতে এবং জাতিসংঘের কার্যালয়ে জনাব পল মার্ক হেনরির সাথে যোগাযোগ করতে। এরপর আমি জেনারেল ফাওমানের উপস্থিতিতে জনাব পল মার্ক হেনরিকে ম্যাসেজ দিলাম এবং জেনারেল ফরমান আরও দুটি দফা/পয়েন্টস যোগ করেন: প্রথম,পাকিস্হান আর্মির যোগাযোগ ব্যবস্হা ভেঙ্গে পড়ার কারণে সাময়িক যুদ্ধবিরতি আরও ৬ ঘন্টা বৃদ্ধি করার জন্য ইন্ডিয়ান আর্মিকে অনুরোধ করা,দ্বিতীয়, ইন্ডিয়ান আর্মিকে আমন্ত্রন জানানো যদি সম্ভব হয় হেলিকপ্টারে ঢাকা বিমান বন্দরে একদল স্টাফ অফিসার পাঠাতে যেখানে তারা নিরাপদ সেনাপতিত্ব এবং যথাযথ সৌজন্যতায় যাতে অধিকতর প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করতে পারে। আমি যথাযথভাবে সম্পূর্ন বার্তাটি আমার রেডিও দ্বারা পল মার্ক হেনরিকে পাঠাই যিনি পালাক্রমে তাৎক্ষনিক সেটি নিউ দিল্লীতে উপরের মহলে প্রেরন করেন।সময়টা ছিল সকাল ০৯:২০ ।
কর্ণেল গাফফার, জনাব লেমপেল এবং আমি এরপর বাংকার অঞ্চল ত্যাগ করলাম, তখনো ভারতীয় বিমান বাহিনী মাথার উপর চক্কর দিচ্ছিলো। যাইহোক, বার্তাটি ভারতীয় কমান্ডো সময়মত পৌঁছেছিল, এবং ঢাকার উপর আক্রমণের হুমকি প্রতিফলিত হয় নি।
ঢাকা: ৮ মার্চ ১৯৭২.